মুর্তি জালিয়াতির চালিয়াতি
কাহিনিটা ২৫ বছরের পুরোনো। একাদশ শতাব্দীর শিবপুরম নটরাজ মূর্তি স্মাগলড হয়ে পৌঁছেছিল আমেরিকায়। পঞ্চলোহা মূর্তিটার ওজন পঞ্চাশ কিলোগ্রাম। ১৯৫৬ সালে তাকে উদ্ধার করা হয় মৃত্তিকার তলদেশ থেকে। স্ট্যাচুটি মেজেঘষে ঝকঝকে সুন্দর করে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব দেওয়া হল এক মূর্তি কারিগরকে। ধুরন্ধর কারিগরটি অভিনব উপায়ে প্রতারণা করলেন কর্তৃপক্ষকে– আসল দিলেন বেচে। একটা হুবহু নকল বানিয়ে ফেরত দিলেন স্ট্যাচু মালিককে।
কিন্তু কারও চোখে ধরা পড়ল না এতবড় জালিয়াতি। পরপর বারোজন ভারতীয়র হাতবদল হল জাল মূর্তি। কারিগর বেচেছিলেন পাঁচ হাজার টাকায়। হাতবদল হতে-হতে সেই মূর্তির দাম গিয়ে দাঁড়াল পাঁচ লক্ষ টাকায়। বিপুল অঙ্কের দামটি পকেট থেকে বার করল এমন এক কারবারি যার বিলক্ষণ সুনাম আছে হন্ট স্ট্যাচু কেনাবেচায়।
নিউইয়র্কের এক সংগ্রাহক মূর্তিটি হাতে পেয়ে আনন্দে উল্লসিত হয়ে তো বলেই ফেললেন– পাঁচ লক্ষ রুপেয়া এর দামই নয়–হওয়া উচিত নব্বই লক্ষ।
মূর্তিটি বর্তমানে রয়েছে সাইমন নর্টন ফাউন্ডেশনে। তারা কত দাম দিয়েছিল হন্ট স্ট্যাচুটির মালিক হওয়ার জন্যে, তা অবশ্য এখনও জানা যায়নি–কোটির ওপর তো বটেই।
কিন্তু আমেরিকা এক আশ্চর্য দেশ। অন্যদেশের সম্পত্তি চুরি করে এনে হজম করবে দেশের একটা নামী সংস্থা, তা জেনেশুনে চোখ বুজে থাকার পাত্র তারা নয়। প্রতিবাদের ঝড় উঠল দেশময়। ইন্ডিয়া হলে পাবলিকের আপত্তিতে বয়ে যেত যে-কোনও মূর্তি সংগ্রাহকের, কিন্তু সাইমন নর্টন ফাউন্ডেশন শেষপর্যন্ত রাজি হল চোরাই মাল ফিরিয়ে দিতে।
কিন্তু ধুরন্ধর ইন্ডিয়ান কারিগরকে তো আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। আরও চারটে অনুরূপ বিগ্রহ তাকে দেওয়া হয়েছিল মাজাঘষার জন্যে তাদের কপালে কী জালিয়াতি ঘটেছে, কে এখন সে রহস্যের সমাধান করবে? ডিটেকটিভ কোথায়? ফেলুদা, ব্যোমকেশ, ইন্দ্রনাথ-কিরীটির তলব তত এখনও পড়েনি।
এই একটি ঘটনা থেকেই অ্যান্টিক সামগ্রী দেখলেই এখন সমঝদার ব্যক্তিরা আঁতকে উঠছেন। আসল কি নকল যাচাই করবে কে? মিউজিয়ামে এমনি অ্যান্টিকের তো পাহাড় জমে রয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে কোনটা জাল, কোনটা আসল চীজ–তা কে জানছে? চুরি যেমন ধরা পড়ছে না, জালিয়াতিও তেমনই ধরাছোঁয়ার বাইরে।
আশ্চর্য, নয় কী?
পুরীর জগন্নাথ মহাপ্রভুর হিরের চোখ চুরি হয়ে গেল যখন, তখন ছোটখাট মন্দির দেবালয়ের লুঠতরাজের কাহিনি দেশবাসীর কানে আদৌ কি পৌঁছোচ্ছে? ১৯৭৩ সালের আর্টস অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিস অ্যাক্ট-য়ের যথা প্রয়োগ করার লোক কোথায়? তা না হলে চিতোরগড় অস্ত্রাগারে এমার্জেন্সির সময়ে সংরক্ষিত একশোটা মূল্যবান বিগ্রহ হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে কেন? কর্তৃপক্ষের টনক নড়ল মাত্র গতবছর, যখন বিগ্রহ-মালিক মূর্তিগুলো ঘষামাজার জন্যে চেয়ে পাঠালেন দরখাস্ত মারফৎ।
যাক সে কথা, নটরাজ-জালিয়াত ভদ্রলোক নকল-মূর্তি বানানোর এমন খাসা কায়দাটি নিজেই উদ্ভাবন করেছিলেন, না, ভুবন কাঁপানো ঠিক এই ধরনের আর একজন জালিয়াতকে গুরু বলে মেনে নিয়েছিলেন, সেই আলোচনাই এখন করা যাক কাগুঁজে-গোয়েন্দাগিরিও বলতে পারেন।
চলুন, সময়ের সড়কে অতীত ভ্রমণে যাওয়া যাক।
সালটা ১৯২০। রোম শহর। আপনি দাঁড়িয়ে আছেন (অদৃশ্য অবস্থায় অবশ্য) একটা খুদে স্টুডিওর মধ্যে। কৃষ্ণনগরে মূর্তি কারিগরদের স্টুডিও দেখেছেন? হুবহু সেই রকমই এই স্টুডিওটি। সমাপ্ত, অর্ধসমাপ্ত মূর্তি এবং বিস্তর পাথরের স্কুপ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ছোট্ট স্টুডিওটিতে।
ছেনি হাতুড়ি নিয়ে তন্ময় হয়ে খটাং-খটাং করে মূর্তি খোদাই করে চলেছেন ওই যে শিল্পীটি, ওঁর নাম অ্যালসিও ডোসেনা। ইটালিয়ান। নামী শিল্পী নন। আসলে উনি পাথর খুদে নতুন-নতুন বাড়ির কার্নিশ তৈরি করে পেট চালাতেন। এখন তার ভাবনাচিন্তা উধাও হয়েছে কয়েক শতাব্দী পেছনে। বাটালির এক-এক কোপে প্রবেশ করছেন ফ্যানটাসি দুনিয়ার আরও গভীরে। নিজেকে এখন লিওনার্ডো দ্য ভিন্সির জায়গায় বসিয়েছেন। এরপর অবশ্য হবেন মাইকেল এঞ্জেলো হবেন গ্রেট রেনেসাঁ যুগের আরও অনেক ভাস্কর–যাঁদের কীর্তি তিনি জানেন এবং ভালোবাসেন।
অস্থিরতার শুরু এই ভাবনাচিন্তা ভালোবাসা থেকেই। কার্নিশ তৈরির কাজ একদিন নিক্ষেপ করলেন–দূর, দূর। এর মধ্যে সৃষ্টির আনন্দ কোথায়! এক-ডেলা মার্বেল পাথরের ওপর ঝুঁকে পড়লেন বাটালি হাতুড়ি নিয়ে। শুরু হয়ে গেল খোদাই কর্ম। ফ্যানটাসি স্বপ্নে মশগুল থাকায় তখন কিন্তু জানতেনও না যে, অজান্তে যে পথ উনি ধরলেন, সেই পথেই অচিরে তাঁর বরাতে নাচছে বিশ্বব্যাপী কুখ্যাতি।
দীর্ঘ আট বছর ধরে খ্যাতির স্বপ্নজগতে বিচরণ করলেন পাথর রাজমিস্ত্রি। ডজন-ডজন অপরূপ সুন্দর খোদাই বানিয়ে গেলেন খুদে কারখানায়। তারপরেই ১৯২৮ সালের যাচ্ছেতাই এক নভেম্বর দিবসে যেন প্রচণ্ড ভূমিকম্পে নড়ে উঠল শিল্প-দুনিয়া ও নিউইয়র্ক, ক্লিভল্যান্ড, বোস্টন, রোম, বার্লিন এবং মিউনিখের কর্তৃপক্ষরা আঁতকে উঠল ভয়াবহ একটা সংবাদে বহু কষ্টে সংগ্রহ করা তাদের অধিকাংশ অমূল্য খোদাই শিল্পই নাকি জাল কার্নিশ মিস্ত্রীর নির্দোষ সাধনার ফলশ্রুতি অনুপম শিল্প নিদর্শন ঢুকে বসে আছে মিউজিয়ামে মিউজিয়ামে।
বিশ্ববন্দিত গুরুদেবদের মহান শিল্পকর্ম বছরের পর বছর খুঁটিয়ে দেখেছিলেন ডোসেনা। বিশেষ করে একজন আর্টিস্ট তাঁর চিন্তাজগতে আলোড়ন তুলেছিল সবচেয়ে বেশিনাম তার সাইমন মার্টিনি–চতুর্দশ শতাব্দীর চিত্রশিল্পী।
মার্টিনি কিন্তু পাথর নিয়ে কোনওদিন কাজ করেননি। ডোসেনা মার্টিনির ক্যানভাসে আঁকা শক্তিশালী চিত্রকর্ম দেখতে-দেখতে কল্পনারঙিন চোখে দেখেছিলেন, মার্টিনির হওয়া উচিত ছিল ভাস্কর। চোখ বন্ধ করে ডোসেনা যেন স্পষ্ট দেখতে পেতেন ছশো বছর আগে মার্বেল খোদাই করে মার্টিনি সৃষ্টি করছেন সারি-সারি অদ্ভুত সুন্দর মূর্তি।
সৃষ্টির প্রেরণা অথবা আইডিয়ার ঝলক তো এমনি করেই উন্মত্ত করে তুলেছে শিল্পীদের যুগ-যুগ ধরে। ডোসেনাই বা বাদ যান কেন! পরিত্যক্ত পাথর খাদে আর প্রহরাহীন ধ্বংসস্তূপে ঘুরে ঘুরে ডোসেনা শেষপর্যন্ত সংগ্রহ করলেন শিরাসমৃদ্ধ উৎকৃষ্ট মার্বেল পাথরঘর বোঝাই করে ফেললেন এই পাথরে। রেনেসাঁ যুগের ভাস্কররা যে-পাথর নিয়ে কালজয়ী সৃষ্টি করে গেছেন, এ সেই পাথর। তারপর মার্টিনি যে স্টাইলে পেন্টিং করেছেন, হুবহু সেই স্টাইলের অনুকরণে নিপুণ হাতে খোদাই করলেন অতীব সুন্দর একটা ম্যাডোনা ও শিশুমূর্তি।
এরপর রেনেসাঁ যুগের অন্যান্য যেসব শিল্পীদের মনে-মনে পূজা করেছেন ডোসেনা, তাদের বিশেষ কায়দা অনুকরণ করলেন এবং হুবহু সেই স্টাইলে সৃষ্টি করলেন চমকপ্রদ স্ট্যাচুর পর স্ট্যাচু।
নিজের কীর্তি দেখে নিজেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন ডোসেনা। আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পেতেই সাহসও বাড়ল। সময়-পথে পেছিয়ে গেলেন আরও পেছনে। গ্রিক ধ্বংসস্তূপ ছিল আশেপাশেই। সেখান থেকে মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করেছিলেন এমন সব মার্বেল পাথর যা ব্যবহার করা হয়েছে এথেন্সের মতো গৌরবময় যুগে। এইসব মার্বেল খুদে সূক্ষ্ম মূর্তির-পর-মূর্তি বানালেন, যা দেখলেই মনে হবে গ্রিসদেশের স্বর্ণযুগ ফিরে এসেছে প্রতিটি মূর্তি যেন খোদিত হয়েছিল সেই সময়ে।
পাথর-মিস্ত্রির কারখানা ধীরে-ধীরে মিউজিয়ামের রূপ নিতে লাগল এইভাবেই। কোণে-কোণে খাড়া রইল পঞ্চাদশ শতাব্দীর সমাধি মন্দিরের খোদিত অংশকে বলবে পঞ্চদশ শতাব্দীতে নয়– আসল জিনিসের সঙ্গে তফাত নেই কোথাও; রইল চতুর্দশ শতাব্দীতে নির্মিত প্রদীপের তৈলাধারের নকল আর গ্রীক দেবীমূর্তি।
সৃষ্টির খেয়ালেই ঝুঁদ হয়েছিলেন ডোসেনা বিক্রি করার কোনও চেষ্টাই করেননি। কিন্তু একদিন পাথর-মিস্ত্রীর রেনেসাঁ স্ট্যাচু দেখতে এলেন আলফ্রেডো ফাসোলি নামে এক অ্যান্টিক ডিলার। প্রাচীনকালের দুষ্প্রাপ্য ললিতকলার সামগ্রী বেচাকেনাই তার ব্যবসা। কাজেই চেনবার চোখ তার ছিল। নকল মূর্তি দেখে তো তার চক্ষু চড়কগাছ। কিন্তু মহাধুরন্ধর বলেই উত্তেজনার প্রকাশ ঘটতে দিলেন না চোখেমুখে। বললেন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে, দূর! দূর! এসব জিনিসের আবার বাজার আছে নাকি! তবে আপনি যদি চান, এখানকার বোঝা খানিকটা কমিয়ে দিতে পারিসস্তায় যদি দিতে পারেন, তবেই।
ডোসেনা বেচারি জানবেন কী করে চতুর ফাসোলির মাথার মধ্যে তখন ঘুরছে অন্য প্ল্যান? তাই রাজি হয়ে গেলেন এককথায়। পাথর-মিস্ত্রির একটা খোদাই মূর্তি নিয়ে ফাসোলি গেলেন তারই এক সতীর্থের কাছে। এঁর নাম পালেসি-আন্তর্জাতিক আর্ট মার্কেটে দারুণ নাম–একডাকেই সবাই চেনে। দুই ধুরন্ধর বিহ্বল চোখে অনিমেষে চেয়ে রইলেন অনিন্দ্যসুন্দর স্ট্যাচুটির প্রতিটি খাঁজ, ভাঙাচোরা, ফাটাফুটো, রং জ্বলে যাওয়া অংশের দিকে–সবই যেন আসলের ভাঙচোর এবং বিবর্ণতা। বহু শতাব্দী পরে সব মূর্তিতেই যা দেখা যায়। মূর্তি বেচে লাভের অঙ্কও ভেসে উঠল চোখের সামনে।
রোমের একটা মিউজিয়ামে বিক্রির জন্য হাজির করা হল সেই স্ট্যাচু। মিউজিয়ামের অফিসাররা মূর্তি দেখেই বললেন, উঁহু, এ যে জাল মনে হচ্ছে! বুক ধড়াশ-ধড়াশ করতে লাগল দুই প্রবঞ্চকের। তলব পড়ল মূর্তি বিশেষজ্ঞদের। তারা খুঁটিয়ে দেখে রায় দিল একবাক্যে–আসলি চিজ!
আনন্দে নেচে উঠলেন প্রতারক-যুগল। আর্ট এক্সপার্টদের কথার ওপর আর তো কথা বলা যায় না। মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ মোটা দাম মিটিয়ে দিলেন এমন একটা আসলি চিজ সংগ্রহ করে আনার জন্যে।
ডোসেনাকে অবশ্য বলা হল, সস্তার নকলি চিজ হিসেবে বিকিয়ে গেছে মূর্তিটা দাম পাওয়া গেছে সামান্যই। খানকয়েক নোট জুটল তার বরাতে! সামান্য টাকা পেয়ে আনন্দে আটখানা হয়েই ফাসোলির ফাঁদে পা দিলেন ডোসেনা। ওঁর সমস্ত খোদাইকর্মের একমাত্র বিক্রয়স্বত্ব চাইলেন অসৎ আর্ট ডিলার ফাসোলি। কৃতজ্ঞচিত্তে তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলেন পাথর-মিস্ত্রি। তার এই সামান্য শিল্পকর্মে এত আগ্রহ দেখেই তিনি ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছিলেন– অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করার বুদ্ধি হারিয়েছিলেন সেই কারণেই। ফলে রেনেসাঁ আমলের অকৃত্রিম শিল্প নিদর্শন হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হল ডোসেনার আরও অনেক স্ট্যাচু সারা ইউরোপের মিউজিয়াম আর প্রাইভেট সংগ্রাহকরা কাড়াকাড়ি করে নিয়ে গেল সেগুলো। প্রতিবারেই সামান্য টাকা গুঁজে দিয়ে গেলেন ফাসোলি পাথর মিস্ত্রির হাতে, সেই সঙ্গে শুনিয়ে গেলেন হাড় কালি হয়ে যাচ্ছে তার নকলি চিজ বেচতে গিয়ে নকলের দর কি বেশি পাওয়া যায়? ডোসেনা ঘুণাক্ষরেও কিছু সন্দেহ করলেন না–প্রশ্নও করলেন না! উলটে আরও উৎসাহিত হয়ে একটার পর একটা মাস্টারপিস উল্কীর্ণ করে গেলেন বাটালি হাতুড়ি দিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
বিশ্বের বহু বিখ্যাত মিউজিয়াম ধোঁকা খেয়ে গেল ডোসেনার গ্রিক আর রেনেসাঁ ললিতকলার নিদর্শন চড়া দামে কিনে। নিউইয়র্ক সিটির মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অফ আর্ট কিনেছিল একটা গ্রীক কুমারীর প্রস্তরমূর্তি যার বয়স নাকি খ্রিস্টপূর্ব ৫০০! ক্লিভল্যান্ড মিউজিয়াম বর্তে গেল ম্যাডোনা এবং শিশুর একটা দারুণ মূর্তি পেয়ে–এ মূর্তির স্রষ্টা নাকি জিওভানি পিসানো; চতুর্দশ শতাব্দীর প্রাতঃস্মরণীয় এই ভাস্করের পাথরের কাজ এতকাল অনাবিষ্কৃতই ছিল! বোস্টনের মিউজিয়ামে অফ ফাইন আর্টস তো উধ্ববাহু হয়ে নৃত্য করতে বাকি রেখেছিল রেনেসাঁ ভাস্কর মিনো দ্য ফিসোল নির্মিত একটা পাথরের শবাধার পেয়ে! পরে যখন ধোঁকাবাজি ধরা পড়ল, তখনও কিন্তু বোস্টন মিউজিয়ামের এক মুখপাত্র মন্তব্য করেছিলেন–হোক জালিয়াতি, এমন জিনিস সাজিয়ে রাখতে ইচ্ছে যায়। বড় সুন্দর! বড় সুন্দর! যে-ই করুক না কেন, তাতে কিসসু এসে যায় না।
এই তো সেদিন ১৯৫৮ সালে, কয়েকজন আর্ট এক্সপার্ট বলে বসলেন, সেন্ট লুই মিউজিয়ামে পরম যত্নে সংরক্ষিত ডায়ানা উইথ ফন প্রস্তরমূর্তিটাও নাকি ডোসেনার স্টুডিওতে তৈরি হয়েছে। কিন্তু তাতেও কি চৈতন্য হয় মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের! সঙ্গে-সঙ্গে একান্ন পৃষ্ঠার ইয়া লম্বা একখানা প্রতিবেদন ছাপিয়ে তারা ছড়িয়ে দিলেন বিশেষজ্ঞ মহলে জিনিসটা বিলকুল খাঁটি, তার স্বপক্ষে হাজার-হাজার যুক্তি প্রমাণ হাজির করে সযত্নে স্ট্যাচুটাকে সাজিয়ে রাখলেন মিউজিয়ামের স্ফটিক আধারে!
এ তো বড় তাজ্জব কি বাত! তাবড়-তাবড় শিল্প-বিশেষজ্ঞরা বিজ্ঞানের সূক্ষ্মতম কলকবজার ব্যবহার সত্ত্বেও ডোসেনার শিল্পকর্মে জালিয়াতি ধরতে পারলেন না কেন? কেন বারে বারে ধোঁকা তো খেলেনই, উলটে জাল জিনিসকেই আসল প্রমাণ করার জন্যে কোমর বেঁধে লাগলেন?
কারণ একটাই। তার আগে কোনও জালিয়াত যা কখনও করেননি, উনি তাই করেছেন। প্রতিটি শিল্পকর্মের মধ্যে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছেন। নিবিড় নিষ্ঠা সহকারে অত্যুৎকৃষ্ট ললিতকলা সৃষ্টি করেছেন–জাল করবেন বলে করেননি, সৃষ্টি করবেন বলেই করেছেন। সৃষ্টির আনন্দে সৃষ্টি বলেই তার সৃষ্টিকে আসল বলে সোচ্চার হয়েছে ধোঁকা খাওয়া মানুষগুলো।
শোনা যায়, ডোসেনা নাকি একটা গুপ্ত রসায়ন আবিষ্কার করেছিলেন। পাথর ছুঁড়ে কেমিক্যালটা প্রবেশ করত ভেতরে এবং পাথরের গায়ে মাটির দাগ ফুটিয়ে তুলত এমন নিখুঁতভাবে যে দেখেই মনে হত যেন মহাকালের নিষ্ঠুর হস্তক্ষেপে কালজীর্ণ হয়েছে মূর্তিগুলো।
আরও একটা কারণ আছে বইকি। খোদাই কর্মগুলোকে যথাবিহিতভাবে যাচাই করেনি। বেশিরভাগ মিউজিয়াম।
সবচেয়ে বড় কারণ কিন্তু ওই একটাই। খুঁটিয়ে পরীক্ষা সত্ত্বেও নকলকে নকল বলে চেনা যায়নি কেননা নকল-মাস্টার অ্যালসিও ডোসেনা ছিলেন বাস্তবিকই প্রতিভাধর–জিনিয়াস।
জিনিয়াস হলেও সৃষ্টিকর্মগুলো তো আসল নয়। কাজেই এমন জিনিস ফেরি করতে বেরিয়ে পরিণাম সম্বন্ধে সতর্ক হয়ে রইলেন ফাসোলি আর তার প্রবঞ্চক সতীর্থ। কোনও স্ট্যাচু সম্বন্ধে কোনও মিউজিয়াম সন্দিগ্ধ হয়ে উঠলেই সঙ্গে-সঙ্গে টাকা ফেরত দিয়েছেন দুজনে। এত সতর্কতা সত্ত্বেও ১৯২৮ সালে জব্বর দুটো ভুল করে ফেললেন ঠগযুগল। চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে ঠকাতে গেলেন ডোসেনাকে এবং নকলি স্ট্যাচুগুলো বিক্রি করতে গেলেন ফ্রিক কালেকশন অফ নিউইয়র্কে।
দুষ্প্রাপ্য সামগ্রীগুলো দেখে আকৃষ্ট হয়েও কিন্তু হুঁশিয়ার রইলেন মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ। টাকাকড়ি মিটিয়ে দেওয়ার আগে ঠিক করলেন নিজেদের এক্সপার্টদের পাঠাবেন ইটালিতে যাচাই করে নেওয়ার জন্যে। বড় অশুভ লগ্নে এসে পৌঁছল আমেরিকান বিশেষজ্ঞরা। আর একজন সাক্ষাৎ প্রার্থী এসে চমকপ্রদ একটা সমাচার দিয়ে গিয়েছিল ডোসেনাকে–তাঁর শিল্পসামগ্রী নাকি আসল রেনেসাঁ সামগ্রীরূপে প্রদর্শিত হচ্ছে বার্লিন মিউজিয়ামে।
আঁতকে উঠলেন ডোসেনা। সর্বনাশ! তাহলে তো দেখা যাচ্ছে তার সব শিল্পকর্ম অসৎ উদ্দেশ্যে কিনেছে তার এতদিনের দুই উপকারী দোস্ত। তিনি নিজেও তো এই প্রতারণার শরিক হয়ে পড়েছেন নিজের অজান্তেই! ভয়ের চোটে মামলা দায়ের করে বসলেন ডোসেনা।
খবরটা যাতে ফ্রিক প্রতিনিধিদের কানে না পৌঁছয়, সে চেষ্টার কসুর করেননি ফাসোনি আর প্যালেসি। কিন্তু অচিরেই চাঞ্চল্যকর খবরটা ছড়িয়ে পড়ল আটলান্টিকের দুই পারের দুই মহাদেশের সবকটা খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় বড়-বড় হেডলাইনের আকারে। হিসেব করে দেখা গেল, ডোসেনার জাল মাল বেচে ফাসোলি, প্যালেসি আর একটি বেনামী আন্তর্জাতিক ললিতকলার কোম্পানি পকেটস্থ করেছে প্রায় এক কোটি আশি লক্ষ টাকা! শুধু একটা খোদাই কর্মই বিক্রি হয়েছে এক কোটি পঁয়ত্রিশ লক্ষ টাকায়।
জোর তদন্ত চালালেন ইটালিয়ান গভর্নমেন্ট। প্রমাণ করে দিলেন তিপ্পান্ন বছর বয়স্ক ডোসেনার কোনও দোষই নেই। প্রবঞ্চক দুজনকে বাধ্য করলেন প্রতারিত ক্রেতাদের অন্তত কিছু টাকা ফিরিয়ে দিতে।
এত কাণ্ড হয়ে যাওয়ার পরেও রেনেসাঁ স্টাইল নিয়ে কাজ চালিয়ে গেলেন ডোসেনা– যা তার প্রাণ, যা তাঁর সাধনা–তা ছাড়েন কী করে? এই সাধনার মধ্যেই ছিলেন তিনি আমৃত্যু মারা যান সাত বছর পরে মৃত্যুর পরে কিন্তু একটা শ্লেষাত্মক উপসংহার গজিয়ে উঠল তার কাহিনিতে।
১৯৩৩-এর ৯ই মার্চ নিউইয়র্কের হোটেল প্লাজায় গ্র্যান্ড বলরুমে অ্যালসিও ডোসেনার অনুপম ললিতকলার ৩৯টি সংগ্রহ নিলেম করে বিক্রি করে দেয় ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি। একটির পেছনে সবচেয়ে বেশি দাম ওঠে মাত্র ৬২৭৫ টাকা। পুরো সংগ্রহটি বিক্রি হয় ৮২,১২৫ টাকায়। প্রতি ক্রেতাকে একটা রুচিসুন্দর প্রশংসিকা অর্পণ করেন ইটালিয়ান গভর্নমেন্ট। ভাবগম্ভীর ভাষায় তাতে গ্যারান্টি দিয়েছিলেন সরকার–প্রতিটি শিল্পসামগ্রী আসল নকল!
কে জানে, শিবপুরম নটরাজনের জালিয়াত ভাস্কর ডোসেনাকেই গুরু বলে মেনে নিয়েছিলেন কিনা!
* ক্রাইম পত্রিকায় প্রকাশিত।