মুশকিল আসান – ১

০১.

কদমতলার মোড়ে লোকটিকে ঘিরে ভিড় জমে গিয়েছিল। বছর ষাটের পাঞ্জাবি-ধুতি পরা মানুষটি রুমালে মুখ ঢেকে কাঁদছিলেন। তাঁর শরীর কাঁপছিল। শেষপর্যন্ত মাটিতে বসে পড়লেন তিনি। বোঝাই যাচ্ছিল খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। যারা এতক্ষণ দর্শক হয়ে দাঁড়িয়েছিল তারা মানুষটিকে ধরাধরি করে নিয়ে এল চৌধুরী মেডিক্যাল স্টোর্সে।

চৌধুরী মেডিক্যালের রামদার সঙ্গে আড্ডা মারতে অর্জুনের বেশ ভালো লাগে। ফাঁক পেলেই চলে আসে সে এই দোকানে। তার সঙ্গে কথা বলতে-বলতে কী অবলীলায় রামদা কাস্টমার অ্যাটেন্ড করেন, ওষুধ দিয়ে টাকা গুনে নেন, না দেখলে বোঝা যাবে না। দোকানের ভেতর দিকে দুটো চেয়ার রাখা থাকে। একটায় অর্জুন বসে, কাস্টমার না থাকলে দ্বিতীয়টায় রামদা এসে বসেন। আজ ওদের তর্ক বেশ জমে উঠেছিল।

আজকের বিষয় ছিল, যদি জলপাইগুড়ির মানুষের আগামী একবছর কোনও অসুখ না হয় তাহলে ওষুধের দোকানদাররা দুঃখিত হবেন। তার মানে, তাঁরা চান শহরের মানুষজন খুব অসুখে ভুগুক, না হলে ব্যাবসা লাটে উঠবে। রামদা তাঁর বক্তব্য জানাতে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই ভিড়টা দোকানের সামনে চলে এল। রামদা ব্যস্ত হয়ে মানুষটিকে চেয়ারে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে?

একজন বলল, কী হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। বাস থেকে নামতে দেখলাম। তারপরেই রুমালে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে টলতে লাগলেন।

রামদা বললেন, কোনও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। আমি ওষুধ বিক্রি করি, ডাক্তার নই।

এইসময় ভদ্রলোক কোনওমতে হাত নেড়ে বললেন, ঠিক আছে। একটু জল।

 জল খেয়ে ভদ্রলোক একটু ধাতস্থ হতে ভিড় হালকা হয়ে গেল। ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত কি না এই নিয়ে লোকেরা কথা বলতেই ভদ্রলোক বললেন, আমি একটু বসে থাকলেই ঠিক হয়ে যাব। আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।

নিশ্চিত হয়ে লোকজন চলে গেল। ভদ্রলোক চোখ বন্ধ করে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর ওঠার চেষ্টা করতেই অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথায় থাকেন?

বানারহাট।

আপনার ব্লাড প্রেসার ঠিক আছে?

অনেকদিন পরীক্ষা করাইনি।

আপনি আজই ডাক্তারের কাছে যাবেন। অর্জুন বলল, বানারহাট যেতে তো বাসে ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। একলা যেতে পারবেন?

গিয়ে কী হবে? ওদের কাছে মুখ দেখাব কী করে?

কেন? কী হয়েছে?

আমার সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। ভদ্রলোকের ঠোঁট কাঁপতে লাগল।

আপনি শান্ত হন। কী হয়েছে আমাকে বলুন।

পরশু আমার মেয়ের বিয়ে। বাড়ির মেয়েরা দশদিন আগে এসে গয়নার অর্ডার দিয়ে গিয়েছিল। শাড়িটারি পছন্দ করে গিয়েছিল। সেগুলো ডেলিভারি নিতে আজ আমি শহরে এসেছিলাম। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল। পাত্রপক্ষ কিছু চায়নি শুধু বলেছিল আপনি আপনার মেয়েকে অন্তত পাঁচভরি সোনার গয়না দেবেন। আমি গরিব স্কুলমাস্টার। অনেকদিন থেকে মেয়ের বিয়ের জন্যে সঞ্চয় করা টাকা থেকে চল্লিশ হাজার নিয়ে বাসে উঠেছিলাম। শহরে ঢোকার মুখে তিস্তাব্রিজের ওপর যখন বাস এল তখনও পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে বুঝেছিলাম ওটা ঠিক আছে। একটা খামের মধ্যে চল্লিশটা একহাজার টাকার নোট। নিয়ে আসার সুবিধের জন্যে ব্যাঙ্ক থেকে হাজার টাকার নোট করিয়ে নিয়েছিলাম। বাস থেকে নামার পরেই দেখি প্যাকেটটা আমার পকেটে নেই। হাঁ করে শ্বাস নিলেন ভদ্রলোক, সব শেষ হয়ে গেল। বাড়ি ফিরে যাব শূন্য হাতে। কী করে আমি মেয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াব! আমার, আমার বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না।

রামদা গালে হাত রেখে শুনছিলেন, বললেন, কী যা তা কথা বলছেন? আপনার উচিত এখনই থানায় গিয়ে পুলিশকে জানানো। কী বলে অর্জুন?

নিশ্চয়ই। পুরোনো পকেটমার হলে পুলিশ নিশ্চয়ই হদিস করতে পারবে। অর্জুন বলল।

কিন্তু আমি তো থানার কাউকে চিনি না। আমার সমস্যাকে ওরা কি গুরুত্ব দেবে?

অর্জুন হাসল, নিশ্চয়ই দেবে। বড়বাবুকে বলবেন আমি আপনাকে ডায়েরি করতে বলেছি। আমার নাম অর্জুন।

পুলিশকে বললে ফেরত পাওয়ার আশা আছে বলছেন?

নিশ্চয়ই। চলুন, আপনাকে রিকশায় তুলে দিই। অর্জুন উঠে দাঁড়াল।

দূরে দাঁড়ানো একজন রিকশাওয়ালাকে হাত নেড়ে ডেকে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, আপনি নিশ্চয়ই বানারহাট থেকে বাসে বসেই এসেছেন?

হ্যাঁ।

আপনার পাশে যিনি বসেছিলেন তাকে মনে আছে?

তিনজন বসেছে। প্রথমজন নেমেছে ধূপগুড়িতে, দ্বিতীয়জন ময়নাগুড়িতে আর তৃতীয়জন শহরে ঢোকার পরে। ভদ্রলোক বললেন।

এই শেষ লোকটির চেহারা মনে আছে? মাথায় টাক আর গালে কঁচাপাকা দাড়ি।

রিকশাওয়ালা এসে দাঁড়ালে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, আপনার নামটা জানতে পারি।

বিটকৃষ্ণ হালদার। রিকশায় চেপে বটকৃষ্ণ থানায় চলে গেলেন।

দোকানে ফিরে এলে রামদা বললেন, সত্যি ভদ্রলোকের সর্বনাশ হয়ে গেল। এখন মেয়ের বিয়ে দেবেন কী করে? তোমার নাম শুনে পুলিশ হয়তো ডায়েরি নেবে কিন্তু পকেটমারকে ওরা খুঁজে বের করতে পারবে কি?

এ ছাড়া উপায় নেই। আইনের সাহায্য নেওয়া কর্তব্য। অর্জুন বলল।

তুমি একটু চেষ্টা করে দ্যাখো না। রামদা বলল।

আমি?

দ্যাখো একটু চেষ্টা করলে যদি ভদ্রলোকের মেয়ের বিয়েটা হয়ে যায়, সামাজিক কারণে তো তা করতে পারো। বিয়ে না হলে ভদ্রলোকের হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এখনি তো আত্মহত্যার কথা ভাবছেন! রামদা বললেন।

মাথা নাড়ল অর্জুন। তারপর একটু চিন্তা করে বলল, একটা কাজ করব রামদা?

নিশ্চয়ই।

থানায় ফোন করল অর্জুন। শুনল বড়বাবু নেই।

খারাপ লাগল। থানার দারোগা সব সময় যে থানায় বসে থাকবেন, বাইরে তার কাজ থাকবে না, তা তো নয়। বটকৃষ্ণবাবুকে এখন তীর্থের কাকের মতো বসে থাকতে হবে। রামদার কাছে বিদায় নিয়ে অর্জুন বেরিয়ে এল চৌধুরী মেডিক্যাল স্টোর্স থেকে।

*

জলপাইগুড়ি শহরে ইদানীং অপরাধের সংখ্যা কমে এসেছে। দুই রাজনৈতিক দলের মারপিটকে পুলিশ আর অপরাধ বলে মনে করে না। এখানে যারা পুরোনো পকেটমার অথবা ছিঁচকে চোর তাদের কাউকে কাউকে অর্জুন চেনে। তারা এখন পেশা ছেড়ে ভদ্রভাবে কাজ করে জীবনযাপন করছে। অর্জুন তাদের একজনকে খুঁজে বের করতে রুপমায়া সিনেমার দিকে এগিয়ে গেল।

.

জলপাইগুড়ি শহরে একসময় গোটা চারেক সিনেমা হল ছিল। রমরম করে চলত সেগুলো। ভালো-ভালো বাংলা ছবি আসত রুপশ্রী আর আলোছায়াতে। পরে আলোছায়া হল রুপমায়া। কিন্তু ভালো ছবি কমে যাওয়ায় একটা হল বন্ধ হয়ে গেল। আর একটায় সিনেমা, নাটক, সভা, সবকিছুই হয়ে থাকে। ফলে চালু সিনেমার হল বলতে এখন দুটো। রুপশ্রী এবং রুপমায়া।

রুপমায়াতে হিন্দি ছবি দেখানো হয়। ফলে সেখানেই বেশি ভিড়। আর যেখানে দর্শকদের ভিড় সেখানে টিকিটের চাহিদা হবেই। চাহিদা হলেই সেটা ব্ল্যাক হবে। ওই হল ব্ল্যাকারদের স্বর্গরাজ্য। পুলিশ জানে, কর্তৃপক্ষের অজানা নয় তবু হিট হিন্দি ছবি এলে দর্শকরা দ্যাখেন হাউসফুল বোর্ড ঝুলছে কিন্তু কানের কাছে ফিসফিসানি শুনতে পান, টিকিট চাই? টিকিট?

এখন দুপুর। বারোটার নুন শো শুরু হওয়ার মুখে। অর্জুন হলের সামনে পৌঁছে দেখল ভিড় উপচে পড়ছে। অমিতাভ বচ্চনের পাকা দাড়িওয়ালা মুখ হোর্ডিং-এ। ছবির নাম ব্ল্যাক। হঠাৎ কানের কাছে এসে কেউ বলল, টিকিট চাই?

অর্জুন ঘুরে দেখল, দেখে অবাক হল। একটি মধ্যবয়সিনী মহিলা। শাড়ি জামা এবং মুখে অর্থাভাবের ছাপ স্পষ্ট। বোঝাই যায় পেটের দায়ে ব্ল্যাকারের কাজে নেমেছে।

তোমার নাম কী?

নামের কী দরকার? টিকিট চাই তো বলুন।

তোমায় পুলিশ ধরলে কী করবে?

ধরবে না। মালিক ছাড়িয়ে নেবে।

কে মালিক?

আরে! এ তো খুব ঝামেলাবাজ লোক। মেয়েটা চেঁচাল।

সঙ্গে-সঙ্গে একজন ছুটে এল, অ্যাই বউদি, চুপ করো। তারপর অর্জুনের দিকে তাকিয়ে বলল, কিছু মনে করবেন না দাদা। ও আপনাকে চিনতে পারেনি। এই লাইনে মেয়েছেলে ছিল না। কিন্তু ওর স্বামীকে তো আপনি চিনতেন। সে বিছানা নিলে না খেয়ে মরছিল বলে ওকে কাজটা পাইয়ে দিয়েছি আমরা।

ওর স্বামী কে? গদাইদা। যার একটা হাত কাটা ছিল।

অর্জুনের মনে পড়ে গেল। হাতকাটা গদাইকে সে চিনত। এই শহরে দুজন গদাই ছিল। একজন হাতকাটা গদাই অন্যজন পোড়াগদাই–দুষ্কর্ম করতে ওস্তাদ ছিল ওরা। পুলিশের হাতে মার খেয়েছে প্রচুর। এক-দুবার জেলও খেটেছে। ওই হাতকাটা গদাইকে সে একবার জেল-খাটা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। বিনা কারণে দোষ পড়ছিল ওর ঘাড়ে। লাইটার রহস্য সমাধান করার সময় ওই হাতকাটা গদাই তাকে খুব সাহায্য করেছিল।

অর্জুন মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে গদাই-এর?

ডাক্তার বলেছে টি বি। রাজার রোগ। বিছানা থেকে উঠতে পারে না।

কোথায় থাকো তোমরা?

ঠিকানা জেনে নিয়ে অর্জুন পা বাড়াল।

বাড়ির দিকে কিছুটা যেতেই একটা জিপ এসে দাঁড়াল তার পাশে। ড্রাইভারের পাশে বসা থানার বড়বাবু বললেন, অর্জুন, আপনি যাকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন তাকে হাসপাতালে ভরতি করিয়ে এলাম। বটকৃষ্ণবাবুর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।

অর্জুন কথা খুঁজে পাচ্ছিল না।

2 Comments
Collapse Comments

I want this full story

Why this story is incomplete? I like to read the full story. Please give the link of the full story.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *