মুষ্টিযুদ্ধ

মুষ্টিযুদ্ধ

সালটা সম্ভবত ১৮৭৮। ইংল্যান্ডে লুটন শহরের কাছে ইংরেজ সেনাদলের একটা পল্টনের শিবির। কিন্তু সম্ভাব্য ইউরোপীয় যুদ্ধের ব্যাপারে পল্টনের সৈন্যদের বিশেষ কোনও ভাবনা চিন্তা নেই। ভাবনা তাদের একটাই সার্জেন্ট বার্টনকে কীভাবে মুষ্টিযুদ্ধে হারানো যায়। হাড়ে মাসে দু-শো পাউন্ড ওজনের শক্তপোক্ত চোহারা বার্টনের। দু-হাতেই ঘুষির এত জোর যে দলের আর কেউ তার সঙ্গে বক্সিং লড়তে গেলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কুপোকাত হয়। সবাইয়ের অভিমতবার্টনকে বক্সিং-এ একবার অন্তত হারাতে না পারলে ওর ঔদ্ধত্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। অতএব দলের সিনিয়র অফিসার ফ্রেড মিলবার্নের ওপর ভার পড়ল লন্ডনে গিয়ে একজন ভালো বক্সারকে জোগাড় করে তার সঙ্গে বার্টনের একটা প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা।

ইংল্যান্ডে বক্সিং-এর ইতিহাসে সেই সময়টা একটা সন্ধিক্ষণ। আগেকার দিনের খালি হাতে লড়ার ট্র্যাডিশন শেষ হয়ে এসেছে। অন্যদিকে দস্তানা পরে, স্টেডিয়ামের রিং-এর মধ্যে নিয়মকানুন মেনে বক্সিং-এর যে আধুনিক প্রথা, তা তখনও শুরু হয়নি। ফলে যে সময়ের কথা আমরা বলছি, সেই সময়ে বক্সিং সমাজের সবথেকে নিম্নস্তরের লোকদের খেলায় পরিণত হয়েছে। যত্র তত্র, অর্থাৎ খামারবাড়িতে, আস্তাবলে, যে-কোনও নির্জন জায়গায় বক্সিং লড়া হত। কোনও নিয়মকানুনের কেউ ধার ধারত না। খেলাটা চলে গেছল কিন্তু গুন্ডাপ্রকৃতির লোকের হাতে, যাদের একমাত্র লক্ষ ছিল বাজি রেখে খেলা ও কিছু টাকা কামিয়ে নেওয়া। মুষ্টিযুদ্ধে কুশলতা না থাকলেও কিছু লোক চোখ রাঙিয়ে, চেঁচামেচি করে নিজেদের দক্ষ বক্সার বলে চালিয়ে দিত।

এইরকম পরিস্থিতিতে বক্সিং-এর আখড়া ও খেলাধূলার ক্লাবে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করেও মিলবার্ন তেমন কোনও ভালো বক্সারের খোঁজ পেলেন না। হেভিওয়েট দু-একজনকে পাওয়া গেলেও তাদের চাহিদা অত্যন্ত বেশি। শেষে অ্যালফ স্টিভেন্স নামের একজন মিওয়েট বক্সারের খোঁজ পেলেন মিলবার্ন।

অ্যালফকে সবাই এক ডাকে চ্যাম্পিয়ন বলে চেনে। ও নাকি এখনও পর্যন্ত কোনও লড়াইতেই হারেনি। সার্জেন্ট বার্টনের থেকে ওজনে কম হলেও অ্যালফ সেটা পুষিয়ে নিতে পারবে তার অভিজ্ঞতা ও শরীরিক কুশলতা দিয়ে। এইসব ভেবে মিলবার্ন অ্যালফের সঙ্গেই কথা পাকা করে নিলেন এবং একটা ঘোড়ার গাড়িতে করে দুজনে লুটন রওনা হলেন। প্ল্যানটা হল, রাতটা একটা সরাইখানায় কাটিয়ে পরের দিন শিবিরে পৌঁছে যাওয়া।

ট্রাফালগার স্কোয়ার হয়ে অক্সফোর্ড স্ট্রিট পেরিয়ে যাওয়ার পর আস্তে-আস্তে লন্ডনের জনবহুল অঞ্চল শেষ হয়ে গেল। রাস্তা একটু ফাঁকা, হতেই মিলবার্ন গাড়িটা একটু জোরে চালাতে লাগলেন। তার পাশে বসে অ্যালফ। আর সহিস বেটস গাড়ির পেছন দিকে। অ্যালফকে এই প্রথম খুঁটিয়ে দেখে খুশি হলেন মিলবার্ন। শরীরে একটুও মেদ নেই। মুখ চোখ দেখে বোঝা যায়, অসম্ভব সাহসী এবং প্রকৃত লড়িয়ে। মনে হয় এতদিনে ওই গোঁয়ার সার্জেন্ট বার্টনকে শায়েস্তা করা যাবে।

–তুমি কি নিয়মিত ট্রেনিং করো? মিলবার্ন জিগ্যেস করলেন।

–হাঁ স্যর। সবসময় ফিট থাকার চেষ্টা করি। এই তো গত সপ্তাহেই একটা বড় লড়াইতে জিতেছি।

–বেশ! এবার কিন্তু তোমাকে যার সঙ্গে লড়তে হবে, তার ওজন ও উচ্চতা তোমার থেকে অনেক বেশি।

অ্যালফ একটু হেসে বলল,–অনেক হেভিওয়েটকেই হারিয়েছি আমি। এটুকু বলতে পারি আমার চেষ্টার কোনও ত্রুটি থাকবে না।

হঠাৎ মিলবার্ন বললেন,জানো, এই অঞ্চলেই এই রাস্তায় একটা গুন্ডাপ্রকৃতির বক্সার থাকে বলে শুনেছি। কেউ-কেউ লোকটাকে দেখেছে, আবার কেউ-কেউ বলে লোকটা নাকি কাল্পনিক। লোকটার একটা সাথীও আছে। পূর্ণিমার রাতে নাকি ওরা দুজনে এই রাস্তায় চলে আসে আর কোনও পথচারীকে পেলে তার সঙ্গে লড়াই করার জন্যে চ্যালেঞ্জ জানায়। একজন ঘুষি মারতে থাকে, অন্যজন মাটিতে পড়ে যাওয়া প্রতিপক্ষকে আবার দাঁড় করায়। এমন অনেক পথিককে এই রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে, যাঁদের মুখ রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত। ভাবছিলাম আজ হঠাৎ যদি আমাদের সঙ্গে ওদের দেখা হয়ে যায়!

–স্যর, তাহলে কিন্তু খুব ভালো হয়। আমার খুব ইচ্ছে করে পুরোনো দিনের স্টাইলে খালি হাতে লড়াই করতে। অ্যালফ বলল।

–তোমার একটুও ভয় লাগবে না?

–ভয়! কী বলছেন! দশ মাইল দূরে গিয়েও ওদের সঙ্গে লড়তে রাজি আছি। খালি একটা জিনিস বুঝতে পারছি

–ওরা যদি এতই ভালো বক্সার তাহলে ওদের নাম শোনা যায় না কেন?

–কী জানি! হয়তো ওরা এদিকেই কোথাও ঘোড়া টোড়ার দেখাশোনা করে-বাইরে যায় না। তাই বিশেষ কেউ ওদের চেনে না। তবে ব্যাপারটা একটু রহস্যময়ই। আরে! আরে! এ কী!

হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠলেন মিলবার্ন। এই জায়গায় রাস্তাটা বেশ ঢালু হয়ে গেছে আর দুধারে বড় গাছের সারি এমনভাবে আছে যে, মনে হয় গাড়িটা যেন একটা টানেলে ঢুকছে। রাস্তার ঢালু অংশটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেইখানে পাথরের পুরোনো ভগ্নপ্রায় ও শ্যাওলাধরা দুটো স্তম্ভ। স্তম্ভের পরেই একটা জংধরা লোহার গেট এবং তার পরেই একটা পুরোনো পরিত্যক্ত প্রাসাদ। এই গেটের কাছেই প্রায় ছায়ার মধ্যে থেকে একটা লোক হঠাৎ বেরিয়ে রাস্তার মাঝখানে এসে মিলবার্নের গাড়ির ঘোড়া দুটোকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ধরে ফেলল। অতএব গাড়িটা গেল থেমে।

লোকটা আর একজনের উদ্দেশ্যে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে বলে উঠল,–জো, তুমি এসে ঘোড়াদুটো সামলাও। আমি আরোহী দুজনের সঙ্গে কথা বলব।

ছায়ার আড়াল থেকে আর একটা লোক বেরিয়ে এসে বিনাবাক্যব্যয়ে ঘোড়াদুটোকে ধরে ফেলল। লোকটা একটু খর্বাকৃতি, শরীরটা একটু গাট্টাগোট্টা টাইপের, মুখমণ্ডল লাল, নীচের ঠোঁটটা বাঁকামতো। লোকটার পোশাকের মধ্যে নজরে পড়ার মতো জিনিস হল, পুরোনো আমলের বাদামি রঙের ঝালর দেওয়া একটা ওভারকোট, গলায় কালোরঙের একটা স্কার্ফ। মাথায় টুপি নেই। ও ঘোড়ার লাগাম ধরতেই অন্য লোকটা গাড়ির ওপর চওড়া কবজিওয়ালা হাত রেখে মিলবার্ন আর অ্যালফের দিকে তাকাল। চাঁদের আলোয় দেখা গেল, নীল দুটো চোখ, দৃষ্টিতে ক্রুরতা। মুখটা ভয়ংকর নিষ্ঠুর, পোড় খাওয়া। লোকটা ওর সঙ্গীকে বলে উঠল, এই দুজনের মধ্যে ছোকরাটাকেই বাছা যাক-লড়াই ভালো জমবে।

মিলবার্ন রেগে বলে উঠলেন,–কে হে তুমি? তোমার আস্পর্ধা তো কম নয়! চাবুক মেরে তোমায় সিধে করে দেব।

–একদম চুপ! আমার সঙ্গে এইভাবে কথা বললে ভালো হবে না বলছি। এখন তোমাদের দুজনের মধ্যে যে কেউ লক্ষ্মীছেলের মতো হাত তুলে নেমে এসো! লোকটা বলল।

অ্যালফ সঙ্গে-সঙ্গে গাড়ি থেকে লাফ মেরে রাস্তায় নেমে এসে বলল, তুমি যদি লড়তেই চাও, আমার সঙ্গে লড়ো। বক্সিং-ই আমার পেশা।

–জো! তোমায় বলছিলাম না এতদিনে একটা ভালো প্রতিদ্বন্দ্বী পাওয়া গেছে। তুমি আমায় একবার হারিয়েছিলে বহুকাল আগে। সেটা বাদ দিলে আমাকে সবাই অপরাজেয় বলেই জানে। ওহে ছোকরা, আমাকে দেখে তোমার কী মনে হয়?

অ্যালফ উত্তর দিল,–তুমি একটা উদ্ধত, দুর্বিনীত লোক। তোমার মুখেই খালি বড়-বড় কথা। সলিড কিছু নেই, শুধু গ্যাসে ভরা।

অ্যালফের কথা শুনে লোকটা নিজের উরুতে চাপড় মেরে ঘোড়ার মতো আওয়াজ করে হাসতে লাগল,–বেশ বলেছ কিন্তু। আমার সম্বন্ধে গ্যাস কথাটাই ঠিক। যাহোক, এবার এসো। চাঁদের আলো থাকতে-থাকতে আমাদের লড়াইটা সেরে ফেলা যাক।

মিলবার্ন এতক্ষণ লোকটাকে কিছুটা কৌতূহল কিছুটা বিস্ময়ে লক্ষ করছিলেন। লোকটার পোশাকটা আস্তাবলে যারা কাজ করে অনেকটা তাদের মতো। টুপি, কোট, হাঁটু অবধি চাপা প্যান্ট, মোজা–এগুলি সবই নানা রঙের এবং যেন আদ্যিকালের। তবে, লোকটার পেটানো ইস্পাতের মতো শরীর দেখে মনে হয়, ও অসম্ভব শক্তিশালী। লন্ডনের বক্সার অ্যালফের হাতে বেদম মার খেয়ে লোকটা হেরে গেলে গল্পটা বেশ জমিয়ে শিবিরের লোকজনের কাছে করা যাবে, এই ভেবে মিলবার্ন মনে-মনে বেশ খুশি হলেন।

এদিকে এসো” এই বলে লোকটা অ্যালফকে নিয়ে সেই লোহার গেটের দিকে এগোতে লাগল। জায়গাটায় গা ছমছমে অন্ধকার। অ্যালফ রাস্তার ওপরেই লড়তে চাইলে লোকটা বলল যে, রাস্তাটা পাকা লড়িয়েদের জায়গা নয়। তোমার কি আমার সঙ্গে যেতে ভয় লাগছে? ব্যঙ্গের সুরে প্রশ্ন নোকটার।

–তোমার মতো দশটা লোককেও আমি ভয় পাই না। বলল অ্যালফ।

–তাহলে অত কথার দরকার কী? এসো আমার সঙ্গে।

গাড়ির সহিস ঘোড়া দুটো ধরে রইল। ঘোড়াগুলো ঘামছিল আর যেন কোনও অজানা আশঙ্কায় মাঝে-মাঝে কেঁপে উঠছিল। চারজনের এই ছোট দলটা অর্থাৎ মিলবার্ন, অ্যালফ আর ওই দুজন গেট পেরিয়ে প্রায় পঞ্চাশ গজ হেঁটে গাছপালায় ভরা একটা জায়গায় এল। গাছপালার ভেতর দিয়ে একটু এগোতেই ঘাসে ঢাকা একটা ছোট গোলাকার ভূমি, চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে। একটু দূরে একটা বহু পুরোনো পরিত্যক্ত বাড়ি। গোলাকার জায়গার একদিকটা একটু উঁচু। ঠিক যেন জমিটার পাড়।

জো নামের লোকটা বলল,–এরকম সুন্দর ন্যাচারাল বক্সিং রিং আশেপাশে কুড়ি মাইলের মধ্যেও কোথাও পাবে না। টম, এবার এই ছোকরাকে দেখিয়ে দাও তুমি কী করতে পারো।

পুরো ব্যাপারটাই যেন একটা অবিশ্বাস্য স্বপ্নের মতো। এই অদ্ভুত লোকদুটো, ওদের বিচিত্র পোশাক ও কথা বলার ধরন, চাঁদের আলোয় আলোকিত এই ঘাসে ঢাকা ভূমি, দূরে একটা পরিত্যক্ত বাড়ি–সব মিলিয়ে যেন একটা অলৌকিক পরিবেশ। যাই হোক, অ্যালফ আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী টম নামের লোকটা কাছাকাছি আসতেই অ্যালফ ভয়ে বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল,–এ কী! তোমার মাথায় কী হয়েছে?

টমের মাথায় কপাল বলে কিছু নেই–সেই জায়গায় একটা গোলাকার লাল ক্ষতচিহ্ন ঠিক মাথার চুল আর ভুরুর মাঝখানে।

–তুই এখন তোর নিজের মাথার কথা ভাব ছোকরা। টম বলল।

টম ততক্ষণে হাত তুলে দাঁড়িয়ে। ওর চওড়া বুক, ঢালু কাঁধ আর হাত দুটো দেখলেই বোঝা যায় যে চেহারাটা পাক্কা বক্সারের। চোখদুটো জ্বলজ্বল করছিল, ঠোঁটে নিষ্ঠুর হাসির আভাস। অ্যালফ বুঝতে পারছিল যে এত মারাত্মক প্রতিদ্বন্দ্বীর পাল্লায় সে আগে কখনও পড়েনি। কিন্তু অ্যালফও খুব সাহসী। নিজের ওপর আস্থা প্রচণ্ড, কেন না আজ পর্যন্ত কেউ ওকে হারাতে পারেনি। অ্যালফও উত্তরে একটু মৃদু হেসে হাত তুলে দাঁড়াল। লড়াইয়ের প্রস্তুতি শেষ।

কিন্তু তারপরে যা ঘটল, তা অ্যালফের কল্পনার বাইরে। টম বাঁ-হাতে চালাবে এরকম ভান করে, ডান হাতটা দিয়ে সজোরে এবং সপাটে মারল একটা মোক্ষম ঘুষি। সেটাকে আটকানোর কোনও সুযোগই পেল না অ্যালফ। তারপরেই টম ঝাঁপিয়ে পড়ল অ্যালফের ওপর এবং ওকে দুহাতে তুলে শূন্যে ছুঁড়ে দিল। আস্তে-আস্তে উঠে দাঁড়াল অ্যালফ। টম তখন দু-হাত জড়ো করে চুপ করে দাঁড়িয়ে।

প্রচণ্ড রেগে গিয়ে অ্যালফ বলল,–এটা তো বেআইনি খেলা হচ্ছে!

মিলবানও বললেন,–এ তো অন্যায়! সমস্ত নিয়মকানুনের বাইরে।

জো বলল,–গুলি মারো তোমার আইনের। কীরকম সুন্দর ওকে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিল বলো তো? কী নিয়মে খেলো তোমরা?

–কেন, কুইনবেরি রুলে! ওতেই তো সবাই খেলে। বলল অ্যালফ।

–আমরা খেলি লন্ডনের অন্য রুলে। টমের মন্তব্য।

–বেশ, তাই হোক। বক্সিং-এর সঙ্গে কুস্তিও লড়ব। আমাকে তা হলে তুমি আগের মত আর পাকে ফেলতে পারবে না। অ্যালফ বলল।

টম এবার এগিয়ে আসতেই অ্যালফ ওকে দুহাতে শক্ত করে চেপে ধরল। তারপর দুজনেই জাপটাজাপটি করতে করতে মাটিতে পড়ে গেল। তিনবার এইরকম হল। প্রতিবারই পড়ে যাওয়ার পর উঠে দাঁড়িয়ে টম একটু দূরে পাড়ের মতো উঁচু জায়গাটায় গিয়ে বসছিল। এইরকমই একটা বিরতির সময়ে মিলবার্ন অ্যালফকে জিগ্যেস করলেন, কী মনে হয় লোকটাকে দেখে?

–লোকটা বক্সিং-এ সত্যিই পারদর্শী। গায়ে সিংহের মতো শক্তি। শরীরটা যেন একটা তক্তা। প্রচুর চর্চা করেছে। তবে শিখেছে কোথায় বলতে পারব না। বলল অ্যালফ। কান থেকে একটু রক্তপাত ছাড়া অ্যালফের শরীরে চোখে পড়ার মতো কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই।

রাউন্ডের পর রাউন্ড চলতে লাগল দুজনের লড়াই। সন্দেহ নেই, অ্যালফ শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর পাল্লায় পড়েছে। টমের দ্রুত পায়ের কাজ, বিদ্যুৎগতিতে হাত চালানো, মুখে আলতোভাবে লেগে থাকা বদমায়েশি হাসি–এসব থেকে বোঝা যাচ্ছিল লোকটা বিপজ্জনক ধরনের। বারবার চেষ্টা করে শেষে ও অ্যালফের মুখে মারল একটা মারাত্মক আপারকাট। অ্যালফ মাটিতে পড়ে গেল। জো হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,টম, লাগাও ওইরকম আর একটা ঘুষি। তাহলেই কেল্লা ফতে।

চিন্তিত মিলবার্ন তখন অ্যালফকে বললেন,–ব্যাপারটা ক্রমশই খারাপের দিকে যাচ্ছে। তুমি এইরকম মার খেলে আমাদের ওখানে গিয়ে কেমন করে লড়বে? তার থেকে বরং এর কাছে হার স্বীকার করে নাও।

–গুলি মারুন আপনাদের সার্জেন্ট বার্টনের সঙ্গে লড়াই। এই লোকটাকে হারিয়ে ওর মুখের হাসি মুছে না নেওয়া পর্যন্ত আমি লড়ে যাব। অ্যালফ উত্তর দিল।

–কী হল? লড়াইয়ের সাধ মিটেছে? টম বিদ্রুপের সুরে অ্যালফকে জিগ্যেস করল।

উত্তরে শরীরের শেষ শক্তিটুকু নিংড়ে নিয়ে টমের দিকে খ্যাপা ষাঁড়ের মতো এগিয়ে গেল অ্যালফ। কিছুক্ষণের জন্যে সে টমকে বেকায়দায় ফেলে দিলেও অক্লান্ত টম আবার আগের মতোই হাত চালাতে লাগল। অ্যালফের শক্তি তখন প্রায় শেষ–কিন্তু টমের ক্ষমতায় তখনও কোনও ঘাটতি নেই। টমের অবিরত ঘুষির আঘাতে জর্জরিত অ্যালফ হয়তো আর এক মিনিট পরেই ভূমিশয্যা নিত। কিন্তু হঠাৎ একটা কিছু ঘটে গেল।

কাছেই গাছপালা, ঝোঁপঝাড়ের আড়াল থেকে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা গেল–যেন কোনও মানবশিশু বা জন্তুজানোয়ার ব্যথায় আর্তনাদ করছে। আওয়াজটা শুনেই টম হঠাৎ যেন অসহায় হয়ে পড়ল, ওর মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে। আর্তস্বরে টম জো-কে বলল,–ওই দেখো! ও আবার আমাকে লক্ষ করে আওয়াজ করছে।

–ওদিকে মন দিও না। কিছু হবে না তোমার। আগে এই ছোকরাকে হারাও। আশ্বাস দিল জো।

–না, না, তুমি বুঝতে পারছ না। যার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছ, সে আমাকে আঘাত করবেই। হ্যাঁ, তাকে আমি দেখতে পাচ্ছি। তার সামনে আমি দাঁড়াতে পারব না।

ভয়ে চিৎকার করতে করতে টম দৌড়ে জঙ্গলের অন্যদিকে দৌড়ে গেল। জো-ও টমের জামাকাপড়গুলো কুড়িয়ে নিয়ে টমের পিছনে-পিছনে দৌড়োল। গাছগুলোর ছায়া যেন দুজনকে গ্রাস করে নিল।

মার খেয়ে প্রায় অচেতন অ্যালফ তখন কোনওরকমে টলতে-টলতে এসে মিলবার্নের কাঁধে মাথা রাখল। মিলবার্ন ওর ঠোঁটে লাগিয়ে দিলেন ব্র্যান্ডির বোতলটা। জঙ্গলের দিক থেকে আসা সেই আওয়াজটা তখন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। তারপরে দেখা গেল, ঝোঁপের মধ্যে থেকে একটা সাদা রঙের কুকুর বেরিয়ে এসে যেন কাউকে খুঁজতে খুঁজতে দৌড়ে চলে গেল। কেউ-কেঁউ আওয়াজ করতে-করতে।

একটু পরে কুকুরটাও যেন ছায়ার মধ্যে হারিয়ে গেল। মিলবার্ন আর অ্যালফ তখন একটা অজানা আশঙ্কায় আর ভয়ে শিউয়ে উঠে কালক্ষেপ না করে সোজা গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। গাড়িতে মাইদুয়েক যাওয়ার পর মিলবার্নের মুখ থেকে আওয়াজ বেরোল,–এইরকম টাইপের কুকুর তুমি আগে কখনও দেখেছ?

–না। আর যেন দেখতেও না হয়। আর্তস্বরে বলল অ্যালফ।

রাত একটু গম্ভীর হতেই দুজনে আশ্রয় নিলেন এক সরাইখানায়। খাওয়াদাওয়ার পর একটা পানীয় নিয়ে বসে কথা হচ্ছিল সরাইখানার মালিক আর স্থানীয় এক ভদ্রলোক মিঃ হরনারের সঙ্গে। হরনার বক্সিং-এর ব্যাপারে বেশ ওয়াকিবহাল। উনি হঠাৎ বললেন,–অ্যালফ, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি কোথাও বক্সিং লড়ে এসেছ। কিন্তু কই, আজকের কাগজে তো কোনও বক্সিং প্রতিযোগিতার বিজ্ঞাপন ছিল না।

–থাকগে ওসব কথা। অ্যালফ বলল।

হঠাৎ হরনারের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল,–আচ্ছা, ব্রোকাসের সেই তথাকথিত বদমেজাজি বক্সারটার সঙ্গে কি তোমাদের পথে দেখা হয়েছিল?

অ্যালফ বলল,–যদি দেখা হয়েই থাকে তো কী?

–আমাদের এখানকার বিখ্যাত বক্সার বব মেডোসকে ওই লোকটাই একবার ব্রোকাস কোর্টে লড়াই করতে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। লোকটার একটা সঙ্গীও আছে বলে শুনেছি। পরেরদিন সকালে বব মেডোসকে গুরুতরভাবে আহত অবস্থায় ওখানে পাওয়া যায়। বললেন হরনার।

মিলবার্ন আস্তে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন যে তাঁদের সঙ্গেও ওই লোকটারই দেখা হয়েছিল।

সরাইখানার মালিক তখন ফিসফিস করে মিলবানকে জিগ্যেস করলেন,–মেডোস বলেছিল ওই লোকদুটোর পোশাক নাকি আমাদের ঠাকুরদার আমলের–সেটা কি সত্যি? আর বক্সার লোকটার কপাল বলতে নাকি কিছু নেই?

–মেডোস ঠিকই বলেছিল। আমাদের অভিজ্ঞতাও তাই। বললেন মিলবার্ন।

সরাইখানার মালিক তখন উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন,–ব্যাপারটা আপনাদের খুলেই বলি। এই অঞ্চলের বিখ্যাত বক্সার টম হিকম্যান আর তার বন্ধু জো রো ঠিক ওই ব্রোকাস কোর্টের কাছেই বহুকাল আগে, সম্ভবত ১৮২২ সালে, মত্ত অবস্থায় ঘোড়ার গাড়ি চালাতে চালাতে অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল। দুজনেই মারা গেছল। গাড়ির চাকাটা নাকি হিকম্যানের কপালের ওপর দিয়ে চলে গেছল।

–হিকম্যান! হিকম্যান! আচ্ছা, ওকেই তো লোকে গ্যাসম্যান নামে ডাকত, তাই না? জিগ্যেস করলেন মিলবার্ন।

–ঠিক তাই। ওকে অনেকে গ্যাস বলে ডাকত। বললেন সরাইখানার মালিক।

এইসব শুনে অ্যালফের মুখ তখন চকের মতো সাদা হয়ে গেছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,আর ভালো লাগছে না। চলুন, এবার রওনা হই।

সরাইখানার মালিক অ্যালফের পিঠ চাপড়ে বললেন, মন খারাপ কোরো না। তুমিই আজ পর্যন্ত একমাত্র লোক যে ওই পাজিটার হাতে পরাজিত হওনি। গ্যাসম্যানকে পিটিয়ে তুমি অনেকের প্রতি ওর অত্যাচারের প্রতিশোধ নিয়েছ। নাও, আরেকটা পানীয় নাও, তোমার এই কৃতিত্বের জন্য। তুমি জানো, সরাইখানার এই ঘরে ও একবার কী করেছিল–সেই ছাপান্ন বছর আগে?

মিলবার্ন, অ্যালফ, হরনার সকলেই ঘরের চারদিকটা দেখলেন। উঁচু সিলিং, পাথরের মেঝে, কাঠে মোড়া দেওয়াল।

সরাইখানার মালিক বললেন, হ্যাঁ, এই ঘরেই। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমাকে ঘটনাটা বলেছিলেন। সেদিন এই অঞ্চলে একটা বড় বক্সিং প্রতিযোগিতা ছিল। টম তাতে বাজি রেখে বেশ কিছু টাকা জিতেছিল। ও আর বন্ধু জো ফেরার পথে সম্পূর্ণ মত্ত অবস্থায় সরাইখানার এই ঘরেই এসেছিল। ওকে দেখে এখানকার লোকজন সবাই ভয়ে কুঁকড়ে যায়, কেউ কেউ টেবিলের নীচেও লুকিয়ে পড়ে। কেন না ওর মুখে সেই খুনির হাসি আর হাতে একটা লোহার রড। সবাই জানত টম মত্ত অবস্থায় খুন পর্যন্ত করতে পারে। ও কী করল জানো? ডিসেম্বরের ঠান্ডার থেকে বাঁচতে একটা ছোট সাদা কুকুর ফায়ার প্লেসের কাছে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়েছিল। টম রডের এক ঘায়ে কুকুরটার পিঠ ভেঙে দিল। তারপর পাগলের মতো হাসতে-হাসতে আর গালিগালাজ করতে করতে টম ওর বন্ধু জো-কে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে বসে জোরে গাড়ি চালিয়ে দিল। পরে শোনা গেছিল, ওই রাতেই দুর্ঘটনায় গাড়ির একটা চাকায় মাথা থেঁতলে টম মারা যায়। জো-ও মারা গেছল। অনেকেই নাকি এখনও ওই কুকুরটাকে দেখতে পায়–পিঠ ভাঙা, রক্তাক্ত, কেউ কেউ আওয়াজ করছে। যেন কুকুরটা তার আততায়ীকে আজও খুঁজে বেড়াচ্ছে। সুতরাং অ্যালফ, তুমি নিজে লড়ার সঙ্গে-সঙ্গে আরও কারোর জন্যেও লড়াই করেছ।

অ্যালফ বলল,–তা হতে পারে। তবে এই ধরনের লড়াই আমি করতে চাই না। এখন সার্জেন্ট বার্টনের সঙ্গে লড়াই করলেই যথেষ্ট। মিঃ মিলবার্ন, চলুন, আমরা বরং একটা ট্রেনে করেই আপনাদের ক্যাম্পে যাই।

The Bully of the Brokers Court গল্পের অনুবাদ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *