2 of 2

মুন্নির সঙ্গে কিছুক্ষণ – দিব্যেন্দু পালিত

মুন্নির সঙ্গে কিছুক্ষণ – দিব্যেন্দু পালিত

দু’দিন ধরে বাক্যালাপ বন্ধ থাকার পর আজ বিকেলে কৃষ্ণা হঠাৎ অফিসে ফোন করল।

নিজের চেম্বারে আমি তখন একটা জরুরি ড্রাফট নিয়ে ব্যস্ত। মন ভাল না থাকায় যা ভাবছিলুম ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছিলাম না। সামনে স্টেনো বসে; ওর চুল থেকে শ্যাম্পুর গন্ধ উঠে এসে নাকে লাগছে, চোখ নামিয়ে নোটবুকে আলতো পেনসিল ঠুকছে—এমন সময় ফোন বেজে উঠল।

খুব স্বাভাবিক কারণে আমি বিরক্ত বোধ করলুম। কাজে বসার আগে অপারেটরকে বলে দিয়েছিলুম ফোনটোন এলে রিসিভ কবো না, বলে দিয়ো, নেই। তা সত্ত্বেও লাইন দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে একটা ধমক দিতে যাব, ওদিক থেকে মিহি গলায় ক্ষমা চেয়ে অপারেটর বলল, ‘ইটস ফ্রম ইয়োর ওয়াইফ, স্যার!’

ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারলুম না, ‘হ্যালো’ বলতে সময় নিলুম। কৃষ্ণা! কৃষ্ণা কেন! দুদিন কথাবার্তা বন্ধ থাকার পর এমন কি জরুরি দরকার পড়ল ওর, এখনই যে-জন্য ফোন করতে হল। তেমন কিছু বলার থাকলে ও বাড়িতেই বলতে পারত। কারণ, খুব ভাল করেই জানে কৃষ্ণা, সব কিছুর পরেও আমি বাড়ি ফিরি; ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায়, কর্তব্য ও করণীয় যা-কিছু সবই করি। ও স্বীকার না করুক, আমি তো জানিই আমার মধ্যে একটা ভাল মানুষ আছে, এখনও বেঁচে আছে।

এইসব চিন্তা সত্ত্বেও আমি কেমন কাতর হয়ে পড়লুম। যত অসময়েই হোক, কৃষ্ণা আমার স্ত্রী, আমাকে ফোন করছে ভেবে খুশিই হলুম আমি। আমার খুব লোভ হল কৃষ্ণা কি বলে শুনি।

এরপর আমাদের কথাবার্তার ধরন দেখেই আপনারা বুঝতে পারবেন আমি কি-রকম আছি।—

‘হঠাৎ ফোন করতে বাধ্য হলাম।’

‘বলো!’

‘তোমার গাড়িটা কি এখন পাওয়া যাবে? পেলে ভাল হয়।’

‘হঠাৎ!’

‘নিজের দরকারে বলছি না। মিসেস নন্দী চাইছিলেন ঘণ্টা তিনেকের জন্যে। ওঁদের গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছে।’

‘এভাবে বলছ কেন! তোমাকে কি দিই না!

‘পারবে কি না সেটাই বল?’

‘আমি তো ফিরবই কিছুক্ষণের মধ্যে। ভেবেছিলুম তোমাকে নিয়ে একবার নার্সিং হোমে যাব। ন’ কাকার অপারেশন—’

‘তাহলে পারবে না?’

‘হ্যাভ পেশেন্স!’ আমি প্রায় চিৎকার করে বললাম, তুমি কি ভাব, কৃষ্ণা, আমি একটা..’

ওপাশ থেকে রিসিভার নামিয়ে রাখার কঠিন, ধাতব শব্দ এল। শব্দটা কিছুক্ষণ আমার কানের পর্দায় লেগে থাকল, ক্রমে আমার মাথায়, আমার শরীরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। অপমানে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে ফোনটা নামিয়ে রাখলুম আমি।

জুলি তখনও চোখ নিচু করে আমার সামনে বসে রয়েছে। কৃষ্ণা নামটি ওর খুব চেনা। একবার অসুখে পড়ে আমি ক’দিন শয্যাশায়ী ছিলুম; সেই সময় অন্যান্যদের মতো জুলিও মাঝে মাঝে আমার খবর নিতে যেত। কৃষ্ণার সঙ্গে আলাপ করত। একদিন ওর মুখে ‘কিস্‌নডি’ ডাকটা শুনে মনে মনে আমি খুব হেসেছিলুম। সে প্রায় চার পাঁচ বছর আগের কথা।

আপাতত আমার গলার স্বর শুনে জুলি নিশ্চয় বুঝেছে আমি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ এবং আমার ক্ষোভের কারণ কৃষ্ণা ছাড়া আর কেউই নয়। ফলে লাজুক ও নম্র মেয়েটির মাথা আরও নিচু হয়ে গেল। আমার ব্যাপারে ও খুবই লজ্জিত।

রাগে ও উত্তেজনায় আমার কানের পাশে শিরা দবদব করছিল, সহজ হবার জন্য ঠোঁটে সিগারেট গুঁজে দেশলাই জ্বাললুম, আগুনের শিখায় অসাবধানে আমার নখ পুড়ে গেল। আমি পাবলুম না, চেষ্টা সত্ত্বেও একাগ্রতা আনতে পারলুম না। ড্রাফটের প্রথম অংশটা ততক্ষণে ভুলে গেছি, পরবর্তী বিষয় সম্পর্কেও কিছু মনে পড়ছে না। সবই কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল।

আরও বেশি বিড়ম্বনা এড়ানোর জন্যে ছুটি দিলুম জুলিকে। জুলি চলে যাবার পর বেল টিপে বেয়ারাকে ডাকলুম। বেয়ারা এলে স্বাভাবিক অথচ বিরক্ত গলায় বললুম, ‘দ্যাখো তো হে, রতন ড্রাইভার আছে কি না। থাকলে বলো আমার গাড়িটা বাড়িতে পৌঁছে দিতে। এই নাও চাবি। আর হ্যাঁ, শোন, আমার জন্যে একটা ট্যাক্সি ডাকো।’

আমি জানি, বাধ্য ও বশংবদ বেয়ারা এক্ষুনি আমার হুকুম তামিল করবে। ওরা আমাকে চেনে, ওরা সকলেই আমার কদর বোঝে, তাই আমার কোনও কথাতেই মাথা চুলকায় না। যতই দেরি হোক বা ছুটোছুটি করতে হোক, ট্যাক্সির দুর্ভিক্ষের সময়েও ও ঠিক আমার জন্যে ট্যাক্সি ধরে আনবে। ঘরে যেমনই থাকি না কেন, বাইরে আমি খুব সুখী। এই বয়সেই আমার কপালে যে কতকগুলো অবাঞ্ছিত ভাঁজ পড়েছে, খুঁটিয়ে দেখলে যে ঠোঁটের পাশে কুঁকড়ে-ওঠা মাংস চোখে পড়ে, বা, চোখের কোলে বিষণ্ণতার ছাপ, ওপরওয়ালারা সেগুলোকে অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফল বলেই জানে। আমাকে খুশি করার জন্য টপ-টু-বটম এখানে সকলেই সদা তৎপর। ফলে ট্যাক্সি আসবেই; আমি উঠে বসব। তারপর মন থেকে রাগ ও অপমান সম্পূর্ণ মুছে ফেলার জন্য প্রায়ই যা করে থাকি, আজও তাই করব।

ভাবতে ভাবতেই ট্যাক্সি এসে গেল। আমি উঠে পড়লুম। ট্যাক্সির পিছনের নরম গদিতে হেলান দিয়ে বসে চতুর্দিকের হট্টগোল, ট্রাম কি বাসের শব্দ এবং শশব্যস্ত ছুটোছুটির ওপর চোখ বুলিয়ে এ-সবের মধ্যে আমি কোথায় আছি, আদৌ আছি কি না, বা থাকলেও কেমন আছি—এক মুহুর্তে সব কিছু পরখ করে নিলুম। আমার বুকের মধ্যে একটা ফাঁকা নিশ্বাস হইচই করে উঠল। ব্যাপারটা ভাল লাগল না। তখন চোখ বন্ধ করে, গতি আগলে, অন্যমনস্ক হবার চেষ্টায় আমি ভাবলাম, আমিই নায়ক, আমার দুঃখটা বড়ই আধুনিক, আজকের যে-কোনও লেখক আমাকে নিয়ে দৈনিকে, সাপ্তাহিকে গল্প লিখতে পারে।

এমন সময় ঝাঁকুনি খেয়ে আমি নড়ে বসলুম। হঠাৎ ট্রাফিক পুলিশ হাত দেখিয়েছে। ট্যাক্সিওলা বোধহয় ফাঁকতালে বেরিয়ে যাবার মতলবে ছিল, পারেনি, জেব্রা ক্রশিংয়ের প্রায় আধাআধি ঢুকে পড়ে থেমে গেছে। আমার সামনে দিয়ে মানুষের অবাধ পারাপার, ট্যাক্সির অনধিকার প্রবেশ কেউ কেউ হয়তো তেমন সহ্য করতে পারছে না, ভুরু কুঁচকে দেখে নিচ্ছে আমাদের। আমায় দোষী কোরো না, বললুম মনে মনে, দু চোখ বন্ধ করে আমি এতক্ষণ গতি আগলে রাখার চেষ্টা করেছি। খুব ইচ্ছে ছিল তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরব, সুখী দম্পতির মতো নার্সিং হোমে দেখতে যাব ন’ কাকাকে। হল না। ফলে এখন আমি খুব আলাদা, সকলের চেয়ে আলাদা। ট্যাক্সিতে বসে আছি বলেই দুর্দান্ত সুখী নই। আমি জানি বাড়ি ফেরার চেয়ে বড় সুখ এই মুহূর্তে আর কিছুতে নেই। এইসব ভাবনার মধ্যে দেখলুম একটি পুষ্ট যুবতী, এক যুবকের গায়ে গা লাগিয়ে রাস্তা পার হতে হতে ঈষৎ ঝুঁকে তাকাল আমার দিকে, আলগোছে হাত তুলে নমস্কার করল যেন। আমিও মাথা নাড়লুম কিন্তু মেয়েটিকে ঠিক চিনতে পারলুম না। ওরা দূরে, ময়দানের ভিড়ে মিশে যেতে মনে পড়ল হঠাৎ, মেয়েটি কদিন আগেই ঢুকেছে আমাদের অফিসে। ইন্টারভিউয়ে অত্যন্ত সহজ একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে ঘেমে উঠেছিল—কেমন মায়া হওয়ায়, প্রায় জেদের বশেই আমি ওকে পাঁচজনের একজন মনোনীত করেছিলুম! আমার ইচ্ছে হল, মানে খেয়াল হল, ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করি ওকে, তুমি সেদিন মিথ্যে বলেছিলে কেন?

ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিতে আমি আবার মেয়েটির কথা ভাবলুম। কে কে আছে এর উত্তরে মেয়েটি বলেছিল বাবা, মা, ভাই, বোন। কিন্তু তোমার যে একজন প্রেমিক আছে, যাকে পেলে বাবা-মা-ভাইবোনকে অনায়াসে ভুলে থাকতে পার, ছুটির পর গায়ে গা লাগিয়ে হেঁটে যাও ময়দানের দিকে, সে-কথা তো বলনি। ভয় পেয়েছিলে? না কি লজ্জা? পরে মনে হল কি আবোল-তাবোল ভাবছি, এ-সব কেউ বলে নাকি! বরং সুযোগ পেলে একদিন মেয়েটিকে ডেকে বলব প্রেমিক সঙ্গে থাকলে কাউকে নমস্কার করার দরকার নেই, মাথা উঁচু করে হাঁটবে।

বাধ্য হয়েই নিজের সঙ্গে এই সব রগড়, রসিকতা করছিলুম আমি। আসলে আমি একটা কিছু ধরতে বা ভুলতে চাইছিলুম। ট্যাক্সিটা বার বার বাধা পাচ্ছে দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলুম।

ট্যাক্সি থামল। ভাড়া মিটিয়ে আমি বারের দিকে হাঁটি। আর একটু, আর একটু, আমার ভিতরের আমি বলে উঠল, ধৈর্য ধরো, আর একটু পরেই ভুলে যাবে বিকেলে কে তোমাকে ফোন করেছিল, তোমার স্মৃতিতে ফোন-রিসিভার নামিয়ে রাখার বিশ্রী, ধাতব শব্দ পীড়ন করবে না।

ভিড় কাটিয়ে বারের সিড়িতে পা দেব, হঠাৎ আমার জামার হাত ধরে কে যেন টানল। দু’দণ্ড চোখকে বিশ্রাম দিলুম আমি।

‘আরে, লাটুদা! কোথায় যাচ্ছেন?’

দেখি মুন্নি দাঁড়িয়ে আছে, চিমটি কাটার মতো করে ওর ফর্সা নিটোল আঙুল টেনে রেখেছে আমার সার্টের হাতা। ওর পাশের কিশোরীটিকেও দেখলুম। মুন্নির চেয়ে বয়সে কিছু বড়ই হবে, যুবতী হতে আর দেরি নেই। ওর পাশে বলেই মুন্নি আমার চোখে তীব্র হয়ে ধরা দিল।

‘মুন্নি যে!’ অবাক ভাব কাটিয়ে আমি হাসলুম। ‘কোথায় গিয়েছিলে?’

‘এই তো, সিনেমা দেখতে।’

দাঁত বের করে হাসল মুন্নি। আমি বুঝতে পারলুম না ওর পাতলা ঠোঁটের রঙটুকু ওর নিজস্ব, না ন্যাচারাল কালার ব্যবহার করেছে ও। দ্বিতীয়টি ভাবতে ভাল লাগল না। কত বড় হয়ে গেছে মুন্নি! মনে করার চেষ্টা করলুম, শেষ কবে ওকে দেখেছি। নীলার বিয়ের সময় কি? সে তো দেড় দু’বছর আগের কথ্য। না, অত দিন নয়, অত দিন নয়।

‘গীতশ্রী, আমার বন্ধু।’ মুন্নি ওর বান্ধবীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলল, ‘আর এই, লাট্টুদা।’

লাট্টুদা। নামটা মনে মনে উচ্চারণ করলুম, লাট্টুদা, লাট্টুদা। কতদিন পরে শুনলুম! নামটা পুরনো অথচ মনে হচ্ছে যেন নতুন শুনছি। মুন্নির কণ্ঠ আমার কানে মধু বর্ষণ করল। হাত বাড়িয়ে আমি ওর ঘাড়ের কাছে চুলের গোছা নেড়ে দিলুম। ‘মুন্নি, খুব ফাজিল হয়েছ!’

‘দিলেন তো নষ্ট করে!‘ আদরে কাঁধ ঝাঁকাল মুন্নি, চোখ ফিরিয়ে চুল দেখল। ওর বান্ধবী বোধহয় আমার সামনে অস্বস্তি বোধ করছিল। সত্যিই তো, আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেটা ফুটপাথ। বলল, ‘মুন্নি, আমি চলি রে। কাল দেখা হবে।’

‘কেন!’ মুন্নি প্রথমে বলল, তারপর দুরের দিকে তাকিয়ে কি দেখল যেন, ইঙ্গিতপূর্ণভাবে হাসল। ‘আচ্ছা যা। সোজা বাড়ি যাবি!’

মেয়েটি দাঁড়াল না। মুন্নির দৃষ্টি লক্ষ করে আমি দেখলুম, দুরে লাইটপোস্টের কাছে দাঁড়িয়ে প্যান্ট-পরা টেরিমাথা যে ছেলেটি এতক্ষণ আমাদের দেখছিল, গীতশ্রী তার সঙ্গ ধরে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

‘মুন্নি, তুমি বাড়ি যাবে কি করে?’

‘কেন, বাসে!’ মুনি অবাক ভাব দেখাল, ‘যাবেন আমাদের বাড়ি? চলুন না? মা প্রায়ই বলে। আপনি, কৃষ্ণাদি—কেউই তো আজকাল যান না!’

‘তোমার মা ভাল আছেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘বাবা?’

পাশ দিয়ে যেতে যেতে একজন ধাক্কা দিল মুন্নিকে। ইচ্ছে করেই। কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে মুন্নি আমার খুব কাছে সরে এল। হাত বাড়িয়ে আমি ওকে আমার গায়ের কাছে টেনে নিলুম। ভাগ্যিস লাগেনি! আমি দেখেছি, গুঁতোটা জোরেই মেরেছিল, লাগতে পারত। মুন্নির হাড় বড় কচি।

‘চলো।’ ফুটপাথে দাঁড়ানো ভাল নয় বলে আমি হাঁটার চেষ্টা করলুম, ‘তোমাকে কি বাসে তুলে দেব? বড় ভিড় যে এখন। তুমি যাবে কি করে?’

‘আপনি কোথায় যাবেন?’ পাল্টা প্রশ্ন করল মুন্নি।

‘কেন, তুমি কি একটু থাকতে পারবে আমার সঙ্গে। তোমাকে পেয়ে খুব ভাল লাগছে। থাকবে? দেরি হয়ে যাবে না?’

‘আপনি আমায় পৌঁছে দেবেন? বলব, আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আপনি গেলে মা খুব খুশি হবে।’

‘বেশ, পৌঁছে দেব।’

‘তাহলে একটা পাইনঅ্যাপেল খাওয়ান।’

মুন্নির চোখে চোখ পড়তেই আমার খুব হাসি পেল। হাসি চাপবার কোনও চেষ্টাই করলুম না আমি। মুন্নি যেন খুব অপ্রস্তুত হয়েছে, রাগবে কি হাসবে ভেবে পেল না। ঈষৎ ভুরু তুলে বলল, ‘হাসছেন যে বড়?’

‘এমনি। তুমি আমাকে এত প্রশ্ন কোরো না।’ একটু থেমে আমি বললুম, ‘শুধু পাইন আপেল খাবে? আর কিছু না? চল, আমার খুব ক্ষিদে পাচ্ছে। তুমি খেলে আমিও খাব।’

মুন্নি দু’ পা পিছিয়ে পড়েছিল। খুব দ্রুত হেঁটে এসে অনুযোগের গলায় বলল, ‘এত তাড়াতাড়ি হাঁটছেন কেন! বাব্বা, কি তাড়া! আমি পারব না বলে দিচ্ছি।’

‘এই নাও। আমি আস্তে হলাম।’

মুন্নির সুবিধের জন্যে আমি পা টিপে হাঁটতে লাগলুম। গরম লাগছিল। জুতোটা খুলে ফেলতে ইচ্ছে হল। কেউ কেউ তাকিয়ে দেখছিল আমাদের। আমি জানি, এখন আমার পাশে মুন্নিকে খুব বেমানান লাগছে। বয়স যতই হোক, আমার কপালে পরিশ্রমেব ভাঁজ, আমার চোখের কোলে স্পষ্ট বিষন্নতা, আমার লম্বা, ভারী শরীর আমাকে বয়স্ক করে তুলেছে। মুন্নিব কত হবে! চোদ্দ কি পনেরো, যে কেউই ওকে আমার মেয়ে বা ছোট বোন ভাবতে পারে। এই চিন্তায় আমার মনের ভিতর একটা আবেগের আলোড়ন শুরু হল। এখন আমি খুব সহজ ও স্বচ্ছন্দ বোধ করছিলুম।

‘চলো, মুন্নি, এই দোকানটায় ঢুকি। এখানে খুব ভাল আইসক্রিম পাওয়া যায়।’

‘ওঃ, লাভলি!’ মুন্নি হ্যাংলার মতন মুখ করে বলল, ‘আপনি কি খাবেন? দো পেঁয়াজি?’

শুনে গলা ছেড়ে হেসে উঠলুম আমি। মুন্নি ভুরু কোঁচকাল, ‘হাসছেন কেন! আমাকে খুব হ্যাংলা ভাবছেন নিশ্চয়। তাহলে কিন্তু যাব না আপনার সঙ্গে।’

‘না, চলো। তোমাকে আমার খুব দরকার এখন।’

‘কেন?’

আমি চুপ করে থাকলুম। কেন-র উত্তর আমার জানা নেই।

আইসক্রিম খেতে খেতে মুন্নি আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কেন দরকার বললেন না তো? কি করবেন আমাকে নিয়ে?’

‘অনেকক্ষণ আটকে রাখব। তোমার কি খারাপ লাগছে?’

‘নাঃ। খুব ভাল লাগছে।‘ মুন্নির ঠোঁটের কোনায় আইসক্রিমের দুধ লেগে আছে। খুব আস্তে আঙুল বাড়িয়ে আমি সেটা মুছে দিলুম। ওর নরম শরীরের হালকা সুবাস আমার নাকে লাগল। মনে পড়ল, ওর অন্নপ্রাশনের দিন ওকে কোলে নিয়ে আমি একটা ছবি তুলিয়েছিলুম। ছবিটা এখনও আছে আমার অ্যালবামের মধ্যে। মুন্নি এখন শাড়ি পরে, একা ম্যাটিনি শো’য় সিনেমা দেখতে যায়। ভাবতেই কেমন অবাক লাগে!

‘আচ্ছা, লাট্টুদা—’ যেন হঠাৎ কিছু মনে পড়ছে এইভাবে চোখ তুলে আমাকে দেখল মুন্নি, ‘আপনি বুঝি মদ খান?

‘কেন!’

‘তাহলে ওই দোকানটায় ঢুকছিলেন কেন!’ হাতের উল্টো পিঠে ঠোঁট মুছল মুন্নি। ‘ওটা তো মদের দোকান। গাড়ি দাঁড় করিয়ে বাবা একদিন ওখানে ঢুকেছিল। বাবাও তো খায়।’

আমি একটু দ্বিধায় পড়লুম। মনে হল এই প্রশ্নটা আমার সাবধানে এড়িয়ে যাওয়া উচিত। আমি জানি না, ব্যাপারটা মুন্নি কোন চোখে দেখবে। যদি খারাপ ভাবে! না, মুন্নিকে আমি আমার সম্পর্কে খারাপ কিছু ভাবতে দেব না। আমি কৌশলে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলুম।

‘তুমি একা সিনেমা দেখতে গিয়েছিলে কেন? ভয় করে না?’

‘একা!’ অবাক চোখে দেখল আমাকে মুন্নি। ‘আহা, একা কেন হবে। ওই তো গীতু ছিল।’

‘ওই ছেলেটাও বুঝি সঙ্গে ছিল?’

‘কোন ছেলেটা!’ এক পলক আমার চোখে চোখ রেখে কি ভাবল মুন্নি। তারপর হেসে ফেলল। ‘ওঃ, আপনি দেখে ফেলেছেন বুঝি! ও দীপকদা, গীতুর লাভার। বিচ্ছিরি!’

‘কে!’

‘ওই ছেলেটা। অ্যালবার্ট কাটে, পয়েন্টেড শু পরে। ওই তো রোগা পাতলা চেহারা। আমার একদম ভাল লাগে না।’

‘তোমার কোনও লাভার নেই?’

‘যাঃ’, মুন্নির চোখে-মুখে লজ্জার ছায়া পড়ল। ও কেঁপে উঠল অল্প, একটু নড়ে বসল। ওর গলার পিছনে সোনালি লোমগুলো আমার চোখে পড়ে, সদ্য গজিয়ে-ওঠা পাখির রোমের মতো ফুরফুরে, ইচ্ছে হল ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিই। কিন্তু, বুঝতে পারছি এখন এমন কিছু করা উচিত নয়, যাতে ও আরও নুয়ে পড়ে। বড়ই সরল এই মেয়েটা, কেমন অনায়াসে সব কথা বলে ফেলে একটু দ্বিধা না রেখে!

মুন্নি চোখ তুলল না অনেকক্ষণ, আইসক্রিমের প্লেটে গলা দুধের দিকে তাকিয়ে থাকল। মজা করার জন্য টেবিলের ওপর রাখা ওর হাত, হাতের বালাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে আমি বললুম ‘মুন্নি, আমি তোমার লাভার হতে পারি না? দ্যাখো, আমি টেরিও কাটি না, পয়েন্টেড শু-ও পরি না। আমাকে তোমার পছন্দ হয় না?’

‘যাঃ,’ সকৌতুকে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে এক পলক দেখে মুন্নি হেসে ফেলল, ‘তা কি করে হয়। আপনি তো লাট্টুদা।

‘দোষ কি!’ আমি বললুম, ‘দীপকদা লাভার হতে পারে, লাট্টুদা কেন পারে না!’

‘জানি না বাবা।’

হুট করে জবাব দিয়ে খানিক কি ভাবল মুন্নি। বাঁহাতের কড়ে আঙুলটা মুখের ভিতর পুরে দিয়ে, নখ কাটতে কাটতে আড়চোখে দেখল আমাকে।

‘আপনার তো কৃষ্ণাদি আছে। আপনি কোন দুঃখে আমার লাভার হবেন!’

মুনি আমার ঠিক সেই ব্যথার জায়গাটায় ঘা দিল। সেই নাম উচ্চারণ করল, ও জানে না, যে-নাম ভুলবার জন্যে আমার মুল্যবান সময়, আমার ভয়ঙ্কর গম্ভীর মন আমি মুন্নির কাছে সমর্পণ করেছি। মুন্নি জানে না, এই মুহুর্তে আমি কি ভীষণ অসহায়, আমি যা বলছি সবই বানিয়ে বলছি। বলছি জোর করে। আমার কোনও কথাই কথা নয়।

‘কি হল! লাট্টুদা আপনি ঘামছেন কেন? এবার যাবেন তো?’

‘যাব।’ নিশ্বাস সামলে আমি বললুম, ‘বড্ডো গরম লাগছে, মুন্নি। তুমি টাই খুলতে পার? দাও না খুলে?’

মুন্নি দ্বিধা করল না। আমার বুকের কাছে মাথা নিয়ে এসে টাইয়ের নট খোলার জন্য হাত বাড়াল। ওপরে চোখ তুলে আমি দেখলুম, সিলিং পাখাটা ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস শব্দ করে অবিরাম ঘুরে চলেছে। রেস্টুরেন্টের নানা শব্দ আমার কানে এল। আমি চোখ বন্ধ করলুম। আমার কানে আমার নিজেরই কণ্ঠস্বর গুঞ্জন তুলল, হ্যাভ পেশেন্স, হ্যাভ পেশেন্স। মুন্নির সিল্কের চাদরের মতো নরম চুল সুন্ধু মাথাটা আমার চিবুকের কাছে আটকে আছে। গলায় বুকে আমি ওর গরম নিশ্বাসের স্পর্শ পাচ্ছি। আমি একটা অবাস্তব সুখের কথা ভাবলুম।

‘মাকে যেন বলবেন না আমি সিনেমা গিয়েছিলুম।’

‘বেশ, বলব না।’ টাইটা ভাঁজ করে পকেটে ভরতে ভরতে বললুম, ‘বলব, তোমার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল, রাস্তায়, তোমাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলুম।’

‘ইস, মার সঙ্গে যদি হঠাৎ কৃষ্ণাদির দেখা হয়ে যায়! তাহলে কৃষ্ণাদিকেও শিখিয়ে দেবেন।’

কৃষ্ণাদি! কৃষ্ণাদি! আমার ইচ্ছে হল, ঠাস করে মুন্নির গালে একটা চড় কষিয়ে দিই। মুনি, তুমি এত বাচাল কেন! এখন তুমি আমার সামনে আছ, শুধু কি আমার কথা ভাবতে পার না! যদি না পার, চুপ করে থাক। আমাকে ভাবতে দাও!

নিজেকে গোপন করে আমি বললুম, মুন্নি, আজকে যেমন হঠাৎ তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, তেমনি ‘রোজ হতে পারে না?’

‘ওরেব্বাস, তাহলেই হয়েছে! রোজ রোজ?’ মুন্নি যেন কথাটার অর্থ ঠিক ধরতে পারল না, ‘রোজ দেখা হয়ে কি হবে?’

‘এমনি। আমরা বেড়াব, আইসক্রিম খাব। তারপর ধরো, সিনেমাতেও যেতে পারি। তোমাকে আমার খুব দরকার কি না—’

চোখ বড় করে মুন্নি আমার পাগলামি-মার্কা কথাগুলো শুনল। কি ভাবল একটু। তারপর বলল, ‘রোজ হবে না। এক একদিন আসব।’

‘ভেরি গুড।’

মুন্নির ফর্সা, নরম হাতটা আমি মুঠোর মধ্যে চেপে ধরলুম। ইচ্ছে হল গুড়িয়ে ফেলি। সেই অবস্থায় দেখলুম মুন্নির চোখে কেমন একটা ছায়া পড়েছে, নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। হাতটা ছাড়িয়ে নেবার কোনও চেষ্টা করল না মুন্নি।

‘একটা কথা বলব?’ ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললুম আমি, ‘তোমাকে আমার খুব ভাল লাগছে এখন। একটা চুমু খেতে দেবে?’

‘যাঃ, অসভ্য।’ মুন্নি সরে গেল একটু, ওর ঠোঁট কাঁপল। ‘আমি কিন্তু চলে যাব।’

‘তাহলে থাক।’ আমি বললুম, ‘তোমার যখন ইচ্ছে করছে না। তুমি আমাকে একেবারেই পছন্দ করো না দেখছি!’

‘আপনার খুব ইচ্ছে করছে?’ দূর থেকেই হঠাৎ বলল মুন্নি, গলার স্বরে তেমন কোনও পরিবর্তন নেই। তারপর একটু অপেক্ষা করে আমি জবাব দিচ্ছি না দেখেই বোধহয় বলল, ‘শুধু একবার তো? ঠিক বলছেন?’

‘বেশ, একবারই।’ লঘু গলায় বললুম আমি। মুন্নির কথা শুনে হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠতে ইচ্ছে করল আমার। কোনওরকমে হাসি চেপে মুন্নিকে দেখলুম আমি। ও কিছু ভাবছে।

পর্দা সরিয়ে কেবিনের বাইরে উঁকি দিয়ে কি দেখল মুন্নি। ক’ মুহূর্ত। মুখটা আবার ভিতরে টেনে নিয়ে বলল, ‘এখানে নয়। তাহলে আপনাকে ট্যাক্সিতে যেতে হবে।’

‘কেন, ট্যাক্সি কেন!’ মুন্নি আমাকে অবাক করে দিল। ‘কেউ বুঝি তোমায় ট্যাক্সিতে নিয়ে গিয়ে চুমু খেয়েছিল?’

‘আহা, আমাকে কেন!’ হাত দিয়ে মুন্নি আমাকে ঠেলল। ‘গীতু বলেছে, দীপকদা একদিন ওকে ট্যাক্সিতে..’

‘ও, বুঝেছি, বুঝেছি।’ আমি তাড়াতাড়ি বললুম, ‘তাহলে চলল। ট্যাক্সিতেই না হয় হবে। তারপর তোমাকে বাড়ি পৌছে দেব।’

আমি বেয়ারাকে ডাকলুম। সিগারেট ধরিয়ে বিলের টাকা দিয়ে বেরিয়ে এলুম বাইরে। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে কত তাড়াতাড়ি একটা ট্যাক্সি পাওয়া যায় তার চিন্তা করতে লাগলুম। দেরি হয়ে যাচ্ছে। মুন্নির তাড়াতাড়ি ফেরা দরকার।

তখন আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ভয়-মাখানো মৃদু গলায় মুন্নি বলল, ‘আপনি কিন্তু কৃষ্ণাদিকে বলবেন না কিছু!’

‘দূর, পাগলি! এ-সব কেউ বলে!’

আলতোভাবে হাতের আড়াল দিয়ে মুন্নিকে আগলে রাখলুম আমি। আর মনে মনে বললুম, ভিতু মেয়ে। অত ভয়ের কি আছে। আমি কি সত্যি সত্যিই তোকে চুমু খাব নাকি। বরং এখন অনেকক্ষণ তোকে নিয়ে ঘুরব। যেখানে ইচ্ছে, যেখানে খুশি। আমি জানি, ঘুরতে ঘুরতে আবার আমি সেই একই জায়গায় ফিরে আসব। আমার পরিত্রাণ নেই। জানি, আজকের এই দেখা হওয়াটাও খুব মিথ্যে। তোর সরল, নিস্পাপ জগৎ থেকে আমি যে অনেক দূরে পড়ে আছি, মুন্নি!

২৮ মে ১৯৬৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *