মুনলাইট সোনাটা – ৩

মল্লিক সায়েব বলতেন, তিনি তাঁর চাকরিতে এসে, দশজনকে সাসপেন্ড করেছেন, একজনের চাকরি খেয়েছেন, সে কোর্টে গিয়েও সুবিধে করতে পারেনি।

কী হয়েছিল স্যার? মজুমদার নিরীহ গলায় জিজ্ঞেস করেছিল।

বদলি করা হয়েছিল, ডেপুটেশন দিতে এসে খারাপ কথা বলেছিল, নিউজ হয়েছিল তো।

আমি জানি। সেই ঘটনা ঘটেছিল দূরের জেলায়। সেখানেও মল্লিক সায়েব জেলা শাসকের দায়িত্বে ছিলেন। সরকার বিরোধী ইউনিয়নের নেতাকে জেলা সীমান্তে বদলি করে দেওয়ায় হয়েছিল বিপত্তি। তাদের হাতে নাকি নিগৃহিত হয়েছিলেন জেলা শাসক। তারপর এফ. আই. আর, গ্রেপ্তার, চাকরি থেকে বহিষ্কার। এই অ্যাকশনে গোটা জেলা কেঁপে উঠেছিল, বিরোধী ইউনিয়ন ভেঙে তছনছ। মল্লিক সায়েব হয়ে ওঠেন সরকারের এবং সরকারি দলের প্রিয়পাত্র। তাঁর ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ক্রমশ। আইনি ক্ষমতার বাইরের ক্ষমতা।

বাবরি মসজিদ ভেঙে ঠিক করেছে রামভক্তরা এ বিষয়ে তাঁর মতামত খোলাখুলি। তা সন্ধ্যের আড্ডায় তিনি বলেন, অধীনস্ত ডেপুটিরা ঘাড় কাত করে ইয়েস স্যার, ইয়েস স্যার করে। এইটিই দস্তুর। তখন কালেক্টরেটের সদরে কোনো মুসলমান ডেপুটি ছিলেন না। তিন সাব-ডিভিসনে একজন। আমি চুপ করে থাকতাম। মনে হতো ঠিক নয়, এসব কথা বলা ঠিক নয়। কিন্তু আমি ওই কথার বিপরীতে কোনো কথা বলার সাহস রাখতাম না। আবার পক্ষেও কিছু বলতাম না। বুদ্ধিমান জেলা শাসক তা লক্ষ রাখতেন। আমি জানতাম জেলা শাসকের ভালোমন্দ লেখার উপর আমার চাকরির ভবিষ্যত। আমার প্রমোশন, আমার বদলি, আমার পোস্টিং — সব। মল্লিক সায়েব বলতেন, আমাদের গা থেকে মছলিখোর অপবাদটা মুছতে পারলে তবেই আমরা প্রকৃত ভারতীয় হতে পারব, ভারতীয় মানেই নিরামিষাশী।

বৈদিক মুনি ঋষিরা সোমরস আর গো-বৎস ভক্ষণ করতেন শুনেছি স্যার। আমি বলে ফেলেছিলাম আচমকা।

একদম মিথ্যে কথা। কে দেখেছে? এসব প্রচার আমাদের ক্ষতি করেছে।

মজুমদার ঘাড় নেড়ে বলেছিল, ইয়েস স্যার প্রচার, আমি তো চিকেন মাটন ছেড়ে দিয়েছি, মাছও ছাড়ব।

আমি চুপ করে গিয়েছিলাম। স্যার কথা বলছেন, বলুন। তাঁরা দুই ভাই এক বোন, তিনি ছোটো, তাঁরা সকলেই প্রশাসনে আছেন। বড়ো ভাই ফরেন সার্ভিসে, তাঁরা ভাই-বোন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে। বোন আই. এ. এস, বোনের হাজব্যান্ডও তাই। স্টেট সার্ভিসে তাঁর র‌্যাঙ্ক ছিল প্রথম। কথায় আমি সাড়া দিতাম না বলে, তিনি আমাকেই শোনাতেন সব, ব্যুরোক্র্যাটরাই একদিন সব পাওয়ার ভোগ করবে, তারাই শাসন করবে। দেশটিকে চেনা যায় তার ব্যুরোক্রেসি দিয়ে।

