৭
মনে আছে এরপর সুনন্দা মরমে মরে থাকল। সে আর কোথাও যেত না। জেলা উৎসব থেকে বাদ যাওয়া তাকে দমিয়ে দিয়েছিল। সে আর আমাদের অফিসার্স ক্লাবে কখনও গান গাইতে যায়নি। জেলা মেলায় বাদ, জেলা শাসকের বউ তার মধু মাখা গান পছন্দ করেন না, তা জেনে তার গানের অনুরাগীর সংখ্যাও কমতে লাগল একটু একটু করে। যতদিন ছিলাম এরপর আমার হাত থেকেও চলে যেতে লাগল ক্ষমতার দায়িত্বগুলি।
মজুমদারকে আমি বললাম, সে তো নিজের জন্য গাইত।
ওঁকে গাইতে হবে এবার, কী চমৎকার গলা ওঁর, মল্লিক সায়েব খুব পছন্দ করতেন ওঁর গান। অম্লান মুখে বলল মজুমদার। সে পুরোনো কথা সব ভুলে গেছে। বলছে, সায়েবরা হলেন গার্জেন, তাঁদের কথা মতো চললে কোনো অসুবিধা হয় না।
আমি বললাম, অচিনপুর থেকে আসার পর সুনন্দা আর কখনও কোথাও গান শোনায় না।
তা বললে হবে দাদা? সব কথা মনে রাখতে নেই। বউদি তো আসলে ভালো গাইতেন। মল্লিক সায়েব বলেছেন ওঁর কথা। তিনি বউদিকে মনে রেখেছেন এখনো, অচিনপুর বলতেই বড়ো ম্যাডামের গান, তারপর বউদির গান, আপনার বক্তৃতা, অনিকেত সান্যালের আবৃত্তি, প্রবীর রায়ের অভিনয়, সব মনে রেখেছেন। আমরা ওকে সংবর্ধনা দেব শুনে কী খুশি। বলেছেন সবাইকে হাজির করতে, প্রবীর রায় বেঁচে নেই শুনে কী দুঃখ করতে লাগলেন, গ্রেট ম্যান উনি, না হলে আমাদের কথা এমনভাবে মনে রাখতে পারেন।
সুনন্দা নেমে এল চা নিয়ে। বসল হাসি মুখে, তারপর প্রস্তাব শুনে বলল, স্যরি, মজুমদারদা, আমি গান ছেড়ে দিয়েছি, এখন যা হবে সব বেসুরো।
তাই-ই হবে ম্যাম, আপনি বেসুরো গাইতে পারেন না। সম্বোধন বারবার বদলে দিচ্ছে মজুমদার। আমার মনে পড়ছে সুনন্দাকে জেলা উৎসব থেকে বাদ দিয়ে মজুমদারের সেই ভঙ্গী। সব ভুলে গেছে মজুমদার। সায়েব আমার চাকরির ক্ষতি করে দিলেন তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করে, তাও! সে আমার বিরুদ্ধে রিপোর্ট দিয়েছিল। ডি.এম. যেমন বলেছিল ঠিক তেমন লিখেছিল। কী করে এল মজুমদার এই কথা নিয়ে? কী রকম নিষ্পাপ মুখ ওর! যেন অতীতে কিছুই হয়নি।
আমি তো জানি কী হবে, আপনারা আর কাউকে ঠিক করুন। সুনন্দা তীক্ষ্ণ গলায় বলল।
ঠিক তো হয়েই গেছে, লোকনাথ মল্লিক সায়েবই বলে দিয়েছেন, উনি এম. পি. ওঁর ইচ্ছাই তো শেষ কথা।
সুনন্দা বলল, না কত বড়ো বড়ো গায়ক আছেন, উনি বললেই তাঁরা চলে আসবেন।
সে তো জানি ম্যাম, কতজন ওঁর কাছে ঘুরঘুর করে, এই যে বিদেশে বঙ্গ-উৎসব হয়, উনি প্রায় সবকটির অ্যাডভাইসার, শুধু কি সিঙ্গার, রাইটার, অ্যাক্টর, সবাই ওঁর কাছে অবলাইজড, সকলে ওঁর পিছু পিছু ঘোরে। আর উনি যে কতজনকে বিদেশ ঘুরিয়ে এনেছেন।
আমার সে লোভ নেই মিঃ মজুমদার। সুনন্দার সম্বোধন বদলে গেল।
মজুমদারের উপর সন্তুষ্ট ছিল না সুনন্দা। অচিনপুরে কথা এখনো মনে পুষে রেখেছে। জেলা উৎসব থেকে বাদ দিয়ে এই লোকটা কী অনায়াসে বলে দিয়েছিল, হার হাইনেস শান্তিনিকেতনে পড়াশুনা করা, গানও ওখানে শেখা, তাঁর ডিসিশনই ফাইনাল, লিস্ট তিনি করেছেন,তার মতো কে পারবে? কেউ না। ডি.এম-এর বউকে যে হার হাইনেস বলতে হয় তা মজুমদারই জানিয়েছিল প্রথম। মিসেস মল্লিকের গাওয়া গানে রবীন্দ্রনাথের বাণীর ভুল পরিবেশন হচ্ছে, সুনন্দার তা বলা ঠিক হয়নি মজুমদারের কাছে। মজুমদার তা বলে দিয়েছিল বড়ো ম্যামের কাছে। বলে আরো বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছিল জেলা শাসকের স্ত্রী কাছে। জেলা শাসকের কাছেও। তার ক্ষমতাও বাড়ল তখন। হাঁটা চলা বদলে গেল, হাতে মাথা কাটতে পারত সে তখন। নানাজনকে নানা উপদেশ দিত, চাকরি কী ভাবে করতে হয় তা মজুমদার দেখিয়ে দিয়েছিল। আমি ওকে এড়িয়ে চলতাম।
কিন্তু এই মজুমদারই তো অনেকদিন পরে আমার জমি পাওয়ায় সুবিধে করে দিয়েছিল। বলেছিল, দেখ বাসু, বেঁচে থাকা একটা লড়াই, কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছেড়ে দেয় না, আমি যা করেছি, প্রয়োজনে করেছি, এখনো তাই-ই করছি, হ্যাঁ, তোমার জমি আমি বের করে দেব, বিনিময়ে কিছুই নেব না। সব হল বউদির জন্য, উনি অচিনপুর থেকে মন খারাপ করে ফিরেছিলেন। মজুমদার দুঃখ প্রকাশ করেছিল, যা হয়েছিল সব ভুলে যাও।
একটা জীবন। ব্যাপ্তি এর বছর পঁয়তিরিশ, চাকরি জীবন তো ওইটুকুই। জীবন ভোগের সময়ও ওইটুকু। এই সময়েই যত ক্ষমতা, আর সেই ক্ষমতার নানারকম রূপ আস্বাদ। প্রয়োজনে ব্যবহার। জেলায় জেলায় ভ্রমণ। সম্পদ অর্জন, ভাগ্যের হাতে মার খাওয়া — সব।
মজুমদার বলল, ওটা আমার অভ্যাস ছিল ম্যাম, আমি আমার বসকে সন্তুষ্ট করতে সব কিছু করতে পারি, করা উচিৎ। করলে সার্ভিস লাইফ ভালো হয়, আপনি চলুন। স্যার সকলকে সস্ত্রীক যেতে বলেছেন, খুব খুশি হবেন স্যার।
উনি কি এখনও আপনার বস?
বলতেই পারেন ম্যাম, বস তো বসই, এখন তিনি এম. পি. মোর পাওয়ারফুল।
ওঁর চাকরির ক্ষতিও করে দিয়েছিলেন, সব কথা কি ভোলা যায়!
সে বাদ দিন, দায়ী সেই রিপোর্টার।
স্যরি আমি যেতে পারছি না, আমার গান আমার ছেলের জন্য, বউমার জন্য, গান গেয়ে গেয়ে ছেলেকে ঘুম পাড়াতাম। এখন তারা বিদেশে, আমার কিছুই ভালো লাগে না। কবে আমার নাতনিকে ঘুম পাড়ার গান গেয়ে গেয়ে, সেই দিন গুনছি।
সুনন্দা গেল না। আমাকে যেতে হল মজুমদারের জন্য। গেলাম কৌতূহলে। আমার বস তো উনি এখন নন। দেখা যাক। পুরোনো অপমানটা ফিরিয়ে কি দিতে পারব? ছোটো এক এয়ার কন্ডিশনড হলে অনুষ্ঠান। দেখা হল কত পুরোনো সহকর্মীদের সঙ্গে। তাদের অনেকে রিটায়ার করে গেছে আমার মতো। কারো কারো চাকরি রয়েছে এখনও বছর দেড় দুই। বস এলেন সস্ত্রীক। বুড়ো হয়েছেন, কিন্তু সব চুল ঘন কালো। যৌবন নেই, কিন্তু তাকে রক্ষা করার কী ব্যর্থ প্রচেষ্টা! মিসেস মল্লিকেরও তাই। বরং আরো বিসদৃশ তিনি। লোকনাথ মল্লিক মঞ্চে বসে একটি তালিকা খুললেন। যেন হাজিরা খাতা ধরে নাম ডাকতে লাগলেন। এই সব হল। সুনন্দা আসেনি শুনে তিনি বললেন, উচিত ছিল আসা, তিনি তো অচিনপুরের গায়িকা, আপনাদের ম্যামের গলা নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি আর গাইতে পারেন না। সি ইজ সাফারিং ফ্রম আ সিরিয়াস ডিজিজ। তার জায়গাটা কে নেবে, মিসেস বোসই গাইবেন ঠিক ছিল, কি মজুমদার, সবাইকে আনতে পেরেছ, পারনি তো?
মজুমদার মাথা চুলকোতে লাগল আগের মতো। বলল, ডেপুটিরা সব এসেছে স্যার, অচিনপুরে আপনার সময় নেজারত ডেপুটি কালেক্টার ছিল সান্যাল, ওই যে স্যার।
সান্যাল উঠে দাঁড়ায় অনুগতের মতো। সায়েব বললেন, ডিফালকেশন কেস থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলাম, মনে আছে, কয়েক লাখের হিসেব ছিল না।
সান্যাল মাথা নামিয়ে নেয়। এত বছর বাদে তার বউ-এর সামনে না বললেই হত। কিন্তু অনেকে হে হে করে হাসতে লাগল। মজুমদার বলল, গুণধর মণ্ডলকে সেভ করলেন স্যার, মনে আছে তার কথা?
এসেছে?
না স্যার, মণ্ডল এখন সিঙ্গাপুরে।
কাকে নিয়ে গেল আবার চাকরি দেওয়ার নাম করে? বলতে বলতে হাসতে লাগলেন বড়ো সায়েব, তেত্রিশ বছর আগের জেলা শাসক। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মিসেস এল না যে, ভেবেছিলাম ওঁকে লানডানের বঙ্গ সম্মেলনে পাঠাব, মজুমদার তো যাবে সকলকে সঙ্গে নিয়ে।
কী রকম পাথরের মতো বসে আছেন বড়ো ম্যাডাম। উনিই বড়ো ম্যাডাম —ম্যাম। আর সবাই শুধু ম্যাম, উনি বসেই থাকলেন। একটি কথাও বললেন না। তাঁর রূপ ঝরে গেছে একেবারে। বুড়ি হয়ে গেছেন। স্যার আর ম্যাডামকে অনেক উপহার দেওয়া হল অচিনপুর প্রাক্তনীদের পক্ষ থেকে। ম্যাডাম শেষে দুটি কথা বললেন, ‘আমি সুনন্দা বসুর গান শুনতে এসেছিলাম!’
কী ফ্যাঁসফেসে কন্ঠস্বর তাঁর। বোঝা গেল অসুখটা কী। তিনি আবার বললেন, অচিনপুর বড়ো সুন্দর ছিল, বড়ো নিষ্ঠুরও ছিল, তাই না?
সকলে চুপচাপ। কেমন মনখারাপের বাতাস উড়ে এল দূর উত্তর থেকে। সেই জাহ্নবী নদীর কুল থেকে। আমার মনে পড়তে লাগল সব। কী নিষ্ঠুর অহঙ্কারী না ছিলেন ম্যাডাম মল্লিক। তার ফাই ফরমাস খাটত কী ভাবে আমাদের মজুমদার। গানের আসর, সাহিত্যের আসর বসাতে বসাতে হিমসিম। কলকাতা থেকে বড়ো কবি গায়ককে নিয়ে গিয়ে তাদের হাত-পা টেপাই ছিল যেন মজুমদারের কাজ। ম্যাডাম বললেই হল। মনে পড়ল তাঁর সেই কঠিন দৃষ্টি। সুনন্দা না গেলেও ম্যাডামের ডাকা কবিতা পাঠ, গানের আসরে আমাকে যেতে হত। কত দূরে পড়ে আছি। যত সময় স্বস্তিতে থাকা যায়। ডি.এম সায়েবের চেয়ে ম্যাডামের প্রতাপ সব জায়গায় বেশি। শোনা যায় আগের জেলা বীরভূমে একজনের চাকরি খাওয়ার ব্যবস্থা পাকা করে এসেছিলেন তিনি ডি.এম সায়েবকে দিয়ে। সেই তিনি কেমন স্থির হয়ে বসে আছেন। শান্ত দৃষ্টি। আজ ফিরেও তাকাচ্ছেন না মজুমদারের দিকে। ফিরে তাকাচ্ছেন না বত্রিশ বছর পিছনে। মজুমদার তাঁকে প্রায় কুর্নিশ করল। তিনি দেখেও দেখলেন না।
আমার কানে মজুমদার গুনগুন করল, সুনন্দা ম্যাডামকে লনডন পাঠাতেন ওঁরা, এতবার আসতে বললাম, চান্স চলে গেল, বঙ্গ সম্মেলন বলে কথা।
আমি বললাম, ওঁর জন্য সুনন্দা গানই বন্ধ করে দিল বলা যায়, এখন আর কেন, অনুগ্রহ নেবে কেন ও, সবাই তো অনুগ্রহ নিয়ে বাঁচে না মজুমদার।
মজুমদার বলল, এঁদের কিন্তু অনেক ক্ষমতা, এখনও সেই আগের মতোই যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন। গুণধর মণ্ডল কত বড়ো অন্যায় করেছিল বলো, চাকরি দেওয়ার নাম করে মেয়েটাকে নিয়ে জাহ্নবীর ডাক বাঙলোয়, তার গায়ে হাতই পড়ল না, অথচ এফ. আই. আর করেছিল মেয়েটার বাবা। বড়ো ম্যাডামই গুণধরকে বাঁচিয়েছিলেন, আর শুভময় সেন ফেঁসে গেল, জেল খাটল শুধু সায়েবের রোষে পড়ে, তোমরা অনেক পেতে পারতে, পাওনি।
আমি চুপ করে থাকলাম। সবটা আমার জানা। ওই অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম আমি। তার কারণ সুনন্দার গান, সুনন্দার রূপ।
সুনন্দা আসুন, তা বারবার বলে দিয়েছিলেন স্যার, বড়ো ম্যাডাম তাই চান, সব মনে আছে ওঁদের, যার এ.সি.আর খারাপ দিয়ে কেরিয়ার শেষ করে দিয়েছিলেন, সেই মানস কুণ্ডুর খোঁজ করছিলেন, কমপেনসেট করবেন বলে।
ওসবের কোনো ক্ষতি পূরণ হয়? আমি বিনবিন করে বললাম, ও গান শোনে শুধু একা একা, সেতার সরোদ পিয়ানোর রাগরাগিনী, সোনাটা সিম্ভনি।
তখন একজন আবৃত্তি করছেন, বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া অনিকেত সান্যাল। গলার সেই মাধুর্য আর নেই। অল্প বয়সে করত। তারপর ওসবের কাছে নেই। কিন্তু ম্যাডামের কথায় তাঁকে করতে হল, তা বললেন বারবার। আবেগে অনিকেত সান্যাল আপ্লুত।
মঞ্চ থেকে মল্লিক স্যার আমাকে বললেন, মিসেসকে নিয়ে কবে আসবেন?
কোথায়?
আমাদের সল্টলেকের ফ্ল্যাটে, আপনাদের ম্যাডাম ওঁর গান শুনবেন, বঙ্গ সম্মেলনে যাওয়ার ইচ্ছে আছে?
আমি বললাম, বলতে পারছি না, আমরা থার্ড উইকে সান দিয়েগো, ক্যালিফোর্নিয়া যেতে পারি, এর ভিতরে সময় হবে না।
বলতে বলতে আমি দেখি বড়ো ম্যাডামের দুটি চোখ জ্বলে উঠল যেন। তিনি অনুগ্রহ বিলোতে এসে ব্যর্থ হয়ে ভিতরে ভিতরে জ্বলছেন। মজুমদার উঠে দাঁড়িয়ে বলছে, আমিই নিয়ে যাব স্যার, আমার উপর ভার থাকল।
এরপর যেন সুর কেটে গেল। আমি বেরিয়ে পড়েছি একা। কাউকে কিছু না বলেই চলে এসেছি। পথে একবার মোবাইল বাজল, ধরিনি। বোধহয় মজুমদার। বাড়ি ফিরে দেখি সুনন্দা স্থির হয়ে কম্পিউটারের সামনে বসে। তার দু-চোখে দিয়ে নেমে আসছে জল। ইন্টারনেটে ফেসবুকে পাওয়া লিঙ্ক থেকে গান নিঃসৃত হচ্ছে। বাঁশির সুর। মনিটরে ভেসে উঠছে এক অকুল গাঙের দৃশ্য। ভেসে যাচ্ছে নৌকো। ভোরের গোলাপি আলোয় ভেসে আছে চরাচর। এ কার বাঁশি?
এর নাম সংস অফ রিভার, নদীর গান, হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া। সুনন্দা আঁচলে চোখ মুছল। বলল, শুনতে শুনতে চোখে জল এসে যায়, এর চেয়ে সুন্দর কিছু হয়। চুপ করে শোনো, আমি প্রথম থেকে আবার বাজিয়ে দিই।
নেটে পাওয়া?
হ্যাঁ, এক বন্ধু পাঠিয়েছেন লিঙ্কটা, পৃথিবীটা শুধু মজুমদার, মল্লিক স্যারের শ্রীবাস্তবদের নয়, পৃথিবী আসলে এমন, আগে এসব শুনিনি কেন? বিড়বিড় করে বলল সুনন্দা।
সন্ধ্যা আর ভোর বুঝি মিলেমিশে একাকার। সেই বাঁশির কী আকুল ডাক। অনন্ত আকাশের নীচে যে নদী, সেই নদীর বাতাসে বাতাসে বাঁশির সুর ছড়িয়ে যেতে লাগল। এক একবার তীব্র হয়ে তা অন্তরাত্মায় প্রবেশ করে ভাসিয়ে দিচ্ছে সব। সুরে ভেসে যেতে লাগল সব, অতীত, বর্তমান। কোথা থেকে নেমেছে নদী, কোন অনন্তের দিকে যাত্রা করেছে নদী, অজানা সমুদ্রে গিয়ে মিলবে … বেদনা উৎসারিত হচ্ছে সুরে সুরে। আবার বহমানতার আনন্দও। বাঁশির ডাকে চঞ্চল হয়ে উঠেছে পাখিরা, নদীর উপর দিয়ে তারা উড়ে যেতে লাগল নদীর গান নিয়ে। তাদের ডানায় লেগে গেল বাঁশির সুর। ডানার কাঁপনে সুর রং হয়ে ঝরে পড়তে লাগল ভোরের নদীতে। বহমান সেই নদী আমাকে স্মরণ করাতে লাগল আমার শৈশব আর যৌবনকালের কথা। আমাদের জীবন যে সব ভালো কিছু দিয়ে সুন্দর হয়েছিল কখনও কখনও তা মনে পড়ে যেতে লাগল। ভুলেই গিয়েছিলাম সব। মনে ছিল শুধু অনেক তিক্ততার কথা। খারাপ মানুষগুলোর কথা। অথচ সুন্দর সব মানুষের মুখোমুখি হয়েছি কতবার। সুনন্দার সঙ্গে আমি ধ্যানস্থ হয়েছি আশ্চর্য সেই বাঁশিতে। অনেক পরে তা থামল।
সুনন্দা বলল, আমার অচেনা বন্ধু আমাকে প্রতিদিন ভোরে একটি করে গান পাঠিয়ে দেন, হারিয়ে যাওয়া গান, ভুলে যাওয়া গান, সেই পঞ্চাশ বছর আগের গান, তখন তোমার কৈশোর, আমার বালিকা বয়স, শুনবে?
তুমি তো আমাকে বলনি?
না বলিনি, নিজের কাছে রেখে দেখ ভেবেছিলাম, রেখে দিয়েও ছিলাম, কিন্তু আজ তুমি বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে মনে হতে লাগল আমি একা নেব কেন এই সুখ, আমার বন্ধুও তো ভোর রাতে উঠে নানাজনকে নানা গান উপহার দিয়ে দিয়ে সকাল শুরু করেন। তিনি বলেন, এই সুর তোমাকে শুদ্ধ করবে, নীরবতা দেবে এইসব সংগীত, সেই গান কি শুধু আমার হবে, গান আমার একার তো হতে পারে না, কিন্তু হলেই বা কী হতো, এতকাল পরে সংগীতের শুদ্ধতা অনুভব করতে পেরেছি, না গেয়েও মনে হয় যেন আমিই গাইছি, এ বাঁশির সুর আমার, নদীর গান আমার, আর তা সবাইকে বিলিয়ে দিলেই বুঝি জীবন সার্থক হতে পারে।
তোমার বন্ধুটি কে?
কে আমি তা জানি না, তাঁর নাম অনন্ত আকাশ, এই নামেই তাকে জানি, শুনেছি বাঙ্গালুরু থেকে একশো কিলোমিটার দূরে কর্নাটকের এক গাঁয়ে থাকেন, ফেসবুকে আলাপ।
চমকে উঠি, কে সে, সুবীর ভদ্র? মেজমাসির বড়ো ছেলে? কিন্তু তিনি অনন্ত আকাশ নাম নিয়ে আসবেন কেন? সুনন্দা বলল, ওই নামেই তাঁর সহস্রাধিক বন্ধু তাঁকে চেনে, আমিও চিনি, ফেসবুকে আর কিছু চেনার দরকার হয় না, আলাপ হয়ে যায়, আমি লিখেছিলাম গান ভালোবাসি, উনি প্রতিদিন একটি করে গান আমাকে উপহার দিয়ে যান সেই কোন ভোরে, কোনো গান জানো, যে গান, ভুলে গেছে মানুষ সেই গান।
আশ্চর্য, তাহলে কি সুবীরদাই সত্যি!
সুনন্দা বলল, ইনি বহু দেশ ঘুরে এদেশের গাঁয়ের লোকের চিকিৎসা করছেন, কত বয়স, সাধুর মতো হয়ে গেছেন, আমরা কি করলাম সারা জীবন? বসো, তোমাকে আর এটাই শোনাই, বেটোফেন-এর মুনলাইট সোনাটাং … ফিল করো তুমি, আগে তো এসব শুনিনি।
জ্যোৎস্না রাতের রূপ ফুটছে ধীরে। আমি যেন নীরবতাকে রূপ দেখতে পাচ্ছি একটু একটু করে। তার ভিতরে আবছা কলকল শোনা যাচ্ছে। অনন্ত আকাশ একা নন, যেন অনেক শিশুর সঙ্গে তিনি বেরিয়ে এসেছেন চাঁদের আলোর ভিতরে। ঘর ভরে উঠেছে তাদের কলধ্বনিতে। আমার কীরকম ছোটো লাগল নিজেকে, সমস্ত দুপুরটা কীভাবে কাটিয়েছি। কীভাবে সকলের সঙ্গে গিয়েছিলাম আনুগত্য প্রকাশ করতে। চুপ করে থাকলাম। মুনলাইট সোনাটা বাজতে লাগল। বেজে যাচ্ছে। আমাদের সেই অচিনপুরে জাহ্নবী নদীর তীরে চাঁদের আলো নিঃশব্দে নেমে এল অনন্ত আকাশ থেকে।