মুশকিল আসান
সত্যি, এতদিন কোথায় ছিলেন বলুন তো? গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, কত ঋতু, কত মাস, কত বছর কেটে গেল তবু আপনার দেখা নেই। অথচ আপনার খোঁজখবর নেহাত কম করিনি। বহু ডাকাডাকিও করেছি সবাই মিলে। সবাই বলতে, এই তিন কুড়ি ঠেকা বুড়ো আমি, আমার বউ, আর ছেলেটা, মেয়েটা। না, ছোট ছেলে আর ছোট মেয়ে এসবের মধ্যে নেই। ওরা আবার লোকের কাছে কারণে-অকারণে হাত পাতা পছন্দ করে নামানে, করত না। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, ওরা এখন বাড়িতে নেই। কোথায় গেছে? সেটা অকপটে বলে দেওয়াটা কি ঠিক হবে? আপনি এত দিন পর দয়া করে এসেছেন, এসময়ে এরকম একটা খবর শুনিয়ে আপনাকে বিব্রত করাটা কি উচিত হবে আমার? অবশ্য বিপদ-আপদের কথা তো আপনাকেই শোনানো উচিত। এগুলো শোনাই তো আপনার কাজ। তা ছাড়া এখন আমার তো আর দ্বিতীয় কেউ নেই, যে এসব ফালতু কথা সময় খরচ করে কান পেতে শুনবে!
জানেন, আপনাকে দেখে সবচেয়ে যে খুশি হত সে আমার বউ। কিন্তু বেচারি এমনই অভাগিনী, কপালে এ-সুখ সইল না। গত মাসেই চলে গেল। তবে মানতেই হবে, ওই রোগা আধপেটা রুগ্ন শরীরে বহুদিন টিকে ছিল। ও আপনাকে যা ভক্তি-মান্য করত সে আর কী বলব! মাঝে-মাঝে আমারই তো বিরক্তি ধরে যেত। মনে হত, বড় বাড়াবাড়ি হচ্ছে। দয়া করে অপরাধ নেবেন না। যা সত্যি তাই বললাম। আসলে অভাবের সংসারে মেজাজটা সবার তিরিক্ষি হয়েই থাকে। তার ওপর রাজ্যের অসুখ-বিসুখ। বউটা কোত্থেকে যে আলসার বাধিয়েছিল জানি না। বাড়তে বাড়তে সেটা এমন হল যে, ডাক্তার-বদ্যিতেও আর ভারসা পাই না। বড় ছেলেটা মা-কে নিয়ে এ হাসপাতাল ও-হাসপাতাল ঢের দৌড়ঝাঁপ করল। মাঝে-মাঝে একটু ভালো হয়, আবার পড়তির দিকে। তারপর শুধুই বিছানায় শোয়াহা, এই বিছানাটায়। তারপর শুধুই বিছানায় পড়ে থাকে, আর আপনাকে ডাকে, খোঁজ করে। ভাবে আপনিই একমাত্র ওর কঠিন অসুখ সারিয়ে দিতে পারেন। বড় ছেলে সিন্টুরও আপনার ওপরে ছিল অগাধ ভরসা। সে-বেচারা মা-কেও ভালোবাসত খুব। তাই যদুর সম্ভব পয়সাও খরচ করল মায়ের রোগের পেছনে। কত খরচই বা করবে! মাড়োয়ারির গদিতে কেরানিগিরি করত যে! তবে ছেলেটার বোধ-বুদ্ধি ছিল, হাতের লেখাটাও ছিল মুক্তোর মতো। বোকার মতো ভাবত, ভালো হাতের লেখা থেকেই নাকি চাকরিতে ওর উন্নতি হবে। বি. এ. পাশ যে করেছিল, তার ওপর ভরসা করত না। বলত, বাবা, বি. এ. পাস ছেলেমেয়ে তো গণ্ডায়গায় পাওয়া যায়, কিন্তু আমার মতো সুন্দর হাতের লেখা কজনের আছে বলো? এই বলে দিলুম তোমায়, ওই হাতের লেখা থেকেই আমার হাত খুলে যাবে। শুনলেন তো, কী সব ছেলেমানুষি কথা!
না, ছেলের হাত তো খুলল না, তবে আমার বউটার পেট খুলল ডাক্তাররা। ছুরি-কাঁচি দিয়ে নানান কাটাছেঁড়া করল। তারপর পেটটাকে আবার সেলাই করে দিল। বউটা কদিন কাতরাল, কদিন অজ্ঞান হয়ে রইল। শরীরটা রোগ থেকে আরও রোগা হয়ে অবশেষে হল কাকলাসের মতো। কী বলছেন? অপারেশানের টাকা কোথায় পেলাম? সিন্টুই সব জোগাড় করেছিল। শুনতে অবাক লাগলেও ওর ওই মাড়োয়ারি মালিকই সব টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তবে ধার হিসেবে। বলেছিল, পরে আস্তে-আস্তে শোধ করে দিলেই হবে। কিন্তু এত কাণ্ড করে লাভ কিছু হল না। অপারেশানের পর কখন যে সেপটিক হয়ে গেছে তা ডাক্তাররাও বুঝতে পারেনি, আমাদের কথা তো বাদই দিলাম! সে-দিনগুলো যে কীভাবে কেটেছে কী বলব! সিন্টু অফিসে ওভারটাইম করে, যাতে ধারটা জলদি শোধ হয়। বড় মেয়েটা ফাংশানে গান-টান করত। হুঁ, ঠিকই ধরেছেন, অল্পবিস্তর টাকা পয়সাও পেত তার জন্য। ফলে একটু রাত করে ফিরত। ছোট মেয়েটা ইস্কুল ফাইনাল পাশ করার পর আর পড়েনি–মানে পড়াতে পারিনি। ও বাড়ি-বাড়ি ঘুরে টিউশনি করে। যা পায় তার কিছু আমাকে দেয়, বাকিটা নিজের সাজগোজে খরচা করে। বলে, ঠিকমতো না সাজলে নাকি টিউশনি পাওয়া যায় না। কী জানি, আমি তো এসব বুঝি না, সেকেলে মানুষ। হয়তো আপনি বুঝবেন, আপনার অজানা তো কিছুই নেই।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম। সবাই তো বাইরে বাইরে। ছোট ছেলে রিন্টু দিনরাত বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায়। বাড়ির কাজ বলতে সকালবেলার দোকানপাটটুকু সেরে দেয়, আর হপ্তায়-হপ্তায় রেশনটা। হাতখরচের পয়সা কোথায় পায় জানি না, তবে যেভাবে হোক জোগাড় করে নেয়। ঘরে ছেলেটা ফেরে রাত করে। দুটো মুখে গুঁজে দিয়ে শুয়ে পড়ে। তার পরদিন আবার একই রুটিন। ফলে নিঃঝুম সন্ধেটা আমার যেন কাটতে চাইত না। তেলচিটে বিছানায় রুগ্ন বউটা শুয়ে কোঁকাচ্ছে। ঘরে কেরোসিনের কুপির টিমটিমে আলো, আর দম আটকানো কালো ধোঁয়া। আমি দরজার চৌকাঠে বসে এক মনে ঠোঙা তৈরি করতাম। চোখের জ্যোতি বেশ কিছুদিন হল কমে এসেছে। আগে একার হাতে দৈনিক পাঁচশো ঠোঙা তৈরি করতে পারতাম, কিন্তু নজর কমে যাওয়ার পর থেকে দু-আড়াইশো বড় জোর হয় কি হয় না। আমার ছোট ছেলেটা বাপের খুব খেয়াল রাখত বোধহয়। কারণ, একদিন হুট করে এসে বলে, বাবা, তোমার প্লাস না মাইনাস? আমি তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছি। রিন্টু কি অঙ্ক জিগ্যেস করছে নাকি? আমার ওই হতভম্ব অবস্থা দেখে ও পকেট থেকে একটা চশমা বের করল। পুরোনো চশমা। ফ্রেমের উঁটির কাছটা ফেটে গেছে। সবুজ ছাতা পড়েছে ভেতরে। বললাম, কার চশমা এটা? রিন্টু বলল, সে জেনে কী হবে! তুমি চোখে দিয়েই দ্যাখো না। ওর কথা অমান্য করলাম না। চশমাটা চোখে দিলাম। রিন্টু জিগ্যেস করল, আগের চেয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছ? সত্যিই, যা আগে ঝাপসা ঠেকত তা যেন কম ঝাপসা ঠেকতে লাগল। ওকে সে কথা বললাম। রিন্টু খুশি হয়ে হাত-পা ছুঁড়ে চলে গেল। কিন্তু পরদিনই শুনলাম, আমাদের পাড়ার ইস্কুল বাড়ির লাগোয়া মাঠে তারিণী মাস্টারকে গলাকাটা অবস্থায় পাওয়া গেছে। আর তার চোখের চশমাটা নাকি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। কী বললেন? না, না, রিন্টুকে আমি কিছুই জিগ্যেস করিনি। জিগ্যেস করলেই হয়তো পালটা বলত, কোন অধিকারে তুমি আমাকে প্রশ্ন করছ? বাবা হলেই কি পৈতৃক সম্পত্তির মতো সব অধিকার বর্তে যায়? নাঃ, ওর প্রশ্নও বুঝি না, তার উত্তরও জানি না। শুধু জানি চশমাটা আমার দৈনিক ঠোঙার সংখ্যাকে তিনশোর কোঠায় নিয়ে গিয়েছিল।
সেই নিঃঝুম সন্ধেয় বসে ঠোঙা ভাঁজতে-ভঁজতে শুধু আপনার কথা মনে পড়ত। দম আটকানো কালো ধোঁয়ায় নেড়ি কুকুরের মতো হাঁ করে হাঁফাতাম। কখনও কখনও কাশ উঠত। বুকের ভেতর ঘড়ঘড় শব্দ হত। থুথু আর কফ দলা পাকিয়ে জিভের ওপরে ঘুরঘুর করত। মাঝে মাঝে বউয়ের কেঁকানি জোরালো হলে উঠে গিয়ে জল দিলাম, কি কফোঁটা ওষুধ ঢেলে দিলাম গলায়। তারপর আবার ঠোঙা। এইরকম একঘেয়েভাবে ঠোঙা বানাতে-বানাতে একসময় মনে হত আমি নিজেই কখন ঠোঙা হয়ে গেছি। আমি ঠোঙা, আমার বউ ঠোঙা, সিন্টু, রিন্টু, সবিতা, পলা সবাই এক-একটা ঠোঙা। খালি ঠোঙা। এমনকী তার আঠার জোড়ও খুলে আসছে একটু-একটু করে। আপনি হাসছেন? অথচ তখন যদি আপনি আসতেন, কাছে দাঁড়িয়ে এইরকম বরাভয় হাসি হাসতেন, কিংবা বলতেন, ভয় নেই, আমি আছি-দুঃখে সুখে পুণ্যে পাপে পতনে উত্থানে সবসময় পাশে আছি, তা হলে ওই তেলচিটে বিছানাটাও আজ আর হা-হা খালি থাকত না, সিন্টু আর সবিতাও হাজির থাকত আপনাকে সসম্মানে আপ্যায়ন করার জন্যে। সত্যি, এত দেরি করলেন কেন বলতে পারেন?
আজ আমার সঙ্গেও আপনার দেখা হত কি না কে জানে! আপনার হয়তো অবাক লাগছে, একটা হেঁপো বুড়ো কী করে ঘরদোর আগলে একা-একা যখের মতো দিন কাটাচ্ছে। জানেন, অবাক আমারও লাগে। কী করে যে টিকে আছি! হ্যাঁ, টিকে থাকার কিছুটা কেরামতি কিন্তু নিমাদ জালানের–সিন্টুর মাড়োয়ারি মালিক। কেন জানতে চাইছেন? আসলে মাড়োয়ারি হলে হবে কি, লোকটার মনটা ভারী নরম। আমার বড় ছেলেটা তো দিনরাত্তির ঘাড় গুঁজে কাজ করে ধার শোধ করে চলেছে। একদিন নিমাদ তাকে বললে, সিন্টুবাবু, উধার শোধ করতে আপনার তো ছসাল লেগে যাবে। সিন্টু চুপ। কারণ কথাটা মিথ্যে নয়। অবশেষে নিমচাঁদ প্রস্তাব দেয়, সিন্টুর দু-ভাই বোন যদি তার কাছে নোকরিতে লেগে যায় তা হলে ছসাল সময়টা দু-সালে নেমে আসবে। সিন্টু নিমাদের প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল। কিন্তু রিন্টু রাজি হল না। ও তখন কদাচিৎ বাড়িতে থাকে। কোথায় যায় কী করে কেউ জানে না। অবশ্য আপনি নিশ্চয়ই জানতেন। ওকে তখন একটু-আধটু শাসন করে ঘরমুখো ফেরালেই পারতেন। আপনার কথা নিশ্চয়ই অমান্য করত না। কী বলছেন? নিয়তির ওপরে কারও হাত নেই? আপনারও নেই? হ্যাঁ, তা তো বটেই। নইলে আমিই বা এরকমভাবে বেঁচে রয়েছি কেন!
রিন্টু রাজি হয়নি, তবে বড় মেয়ে সবিতা রাজি হয়েছিল। ও চাকরি নিল নিমাদের অফিসে। আর রাতে ফাংশান। নিমাদের ধার বেশ তাড়াতাড়ি শোধ হতে লাগল। অথচ দেখি সিন্টু দিনের পর দিন কেমন মনমরা হয়ে যাচ্ছে। ওকে ডেকে যতই জানতে চাই, কী ব্যাপার, ও কোনও জবাব দেয় না। মাঝে-মাঝে শুধু বলে, হাতের লেখা ভালো হয়ে কোনও লাভ নেই, বুঝলে, বাবা। আমি তখন মুখের ভেতরে নল ঢুকিয়ে রবারের পাম্প টিপে গলায় ওষুধ দিচ্ছি। দুবার ওয়াক তুলে সামলে নিয়ে বললাম, কে বলেছে লাভ নেই। আমার বাবা সিন্টু আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে ছোট্ট করে বলল, কে আবার বলবে, নিমাদ বলেছে। আমি ওকে সান্ত্বনা দিতে গিয়েও পারলাম না। আমার বড় ছেলেটা খুব সোজা-সরল, নিরামিষ খায়। ওকে ঠকাতে কষ্ট হল।
বুঝলেন, এরপর থেকেই বড় ছেলেটা কেমন যেন ধার্মিক হয়ে যেতে লাগল। কণ্ঠি নিল। নামগান শুনতে যায়। বাড়িতে পাঁচালি নিয়ে বসে। ভাই-বোনগুলো আড়ালে হাসাহাসি করে। তবে ওর মা খুশি। ওকে উৎসাহ দিয়ে কাতর কণ্ঠে বলে, কোনও ভালো কাজ কখনও বিফলে যায় না রে! না, সিন্টুর ভালো কাজ বিফলে যায়নি। ও একদিন চলে গেল বাড়ি ছেড়ে। দু কলম লিখে জানিয়ে দিল, সংসারে পাপ আছে। এখানে হাতের লেখা ভালো হলেও কারও উন্নতি হয় না। তাই চলে গেলাম।
আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, সেদিন খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। রোজগেরে ছেলে না বলেকয়ে উধাও হলে কোন বাপটা না ভয় পায়! কী বলছেন? সেরকম ভয়ের কিছু ছিল না? হ্যাঁ, মানে দু-মেয়ে রোজগার করছিল বটে, তবে হাজার হলেও মেয়ে তো! সবিতার কাজে নিমচাঁদ খুশি! ওর প্রমোশন হয় চাকরিতে। যদিও ওর হাতের লেখা ভালো নয়। সবিতা টাকা দিয়ে এই তে-পায়া সংসারটার একটা পায়া ধরে রেখেছে। আর পলা? একইসঙ্গে ওর সাজগোজ আর টিউশনি, দুই-ই বাড়ছে। মেয়েটা নিশ্চয়ই খুব ভালো পড়ায়। খুব খাটতেও পারে। জানেন, মাঝে মাঝে বেশ খারাপ লাগত। মেয়ের রোজগারে খাওয়া! কী বলছেন? আজ আর সে-যুগ নেই? ঠিকই বলেছেন। আজ শুধু ঠোঙা বানানোর যুগ, কিংবা ঠোঙা হয়ে যাওয়ার যুগ।
সিন্টু গেল। রিন্টুর যাতায়াত কমতে কমতে একেবারে শূন্যের কোঠায় এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ব্যস, সে-ও গেল। কিন্তু আমার বউটা যাই-যাই করেও যায় না। তখনও আপনার খোঁজে মত্ত। ওর হাবভাব দেখে মনে হত এই আপনি এসে পড়লেন বলে। এই বুঝি সিন্টু-রিন্টুকে খুঁজে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন! এই বোধহয় আমার বউয়ের পেটের দগদগে ঘা সেরে গেল! আর আমার মতো হেঁপো বুড়োকেও বুঝি ম্যাজিক দিয়ে জোয়ান করে দেবেন। কিন্তু না। কিছুই হল না। দু মেয়ে বাইরে গতর খাটায়। আর ঘরে আমার বউ কোঁকায়, আমি হাঁপ টানি। বউ আপনাকে ডাকে, আমি ঠোঙা বানাই। হঠাৎ-হঠাৎ মনে হয়, ও যেন আপনাকে ডাকছে আমার হয়ে ঠোঙা বানিয়ে দেওয়ার জন্যে। হতেও পারে। হয়তো আমাদের জীবনের জোড়গুলোয় আশা-আকাঙ্ক্ষার আঠা লাগিয়ে ঠোঙা তৈরি করাটাই আপনার নেশা। পরে আকাঙ্ক্ষা যখন খসে যায়, তখন ঠোঙাও খুলে গিয়ে দাঁত ছরকুটে চৌরাস্তার কাদায় ব্রে-আব্রু হয়ে পড়ে থাকে।
না, সব আশা-আকাঙ্ক্ষা খসে যায়নি আমাদের। তা-ই যদি বলি তা হলে সবিতাই বা কোম্পানি থেকে কোয়ার্টার পাবে কেন, আর পলাই বা নামকরা টিউটোরিয়াল হোমে চাকরি পাবে কেন! কোয়ার্টার পাওয়ার পর সবিতা চিঠি লিখেছিল, বাবা, সবই দয়াময়ের ইচ্ছে। মার চিকিৎসার যেন কোনওরকম ব্যাঘাত না হয়…। দয়াময়? দয়াময় জালান? নিমৰ্চাদের কেউ হয় নাকি? সে কথা বউকে বলতেই ও হেসেছে। আশ্চর্য, ওর হাসিতে এখনও ঘা হয়নি! হেসে ও বলেছে, তোমার আর কবে বুদ্ধি হবে? দয়াময় বলতে একজনই আছেন। সত্যি বলছি, সেই একজন কে আমি বুঝতে পারিনি। আসলে আধপেটা খেয়ে দিনে তিনশো ঠোঙা তৈরি করলে কারই বা বুদ্ধি ঠিক থাকে, বলুন? আমি চালসে পড়া চোখে ধার করা চশমা লাগিয়ে একমনে ঠোঙা ভঁজি আর আনমনে পাঁজরার হাড়গুলো গুনি, যেন তা থেকেই জানতে পারা যাবে আপনার আসতে আর কত দেরি। নাকি আমার যেতে?
আজকালকার ছেলেমেয়েরা অকৃতজ্ঞ হয় তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সিন্টু চিঠি দেয় না। রিন্টুও না। সবিতার চিঠি কমে এসেছে। আর পলাও থাকার জায়গা পেয়েছে টিউটোরিয়ালে। ঘরটা যেন এখন সত্যি শ্মশান। বিছানায় শোওয়া একটা আধমরা দেহ। আর সেই দেহকে আগলে আমি বসে আছি। ঘরে রয়ে গেছে ছেলেমেয়েগুলোর স্মৃতির কঙ্কাল।
হ্যাঁ, একটা সেকেন্ড হ্যান্ড চশমা। রিন্টু। সুন্দর হাতের লেখায় ভরা দুটো খাতা। সিন্টু। একটা পুরোনো হারমোনিয়াম–তাতে এখন আর খুশির সুর বাজে না। সবিতা। পাউডার, স্নো, সেন্ট, কাচপোকার টিপ, নেলপালিশ, লিপস্টিক। পলা। আমার স্মৃতি আমি নিজে। আর বউয়ের স্মৃতি ওই অক্ষয় মিষ্টি হাসি! কিন্তু শেষমেশ তাও গেল।
সবিতার চিঠি একদিন বন্ধ হল। চিঠির সঙ্গে টাকা আসত। তাও বন্ধ হল। নিমাদের ঋণ কি শোধ হয়ে গেছে তা হলে? পলার সাহায্য আসত কখনও সখনও। একসময় তাও ডুমুরের ফুল। এখন শুধু আমি, ঠোঙা, আর বউ। তিনজনে মিলে ধরে রেখেছি তেপায়া টেবিলটাকে। বউয়ের মুখে চব্বিশ ঘণ্টাই শুধু আপনার কথা। আপনার গুণাবলী সাতকাহন করে শোনায় আমাকে। বলে, আপনি কত ভালো। কত ক্ষমতা আপনার। কত মহান আপনি। আমি শুনি, ঠোঙা বানাই, রান্না করি, ঠোঙা বানাই, রান্না করি, ঠোঙা বানাই, শুনি, রান্না করি, ঠোঙা বানাই…।
আপনার কি একঘেয়ে লাগছে? কী বলব বলুন। একঘেয়ে জীবনের গল্প সবসময় একঘেয়েই হয়। তবে খুব বেশি দিন একঘেয়েমিতে কাটেনি আমার। আপনার খোঁজ করে করে বউটা শেষে চলে গেল। না, নিয়তির ওপরে তো কারও হাত নেই! আপনারও নেই। আমারও নেই। ফলে এখন শুধু আমি আর ঠোঙা রয়ে গেলাম।
গত একটা মাস খুব কষ্টে কাটিয়েছি, মহামান্য। পরের জন্যে কষ্ট করলে কষ্টকে কষ্ট বলে মনে হয় না। কিন্তু নিজের জন্যে কষ্ট করলে সে-কষ্ট লক্ষগুণ হয়ে বুকের মধ্যে চেপে বসে। একটা মাস আমি একা এই একশো চুয়াল্লিশ বর্গফুট রাজ্যের ওপর দোর্দণ্ডপ্রতাপে রাজত্ব করেছি। কিন্তু আর সইছে না। যে রাজ্যে প্রজা নেই সে রাজ্যের রাজার কষ্ট আপনি বুঝবেন না, মহানুভব। কী বলছেন? কষ্টের মধ্যেই মোক্ষ? হয়তো তাই। আর আমিও তো তাই চেয়েছিলাম, কিন্তু পেলাম কই?
অনুমতি না নিয়ে কেশে ফেললাম। মাফ চাইছি, মহাত্মন। আসলে শরীরের ওপরে সমস্ত নিয়ন্ত্রণই আমি হারিয়ে ফেলেছি। আমার এই শীর্ণ হাত, আমার এই জীর্ণ দুটি পা আজ ভাবতে অবাক লাগে যে, এগুলো আমারই শরীরের প্রত্যঙ্গ। ইচ্ছেমতো এগুলো আমি নাড়াচাড়া করতে পারি। কী বলছেন? পায়ের এই ক্ষতটা কীসের? বিশেষ কিছু নয়, কাচে সামান্য কেটে গেছে। আপনার কাছে লুকিয়ে তো লাভ নেই, আপনি সর্বজ্ঞ। হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম, এতদিন প্রতীক্ষার পর যখন এলেন, তখন অধমের একটা প্রার্থনা আপনাকে পূরণ করতেই হবে। আপনার তো অদেয় কিছুই নেই! আমার এই…কী বলছেন? ঘরে এত কাচের গুঁড়ো কোত্থেকে এল? কিছুই না, বাঁধানো ফটোর কাচটা আচমকা ভেঙে গেছে। এতদিন ঠিকই ছিল! বউটা ভীষণ যত্ন-আত্তি করত ফটোটার। ফুল ধূপ-ধুনো কিছুই বাদ দিত না। মরবার আগেও অসহায় চোখে চেয়ে ছিল এই পরমাত্মা ছবিটার দিকে। আপনি তো সবই জানেন! কি? ফটোটা ফ্রেম ভেঙে কাত হয়ে পড়ে আছে কেন? কে জানে। আমার তো কদিন ধরে বিশেষ জ্ঞানগম্যিই নেই। আধপেটা ভগ্নাংশ হয়ে কবেই সিকিপেটায় ঠেকেছে। সিকির ভগ্নাংশ, তার আবার ভগ্নাংশ, এইরকম বহু ভগ্নাংশ হতে-হতে এখন আমার পেটের ঠিক কত অংশ ভরতি তার কোনও স্পষ্ট হিসেব আমার কাছে নেই, প্রভু। আর সেইজন্যেই তো আপনার কাছে একটাই প্রার্থনা! জানিনা, ফটোর কাচ ভেদ করে ধূপ-ধুনো ফুলের গন্ধ আপনার খুঁতহীন নাকে পৌঁছেছিল কি না। জানি না, আমার বউয়ের নিত্যদিনের আকুল পুজোপিট আপনার সর্বৰ্শব্দগ্রাহী কানে পৌঁছেছিল কি না। নিশ্চয়ই পৌঁছেছে। নইলে দেরিতে হলেও আপনি এলেন কী করে? কী বলছেন? আমার কাচে কাটা পা আর এই ফটোর গুঁড়ো হয়ে যাওয়া কাচের মধ্যে…না,, প্রভু! আমার জ্ঞান ছিল না, সংযম ছিল না, নিয়ন্ত্রণ ছিল না, শ্রদ্ধা ছিল না, ভক্তি ছিল, সম্ভ্রম ছিল না–এ কী! আপনি চলে যাচ্ছেন, মহামান্য?
দয়া করুন, দেবাদিদেব! করুণা করুন, দয়াময়। অত্যন্ত সহজ একটি প্রার্থনা পূরণ করলেই আপনি আমার চেতনায় সমস্ত বোধ ফিরিয়ে আনতে পারেন সম্ভ্রম, ভক্তি, শ্রদ্ধা, নিয়ন্ত্রণ, সংযম, জ্ঞান, সব, সব!
হে ঈশ্বর, করুণাসিন্ধু! শুনেছি আপনার ক্ষমতা ও শক্তি অপরিমেয়। বহু অত্যাচারী শক্তিশালীকে নিছক বাহুবলে দমন করেছেন আপনি। প্রভু, আমার বুকের সামান্য নীচে, তলপেটের কিছুটা ওপরে, অর্থাৎ নাভির আশেপাশে, একটা ভয়ংকর দৈত্য লুকিয়ে আছে। আমি কিছুতেই একে বাগে আনতে পারছি না। ওর দাপাদাপি আমাকে পাগল করে তুলেছে। দয়া করে একে সংহার করুন, প্রভু! আমার জোড় খুলে যাওয়া ঠোঙাটা আবার বেঁচে উঠুক। এ কী, দয়াময়, আপনি চলে যাচ্ছেন? কেন, মহামান্য, কী অপরাধ আমি করেছি? কী? ওই চূর্ণ-বিচূর্ণ ছবি, আমার কেটে যাওয়া পায়ের চেটো, আমার অবিশ্বাসী রুক্ষ দৃষ্টি আপনাকে সন্দিহান করে তুলেছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন– তবু আপনি চলে যাচ্ছেন? একজন ভক্তের আর্তিকে উপেক্ষা করছেন আপনি? আপনার মনে কি করুণা নেই, করুণাময়? হয় আমাকে, নয় ওই দৈত্যকে সংহার করতেই হবে আপনাকে! প্রভু! মহাত্মন! করুণাসিন্ধু! দেবাদিদেব! এতবার অনুনয় করে বলছি তবু আপনি টলছেন না? শুনুন…।
…ওরে শালা, যাওয়ার আগে আমার পেটের এই দৈত্যটাকে ঘাড় মটকে নিকেশ করে দিয়ে যা।