২
মজুমদার একদিন এসে বলল, ‘গতকাল বড়ো ম্যাডাম আমার বউকে একটি পারফিউম পাঠিয়েছে, কী সুগন্ধ তার!’ বলতে মজুমদারের চোখমুখ উদ্ভাসিত। শুনে শুভময় সেন বলল,
‘ওইটা তুমি গায়ে স্প্রে করো মজুমদার, আজ করেছ নাকি?’
না, ওটা মেয়েদের পারফিউম, আমার হবে না। মজুমদার বলেছে।
তোমারই হবে। শুভময় সেন বলেছিল।
তুমি জান না, আমার গায়ে ওই গন্ধ পেলে স্যার ধরতে পারবেন, ওইটা বড়ো ম্যাডামই গায়ে দেন, আমার বউকে দিয়েছে আমি কেন গায়ে দেব?
আসলে তোমার জন্যই দিয়েছে। শুভময় সেন বলেছে।
কী বলছ তুমি, এটা মেয়েদের।
ম্যাডাম তোমার জন্যই দিয়েছে।
না, না, না। মজুমদার তীব্র আপত্তি জানিয়েছে, তুমি জান না।
শুভময় সেন মাথা নেড়েছে, জানি, যা বলছি তা হতেই হবে।
অনেকটা কথাবার্তার পর মজুমদার টের পেল শুভময়ের ব্যঙ্গ। গম্ভীর হয়ে গেল। কথা বদলে দিলাম আমি। কিন্তু মজুমদার আর বসল না। সে আচমকা উঠে যেতেই শুভময় মন্তব্য করল, শালা, তোকেই দিয়েছে ম্যাডামের ঝি, কাজের মেয়ে-বউকে বাড়ির কর্ত্রী কি দেয় না, এরপর শাড়ি দেবে, ম্যাক্সি দেবে, ফেলে দেওয়া নাইটি দেবে, রাতে বেঁচে যাওয়া বিরিয়ানিও দেবে, তুই খেয়ে ধন্য করবি ওঁদের।
এখন মজুমদার কোথায়? আমার মতো সব ক্ষমতা থেকে মুক্ত হয়ে কি বাড়ির ব্যালকনিতে বসে থাকে দিনভর। নিঃঝুম নগরের পড়ন্ত বেলা চোখে নিয়ে দিন কাটায়? একা একা। দিন পার করে সন্ধ্যা, রাত্রি। জীবনে কত ক্ষমতা ভোগ করেছে সে তা বলতে থাকে লুঙ্গি আর ফতুয়া পরা বুড়োদের তাসের আসরে বসে? বলে নাকি তখন আমি পশ্চিম দিনাজপুরে, পশ্চিম ভেঙে উত্তর আর দক্ষিণ দিনাজপুর হয়নি, আমি নাজারত ডেপুটি কালেক্টর …. আঙুলে ঘিয়ের গন্ধ শোঁকে মজুমদার! ম্যাডাম মল্লিক, ডিয়েমের ওয়াইফ আমাকে কী ভালোই না বাসতেন, আমার স্ত্রীকে পারফিউম, শাড়ি, আমাকে পাঞ্জাবি …. বলে, তখন আমি অচিনপুর, মিস শ্রেয়া চৌধুরী এসেছিলেন বেড়াতে, তিনি এখন পটনায়, ইরিগেশনের ডিপার্টমেন্টাল সেক্রেটারি, তাঁর সব ভার ছিল আমার উপর …., আমি তাকে শেখালাম কী করে প্রশাসন চলে, কী ভাবে ল অ্যান্ড অর্ডার মেইনটেইন করতে হয়।
এসব এখন আমার মনে হয়। একা ব্যালকনিতে বসে মজুমদারকেই মনে পড়ে বেশি।
আমার ছেলে আমেরিকায় সেটল করেছে। থাকে ক্যালিফর্নিয়া স্টেটের সান-দিয়েগো শহরে। প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে সেই শহর। আমি ইন্টারনেটে দেখেছি চারশো বছর আগে স্পেনীয়রা প্রথম ওই উপকূলে জাহাজ নোঙর করে। ক্যালিফর্নিয়ার পুব দিকে সান-দিয়েগো। ছেলের সঙ্গে কোনো কোনো রোববার ইন্টারনেটে ফেসবুকে কথা হয়। ভিডিও চ্যাটে ওর ঘর দেখা যায়। ও আর বউমা দুজনে এঘর ওঘর করে, ল্যাপটপ নিয়ে। চোদ্দতলা থেকে নীচের শহর দেখা যায়। যদি আমি সকালের ভিতর থাকি, ওরা আগের দিন রাতে। দীপাবলীর আলোর মালায় সেজেছে সেই শহর। খোলা জানালা দিয়ে ওদের ঘরে প্যাসিফিকের বাতাস ঢোকে, কী সেই হাওয়া। আমাদের ঘরে এসেও ঢোকে যেন। তোলপাড় করে দেয় মন। আমি কি কখনও ভেবেছিলাম এই রকম। মেজমাসির বড়ো ছেলে সুবীরদা যখন চলে গেল লন্ডনে (আমরা বলতাম লন্ডন, ছেলে বলেছে ওটা হবে লানডান), কী রকম ছোটো না লেগেছিল নিজেকে। আমাদের সাতপুরুষের কেউ বিদেশ যায়নি, যাবেও বলে মনে হয় না। সুবীরদা গিয়েছিল বিলেতের হাসপাতালে চাকরি করতে। ফিরেও ছিল বছর দুই পরে পাকাপাকি ভাবে। নিজের দেশ ছেড়ে মা বাবা ভাই বোনকে ছেড়ে বিদেশে মন বসেনি। বড়ো অফার পেয়ে ওদেশে থাকা সব্যস্ত করেও থাকেনি। সে ফিরে এলে আমার বাবা, সুবীরদার ছোটো মেসো বলেছিলেন, ‘ঠিক করেনি সুবীর, বিলেতে থাকলে অনেক বড়ো হতে পারত। ওটা ইংরেজের দেশ, ওদেশে এখনও রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ আছেন। ওদের সাম্রাজ্যের সূর্য অস্ত যেত না একসময়, আবার ওদের সুদিন ফিরবে।’
সুবীরদা এসব কথা কানেই নেয়নি, তুচ্ছ করে দিয়েছিল সকলের মতামত। বলেছিল, আমি আমারটা ভালো বুঝি, কী করতে হবে, হবে না তাও জানি, কলেনিয়াল হ্যাং ওভার কাটেনি এদেশের মানুষের, পারলে আবার ওদের ডেকে আনে।
সে আমাদের ছোটোবেলার কথা। কত বয়স হবে তখন বারো তের। মনে হয়েছিল, সুবীরদার খুব অহংকার, বুঝবে পরে, আফশোশ করবে। বাবাই ঠিক কথা বলেছে। এখনো তাই মনে হয়। কিন্তু মন তো খারাপ হয়। কতদূরে ছেলেটা। আমাদেরও বয়স হচ্ছে। এখন ছেলে-বউ, নাতি-নাতনি নিয়ে দিন কাটাবার সময়। কত আহ্লাদ করা যেত। যে বয়সের যা।
বাবা বলতেন, ওসব বড়ো বড়ো কথা, ও তো নকশালদের মতো কথা বলছে, ইন্ডিয়ানরা কি দেশ শাসন করতে পারে, ওদেরই আবার ডাকতে হবে তা জানে সায়েবরা, ওদের দেশে গুণীর কদর আছে। সুবীর খুব ভুল করল।
সেই সুবীরদা এখন বাঙ্গালুরু ছাড়িয়ে গিয়ে কর্নাটক আর মহারাষ্ট্রের সীমান্তে মহারাষ্ট্রের সেই লাতুর জেলার কিল্লারি গাঁয়ে চিকিৎসা করেন। কোন লাতুর জেলা? ১৮ বছর আগে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল যেখানে, সেই লাতুরের কথা বলছি। সে একটা কথা। আমার বন্ধু সুবিমল খবরের কাগজে আছে। সাংবাদিকতা তার কাজ। সে অযোধ্যায় গিয়েছিল ৯২-এর ডিসেম্বরে। তার রিপোর্ট ছিল অসম্ভব ভালো। সে লাতুর গিয়েছিল ১৯৯৩-এর অক্টোবরে। পুজোর ঠিক আগে আগে। লাতুরের রিপোর্টে সে এক বাঙালি ডাক্তারের কথা লিখেছিল, সুবীর ভদ্র। কর্নাটকের প্রত্যন্ত গাঁয়ে দাতব্য চিকিৎসালয় চালান, পুরো ইউনিট নিয়ে ভূমিকম্প পীড়িত এলাকায়। আমি ওর লেখা পড়ে উত্তেজিত হয়ে ফোনে যোগাযোগ করেছিলাম সুবিমলের সঙ্গে। সুবিমল আমার খোঁজ নিয়ে বলেছিল সে আসবে ওই জেলায় তার সাংবাদিকতার কাজেই। আমি তখন কলকাতা থেকে দূরে উত্তরবঙ্গের সেই জেলায়, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। অনেক দপ্তরের ভার আমার উপর। জেলা শাসক মল্লিক সায়েব মধ্যবয়সী সিভিল সার্ভিসের অফিসার, প্রমোশনে আই.এ.এস। সেই মানুষটির অনেক গুণ। নিরামিষাশী। উত্তর-ভারতীয়রা যে বলে, ‘মছলিখোর বঙ্গালি’ কী করে হিন্দুত্ব রেখেছে তা তিনি সমর্থন করেন। সুবিমল আমার কোয়ার্টারে এসেছিল জেলা কভার করতে এসে। ওর জন্য ভালো বাংলোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। একদিন সন্ধেয় সেই বাংলোয় মদের আসর বসিয়েছিলাম। মজুমদার আমাকে সাহায্য করেছিল ভালো ব্র্যান্ডের হুইসকি উপহার দিয়ে। ও ছুঁয়ে দেখত না, বসে থাকত সামনে। শহরের সব চেয়ে বড়ো ডিলারকে বলে দিত কোন সায়েব কী চাইছেন, কী দিতে হবে, কখন দিতে হবে?
সুবিমল আমার কোয়ার্টারে এসে বলেছিল,মানুষটার জন্য গর্ব হয় বিপুল, মনে হল জীবনের একটা মানে খুঁজে পেয়েছেন ওখানকার ‘ডাগদারসাব’। আরে আমাকে বলল, নিজে শুদ্ধ না থাকলে, মন পবিত্র না থাকলে নাড়িজ্ঞান হয় না। নাড়িজ্ঞান না থাকলে চিকিৎসা কী করবে ডাক্তার, এই রকম নাকি তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইচ্ছামতী উপন্যাসে এক কবিরাজের মুখে শুনেছিলেন। তিনি নিজেকে শুদ্ধ রাখেন, অর্থের কথা ভাবেন না, কী রকম মানুষরে ভাই, ওদিকের মানুষের কাছে ভগবান।
আমি আর সুনন্দা অবাক হয়ে সেই রূপকথা শুনছিলাম। শুনতে শুনতে সুনন্দা বলেছিল, তুমি হাটেবাজারে বলে একটা সিনেমা দেখেছ সুবিমলদা, বনফুলের উপন্যাস, অশোককুমার, বৈজয়ন্তী মালা, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন।
কে দ্যাখেনি সেই সিনেমা, বনফুল নিজে ডাক্তার ছিলেন, ওই ডাক্তারকে উনি নিশ্চয় দেখেছিলেন। কিন্তু সিনেমার চেয়েও ওই ডাক্তারের জীবন আরো কালারফুল, বিলেত থেকে ফিরে এসেছিলেন গরিব দেশবাসীর চিকিৎসার করবেন বলে, মূলত শিশুদের দ্যাখেন, বড়োদেরও দেখতে হয়।
সুবিমল অনেক কথা বলেছিল সেই ডাক্তারকে নিয়ে। আমাকে তাঁর ফোন নম্বর দিয়েছিল সে-ই। সুবিমলকে নিয়ে আমি জেলা শাসকের কাছে গিয়েছিলাম। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। সুবিমল ভূমিকম্প পীড়িত লাতুর জেলার কথা শুনিয়েছিল তাঁকে। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কত কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। কফি নিয়ে ঘন্টা দেড় আড্ডা হয়েছিল। নামী সংবাদপত্রের সাংবাদিক। তাকে তো খাতির করতে হয়। আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন জেলা উৎসবে। সেই উৎসব হত বর্ণাঢ্য। তার জন্য খরচও হতো দেদার। জেলার বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীরা অকৃপণ হাতে বাড়িয়ে দিতেন। শীত ওখানে চমৎকার। উৎসবের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল বহুদূর পর্যন্ত। কলকাতা থেকে ট্যুরিস্টের ভিড় হতো। আদিবাসী নৃত্য, ভাওয়াইয়া থেকে নানা লোক সংগীত, লালনের গান, রবীন্দ্রনাথের গান, শাস্ত্রীয় সংগীত, সব হত। চিত্রতারকাদের নিয়েও অনুষ্ঠান হতো। আগে অতটা বড়ো করে হত না। মল্লিক সায়েব জেলার ভার নেওয়া পর উৎসব বৃহৎ আকার ধারণ করেছিল। কিন্তু সত্য সন্ধানী সুবিমল অনাহারী গ্রাম নিয়ে দীর্ঘ রিপোর্ট করেছিল। উদাসীন জেলা প্রশাসনের অজ্ঞাতে অনাহারে মৃত্যু হচ্ছে। আশ্চর্য, সুবিমল যে এই খবর করতেই এসেছিল আমাদের জেলায় তা আমিও জানি না। আমি তাকে কত সাহায্য করলাম, মদ উপহার দিলাম, সবই তো জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে, নাজিরখানা দিয়েছিল টাকা। সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা দূরের কথা, আমাদের বিব্রত করে গেল। অনাহার যত না, বলল অনেক বেশি। এক বেলা, আধ-পেটা খাওয়া, না খাওয়া, উপোস, এসব তো আমাদের দেশের মানুষের অভ্যাস, না খাওয়া মানুষ কোথায় নেই, কোন জেলায়? এটাকেই ওই সব মানুষ তাদের জীবনের অন্তর্গত বলে মেনে নিয়েছে।
‘সাতপুরুষ ধরেই তারা না খেয়ে থাকে, তাতে কী হয়েছে? না খাওয়া তাদের অভ্যেস, সাংবাদিক হারামি খুঁচিয়ে ঘা করল।’ কথাটা বলেছিলেন ডি.এম — মল্লিক সায়েব।
মল্লিক সায়েব আমাদের সকলের কর্তা। তাঁর প্রতিক্রিয়ার কথা শুনেছিলাম আমি মজুমদারে মুখে। এতটাই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন বড়ো সায়েব, যে খিস্তি করতে তাঁর বাধেনি। এটা ঠিক করেনি সুবিমল। বিধানসভা অবধি গড়াল অনাহারের রিপোর্ট। টেলিভিশনে খবর হল। ক্ষতি আমার হল, তারপর থেকে মল্লিক সায়েবের ভালো নজর থেকে আমি সরে গেলাম। তাঁর স্থির বিশ্বাস সবটাই আমি জানতাম। আদিবাসীরা কবে খেতে পায়? খাওয়ার গল্প শুনেই তাদের দিন কাটে, তা কে না জানে। আর তারা না খায় তাই বা বলল কী করে, তারা বনের ফল-পাকুড়, কন্দমূল, সাপ-ব্যাঙ, পিঁপড়ের ডিমেই অভ্যস্ত, বিরিয়ানি দিলেও খাবে না।
এসব কতদিন আগের কথা। মল্লিক সায়েবকে আমি একটুও ভুলিনি। এখন এই প্রায় নির্জন বাড়িতে বসে চাকরিজীবন নিয়ে নানা কথা মনে পড়ে। তা ছাড়া কীই বা মনে থাকবে। জীবনের সঞ্চয় তো ওইটুকু। আমার জীবনের দুটি কাজ, একটি আমার সন্তানটিকে মনের মতো করে তৈরি করা, অন্যটি হল এই বাড়ি। সল্টলেক সিটিতে এই বাড়িটি করেছিলাম মনের মতো করে। বিধাননগরের চেয়ে সল্টলেক সিটি নামই আমার পছন্দ। ওয়াশিংটন সিটি — ওয়াশিংটন সিটি মনে হয়। কত কষ্ট করে এই বাড়ি করেছিলাম। জমি জোগাড় করেছিলাম পুরোনো সহকর্মী মজুমদার আর অফিসের এক অধঃস্তন কর্মচারীকে ধরে। তার ভগ্নিপতি সে বছর রাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন। আমাকে তাঁর কাছেই নিয়ে গিয়েছিল সে। বদলে তাকে অফিসের এমন ফাইল দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল যার ভিতরে টাকা আছে। এ ব্যাপারে আমাকে চুপ করে থাকতে হয়েছিল। তাতে কী হয়েছে? ওই ফাইল যার হাতে যাবে, সেই টাকা নেবে, তাহলে ভবতোষ গাঙ্গুলী টাকা নিলে কী দোষ? কেউ না কেউ তো নেবেই। কিন্তু আগে টাকা নাকি ভাগ হতো, ভবতোষ সেইটা বন্ধ করে দিল। সে একাই নিতে লাগল। তখন ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিল ধীরে ধীরে। এক বছরে বেশি ওই ফাইল যেন না দেওয়া হয় কাউকে। বদলে বদলে সকলেই সুযোগ পাক। আমার বদলি হয়ে গেল সেই সময়। জমি পেয়ে তা রেজিষ্ট্রি করে পজেশনও পেয়ে গেছি।
সুতরাং বদলি। আমার বদলে যিনি এলেন তাকে আমি বলে এলাম ওই অর্থকরী ফাইল ঘুরিয়ে সকলের হাতে দিতে। সেই বাড়িতে আমরা এখন দুজন। আমি বুড়ো হয়েছি, আমার বউ বুড়ি হয়েছে। আগের মতো আর খাটতে পারে না। আগের মতো আর উৎসাহ প্রকাশ করতে পারে না। সারাজীবন ও-ই আমাকে চালিয়েছে, এখন বলে, কিছুই তার ভালো লাগে না। আমাদের একটি নাতনি হয়েছে, তার এখন বছর চার। রয়েছে সেই সাতসাগরের ওপারে। তাকে দেখছে এখন বউমার মা, বাবা, এরপর যাব আমরা। পালা করে যাওয়া স্থির হয়েছে। অপেক্ষা করছি কবে যাব বিদেশে। কিন্তু আমার বউ বলছে, যাবে না। কেন যাবে না? ওর এখন কিছুই ইচ্ছে করে না। চুপচাপ বসে থাকে। এমনিতেই ও খুব খেয়ালি। ওর মন খারাপ অনেকদিন থেকে যায়। চুপচাপ থাকে, মাঝে মাঝে বলে ওঠে, এ জীবনের মানে কী?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কী হয়েছে?
ও বলল, কিছু হয়নি।
তাহলে চুপ হয়ে গেলে কেন?
কী করব চুপ করে না থেকে?
কিছু একটা হয়েছে তোমার।
না কিছু হয়নি। বলে সুনন্দা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। আমি ব্যালকনি থেকে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। একটা বুড়ো মতো লোক আসছে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে। রোগা, মাথার চুল সাদা। জিনস আর রঙিন চেক শার্ট। এ পাড়ার লোক বলে মনে হয় না। বাড়ির নম্বর খুঁজছে মনে হয়। একটা লোককে জিজ্ঞেস করছে কিছু। খোঁজ নিচ্ছে কোনো বাড়ির। আমি দেখতে দেখতে ভাবি আমাদের বাড়ি এলে ভালো হয়। কতদিন আমাদের বাড়ি তেমন লোক আসে না। টেলিফোন হওয়ায় মানুষের যাওয়া আসা কমে গেছে। আমরাও তো তেমন একটা যাই না কোথাও। এখন মানুষের চলন কমে গেছে মনে হয়। টিভিও তার কারণ একটা। বেরোতে গিয়েও মানুষ ঘরে আটকে থাকে এই সব নিয়ে। টেলিভিশনের সিরিয়ালের চরিত্ররাই এখন আমাদের ঘরে এসে বসে। কথা বলে, গান গায়, কাঁদে হাসে, প্রেম-কলহও করে। আমরা তা নিবিষ্ট হয়ে দেখি। শেষ হলে বলি রূপসী আর একটু থেকে যাও। সে থাকে না, তখন অন্যরা আসে অন্য সংসারে অন্য গল্প নিয়ে। সেই গল্পের সঙ্গে আগের গল্পের আপাত কোনো মিল নেই, কিন্তু একই গল্প মনে হয় বারবার। তবে হ্যাঁ, এই সব গল্প কোন সংসারের গল্প তা ধরা যায় না। ধরা যায় না বলেই নিবিষ্ট হয়ে আমরা দেখি।
দোতলার এই ব্যালকনিতে বসে কতদূর দেখা যায়। প্লটটি একদম মনের মতো করে নির্বাচন। সামনেটা খোলা মাঠ, তার গা দিয়ে রাস্তা গেছে বাস রাস্তার দিকে। সুনন্দা কখনও এসে বসে, বেশিরভাগ সময় আমি একা। এই যে সুনন্দা ছিল, এখন উঠে গেছে বাগানের গাছে জল দেবে বলে। বাগানে নানারকম ফুল ফোটে, গাঁদা থেকে গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, জিনিয়া, জুঁই, স্বর্ণচাঁপার গাছও আছে একটি। সিজিনের ফুল সিজিনে ফোটায় মালি। বনসাই করেছে বট, অশ্বত্থ আর গন্ধরাজের। বড়োকে ছোটো করে দিয়েছে। বড়ো যদি ছোটো হয়ে যায়, দেখতে বড়ো ভালো লাগে, এই এখন। মনে হয় ক্ষমতার ডানা ছেঁটে দিয়ে উৎসটাকে বন্দী করে ফেলেছি।
সুনন্দা নির্দেশ দেয়। নতুন নতুন ফুলের জন্য তার সঙ্গে কথা বলে। নিজে চলে যায় নার্সারিতে। সেদিন আমাদের গাড়িটা গ্যারেজ থেকে বেরোয়, ভাড়াটে ড্রাইভার আসে। ফোন করলেই সে হাজির অন্য ডিউটিতে জড়িয়ে না গেলে। নার্সারির গাছের, লতাগুল্মের ভিতরে গিয়ে মনে হয় জীবন অনেক সতেজ ও সুন্দর। বেশ ভালো লাগে। আদর্শ দাম্পত্যের এক রূপ হলো সতেজ গাছ-গাছালি, আর নতুন ফোটা ফুল। তা আমাদের বাগানে কখনও কখনও দেখা যায় ক-দিনের জন্য। তখন কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মন স্থির থাকে, চঞ্চল হয় না। অকারণে উদ্বিগ্ন হয় না। রাতে কোন ফুল ফুটল সেই কথা নিয়ে আমরা প্রাতঃভ্রমণে বের হই। আর সব বয়স্ক ভ্রমণকারীদের ফুল ফোটা খবর দিই। তাঁদের কাছ থেকে তাঁদের বাগানে, টবে ফুল আসার খবর পাই। তখন ইমারতে ইমারতে ভরা শহর ঘুমিয়ে। পথের ধারের রাধাচূড়া কৃষ্ণচূড়ার রং ভাসানো দেখি। আয়ু বৃদ্ধির জন্য কত সময় হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরি। এক একজনকে দেখে মনে হয় ভগবানের কাছে সার্ভিস এক্সটেনশনের প্রেয়ার দিচ্ছে। ভোরের সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে যুক্ত-করে। কত সময় ধরে! হে সূর্য, হে দিনমণি, সব কাজ ফুরোলেও কত কাজ ফুরোয়নি এখনও, বেঁচে থাকতে দাও। রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার চক্রবর্তীবাবুর কাজ কম করে আধ ঘন্টা সূর্য প্রণাম করে। সুগারে লোকটার শরীর শুকনো বাঁশের মতো হয়ে গেছে, কিছুতেই কিছু না হওয়ায়, আদি পিতা সূর্যের শরণাপন্ন হয়েছেন তিনি। হাঁ করে প্রথম আলোকে গ্রহণ করেন তিনি। এর নাম অতি বেগুনি রশ্মিকে শরীরে প্রবেশ করানো। তাতে শরীর নিরোগ হয়! এক সাধুর কাছ থেকে এই নিদান পাওয়া। চক্রবর্তী লোকটা খুব দাপুটে অফিসার ছিল। পিটিয়ে একটা আসামীকে মেরেও ফেলেছিল শোনা যায়। আবার এক গোলমালে গিয়ে মরতে বসেছিল। তার গায়ে বালতি করে কেরোসিন ছুঁড়ে দিয়েছিল ক্ষিপ্ত জনতা। তারপর আগুন ছুড়তে আরম্ভ করেছিল। জিপ নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছিল চক্রবর্তী। মাঝে মাঝে এসব কথা শোনায়। এসবই এখন সম্বল। বিরক্ত সুনন্দা বলে, ‘জাবর কাটতে কাটতেই তোমাদের দিন যায়, শুনলে গা রি রি করে।’
সমস্ত জীবনের সঞ্চয় তো ওই স্মৃতি, ওই কথাই তো মানুষ বলবে এই বয়সে। আমি সুনন্দাকে বলেছি।
সত্যি, কিন্তু বলতে পারে না কেন ছোটোবেলার কথা, ছোটোবেলাটা কেমন কেটেছিল সেই সব কথা?