৫
সেই সময় বনবাংলোর কর্মচারী বুড়োর বুড়ি-বউ বাইরের দীর্ঘ করিডোরের সিঁড়িতে। তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল দূর থেকে। সে দরজার গোড়া থেকে সরে এসে বড়ো হলঘরটি পার হয়ে মোটা কার্পেটে নিঃশব্দে হেঁটে বাইরে এল। নেমে গেল সিঁড়ির একটি ধাপে, কপট চোখ রাঙালো, জিজ্ঞেস করল, কী চাই, এখন এখানে কেন, বারণ করিনি?
বুড়ি তার সমস্ত প্রাচীনতা নিয়ে হাঁ করে তাকে দেখল কয়েক মুহূর্ত, কী এক অবিশ্বাস জেগে উঠল তার ঘোলাটে চোখে। চামড়া কোঁচকানো মুখ ময়লা আঁচলে ঢাকল, তারপর বিনবিনে গলায় বলল, হুজুর, আমার সব্বোনাশ হঁই গিছে, তুমি আস।
মজুমদার নীচে নেমে এল, সব্বোনাশ আর সময় পেলে না, পরে এস, বেরবার সময়।
হুজুর! বুড়ি চাপা আর্তনাদ করে ওঠে, আমার কী হল!
বড়ো সায়েব-ম্যাডাম রেগে যাবে, পরে এস।
বুড়ি কেঁদে ওঠে বিনবিন শব্দে, বলল, আমার বুড়া থির হয়ে গেল হুজুর, বসে বসেই চোখ বন্ধ করল, হুজুর দেখে যাও।
হাসপাতাল নিয়ে যাও। মজুমদারের গলায় দার্ঢ্য এল। ধমকে উঠল বুড়িকে। সে বুড়ির সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল না। শোনার মন ছিল না, কান ছিল বাংলোর দরজায়। তাঁদের উল্লাস থেমে গেছে, তৃপ্ত নারী-পুরুষ এখন নিঃশ্বাস ফেলছে ধীরে ধীরে। বেরোনোর সময় হল।
বুড়ি মৃদুস্বরে কাঁদতে আরম্ভ করল, হুজুর, আমার বুড়া কথা বলছে না। হা ভগবান, বুড়া কথা বলতে বলতে পড়ে গেল মেঝেয়, চোখ খুলছে না।
বাংলোর পিছন দিকে অনেকটা দূরে প্রাচীরের গা ঘেষে তাদের ভাঙাচোরা বাড়ি। আউট-হাউসের মতো। তারা দাঁড়িয়ে বাংলোর সামনে। বাংলোকে বেড় দিয়ে ওদের বসতবাটিতে যেতে হবে। ওদিকটায় অনেক গাছ-গাছালি, পাঁচিলের বাইরে বড়ো একটা শিরিষ গাছ। তার ছায়া পড়ে থাকে বাড়িটির উপর। ছায়া অন্ধকারে বসে থাকে বুড়ো-বুড়ি।
কী হলো সেই বুড়োর? বুড়োই তো বাংলোর দরজা খুলে, ঘর পরিষ্কার করে, মুরগি কেটে রেঁধে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আগের দিন খবর দেওয়া হয়েছিল বিডিওর চৌকিদারকে দিয়ে। সবকিছু সাজানো ছিল। বিছানার চাদর বদলানো ছিল, ঘরে ধুপ জ্বালানো ছিল, জল আর গ্লাস ছিল। সব গুছিয়ে বুড়ো অপেক্ষা করছিল সায়েবদের জন্য। তারা এসে গেলে সায়েব-ম্যাডাম তাদের জন্য রাখা সবচেয়ে ভালো ঘরটিতে বুড়োই কয়েকবার ঢুকেছে এটা ওটা নিয়ে। তারপর তাকে বলে চলে গেল। বুড়োকে আগেও অনেকবার দেখেছে মজুমদার। কথা বলে না বিশেষ। এবার তাকে দেখছিল বিস্ময়ের চোখে। বাংলোয় মেম সায়েব আর সায়েবরা ফুর্তির জন্যই আসে। যে ফুর্তি করবে, সে আসে। তবে এই সায়েব কি করতে এল? সে বিড়বিড় করে বলেছিল, মোরে তো চোকিদার কহে নাই।
অবাক হয়ে মজুমদার তাকে দেখছিল, বলেছিল, এই যে বললে চৌকিদার খবর দিয়ে গেছে সকালে।
হুজুরের কথা তো কহে নাই।
কার কথা বলেছিল?
বুড়ো বলেছিল, মে’ছেলে না নিয়ে আসবে হুজুর, মোরে তা বললে আমি গাঁ থেকে আনা করাতাম, বেশি দামও লাগতনি। সব বসে আছে, অভাবী ঘর সব, দুটা পোয়সা হত, ভাত পেত। গাঁয় না খোয়া চঁইলছে বহুত দিন ধরে।
মজুমদার চুপ। বুড়ো তার দিকে ঘুরে তাকাতে তাকাতে নেমে গেল ঘন্টা দুই আগে। ওই সায়েব ম্যাডাম ফুর্তি মারছে, এই সায়েব করবে কী? ফুর্তি যদি না মারবে, এল কেন? ঘরে ফিরে তার বুড়ি বউকে কি ওই কথাই শোনাচ্ছিল? ছোটো সায়েবের জন্য মেয়েছেলে আনতেই পারত সে, ইস কী হলো এটা; একা একা লোকটা বসে থাকবে, আগে বললে অমন হতোনি?
কী বলছ তুমি! মজুমদার তখন টের পায় একটু একটু করে।
হ্যাঁ হজুর, কথা কহিতে কহিতে থির হঁই গেল, হুজুর বুড়াকে দেখবা চলো।
হাসপাতাল নিয়ে যাও।
কী করে নি যাব হুজুর?
ভ্যানট্যান জোগাড় করে নিয়ে যাও।
হুজুর, হাসপাতাল নি যাবার অবস্থা নেই, বুড়ার কী হলো হুজুর।
তখন ডাক এসেছিল শ্রীবাস্তব সায়েবের, মুজুমডার, কাঁহা হ্যায় মুজুমডার?
দূর থেকে মজুমদার দেখতে পেয়েছিল শ্রীবাস্তব সায়েব পাকা প্রশাসকের পোশাক পরে বেরিয়ে এসেছে। জিনস, টি-শার্ট, শ্যু। মুখখানি যেন জলে ধোয়া। কিছুই হয়নি। সে ছুটে গিয়েছিল, ইয়েস স্যার?
গগন শ্রীবাস্তব বলেছি, মুজুমদার, বাংলোর খাট ড্যামেজ হয়ে গেছে, নাজিরখানায় বলে নতুন এনে দিয়ো।
ইয়েস স্যার।
চলো, এবার ফিরতে হোবে।
শ্রীবাস্তবের একটু পর বেরিয়ে এল মিস শ্রেয়া চৌধুরী। তার দিকে চেয়ে হাসে, হাই, হাও ডিড য়্যু এজনয়? নাইস বাংলো, নাইস নাইস, থ্যাঙ্কস জগবন্ধু।
শ্রেয়ার কথায় বিগলিত হাসে মজুমদার। হাত কচলায়। শ্রেয়া তখন বলে, নাইস অফিসার, মোস্ট ওবিডিয়েন্ট। গগন, য়্যু আর লাকি। এমনি অফিসার পেলে কোনো চিন্তা থাকে না। আমি জানতামই না এমন লয়াল অফিসার থাকতে পারে।
শ্রীবাস্তব বলে, মজুমদারকে আমি তৈরি করেছি, তোমার আঙ্কেল ডি.এম. নিয়ে নিয়েছে।
ওক্কে গগন, মজুমদার এবার আমরা ব্যাক করব তো।
ইয়েস ম্যাডাম।
হাঁ মজুমদার, বুড়াটাকে সব মিটিয়ে দিয়েছ? শ্রীবাস্তব জিজ্ঞেস করে।
ইয়েস স্যার।
কুছু বকশিস তো দাও, হান্ড্রেড রুপিজ।
ইয়েস স্যার।
আমিও দেব গগন, পে অ্যানাদার হান্ড্রেড ফর মি। শ্রীবাস্তবের হাত ধরে শ্রেয়া বলল, বুড়োটা বেশ ভালো, গ্র্যান্ড ফাদার গ্র্যান্ড ফাদার ভাব।
তখন শ্রীবাস্তব বলল, বাংলোর কেয়ার টেকার গ্রান্ড ফাদার হয় নাকি, তোমাকে নিজেকে সকলের থেকে সেপারেট করে নিতে হবে শ্রেয়া। তুমি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, তোমার ক্লাস আলাদা। মুজুমডার, টু হান্ড্রেড দিয়ে দিয়ো, আর বলো বটলে কিছুটা ওর জন্য রেখে দিলাম, তিন পেগ হয়ে যাবে, যেমন ছুকছুকে চোখ বুড়ার, বটলে হাত ঘষছিল।
বলল তো বটলে একটু রেখে দিতে, হাউ ফানি, আমি তাই বললাম বুড়ো চেয়েছে থাক একটু। বলে শ্রেয়া হাসল, বাংলোর বুড়োরা এমনি হয় গগন, প্রসাদ পায়।
শ্রীবাস্তব বলল, নাজিরখানা থেকে টাকা নিয়ে নিও মজুমদার।
নাজিরখানা সরকারি কোষাগারের টাকা খরচ করে। এসব খরচ ওখান থেকেই হয়। নানা খাতে খরচ দেখিয়ে এসবের জন্য টাকার জোগান দিতে হয় নাজিরবাবুকে। মজুমদারের কি অজানা এইসব? জেলা শাসকের চা-পাতার দামও দিতে হয় নাজিরখানাকে। স্যারিডন কিংবা অ্যালজোলামের দামও। সে নিজেকে একটু নুইয়ে বলল, ”ইয়েস স্যার, স্যার!” তারপর মজুমদার বুড়োর কথাটা বলতে গেল, বুড়ো বোধ হয় …। বলতে পারল না। সায়েব তখন শ্রেয়া চৌধুরীকে নিয়ে বাংলোর বাইরে রাখা গাড়ির দিকে এগোতে শুরু করেছে। মজুমদার পার্স থেকে দুশো টাকা বের করে বুড়ির দিকে ছুটল। সায়েবের অভ্যেস সে জানে। সায়েব দেরি করবে না। সায়েবের গাড়ি খুব জোরে ছোটে। এখন তাঁর গাড়িতেই যাবেন মিস চৌধুরী, শহরে ঢোকার আগে তিনি গাড়ি বদল করে মজুমদারের গাড়িতে উঠবেন। মজুমদার তখন গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে দাঁড়াবে। মিস চৌধুরী উঠে গেলে সে উঠবে ড্রাইভারের পাশে। শহরের আগের ওই গাড়ি বদলের জায়গা অবধি মজুমদারকে অনুসরণ করতে হবে শ্রীবাস্তব সায়েবে গাড়ি। গগন সায়েবকে হারিয়ে ফেলা চলবে না। কারণ নির্দিষ্ট পয়েন্টে পৌঁছে গগন শ্রীবাস্তব দাঁড়াতে চাইবে না। অপেক্ষা করতে হলে সে মজুমদারের উপরে রেগে যাবে। দরকারে শ্রেয়া চৌধুরীর সামনে খিস্তি করতে আরম্ভ করবে, আরে বুদ্ধু, আমি কি তোমার জন্য ওয়েট করব মুজুমডার, আমার কাজ নেই, ফাইল নিয়ে বসে আছে বড়োবাবু! তুরন্ত আসতে পার না।
বুড়ির হাতে দুশো টাকা ধরিয়ে দিয়ে মজুমদার ছুটল। বুড়ি তখন কাঁদতে আরম্ভ করেছে, হুজুর, বুড়া মোরে ছেড়ে চলি গেল, হুজুর, বুড়া আর নাই!
তারপর কি হল মজুমদার? আমি জিজ্ঞেস করলাম। অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম মজুমদারের কথায়। সে যেন কনফেশনে বসেছে।
দুশো টাকায় সৎকার হয়ে যাবে, নিস্তব্ধ হয়ে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলল মজুমদার। আচমকা কেঁপে ওঠে সে, টাকাটা বুড়িকে দিয়ে ছুটেছি, পিছনে বুড়ি তখন রোখ ছেড়ে কেঁদে উঠল, এতক্ষণ সায়েবদের ভয়ে কাঁদতে পারছিল না, আমরা বেরোতে তারা যেন বাঁচল। মনে হয়েছিল বুড়োও বোধহয় বাঁচল।
তারপর? এসব কথা আমরা কেউ জানতাম না, কৌতূহল বেড়ে যাচ্ছিল।
মজুমদার বলল, সারাটা পথ আমি কাঁপতে লাগলাম বাসু। সে ছিল ভরা ভাদ্দর, পচা গরম, হাই রোডের পাশে নয়ানজুলিতে পাট পচছে, তার গন্ধ পচা ভাদুরে মেঘের মতো ভেসে আছে শূন্যে। আমি গুটিয়ে পড়ে থাকলাম গাড়ির পিছনে। অর্ধেক পথ যেতে ড্রাইভারকে বললাম, আস্তে চালাতে, আমার ভয় করছিল খুব। বুড়ো মরেছে তা ড্রাইভারও বলল। বয়স্ক ড্রাইভার কতবার কত সায়েব মেমকে নিয়ে বাংলোয় এসেছে। বুড়োকে সে অনেকদিন ধরে চেনে, যৌবনকালে নাকি তার খুব জোশ ছিল, সায়েবদের খুব ফেবারিট ছিল, সাত পেগ খেয়েও টলত না। এক সায়েব ওর জন্য আলাদা বোতল আনত। সায়েব আর ও নেশা করত সন্ধে থেকে। সায়েবটা ভালো ছিল। নেশা করেই ওকে দোস্ত বলত। সেই সায়েবের কথা বুড়ো আজও বলল। সে ছিল একা মানুষ। কী ভালো মানুষ! ….. ওর বউ বিয়ের আগে কাজ করত আর এক সায়েবের বাংলোয়, সায়েব তাকে নষ্ট করে বুড়োর কাছে দিয়ে গেছিল, সেই থেকে সে বুড়োর বউ। তখন বুড়ো জোয়ান মরদ। এসব কথা ড্রাইভার বলতে বলতে স্টিয়ারিং ধরে ঢিমে তালে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল। বলতে বলতে থামে মজুমদার, তারপর আবার বলে, সে যখন নির্দিষ্ট পয়েন্টে পৌঁছয়, গগন শ্রীবাস্তব সায়েব চলে গেছেন শ্রেয়া ম্যামকে নিয়ে, ডি. এম. বাংলোয় পৌঁছে দিয়েছেন। ভার্গব সায়েব ব্লক অফিস ভিজিটে গিয়েছিলেন, সঙ্গে ছিলেন শ্রেয়া ম্যাম। প্রোগ্রাম তো সেই রকম ছিল। শ্রেয়া চৌধুরী ইন্টারভিউ-এর জন্য ওইভাবেই তৈরি হচ্ছিলেন।
আমরা দুজনে চুপ। শেষে আমি বললাম, এত ভয় করতে কেন মজুমদার, তুমি তো স্টেট সার্ভিসের অফিসার, ভয়ের কী ছিল?
মজুমদার বলল, ভয়টা পারিবারিক, জেনেটিক বলা যায়। তুমি আমাকে একটা গল্প বলেছিলে, বিদেশি লেখকের, সেই এক কেরানি, কী যেন নাম?
ডেথ অফ এ ক্লার্ক, আন্তন চেখভের গল্প।
আমি ওই রকম ভয় পেতাম বাসু। আর বুঝেছিলাম, আমি ওই ভাবেই পাওয়ারের ছিটেফোঁটা পাব, নীচ থেকে উঠেছি প্রোমোশনে প্রোমোশনে, ওর কোনো দাম ছিল না সায়েবদের কাছে। তারা অবিশ্যি সবসময় প্রকৃত চাকর খুঁজত, যত খারাপ কাজ, ঘর ঝাঁট দেওয়া থেকে বাসন মাজা, টয়লেট সাফাই — সব প্রমোটিরা করবে। আমি ভয় করতাম যেমন, ভক্তিও করতাম। জানতাম, গভর্মেন্ট সার্ভেন্ট আসলে সায়েবদের সার্ভেন্ট, দেখেছি ভয় থেকেই আসে ভক্তি।
ভয়ে ভক্তিতে নার্সিং হোমে ঢুকে গেলে?
আমি সেদিন সারারাত প্রায় ঘুমোইনি বাসু। বুড়োটা আচমকা মরল, তখন ওরা দুজন বাংলোর পুরোনো খাট ভাঙছে ভীষণ আনন্দে, আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। চুপ করল মজুমদার। তারপর নিম্ন স্বরে বলল, রাতভর বুড়ো আমার পাতলা ঘুমের ভিতর হানা দিতে লাগল। বুড়ো হাত কচলে কচলে বলছে, আগে যদি সে জানত হুজুর একা, সে গাঁ থেকে হুজুরের পছন্দমতো নিয়ে আসত কাউকে, ভাদ্দর মাসে অভাব খুব, তারা আসবে বলে বসে আছে। সে বুড়ো হয়েছে, তার যৌবনকালে সায়েবের এঁটো হতে পারলে ভাগ্য ফিরে যেত, পছন্দ হলে সায়েব তার কোয়ার্টারে কাজে বহাল করত, পরে গরমেন তার চাকরি দিত। আমি সত্যি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম বাসু, ভয় করছিল কেন তা বলতে পারব না আমি, মনে হচ্ছিল আমি তলিয়ে যাচ্ছি। ভোর রাতে আমার জ্বর এল, মাথা ছিঁড়ে যেতে লাগল।
আমরা ভেবেছিলাম তুমি বড়ো সায়েবের ভয়ে নার্সিং হোমে অ্যাডমিশন নিলে।
না, বুড়োটার ভয়ে।
সুনন্দা উপর থেকে নেমে এল, বলল, বউমা অন লাইন হয়েছিল, অনেক ফোটো পোস্ট করেছে নেটে, নায়াগ্রা গেছিল ওরা।
মজুমদার বলল, কতদিন বাদে দেখা হল ম্যাডাম বউদি, আপনারা খুব ভালো।
কেন? সুনন্দা শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে।
সে আমি জানি, তা আপনি কি তারপর থেকে বাড়িতে বসে গেলেন ম্যাডাম?
সুনন্দা কথা এড়িয়ে গিয়ে বলল, মেয়েদের বাড়িই ভালো, বাড়ি ছাড়া আর কোথায় যাবে তারা মজুমদারদা?
আমি একটু কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কেন এসেছ মজুমদার, স্রেফ আড্ডা দিতে কি তুমি এলে, আড্ডা কোনোদিন দিয়েছ বলে তো মনে পড়ে না। সব সময় সায়েবদের গা ঘেষে ঘেষে থাকতে, সক্কাল থেকে তোমার ডিউটি শুরু হতো। সায়েবের অনুগ্রহ পেতে তোমাকে ধরত সবাই। তোমার পাওয়ারও কম ছিল না।
কথাটা গায়ে মাখে না মজুমদার। তার মুখে অচিনপুরের সেই নির্লিপ্ত হাসি দেখলাম। বলল, পাওয়ার কে না পেতে চায় বাসু, কথাটা তা নয়, আমি তোমাদের ইনভাইট করতে এসেছি, আমরা একটা জমায়েত করব, রি-ইউনিয়ন বলতে পার বাসু। যারা ছিল অচিনপুরে, নাইনটিন নাইনটি টু থেকে নাইনটি সিক্স, তাদের ডাকছি সকলকে। আমাদের স্যার এম. পি. হয়েছেন।
স্যার মানে কোন স্যার?
হেডস্যার! মৃদু হাসে মজুমদার, বলে, লোকনাথ মল্লিক স্যার, বড়ো সায়েব, রিটায়ারমেন্টের পর রাজনীতিতে নেমেছেন। দ্যাখো বাসু, আসল পাওয়ার কিন্তু অন্যখানে, রাজনীতিতে। আমলারা ভাবে তাদের কাছে। আসলে তা মন্ত্রীদের কাছে, এম.এল.এ, এম.পি.-র কাছে, স্যার তা রিয়ালাইজ করেছেন।
তাঁরা কোথা থেকে ক্ষমতা পান? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
কেন জনগণের কাছ থেকে, মজুমদার বলে।
সব ক্ষমতা তাহলে জনগণের? বিপুল ক্ষমতা!
হুঁ। সংক্ষিপ্ত মত প্রকাশ করল মজুমদার।
জনগণের উপরই তো রোলার চালানো হয় মজুমদার, তাদের কি সত্যিই ক্ষমতা আছে?
মজুমদার মাথা চুলকোতে লাগল, বলল, জানি না, আশ্চর্য, আমি কেন এটা জানি না।
আমিও জানি না, মনে হয় অস্ত্র যার হাতে তার হাতেই প্রকৃত ক্ষমতা। আমি বললাম।
এ তো সাধারণ কথা। বিড়বিড় করল মজুমদার, কিন্তু ধরতে পারলাম না কিছুই।
হুঁ, আমি চুপ করে থাকলাম, তারপর বললাম, মল্লিক সায়েব ব্যুরোক্র্যাটদের কথা বলতেন, তারা ক্ষমতার অধীশ্বর হবে। কিন্তু তিনি তো এম.পি-র কথায় উঠতেন বসতেন, জানো তা?
জানি, তিনি খুব পাওয়ারফুল ছিলেন। এখন শয্যাশায়ী। একা। কেউ তাঁর কাছে যায় না শুনেছি। পার্টিও ত্যাগ করেছে প্রায়, পার্টির বিরুদ্ধে বলেছিলেন।
তাহলে কী হল? আমি অস্ফুট গলায় বললাম।
জানি না, ক্ষমতা কারোর কাছে চিরজীবনের জন্য থাকে না জমি বাড়ির মতো। কেউ কেউ চেষ্টা করেন তা রেখে দিতে, হয় না। পার্টিও তো পারে না শেষ অবধি, দেখলাম তো, তিন দশকের ক্ষমতা চলে গেল। বলল মজুমদার।
তাহলে কি ক্ষমতা সাধারণ মানুষের? আমি বললাম।
ওসব জানি না, তাহলে আমার বাবা কেন ঘাড় ধাক্কা খেয়ে বাড়ি এসে অপমানে বিষ খাবেন। ওসব থাক, আমরা স্যারকে সংবর্ধনা দেব। তিনি আবার পাওয়ারফুল হয়ে উঠেছেন। ম্যাডাম বউদিকে গান গাইতে হবে। জানি না উনি এখনও গান করেন কিনা।
আমি চুপ করে গেলাম। পরিবেশ থম থমে হয়ে উঠতে লাগল তা টের পেলাম। আমার মাথার দপদপানি শুরু হয়ে গেল বুঝি। আচমকা মনে হল মজুমদারকে বলি চলে যেতে। তোমার সেই কর্তাভজা অভ্যেস এখনো গেল না মজুমদার? তুমি তোমার মল্লিক সায়েবের বেডরুম পাহারা দাও গিয়ে, আমাদের, আমাদের মতো থাকতে দাও। চাকরি শেষ হয়ে গেছে, এখন ওই লোকনাথ মল্লিক আমার কাছে কে? হু ইজ হি? তিনি কে মজুমদার?
আরে আমাদের বস মল্লিক সায়েব, ডি. এম. তাঁকে আমরা সংবর্ধনা দেব।
আমার মনে পড়ছে না মজুমদার। নির্লিপ্ত স্বরে বললাম।
হা হা করে হাসল মজুমদার। বলল, কী দারুণ বললে বাসু, অচিনপুরকে ভুলে গেলে! এতক্ষণ যে গল্পটি শুনলে, সেই অচিনপুর।
ও আচ্ছা, আমি কেন যাব, আমার কী ইন্টারেস্ট?
মজুমদার একটু সময় চুপ করে থাকে। তারপর দম নিয়ে বলে, বাসু, তোমাদের উপর ইনজাস্টিস হয়েছিল। কিন্তু জীবনে কতরকম ইনজাস্টিসকে ফেস করতে হয়। ভুলে যাও বাসু, ভুলে যাও, আসলে তোমার কিছুই ক্ষতি হয়নি বাসু।
তুমি কী করে এলে মজুমদার, সব ভুলে গেছ?
মজুমদার বলল, আমি কিছুই ভুলিনি বাসু। আমি স্যারকে কথা দিয়েছি বাসু।
এই সেই পুরোনো মজুমদার। সামান্য আলাদা লাগছিল, কিন্তু আলাদা নয়। সময় গেলে সব কিছুরই পরিবর্তন হয়। মজুমদার বদলায়নি। সে রিটায়ার করে গেছে। কিন্তু অভ্যেসটি আগের মতো রয়েছে। ক্ষমতাকে কুর্নিশ করতে ভালোবাসে মজুমদার। সায়েব লোকনাথ মল্লিক পাওয়ার থেকে সরে গিয়ে আবার পাওয়ারে ফিরেছেন, মজুমদার কি তাঁর ছায়ায় যেতে চাইবে না? মজুমদার বলছে, দ্যাখো বাসু, পাওয়ার কিন্তু রাজনীতিকদের হাতেই। স্যার যা বলতেন, ব্যুরোক্র্যাটরা একদিন সমস্ত ক্ষমতা দখল করে নেবে, তারাই কন্ট্রোল করবে সব ….।
আমি হাত তুললাম। থাক মজুমদার, আমি তো পাওয়ারের বাইরে আছি, আমার ওসবে কোনো কৌতুহল নেই।
মজুমদার বলল, আসলে সেটাই হবে। যত বেশি ব্যুরোক্র্যাট রাজনীতিতে আসবে, তত বেশি ক্ষমতা যাবে ব্যুরোক্রেসির হাতে।
তুমি যাই বলো, এসব শুনতে আমার ভালো লাগছে না।
মজুমদার বলল, ব্যুরোক্রেসিই কন্ট্রোল করবে রাজনীতিকে। তারা ধীরে ধীরে সব ক্ষমতা নিয়ে নেবে।
থাক না মজুমদার।
বাসু, তিনি তোমাদের কমপেনসেট করতে চান, শুভময় সেন লোকটার খোঁজ জানো?
আমি মাথা নাড়ি। তারপর বলি, শোনো মজুমদার, আমরা তো চাই না, আমরা ক্ষতিপূরণের জন্য ধর্ণা দিইনি।
মজুমদার হাসল। চুপ করে থাকল, তারপর বলল, শুভময় চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল, তুমি জান না?
না। আমি বললাম, ওকে রেখে চলে আসি কলকাতার পাশে, আমিই তো আগে বদলি হলাম।
মজুমদার বলল, কট রেড হ্যান্ডেড, হাতে নাতে ধরা পড়েছিল সেন।
তার মানে?
আমি জানতাম অমনি কিছু হবে, মল্লিক সায়েব সব জানতেন।
কী জানতেন? আমি অবাক হচ্ছিলাম, কত কথা বয়ে এনেছে মজুমদার। শুভময় সেন একটু বেশি বলত। তার হাত থেকে গুরুত্বপূর্ণ সব ফাইল সরে গিয়েছিল। শুভময় বসে খবরের কাগজ পড়ত আর নিন্দা করত জেলা শাসকের। তাঁর সান্ধ্য-সভাতেও যেত না। মজুমদারের সামনেই মল্লিক সায়েবের সমালোচনা করত। নাজিরখানা তার বাজার করে দেয়, রোজগার কী করতে করে এইসব আমলারা? সব চেটেপুটে খেয়ে নেবে। দেশটাকে ওরাই শেষ করছে। আমিও পরের দিকে এড়িয়ে যেতাম ওকে। ভয় করত। শুভময়ের সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে নেবে না তো মজুমদার? আমি ছিলাম ভীরু প্রকৃতির। এখনও তাই।