মুনাফার জন্মকথা
কিন্তু কথা হলো, মালিকদের ওই মুনাফাটা ঠিক কোথা থেকে আসে?
মালিকরা মাথা খাটিয়ে কারখানা ফাঁদে। মুনাফা কি ওই মাথা-খাটানো থেকে জন্মায়? কারখানায় মালিকদের টাকা খাটে। মুনাফাটা কি ওই টাকা খাটানো থেকে জন্মায়? শ্রমিকেরা কারখানায় গতির খাটায়। মুনাফাটা কি ওই গতর খাটানো থেকে জন্মায়?
এই প্রশ্নের কিনারা করতে হবে। কিন্তু কিনারা করতে গেলে আর একটা কথা খুব ভালো করে বোঝা দরকার : ‘দাম’ মানে কী? কোনো একটা জিনিসের দাম ঠিক কিসের ওপর নির্ভর করে?
চলতিভাবে আমরা বলি, হাওয়া খুব দামী জিনিস, কেননা হাওয়া না হলে আমাদের প্রাণ বাঁচে না। তার মানে, আমাদের কাজে লাগে, তাই হাওয়ার দাম আছে। কিন্তু দাম বলতে আমরা শুধুই তো এই ‘কাজে-লাগার’ কথাটুকুই বুঝি না। কেনা-বেচার কথাও বুঝি, লেনদেনের কথাও বুঝি। যেমন ধরো, আমি দোকানে গিয়ে একটা কলমের দাম জিজ্ঞেস করলাম, দোকানদার বললো : দু’টাকা। তার মানে কি কলমটা আমার কতোখানি কাজে লাগবে এটা তারই হিসেব হলো? মোটেই নয়। কলামটা তো আমার দারুন কাজে লাগবে-কলম না হলে আমি একছরও লিখতে পারবো না, লিখতে না পারলে আমার সংসার চলবে না। কিন্তু শুধু দু-টাকা দিয়েতো আর এতোখানি কাজে লাগবার হিসেব হয় না। অথচ কলমটার দামতো দু-টাকাই। কেউ ধরো শখ করে তার কচি ছেলেকে কলম কিনে দিতে চাইলো। কচি ছেলেতো কলমটা কামড়ে কামড়ে শেষ করে দেবে। কাজে লাগার দিক থেকে কতো কম দাম। তবুও তাকেও ওই দু-টাকা দিয়েই কলমটা কিনতে হবে, কলমটার দাম যে তাই। কিন্তু কোন দিক থেকে দাম? কেনা-বেচার দিক থেকে, লেনদেনের
দিক থেকে। কাজে লাগবার দিক থেকে নয়। আসলে কাজে লাগার দিক থেকে যে দাম তা নিয়ে কোনো হিসেব-পত্তর করা চলে না। শুধু লেনদেনের দিক থেকে যে দাম তাই নিয়েই হিসেব-পত্তর করা যায়। যেমন ধরো, একবার একজন কোটিপতি সওদাগর মরুভূমির মধ্যে বিপদে পড়ে গিয়েছে, এক ঘটি জল পেলে তার প্রাণ বাঁচে, নইলে নয়। কাজে লাগার দিক থেকে তাই তখন তার কাছে এক ঘটি জলের দাম কোটি টাকার চেয়ে বেশি। কিন্তু তাই বলে কি হিসেব করে বলা যায় এক ঘটি জলের অতোখানিই দাম?
যে দামটা নিয়ে হিসেবপত্তর করা যায়, ‘দাম’ বলতে সেই দামিটার কথাই বুঝতে হবে। অর্থাৎ কিনা, কেনাবেচার দিক থেকে দাম, লেনদেনের দিক থেকে দাম। একটা কলমের দাম হয়তো দু-টাকা আর একটা হাওয়া-গাড়ির দাম হলো এক লাখ টাকা। কিন্তু কেন? একটার দাম দু-টাকাই বা কেন আর একটার দাম লাখ টাকাই বা কেন? কেননা, কলমটিকে তৈরি করতে মেহনত লাগে সামান্যই, কিন্তু হাওয়াগাড়ি তৈরি করতে মেহনত লাগে ঢের বেশি। তার মানে, যে-জিনিসটার পেছনে যতো বেশি মেহনত সেই জিনিসটার দামও ততো বেশি।
যেমন ধরো, বছর পঞ্চাশ আগেও রুপোর চেয়ে অ্যালুমিনিয়ামের দাম অন্তত আট-দশগুণ বেশি ছিলো। কেননা তখন অ্যালুমিনিয়াম তৈরি করতে ভয়ানক মেহনত লাগতো। কিন্তু তারপর অ্যালুমিনিয়াম তৈরি করবার খুব সোজা কায়দা বের হয়েছে; অনেক কম মেহনত দিয়েই আজকাল অ্যালুমিনিয়াম তৈরি করা যায়। তাই আজকাল রুপোর চেয়ে অ্যালুমিনিয়ামের দাম এতো সস্তা হয়ে গিয়েছে।
আর, যদি মেহনতের ওপরই একটা জিনিসের দাম নির্ভর করে তাহলে পয়সাকড়ির চেয়ে বরং মেহনত দিয়েই একটা জিনিসের দাম বাতলানোই ঠিক হবে। না কি? আমরা অবশ্য সাধারণত তা বোঝাই না। তাই শুনতে খানিকটা অদ্ভুত লাগবে। যেমন ধরো, কলমটার দাম আর দু-টোকা না বলে আমি হয়তো বলবো : এক মিনিটের মেহনত। তার মানে, কলমের কারখানায় একজন শ্রমিক মিনিটে একটা করে কলম তৈরি করতে পারে। এই অনুপাতে হাওয়া-গাড়িটার দাম হয়তো হবে, চৌষট্টি হাজার ঘন্টার মেহনত। তার মানে, হাওয়া-গাড়ি তৈরির কারখানায় একজন শ্রমিক চৌষট্টি হাজার ঘন্টা খাটলে ওই রকমের একটা হাওয়া-গাড়ি বানাতে পারবে। অবশ্য কারখানায় তো আর একজন শ্রমিক আগাগোড়া একটা গাড়ি বানায় না? হয়তো এক হাজার শ্রমিক প্রত্যেকে চৌষট্টি ঘন্টা করে খেটে হাওয়া-গাড়িটা তৈরি করছে। তাই ওই মোট মেহনত বলতে বোঝা উচিত অনেকে মিলে সবাশুদ্ধ যত ঘন্টা মেহনত করছে, তাই-ই।
মেহনতের দরুনই দাম। এই কথাটা মনে রেখে চলো এইবার একটা কারখানার হিসেব দেখা যাক। ধরো, একটা কাপড়ের কারখানা। কাপড় তৈরি করবার জন্যে মালিককে প্রথমে নগদ কিছু খরচ করতে হবে: কাঁচামালের (তুলো) দাম বাবদ খরচ, তেল-
কয়লার দাম বাবদ খরচ, দিনমজুরদের মজুরির দাম বাবদ খরচ, কলকব্জাগুলো খাটতে খাটতে জখম হবে তাই তার দাম বাবদ ও খরচ। মালিকের হালখাতায় অবশ্য ওইসব দাম গুলো টাকা-কড়ি দিয়ে লেখা থাকে, কিন্তু আমরা তো দেখছি দাম বলে ব্যাপারটা আসলে মেহনতেই দরুন। তাই আমরা মালিকদের খাতায় খরচের দিকটা একটু অন্য রকম ভাষায় লিখবো। ধরো, পাঁচশো হাত কাপড় তৈরি করবার জন্যে মোট খরচ হবে :
তুলো (কাঁচা মাল) : ১৫০০ ঘন্টা মেহনতের দাম
তেল-কয়লা : ২৫০০ ঘন্টা মেহনতের দাম
কলকব্জার জখম বাবদ : ২৫০ ঘন্টা মেহনতের দাম
দিনমজুরদের মজুরি : ১৫০০ ঘন্টা মেহনতের দাম
মোট : ৩৫০০ ঘন্টা মেহনতের দাম
তারপর এই তৈরি কাপড়গুলো বাজারে বেচা হবে। কিন্তু ৫০০ হাত কাপড় নিশ্চয়ই মোট ৩৫০০ ঘন্টা মেহনতের দরে বেচা হবে না, তৈরি কাপড়গুলোর দর অনেক বেড়ে গিয়েছে। তাই, ৫০০ হাত কাপড় হয়তো মোট ৫০০০ ঘন্টা মেহনতের দরে বেচা হবে। আর তারপর মালিকের হালখাতায় লেখা হবে?
মোট আদায় : ৫০০০ ঘন্টা মেহনতের দাম
মোট খরচ : ৩৫০০ ঘন্টা মেহনতের দাম
মোট লাভ : ১৫০০ ঘন্টা মেহনতের দাম
মালিক বলবে, এই তো মজা। আগে পয়সা ফেললাম, পরে পয়সা কুড়োলাম, মাঝখান থেকে লাভ হয়ে গেলো। কিন্তু কথা হচ্ছে, ঐ লাভটা এলো কোথা থেকে? পয়সাতো আর সত্যিই কুমড়ো-বীজের মতো নয় যে মাটিতে ছড়ালেই গাছ গজাবে আর তাতে ফল ফলবে। তাহলে? লাভটা এলো কোথা থেকে? কাঁচা মাল থেকে? মোটেই নয়। যদি ১৫০০ ঘন্টা মেহনতের দাম দিয়ে তুলো কেনা হয় তাহলে তার দাম তাই থেকে যাবে। তেল-কয়লার বেলাতেও তাই, কলকব্জার আয়ুক্ষয়ের বেলাতেও তাই। কলকব্জার ব্যাপারটা নিয়ে একটু গোলমাল লাগতে পারে, মনে হতে পারে মালিকের লাভটা বুঝি আসলে ওখান থেকে আসছে। তাই এই ব্যাপারটা ভালো করে বোঝা দরকার। ধরো, দশ হাজার ঘন্টা মেহনতের দাম দিয়ে একটা কল কেনা হলো। কিন্তু কলটা তো আর চিরকাল চলবে না, চলতে চলতে খারাপ হয়ে যাবে। আর শেষ পর্যন্ত অচল হয়ে যাবে। তাই কলটার একটা পরমায়ু আছে। ধরো, এই কলটার পরমায়ু হলো দশ হাজার ঘন্টা। তার মানে, কলটা প্রতি ঘন্টা চলবার দরুন তার দাম কমবে-এক ঘন্টা মেহনতের যা দাম সেই দাম কমবে। ওটাই হলো কলটার আয়ুক্ষয় বাবদ খরচ। তাহলে দেখতেই পাচ্ছে, কলটা যতো। চলবে ততোই তার দাম কমবে। দাম কিছুতেই বাড়তে পারে না। তাই কারখানা চালানোর যে-লাভ তা কলকব্জাগুলো চালাবার দরুন হতে পারে না। কল চালানোটা খরচের ব্যাপার, লাভের ব্যাপার নয়।
অথচ, লাভ তো হলো! কোথা থেকে এলো এই লাভ? কাচা মাল থেকে নয়, তেল-কয়লা থেকে নয়, কলকব্জা থেকে নয়। তাহলে? বাকি থাকে তো শুধু আর একটা ব্যাপার : মজুরদের মেহনত। তার মানে, লাভ যা হলো তা ওই মজুরদের মজুরি থেকেই এলো।
ভারি মজার জিনিস মজুরদের এই মেহনত। মালিকেরা অন্য সব জিনিস যেদরে কেনে সেগুলোর সেই দরই থেকে যায়। কেবল মজুরদের মেহনতের বেলায় তা নয়। এই জিনিসটাও মালিক নগদ পয়সা দিয়ে কেনে, কিন্তু এটাকে কাজে লাগাবার পর এর দাম বেড়ে যায়। আর, যতোটুকু বাড়ে ততোটুকুই মালিকের মুনাফা; ওই বাড়তি দরটুকুই লাভ। মুনাফাকে তাই ফালতু দর বলতে পারো। এখন, এই ফালতু দরটা।–মুনাফাটা— ঠিক কেমনভাবে সৃষ্টি হয় তাই দেখা যাক।
মালিক যখন কারখানার কাজে একজন মজুরকে বহাল করেছে তখন ঠিক করে নিচ্ছে তার মেহনত বাবদ একটা দাম দেওয়া হবে। কিন্তু মোহনতের দামটা কী হবে? শুধু ততোটুকু পয়সা যেটুকু না হলে মজুরের জান বাঁচবে না। মজুরের জান যদি না বাঁচে তাহলে কারখানাটা চালাবে কে? কারখানা তো আপনি-আপনি চলবে না। তাই মেহনত বাবদ ওইটুকু পয়সা দিতেই হয়। কিন্তু তার বেশি নয়। তারপর মজুর গিয়ে কারখানায় কাজ শুরু করলো। আর দেখা গেলো, সারা দিনের মেহনত বাবদ তাকে মোট যেটুকু দাম দেওয়া হয়েছে তার সবটাই উশুল হয়ে যায় তার প্রথম ক-ঘন্টা মেহনত থেকেই। তার মানে, বাকি দিনটা ধরে সে যে-মেহনত করবে: তার দরুন সে কোনো দাম পাবে না। অথচ, তার বাকি দিনটার এই মেহনতের দরুন কারখানায় জিনিস তো তৈরি হচ্ছে। সেই জিনিসের দাম আছে; ওই দামিটার জন্যে মালিকের কোনো খরচ নেই। তাই ওই দামটাই মালিকের নগদ লাভ।
ধরো, একটা কারখানায় মজুরকে বহাল করা হলো। ঠিক হলো, সে দশ ঘন্টা করে খাটবে। আর দশ টাকা করে মজুরি পাৰে। দশ টাকা মজুরি মানে কি? দশ টাকা দিয়ে যে-জিনিস কেনা যায় তারই দাম তো! সেই জিনিস তৈরি করতে হয়তো পাচ ঘন্টার মেহনত লাগে। তার মানে, দশ ঘন্টা ধরে খাটবার দরুন মজুর পাবে পাঁচ ঘন্টা মেহনতের দাম। তাই তার বাকি পাঁচ ঘন্টার যে-মেহনত সেই মেহনতের দাম সে পাবে না। তধু ওই ফালতু পাঁচ ঘন্টা মেহনতের ফলে কিছু তো তৈরি হবে, তার তো একটা দাম আছে। সেই দামটা পাবে মালিক। সেটাই তার লাভ ।
মালিক যখন মেহনতের দাম দিচ্ছে তখন মেহনতটার আসল দর কতো হওয়ার কথা সে-হিসেব অনুসারে তো দাম দিচ্ছে না; কতোটুকু না হলে মজুরের জান বাঁচে না। শুধু সেইটুকু হিসেব করেই দিচ্ছে! অথচ, মজুর তার মেহনত দিয়ে অনেকখানি বাড়তি জিনিস তৈরি করতে পারে।–নিছক নিজের বেঁচে থাকবার জন্যে যতোটা জিনিসের দরকার তার চেয়েও অনেকখানি বেশি। এই বাড়তি জিনিসের একটা দাম আছে। সেই দামটাই হলো মালিকের লাভ।