ইয়েস স্যার।

অ্যাবসলিউট পাওয়ার পেলে আমরাই দেশটাকে ঠিকঠাক রাখতে পারব।

ইয়েস স্যার। মজুমদার বলত, হয়ে যাবে স্যার। পোলিটিসিয়ানদের কেউ বিশ্বাস করে না। পলিটিকস শুধু ভোট ওরিয়েন্টেড। লোকে বলে, পোলিটিসিয়ানদের দিন শেষ হয়ে যাবে শিগগির, পাঁচ বছর নয়, পঞ্চাশ-একশো বছরের জন্য।

তা ঠিক, কিন্তু আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, সময়ে ক্ষমতা চলে আসবে ঠিক।

ইয়েস স্যার, আমাদের ডিউটি আমাদের করতে হবে। মজুমদার হাত কচলে বলেছে।

মজুমদার, আমার ভাগ্নী আসবে, তুমি স্টেশনে যাবে রিসিভ করতে।

ম্যাডাম যাবেন নাকি স্যার?

জিজ্ঞেস করো ম্যাডামকে। আমার ভাগ্নী এবার বসেছিল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে, র‌্যাঙ্ক করেছে নাইনটি এইট। এবার ইন্টারভিউ। আমি বলেছি রাজস্থান কিংবা পাঞ্জাব ক্যাডার অপশন দিতে। ওদিকে ব্যুরোক্রাটরা অনেক বেশি পাওয়ার এনজয় করে। আর দিল্লিটাও কাছে ওদিকের অফিসাররা পাওয়ার কী তা দেখতে পায়, পাওয়ারের খাঁটি চেহারা ওখানে গেলে টের পাওয়া যায়। তোমারই সব, ক্ষমতাকে ব্যবহার করো, এনজয় করো পাওয়ারটাকে।

ইয়েস স্যার। মজুমদার বলল, আপনার ফ্যামিলিই দেশ শাসন করছে।

আমাদের ফ্যামিলি ব্যুরোক্রেসিটা জানে।

ইয়েস স্যার।

তুমি জান না তোমার পাওয়ার কোথায়, কতটা পাওয়ার তুমি হোল্ড করো, জানলে তুমি ওইটাকে ব্যবহার করে আরো পাওয়ার অ্যাকোয়ার করতে পারবে।

মজুমদার বলল, জানি স্যার। রাজস্থান বেড়াতে গিয়ে হোটেলের রিসেপশনে কার্ড শো করাতে, সে কী খাতির স্যার। আমাকে একটা গাড়িই দিয়ে দিল সব সময়ের জন্য।

আমরা জানতাম মজুমদার পারে। মধ্যপ্রদেশ গিয়ে সাগর জেলার কালেক্টরের সঙ্গে দেখা করে বান্ধবগড় ফরেস্ট ঘোরার জন্য সরকারি গাড়ি অ্যালট করে নিয়েছিল। কালেক্টরের ঘরে ঢুকে এমন স্যার স্যার করতে লাগল, তিনি সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেই মানুষটি পরে ইলেকশনের অবজার্ভার হয়ে পাশের জেলায় এলে মজুমদার সাময়িক বদলি নিয়ে সেই জেলায় চলে গিয়েছিল। ইলেকশনের সময় এমন হয়। জেলার পুরোনো অফিসারদের বদলি করে দেওয়া হয় কমিশনের আদেশে। মজুমদার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল সবচেয়ে দামি সিল্ক। আমাদের শহরের ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নেওয়া। সেই সায়েবের সঙ্গে তাঁর গৃহিনীও এসেছিলেন।

সুনন্দা ফিরল ব্যালকনিতে, বলল, ভালো লাগছে না।

জল দেওয়া হয়ে গেল?

মালি ছেলেটা কাল সকালে আসবে, আজ না দিলেও হবে।

একটা দিন শুকিয়ে থাকবে?

থাকুক। গাছ-টাছ আমি রাখতে পারব না। আমার ভালো লাগছে না। সুনন্দার গলায় বিরক্তি।

কেন কী হল?

কিছু হয়নি, আমার ভালো লাগছে না।

কতবার বলেছে ছেলে-বউ, চলো ঘুরে আসি।

সুনন্দা চুপ করে থাকে। আমি বললাম, গান নিয়ে বসতে পারো তো।

কী জানি কেন ভালো লাগে না, ওই একটা লোককে দেখছ।

হুঁ, কত লোক তো রয়েছে, কোনজন?

এদিকে আসছে, ও কে?

কী করে জানব কে, আমাদের বাড়ি তো আসছে না।

আসতেও তো পারে। সুনন্দা বলল, চেনা মনে হয় যেন।

আমি তো চিনতে পারছি না।

দেখ, আমাদের বাড়িই আসবে।

আমি জানি আমাদের বাড়ি আসবে না, আমাদের বাড়ি অনেকদিন কেউ আসে না। বউমার বাপের বাড়ি বর্ধমানে, কলকাতায় এলে আসেন তাঁরা কখনও সখনও। আসলে মেয়ে থাকলে আসতেন, মেয়ে নেই কার কাছে আসবেন? তাঁরাও একা হয়ে গেছেন। তবে ওটা জেলা শহর। ওই শহরের আদি বাসিন্দা তাঁরা। আত্মীয়-স্বজন সব আশপাশে। বিশ মাইল দূরে দামোদরের ওপারে তাঁদের গ্রাম, গ্রামেও যাওয়া আসা আছে। আমাদের গ্রাম নেই। আছে এই নতুন শহর, পঞ্চাশ বছরও বয়স হয়নি যার। এই শহর এখনো অচেনা হয়ে আছে আমাদের কাছে। সুনন্দা এই ব্যালকনিতে বসে দূরের পথচারী দেখে প্রায়ই কল্পনা করে আমাদের বাড়ি আসছে কেউ। কিন্তু কল্পনা একবারও সত্য হয়ে ওঠেনি এখনও।

জেলা শাসকের ভাগ্নী, বছর ২৭-২৮-এর শ্রেয়া চৌধুরীকে রিসিভ করতে মজুমদার গিয়েছিল। সঙ্গে দু’জন অর্ডারলি। জেলা শাসকের ভাগ্নী শ্রেয়া রূপবতী, ক’দিন বাদেই আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা গ্রহণ করবেন রাষ্ট্রের কাছ থেকে, তাকে মজুমদার নিজের হেপাজতে নিয়ে নিল। ম্যাডামের দেখাশুনো করবে সে। ম্যাডামকে জেলাটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবে। অর্ডারলি দুজন, যাদব আর মাধবকেও মজুমদার তার হেপাজতে নিয়ে নিয়েছিল ছোটো ম্যাডামের খিদমত খাটার জন্য। শ্রেয়া চৌধুরী যখন বিশ্রাম নেন মজুমদার তার চেম্বারে আসে। তার চেম্বারে আমরা ভিড় করি। মজুমদারের ভাগ্য কী। এই ভাগ্য সে নিজেই অর্জন করেছিল। অমন সুন্দরী যুবতির বডি গার্ড হতে পারা চাড্ডিখানি কথা নয়। কেউ কেউ বলতে শুরু করল, যতক্ষণ ছোটো ম্যাডাম না ঘুমোবেন, মজুমদার ডিউটি দিয়ে যাবে।

আমি তাকে দেখেছিলাম দূর থেকে। মাথায় মজুমদারের চেয়ে উঁচু, পাঁচফুট সাত ইঞ্চির মতো হবে, মাজা মাজা গায়ের রঙে আশ্চর্য লাবণ্য, মাথাভরা চুল, বেতস গাছের মতো টান টান দেহলতা, উদ্ধত যৌবনে আভিজাত্য ছিল, ছিল ছোটো নদীর বহমানতা। হালকা নীল শাড়ি, হালকা নীল ব্লাউজ। সে উঠল গাড়ির পিছনে, সঙ্গে বড়ো ম্যাডাম, মিসেস মল্লিক। মজুমদার ড্রাইভারের পাশে। একদিন দেখলাম গাড়ির পিছন থেকে নামছে শ্রেয়া চৌধুরী একা। মজুমদার ড্রাইভারের পাশ থেকে। জেলা কালেক্টর — ডি. এম-এর বাংলো কালেক্টরের অফিসের লাগোয়া। তবে প্রাচীরে ঘেরা। বড়ো গেটের মুখে সেন্ট্রি রাইফেল উঁচিয়ে। ভিতরে টেনিস কোর্ট, বাগান, প্রাচীরের গা ঘেষে একশো বছর পার করা বুড়ো শিরীষ, পিপুল, কদম, মেহগনি, অশ্বত্থ। কয়েক কাঠার সব্জি-খেত। তাতে শীতের সময় শখের ফুলকপি, টমেটো ইত্যাদি হয়। সব ব্রিটিশের রেখে যাওয়া দর্পের চিহ্ন। ব্রিটিশের যে যে উত্তরাধিকার আমরা সযত্নে রক্ষা করছি, তা হল প্রশাসনিক রীতিনীতি, দেশ শাসনের আইন-কানুন। যে আইনে ব্রিটিশ সরকার এ-দেশ শাসন করত, সেই আইনই বলবৎ রয়েছে স্বাধীন দেশে। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম শ্রেয়া চৌধুরী আমাদের অফিসের দিকেই আসছেন। তাকে পথ চিনিয়ে চিনিয়ে আসছে মজুমদার, ‘ইয়েস ম্যাডাম, এই দিকে, এই দিকে, এমন হতে পারে আপনি এলেন আমাদের গার্জেন হয়ে, যেমন আছেন বড়ো সায়েব, মোস্ট ওয়েলকাম ম্যাডাম।’

আমরা অবাক হয়ে দেখলাম এই কথা বলতে বলতে মজুমদার শ্রেয়া চৌধুরীকে এ.ডি.এম-মিঃ গগন শ্রীবাস্তবের চেম্বারে নিয়ে গেল। শ্রীবাস্তব সেই মানুষটি যার বাংলোয় খাঁটি গোরুর দুধ পৌঁছনোর ব্যবস্থা করেছে মজুমদার। ইউ.পি.-বিহার সীমান্তের ছেলে মিঃ শ্রীবাস্তবের ব্যবহার ভালো নয়। আমাদের তুচ্ছ মনে করেন। ভিতরে মিস শ্রেয়া চৌধুরীকে রেখে মজুমদার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে থাকল। পায়চারি করতে লাগল। ঘড়ি দেখতে লাগল। রুমালে ঘাম মুছতে লাগল।

আমি ডাক দিলাম, মজুমদার, আমাদের দিকে একটু তাকাও।

মজুমদার এগিয়ে এল, ম্যাডাম বেরোলে আমাকে খুঁজবেন।

আরে শ্রীবাস্তব সায়েব তোমার ম্যাডামকে এখন ছাড়বে না। বলল শুভময় সেন, আমার চেম্বারে সে এসেছিল হয়তো শ্রেয়াকে এই বিল্ডিংয়ে ঢুকতে দেখে।

মজুমদার ঘড়ি দেখল। বিড়বিড় করল, দু-টোয় লাঞ্চ।

এখনও অনেক দেরি, তুমি চঞ্চল হচ্ছ কেন?

মজুমদার চুপ করে থাকে। তখন আগস্ট মাস। বর্ষা কদিন বন্ধ। একটা গুমোট ভাব চারদিকে। মজুমদারকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, শ্রীবাস্তবের মিসেস তো পটনা।

হ্যাঁ। মজুমদারে কন্ঠস্বর ম্রিয়মান।

দেখ, বড়োসায়েব যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তা পালন করো ঠিকঠাক করে। শুভময় সেন বলল গম্ভীর গলায়, অফিসটা বৃন্দাবন হয়ে গেল, বেশ বেশ!

মজুমদার চুপ। গগন শ্রীবাস্তব ছ-ফুট উঁচু, মস্ত দেহ তার। ঈষৎ লাল চোখ দুটি বনবন করে ঘুরছে সব সময়। মহিলা অফিসার তানিয়া সেন তার ব্যাপারে বিরক্তি প্রকাশ করেছিল আমার কাছে, নতুন এ.ডি.এম-এর চোখ ভালো নয়, লোকটার কথাও ভালো না।

কেন কী হল? শুভময় সেন জিজ্ঞেস করেছিল।

ফাইল নিয়ে গেলে আটকে রাখে, আবোলতাবোল গল্প জোড়ে।

তোমাকে তো ঘন ঘন ডেকে পাঠায়। শুভময় বলে।

হ্যাঁ, আমি ফাইল পাঠিয়ে দিই, যাই না। কিন্তু ফাইলে যদি বারবার স্পিক লেখে, যেতে হবে। অথচ ফাইলের কথা না বলে বিচিত্র সব কথা বলে।

কী কথা?

তানিয়া বলেছিল, বলা যাবে না।

ডি. এম. সায়েবকে বলো, আমরা সবাই যাব। শুভময় প্রস্তাব দিল।

না, বড়ো সায়েব ওঁকেই সাপোর্ট করবেন, আমি বদলি নেব, আর এ সব বিষয় পাঁচজনে জানলে মেয়েদের দোষই দ্যাখে।

তানিয়া জেলা থেকে বদলি হয়ে গেল তারপর। গগন শ্রীবাস্তব স্পিক করতে বললেও সে আর যেত না তার চেম্বারে। তখন মজুমদার তানিয়াকেই দোষ দিয়েছিল, সায়েব ডাকলে যেতেই হবে। সায়েব তোমাকে নিয়ে ব্লক ভিজিটে যাবেন, তুমি যাবে না কেন? এ তো ইন-সাবর্ডিনেশন, আমি তো যাই সায়েবের সঙ্গে এখন, আমার আলাদা গাড়ি।

কতদিন আগের কথা এসব। সব কেমন ঠিকঠাক মনে আছে। মনে করতে ভালো লাগে। সুনন্দা যে বলেছিল শৈশবের কথা মনে নিয়ে আসতে, তা কেন আসে না জানি না। মনে আসে মজুমদার, শ্রেয়া চৌধুরী, শুভময় সেন, মল্লিক সায়েবদের কথা। এসব তো অনতি-অতীত।

মজুমদার একটু পরে বলেছিল, ম্যাম নিজেই তো বললেন মিঃ শ্রীবাস্তবের কাছে যাবেন, বড়ো সায়েবের সামনেই তো বললেন, সায়েব বললেন নিয়ে আসতে।

মিস শ্রেয়া চৌধুরী বেরিয়ে এলেন একঘণ্টা বাদে। ছুটে গেল মজুমদার। তরুণীর চোখমুখ আনন্দ আর তৃপ্তিতে ঝলমল করছিল। হাসি হাসি মুখখানি।

শুভময় সেন বলল, স্যাটিসফায়েড।

এরপর নিয়ম করে প্রতিটি দিন তাকে নিয়ে আসতে লাগল মজুমদার। তাকে ঢুকিয়ে দিয়ে মজুমদার আমার ঘরে এসে বসে থাকে।

শুভময় সেন একদিন বলল, বড়ো বড়ো সায়েবদের বড়ো বড়ো ব্যাপার, তুমি না বড়ো সায়েবের রোষে পড়ে যাও মজুমদার, তুমি তোমার যে ডিউটি নিয়েছ, তা খুব রিসকি, এ.ডি.এম-এর চেম্বারে আচমকা ঢুকে পড়তে পারবে, স্যারের ভাগ্নী কী করে পটনাই ষাঁড়টাকে ধরল এসেই, এঁর সঙ্গে এত সময়?

বাদ দাও ওসব কথা, সায়েবদের কথা নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না।

আরে আচমকা ঢুকে পড়ো চেম্বারে।

উনি পছন্দ করবেন না, ইন্টারকমে যোগাযোগ করার অর্ডার আছে।

কথা উঠবে মজুমদার, তানিয়া সেনকে ঘরে ডেকে কাজের অছিলায় আটকে রাখত শ্রীবাস্তব সায়েব, তোমার মনে নেই, অশ্লীল গল্প জুড়ত, তানিয়া বলেনি? আমি বললাম।

মজুমদার বলল, সায়েব যা বলবে, তা আমাকে করতে হবে বাসু। উনি ক’দিন বাদেই জয়েন করবেন ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে, তখন কী হবে?

কী হবে মজুমদার?

মজুমদার বলল, তুমি বুঝতে পারছ না বাসু। উনি অপশন দিয়ে এই স্টেটেও আসতে পারেন। পারেন কিনা? তখন আমি ওর অধীনে চলে যাব।

তাতে হবে কী, উনি কি স্যালারি বাড়িয়ে দেবেন, না অ্যাডিশনাল ইনক্রিমেন্ট পাইয়ে দেবেন? শুভময় জিজ্ঞেস করেছিল।

মজুমদার এড়িয়ে গিয়ে বলল, ওই উনি বেরোলেন, উনি ইন্টারভিউ-এর জন্য রেডি হচ্ছেন, ওঁর কাছে সেই কারণেই আসেন, শ্রীবাস্তব সায়েবের র‌্যাঙ্ক ছিল ঊনআশী।

ছোটো শহর। এ শহরে গোপন কিছু থাকে না। অফিসে ফিসফাস আরম্ভ হয়ে গেল। শ্রীবাস্তবের বাংলোর বারান্দায় বসে থাকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মজুমদার, ভিতরে ডি. এম-এর ভাগ্নী আর আর পট্টলিপুত্তরের আর্যপুত্র। আমরা চুপচাপ। বড়ো সায়েবের কানে গেলে অনর্থ হবে। মজুমদারের চাকরির ক্ষতি হয়ে যাবে। তোমাকে বলেছিল, ভাগ্নীর দেহরক্ষী হতে, তুমি তাকে কার কাছে ঠেলে দিয়েছ? শ্রীবাস্তব মেয়েখোর আর সে মেয়েই বা কী, ওর পাল্লায় গিয়ে পড়ল, বিবাহিত পুরুষ, এ নিয়ে সমস্যা হতে পারে।

মজুমদারকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, সায়েব ম্যামদের ব্যাপার তারা বুঝবেন, আমার ডিউটি আমি করব বাসু।

জেলা শাসক ‘বাসু’ বলেন, তাই মজুমদারও। আমি বললাম, তুমি জড়িয়ে যাচ্ছ। ও মেয়ে ফুর্তি করে তোমার নামে দোষ দেবে, তুমিই তাকে নিয়ে গেছ ওর কাছে। শ্রীবাস্তব বড়ো অফিসার, মদ আর মেয়েমানুষে ওর খুব রুচি, ওর কিছু হবে না। ওদের কিছু হয় না। ফাঁসবে তুমি আঁচল না ছুঁয়েও।

মজুমদার গোমড়া হয়ে থাকল, জবাব দিল না।

শুভময় সেন বলল, তোমার নার্সিং সার্ভিসে গেলেই ঠিক হত।

কথাটা গায়ে মাখে না মজুমদার। কোনো অপমানই গায়ে মাখে না। প্রতিক্রিয়া জানায় না। আসলে সে ছিল ‘কুল’, প্রকৃত অর্থেই তা। কিন্তু সে মনে রাখত সব। সময়ে এলে শোধ নিত। শুভময় সেন আর আমি কেউ-ই বাদ যাইনি। আমাদের বিরুদ্ধে এনকোয়্যারি করে রিপোর্ট দিয়েছিল মজুমদারই। সে ছিল শাণিত বুদ্ধির মানুষ। কয়েকদিন বাদেই হঠাৎ ছুটি নিয়ে লোকাল নার্সিং হোমে ভরতি হয়ে গেল। মজুমদারের চেনা ডাক্তাররা বলল, সত্যি মজুমদার, সায়েবের হার্টের দপদপানি বেড়ে গেছে, সাতদিন পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। জেলা শাসক তার খোঁজ নিলেন, বুঝেছিলেন নিশ্চয় সবটা। তাঁর কানে কি যায়নি? এরপর শ্রেয়া চৌধুরী ফিরে গেলেন জীবনের পাঠ নিয়ে। মজুমদার নার্সিং হোম থেকে ছাড়া পেল আর ক-দিন বাদে। তাঁর আসা যত উচ্চকিত ছিল, যাওয়া ছিল নিঃশব্দে। শুনছিলাম শ্রীবাস্তব সেই সময় আচমকা পটনা চলে গিয়েছিল। বাড়ি থেকে ডাক এসেছিল মিসেসের। তাঁর কাছে কি খবর চলে গিয়েছিল? তিনি তো তাঁর কামুক স্বামীটিকে চিনতেন। আর তার তীব্রতা হয়তো পছন্দও করতেন। কিন্তু স্বামী অন্য নারীতে মত্ত হলে তিনি কী করে স্থির থাকবেন? ক-দিনের ভিতরে বউ বাচ্চা নিয়ে ফিরেছিল শ্রীবাস্তব। মনে হয় খবরই পেয়েছিল তার বউ।

শ্রীবাস্তব মহকুমা ভিজিটে গেলে কী করে তা জেলায় কি অজানা ছিল? আর্যপুত্র শ্রীবাস্তবই ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে জানত। শ্রীবাস্তব সঙ্গে নিয়ে যেত মজুমদারকে। ডাক বাংলোর কেয়ার টেকারকে বলে সায়েবের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করত মজুমদার। এসব খবর শুভময় সেন বলাবলি করত। বলত, মজুমদারটা মেয়েমানুষের দালালি করে সায়েবের সঙ্গে গিয়ে।

না না, এসব কথা বলা ঠিক নয়, ওকে নিয়ে যায় সায়েব, তাই যায়। আমি মজুমদারকে আড়াল করতে গিয়েও পারি না। শুভময় সেন বলত, ওকে দরাদরি করতে নিয়ে যায় শ্রীবাস্তব।

তখন চুপ করে থাকা ব্যতীত উপায় ছিল না। কথায় কথা বাড়ে। কারো কানে গেলে আমার বিপদ হবে। সন্দেহ হত, আবার মনে হত তা অমূলক। শ্রীবাস্তবের বউকে আমি তো দেখেছি। তার ভিতরে বন্য সৌন্দর্য ছিল। সায়েবের বউ কি কোনো আন্দাজই করতে পারে না? সব জেনেও কি স্বামীর গা ছুঁয়ে থাকে, আহ্লাদে ডগমগ করে। সে তার স্বামীতে ছিল মুগ্ধ। আমরা দেখেছি তা। কোনো অনুষ্ঠানে এলে তার হাতই ছাড়ত না প্রায়।

শুভময় সেন বলেছিল, তার স্বামী যদি গাঁয়ের গরিব মেয়েদের ইজ্জত লুট করে, তাতে তার কিছু যায় আসে না। পুরুষ মানুষ তো তা করবেই। গরিব আদমির জন্মই তাদের সেবা করতে। কিন্তু স্বামী যদি ইজ্জতঅলা মেয়ে ধরে তখন সে ক্ষিপ্ত। সেখানে তার অধিকারে টান পড়ে। তাই ফিরে এসেছিল সে। শ্রেয়া চৌধুরী বা তানিয়া সেন তার অধিকার হরণ করবে তা সে মেনে নেবে না। তখন বাঘিনীর রোষ জাগে তার ভিতর। কিন্তু গাঁয়ের চাষার মেয়েকে স্বামী ভোগ করলে তার ভিতরে কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয় না। তাদের ভোগ না করলে কিসের ক্ষমতা! কিসের পুরুষ! গন্ধি লেড়কিগুলো আছেই তো ওই করতে। হয়তো দেখা যাবে বড়ো ভূ-স্বামীর কন্যা সে। শ্রীবাস্তবকে বিশ-তিরিশ লাখ বর পণ দিয়েছে তার বাবা। বাবার আছে তিনটে পোষা মেয়েমানুষ। কী সুন্দর বলত শুভময়। সে আসলে ডায়েরি লিখত গোপনে। বিয়ে করেনি, একা থাকত। হয়তো অনেক কথাই বানাত নিজের মতো করে। বলত, ফিউডাল সোসাইটির মানসিকতা এমনই হয়। মাঝে মাঝে শুভময় বাড়ি যেত। ভাইপো ভাইঝিই ছিল তার প্রাণ।

শুভময় বলত, শ্রীবাস্তব তাকে তৃপ্ত করেছে, সন্তান দিয়েছে, তাও আবার পুত্র সন্তান, আর সেই কারণেই দিয়েছে সামাজিক ইজ্জত, মোটা মোটা গয়না, আর কী চাই? স্বামী যদি দশটা গাঁয়ের মেয়ের ইজ্জত নেয়, তার কী? পুরুষের সেই অধিকার আছে, তাতে পুরুষের ক্ষমতা প্রমাণ হয়। লেকিন, ওই চৌডরি! কভি নেহি। গরগর করতে করতে সে ফিরে এল যখন ‘চৌডরি’ উধাও। না হলে বিচিত্র এক দৃশ্য নির্মাণ হতো নিশ্চয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *