মুনরেকার
গুপ্ত ফাইলের কাজ
একই সাথে আটত্রিশ ক্যালিবারের রিভলভার দুটো গর্জে উঠল। মাটির নিচে ঘরের দেওয়ালগুলো কেঁপে কেঁপে উঠল। তারপর স্তব্ধতা। জেমস বন্ডের নিজের ওপর বিশ্বাস ফিরে এসেছে। মনে পড়ছে তার আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় গুলি ছোঁড়ার কথা। কোল্ট ডিটেকটিভ স্পেশাল-এর চেয়ার খুলে সে অপেক্ষা করতে লাগল।
ইনস্ট্রাক্টর এগিয়ে এল বন্ডের কাছে। তার এক হাতে একটা লোকের শরীরের ওপরের আধখানা অংশের শিট ছবি। অন্য হাতে পোস্টকার্ড সাইজের পোলারয়েড ফিল্ম। সেগুলো সে বন্ডের হাতে দিল। ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা চোখের সামনে তুলে বন্ড ফটোটার ওপর ঝুঁকে পড়ল। দেখল সেই ছবিতে তার ডান হাত ঘিরে সাদা সাদা ঝলসানো দাগ। ফ্ল্যাশ-লাইট দিয়ে ঠিক গুলি ছোঁড়ার মুহূর্তে ছবিটা তোলা। সে আরো দেখল তার হৃৎপিণ্ডের ঠিক মাঝখানে একটা আলোর বিন্দু। খুশি হয়ে ইনস্ট্রাক্টার বলল, পেটের বাঁ দিকে ঢুকে পেছন দিয়ে গুলিটা বেরিয়ে গেছে। একটা পেনসিল বের করে টার্গেটের ওপর কি-সব সে লিখল। তারপর বলল, কুড়ি রাউন্ড। আমাকে তাহলে দেবেন ছিয়াত্তর।
বন্ড হেসে খুচরোগুলো গুণে গুণে বের করল। বলল, সোমবার বাজির টাকা ডবল করে ধরবেন। ইন্সট্রাক্টার বলল, আমার কোন আপত্তি নেই। আপনি যদি ডিউ আর ট্রফিতে যোগ দিতে চান তবে ঐ বত্রিশ নম্বরের রিভলভারটা ছেড়ে তার বদলে নিতে হবে রেমিংটন। নতুন একটা বাইশ নম্বরের কাটিজ সবে বেরিয়েছে। জেতার জন্য তাই দিয়ে ৮,০০০-এর মধ্যে প্রায় ৭,৯০০ বার টার্গেটে মারতে পারবেন।
বন্ড বলল, গুলি ছোঁড়ায় আমি আপনাকে হারাতে চাই। হাতের তালুতে তাজা বুলেটগুলো বার করে সে টেবিলে রাখল। সোমবার ঠিক এই সময় আবার দেখা হবে, ঠিক এই সময়।
ইনস্ট্রাক্টর বন্ডের গুলি ছোঁড়া দেখে খুব খুশি। কিন্তু গুপ্তচর বাহিনীতে বন্ডই যে সেরা নিশানাদার–সে কথা তার বলা বারণ। কথাটা শুধু জানার কথা M-এর, আর বডের বড়কর্তার।
বন্ড লিফটে গিয়ে উঠল। লিস্টটা তাকে নিয়ে যাবে রিজেন্ট স্ট্রীটের সেই ছাইরঙা বাড়িটার নবম তলায়–সেটা তাদের গুপ্তচর বাহিনীর হেড কোয়ার্টার্স।
গুলি ছোঁড়ার ফলাফল দেখে বন্ড খুশি। সে ভাবতে লাগল কি করে আরও ঝটপট গুলি চালিয়ে মেশিনটাকে হারাতে পারবে। মেশিনটা মাত্র তিন সেকেন্ডের জন্য টারগেটকে তুলে ধরে। তারপর সেখান থেকে তার দিকে মেশিনটা ছেড়ে ৩৮ নম্বরের ফাঁকা গুলি। সেই সঙ্গে তার দিকে ছুটে আসে আলোর একটা শিখা। সঙ্গে সঙ্গে ফটো তোলা হয়ে যায়। ফটোতে দেখায় খড়ি দিয়ে আঁকা গোল বৃত্তের মধ্যে বন্দুক হাতে সে দাঁড়িয়ে গুলি ছুঁড়ছে।
লিফটের দরজা খুলে গেল। বন্ডের সর্বাঙ্গ দিয়ে কর্ডাইটের গন্ধ লিফটম্যানের নাকে গেল। বন্ড ভাবল, আলোটা যদি আর একটু ভাল হত। M কিন্তু বরাবরই জোর দিয়ে বলেন, মোটামুটি খারাপ অবস্থার মধ্যে গুলি ছোঁড়া দরকার। ঝাপসা আলো আর সঙ্গে সঙ্গে টার্গেট থেকে নিজের দিকে গুলি ছুটে আসা বাস্তবে মোটামুটি এরকমটাই ঘটতে পারে। লিফট থামল। মিনিস্ট্রি-অফ-ওয়ার্ক -এর সবুজ করিডোরে বেরিয়ে এল বন্ড। গুলি ছোঁড়া প্র্যাকটিসের কথা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে হেড কোয়ার্টার্সের দৈনন্দিন রুটিন কাজে মন দেবার জন্য প্রস্তুত হল বন্ড। ডান দিকের শেষ দরজাটার দিকে সে এগিয়ে গেল। দরজায় টোকা দিয়ে বন্ড অপেক্ষা করতে লাগল। সকাল এগারটা। দু-দিনের জমা ডকেট আর ফাইল গুলো পড়তে হবে। আর বিদেশে শনিবারেই সাধারণত বহু ঘটনা ঘটে। খালি ফ্ল্যাটে চুরি হয়, নানা অস্বস্তিকর বেকায়দা অবস্থায় স্ত্রী-পুরুষের লুকিয়ে ফটো তোলা হয়। শনিবার যে সব মোটর দুর্ঘটনায় পথে লোকজন নিহত হয়, সাধারণত সেই দুর্ঘটনাগুলো তাৎপর্যপূর্ণ হয় না। এটাই যা বাঁচোয়া। বিবরণ গুলোর ওপর মোটামুটি একবার চোখ বুলিয়ে নিলেই চলে। ওয়াশিংটন, ইস্তামবুল আর টোকিও থেকে চিঠিপত্রের সাপ্তাহিক ব্যাগগুলো ইতিমধ্যে পৌঁছে বাছাই হয়ে যাবার কথা। সেগুলোর মধ্যে তার জন্য কিছু মাল মশলা থাকতে পারে।
বন্ড দরজা খুলে নিজের সুন্দরী সেক্রেটারির মুখের দিকে তাকিয়ে সুপ্রভাত জানাল। তার সেক্রেটারির নাম লোয়েলিয়া পনুসেবি । মেয়েটি দীর্ঘাঙ্গী, যুদ্ধ আর গুপ্তচর দপ্তরে পাঁচ বছর চাকরির পর তার সৌন্দর্যের মধ্যে ফুটে উঠেছে কাঠিন্যের সামান্য ছোঁয়াচ। গুপ্তচর বিভাগের চাকরিটা অনেকটা দিনমজুরের। মহিলা কর্মচারি হলে কারুর সঙ্গেই চাকরির সম্পর্ক ছাড়া অন্য কোন সম্পর্ক পাতানো সম্ভব নয়। কিন্তু পুরুষের বেলা অন্য কথা। মাঝে মাঝে প্রেম করার তাদের একটা অজুহাত থাকে। কিন্তু মহিলা হলে গুপ্তচর দপ্তরের বাইরে কারুর সঙ্গে প্রেমের ব্যাপারে জড়িয়ে। পড়া মানেই দপ্তরের গোপনীয়তা বিপন্ন হবার সম্ভাবনা। মহিলাদের সামনে দুটি মাত্র পথ খোলা থাকে, হয় কাজে ইস্তফা দিয়ে স্বাভাবিক ঘর সংসার পাতা, নয় আজীবন কুমারী থেকে নিজের দেশ আর রাজাকে সেবা করা। পনসেবি জানে একটা চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সময় এসে গেছে। নিজের সহজাত বুদ্ধি তাকে বলছে কাজে ইস্তফা দিতে কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ততই বেশি করে এই রহস্যময় জগতের চমকপ্রদ ঘটনা প্রবাহ এবং রোমান্স হেড কোয়ার্টার্সের অন্য মেয়েদের সঙ্গে তাকে জড়িয়ে ফেলেছে। বন্ড জানতে চাইল কোন খবর আছে কিনা। লোয়েলিয়া বলল, না। কিন্তু তোমার টেবিলে বহু কাগজপত্র জমে আছে। কোনটাই জরুরী নয়। পাউডার ভাইনে শুনেছি 008 ফিরে এসেছে। বার্লিনে বিশ্রাম করছে। খুব ভাল খবর, তাই না? বন্ড ভাবল বিল তাহলে শেষ পর্যন্ত কাজটা হাসিল করতে পেরেছে। খুব দুরূহ কাজে গিয়েছিল, ফিরেও এসেছে সেখান থেকে। বার্লিনে বিশ্রাম করার অর্থ তার অবস্থা বিশেষ ভাল নয়। এই বাড়িতে মাত্র একটা জায়গা থেকেই খবর চুঁইয়ে বেরোয়। সেটা হচ্ছে মেয়েদের গেস্টরুম। নিরাপত্তা বিভাগের কর্মচারিরা নিষ্ফল আক্রোশে সেই ঘরটার নাম দিয়েছে পাউডার ভাইন। সেখানকার খবরের জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হবে।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বন্ড তার ডেস্কের সামনে বসল। ট্রে-টা কাছে টানল। তার মধ্যে বাদামী রঙের নানা ফোল্ডার–ওপরে লাল তারা আঁকা–যার অর্থ ও অত্যন্ত গোপনীয়। কিন্তু 001-এর কি খবর? মাস দুয়েক আগে। সিঙ্গাপুরে সে উধাও হয়েছে। এর মধ্যে আর কোন খবর পাওয়া যায়নি। 00 বিভাগের তিনজনের মধ্যে বন্ডই সবচেয়ে
পুরোনো। তার নম্বর 007। সবচেয়ে ওপরকার ফোল্ডারটার মধ্যে ছিল দক্ষিণ পোল্যান্ড আর উত্তর-পূর্ব জার্মানির বিশদ। মানচিত্র। সেটার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটা আঁকাবাকা লাল লাইন যেটা ওয়ারশ থেকে পৌঁছেছে বার্লিন পর্যন্ত। ফোল্ডারটার মধ্যে আরও ছিল টাইপ করা লম্বা একটা স্মারকলিপি। শিরোনামায় লেখা মেনলাইন ও পূর্ব থেকে পশ্চিমে পালাবার সুপ্রতিষ্ঠিত পথ। বন্ড একটা সিগারেট ধরিয়ে, গদি মোড়া চেয়ারে আরাম করে বসে পড়তে শুরু করল।
দিনটা শুরু হল …একেবারে ছককাটা, একঘেয়ে একটা দিন। বছরের মধ্যে মাত্র দু-তিনবার এমন কাজের ভার বন্ড পায়, যাতে তার বিশেষ ধরনের শক্তি সামর্থ্যের দরকার পড়ে। বছরের বাকি সময় তার ডিউটি হচ্ছে যে কোন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারির মত।
কোন ছুটি সে নেয় না কিন্তু দায়িত্ব সম্পন্ন প্রত্যেকটি কাজ শেষ করার পর তাকে দেওয়া হয় পনের দিনের ছুটি। তাছাড়া প্রয়োজন মত ছুটি পায় অসুস্থতার জন্য। বছরে তার রোজগার ১৫০০ পাউন্ড। কিংস রোডের কাছে তার একটা ছোট ছিমছাম ফ্ল্যাট আছে। তার ফ্ল্যাটের তত্ত্বাবধান করে মে নামে বয়স্কা এক স্কটিশ ভদ্রমহিলা। এ ছাড়া তার। আছে ১৯৩০ সালের মডেলের সাড়ে চার লিটারের সুপারচার্জড় একটা বেন্টলি গাড়ি। এই সব জিনিসের ওপর বন্ড খরচ করে তার সব টাকা। তার একমাত্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা-নিজের ব্যাংক একাউন্টে যথাসম্ভব কম টাকা রেখে মরা। নিরুৎসাহ অবস্থায় তার মনে হয় পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের আগেই তার মৃত্যু হবে।
আট বছর পরে 00 বিভাগ থেকে সরিয়ে হেড কোয়ার্টার্সে তাকে অফিসের কাজ দেওয়া হবে। এই ক বছরের মধ্যে তার ওপর ভার পড়বে অন্তত আটটা খুব কঠিন কাজের। সংখ্যায় বেশি হওয়াও বিচিত্র নয়।
মেনলাইনের তথ্যগুলো বন্ডের মুখস্থ হবার পর দেখা গেল তার কাঁচের বড় এ্যাশ-ট্রে-তে পাঁচটা সিগারেটের টুকরো জমেছে। সব শেষে 00-র পাশে 7 লিখে সই করে ফাইলটা বন্ড ছুঁড়ে দিল OUT লেখা ট্রের-মধ্যে। তখন বারটা বাজে। গাদার মধ্যে পরের ফোল্ডারটা নিয়ে বন্ড খুলল। সেটা NATO-র রেডিও ইনটেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের। লেখা শুধুমাত্র তথ্যের জন্য। শিরোনামে রয়েছে, রেডিও সিগনেচার্স । ফাইলের স্তূপটা কাছে টেনে প্রত্যেকটার প্রথম। পাতায় বন্ড চোখ বুলিয়ে গেল। এই ফাইলগুলো জরুরী নয়। এগুলো নিয়ে তার কিংবা তার অন্য দুজন সহকর্মীর করার কিছু নেই। বন্ডের শুধু দরকার সেই সব ফাইলের নম্বর টুকে রাখা যেগুলো অন্য দুজনের পরের বার হেড। কোয়ার্টার্সের কাজ করতে এলে, পড়ে দেখা উচিত। 00 সেকশনের ফাইলগুলো পড়া হবার পর সেগুলো চলে যাবে। তাদের শেষ গন্তব্য স্থানে, তথ্যবিভাগে।
NATO-র কাগজপত্রগুলো আবার দেখতে শুরু করল বন্ড। সে পড়ে চলল, খুব ছোট ছোট আচরণের মধ্যেও মানুষের ব্যক্তিত্ব নির্ভুলভাবে ফুটে ওঠে। এটা হাতে কলমে দেখানো হয়েছে প্রত্যেক রেডিও অপারেটরের হাত -এর অনপনেয় বৈশিষ্ট্যের মধ্যে। এই হাত অর্থাৎ সংবাদ প্রেরণ করার ধরন প্রত্যেকের আলাদা আলাদা। সংবাদ গ্রহণ করতে যারা অভ্যস্ত তারা সেটা চিনতে পারে। খুব সূক্ষ্ম যন্ত্র। এই যন্ত্রটাকে অপারেটরদের কব্জিতে আটকে দেওয়া যায়। উদ্দেশ্য–হাতের পেশিগুলোকে যে সব স্নায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করছে সেগুলোকে খুব সূক্ষ্মভাবে বাধা দেওয়া।
হঠাৎ টেলিফোনের শব্দে ঘরের স্তব্ধতা ভেঙে গেল। টেলিফোন করছিল বড়কর্তা। তিনি বন্ডের সঙ্গে দেখা করতে চান। যাচ্ছি বলে বন্ড রিসিভারটা নামাল। বন্ড সেক্রেটারিকে বলল, M-এর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। তার জন্য সে যেন অপেক্ষা না করে। তারপর নিজের অফিস থেকে বেরিয়ে করিডোর দিয়ে চলল লিফট-এর দিকে।
.
কোলাস বাইটের রাজা
দশতলাটা সব সময়েই ভারি চুপচাপ। লিফ্ট থেকে বেরিয়ে নরম কার্পেট মোড়া করিডোরের বাঁ-দিক ধরে বন্ড চলল সবুজ পর্দা ঢাকা সেই দরজাটার দিকে। টোকা না দিয়ে সেই সবুজ পর্দা ঢাকা দরজা ঠেলে বন্ড ভেতরে গেল। M-এর প্রাইভেট সেক্রেটারি মিস্ মানিপেনি টাইপরাইটার থেকে মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল।
পাশের ঘরের খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল বড়কর্তা। লোকটা বন্ডের সমবয়সী। অতিরিক্ত পরিশ্রমে ক্লান্ত শুকনো মুখে তার সকৌতুক মৃদু হাসি। সে বলল, হাসি মস্করা রাখ। M অপেক্ষা করছেন। তারপর লাঞ্চে আসবে তো?
বন্ড বলল, নিশ্চয়ই। মিস মানিপেনির পাশের দরজা ঠেলে ভিতরে গিয়ে সেটা সে বন্ধ করে দিল। দরজার উপরে জ্বলে উঠল সবুজ একটা আলো। বড়কর্তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল মিস মানিপেনি। দরজা ঠেলে বন্ড যখন ভেতরে এল M তখন তার বিরাট ডেস্কের পেছনে পাইপ ধরাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি প্রশ্ন করলেন, ছুটিটা ভাল কেটেছে
হ্যাঁ, ধন্যবাদ স্যার, বলল বন্ড। বন্ড তাকাল M-এর সুপরিচিত পোড় খাওয়া মুখটার দিকে। সেই মানুষটার দিকে, যাকে সে আন্তরিক শ্রদ্ধা করে। তাঁর মনের ভাব বুঝতে চেষ্টা করল সে। কিন্তু নিষ্প্রভ। হঠাৎ M নিরুত্তাপ গলায় প্রশ্ন করলেন, জেমস্! তোমার হাতে কি বিশেষ কোন কাজ আছে?
বন্ড বলল, না, স্যার! শুধু ফাইলের কাজ আর যথারীতি প্র্যাকটিস্। আমাকে কোন কাজের জন্য দরকার?
সত্যি বলতে কি–তাই দরকার, কিন্তু আসলে গুপ্তচর দপ্তরের সঙ্গে সেটার কোন সম্পর্ক নেই। এটা একটা নেহাতই ব্যক্তিগত ব্যাপার। মনে হয়েছিল হয়ত তুমি সাহায্য করতে পারবে। কাজটায় তোমার খুব বেশি সময় লাগবে না। একটা মাত্র সন্ধ্যের কাজ। নিশ্চয়ই তুমি এই লোকটির নাম শুনেছ–স্যার হিউগো ড্রাক্স? বন্ড বলল, শুনেছি বই কি! সানডে এক্সপ্রেসে তার জীবনী ছাপা হচ্ছে। আশ্চর্য কাহিনী। M জানতে চাইলেন লোকটির সম্বন্ধে বন্ড আর কি কি জানে। বন্ড বলতে শুরু করল– লোকটি সম্বন্ধে প্রথম কথা তিনি আমাদের জাতীয় বীর হয়ে উঠেছেন। দেশের এখন সবাই তার ভক্ত। সবাই তাঁকে আন্তরিক শ্রদ্ধা করে। তাঁর সমস্ত মুখে যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন। মানুষটা সবজান্তা গোছের। মনে হয় মেয়েরা সে কারণে তাঁর কথা ভেবে রোমাঞ্চিত হয়। নিজের গাঁটের পয়সা জমিয়ে দেশের জন্য যা তিনি করেছেন, মনে হয় সেটা যে কোন সরকারের সাধ্যাতীত। তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব জনসাধারণের কাছ থেকে এখনো কেন যে আসেনি, সে কথা ভেবে অবাক হই।
বন্ড লক্ষ্য করল M-এর ঠাণ্ডা চোখ দুটো যেন আরও ঠাণ্ডা হয়ে উঠল। কিন্তু ড্রাক্স সব দিক দিয়েই জীবনে সফল হয়েছেন এবং তার এই সাফল্যকে বন্ডও মনে মনে শ্রদ্ধা করে।
M বলল, বাস্তবিকই তিনি অসাধারণ মানুষ। তবে মনে হয় না তার সম্বন্ধে বেশি কিছু জানি। যুদ্ধ দপ্তর ছাড়া আর কোথাও তাঁর সম্পর্কে কোন ফাইল নেই। M বন্ডকে বললেন, সানডে এক্সপ্রেসে যে কাহিনী ছাপা হয়েছে সংক্ষেপে সেটা বলতে।
বন্ড বলল, তার মধ্যেও বিশেষ কোন তথ্য নেই। ১৯৪৪-এর শীতকালে অর্ডেন আক্রমণ করার সময় জার্মানরা বহু গেরিলা আর অন্তর্ঘাতকের সাহায্য নেয়। এই সব লোকেদের জার্মানরা নাম দিয়েছিল পিশাচ । তারা প্রচুর ক্ষতি করে। ছদ্মবেশ ধরার ব্যাপারে তাদের জুড়ি ছিল না। অর্ডেন তারা দখল করতে পারেনি। আমরা রাইন পার হয়ে যাই কিন্তু সেই দলের কিছু লোক তখনো অর্ডেনে থেকে গিয়ে ধ্বংসমূলক কাজ করে যায়। কিন্তু অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে দেখে শেষটায় তারা চটপট সরে পড়ে।
আমেরিকান আর বৃটিশ সৈন্য বাহিনীর মধ্যে পেছন দিকে যে যোগাযোগ হেড কোয়ার্টার্স ছিল সেটাকে তারা উড়িয়ে দেয়। তাদের মধ্যে ছিল মিত্র শক্তির নানা বাহিনীর পাঁচমিশেলী লোক–যেমন আমেরিকান সিগন্যালার, বৃটিশ এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার ইত্যাদি। পিশাচ -রা মেস হলদে মাইন দিয়ে উড়িয়ে দেয়, সেই সঙ্গে উড়ে যায় যুদ্ধক্ষেত্রের হাসপাতালের বিরাট একটা অংশ। হতাহত হয়েছিল শ-খানেকের বেশি লোক। আহত ইংরেজদের মধ্যে একজন হলেন ড্রাক্স। তার মুখের আধখানা উড়ে গিয়েছিল। এক বছর ধরে তার একেবারেই কোন রকম স্মৃতিশক্তি ছিল না। এক বছর ধরে তাকে নানা হাসপাতালে ঘোরাবার পর যুদ্ধ দপ্তরের খাতায় নিরুদ্দেশ লোকের তালিকার মধ্যে ড্রাক্সের নাম লেখা হয়। অবশেষে কর্তৃপক্ষ হিউগো ড্রাক্স নামে একজনের নাম পায়। লোকটার তিনকূলে কেউ ছিল না। কাজ করত লিভারপুলের ডকে। এই লোকটার নাম শোনার পর আমাদের ড্রাক্সের মধ্যে খানিকটা কৌতূহল দেখা দেয়। সেই লোকটার ফটো আর শারীরিক বর্ণনার সঙ্গে আমাদের ড্রাক্সের খানিকটা মিল পাওয়া যায়। তারপর থেকে ধীরে ধীরে ড্রাক্সের স্মৃতিশক্তি ফিরে আসতে থাকে। তার মনে পড়তে থাকে খুব ছোটখাটো নানা ঘটনার কথা। ডাক্তারেরা এই সাফল্যে বেশ গর্ব অনুভব করেন। যে বাহিনীতে এই হিউগো ড্রাক্স নিযুক্ত ছিলেন সেখানকার এক কর্মচারিকে যুদ্ধদপ্তর খুঁজে বার করে। সেই লোক হাসপাতালে গিয়ে নিঃসন্দেহে সনাক্ত করে ইনিই সেই ড্রাক্স। কোন সন্দেহ থাকে না। ১৯৪৫ সালে হিউগো ড্রাক্স নামে হাসপাতাল থেকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে তাঁকে দেওয়া হয় বকেয়া বেতন আর অসমর্থ লোকেদের পুরো পেনশন।
বন্ড আরও বলল, যুদ্ধের পর তিন বছর নাকি তার কোন পাত্তা ছিল না। তারপর পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে তার খবর আণরা পেতে শুরু করি। ধাতুর ব্যবসায় প্রথম তার কথা শোনা যায়। কোলাবাইট নামে খুব দামী একটা ধাতুর ব্যবসা তিনি একচেটে করে ফেলেছেন। ঐ ধাতু প্রত্যেকেই এখন চায়। এর গলনাংক অসম্ভব বেশি। এই ধাতু ছাড়া জেট ইঞ্জিন তৈরি করা যায় না। পৃথিবীতে এই ধাতুর পরিমাণ খুবই অল্প। কোন উপায়ে তিনি দশ হাজার পাউন্ড জোগাড় করেন। কারণ সানডে এক্সপ্রেসে লিখেছে ১৯৪৫ সালে টন পিছু তিন হাজার পাউন্ড দিয়ে তিনি তিন টন কোলামবাইট কেনেন। এক আমেরিকান বিমান কারখানায় ঐ ধাতুর খুব জরুরি দরকার পড়ে। তাদের কাছে সেটা বেচে তিনি পাঁচ হাজার পাউন্ড লাভ করেন। তারপর সেই ধাতুর জন্য তিনি বায়না দিয়ে চলেন–ছ মাস, ন মাস, এক বছরের। তিন বছরের মধ্যে এই ধাতু তিনি পুরোপুরি হস্তগত করে ফেলেন। এখন কোলাবাইটের দরকার পড়লে লোককে ছুটতে হয় ড্রাক্সমেটালস্-এর কাছে। ইতিমধ্যে নানা জিনিস তিনি বায়না দিয়ে কিনতে থাকেন, যেগুলো বিক্রি করলে মোটা টাকা লাভ করা যায়। যে সব পণ্য দ্রব্যের দাম বাড়ার সম্ভাবনা সেগুলো আগে থেকে কিনে তিনি এক ধরনের জুয়া খেলতে শুরু করেন। লাভের টাকা তিনি খাটান অন্যান্য ব্যবসায়।
পাইপ টানতে টানতে শান্ত স্থির চোখে বন্ডের দিকে তাকিয়ে রইলেন M।
বন্ড বলে চলল, তার এইসব কাণ্ডকারখানা দেখে স্বভাবতই আমাদের দেশের লোকেরা দারুণ হকচকিয়ে যায়। পণ্যদ্রব্যের দালালরা ক্রমাগত শুনতে থাকে ড্রাক্স-এর নাম। ১৯৫৬ সালের মধ্যে তিনি কোটি টাকার মালিক হয়ে ওঠেন। তারপর ইংল্যান্ডে ফিরে সেই টাকা তিনি খরচ করতে শুরু করেন। ভাল বাড়ি, গাড়ি, মেয়েমানুষ কোনকিছুরই অভাব নেই তার। নানা অপেরায় তাঁর বক্স থাকে রিজার্ভ করা। দুটো প্রমোদতরী আছে তাঁর। ওয়াকার কাপ টিমকে তিনি মোটা টাকা চাঁদা দিয়েছেন। বন্যা পীড়িতদের জন্য দিয়েছেন লক্ষ পাউন্ড। অ্যালবার্ট হলে নার্সদের জন্য করোনেশন বল নাচের ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন। এক সপ্তাহ যায় না খবরের কাগজের হেডলাইনে তার নাম ছাপান হয় না। যত দিন যাচ্ছে ততই তিনি ধনী হয়ে উঠছেন। লোকেরা তাঁকে দারুণ ভক্তিশ্রদ্ধা করে। তাঁকে দেখে সাধারণ মানুষের মনে আশার আলো জ্বলে ওঠে।
রাণীর কাছে তাঁর সেই বিস্ময়কর চিঠি ও ইয়োর ম্যাজেস্টি, অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে আমি প্রস্তাব করতে পারি… সানডে এক্সপ্রেস খবরটা মোটা হরফে হেডলাইন দেয় : বিনীত ড্রাক্স।
তারপর ছাপে পুরো খবরটা–একটা বিরাট অ্যাটমিক রকেট বানাবার জন্য বৃটেনকে তিনি তার সমস্ত মজুত কোলাবাইট দান করেছেন। সেই রকেটের পাল্লার মধ্যে পড়বে য়ুরোপের প্রায় সব রাজধানী–যে কোন দেশ লন্ডনের ওপর এ্যাটম বোমা ফেলতে চাইলে তাদের কাছে এই রকেট হবে মুখের মত জবাব। সেটা বানাবার খরচের দরুন নিজের পকেট থেকে তিনি দেবেন এক কোটি পাউন্ড।
তারপর বেশ কয়েক মাস সব চুপচাপ। জনসাধারণ অধৈর্য হয়ে ওঠে। লোকসভায় প্রশ্ন ওঠে। বিপক্ষ দল বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থাসূচক প্রস্তাব তুলতে চায়। তারপর প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন রাষ্ট্রীয় সরবরাহ দপ্তরের বিশেষজ্ঞরা রকেটের ডিজাইন মনোনীত করেছেন। বৃটেনের জনগণের তরফ থেকে রাণী সানন্দে এই দান গ্রহণ করেন। এবং দাতাকে স্যার উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
বন্ড এই অসাধারণ মানুষটির কাহিনী বলতে বলতে প্রায় আত্মহারা হয়ে পড়েছিল। এবারে সে থামল।
M বললেন, হ্যাঁ। খবরের কাগজের হেডলাইনটা মনে পড়ছে? আমাদের জীবনে শান্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হল। এক বছর আগে ছাপা হয়েছিল, রকেট তৈরি প্রায় শেষ হতে চলেছে। নাম–মুনরেকার। যে সব খবর পেয়েছি তাতে মনে হয় যা দাবী করা হচ্ছে, রকেটটা তা পুরোপুরি পূরণ করতে পারবে। কিন্তু একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝতে উঠতে পারছি না।
M বন্ডকে বললেন, তুমি যা বললে মোটামুটি তাই। তোমার চেয়ে আমিও বেশি কিছু জানি না। আশ্চর্য কাহিনী। অসাধারণ মানুষ। চট করে কি যেন একটা ভেবে নিলেন, তারপর শান্ত চোখে বন্ডের দিকে তাকিয়ে M বললেন, শুধু একটা ব্যাপার… স্যার হিউগো ড্রাক্স তাস খেলার সময় জোচ্চুরি করেন।
.
তাসের রাজা
M নীরস গলায় মন্তব্য করলেন, একজন কোটিপতি তাস খেলার সময় ঠকান–ব্যাপারটা তোমার অদ্ভুত মনে হয় না?
বন্ড হেসে জবাব দিল, এমন অনেক বড়লোকদের কথা জানি পেশেন্স খেলার সময় যারা নিজেদের সঙ্গেই নিজেরা জোচ্চুরি করে থাকেন। কিন্তু ড্রাক্স সম্পর্কে আমার যেটা ধারণা তার সঙ্গে এটা ঠিক খাপ খাচ্ছে না। কেমন যেন বেমানান। M বললেন, জোছুরি ড্রাক্স এমনভাবে করেন যে, এ পর্যন্ত কেউ তাকে ধরতে পারেনি। সত্যি কথা বলতে কি ব্যাসিলডন ছাড়া মনে হয় না আর কেউ ব্যাপারটা সন্দেহ করেছে। তিনি ব্লেডস ক্লাবের চেয়ারম্যান। আমার কাছে তিনি এসেছিলেন। গুপ্তচর বিভাগের সঙ্গে আমি খানিকটা জড়িত বলে তার একটা ভাসাভাসা ধারণা আছে। অতীতে ছোটখাটো কয়েকটা ব্যাপারে তাকে আমি সাহায্য করেছিলাম। আমার পরামর্শ তিনি চেয়েছেন। বলেছেন, ব্যাপারটা নিয়ে ক্লাবের মধ্যে অবশ্যই তিনি কোনরকম হৈ-চৈ চান না। ড্রাক্সকে এই বোকামির হাত থেকে বাঁচানোই তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। আমাদের সবাইকার মত তিনিও ড্রাক্সকে শ্রদ্ধা করেন। তাই কোন একটা কেলেঙ্কারির আতঙ্কে তিনি রয়েছেন। এ ধরনের কেলেঙ্কারির কথা কিছুতেই ধামাচাপা দেওয়া যায় না। ফলে ব্লেডস থেকে ড্রাক্স-কে পদত্যাগ করতে হবে। তারপর তাঁর পক্ষ নিয়ে তাঁর কোন বন্ধু রুজু করে দেবেন মানহানির মামলা। এ ধরনের সব চিন্তাই ব্যাসিলডনের মাথায় ঘুরছে। এ রকম একটা কাণ্ড ঘটতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। যাইহোক আমি বলেছি তাকে সাহায্য করব। বন্ডের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন তাই তোমার সাহায্যের দরকার। গুপ্তচর বাহিনীতে তুমিই সবচেয়ে ভাল তাস খেলোয়াড়–অন্তত তোমার তাই হওয়ার কথা। তুমি জান কি করে টেক্কার পিঠে মোম লাগাতে হয়, যাতে প্যাকেট ভাঙলেই টেক্কার জায়গা খুলে যায়; বড় বড় তাসের পিঠে কি করে ক্ষুর দিয়ে চিহ্ন দিতে হয়। আরও অনেক কায়দা–আস্তিনের ভেতর থেকে যন্ত্রের সাহায্যে হাতের মধ্যে দরকার মত তাস নিয়ে আসা। M বললেন, মনে হয় না ড্রাক্স অতটা পেশাদার ধরনের জোচ্চর। ও সব জোদুরি শেখবার জন্য দিনে অনেক ঘণ্টা ধরে প্র্যাকটিস করা দরকার। এমনও হতে পারে তার তাসের ভাগ্যটা অবিশ্বাস্য রকমের ভাল, কিন্তু সমস্তটাই কেমন যেন খাপছাড়া গোছের তিনি শুধু ব্রিজ খেলেন এবং সব সময় তিনি জেতেন মোটা টাকা। ড্রাক্স কি পদ্ধতি অনুসরণ করেন বলে তোমার ধারণা?
বন্ডের মন তখন লাঞ্চ খেতে যাবার জন্য ছটফট করছিল। আর M এমন ধরনের মানুষ যার ক্ষুধা তৃষ্ণা ঘুম বলে কোন কিছুরই বালাই নেই। তবু ধৈর্য ধরে সে বলে চলল, ধরা যাক ড্রাক্স পেশাদার জোচ্চোর নন। ধরা যাক তাস নিয়ে কোন রকম কারসাজি তার পক্ষে করা অসম্ভব। তা হলে ব্যাপারটার দুটো মাত্র উত্তর আছে। হয় কোন রকমে বিপক্ষের হাত তিনি দেখেন, নয়ত তার সঙ্গীর সঙ্গে একটা গোপন ইশারা-টিশারা করেন।
M বললেন, বন্ড আজ রাতে তুমি আসতে পারবে? অন্য কিছু না, ডিনারটা খুব ভাল পাবে। ডিনারের পর ড্রাক্স আর তার বন্ধুর সঙ্গে আমরা কয়েক বাজি রাবার খেলব। তারা প্রতি সোমবারেই আসেন।
বন্ড মৃদু হেসে বলল, ড্রাক্স যদি তাসে জোচ্চুরি করেন, আমি বুঝিয়ে দেব ধরতে পেরেছি। তাতেই তিনি ভবিষ্যতে সাবধান হয়ে যাবেন। আমি চাই না তিনি কোন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন। আর কোন কাজ আছে স্যার? ।
M বললেন, না জেমস্ আর কোন কাজ নেই। তোমার সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ। সন্ধ্যে ছ-টা নাগাদ তোমার সঙ্গে আবার তাহলে দেখা হচ্ছে। ডিনারের পোশাক পরার তোমার দরকার নেই। যাও এখন গিয়ে তৈরি হও।
বন্ড চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। মনে হল সন্ধ্যেটা ভালই কাটবে। দরজা দিয়ে বেরিয়ে তার মনে হল–এমন একটা কাজের ভার পেয়েছে যার মধ্যে বিপদের কোন রকম ঝুঁকি নেই। সে করিডোর পেরিয়ে লিফট-এর কাছে এল। অফিসারদের ক্যানটিনে তখন বিশেষ লোকজন ছিল না। বন্ড সেখানে একলা বসে কিছু ভাজা মাংস, অনেকটা পাঁচ মিশেলী স্যালাড, কিছুটা চীজ খেল, আর তার সঙ্গে আধবোতল সাদা বোর্দো মদ। দু-পেয়ালা কফি শেষ করে বিকেলে তিনটেয় ফিরল নিজের অফিস ঘরে। তার মনের আধখানা জুড়ে তখন M-এর সমস্যার কথা। NATO ফাইলের বাকি অংশটা পড়ে তার সেক্রেটারির কাছে সে বিদায় নিল। যাবার আগে তাকে জানাল সে সন্ধ্যেয় কোথায় থাকবে।
নিজের গাড়িটাকে বার করে বন্ড বাড়ি ফিরে এল। নিজের শোবার ঘরে ঢুকল। জামা কাপড় খুলে গুছিয়ে রাখল তারপর বাথরুমে ঢুকে গোসল সেরে নিল। আয়নার নিজের মুখটা দেখল, তার শীর্ণ ক্ষুধিত মুখটা শত্রুর সঙ্গে পাল্লা দেবার জন্য যেন কঠিন হয়ে উঠেছে। দশ মিনিট পরে বন্ড নিজের টেবিলে গিয়ে বসল। পরনে তার পুরু সিল্কের সাদা শার্ট, সার্জের গাঢ় নীল রঙের ট্রাউজার। পায়ে গাঢ় নীল রঙের মোজা আর ঝকঝকে পালিশ করা কালো মোক্যাসিন। জুতা। সামনে খোলা স্কার্নের তাসে ঠকানোর আশ্চর্য গাইড বইটা। পদ্ধতি নামে পরিচ্ছেদটার উপর চটপট সে চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর প্র্যাকটিস করে চলল সেইসব বিচিত্র পদ্ধতিগুলো। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় টেবিলের তাসগুলো ছুঁড়ে ফেলে বই বন্ধ করল সে। শোবার ঘরে গিয়ে কালো চওড়া কেসে সিগারেট ভরে সেটা হিপ পকেটে গুজলো বন্ড। তারপর গলায় সিল্কের কালো টাই বেঁধে কোট পরে দেখে নিল তার নোটকেসের মধ্যে চেক-বইটা ঠিক আছে। কিনা। মুহূর্তের জন্য বেছে নিল সিল্কের সাদা দুটো রুমাল। তারপর সেগুলো খুলে কুঁকড়ে নিয়ে কোটরে দু-পাশের। পকেটে ভরলো। সন্ধ্যে তখন ঘনিয়ে এসেছে। তার মনে পড়ল প্রাইভেট তাস খেলার ক্লাব হিসেবে ব্লেস্ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। ১৭৮৮ সালে ঐতিহাসিক গিবনের এক চিঠিতে প্রথম ব্লেড-এর উল্লেখ দেখা যায়। তিনি লেখেন এই ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ল্যাম্প নামে এক জার্মান। প্রতিষ্ঠিত হবার শুরু থেকেই ব্রেড় -এর খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ক্লাবের সমৃদ্ধি দিনকে দিন বাড়তে থাকে। বর্তমানে দ্র জুয়ার ক্লাব হিসেবে ব্লেড পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। লন্ডনে এটাই বর্তমানে সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ক্লাব। এখানকার মেম্বার হবার জন্য দুটি গুণ অবশ্যই থাকতে হবে।
প্রথমতঃ ভদ্রলোকের মত ব্যবহার করতে হবে। দ্বিতীয়তঃ দেখাতে হবে হাতে নগদ এক লক্ষ পাউন্ড আছে। এই ক্লাবের মধ্যে প্রত্যেক মেম্বারকে বছরে পাঁচশ পাউন্ড হয় হারতে হবে নয় জিততে হবে। নইলে বছরে দিতে হবে আড়াইশ পাউন্ড ফাইন। এই ক্লাবের খাদ্য ও পানীয় লন্ডনের মধ্যে সবচেয়ে সেরা। তার জন্য কোন বিল পেশ করা হয় না।
যে কোন ক্লাবের সার্থকতা বা বিফলতা নির্ভর করে সেখানকার চাকর-বাকরের ওপর। এই ক্লাবের পেছন দিকে মেম্বারদের জন্য বারটা বেডরুম আছে। ওয়েট্রেসদের কাউকে সেরকম ঘরে কোন মেম্বার যদি রাতে নিয়ে যায়–তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। মেম্বারদের সেটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। ব্লে -এর প্রবেশ মূল্য একশ, এবং বাৎসরিক চাদা পঞ্চাশ পাউন্ড। তার পরিবর্তে মেম্বাররা সেখানে পায়ে ভিক্টোরিয়ান যুগের সব রকম বিলাস ব্যবস্থা আর সেই সঙ্গে দারুণ সুখ সুবিধের মধ্যে বছরে বিশ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত জেতবার বা হারবার সুযোগ।
এই সব কথা ভেবে বন্ডের মনে হল সন্ধ্যেটা তার ভালই কাটবে। জীবনে মাত্র কয়েকবার ব্লেড়স-এ সে খেলেছে। এই ব্রিজ খেলা ছাড়াও রয়েছে হিউগো ড্রাক্সের ব্যাপারটা। তাতে হয়তো সন্ধ্যের নাটকটা আরও জমবে।
কিংস্ রোড দিয়ে স্নোন স্কোয়ারে পৌঁছবার সময় সাবধানে ট্রাফিকের উপর নজর রাখতে রাখতে ভাবছিল সে আসন্ন সন্ধ্যের কথা। তখন ছ-টা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। আকাশটা ঝড়-বিদ্যুৎ-বজে থমথমে। হঠাৎ চারদিক
অন্ধকার হয়ে এল। তার সামনে চক ছাড়িয়ে আকাশে জ্বলজ্বল করে বিজলি-বাতির একটা বিজ্ঞাপন জ্বলতে নিভতে। শুরু করল। মিলিয়ে আসা আলোর তরঙ্গ নিয়ন বাতিটাকে সচল করে তুলেছে। এই আলো রাত ভোর সক্রিয় থাকবে।
বড় হরফের রক্তবর্ণ অক্ষরগুলো পড়ে চমকে উঠল বন্ড। পথের এক পাশে গাড়িটা থামিয়ে নামল। তারপর রাস্তা পেরিয়ে অন্যপাশে এসে ভাল করে পড়বার চেষ্টা করল আকাশে বিজলি আলোয় লেখা বিজ্ঞাপনের কথাগুলো।
এটা SHELL কোম্পানির বিজ্ঞাপন। আপন মনে হাসতে হাসতে বন্ড গাড়িতে উঠল।
সন্ধ্যের আকাশে বড় বড় রক্তাক্ষরে সেই বাড়িটায় খানিকটা ঢাকা পড়া বিজ্ঞাপনের অক্ষরগুলো দেখে সে চমকে উঠেছিল। বন্ড যে অংশটুকু পড়েছিল সেটা বিজ্ঞাপনের কোন কথাই নয়। সেটার মানে সম্পূর্ণ আলাদা।
বন্ড বার বার যে কথাগুলো জ্বলতে নিভতে দেখেছিল, তা হল এই : HELL IS HERE …HELL IS HERE …HELL IS HERE (এটাই নরক, এটাই নরক, এটাই নরক! )
.
আয়নাবাজ
ক্লক -এর সামনে গাড়ি থামিয়ে পার্ক স্ট্রিটের কোণ ধরে বন্ড এগিয়ে চলল।
গোধূলিতে ব্লেড ক্লাবের সামনেটা খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। আশপাশের বাড়িগুলো থেকে সেটা কয়েক গজ ভেতর দিয়ে। দোতলার তিনটে জানালার পর্দা সরাবার সময় মুহূর্তের জন্য দেখা গেল ইউনিফর্ম পরা এক চাকরকে। সেই বিখ্যাত জুয়ার ঘরে তিনটে বিরাট ঝাড়বাতির একটা জুলছিল। সেটার আলোয় ঘর ঝলমল করছে। স্যইং দরজা ঠেলে বন্ড গেল পোর্টারের পুরনো ধাঁচের ঘরের কাছে। পোর্টারের নাম ব্রেভেট। লোকটি ব্লেডস্ ক্লাবের কাউন্সিলার। গুড ইভিনিং, ব্রেভেট, অ্যাডমিরাল এসেছেন?
ব্ৰেভেট বন্ডকে চিনত। মাঝে মাঝে অতিথি হিসেবে সে এসে থাকে। বলল, গুড ইভিনিং স্যার। তাসের ঘরে অ্যাডমিরাল আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। ইউনিফর্ম পরা ছোকরা চাকর সিঁড়ির ওপরকার একটা লম্বা দরজা বন্ডের জন্য খুলে ধরল। বন্ড দেখল M এক কোণে একলা বসে পেশেন্স খেলছেন। বন্ডকে আসতে দেখে M বললেন, আরে, এই যে। তাসের টেবিলের সামনেকার একটা চেয়ার দেখিয়ে তিনি তাকে বসতে ইঙ্গিত করলেন। চেয়ারে বসে M এর খেলা দেখতে দেখতে দারুণ হাসি পেল বন্ডের। M-কে এখানে লোকে জানে অ্যাডমিরাল স্যার M, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কি যেন একটা। সেন্ট জেমস্ স্ট্রিটের যে-কোন ক্লাবের যে-কোন মেম্বারের মত দেখতে M-কে। আজ সন্ধ্যেতেই তাঁর হাতে রক্তের তাজা ছোপ পড়বে, কিংবা কোন চুরির তদন্তের ব্যাপারে সফল হবেন, কিংবা জানতে পারবেন কোন ন্যক্কারজনক ব্ল্যাকমেল কেসের বীভৎসতার কথা।
আর তাকে দেখেই বা সাধারণ দর্শকের কি মনে হবে যার নাম কম্যান্ডার জেমস বন্ড, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সঙ্গে যে জড়িত। বন্ড জানত তার চেহারার মধ্যে এমন একটা বিদেশী ছাপ আছে যাতে তাকে ইংরেজ বলে মনে হয় না। সে জানত তার পক্ষে গা ঢাকা দেওয়া কঠিন। বিশেষ করে ইংল্যান্ডে। গুপ্তচর দপ্তরের এলাকার বাইরে তার কাজ। আজ অবশ্য তার ছদ্মবেশের দরকার নেই।
M একজন ওয়েটারকে ডেকে বলল, ট্যানার, পিকের-এর তাস নিয়ে এস।
অল্পক্ষণের মধ্যেই ওয়েটার পাতলা দু-প্যাকেট তাস নিয়ে এল। M হইস্কির অর্ডার দিলেন। আধ ঘণ্টা ধরে তারা খেলে চলল। খেলা শেষ হতে বন্ড গুণে গুণে তিনটে এক পাউন্ডের নোট M কে দিল। ওরা উঠে পড়ল। ব্রিজের টেবিলে গিয়ে ওরা দেখল ড্রাক্স খেলছেন ব্যাসিলডনের টেবিলে। দশ মিনিট আগে এসেছেন। ঘরের অন্যপাশে ভিড় জমতে শুরু করেছে। গোটা ছয় টেবিলে চলছে ব্রিজ খেলা। M-এর পিছন পিছন আসতে আসতে বন্ড ঘরের নানা দৃশ্য উপভোগ করতে লাগল। দীর্ঘ ঘর পেরিয়ে অন্যদের কাছে আসার সময় সেখানকার গন্ধে ও বর্ণে দ্রুততর হয়ে উঠল তার নাড়ির স্পন্দন, নাসারন্ধ্র হয়ে উঠল সামান্য স্ফুরিত।
বন্ডের দিকে পিছন করে যে খেলোয়াড় বসেছিল, দরাজ গলায় সে চেঁচিয়ে উঠল, ডল-ড্যাম্ ইউ। বন্ড লক্ষ্য করল লোকটার চুল ঘন লালচে। তারপর বাঁ দিকে ফিরে দেখল লর্ড ব্যাসিলডনের একাগ্র মুখের একটা পাশ। ব্লেড়স -এর চেয়ারম্যান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিলেন নিজের হাতের তাসগুলো। তিনি বললেন, মাই ডিয়ার ড্রাক্স, আমার হাতটা এমন নিখুঁত যে, রি-ডাবল দিতে বাধ্য হচ্ছি। তারপর পার্টনারের দিকে তাকিয়ে বললেন, টমি, যদি হারি তাহলে হারের টাকা আমি দেব। তার পার্টনার বলল, দূর! মেয়ার ড্রাক্সকে বরঞ্চ তুমি বাঁচাবার চেষ্টা কর।
ড্রাক্স-এর কাঁধের ওপর দিয়ে বন্ড তাকাল। ড্রাক্সের হাতে ছিল ইশকাবন আর হরতনের টেক্কা। চটপট সেই দুটো টেক্কার পিঠ নিয়ে ড্রাক্স আবার হরতন খেললেন। ব্যাসিলডন পিঠটা নিলেন হরতনের সাহেব দিয়ে। ড্রাক্সের বিরুদ্ধে তিতি তাস চালালেন কিন্তু মেয়ার বিবি দিয়ে পিঠটা নিল। চেঁচিয়ে উঠলেন ব্যাসিলডন। হাতের সব তাসগুলো টেবিলে বিছিয়ে কাঁচুমাচু মুখে পার্টনারের দিকে তাকালেন। ড্রাক্স হেসে উঠলেন। তিনি ব্যাসিলডনকে বললেন, এতে লাইনের ওপরে দাঁড়াচ্ছে চার শ পয়েন্ট। তোমার ডিল। তাস বেঁটে তিনি ব্যাসিলডনের দিকে এগিয়ে দিলেন। খেলা চলতে থাকল। বন্ড একটা সিগারেট ধরিয়ে ড্রাক্সের মাথার পেছন দিকটা চিন্তিতভাবে লক্ষ্য করতে লাগল।
M এর স্বরে বন্ডের চিন্তাসূত্র ছিন্ন হল। বেসিল, আমার বন্ধু কম্যান্ডার বন্ডকে মনে পড়ে? ভাবলাম একে এনে আজ সন্ধ্যেয় খানিক ব্রিজ খেলা যাক।
বন্ডের দিকে তাকিয়ে ব্যাসিলডন হাসলেন। বললেন, শুভসন্ধ্যা। তারপর টেবিলের বাঁ দিক থেকে ডান দিকে হাত ঘোরালেন, মেয়ার, ডেঞ্জারফিল্ড, ড্রাক্স। তারা তিনজনে মুহূর্তের জন্য মুখ তুললেন, টেবিলের সবাইকার উদ্দেশ্যে নড় করে বন্ড জানাল অভিবাদন। তোমরা সবাই অ্যাডমিরালকে চেন, তাস বিলি করতে করতে ব্যাসিলডন যোগ করে দিলেন।
চেয়ারে খানিক ঘুরে বসে হৈ হৈ করে উঠলেন ড্রাক্স, আরে, খোদ অ্যাডমিরাল! তারপর পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন বন্ডের দিকে। বন্ডের চোখে পড়ল তার লালচে গোঁফ আর নিরুত্তাপ গোছের চোখ দুটো। টেবিলের দিকে ফিরে নিজের তাসগুলো কুড়িয়ে নিলেন ড্রাক্স। অধিকাংশ খেলোয়াড় যেমন আলাদা আলাদা রঙের তাসগুলো সাজিয়ে নেয়, ড্রাক্স সেভাবে সাজালেন না। শুধু লাল আর কালো তাসগুলো আলাদা করলেন। কিন্তু সেগুলো এলোমেলো হয়ে রইল। ফলে তার হাতটা আন্দাজ করা পাশের লোকের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
বন্ড জানে যারা খুব সাবধানী তাস খেলোয়াড়, তারা এইভাবেই তাস সাজায়।
ফায়ারপ্লেসের কাছে গিয়ে দাঁড়াল বন্ড। যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে মেয়ার-এর হাতটা সে দেখতে পাচ্ছিল। ডানদিকে এক পা সরে সে দেখতে পেল ব্যাসিলডনের হাতটা। স্যার হিউগো ড্রাক্সকে সে দেখতে পাচ্ছিল সোজাসুজি। সে ড্রাক্সকে লক্ষ্য করে চলল। ড্রাক্স কুলকুল করে ঘামছেন। তাঁর কোটের পকেটে এক বাক্স কর্ক-টিপড় ভার্জিনিয়া সিগারেট ছিল। সেটা থেকে বার করে ক্রমাগত তিনি সিগারেট টানছিলেন। তাঁর হাত দুটো বলিষ্ঠ আর দক্ষ। বুড়ো আঙুল দুটো বলিষ্ঠ কিন্তু কদাকার। ড্রাক্সের পোশাক-আশাক খুঁটিয়ে দেখল বন্ড, সেগুলো দামী আর সুরুচির পরিচায়ক।
ড্রাক্স আর ব্যাসিলডনের মাঝখানে বসে পাইপ টানছিলেন M। হঠাৎ তার দিকে ফিরে ড্রাক্স বললেন, অনেকক্ষণ ধরে এই রাবার-এর খেলা চলছে। এতক্ষণ তোমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে বলে দুঃখিত। ডিনারের পর একটা চ্যালেঞ্জ গেম খেলতে রাজি। একদিকে ম্যাক্স আর আমি, অন্য দিকে তুমি আর কম্যান্ডার। দৃঢ় প্রত্যয় ভরা বন্ডের জ্বলজ্বলে চোখ দুটো টেবিলের ওপাশ থেকে M লক্ষ করলেন। একমুখ হেসে বন্ড বলল, নিশ্চয়, এ তো খুব ভাল প্রস্তাব।
প্রথমে M তারপর বন্ডের দিকে তাকিয়ে ড্রাক্স বললেন, রাত নটা নাগাদ তাহলে? নিজের তাসগুলো তুলতে তুলতে বললেন, মনে হচ্ছে ক্যাসিনোর টাকাতেই আমার খেলা চলবে।
চুপচাপ সিঁড়ি দিয়ে নেমে তারা সেক্রেটারির অফিসে পৌঁছল। ঘরটা অন্ধকার ছিল। স্যুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে M গিয়ে বসলেন সেক্রেটারির ডেস্কের সামনেকার স্যুইভেল চেয়ারে। শূন্য ফায়ারপ্লেসের কাছে গিয়ে বন্ড একটা সিগারেট ধরাল। M বন্ডের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন কোন হদিশ পেলে? বন্ড বলল, হ্যাঁ, সত্যিই উনি জোচ্চুরি করেন। শুধু নিজের তাস যখন বিলি করেন তখন। তাঁর সামনেকার সিগারেটের রূপার বাক্স আর লাইটারটা তো আপনি দেখেছেন। সেটা থেকে কখনও তিনি সিগারেট নেন না। সেটার ওপর আঙুলের ছাপ ফেলতে চান না। সেটার কাছ থেকে কখনও তিনি হাত সরান না। চারজনের তাস তিনি নিজের খুব কাছে বিলি করেন। প্রত্যেকটা তাসেরই ছায়া পড়ে কেসটার ওপর। উনি ছায়ার খুব ভাল ব্যবসাদার। আপনাকে আয়নাবাজের কথা বলেছিলাম, বোধহয় মনে আছে। এটাও এক ধরনের আয়নাবাজি পদ্ধতির জোচ্চুরি। অন্য সমস্ত দানে তিনি সাধারণ খেলেন কিন্তু প্রত্যেক চতুর্থ দানে সব তাসগুলো জানা খুব সুবিধের। তিনি যে সব সময় জেতেন তাতে অবাক হবার কিছু নেই। আমার মনে হয় তার কটাক্ষ দৃষ্টি খুব ভাল।
দরজা খুলে ব্যাসিলডন ঘরে এলেন। দরজাটা বন্ধ করে তিনি প্রায় ফেটে পড়লেন।
ড্রাক্সের ঐ হতচ্ছাড়া মুখ-বন্ধ-করা ডাকের কথা বলছি। ডাক দেবার সুযোগ পেলে টনি আর আমি চারটে হার্টের খেলা করতে পারতাম। থ্রি নো ট্রাম্পস ডাকার বুকের পাটা কি করে ওর হল কল্পনা করতে পারছি না। কমিটিকে ব্যাপারটা আমাকে জানাতেই হবে। ১৯১৪–১৮ সালের যুদ্ধের পর থেকে আমাদের ক্লাবে কোন জোচ্চুরির কেস হয়নি। ঘরের মধ্যে তিনি পায়চারি করতে লাগলেন। তারপর ড্রাক্স মানুষটার গুরুত্বের কথা মনে পড়তে ব্লেড ক্লাবের কথা তিনি তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন। বলতে শুরু করলেন, লোকে বলছে রকেটটা তৈরি করতে বেশি দেরি নেই। কিছুটা চিত্তবিনোদনের জন্য সপ্তাহে দু একবার ড্রাক্স এখানে আসে। লোকটা জনসাধারণের কাছে হিরো! সাংঘাতিক ব্যাপার। নিজের দায়িত্বের কথা স্মরণ করে ব্যাসিলডনের বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল। তিনি বললেন, এই ক্লাবে হাজার হাজার পাউন্ড লোকটা জিতেছে, অন্যরা হেরেছে হাজার হাজার পাউন্ড। অবশ্য আমার হারে কিছু যায় আসে না। কিন্তু ডেঞ্জার ফিল্ডের কপালটা খুব খারাপ যাচ্ছে। কথাটা কমিটিকে জানান ছাড়া আর তো কোন উপায় দেখছি না। কমিটিতে দশ জন আছে। ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যেতে বাধ্য। তারপর কেলেংকারির কথাটা ভাব। লোকে বলে ড্রাক্স ছাড়া মুনরেকার হতে পারে না। কাগজে লিখছে দেশের সমস্ত ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে রকেটটার ওপর। এটা দারুণ সিরিয়াস ব্যাপার, আশাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন M এবং তারপর বন্ডের দিকে। অন্য কোন উপায় আছে?
বন্ড শান্ত গলায় বলল, তার জোচ্চুরি বন্ধ করা যেতে পারে। তার প্যাঁচেই তাকে কাবু করতে হবে। ব্যাসিলডন খুব জোর দিয়েই বললেন, যা খুশি করতে পার। কি করবে ভাবছ? বন্ডের প্রতিশ্রুতি শুনে তার চোখে আশার আলো জ্বলে উঠল।
বন্ড বলল, আমি তাঁকে বুঝিয়ে দিতে পারি তার জোচ্চুরিটা ধরে ফেলেছি সেই সঙ্গে তাঁর কায়দাতেই পারি তাঁর পিঠের চামড়া ছাড়িয়ে নিতে। অবশ্য তাতে মেয়ারের খুবই লোকসান হবে।
ব্যাসিলডনের বুক থেকে যেন একটা ভারি বোঝা নেমে গেল। M-এর দিকে তাকিয়ে বন্ড প্রশ্ন করল, এতে আপনার আপত্তি নেই তো?
M কিছুক্ষণ ভেবে তাকালেন ব্যাসিলডনের দিকে। তাঁর মনের কথা স্পষ্ট হয়ে উঠল।
বন্ড কোটের দু পকেটে হাত চালিয়ে সিল্কের সেই দুটো রুমাল ছুঁয়ে নিল। বন্ড এখন চায় এই ঘরে দশ মিনিট একটু একলা থাকতে, আর চায় দু রঙের দু-প্যাকেট তাস। নিশ্চয়ই সফল হবে।
.
ব্লেডস্–এ ডিনার
তখন সন্ধ্যে আটটা। তাস খেলার ঘর থেকে বেরিয়ে বড় বড় দরজার ভিতর দিয়ে M-এর পিছনে পিছনে বন্ড পৌঁছাল ব্লেড -এর সুন্দর সাদা ও সোনালি রঙের রাজকীয় ডাইনিং রুমে।
ব্যাসিলডন বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে বসেছিলেন। তিনি তাদের আমন্ত্রণ জানালেন। M ইঙ্গিতে বন্ডকে বসতে বললেন গদিমোড়া একটা চেয়ারে। নিজে বসলেন বন্ডের বাঁ পাশের একটা চেয়ারে, ঘরের আর সবাইকার দিকে পিঠ ফিরিয়ে।
একজন ওয়েস্ট্রেস এসে টেবিলের ওপর রাখল র্যাকভর্তি তাজা টোস্ট আর রূপার ডিশ-এ জার্সি মাখন। টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ার সময় তার কালো স্কার্ট বন্ডের হাত ছুঁয়ে গেল। বন্ড তাকিয়ে দেখল রেশমের মত নরম চুলের তলায় কৌতুক ভরা জুলজুলে দুটি চোখ। সেই চোখ দুটি মুহূর্তের জন্য বন্ডের চোখের দিকে স্থির হয়ে রইল।
M প্রশ্ন করল, শ্যামপেনের ওপর তোমার অত ঝোঁক কেন?
বন্ড বলল, কিছু মনে করবেন না স্যার–আজ রাতে আমাকে মাতাল হতে হবে। কিছুটা নেশা না হলে এ রকম অভিনয় করা খুব কঠিন। রাতে আমি বেহেড মাতাল হয়ে পড়েছি বলে মনে হল আশা করি আপনি ঘাবড়ে যাবেন না।
M বললেন, কাজের সুবিধার জন্য যত খুশি ড্রিংক কর, আমার আপত্তি নেই।
মাখন মাখানো টোস্ট চিবুতে চিবুতে তিনি বললেন, ড্রাক্স মানুষটা সম্বন্ধে তোমার কি ধারণা?
বন্ড এক টুকরো স্কোল্ড ম্যামন মুখে দিয়ে বলল, তার হাবভাব মোটেই ভাল নয়। এখানে তাকে আপনারা বরদাস্ত করেন দেখে প্রথমটায় আমি বেশ অবাকই হয়েছিলাম। হাজার হলেও তিনি আমাদের জাতীয় হিরো, কোটিপতি আর স্পষ্টতই একজন ভাল তাস খেলোয়াড়। আমি শুধু বুঝতে পারছি না তাসের এই জোচ্চুরি করে সবকিছু খোয়াবার ঝুঁকি তিনি কেন নিচ্ছেন এটা বাস্তবিকই কল্পনার বাইরে। তিনি তাস নিয়ে এমন উত্তেজিত হয়ে ওঠেন যে, মনে হয় এটা মোটেই শুধুমাত্র খেলা নয়–এটা যেন অপরের সঙ্গে নিজের শক্তি পরীক্ষার ব্যাপার। তাঁর মধ্যে কোথায় যেন সব সময়েই উত্তেজনার একটা টান টান ভাব রয়েছে। সেটা বোঝা যায় তাঁর বীভৎস ধরনের ঠাট্টা ইয়ার্কির মধ্যে। লোকটাকে একেবারেই আমি বরদাস্ত করতে পারছি না। আজ রাতে তাকে খুব জ্বলুনি ধরা হুল ফোঁটাবার আমার ইচ্ছা।
M বললেন, তোমার কথাগুলো বুঝলাম, কিন্তু মনে হয় লোকটার প্রতি হয়ত সুবিচার করছ না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস জীবনে উন্নতি করার জন্য তাকে অনেক শর্ট-কাট পথ বেছে নিতে হয়েছে। কে যেন বলেছিল খুব ধনী হবার জন্য দরকার অবিশ্বাস্য অনুকূল পরিবেশ আর অফুরন্ত সৌভাগ্য। শুরুতে দশ হাজার পাউন্ড বা এক লাখ পাউন্ড জোগাড় করতে হলে একটা অসাধারণ অনুকূল পরিবেশের একান্ত দরকার। যুদ্ধের পর পণ্যদ্রব্যের ব্যবসায়ে ছিল নানা কড়া আইনকানুন। তাতে মোটা লাভ যারা করেছে, আমার মনে হয় নানা অফিসারকে মোটা ঘুষ তাদের দিতে হয়েছে। হঠাৎ একজন ছোকরা চাকর তাদের টেবিলের কাছে এসে প্রশ্ন করল, কম্যান্ডার বন্ড বন্ডকে সে একটা খাম দিল। খামটা ছিঁড়ে পাতলা কাগজের একটা প্যাকেট বার করে টেবিলের নিচে সাবধানে বন্ড খুলল। তার মধ্যে ছিল সাদা পাউডার। কিছুটা পাউডার তুলে বন্ড শ্যাম্পেনের গ্লাসে মিশিয়ে নিল। M জানতে চাইল এটা কি ব্যাপার।
বন্ড বলল, এটা বেনজিড্রিন। আজ রাতে মাথা পরিষ্কার করে রাখতে গেলে এটা আমার দরকার। এটা খেলে নিজের ওপর একটু বেশি রকমের বিশ্বাস জন্মাতে পারে। কিন্তু, তাতে আমার কাজের সুবিধাই হবে।
বন্ড বলল, ভাল কথা, আজ রাতে কি রকম বাজি ধরে খেলা হবে। আমাদেরই জেতার কথা। কিন্তু জানতে চাই। ড্রাক্স কতটা হারতে পারেন।
M বললেন, সে One and One বাজি ধরে খেলা পছন্দ করে। কথাগুলোর মানে না জানলে মনে হবে বাজিটা সামান্য। একশ তে দশ আর প্রতি রাবার এ একশ পাউন্ড।
সসম্ভমে বন্ড বলল, বুঝলাম । বরফের মত ঠাণ্ডা বাদবাকি শ্যামপেন বন্ড তার গ্লাসে ঢালল। তার মন তখন ভারি প্রফুল্ল হয়ে উঠেছে। সে ঘরের চারদিকে তাকাতে লাগল। সেখানে গোটা পঞ্চাশেক লোক। অধিকাংশ লোকের পরনে ডিনার জ্যাকেট। চড়া বাজির জুয়া খেলার সম্ভাবনায় প্রত্যেকেই বেশ কিছুটা উত্তেজিত। ঘরের মাঝখান থেকে ঝুলছে বিরাট এক ঝাড়বাতি। প্রত্যেক টেবিলের মাঝখানে লাল সিল্কের শেড় দিয়ে ঢাকা মোমবাতি দান।
এই সুন্দর, পরিচ্ছন্ন, উষ্ণ পরিবেশের মধ্যে বন্ড যখন ড্রিঙ্ক শেষ করছিল, কতকগুলো টেবিল থেকে লোজন উঠতে শুরু করল। স্যার হিউগো ড্রাক্সের রোমশ লালচে মুখ একটা প্রফুল্ল প্রত্যাশায় জ্বলজ্বল করছিল। M আর বন্ডের দিকে তিনি এগিয়ে এলেন। তার পিছনে মেয়ার।
M বন্ডকে বললেন, তাস খেলার ঘরে আমরা কফি আর ব্রান্ডি খাব। ওখানে সিগারেট খাওয়া বারণ। আর কোন মতলব আছে।
বন্ড বলল, চরম আঘাত হানার আগে ধাপে ধাপে ড্রাক্সের লোভটা আমাকে বাড়িয়ে যেতে হবে। তাই আমাকে চড়া বাজি ধরতে দেখলে ঘাবড়াবেন না। উপযুক্ত সময় না আসা পর্যন্ত আমরা যেমন খেলে থাকি তেমনি খেলে যাব। ড্রাক্স তাস বিলি করার সময় আমাদের সাবধান হতে হবে। তিনি অবশ্য তাস বদল করতে পারবেন না। আমাদের ভাল তাস বিলি না করারও কোন কারণ নেই। কিন্তু নিশ্চয়ই তিনি কয়েক বার আকস্মিক ও প্রচণ্ড আক্রমণ করে যে সফল হবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। ড্রাক্সের বাঁ পাশে বসলে আপনার আপত্তি হবে? M বললেন না। বন্ড একটু চিন্তা করে আবার বলল, শুধু একটা কথা, স্যার। সময় হলে আমার কোটের পকেট থেকে সাদা একটা রুমাল আমি বার করব। তার মানে এমন হাত আপনাকে বিলি করা হচ্ছে যার মধ্যে নহলার ওপরে কোন তাস নেই। সেই দানের ডাকটা আমার ওপর দয়া করে ছেড়ে দেবেন।
.
সেয়ানে সেয়ানে
ড্রাক্স আর মেয়র তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। হাভানা চুরুট টানছিলেন তারা চেয়ারে বসে বসে। M আর বন্ড যখন পৌঁছাল, ড্রাক্স তখন একটা নতুন তাসের প্যাকেটের কাগজের মোড়কটা ছিঁড়ছিলেন।
ড্রাক্সের বাঁ পাশে বন্ড বসল। একজন ওয়েটারকে ডেকে M বললেন, কফি আর ক্লাব ব্রান্ডি।
M এর দিকে তাকিয়ে ড্রাক্স প্রশ্ন করলেন, বাজিটা কি? One and One নাকি তার বেশি? Five and Five পর্যন্ত খেলতে আমি রাজি। তীক্ষ্ণ গলায় ড্রাক্স প্রশ্ন করল, তোমার বন্ধু জানে তো বাজিটা কি?
M এর হয়ে বন্ড উত্তর দিল, জানি। তারপর ড্রাক্সের দিকে তাকিয়ে বলল, আজ রাতে নিজেকে খুব দরাজ বলে মনে হচ্ছে। আমার কাছ থেকে কত জিততে চান? ড্রাক্স হেসে বললেন, তোমার বন্ধু জানে তো বাজিটা কি?
M এর হয়ে বন্ড উত্তর দিল, জানি। তারপর ড্রাক্সের দিকে তাকিয়ে বলল, আজ রাতে নিজেকে খুব দরাজ বলে মনে হচ্ছে। আমার কাছ থেকে কত জিততে চান? ড্রাক্স হেসে বললেন, তোমার প্রত্যেকটা পয়সা। কত হারতে। পারবে? বন্ড বলল, সবটা ফুরিয়ে গেলে আপনাকে বলব। হঠাৎ সে নির্মম হয়ে উঠল। শুনেছি আপনার বাজির সীমা Five and Five সেই বাজিতেই খেলা যাক। বন্ড টের পেল তার কপালটা ঘেমে উঠেছে।
ড্রাক্স তার দিকে চাইলেন, তার দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে তীব্র বিদ্রূপ আর অবিশ্বাস।
বন্ড লক্ষ্য করল M এর সমস্ত মুখ টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। M জানালেন, যদি বলতে চাও সঙ্গীর হারের টাকা দেবার ক্ষমতা আমার আছে কিনা–তাহলে বলব হ্যাঁ। ড্রাক্স বললেন, চড়া বাজির খেলা আমার অবশ্যই পছন্দ। তাস বিলি করতে করতে তিনি বললেন, তাহলে শুরু করা যাক্।
এই চড়া বাজি সম্পর্কে সমস্ত দ্বিধা, সঙ্কোচ, ভয় বন্ডের মন থেকে হঠাৎ মুছে গেল। তার মনে তখন একমাত্র প্রতিজ্ঞা এই বনমানুষটাকে এমন শিক্ষা দিতে হবে, জীবনে সেটা যাতে না ভোলে। এমন একটা প্রচণ্ড আঘাত তাকে হানতে হবে যাতে চিরকাল তার মনে থাকে আজকের সন্ধ্যা।
খেলার শুরুত্বের জন্য মুনরেকারের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেল বন্ড। এটা দুজন মানুষের মধ্যে ব্যক্তিগত লড়াই।
ড্রাক্সকে তাঁর দু-হাতের নিচেকার সিগারেট কেসের দিকে মাঝে মাঝে তাকাতে লক্ষ্য করল বন্ড। বুঝতে পারল সিগারেট কেসের ওপর দিয়ে তাসগুলো বিলি করার সময় ঠাণ্ডা মাথায় ড্রাক্স সেগুলোকে মনে মনে মুখস্থ করে চলেছেন। বন্ড খেলার দিকে মন দিল। তাসগুলো তুলল বন্ড। হাতটা সাধারণ। বড় জোর আড়াইটা ট্রিক।
ড্রাক্স বললেন, থ্রি ক্লাবস।
বন্ড দিল নো বিড।
মেয়ার হাঁকালেন চারটে ক্লাস।
M দিলেন নো-বিড।
বন্ড বুঝল ড্রাক্সের হাতে গেম করার ডাক দেবার মত তাস এবার নেই। সে ভাবল সম্ভবত আমাদের হাতে সবগুলো হার্টস আছে। দেখা গেল M এর হাতে হার্টস ছিল না। ছিল সাহেব ছাড়া ডায়মন্ডের অনেক ছোট বড় তাস। সাহেবটা ছিল মেয়ারের হাতে। তিনটের ডাক দেবার মত তাস ড্রাক্সের ছিল না। বাকি ক্লাবগুলো মেয়ারের হাতে।
পরের দান তাস বিলি করতে করতে বন্ড ভাবল, আমাদের কপাল ভাল–ওরা গেম দিতে পারেনি।
তাদের কপাল ভালই চলতে থাকল। বন্ড প্রথমে কল দিল–একটা নো-ট্রাম্প। M সেটা বাড়িয়ে করলেন তিন। একটা বাড়তি পিঠ নিয়ে খেলা করল তারা। মেয়ারের দানে পাঁচটা ডায়মন্ডের ডাকে ড্রাক্সরা একটা ডাউন খেলেন। কিন্তু পরের দানে M প্রথম ডাক দিলেন ফোর স্পেডস্। তিনটে ছোট ছোট রঙ ছাড়া বন্ডের হাতে ছিল অন্য রঙের একটা সাহেব আর বিবি। তারা গেম এবং রাবার করল।
M আর বন্ড এর প্রথম রাবার। বিরক্ত হয়ে উঠল ড্রাক্সের মুখটা। এই রাবার-এ তিনি হারলেন ৯০০ পাউন্ড।
ড্রাক্স বললেন, সোজাসুজি খেলা চলুক। কে ডিল করবে সেটা নিয়ে কাট করার দরকার নেই। M বললেন আপত্তি নেই। দেখা গেল ড্রাক্সের খুশি হবার যথেষ্ট কারণ ছিল। পরের হাতে তিনি এবং মেয়ার স্পেস্-এর খেয়াল করলেন স্মল স্ল্যাম । এই খেলার মধ্যে ছিল রোমাঞ্চকর দুটো তাসের চাল। বন্ডের মনে হল এবার সামান্য একটা খোঁচা দেওয়া দরকার।
বন্ডকে ড্রাক্স তাস কেটে দিলেন। তাস বিলি করার সময় বন্ড টের পেল ড্রাক্স খুঁটিয়ে দেখছেন।
খেলা চলল প্রায় সমান সমান। এবার তাসের মোড় ঘুরল। হার্টস-এর ডাক দিয়ে বন্ড করল স্মল স্ল্যাম এবং পরের দানে M করলেন তিনটে নো ট্রাম্পস্-এর খেলা। ড্রাক্সের ঘর্মাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বন্ড হাসল। দারুণ রেগে দাঁত দিয়ে ড্রাক্স নখ কাটছিলেন।
বন্ড বলল, এটাই আমার শেষ রাবার। সকাল সকাল উঠতে হবে। আশা করি আমাকে আপনারা ক্ষমা করবেন। সেই সন্ধ্যেয় প্রায় অধিকাংশ সময় মেয়ার ছিলেন প্রায় নীরব। স্কোর-কার্ড থেকে মুখ তুলে তাকালেন ড্রাক্স বন্ডের দিকে। লক্ষ্য করলেন বন্ড মাতাল হয়ে পড়েছে।
ড্রাক্স বললেন, এ পর্যন্ত হার জিতের হিসেব হাস্যকর রকম কম। দেখছি এ-পর্যন্ত তোমরা জিতেছ মাত্র শ দুয়েক পাউন্ড। খেলা শেষ করে যেতে চাইলে অবশ্য তোমরা যেতে পার। কিন্তু আর চড়া বাজি ধরে শেষবারের মত আর একটা গেম খেললে কেমন হয়? শেষ রাবার-এ বাজিটাকে যদি আমরা তিনগুণ করি?
Fifteen and fifteen রাজি?
ড্রাক্সের আরক্ত মুখের নিরুত্তাপ চোখটার দিকে তাকাল বন্ড। কেটে কেটে অত্যন্ত স্পষ্ট করে সে বলল, একশ তে দেড়শ পাউন্ড, রাবার-এ দেড় হাজার।–রাজি।
.
সাত হাত সাফাই
মুহূর্তের জন্য টেবিলের চারপাশের সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। সেই স্তব্ধতা ভাঙল মেয়ারের উত্তেজিত স্বরে। উদ্বিগ্ন গলায় তিনি বললেন, হিউগো, আমাকে বাদ দাও। তিনি জানতেন বন্ডের সঙ্গে ড্রাক্সের এটা ব্যক্তিগত বাজি। তা সত্ত্বেও ড্রাক্সকে বোঝাতে চাইলেন, তিনি ভারি নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। মনে হচ্ছে তিনি কোন মারাত্মক ভুল করে বসবেন। ফলে তার পার্টনার হারবে রাশি রাশি টাকা।
খিঁচিয়ে উঠে ড্রাক্স বললেন, বোকার মত কথা বল না, ম্যাক্স। নিজের খেলা খেল। এই বাজির সঙ্গে তোমার কোন সম্পর্ক নেই। এই বেপরোয়া বন্ধুর সঙ্গে এটা একটা ব্যক্তিগত মজাদার বাজি। শুরু করে দাও অ্যাডমিরাল M তাস বাটলেন। খেলা শুরু হল। বন্ড সিগারেট ধরাল। তার কাঁপা হাত-দুটো হঠাৎ স্থির হয়ে উঠেছে। মাথা তার একেবারে পরিষ্কার। সে জানে ঠিক কি এবং কখন তাকে করতে হবে। চরম সিদ্ধান্ত নেবার মুহূর্ত উপস্থিত। তাই সে খুশি।
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল বন্ড। টের পেল তার দু পাশে লোক গিজগিজ করছে। তার কাঁধের উপর ঝুঁকে তার তাসগুলো দেখার জন্য সবাই উদগ্রীব। মনে হল সবাই তার স্বপক্ষে, ড্রাক্সকে সে যে কঠোর শিক্ষা দিতে চলেছে সবাই সেটা অনুমোদন করেছে।
সেই বিখ্যাত জুয়া খেলার ঘরের নেপথ্যে নানা শব্দে তার চিন্তা সূত্র ছিন্ন হোল, চারদিকে তাকাল বন্ড। সেই লম্বা ঘরের মাঝখানকার ঝাড়বাতির তলায় কয়েকজন পোকার খেলা দেখছিল। নানা কাটা কাটা কথা ভেসে আসছে– তোমার বাজির ওপর আরও একশ চড়ালাম। আরও একশ আরও একশ, চুলোয় যাও। আমার হাতটা দেখাব। তারপর বিজয়োল্লাস।
বন্ডের মনে পড়ল এই বিখ্যাত ঘরে দেড়শ বছর ধরে প্রায় প্রতি রাত্রেই এই একই দৃশ্য অভিনীত হয়ে আসছে। হারজিতের সেই একই দৃশ্য অভিনীত হয়ে আসছে। হারজিতের সেই একই নাটক। বন্ড জুয়া খেলতে ভালবাসে।
তাই তার কাছে এটাই পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ দৃশ্য। সবকিছু মনে রাখার জন্য শেষবারের উত্তেজনাপূর্ণ দৃশ্য। সবকিছু মনে রাখার জন্য শেষবারের মত চারদিকে তাকাল সে, তারপর মুখ ফেরাল নিজের টেবিলের দিকে। নিজের তাস তুলল বন্ড। চোখ-দুটো তার চকচক করে উঠল। এই প্রথম ড্রাক্সের ডিল-এ গেম করার মত একটা নিখুঁত হাত সে পেয়েছে। সাতটা স্পেস, তার মধ্যে চারটে সবচেয়ে বড় অনার্স। হার্টস-এর টেক্কা আর ডায়মন্ডস্ এর টেক্কা ও সায়েব। ড্রাক্সের দিকে তাকাল। তিনি আর মেয়ার কি সব ক্লাসগুলো পেয়েছেন? পেলেও বন্ড তাদের চেয়ে বেশি ডাক দেবে।
নো বিড ড্রাক্স বললেন, বন্ড-এর হাত তার জানা। তার স্বরের মধ্যে ফুটে উঠল তিক্ততা। ফোর স্পেড়স বলল বন্ড। মেয়ার আর M নো বিড দিলেন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ড্রাক্সও দিলেন নো বিড। M এর হাত থেকে খানিকটা সাহায্য পাওয়া গেল। পাঁচটার খেলা করল বন্ড। লাইনের তলায় দেড়শ পয়েন্ট। লাইনের ওপরে অনার্সের দরুন একশ।
সাবাস! বন্ডের কনুয়ের পেছন থেকে একটা স্বর শোনা গেল। মুখ তুলে বন্ড দেখতে পেল ব্যাসিলডনকে, নিজের খেলা শেষ করে তিনি এসেছেন অন্য যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা দেখতে।
বন্ডের স্কোর-কার্ড তুলে তিনি দেখলেন। হেসে বললেন, এ দেখছি একবারে টুটি টিপে মার। মনে হচ্ছে চ্যাম্পিয়নদের তুমি কোণঠাসা করে ফেলেছ। বাজিটা কি? বন্ড চাইল উত্তরটা ড্রাক্সই দিন। বেজায় খুশি হয়ে উঠল সে।
ঠিক লাগসই সময়ে ব্যাপারটা ঘটেছে। নীল তাসগুলো কেটে ড্রাক্স রাখলেন বন্ডের সামনে। বাঁটা তাসগুলো একসঙ্গে করে বন্ড রাখল নিজের সামনে, টেবিলের কিনারে।
Fifteen and Fifteen। আমার বাঁয়ে ড্রাক্স বললেন, বন্ড শুনল ব্যাসিলডনকে জোরে নিশ্বাস টানতে। ছোকরা জুয়া খেলতে চায়। তাই তাকে সুযোগ দিয়েছি। সব ভাল ভাল তাস দেখছি ও-ই পাচ্ছে …
গজ গজ করতে লাগলেন ড্রাক্স।
টেবিলের ওপাশ থেকে M লক্ষ্য করলেন বন্ডের ডান হাতে একটা সাদা রুমাল। M এর চোখ দুটো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। সেটা দিয়ে বন্ড মুখ মুছল। M দেখলেন মেয়র আর ড্রাক্সের দিকে বন্ডকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে। তারপর রুমালটা বন্ড পকেটে ভরল।
বন্ডের হাতে এক প্যাকেট নীল তাস। সেগুলো বিলি করতে শুরু করল বন্ড।
ব্যাসিলডন বললেন, সাংঘাতিক বাজি। এখানে একবার ব্রিজে হাজার পাউন্ডের সাইড বেট ধরা হয়েছিল। কিন্তু সেটা ১০১৪–১৮ এর লড়াইয়ের আগেকার ঘটনা, যখন রবারের বাজার খুব গরম, আশা করি কোন গণ্ডগোল হবে না। এটা তার আন্তরিক কথা। সাধারণত প্রাইভেট গেমে চড়া বাজির ফলে নানা গন্ডগোল পাকিয়ে ওঠে। M এবং ড্রাক্সের মাঝখানে গিয়ে তিনি দাঁড়ালেন।
তাস বিলি শেষ করে খানিক উৎকণ্ঠিতভাবে নিজের তাসগুলো তুলল বন্ড। তার হাতে টেক্কা বিবি নহলা সমেত পাঁচটা ক্লাবস এবং বিবি নিয়ে ঘোট ঘোট আটটা ডায়মন্ড দেখল। কোন ভুল হয়নি। নিখুঁতভাবে ফাঁদ পাতা হয়েছে। বন্ড দেখল নিজের তাসগুলো দেখে ড্রাক্সকে উত্তেজনায় টান-টান হয়ে উঠতে। নিজের চোখকে যেন তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। আবার ভাল করে তিনি দেখলেন নিজের তাসগুলো। বন্ড জানে ড্রাক্স অবিশ্বাস্য ভাল তাস পেয়েছেন। নিঃসন্দেহে দশটা পিঠ তার হাতে। তাঁর হাতে স্পেডস্ এর টেক্কা সাহেব বিবি গোলাম, হার্টস-এর টেক্কা, সায়েব বিবি গোলাম, ডায়মন্ডের টেক্কা, সায়েব, চিড়িতনের সাহেব, গোলাম নহলা। ডিনারের আগে সেক্রেটারির ঘরে এই হাতটাই ড্রাক্সের জন্য বন্ড বানিয়েছিল।
এই অবিশ্বাস্য রকম ভাল হাত পেয়ে ড্রাক্সের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য বন্ড অপেক্ষা করতে লাগল। পেটুক মাছটা টোপ গিলতে আসছে দেখে একটা নিষ্ঠুর আনন্দ অনুভব করল বন্ড।
এমন একটা প্রতিক্রিয়া ড্রাক্সের হবে বলে বন্ড কিন্তু কল্পনাও করতে পারেনি। ড্রাক্স খুব স্বাভাবিকভাবেই তাসগুলো টেবিলের উপর রাখলেন। বেপরোয়াভাবে পকেটে থেকে সিগারেটের বাক্সটা বার করে একটা সিগারেট জ্বালালেন। বন্ডের দিকে তাকালেন না। তাকালেন ব্যাসিলডনের দিকে।
বাজির কথার খেই ধরে তিনি বলে চললেন, বাজিটা বড়। কিন্তু এর চেয়েও চড়া বাজিতে আগে খেলেছি। কায়রোতে একবার খেলেছিলাম রাবার পিছ দু-হাজার। মোহামেত্ আলিতে। সেখানকার লোকদের বাস্তবিকই বুকের পাটা আছে। গেম এবং রাবার ছাড়া ও প্রতি প্যাকেটের ওপর প্রায়ই তারা বাজি ধরে। তারপর ধূর্ত চোখে বন্ডের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন আমার কয়েকটা ভাল তাস এবার এসেছে–কথাটা স্বীকার করেই নিচ্ছি। কিন্তু তুমিও ভাল তাস পেতে পার। বন্ড মনে মনে বলল ওরে বুড়ো জোচ্চোর। ভাল করেই জানিস সে সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তোর নিজের হাতেই তো তিন রঙের টেক্কা সায়েব রয়েছে। এই হাতের বাড়তি বাজি ধরতে চাও?
খুব মাতালের মত ভান করে নিজের তাসগুলো বন্ড দেখতে লাগল। জড়ানো গলায় বলল, আমার হাতেও কিছু ভাল ভাল তাস এসেছে দেখছি। আমার পার্টনারের সামান্য সাহায্য পেলে আমিও অনেক পিট নিতে পারব। কত বাজি ধরতে চান?
মনে হচ্ছে দু জনেই আমরা প্রায় সমান সমান মিথ্যে করে–বললেন ড্রাক্স। সাইড-বেটিং-প্রতি পিটের ওপর একশ পাউন্ড। রাজি? বন্ডকে দেখল খানিকটা চিন্তান্বিত। যেন সবকিছু তার গুলিয়ে যাচ্ছে। আবার নিজের তাসগুলো একটা একটা করে সে দেখল। তারপর বলল অল রাইট। আপনার বাজিতে রাজি। সত্যি বলতে কি, জুয়াখেলার দিকে। আমাকে আপনিই টেনেছেন। বুঝতে পারছি, হাতটা আপনার বেজায় ভাল। তাই আপনাকে ডাক দেবার সুযোগ দেব। না। একটা রিস্ক নিই—
মাতাল-মাতাল চোখে বন্ড M-এর দিকে তাকিয়ে বলল, হারলে পার্টনার টাকাকড়ি চুকিয়ে দেবেন। শুরু করা যাক–সেভেন ক্লাস। একেবারে থমথমে পরিবেশ। ড্রাক্সের হাত ব্যাসিলডন দেখেছিলেন। বন্ডের ডাক শুনে তিনি এমন চমকে উঠলেন যে তাঁর হাত থেকে হুইস্কি আর সোডা ভরা গ্লাসটা পড়ে গেল। ভাঙা গ্লাসটার দিকে ফ্যালফ্যাল। করে তিনি তাকিয়ে রইলেন।
চমকে উঠে ড্রাক্স বললেন, সেভেন ক্লাবৃস? আর একবার নিজের হাত চটপট দেখে নিলেন তিনি। বন্ডের দিকে তাকালেন ড্রাক্স কৌতূহলী দৃষ্টিতে। স্পষ্টই বোঝা যায় বন্ড মাতাল হয়ে পড়েছে, তুমি গ্র্যান্ড ক্লারের ডাক দিয়েছ ক্লাব এ? আমার আর কি তোমারই শবযাত্রা। ম্যাক্স, তুমি কি বল?
মেয়ার বললেন, নো বিড। টের পেলেন চারপাশে যেন দারুণ দুর্যোগ। এটা এড়াতেই তিনি চেয়েছিলেন : এই শেষ রাবার-এর আগে কেন তিনি বাড়ি ফিরে যাননি? মনে মনে গুমরাতে লাগলেন।
M বললেন, নো বিড। দেখলে মনে হয় তিনি মোটেই উত্তেজিত হননি।
ডবল। হিস-হিস করে বললেন ড্রাক্স। নিজের তাসগুলো রাখলেন টেবিলের ওপর। এই গাধাটা ফাঁদে পড়েছে। বন্ড বলল, তাহলে সাইড-বেটস-এতেও আপনি ডবল দিলেন। লোভির মত ড্রাক্স বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ। সাইডবেট্রস এতেও ডাবল দিয়েছি।
বন্ড বলল, অল রাইট। খানিক থামল সে। নিজের তাসের দিকে তাকাল না। তাকাল ড্রাক্সের দিকে। স্পষ্ট করে। বলল, রি ডাবল। কন্ট্রাক্ট আর সাইড-বেটের ওপর। পিট পিছু ৪০০ পাউন্ড। সেই মুহূর্তে ড্রাক্সের মনে একটা অবিশ্বাস্য আর ভয়ঙ্কর সন্দেহ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। আবার দেখলেন তিনি নিজের তাসগুলো দেখে ভরসা পেলেন। অন্তত দুটো পিট তিনি পাবেনই-কেউ সেটা আটকাতে পারবে না। বিড় বিড় করে মেয়ার বললেন, নো বিড । অস্পষ্ট স্বরে M বললেন নো। ড্রাক্সও আর কোন ডাক দিলেন না। মাথা ঝাঁকালেন।
ব্যাসিলডনের মুখটা দারুণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। টেবিলের ওপাশ থেকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তিনি তাকালেন বন্ডের দিকে। তারপর টেবিলের চারদিকে ধীরে ধীরে হেঁটে তিনি দেখতে লাগলেন সবাইকার হাত।
তারপর হঠাৎ সমস্ত ব্যাপারটা ব্যাসিলডনের কাছে পানির মত পরিষ্কার হয়ে গেল। বন্ডের যে হাত তাতে যে কোন ডিফেন্সের বিরুদ্ধে তাদের Grand Slom অবধারিত। কেউ আটকাতে পারবে না। মেয়ার যাই খেলুন না কেন বন্ড তুরুপ করবে হয় নিজের, নয় টেবিলের ওপর পাতা M-এর তাস নিয়ে। তারপর ড্রাক্সের বিরুদ্ধে Finense করে। রঙগুলো সব বার করে নিয়ে। দু-হাত ডায়মন্ডস্ খেলে, ডামির হাত দিয়ে তুরুপ করে বন্ড ধরবে ড্রাক্সের সায়েব আর বিবিকে। পাঁচ-দান খেলার পর বন্ড ধরবে ড্রাক্সের হাতে থাকা বাকি রঙগুলো আর ডায়মন্ডস্-এর ছটা জেতা তাস। ড্রাক্সের সব টেক্কা-সায়েবগুলো হয়ে পড়বে সম্পূর্ণ মূল্যহীন।
ব্যাপারটা যাকে বলে একেবারে খুন খারাপির মত কাণ্ড। প্রায় মোগ্রস্ত মানুষের মত টেবিলের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে ব্যাসিলডন এসে দাঁড়ালেন মেয়ার এবং M এর মাঝখানে, যাকে তিনি বন্ড আর ড্রাক্সের মুখ ভাল করে লক্ষ্য করতে পারে। তার নিজের মুখ একেবারে ভাবলেশহীন। কিন্তু হাত দুটো তাঁর ঘেমে উঠেছিল ট্রাউজারের পকেটের মধ্যে। যে সাংঘাতিক সাজা ড্রাক্স পেতে চলেছেন, দুরু দুরু বুক নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। ব্যাসিলডন দেখলেন গুণে গুণে তেরটা চাবুক, যেগুলোর ক্ষতচিহ্ন কোন তাস খেলোয়াড় কোনদিন মুছে ফেলতে পারে না।
অসহিষ্ণু হয়ে ড্রাক্স বললেন, কিছু একটা খেল, ম্যাক্স এখানে রাত ভোর থাকতে পারব না। ব্রাসিলডন মনে মনে বললেন : ওরে গাধা, দশ মিনিটের মধ্যেই তোর মনে হবে প্রথম তাসটা খেলার আগে চেয়ারের মধ্যে মেয়ারের মৃত্যু হলেই ভাল হত।
মেয়ারকে দেখে মনে হল যে-কোন মুহূর্তে তার স্ট্রোক হতে পারে। মুখটা তার মরার মত সাদা, থুতনি থেকে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ঝরছে তার শার্টের ওপর, মেয়ারের মনে হল তার প্রথম তাসটাই সর্বনাশের সূচনা করবে। অনেক ভেবে মনে হল তাঁর হাতে স্পেডস্ এবং হাটস্-এর লম্বা সুট থাকায় ঐ দুটো রঙের কোন তাসই খুব সম্ভব বন্ডের হাতে নেই। তাই তিনি খেললেন ডায়মন্ডস্-এর গোলাম। তিনি যে-কোন তাসই খেলতেন না কেন, তাতে কিছুই ইতর-বিশেষ হত না। M তার হাত টেবিলের ওপর পেতে দিলেন। দেখা গেল তার হাতে কোন ডায়মন্ডস্ নেই। ড্রাক্স তার পার্টনারকে খিজিয়ে উঠলেন, বুন্ধু। আর কোন তাস পেলে না? গেমটা ওদের হাতে তুলে দিতে চাও নাকি? কাদের দলে খেলছ। ভয়ে সিঁটিয়ে উঠলেন মেয়ার। রুমালে মুখ মুছে ভীরু গলায় বললেন, হিউগো মনে হল খেলার পক্ষে এটাই সবচেয়ে ভাল তাস।
কিন্তু ততক্ষণে ড্রাক্স নিজের দুশ্চিন্তা নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়েছেন। M-এর হাত থেকে তুরুপ করে ড্রাক্সের ডায়মন্ডস্ এর সায়েব ধরে সঙ্গে সঙ্গে বন্ড খেলল একটা ক্লাবস। ড্রাক্স দিলেন তাঁর নহলা। নহলা দিয়ে পিটটা নিয়ে বন্ড খেলল একটা ডায়মন্ড। তারপর M-এর হাত দিয়ে সেটা তুরুপ করল। ধরা পড়ল ড্রাক্সের টেক্কা। M এর হাত থেকে একটা ক্লাব খেলে বন্ড ধরে নিল ড্রাক্সের গোলাম।
তারপর বন্ড খেলল ক্লাবস-এর টেক্কা। নিজের হাতের সায়েবটা ধরা পড়তে এই প্রথম ড্রাক্স আভাস পেলেন কি ঘটতে চলেছে। উদ্বিগ্ন চোখে বন্ডের দিকে তাকিয়ে সভয়ে তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন পরের তাসটার জন্য। বন্ডের হাতে কি ডায়মন্ডস্ আছে? মেয়ার কি ডায়মন্ডগুলোকে গার্ড করে রাখেননি, তিনিই তো ডায়মন্ড দিয়ে খেলা শুরু করে ছিলেন। ড্রাক্স অপেক্ষা করতে লাগলেন। হাতের ঘামে তাসগুলো তার চটচটে হয়ে উঠল। মাফি ছিলেন বিখ্যাত দাবা খেলোয়াড়। তার একটা অভ্যেস ছিল মারাত্মক। যতক্ষণ না নিঃসন্দেহ হতেন প্রতিপক্ষ আর হার এড়াতে পারবে না, ততক্ষণ খেলা থেকে মুখ তুলতেন না। তারপর নিজের বিরাট মাথাটা ধীরে ধীরে তুলে বোর্ডের অন্য পাশের প্রতিপক্ষের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাতেন। প্রতিপক্ষ সেই চাহনিটা অনুভব করে নম্রভাবে তাকাতো মাফির চোখের দিকে। সেই মুহূর্তে প্রতিপক্ষ বুঝতে পারত আর খেলে লাভ নেই। মাফির চোখেও ফুটে উঠত সেই কথা। প্রতিপক্ষ বুঝতে পারত আত্মসমর্পণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
মাফির মতই এবার বন্ড মুখ তুলে সোজা তাকাল ড্রাক্সের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে ডায়মন্ডস-এর বিবি বার করে রাখল টেবিলের উপর। তারপর মেয়ারের দান দেবার জন্য অপেক্ষা না করে একে একে চিতিয়ে দিল ৮, ৭, ৬, ৫, ৪ এবং ক্লাস-এর দুটো জেতা তাস।
তারপর ধীরে ধীরে চেয়ারে হেলান দিয়ে শান্ত গলায় বলল, আর খেলে লাভ নেই ড্রাক্স। সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে ঝুঁকে মেয়ারের হাত থেকে তাসগুলো ছিনিয়ে নিল ড্রাক্স। টেবিলের ওপর সেগুলো চিতিয়ে ফেলে পাগলের মত দেখতে লাগলেন সেখানে জেতবার মত কোন তাস আছে কিনা।
তারপর টেবিলের ওপর ছুঁড়ে ফেললেন নিজের তাসগুলো। মুখটা তার মরার মত সাদা হয়ে উঠল কিন্তু রক্তচক্ষু দুটো ধ্বক-ধ্বক জ্বলতে লাগল বন্ডের দিকে চেয়ে। তারপর টেবিলের ওপরকার অর্থহীন টেক্কা সাহেব, বিবিগুলোর ওপর সজোরে বসালেন প্রচণ্ড এক ঘুসি। নিচু গলায় কেটে-কেটে বন্ডকে তিনি বললেন, তুমি একটা টেবিলের ওপাশ থেকে চাবুকের মত ব্যাসিলডনের স্বর শোনা গেল, হয়েছে হয়েছে ড্রাক্স-চুপ কর। ও-ধরনের কথা এখানে চলবে না। পুরো খেলাটা আমি লক্ষ্য করেছি। তাসের দেনা চুকিয়ে দাও। কোন অভিযোগ থাকলে লিখিতভাবে কমিটির কাছে পেশ কর।
ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে চেয়ার থেকে সরে এস ভিজে লালচে চুলগুলোর মধ্যে আঙুল চালালেন ড্রাক্স। ক্রমশ তাঁর মুখের রঙ স্বাভাবিক হয়ে এল, সেই সঙ্গে ফুটে উঠল একটা ধূর্ত অভিব্যক্তি। বন্ডের দিকে তিনি তাকালেন। তার সুস্থ চোখের মধ্যে অদ্ভুত ধরনের একটা ঘৃণা মেশান বিজয়োল্লাসের দৃষ্টি ফুটে উঠল। বন্ডের কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল। টেবিলের সবাইকার দিকে একে একে তিনি তাকালেন। সেই একই ঘৃণার দৃষ্টিতে। বললেন গুডনাইট। প্রায় হাজার পনের পাউন্ড আমি ধরি। মেয়ারের ধারটাও আমি শোধ করব।
সামনে ঝুঁকে তিনি তাঁর সিগারেট কেস এবং লাইটারটা তুলে নিলেন।
তারপর বন্ডের দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত গলায় তিনি বললেন, কম্যান্ডার বন্ড। এই টাকাটা খুব চটপট খরচ করে ফেলতে চেষ্টা কর।
টেবিল থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে তিনি বেরিয়ে গেলেন।
.
দ্বিতীয় খণ্ড—মঙ্গলবার বুধবার
আট্রালোল টেলিফোন
রাত দুটো পর্যন্ত বিছানায় শোয়নি বন্ড। তবু পরের দিন কাঁটায় কাঁটায় সকাল দশটায় হেড কোয়ার্টার্সে পৌঁছল। তার বিশ্রী লাগছিল, প্রায় পুরো দু বোতল শ্যামপেন খাবার জন্য খুব অম্বল আর একটা ক্লান্ত মনমরা ভাব। সেটা
আংশিকভাবে বেনজিড্রিন ও আংশিকভাবে গত রাত্রের নাটকের প্রতিক্রিয়া।
আর একটা রুটিন মাফিক কাজের দিন শুরু করার জন্য লিফটে সে যখন ওপরে উঠছিল গত রাত্রে তিক্ত স্বাদ তখনো তার দেহ মনে।
মেয়ার চলে যাবার পর কোটের দু পকেটে থেকে দু প্যাকেট তাস বার করে ব্যাসিলডন এবং M-এর সামনে টেবিলে সে রেখেছিল। একটা প্যাকেটের রঙ নীল-ড্রাক্স যেটা বেটে তাকে দেন এবং সেটা হাত সাফাই করে পকেটস্থ করে রুমালের আড়ালে তার জায়গায় সে বার করে আনে অন্য একটা নীল প্যাকেট। এই প্যাকেটটা ছিল তার ডান পকেটে। বা পকেটে ছিল আর একটা লাল প্যাকেট। সেটার দরকার পড়েনি।
লাল তাসগুলো M আর ব্যাসিলডনের সামনে টেবিলে সাজিয়ে বন্ড দেখায় সেগুলো দিয়েও একইভাবে Grand Slom করে ড্রাক্স-কে সে হারাতে পারত।
বন্ড বলে, এটা কাল বটসনের সাজানো বিখ্যাত হাত। আমি লাল এবং নীল দু রঙের তাসই সাজিয়ে রেখেছিলাম– কারণ জানতাম না কোন রঙের তাস আমাকে বিলি করতে হবে।
ব্যাসিলডন কৃতজ্ঞচিত্তে বললেন, একেবারে মোক্ষম প্যাঁচ কষেছিলে। আশা করি আসল কথাটা ড্রাক্স এবার বুঝবে। ভবিষ্যতে হয়ত সে আর খেলবে না। যদি বা খেলে, তাহলে খেলবে জোচ্চুরি না করে সোজাসুজি খেলা। আজ রাতে তার বেশ মোটা টাকা খসেছে। তোমার জিত নিয়ে আমরা কোন আলোচনা করব না। আজ রাত প্রত্যেকের দারুণ উপকার করেছ, বিশেষ করে ড্রাক্সের। কোন রকম ভুলচুক হলে তোমাকেই হারতে হত মোটা টাকা। শনিবার চেকটা তোমার কাছে পৌঁছবে।
শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নেবার পর বন্ড তার ফ্ল্যাটে যায় ঘুমতে। সেই রাত্রে অদ্ভুত ঘটনাগুলো ভোলার এবং পরের দিন সকালে অফিসে সুস্থ শরীরে যাবার জন্য বন্ড ঘুমের একটা বড়ি খায়।
দরজা বন্ধ করার পর বন্ডের চোখের নিচেকার কালচে ছোপের দিকে লোয়েলিয়া পসেবি লক্ষ্য করল।
এক মুখ হেসে সে বলল, খানিক কাজ, খানিক খেলা। পুরোপুরি পুরুষ সঙ্গীদের সঙ্গে বেনজিড্রিনটার জন্য ধন্যবাদ। বাস্তবিকই সেটার খুব দরকার ছিল। আশা করি সন্ধ্যেটা তোমার মাটি করে দিইনি।
লোয়েলিয়া বলল, মোটেই না। তার মনে পড়ল, বন্ড টেলিফোন করার পর লাইব্রেরির বই আর ডিনার ছেড়ে তাকে উঠে যেতে হয়েছিল। নিজের শর্টহ্যান্ড প্যাডের দিকে তাকিয়ে সে বলল, আধঘণ্টা আগে বড়কর্তা ফোন করেছিলেন। বললেন আজ তোমাকে M-এর দরকার। কখন–তা বলতে পারেননি। আমি তাকে জানাই আজ বিকেল তিনটেয়। তোমার নিরস্ত্র লড়াইয়ের মহড়া আছে। তিনি বলেছেন সেটা বাতিল করে দিতে, এই খবর। তাছাড়া আছে গতকালের বাকি কাগজপত্রগুলো। বন্ড বলল, বাঁচলাম, সেই কম্যান্ডো ছোকরার সঙ্গে কিছুতেই আজ লড়তে পারতাম না। ০০৪ এর কোন খবর আছে? লোয়েলিয়া বলল, হ্যাঁ। সে নাকি ভালই আছে। ওয়ারেন হাউড-এর মিলিটারি হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। স্পষ্টতই এটা শক্-এর ব্যাপার। বউ জানে তাদের পেশায় শক বলতে কি বোঝায়। মুখে বলল ভাল, কিন্তু খবরটা সত্যি সত্যি ভাল বলে তার মনে হল না। লোয়েলিয়ার দিকে আবার হেসে নিজের অফিস ঘরে গিয়ে সে দরজা বন্ধ করল।
দৃঢ় পায়ে ডেস্কের কাছে গিয়ে চেয়ারে বসে ওপরকার ফাইলটা নিজের দিকে সে টেনে নিল। শেষ হয়েছে সোমবার। মঙ্গলবার আজ। নতুন একটা দিন নিজের টিপটিপ করা মাথা আর গত রাতের ঘটনাগুলো ভোলবার চেষ্টা করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বাদামী রঙের ফোল্ডারটা খুলল। সেটার ওপর লাল তারার চিহ্ন অর্থাৎ একান্ত গোপনীয়। আমেরিকায় কাস্টমস্ ব্রাঞ্চ-এর প্রধান নিরাপত্তা অফিসারের কাছে থেকে এসেছে। শিরোনামায় লেখা : The Inspectoscope
বন্ড পড়তে লাগল, চোরাই চালান ধরবার জন্য এই ইন্সপেক্টোস্কোপ যন্ত্র ফুরোস্কোপিক (fluoroscopic) পদ্ধতিতে কাজ করে। সানফ্রানসিসকোর সিকুলার ইন্সপেক্টোস্কোপ কোম্পানী এই যন্ত্র তৈরি করে। অপরাধী ও জেল দর্শনার্থীদের পোশাক কিংবা দেহে ধাতব দ্রব্যের গোপন সন্ধানের জন্য আমেরিকার নানা জেলে এই যন্ত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। আফ্রিকা এবং ব্রাজিলে হীরের খনিতে বেআইনী হীরে কেনা এবং চোরাপথে হীরে পাচারও ধরবার জন্যও এই যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। যন্ত্রটার দাম সাত হাজার ডলার। এটা লম্বায় প্রায় আট ফুট, উচ্চতায় সাত ফুট এবং ওজনে প্রায় তিন টন। এর জন্য দরকার দু-জন দক্ষ অপারেটর। আইড়ওয়াইল্ডের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাস্টম্স্ হলে এই যন্ত্র নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে দেখা গেছে যে…
দুটো পাতা বন্ড বাদ দিয়ে গেল। তাতে ছিল কয়েকটা ছোট খাটো চোরা চালানের খুঁটিনাটি বিবরণ। সিদ্ধান্তগুলোর সারাংশ ভাল করে সে পড়ল। পড়ে খানিক বিরক্ত হল সেঃ বুঝতে পারল পরের বার বিদেশে যাবার সময় তার ২৫ বেরেটা পিস্তলটাকে অন্য কোথাও লুকোতে হবে–বগলের মধ্যে আর সেটাকে নেওয়া চলবে না। স্থির করল এই সমস্যা নিয়ে যন্ত্রপাতি বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
ডিস্ট্রিবিউশন স্লিপের ওপর টিক দিয়ে নাম সই করে পরের ফোল্ডারের দিকে সে হাত বাড়াল। এটার নাম ফিলোপোন-জাপানি খুনে-মাদক।
বন্ড পড়তে লাগল।
জাপানে অপরাধ বাড়ার প্রধান কারণ হচ্ছে ফিলোপোন। জনকল্যাণ মন্ত্রকের মতে জাপানে এখন এই মাদকে আসক্ত মানুষের সংখ্যা ১৫ লক্ষ, এদের মধ্যে ১০ লক্ষের বয়েস কুড়ি বছরেরও কম। টোকিও পুলিশের ধারণা তরুণদের অপরাধের শতকরা ৭০ ভাগের মূলে আছে এই মাদকদ্রব্য।
আমেরিকার মারিজুয়ানার (গাঁজা) মত ফিলোপোনের একটা ইনজেকশনেই আসক্তি জন্মায়। এর ফলে উত্তেজনা জন্মায় এবং ক্রমশ এটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে যায়। এটার দামও সস্তা, ইনজেকশন পিছু প্রায় দশ ইয়েন (ছ পেন্স)। আসক্ত ব্যক্তি খুব তাড়াতাড়ি ইনজেকশনের পরিমাণ বাড়িয়ে ফেলে। দিনে প্রায় ১০০ টা পর্যন্ত। তখন আর সেটা সস্তা থাকে না। বেশ খরচের ব্যাপার হয়ে পড়ে। ফলে নেশার দাম জোগাড় করার জন্য আসক্ত ব্যক্তি নানা অপরাধ করতে থাকে। এই অপরাধের অন্তর্গত হচ্ছে দৈহিক আক্রমণ এবং খুন। তার কারণ এই মাদকের অদ্ভুত এক বৈশিষ্ট্য। এই মাদক একটা তীব্র নির্যাতন মনোভাব (Persecution Comlpex) আসক্ত ব্যক্তির মনে নিয়ে আসে। তার মনে একটা কাল্পনিক ভয় জন্মায়, সব সময়ে মনে হয় লোকে তাকে খুন করতে চাইছে, সর্বদাই লোকে তার পিছু নিচ্ছে ক্ষতি করার উদ্দেশ্য নিয়ে। যদি তার মনে হয় পথের কোন অপরিচিত লোক আপত্তিজনকভাবে তাকে দেখছে তা হলে সে সেই অপরিচিত লোককে কিল-চড়-লাথি মারতে শুরু করে কিংবা ক্ষুর নিয়ে তেড়ে যায়। যাদের আসক্তি খুব বাড়েনি। তারা সেই সব পুরনো বন্ধুদের এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে, দিনে যাদের দৈনিক মাত্রা একশতে পৌচেছে। ফলে শেষোক্ত আসক্ত ব্যক্তির নির্যাতন মনোভাব আরও যায় বেড়ে। এইভাবে আসক্ত ব্যক্তির মনে একটা ধারণা গড়ে ওঠে। তাদের মনে হতে থাকে খুন করাটা নিষ্পাপ এবং সমর্থন যোগ্য–তারা মনে করে, খুন করছে আত্মরক্ষার জন্য, কোন পাপ নয় সহজেই বোঝা যায়। সংগঠিত অপরাধ মূলক কাজ পরিচালনার ব্যাপারে ধূর্ত লোকের হাতে ফিলোপোন কি রকম একটা বিপজ্জনক হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। জানা গেছে কুখ্যাত Bar Mecca মার্ডার কেসের মূলে ছিল ফিলোপোন। সেই অপ্রীতিকর ঘটনার পর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে উক্ত মাদকের পাঁচ হাজারের বেশি সরবরাহকারীকে পুলিশ গ্রেফতার করে।
যথারীতি কোরিয়ানদের ঘাড়ে দোষ চাপানো হচ্ছে… হঠাৎ বন্ডের সমস্ত মন বিদ্রোহ ঘোষণা করল। এই সব পড়ে তার লাভটা কি? ফিলোপোন নামে একটা জাপানি খুনে-মাদক সম্বন্ধে এই সব জ্ঞান কবে কখন তার কাজে লাগবে?
অন্যমনস্কভাবে কোন রকমে বাকি পাতাগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে ডিস্ট্রিবিউশন স্লিপে টিক চিহ্ন দিয়ে নিজের নাম সই করে আউট-লেখা ট্রর মধ্যে ডকেটটাকে সে ছুঁড়ে ফেলল।
মাথার যন্ত্রণাটা তখন নেমে আসছে তার ডান চোখের ওপর। পেরেক দিয়ে সেটা যেন সেখানে গেঁথে দেওয়া হয়েছে। ডেস্কের একটা ড্রয়ার খুলে ফেনসিক-এর একটা শিশি-সে বার করল। একবার ভাবল সেক্রেটারিকে বলে এক গ্লাস পানি দিতে। কিন্তু সে চায় না কেউ তার জন্য আহা উঁহু করে। তাই মুখ বিকৃত করে দুটো ট্যাবলেট দাঁতে শুড়িয়ে সেই তীব্র বিস্বাদ গুঁড়োটা সে গিয়ে ফেলল। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে দাঁড়াল গিয়ে জানালার সামনে। উদ্দেশ্যহীনভাবে তাকাল নিচেকার সবুজ দৃশ্য আর লন্ডনের দিগন্তের দিকে। কিন্তু কোন কিছুই যেন তার চোখে পড়ল না। শুধু মনে পড়তে লাগল গত রাতের অদ্ভুত ঘটনা গুলোর কথা।
যত ভাবতে লাগল ততই অদ্ভুত বলে মনে হতে লাগল তার। ড্রাক্স কোটিপতি। জনসাধারণের কাছে হিরো। দেশে অদ্বিতীয় প্রতিষ্ঠা। কেন তিনি তাস খেলায় জোচ্চুরি করেন? এই জোচ্চুরি করে তার লাভ কি? নিজের কাছে কি প্রমাণ করতে চান তিনি। তিনি কি নিজেকে মনে করেন সবাইকার চেয়ে এমনি ঊর্ধ্বে যে অনায়াসে জনমতের ওপর থু থু ছিটোতে পারেন।
বন্ডের চিন্তাধারা স্তব্ধ হল, জনসাধারণের মুখে থু থু ছিটানো! ধিক! ব্লেস-এ তার ধরণ-ধারণের এইটাই অর্থ। উন্নাসিকতা ও ঘৃণার মিশ্রণ। সব মানুষগুলোই যেন নোংরা জঞ্জাল। ঘৃণারও অযোগ্য। তাদের সঙ্গে ভদ্র আচরণের ভান করারও দরকার নেই।
স্পষ্টতই ড্রাক্স জুয়া খেলতে ভালবাসেন। হয়ত তাতে তাঁর চাপা উত্তেজনার লাঘব হয়। যে উত্তেজনা ফুটে ওঠে তার কর্কস স্বরে, দাঁত দিয়ে ক্রমাগত নখ কাটায় এবং সর্বদা গলগল করে ঘামার মধ্যে। কোথাও কিছুতেই হারব না এই তার মনের ভাব। এই নিচু স্তরের মানুষগুলোর কাছে হার মানা ভারি লজ্জার ব্যাপার। তাই সবরকম ঝুঁকি নিয়ে। জাল-জোচ্চুরি করে জিততে তাঁকে হবেই। নিশ্চয়ই তাঁর ধারণা-যে কোন অবস্থা থেকেই হুমকি দিয়ে তিনি বেরিয়ে আসতে পারবেন। বন্ডের মনে হল, মোহগ্রস্ত মানুষরা সাধারণত বিপদ সম্বন্ধে অন্ধ হয়ে থাকে। চৌর্যোদরা ক্রমশ কঠিন কঠিন জিনিস চুরি করার চেষ্টা করে। যৌনোন্মত্তরা এমন অসভ্যতা শুরু করে, যেন গ্রেফতার হতে চায়। কিন্তু কোন্ মোহ এই মানুষটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করছে। তার মধ্যেকার এই সর্বনাশা তাগিদের আদি কারণ কি, যেটা তাঁকে খাড়া পাহাড় থেকে সোজা টেনে নিয়ে চলেছে সমুদ্রের মধ্যে?
সবগুলো লক্ষণই প্যারানোইয়ার (ভ্ৰম-বাতুলতা) বিরাটত্বের মোহ, তার পেছনে রয়েছে নির্যাতন মনোভাব। এগুলো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছিল তার মুখের ঘৃণার ভাবে, তার গর্জন ভরা স্বরে, তিক্ত পরাজয়ের পর তার মুখের সেই গোপন বিজয়োল্লাসের অভিব্যক্তির মধ্যে। সেই বিজয়োল্লাসের অভিব্যক্তিটা উন্মাদের মত, যাদের ধারণা–আসল ঘটনা যাই হোক না কেন, তারা অভ্রান্ত। উন্মাদদের ধারণা থাকে, যে-কেউ বাধা দিতে আসুক না কেন, তাকে তারা নির্ঘাত হারিয়ে দেবে। তাদের ধারণা নিজেদের এমন-সব গোপন ক্ষমতা আছে যার দরুন কিছুতেই তারা হারবে না। তাদের ধারণা তার সোনা বানাতে পারে, উড়তে পারে পাখির মত-তারাই সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা। রিজেন্ট স্ট্রিটের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বন্ডের মনে হল–এটাই সমস্যাটার একমাত্র উত্তর। স্যার হিউগো ড্রাক্স বদরাগী একজন প্যারাননাই যাকে এই উন্মত্ত ক্ষমতাই নানা সর্পিল পথে কোটি কোটি পাউন্ড সগ্রহ করতে সাহায্য করেছে। প্যারনোইয়াক বলেই তিনি ইংলন্ডকে উপহার দিতে চলেছেন এই অতিকায় রকেটটা, যেটা নির্মূল করবে আমাদের শত্রুদের। ধন্যবাদ সর্ব শক্তিমান ড্রাক্স-কে।
কিন্তু কে বলতে পারে এই মানুষটার পুরোপুরি পাগল হয়ে যেতে আর কত দেরি, তার সেই তর্জন-গর্জন, তাঁর সেই লালচে চুল-ভরা মুখ ভেদ করে কে জানতে পেরেছে আসল কথাটা? তার মধ্যে কে সেই সব সংকেত চিহ্নগুলোর আসল অর্থ পড়তে পেরেছে-যে গুলো তাঁর নিচ বংশ পরিচয় অথবা যুদ্ধক্ষতগুলোর জন্য প্রকট হয়ে ওঠেনি।
হেসে উঠল বন্ড। কি নিয়ে এরকম নাটুকেপনা সে করছে তার কি ক্ষতি করেছে লোকটা? বলতে গেলে ১৫ হাজার পাউন্ড তাকে তো সে উপহার দিয়েছে। কিন্তু তার সেই শেষ মন্তব্যটার মানে কি? কম্যান্ডার বন্ড, এই টাকাটা খুব চটপট খরচ করে ফেল। কথাগুলো তার মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। বন্ডের মনে হল ওই কথা গুলোর দরুনই হয়ত ড্রাক্সের সমস্যা নিয়ে সে মাথা ঘামাচ্ছে।
চটপট জানালা থেকে সরে এল বন্ড। ভাবল চুলোয় যাক; নিজেই দেখছি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। পনের হাজার পাউন্ড একেবারে কল্পনার বাইরে। বেশ কথা, খুব চটপট সে খরচ করে ফেলবে, ডেস্কের সামনে বসে একটা পেনসিল নিয়ে অতি গোপনীয় লেখা ছোট একটা প্যাডে সাবধানে সে লিখে চলল।
১। রোলস-বেন্টলি কনৃভাটিব–প্রায় ৫০০০ পাউন্ড। ২। তিনটে হারের ক্লিপ, প্রত্যেকটা ২৫০ পাউন্ড–৭৫০ পাউন্ড, সে থামল। তখনো বাকি থাকে প্রায় ১০,০০০ পাউন্ড। কিছু পোশাক, নিজের ফ্ল্যাটটা রঙ করা। একসেট নতুন Henry Gottn বাসন, কয়েক ডজন টিটটিনজার শ্যামপেন। কিন্তু এ গুলো পরে হলেও চলবে। আজ বিকেলেই সে যাবে ক্লিপগুলো কিনতে আর বেন্টলি কোম্পানির সঙ্গে কথা বলতে। বাদবাকি টাকায় সে কিনবে সেরা শেয়ার। প্রচুর টাকা হবে তার। তারপর–রিটায়ার।
যেন রেগে আপত্তি জানিয়ে লাল টেলিফোনটা ঘরের স্তব্ধতা চুরমার করে দিল।
আসতে পার? তোমাকে M-এর দরকার। বড় কর্তার স্বর।
আসছি, হঠাৎ অত্যন্ত সতর্ক হয়ে উঠে বলল বন্ড। কি ব্যাপার?
বড়কর্তা বললেন কোন ধারণাই নেই। এ পর্যন্ত কোন সিগন্যালে উনি হাত ছোঁয়াননি। সারা সকাল ছিলেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আর সরবরাহ দপ্তরে।
টেলিফোনটা সে কেটে দিল।
.
নয়া বন্ডের নতুন কাজ
কয়েক মিনিট পরে সেই পরিচিত দরজা ঠেলে বন্ড ভেতরে গেল। দরজার ওপরকার সবুজ আলোটা জ্বলে উঠল।
তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে M বললেন, চেহারাটা বিশ্রী দেখছি, 007, বস। বন্ড বুঝল এটা কাজের ব্যাপার। দ্রুততর হয়ে উঠল তার নাড়ির স্পন্দন। আজ আর জেমস্ নয়, আজ 007। বন্ড বসল। একটা প্যাডে পেন্সিলে কিছু নোট করা ছিল। M সেটা পড়ছিলেন। তিনি মুখ তুললেন। তাঁর চোখে এখন বন্ড সম্বন্ধে আর কোন কৌতূহল নেই।
তিনি বললেন, গত রাত্রে ড্রাক্সের কারখানায় গণ্ডগোল হয়েছে। জোড়া খুন। পুলিশ ড্রাক্সের সন্ধান করেছিল। ব্লেস্-এর কথা তাদের মাথায় আসেনি। রাত প্রায় দেড়টায় রিজ-এ ফিরলে পুলিশ তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। কারখানার কাজে একটা বার-এ মুনরেকারের দু-জন লোক গুলি খায়। দু-জনেই মারা গেছে। পুলিশকে ড্রাক্স বলেন মরেছে তো তাতে তার কি? তারপর টেলিফোন কেটে দেন। লোকটার যেমন স্বভাব। এখন তিনি সেখানে। শুনলাম ঘটনাটাকে এখন তিনি একটু গুরুত্ব দিচ্ছেন।
চিন্তিতভাবে বন্ড বলল, অদ্ভুত যোগাযোগ। কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের কি সম্পর্ক স্যার? এটা তো পুলিশের কাজ তাই না? M বললেন, আংশিকভাবে, কিন্তু সেখানকার অনেক কর্মচারির জন্য আমরা দায়ী যারা গুরুত্বপূর্ণ পদে আছে। তারা জার্মান। প্যাডের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ব্যাপারটা খোলসা করে বলি। এটা রাষ্ট্রীয় বিমান বাহিনীর প্রতিষ্ঠান। পূর্ব উপকূল জুড়ে যে বিরাট রেডার ব্যবস্থা রয়েছে এটা তার একটা অংশ। সেখানকার সীমানা পাহারা দেবার দায়িত্ব বিমান বাহিনীর। শুধু কারখানার ওপর সরবরাহ দপ্তরের আধিপত্য। সেখানেই কাজ চলছে। ডোভার আর ডীল-এর মাঝখানকার খাড়া পাহাড়গুলোর কিনারে জায়গাটা; পুরো জায়গাটা হাজার একরের। কিন্তু কারখানাটা প্রায় দুশ একর জুড়ে। সেই কারখানায় এখন আছেন শুধু ড্রাক্স আর বাহান্ন জন কর্মচারি। কনস্ট্রাকশন টিমের আর সবাই চলে গেছে।
বন্ডের মনে হোল? এক প্যাকেট তাস আর একটা জোকার। M বলে চললেন, তাদের মধ্যে পঞ্চাশ জন জার্মান। এরা মোটামুটি সেই সব ক্ষেপণাস্ত্র-বিশেষজ্ঞ-রুশীরা যাদের যুদ্ধের শেষে চুরি করে নিয়ে যেতে পারেনি। তাদের এখানে আসার আর মুনরেকারে কাজ করার সব খরচ দিয়েছেন ড্রাক্স। এই ব্যবস্থায় কেউই খুব খুশি হয়নি। কিন্তু অন্য কোন উপায় ছিল না। সরবরাহ দপ্তর তাদের কোন বিশেষজ্ঞকে দিতে পারেনি। যেখান থেকে পেরেছেন ড্রাক্স তাদের জোগাড় করেছেন। বিমান বাহিনীর নিরাপত্তা দলকে জোরদার করার জন্য সরবরাহ-সচিব নিয়োগ করেছিলেন নিজেদের একজন সিকিউরিটি অফিসার। কারখানায় সে থাকত। নাম মেজর ট্যালন। খানিক থেমে M ছাদের দিকে তাকালেন। গত রাত্রে যে দুজন খুন হয়েছে, মেজর ট্যালন তাদের একজন। তাকে গুলি করে এক জার্মান। তারপর নিজের ওপর সে গুলি চালায়। চোখ নামিয়ে বন্ডের দিকে তাকালেন M। বন্ড কোন কথা বলল না। বাকি কাহিনীটা শোনার জন্য অপেক্ষা করে রইল। ঘটনাটা ঘটে কারখানার কাছের একটা বার-এ। বারটা কারখানার কিনারে। সেখানে সেই লোকেদের যাবার অনুমতি ছিল। M থামলেন। তারপর বন্ডের দিকে তাকিয়ে বলে চললেন, তুমি প্রশ্ন করেছিলেএর সঙ্গে আমাদের কি সম্পর্ক? সম্পর্ক এই, যে জার্মানটি মারা গেছে তার এবং অন্য সব জার্মানদের এখানে আসার অনুমতি আমরা দিয়েছিলাম। তাদের সবাইকার দলিলপত্র বিমান বাহিনীর সিকিউরিটি অফিস এবং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড প্রথমেই মৃত জার্মানের ফাইলটা চেয়ে পাঠায়। গত রাত্রে ডিউটি অফিসারের কাছে তারা যায়। রেকর্ডস থেকে ডিউটি অফিসার কাগজপত্রগুলো খুঁজে বার করে পাঠায় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে। রুটিন কাজ। লগ-বুকে সেটা সে লিখে রাখে। আজ সকালে সেখানে গিয়ে লগ-বুকে লেখাটা দেখে হঠাৎ আমি কৌতূহলী হয়ে পড়ি। তারপর শান্ত গলায় বললেন M, ড্রাক্সের সঙ্গে সন্ধ্যেটা কাটাবার পর, তুমি যা মন্তব্য করেছিলে তাই মনে হল যোগাযোগটা অদ্ভুত।
খুবই অদ্ভুত স্যার, বলল বন্ড। আরও শোনবার জন্য অপেক্ষা করে রইল সে। M বলে চললেন আর একটা ব্যাপার। ব্যাপারটা থেকে হাত মুছে না ফেলে নিজেকে যে জড়িয়ে ফেলেছি–সেটাই তার আসল কারণ। সব কাজ ফেলে আগে এটা করতে হবে। M এর স্বর অত্যন্ত শান্ত হয়ে উঠল। শুক্রবার ওদের মুনরেকার ছোড়বার কথা। আর চারদিনও নেই প্র্যাকটিস করার জন্য এই ছোঁড়া।
চুপ করে পাইপটা তুলে M ধরাতে শুরু করলেন। বন্ড কোন কথা বলল না। তখনও সে বুঝতে পারল না এর সঙ্গে গুপ্তচর দপ্তরের কি সম্পর্ক, যার কাজের এলাকা ইংল্যান্ডের বাইরে। তার মনে হল, এটা তো স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের স্পেশ্যাল ব্র্যাঞ্চ কিংবা MI-এর কাজ। অপেক্ষা করতে করতে নিজের ঘড়ির দিকে তাকাল সে। এখন দুপুর।
পাইপ ধরিয়ে M বলে চললেন। কিন্তু এসব ছাড়াও আমার কৌতূহলের কারণ, গতরাতে ড্রাক্সকে দেখে আমার কৌতূহল হয়েছে। বন্ড বলল, আমারও হয়েছে স্যার। বন্ডের মন্তব্যে কান না দিয়ে M বলে চললেন, তাই লগ-বইটা পড়ে ইয়ার্ডের বড় সাহেব ভ্যালন্সকে টেলিফোন করে পুরো ব্যাপারটা আমি জানতে চাই। ভ্যালন্স বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছিল। আমাকে সে আসতে বলে। আমি বলি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কাজের মধ্যে নাক গলাতে চাই না। কিন্তু সে বলে ইতিমধ্যেই কর্তৃপক্ষকে কথাটা জানিয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলে ব্যাপারটা পুলিশ আর আমার বিভাগের সঙ্গে জড়িত। কারণ যে জার্মান খুন করে, তার কাগজ পত্র ঠিক আছে বলে আমার অফিসে জানিয়েছিল। তাই সেখানে আমি যাই। থেমে M তাঁর নোটের দিকে তাকালেন। তিনি বললেন, জায়গাটা সমুদ্রের তীরে, ডোভার থেকে প্রায় তিন মাইল উত্তরে। এই বার-টা সমুদ্রতীরের প্রধান রাস্তাটার কাছে, যেটার নাম ওয়ার্লড উইদাউট ওয়ান্ট (অভাবশূন্য জগৎ)। সন্ধ্যেয় কারখানার লোকেরা সেখানে যায়। গত সন্ধ্যেয় কারখানার লোকেরা সেখানে যায়। গত সন্ধ্যেয় প্রায় সাড়ে সাতটায় ট্যালন নামে মিনিস্ট্রির সেই সিকিউরিটি অফিসার সেখানে গিয়ে একটা হুইস্কি আর সোডা খেতে খেতে কয়েকজন জার্মানের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল। এমন সময় সেই খুনে-লোকটাকে, তাই যদি বলতে চাও–সেখানে গিয়ে সোজা চলে যায় ট্যালনের কাছে। শার্টের ভেতর থেকে সে একটা লুগার পিস্তল বার করে–ভাল কথা, সেটায় কোন সিরিয়াল নম্বর ছিল না–তারপর বলে গালা ব্র্যান্ডকে আমি ভালবাসি। তুমি তাকে পাবে না। তারপর ট্যালনের বুকে গুলি করে ধোয়া-বেরুনো বন্ধুকের নলটা নিজের মুখে পুরো ট্রিগার টানে। কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার, বলল বন্ড। কল্পনায় সে দেখতে পেল, সেই বার-এর নাচ ঘরে লোকেদের হুড়োহুড়ি করার প্রতিটি খুঁটিনাটি ঘটনা। মেয়েটি কে?
M বললেন, সেটাও আর একটা দুর্বোধ্য ব্যাপার। মেয়েটি স্পেশ্যাল ব্র্যাঞ্চের একজন এজেন্ট, জার্মান জানে। ভ্যালান্সের অফিসের সবচেয়ে ভাল মেয়ে এজেন্টদের একজন। কারখানায় ড্রাক্সের কাছে যারা ছিল তাদের মধ্যে গালা ব্র্যান্ড আর ট্যালন ছাড়া সবাই জার্মান। ভ্যালন্স সন্দিগ্ধ প্রকৃতির লোক। সেটাই দরকার। ইংল্যান্ডের মধ্যে এই মুনরেকার প্ল্যানটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কাউকে কিছু না বলে, মোটামুটি নিজের সহজাত ধারণার ওপর নির্ভর করে নানা কৌশলে ড্রাক্সকে সে রাজি করায় গালা ব্র্যান্ডকে তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি করে নিতে। গোড়া থেকেই ব্র্যান্ড সেখানে আছে। এ পর্যন্ত রিপোর্ট করার মত কিছুই সে পায়নি। তার সঙ্গে দ্র ব্যবহারের কথা বাদ দিলে মনিব হিসেবে ড্রাক্স খুবই ভাল। কর্মচারিদের দারুণ খাটায় সে। যথারীতি ব্র্যান্ড বলেছিল, একজনের সঙ্গে সে বাগদত্তা। তার সত্ত্বেও গোড়ার দিকে তার সঙ্গে ট্যালন প্রেম করার চেষ্টা করে। কিন্তু যখন সে দেখে ব্র্যান্ড আত্মরক্ষা করতে সমর্থ, তখন থেকে তাকে আর সে জ্বালাতন করেনি। ব্র্যান্ড বলে, এখন তারা খুব ভাল বন্ধু। ট্যালনকে অবশ্য ব্র্যান্ড আগে থেকেই চিনত। কিন্তু ট্যালন তার বাবার বয়সী। তাছাড়া তার বিবাহিত জীবন সুখের, ছেলেমেয়ে চারটি। ভ্যালান্সের লোক আজ সকালে ব্র্যান্ডের সঙ্গে দেখা করে। তাকে ব্র্যান্ড বলেছে, গত আঠার মাসের মধ্যে মাত্র দু-বার ট্যালন তাকে সিনেমায় নিয়ে গিয়েছিল–বাপ যেভাবে নিজে মেয়েকে নিয়ে যায়। যে-লোকটা খুন করেছে, তার নাম এগ বারস। ইলেক্ট্রনিক্সের ব্যাপারে লোকটা এক্সপার্ট। বলতে গেলে ব্র্যান্ড তাকে দেখেইনি।
বন্ড প্রশ্ন করল, এ-বিষয়ে বারস-এর বন্ধুরা কি বলে? যে লোকটা বারস-এর সঙ্গে এক ঘরে থাকত সে বারৎস এর কথাতেই সায় দিয়েছে বলে। ব্র্যান্ডকে বারস পাগলের মত ভালবাসত বারৎস নাকি বলত ঐ ইংলিশ ম্যানটার জন্যই প্রেমের ব্যাপারে সে সফল হতে পারেনি। বলে সম্প্রতি বারৎস্ খুব মনমরা আর গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। এই গুলি করার কথা শুনে মোটেই সে অবাক হয়নি।
বন্ড বলল, সব শুনে ব্যাপারটা সত্যি বলেই মনে হচ্ছে। এটা কল্পনা করতে অসুবিধে হয় না! অভিমানী আর নার্ভাস গোছের এক ছোকরা, মাথায় যার জার্মানদের গো। ভ্যাগলান্সের কি ধারণা?
M বললেন, সে পুরোপুরি নিঃসন্দেহ নয়। খবরের কাগজওয়ালাদের হাত থেকে মেয়েটিকে বাঁচানোই এখন তার প্রধান ভাবনা। আর দেখা মেয়েটির আসল পরিচয় যাতে ফাঁস হয়ে না যায়। সব কাগজই খবরটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দুপুরের এডিশনে সব কাগজে খবরটা ছাপা হবে। মেয়েটির ছবির জন্য সবাই হন্যে হয়ে উঠেছে। মোটামুটি তার মত দেখতে একটি মেয়েকে ভ্যালান্স জোগাড় করেছে। সেই মেয়েটির ছবি আজ সন্ধ্যেয় দেওয়া হবে। ভালোর মধ্যে কোন রিপোর্টারই সেই কারখানার কাছে যেতে পাচ্ছে না। ভ্যালান্স মনে মনে প্রার্থনা করছে জাল মেয়েটির কথা তার কোন আত্মীয় বা বন্ধু যেন ফাঁস করে দিতে না পারে। আজকে করোনারের বিচার হবে। ভ্যালান্স, আশা করছে। আজ সন্ধ্যের মধ্যে এই কেসটা সরকারিভাবে চুকিয়ে দেওয়া হবে। উপযুক্ত তথ্যের অভাবে খবরের কাগজগুলোও ব্যাপারটা নিয়ে আর হৈ-চৈ করতে পারবে না।
বড় প্রশ্ন করল মুনরেকারের প্র্যাকটিস ছোঁড়া কবে হবে?
M বললেন আগে যা ঠিক ছিল তাই, শুক্রবার দুপুর। ট্যাঙ্কের তিন ভাগে জ্বালানী ভরে, নকল বোমা দিয়ে সেটা ছোঁড়া হবে খাড়া ওপর দিকে। ল্যাটিচিউড ৫২ থেকে উত্তর সাগরের একশ বর্গ মাইল জায়গা ফাঁকা করে ফেলা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাতে প্রধানমন্ত্রী পুরো খবরটা জানাবেন।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাবার জন্য M তার চেয়ারে ঘুরলেন। দূরে একটা ঘড়ির শব্দ শুনতে পেল বন্ড। দুপুরে একটা। আজকেও কি তার লাঞ্চ খাওয়া বাদ যাবে? অন্য ডিপার্টমেন্টের কাজ নিয়ে M মাথা না ঘামালে চটপট লাঞ্চ সেরে সে যেতে পারত বেন্টলি কোম্পানিতে। বন্ড তার চেয়ারে নড়েচড়ে উঠল। M আবার চেয়ার ঘুরিয়ে বন্ডের মুখোমুখি হলেন। বললেন, সবচেয়ে ভাল কর্মচারিদের একজন, এ পর্যন্ত কোন রিপোটেই সন্দেহজনক কিছু সে জানায়নি। তারপর হঠাৎ গতকাল বিকেলে এ্যাসিস্ট্যান্ট আন্ডার সেক্রেটারিকে ফোনে সে জানায় কারখানায় কিছু কিছু। সন্দেহ জনক ব্যাপারের হদিস সে পেয়েছে। বলে আজ সকাল দশটায় নিজে সে মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবে। টেলিফোনে আর কোন কথা বলতে সে রাজি হয়নি। টেলিফোন করার কয়েক ঘণ্টা পরেই তাকে গুলি করে খুন করা হয়। এটাও একটা আশ্চর্য যোগাযোগ-তাই-না? বন্ড বলল, খুবই আশ্চর্য, কিন্তু সরকার কেন কারখানাটা বন্ধ করে পুরোপুরি তদন্তের ব্যবস্থা করছে না। ব্যাপারটা দারুণ গুরুত্বপূর্ণ, কোন রকম চান্স নেওয়া উচিন নয়। M বললেন আজ খুব ভোরে ক্যাবিনেট মিটিং হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন করেন মুনরেকার-কে স্যাবোটাজ করার প্রচেষ্টার কি প্রমাণ আছে? কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে কোন প্রমাণ নেই, কোন উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু ট্যালনের ভাসা-ভাসা খবর আর খুনের ব্যাপারে সবাই কেমন যেন ভয় পেয়ে গেছে। এ-বিষয়ে সবাই এক মত যে, কোন রকম প্রমাণ না পেলে ধরে নিতে হবে এই সব ঘটনার আসল কারণ হচ্ছে কারখানার মধ্যে নিদারুণ কাজের চাপ। পৃথিবীর সর্বত্র এখন একটা ঘোরালো অবস্থা। তাই যত তাড়াতাড়ি মুনরেকার আমাদের ভরসা দেয়, তত ভাল। শুধু আমাদের নয় সমস্ত পৃথিবীর পক্ষে মুনরেকার ছোঁড়ার স্বপক্ষে হাজার যুক্তি আছে, বিপক্ষে একটাও যুক্তি নেই। কথাটা সাপ্লাই মিনিস্টারকে মেনে নিতে হবে। কিন্তু আমরা সবাই জানি, প্র্যাকটিস ছোঁড়ার ঠিক আগে মুনরেকার-কে ধ্বংস করতে পারা রুশীদের পক্ষে মস্ত বড় একটা জিত। ভাল করে স্যাবোটাজ করতে পারলে পুরো পরিকল্পনাটাই বানচাল হয়ে যেতে পারে। মুনরেকার নিয়ে পঞ্চাশ জন জার্মান কাজ করছে। তাদের মধ্যে যে কোন একজনের কোন নিকট আত্মীয় হয়ত রাশিয়াতে এখন বন্দী আছে, যাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে রুণীরা নিজেদের নানা উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে। চুপ করে, M ছাদের দিকে তাকালেন। তারপর চোখ রাখলেন বন্ডের চোখে। ক্যাবিনেট মিটিং-এর পর মন্ত্রী আমাকে বলেছেন, তার সঙ্গে দেখা করতে, ট্যালনের জায়গায় এখনই কাউকে তিনি পাঠাতে চান। এই নতুন লোকের জার্মান ভাষা জানা দরকার। স্যাবোইাজের কাজ আর রুশীদের সম্বন্ধে প্রচুর অভিজ্ঞতা থাকাও তার দরকার। M, তিনজন লোকের নাম দিয়েছে। তারা সবাই এখন নানা কাজে ব্যস্ত-বেশ কয়েক দিনের আগে তাদের কারুরই ছুটি নেই। মন্ত্রী আমার মতামত জানতে চেয়েছিলেন। সেটা আমি জানিয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি আলোচনা করেছেন।
খানিকটা বিরক্ত হয়েই বন্ড তাকাল M এর নিষ্করুণ ধূসর চোখের দিকে। নিরুত্তাপ গলায় M বললেন, এই নতুন পদে তোমাকে বহাল করার খবর স্যার হিউগো ড্রাক্সকে জানান হয়েছে। তিনি আশা করেন আজ রাতে তার সঙ্গে তুমি যোগ দেবে।
.
স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের এজেন্ট
মে মাসের শেষ। মঙ্গলবার সন্ধ্যে ছটা। সোজা ডোভার রোড ধরে দারুণ জোরে বন্ডের বিরাট বেন্টলি ছুটছে। রাস্তাটা মেড় স্টোনে।
একাগ্র হয়ে জোরে গাড়ি ছোটালেও বন্ডের মনের একাংশ জুড়ে ছিল গত সাড়ে-চার ঘণ্টা আগে M-এর অফিস থেকে বেরুবার পরের নানা ঘটনার কথা।
সেক্রেটারিকে তার কাজের কথা সংক্ষেপে জানিয়ে অফিস-ক্যান্টিনে একলা সে চটপট লাঞ্চ শেষ করে। তারপর গ্যারেজে টেলিফোন করে বলে, বিকেল ঠিক সাড়ে চারটায় ট্যাঙ্কে পুরো তেল ভরে গাড়িটা যেন তার ফ্ল্যাটে পায়। তারপর ট্যাক্সি নিয়ে ছোট স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে। পৌনে তিনটের সময় সেখানে এ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার ভ্যালান্সের সঙ্গে তার এ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল।
এক শান্ত চেহারার মাঝ বয়সী মহিলা এসে তাকে জানায় এ্যাসিসস্ট্যান্ট কমিশনার পাঁচ মিনিট পরে দেখা করবেন। মহিলার চোখের দৃষ্টি নিরুৎসাহ ধরনের মনে হয়। পৃথিবীতে যা-কিছু দেখার তিনি দেখেছেন।
কিছুক্ষণ পরে সেই মহিলাই আসেন তাকে ডাকতে। গভর্নমেন্ট ডিপার্টমেন্টের সব ওয়েটিং-রুমেই অ্যাশট্রের বদলে থাকে খালি প্লেয়ার্স সিগারেটের টিন। সেই রকম একটা টিনের ঢাকনিতে সিগারেটটা টিপে নিভিয়ে করিডোর দিয়ে মহিলাটির পিছনে পিছনে বন্ড যায়।
সেই অন্ধকার মত ওয়েটিং-রুমের পর আলোয় ঝলমলে বড় ঘর আর সেখানকার ফায়ারপ্লেসে বছরের এই অসময়ে আগুন জ্বলতে দেখে বন্ডের মনে হয়, সবটাই কেমন যেন একটা ছলাকলা।
নিজের মনমরা ভাবটা কাটিয়ে উঠতে বন্ডের লাগে পুরো পাঁচ মিনিট। তারপর সে বুঝতে পারে রনি ভ্যাগল্যান্স তাকে দেখে সত্যিই হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন। বোঝে আন্তর্বিভাগীয় রেষারেষির ব্যাপারে তার কোন রকম উৎসাহ নেই। তিনি শুধু চান মুনরেকার আর তার নিজের সবচেয়ে ভাল অফিসারদের নিরাপত্তা।
ভ্যাগলান্স খুব বিচক্ষণ মানুষ। প্রথম কয়েক মিনিট তিনি শুধু বলেন, M-এর কথা। ভেতরকার অনেক খবর তার জানা। কথাগুলো তার খুব আন্তরিক। কেসটার কথা উল্লেখ করার আগেই বন্ডের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা তিনি লাভ করেন।
পনের মিনিট ধরে গভীর আলোচনার পর বন্ড যখন চলে আসে তখন দুজনেই অনুভব করে সে ভাল করেছে, একজন ভাল সুহৃদ। ভ্যাগলা বুঝতে পেরেছিলেন ব্র্যান্ডকে বন্ড যথাসাধ্য সাহায্যে করবে।
কাজের দায়িত্ব পেশাদারীভাবে গ্রহণ করায় এবং স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের প্রতি রেষারেষির ভাব না দেখানোয় বন্ডের প্রতি তার শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। ভ্যাগলান্সের এজেন্টের সব কথা শুনে বন্ড মনে মনে খুব তারিফ করে। তার মনে হয় সে আর একলা নয়। বুঝতে পারে ভ্যাগলান্সের গোটা ডিপার্টমেন্ট তার পিছনে রয়েছে।
মিনিস্ট্রি অফ সাপ্লাই-তে এই কেস সম্বন্ধে নতুন কোন তথ্য সে পায়নি। ট্যালনের রেকর্ড এবং তার লেখা সব রিপোর্ট বন্ড খুঁটিয়ে পড়ে। তার রেকর্ড পড়ে বন্ড জানতে পারে মানুষটা ছিল খুব সৎ-আজীবন কাজ করেছে সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ এবং ফিল্ড সিকিউরিটিতে। তার রিপোর্টগুলোয় ছিল এক কর্মমুখর ও সুপরিচালিত প্রতিষ্ঠানের ছবি, দু-একটা মাতলামির ঘটনা। একটা ছিঁচকে চুরি এবং ব্যক্তি গত শত্রুতার ফলে গোটা কয়েক মারামারি ও সামান্য রক্তপাতের কথা। এইসব টুকিটাকি ঘটনার কথা বাদ দিলে বলা যায় পুরো দলটাই অত্যন্ত কর্তব্যনিষ্ঠ এবং খুব পরিশ্রমী। তারপর বন্ড আধঘণ্টা কাটায় মিনিস্ট্রির অপারেশনস রুমে প্রফেসর ট্রেনের সঙ্গে। মানুষটা মোটাসোটা, সাদাসিধে চেহারায়। গত বছর অনেকে ভেবেছিল ফিজিক্সে তিনি নোবেল প্রাইজ পাবেন। Guidedmissiles (নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র) সম্বন্ধে সবচেয়ে নাম করা এক্সপার্টদের মধ্যে তিনি একজন।
প্রফেসর ট্রেন সারি সারি বিরাট আকারের দেওয়াল মানচিত্র-গুলোর কাছে গিয়ে একটার দড়ি ধরে টানেন। মস্ত বড় একটা নকশা বেরিয়ে আসে। সেটাকে দেখতে অনেকটা v,-র মত। ডানা দুটো তার বিরাট। প্রফেসর ট্রেন বলেন, রকেট সম্বন্ধে তুমি কিছুই জান না। তাই সহজ করে বলছি। Nozzle Expansion Ratios, Exhaust Velocity, Raplerian Ellipse ইত্যাদি নানা শক্ত শক্ত কথা আমি ব্যবহার করব না। ড্রাক্স এটার নাম দিয়েছেন মুনরেকার। এটা সিঙ্গল-স্টেজ রকেট। আকাশে সোঁ করে ওঠার সময় এটার সমস্ত জ্বালানী খরচ হয়ে যায়। তারপর ছুটতে থাকে লক্ষ্য বস্তুর দিকে। V, রকেটের গতিপথ হল কামান থেকে ছোঁড়া গোলার মত। সেটা যেতে পারত ২০০ মাইল, ২০০ মাইলের শেষে সেটা উঠতে ৭০ মাইল ওপরে। তার জ্বালানি ছিল এ্যালকোহল আর তরল অক্সিজেন মেশান। সেটা খুব সহজেই জ্বলে ওঠে। তাই সেটায় পানি মেশানো হত, যাতে সেটার তাপে কোমল ইস্পাত গলে না যায়। সেটার ইঞ্জিন এই কোমল ইস্পাত দিয়ে বানানো হত। আরও অনেক শক্তিশালী জ্বালানী পাওয়া যায়। কিন্তু এ-পর্যন্ত সেই সব জ্বালানি নিয়ে একই কারণে আমরা বেশি দূর এগুতে পারিনি। সেগুলোর দহনের মাত্রা এমন বেশি যে সবচেয়ে শক্ত ইঞ্জিনকেও গলিয়ে দিতে পারে। প্রফেসর থেমে বন্ডের বুকে একটা আঙুল দিয়ে বলেন এই রকেট সম্বন্ধে শুধু এই কথাটা মনে রেখ, ড্রাক্সের কোলাম বাইটের জন্য আমরা অনেক বেশি দাহ্য জ্বালানি ব্যবহার করব। যেটা মুনরেকারের ইঞ্জিন গলিয়ে ফেলতে পারবে না। কোলাবাইট গলে ৩৫০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে। যে-ইস্পাত দিয়ে V2-র ইঞ্জিন তৈরি হত সেটা গলে ১৩০০-তে। আমরা ব্যবহার করছি ফুরিন আর হাইড্রোজেন মেশানো জ্বালানি।
তাই নাকি? স-সম্ভ্রমে বলে ওঠে বন্ড।
তার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রফেসর বলে যান, অতএব আশা করছি ঘণ্টায় প্রায় ১৫০০ মাইল স্পিডে পৌঁছাতে পারব, খাড়া উঠতে পারব প্রায় ১০০০ মাইল। ফলে ৪০০০ মাইল এলাকা জুড়ে মুনরেকার কাজ করতে পারবে। ইংল্যান্ডের নাগালের মধ্যে থাকবে ইউরোপের প্রতিটি রাজধানী, এটা নীরস গলায় তিনি যোগ করে দেন। কতকগুলো বিশেষ অবস্থায় খুব সুবিধের। কিন্তু বৈজ্ঞানিকদের কাছে এটার প্রধান গুরুত্ব-মহাশূন্যে পাড়ি দেবার এটা প্রথম পদক্ষেপ-কোন প্রশ্ন আছে।
কি করে এটা কাজ করে? কর্তব্যবোধে প্রশ্ন করে বন্ড। নক্শাটার দিকে আঙুল তুলে প্রফেসর বলতে থাকেন, এটার গোড়া থেকে শুরু করা যাক। প্রথমেই আসে ওয়ার হেডের (warhead) কথা। এই প্র্যাকটিস ছোঁড়ার সময় ডগায় থাকবে ওপরকার আবহাওয়া পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি, রেডার ইত্যাদি। তারপর জাইরো কম্পাস, যাতে সোজা এটা উড়তে পারে, তারপর নানা ছোট খাট যন্ত্রপাতি, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা, তারপর বিরাট জ্বালানির ট্যাঙ্কটায় ৩০,০০০ পাউন্ডের জ্বালানি থাকবে।
মনুরেকারের পেছন দিয়ে টারবাইন চালাবার জন্য আছে দুটো ট্যাঙ্ক। চারশ পাউন্ড হাইড্রোজেন পেরোক্সাইড চল্লিশ। পাউন্ড পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেটের সঙ্গে মিশে বাষ্প তৈরি হবে। সেই বাষ্প নিচেকার টারবাইনগুলো চালাবে। টারবাইনগুলো চালাবে কতকগুলো সেন্ট্রিফুগাল পাম্প। সেই পাম্পগুলো দারুণ চাপ দিয়ে প্রধান জ্বালানিকে ঠেলে দেবে রকেটের মোটরে। বুঝলে, সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকান তিনি বন্ডের দিকে।
বন্ড বলল, মনে হচ্ছে জেটপ্লেনের মত একই পদ্ধতি। মনে হল প্রফেসর খুশি হলেন। তিনি বলে যান, মোটামুটি তাই। কিন্তু রকেটের মধ্যেই থাকে সমস্ত জ্বালানিটা, বাইরে থেকে অক্সিজেন শুষে নেয় না, কমেট যেমন নেয়। মোটরের মধ্যে জ্বালানিটা জ্বলে উঠবে। তারপর প্রবল বেগে রকেটের পেছন দিকে দিয়ে বেরিয়ে যেতে থাকবে। অনেকটা ক্রমাগত বন্দুকের রিকয়লের (পেছন-ধাক্কা) মত। এই ব্লাস্ট। আতসবাজির মত রকেটকে ঠেলে তুলবে। ওপরে। বন্ড প্রশ্ন করে, যেখানে চান ঠিক সেখানে এটা পড়বে বলে কি করে আপনারা নিশ্চিত হচ্ছেন? আগামী শুক্রবার প্যারিসে গিয়ে পড়তে এটার বাধা কি?
সেটা জাইয়োগুলোর কাজ। আসলে কিন্তু শুক্রবার আমরা কোন রকম ঝুঁকি নিচ্ছি না। সমুদ্রের মাঝখানে একটা ভেলায় আমরা একটা রাডার যন্ত্র রাখছি। রকেটের ডগায় থাকবে একটা রাডার ট্রান্সমিটার। সমুদ্রের যন্ত্রের প্রতিধ্বনি। সেটা তুলে নিয়ে আপনা থেকেই রকেটটাকে নিয়ে যাবে লক্ষ্যবস্তুর দিকে। তারপর প্রফেসর হেসে বলেন, যুদ্ধের সময় এটাকে কখনো ব্যবহার করতে হলে মস্কো কিংবা ওয়ারশ কিংবা প্রাগ কিংবা মন্টি করেলো কিংবা যেখানে আমরা ছুঁড়ছি সেই শহরের মাঝখানে যদি কোন সংকেত প্রেরণ করার যন্ত্র থাকে তাহলে খুব সুবিধে হয়। সম্ভবত তোমাদের মত কাউকে সেখানে যন্ত্রটা বসিয়ে আসতে হবে। গুডলাক। বন্ড হেসে বলে, আর একটা প্রশ্ন। রকেটটাকে ভণ্ডুল করতে চাইলে সবচেয়ে সহজ উপায় কি? প্রফেসরও হেসে উত্তর দেন, বহু উপায় আছে। জ্বালানির মধ্যে বালি, পাম্পের মধ্যে পাথরকুচি, ডানায় কিংবা ফিউসলেজে ছোট একটা ফুটো। ও-রকম সাংঘাতিক শক্তি আর স্পিডের মধ্যে এতটুকু খুঁত থাকলেই রকেটটা খতম হয়ে যাবে।
বন্ড বলে, অনেক ধন্যবাদ। মনে হচ্ছে মুনরেকার সম্বন্ধে আমার চেয়ে আপনার দুর্ভাবনা অনেক কম। প্রফেসর বলেন, মেশিনটা আশ্চর্য। কেউ বাগড়া না দিলে নির্ভুল হিসেবে ওটা উড়বে। ড্রাক্স নিখুঁত কাজ করেছেন। অদ্ভুত ভাল। কর্মী। যে দলটা তিনি জোগাড় করেছেন সেটা ব্রিলিয়ান্ট। ড্রাক্সের জন্য সব কিছু করতে তারা প্রস্তুত। বহু কারণেই আমাদের ধন্যবাদ তার প্রাপ্য। চেয়ারিং-এর মুখে বন্ড তার বিরাট গাড়িটাকে বাঁ দিকে নিয়ে গেল। অ্যাশফোর্ড আর। ফোক্ স্টেশনে বেজায় ভিড়। সে ভাবতে লাগল ড্রাক্সের কথা। আজ সন্ধ্যেয় কি রকম অভ্যর্থনা সে পাবে? M বলেছিলেন, টেলিফোনে তাঁর কাছ থেকে বন্ডের নাম শুনে মুহূর্তের জন্য চুপ করে থেকে ড্রাক্স বলেন, ছোকরাকে আমি জানি। জানতাম না পুলিশ দপ্তরের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে। আর একবার তাকে দেখতে চাই। তাকে পাঠিও। ডিনারে। তাকে আশা করব। তারপর তিনি টেলিফোন কেটে দেন।
ড্রাক্স সম্বন্ধে মিনিস্ট্রির লোকেদের একটা নিজস্ব ধারণা আছে। ড্রাক্সের সংস্পর্শে এসে তারা লক্ষ্য করে যে, একটা পবিত্র উদ্দেশ্যের জন্য নিজেকে তিনি উৎসর্গ করে দিয়েছেন। মুনরেকারের সাফল্যই তার জীবনের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। কর্মচারিদের তিনি দারুণ খাটান। তার প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র যাতে অগ্রাধিকার পায়, যাতে সেগুলো ক্যাবিনেট পর্যায়ে খালাস করে দেওয়া হয়, তার জন্য তিনি মিনিস্ট্রি অফ সাপ্লাইকে তিতিবিরক্ত করে ছাড়েন। তর্জন-গর্জন করে তার কর্তৃত্ব। জাহির করার ভাবটাকে তারা পছন্দ করতে না। কিন্তু তারা তাঁকে শ্রদ্ধা করে, তার টেকনিক্যাল জ্ঞান, তার কর্মোদ্যম। এবং তার আত্মোৎসর্গ ভাবের জন্য। ইংল্যান্ডের আর সবাইকার মত তারাও মনে করে ড্রাক্স দেশের ত্রাণকর্তা।
চিলহাম কাসল ছাড়িয়ে সোজা পথে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে বন্ড ভাবতে লাগল, মানুষটার সঙ্গে কাজ করতে হলে তাঁর চরিত্রের বীরত্বপূর্ণ দিকটা তাকে মেনে নিতে হবে। ড্রাক্স চাইলে ব্লেড়স-এর ঘটনার কথা মন থেকে একেবারে মুছে ফেলে ড্রাক্স এবং মুনরেকার কে দেশের শত্রুদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা সে করবে। মাত্র আর তিন দিন বাকি। ইতিমধ্যেই নিরাপত্তামূলক সবরকম ব্যবস্থা করা হয়েছে। আরও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে চাইলে ড্রাক্স সম্ভবত আপত্তি করবেন। কাজটা সহজ নয়, খুব বিচক্ষণতার দরকার। ক্যান্টারবেরি থেকে বেরিয়ে শর্টকাট করার জন্য ওল্ড ডোভার রোড ধরে বন্ড তার ঘড়ির দিকে তাকাল। সাড়ে ছটা। ডোভার পৌঁছতে আর পনের মিনিট। তারও দশ মিনিট পরে ডীল রোড। আর কোন প্ল্যান করা কি দরকার? সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, জোড়া-খুনের তদন্তের ভার তার ওপর পড়েনি। করোনারের রায় অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় হত্যা এবং আত্মহত্যা এমনকি মেয়েটিকে কোর্টে আনাও হয়নি। ওয়ার্লর্ড উইদাউট ওয়ান্ট-এ একটা ড্রিঙ্কের জন্য সে থামবে। সরাইখানার মালিকের সঙ্গে চটপট সেরে নেবে কয়েকটা কথা। যে সন্দেহজনক ব্যাপারের জন্য মন্ত্রীর সঙ্গে ট্যালন দেখা করতে চেয়েছিল পরের দিন, সেটা আবিষ্কার করার চেষ্টা তাকে করতে হবে। ট্যালনের ঘরে কিছুই পাওয়া যায়নি। সম্ভবত সে-ঘরেই তাকে থাকতে হবে। তাতে অন্তত ট্যালনের কাগজপত্র দেখার প্রচুর অবসর পাবে সে। ডোভারের উপকূল দিয়ে যাবার সময় একাগ্র হয়ে সে ড্রাইভ করতে লাগল। বাঁ দিক ঘেঁষে যেতে লাগল সে। অল্পক্ষণের মধ্যে শহর পেরিয়ে আবার চড়াই পথ ধরল। সেই অদ্ভুত সুন্দর দুৰ্গটার পাশ দিয়ে গেল, সেটা দেখলে মনে হয় যেন পিচবোর্ড দিয়ে বানানো। মেয়েটি কেমন? এমনভাবে সাবধানে মেয়েটির সঙ্গে তাকে আলাপ করতে হবে যাতে সে না ঘাবড়ে যায়। মেয়েটি তার কোন কাজে লাগবে কিনা কে জানে। বড় কর্তার প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে এক বছর ধরে কারখানায় সে রয়েছে। অতএব, পুরো পরিকল্পনাটার সব রকম খুঁটিনাটি অর্থ জানার সুযোগ পেয়েছে সে, সুযোগ পেয়েছে ভ্রাক্সকে ভাল করে চেনবার। নিজের বিশেষ ধরনের কাজ করার ট্রেনিং-ও তার আছে। তার কাজে নতুন কাউকে নাক গলাতে দেখলে হয়ত মেয়েটি প্রথমটায় চটেই উঠবে। তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে বন্ডকে। তাকে আসলে দেখতে কেমন, বন্ড ভাবল। ইয়ার্ডের রেকর্ড বইতে যে ফটো আছে সেটা দেখে মনে হয় মেয়েটি সুন্দরী হলেও খানিকটা গুরুগম্ভীর ধরনের। তার চেহারার মধ্যেকার সম্মোহনী ভাবের আভাস মেয়ে-পুলিশের রসকষবিহীন ইউনিফর্মের নিচে একেবারে চাপা পড়ে গেছে। চুল সোনালি। চোখ : নীল। উচ্চতা ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি। ওজন : ৯ স্টোন। নিতম্ব : ৩৮। কোমর ও ২৬। বক্ষদেশ : ৩৮। নির্ণয়চিহ্ন : ডান স্তনের ওপর দিকে তিল। হুম? ভাবল বন্ড। ডানদিকের মোড়ের কাছে এসে এই মাপ জোপগুলো মন থেকে সে মুছে ফেলল। সেখানে একটা সাইনবোর্ড ছিল। লেখা কিংসটাউন। আর ছিল ছোট একটা সরাইখানার কয়েকটা আলো।
সেখানে গাড়ি থামিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করল বন্ড। তার মাথার ওপর একটা সাইন বোর্ডে অস্পষ্ট সোনালি অক্ষরে লেখাঃ ওয়ার্লর্ড উইদাউট ওয়ান্ট। আধ মাইল দূর থেকে পাহাড়ের ওপর দিয়ে ভেসে আসা নোনা বাতাসে সাইন বোর্ডটা মড়মড় শব্দ করছিল। গাড়ি থেকে নেমে আড়মোড়া ভেঙে বন্ড সেই বার এর দরজার কাছে গেল। দরজাটা বন্ধ। বার বন্ধ হয়ে গেছে, নাকি সাফ করা হচ্ছে? পাশের দরজাটা ঠেলতে সেটা খুলে গেল। সেটা ছোট একটা প্রাইভেট বার এর দরজা, বার এর পেচনে শার্টপরে নির্বিকারভাবে একটা লোক সান্ধ্য সংস্করণের খবরের কাগজ পড়ছিল।
বন্ড ভেতরে আসতে কাগজটা নামিয়ে মুখ তুলে তাকাল সে, বলল ইভনিং স্যার। একজন খদ্দেরকে আসতে দেখে স্পষ্টই বোঝা গেল সে স্বস্তি পেয়েছে। বন্ড বলল ইভনিং। বড় হইস্কি আর সোডা। ববি-এগিয়ে এসে দু পেগ ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট ঢেলে গ্লাস আর সাইফন-সমেত সোডা বন্ডের সামনে রাখাল।
সোডা নিয়ে গ্লাসটা ভরে বন্ড সেটা শেষ করে প্রশ্ন করল গতকাল রাতের ব্যাপারটা যাচ্ছে তাই-নয় কি? গ্লসটা টেবিলে রাখল বন্ড।
লোকটা বলল সাংঘাতিক কাণ্ড স্যার। এখানকার ব্যবসাটাও লাটে উঠতে পারে। আপনি কি প্রেসের লোক? সারাদিন ধরে শুধু এসেছে পুলিশ আর রিপোর্টারের দল।
বন্ড বলল না, যে-লোকটি গুলিতে মরেছে আমি এসেছি তার জায়গায়–মেজর ট্যালনের জায়গায়। সে কি এখানে নিয়মিত আসত?
আগে কখনও আসেনি। সেই প্রথম আর শেষ বার। এখন এক সপ্তাহ ধরে এখানে লোকেদের আসা-যাওয়ার ভয়ানক কড়াকড়ি। কিন্তু একটা কথা স্বীকার করতেই হবে-স্যার হিউগো ভারি ভদ্রলোক। ক্ষতিপূরণ হিসেবে আজ সন্ধ্যেয় তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন পঞ্চাশ পাউন্ড। এখানে সবাই তাঁকে খুব পছন্দ করে। দু-হাতে খরচ করেন। সবাইকার সঙ্গেই হাসি মুখে কথা বলেন হ্যাঁ। ভারি ভাল লোক। বন্ড বলল খুনোখুনির ব্যাপারটা দেখেছিলে?
প্রথম গুলিটা দেখিনি স্যার। একজন খদ্দেরকে তখন এক পাইট মদ দিচ্ছিলাম। শব্দটা শুনে তাকাই, আর হাত থেকে পড়ে যায় মদের সেই পাঁইট টা। তারপর সবাই সিটিয়ে ওঠে। ভিড়ের মধ্যে সবাই জার্মান। গিজগিজ করছিল। গুলি খেয়ে লোকটা মেঝেয় পড়ে। বন্দুক হাতে লোকটা তার দিকে তাকিয়ে তারপর হঠাৎ এটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে বা হাতটা ওপর দিকে তুলে হাই বলে সে চেঁচিয়ে ওঠে-লড়াই এর সময় জার্মানরা যেমন চেঁচায় হাইল হিটলার বলে। তারপর বন্দুকের নলটা নিজের মুখে পোরে হারামজাদাটা। তারপর মুখ বিকৃত করে লোকটা বলল, এ ঘরের সিলিঙের মাঝখানে সে ছিটিয়ে-ছড়িয়ে পড়ে।
বন্ড প্রশ্ন করল, প্রথম গুলি ছোঁড়ার পর সে কি শুধু ওই এক কথাই বলে-হাইল?
হা। মনে হয় ওই কথাটা জার্মানেরা ভুলতে পারবে না। তাই না স্যার? চিন্তিতভাবে বউ বলল না কখনো তারা ভুলতে পারবে না।
.
মেয়ে পুলিশ ব্যান্ড
উঁচু তার-ঘেরা বেড়ার সামনেকার ফটকে ইউনিফর্ম পরা গার্ডকে বন্ড তার পাশ দেখাল।
বিমান বাহিনীর সার্জেন্ট সেটা ফেরত দিয়ে স্যালুট করল।
স্যার হিউগো আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন, স্যার।–বনের মধ্যে ওই বড় বাড়িটায়। পাহাড়ের উপর প্রায় শ খানেক গজ দূরের কয়েকটা আলোর দিকে হাত তুলে দেখাল সে।
পরের গার্ডের ঘাঁটিতে বন্ড তাকে ফোন করতে শুনল। নতুন পিচ-বাঁধানো পথ ধরে ধীরে সে গাড়ি চালিয়ে চলল।
শুনতে পেল দূর থেকে ভেসে আসা পাহাড়ের নিচেকার সমুদ্র গর্জন আর নানা যন্ত্রপাতির তীক্ষ্ণ রিনরিনে শব্দ। শব্দটা ক্রমশ হয়ে উঠতে লাগল তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর।
দ্বিতীয় একতারের বেড়ার কাছে সাধারণ পোশাকধারী এক গার্ড আবার থামাল বন্ডকে। তারপর হাতের ইঙ্গিতে জানাল এগিয়ে যেতে। দূরে পুলিশ কুকুরের ডাক শুনতে পেল সে। বুঝল তারা তাদের চৌকিদার। সতর্কতার ব্যাপারে কোন রকম ঢিলেঢালা নেই। অতএব বাইরের নিরাপত্তা নিয়ে তাকে মোটেই মাথা ঘামাতে হবে না। বন্ড খানিকটা আশ্বস্ত হল।
তারপর ছোট মত যেন একটা জঙ্গল, নানা রকমের গাছ। গাছগুলো পেরিয়ে কংক্রিট-মোড়া অনেকটা জায়গা। অস্পষ্ট আলো। বন্ডের বেন্টলির হেডলাইটও সেই কংক্রিট-বাঁধানো জায়গাটার শেষ সীমা খুঁজে পেল না। গাছগুলোর কিনারে বাঁ দিকে প্রায় একশ গজ দূরে একটা বিরাট বাড়ির আলো দেখা গেল। ছ-ফুট চওড়া একটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়িটা। সবটা দেখা যায় না। আরও ধীরে-ধীরে বন্ড চালাতে লাগল তার গাড়ি। তার গাড়ির হেডলাইট পড়ল অন্তত আধ মাইল দূরের একটা গম্বুজ মত জায়গায়। গম্বুজটাকে দেখতে একটা অবজারভেটারির চূড়োর মত।
বাড়িটার সামনে এসে বন্ড গাড়ি থামাল। সঙ্গে সঙ্গে সামনের দরজা খুলে বেরিয়ে এল একজন বাটলার। পরনে তার সাদা জ্যাকেট।
বন্ডের গাড়ির দরজা খুলে ধরে সে বলল, গুড ইভনিং স্যার। আমার সঙ্গে আসুন। তার স্বর ভাবলেশহীন। উচ্চারণটাও বিদেশীর মত। তার পেছন পেছন বাড়িটার মধ্যে গিয়ে হল-ঘর পেরিয়ে একটা দরজার কাছে পৌঁছল বন্ড। বাটলার দরজায় টোকা দিল।
এসো।
সেই পরিচিত কর্কশ স্বর। ঐ একটা কথার মধ্যেও আদেশের সুর শুনে মনে মনে হাসল বন্ড। সেই লম্বা ঝলমলে ঘরে খালি ফায়ার প্লেসের সামনে পেছন ফিরে দাঁড়িয়েছিলেন ড্রাক্স। বিরাট তার চেহারা। পরনে কিশমিশ রঙের ভেলভেটের মোকিং-জ্যাকেট। তার মুখের লালচে লোমগুলোর সঙ্গে একেবারে বেমানান সেটা। তার কাছে আর তিনজন মানুষ দাঁড়িয়ে।
দু-জন পুরুষ, একটি মেয়ে।
এসো, এসো এগিয়ে এসে করমর্দন করে দরাজ গলায় বলে উঠলেন ড্রাক্স। আবার তাহলে আমাদের দেখা হল। এত তাড়াতাড়ি হবে বলে ভাবিনি। জানতাম না তুমি একজন সরকারি গুপ্তচর। জানলে আরও সাবধানে তোমার সঙ্গে তাস খেলতাম।
জিতের টাকাটা খরচ করছো?
হেসে বন্ড বলল, এখনো করিনি। নোট গুলোর রঙ পর্যন্ত দেখিনি।
তা ঠিক। দেনা-পাওনা শনিবার চোকানো হয়। আমাদের এই রকেটটা ছোঁড়ার পর ফুর্তি করার জন্য সম্ভবত যথাসময়ে টাকাটা পাবে। মেয়েটির কাছে বন্ডকে তিনি নিয়ে এলেন। এ আমার সেক্রেটারি-মিস ব্র্যান্ড।
স্থির দুটো নীল চোখের দিকে তাকাল বন্ড। মিষ্টি হেসে বলল, গুড ইভনিং।
মেয়েটির চোখের মধ্যে হাসির কোনরকম আভাস নেই। শান্ত চোখে তাকাল সে বন্ডের দিকে। বন্ড তার হাতে মৃদু চাপ দিল। মেয়েটি দিল না। বন্ডের মনে হল প্রায় যেন রুক্ষ স্বরেই মেয়েটি বলল, কেমন আছেন? বন্ডের মনে হল এই কাজের জন্য মেয়েটিকে সঠিক বাছাই করা হয়েছে। এ যেন আর একজন লোয়েলিয়া পসেবি।
গম্ভীর, দক্ষ, কর্তব্যনিষ্ঠ এবং কুমারী। এ আমার ডানহাত–ডাঃ ওয়ালটার। রোগা চেহারা। বয়স্ক। মাথায় ঝাকড়া কালো চুল। চোখ দুটো রাগী রাগী। মনে হল বন্ডের প্রসারিত হাত সে লক্ষ্য করেনি।
তড়াক করে এ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে সে মাথা হেলাল। ড্রাক্স-এর উচ্চারণ শুধরে দিয়ে সে বলল, ভালটার।
আর এ হল আমার পার্শ্বচর উইলিক্রেবস। লোকটার হাত ভিজে ভিজে। বলল, আলাপ করে খুব খুশি হলাম। লোকটার মুখ গোল আর ফ্যাকাশে। অস্বাস্থ্যকর ধরনের। তার মুখের কৃত্রিম হাসিটা সঙ্গে-সঙ্গে মিলিয়ে গেল। তার চোখের দিকে তাকাল বন্ড। কালো বোতামের মত চোখ দুটো। অস্থির গোছের। বন্ডের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিল সে। এই নিরুত্তাপ লোকগুলোর মধ্যে দানবের মত চেহারার ড্রাক্সকেই বন্ডের ভাল লাগল। তার স্বাগত জানাবার ভঙ্গিটা রুক্ষ হলেও প্রাণবন্ত। অতীতের বিদ্বেষ ভুলে নতুন সিকিউরিটি অফিসারের সঙ্গে আন্তরিক ব্যবহার করছেন দেখে কৃতজ্ঞ বোধ করল বন্ড। আতিথ্যের ব্যাপারে ড্রাক্সের কোন ত্রুটি নেই। নিজের দুটো হাত ঘষে তিনি বললেন, উইলি, তোমার চমৎকার মাটিনিটা এবার বানাও। ডক্টরকে অবশ্যই দেবে না। ডক্টর, পানও করে না, ধোয়াও টানে না। বন্ডের দিকে চেয়ে তিনি বললেন, বলতে গেলে নিঃশ্বাসই নেয় না গলা ফাটিয়ে হাসলেন তিনি। রকেট ছাড়া আর কোন চিন্তা ওর মাথায় নেই। আছে নাকি, দোস্ত? নির্মম দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে ওয়ালটার বলল, আমাকে নিয়ে ঠাট্ট-তামাসা করতে আপনার খুব ভাল লাগে।
আহা, চটছ কেন? এমনভাবে ড্রাক্স বললেন, যেন শিশুর সঙ্গে কথা বলছেন। সমস্যাগুলোর কথা পরে আমরা আলোচনা করব। তুমি ছাড়া সবাইকার কোন দুর্ভাবনা নেই। বন্ডের দিকে ফিরে তিনি বললেন, ডক্টর এক সময় আমাদের ভয় দেখায়। সব সময়েই যেন দুঃস্বপ্ন দেখছে। এখন ওর দুর্ভাবনা রকেটের ডানাগুলো নিয়ে। সেগুলো ক্ষুরের মত ধারাল। বাতাসকে মোটেই বাধা দিতে পারবে না। এখন হঠাৎ ডক্টরের মাথায় ঢুকেছে ওগুলো গলে যাবে বাতাসের ঘষা লেগে। সব কিছুই অবশ্য সম্ভব।
কিন্তু ওগুলোকে তিন হাজার ডিগ্রি তাপে পরখ করে নেওয়া হয়েছে। ডক্টরকে বলেছি, ওগুলো গললে পুরো রকেটটাই গলে যাবে–যেটা অসম্ভব। ড্রাক্স-এর হাসি হিংস্র হয়ে উঠল। একটা রূপার ট্রে নিয়ে ক্রেবস এল। তাতে চারটে ভর্তি গ্লাস আর একটা হিম ঠাণ্ডা শেকার। মাটিনিটা চমৎকার। বন্ড তারিফ করল। বোকা বোকা হেসে ক্রেস বলল, অনেক ধন্যবাদ, স্যার হিউগো কোনরকম খুঁত বরদাস্ত করতে পারেন না। ড্রাক্স বললেন, বন্ডের গ্লাসটা ভরে দাও। তারপর ও মুখহাত ধুতে যাবে। আমরা কাঁটায়-কাঁটায় আটটায় ডিনারে বসি। তার কথার পরেই সাইরেনের চাপা শব্দ শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল বাইরের কংক্রিট বাঁধানো জায়গা দিয়ে নিখুঁতভাবে পা মিলিয়ে একদল লোককে ছুটতে।
ড্রাক্স বললেন, এটা প্রথম নাইট শিফট। বাড়ির পেছন দিকে ব্যারাক। নিশ্চয় আটটা বাজে। তার চোখের মধ্যে আত্মতৃপ্তির ভাব ফুটে উঠল। একেই বলে নিয়মনিষ্ঠা। এখানে অনেক বৈজ্ঞানিক থাকা সত্ত্বেও মিলিটারি ব্যারাকের মত আমাদের সব আইন কানুন। উইলি, তোমার উপর কম্যান্ডারের দেখাশোনার ভার রইল–এবার খেতে যাওয়া যাক্।
ডিনারের কোন তুলনা হয় না। ড্রাক্সের আতিথ্য একেবারে নিখুঁত। তিনি চাইছিলেন ডাঃ ওয়াল্টারকে দিয়ে কথা বলাতে, যাতে সব কিছু বুঝতে পারে বন্ড। নানান বৈজ্ঞানিক ব্যাপার বুঝিয়ে দিলেন ড্রাক্স। ড্রাক্সের খুঁটিনাটি ব্যাপার সম্বন্ধে জ্ঞান দেখে বন্ড স্তম্ভিত হল। লোকটাকে আন্তরিকভাবে সে তারিফ করতে লাগল। বন্ডের মন থেকে তার প্রতি আগেকার বিদ্বেষ একেবারে মুছে গেছে। এ যেন অন্য এক ড্রাক্স-যার সঙ্গে ব্লেড্রস ক্লাবে তাস খেলার কোন সম্পর্ক নেই। ইনি একজন স্রষ্টা। একজন নেতা-অবিশ্বাস্য একটা কাণ্ড করতে চলেছেন। মিস্ ব্র্যান্ড আর ড্রাক্সের মাঝখানে বসল বন্ড। মেয়েটির সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হল।
হা আর না ছাড়া মেয়েটির মুখে আর কোন কথা নেই। চোখের দিকেও তাকায় না। মনে মনে চটে উঠল বন্ড। ভারি সুন্দরী মেয়েটি। বন্ডের মনে হল মেয়েটির গাম্ভীর্য যেন একটু বেশি বাড়াবাড়ি ধরনের। মুখ গোমড়া করে না থেকে খোলাখুলি হাসিখুশি ভাব দেখানোটাই তার উচিত। তাতে তার আসল কাজেরই সুবিধে-কারুরই কোন রকম সন্দেহ হবে না। তার খুব ইচ্ছে করছিল টেবিলের তলা দিয়ে মেয়েটির পায়ের গোছে জোরে একটা লাথি কষাতে। মেয়েটির দিকে আবার সে এমনভাবে তাকাল যেন সে নিতান্তই সুন্দরী একটি মেয়ে তার সহকর্মিনী নয়। ড্রাক্স আর ওয়ালটার কথা বলছিলেন। সেই আলোচনায় মেয়েটিকে যোগ দিতে হচ্ছিল।
মেয়েটি তার ফটোর চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী। তার চেহারার সঙ্গে মেয়ে পুলিশের দক্ষ হাবভাব ঠিক যেন খাপ খায় না। মুখের মধ্যে কর্তৃত্বের একটা স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু তার গভীর নীল চোখের উপরকার কালো দীর্ঘ পল্লব আর মুখটা যেন কোন নিপুণ শিল্পীর আঁকা ছবির মত। তার ভাবভঙ্গি যেন একটু বেশি রকম গাম্ভীর্য আর কর্তৃত্বময়–দেখলে নিঃসন্দেহে মনে হয় সে একজন সুদক্ষ সেক্রেটারি। মনে হয় সে যেন ড্রাক্সের দলেরই একজন।
ড্রাক্সের প্রশ্নের উত্তর সে যখন দিচ্ছিল, বন্ড লক্ষ্য করল অন্য দুজন সেটা খুব মন দিয়ে শুনছে। মেয়েটির পোশাক কুচকুচে কালো। হাত দুটো কনুই-এর চেয়ে কিছু বড়। বডিসের ওপরকার ওড়না ভেদ করে দেখা যায় তার উদ্ধত স্তনরেখা। রেকর্ড বইতে তার যে মাপজোপ পড়েছিল, তা থেকে বন্ড অনুমান করল সে দুটি নিশ্চয়ই অপরূপ। তার বুকে একটা উজ্জ্বল নীল পাথরের ব্রু।
সবকিছু মিলিয়ে বন্ডের মনে হল মেয়েটি ভারি সুন্দরী এবং গম্ভীর হলেও খুবই আবেগ প্রবণ প্রকৃতির। ভাবল সে মেয়ে পুলিশ এবং জুজুৎসুতে এক্সপার্ট হতে পারে, তবু তার ডান দিকের স্তনের উপর আছে একটা তিল!
এই সব ভাবনা চুকিয়ে ড্রাক্স আর ওয়ালটারের আলোচনা খুব মন দিয়ে শুনতে লাগল বন্ড। মেয়েটির সঙ্গে ভাব জমাবার আর কোন চেষ্টা করল না। ন-টায় ডিনার শেষ হল। আচমকা টেবিল থেকে উঠে পড়ে ড্রাক্স বললেন, এবার আমার তোমার সঙ্গে মুনরেকারের পরিচয় করিয়ে দেব। ওয়ালটার আমাদের সঙ্গে আসবে। তার অনেক কাজ। চলে এস, ডিয়ার বন্ড। ক্রেবৃস আর মেয়েটির সঙ্গে কোন কথা না বলে লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘর থেকে তিনি বেরিয়ে গেলেন। বন্ড আর ওয়ালটার চলল তার পেছন পেছন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে কংক্রিট-মোড়া জায়গাটা পেরিয়ে দূরে পাহাড়ের কিনারে আবছা জিনিসটার দিকে তারা এগিয়ে চলল। চাঁদ উঠেছে। দূরের সেই হোঁকা মত জিনিসটা জ্যোৎস্নায় চিকচিক করছে।
জায়গাটা শ খানেক গজ দূরে থেকে ড্রাক্স বললেন, এখানকার ভৌগোলিক অবস্থা তোমাকে বুঝিয়ে দিই। ওয়ালটার, তুমি এগোও। ওরা অপেক্ষা করছে। আর একবার ডানাগুলো তুমি পরখ করে দেখ। ওগুলো নিয়ে দুর্ভাবনা। কর না। বন্ডের দিকে ফিরে দুধের মত সাদা গম্বুজটা দেখিয়ে তিনি বললেন, ওটাই মুনরেকার। যেটা দেখছ সেটা। একটা চওড়া গর্তের ঢাকনা। চল্লিশ ফুট খড়ি পাথর কেটে ওটা বসানো হয়েছে। একদিকে প্রায় অদৃশ্য একটা চৌকোমত জিনিস দেখিয়ে তিনি বললেন, ওটা হচ্ছে রকেট ছোড়বার জায়গা। কংক্রিটে তৈরি। রেডার অনুসরণের বহু যন্ত্রপাতি ওঠার মধ্যে। ওখানে একটা খুব বড় টেলিভিশন পর্দাও আছে, রকেটে কি ঘটছে দেখবার জন্য। আকাশে ওঠার শুরুতে রকেটটা অনুসরণ করার জন্য আরও একটা টেলিভিশন সেট আছে। কংক্রিটের ব্লকের পাশে পাহাড়ের মধ্যে একটা লিস্ট চলে গেছে। সমুদ্র পথে বহু যন্ত্রপাতি এসেছে। ওই লিফ্ট দিয়ে সেগুলো তোলা হয়। ডোভারের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বললেন, যে ঘ্যানঘেনে শব্দটা শুনেছ সেটা ওখানকার পাওয়া হাউসের। পুরু দেওয়াল দিয়ে বাড়ি আর ব্যারাকগুলো আড়াল করা। কিন্তু যখন রকেটটা ছোঁড়া হবে তখন সরকারি বিশেষজ্ঞ আর B.B.C.-র দল ছাড়া জায়গাটার এক মাইলের মধ্যে কেউ থাকবে না। আশা করি দেওয়ালটা বিস্ফোরণে ভেঙে পড়বে না। ওয়ালটার বলে নিদারুণ তাপে জায়গাটা আর অনেকখানি কংক্রিট গলে যাবে। ভেতরে যাবার আগে আর কিছু দেখার নেই। চলে এস। আবার সেই আচমকা আদেশের সুর, বন্ড লক্ষ্য করল। জ্যোত্সার মধ্যে ড্রাক্সের পেছন পেছন বন্ড চুপচাপ চলল সেই গম্বুজটা আড়াল করা পাঁচিল পর্যন্ত। পাঁচিলের মধ্যে ইস্পাতের দরজার উপর আটকান একটা লালবাতি জ্বলছিল। বড় বড় হরফে লেখা একটা সাইনবোর্ডের উপর সেটার আলো পড়েছে। ইংরেজি এবং জার্মান ভাষায় লেখা ও মারাত্মক বিপদ। লাল বাতি জ্বললে প্রবেশ নিষেধ। ঘন্টা বাজিয়ে অপেক্ষা করুন।
নোটিশের নিচেকার একটা বোতাম টিপলেন ড্রাক্স। একটা এ্যালার্ম বেলের চাপা ঢং-ঢং শব্দ শোনা গেল। ড্রাক্স বললেন, সম্ভবত কেউ অক্সি-এ্যাসিটিলিন নিয়ে কাজ করছে। নয়তো অন্য কোন সূক্ষ্ম কাজ। কেউ আসায় মুহূর্তের জন্য তোক অন্য মনস্ক হয়ে পড়লে চড়া খেসারত দিতে হবে। ঘণ্টা বাজলে সবাই হাতের যন্ত্রপাতি নামায়। তারপর ব্যাপারটা দেখে আবার তুলে নেয় নিজেদের যন্ত্রপাতি।দরজা থেকে সরে পাঁচিলের উপরকার সারিসারি চারফুট চওড়া কতকগুলো ফোকর দেখিয়ে ড্রাক্স বললেন, ভেন্টিলেটার শাট। ভেতরটা ৭০ ডিগ্রিতে এয়ারকন্ডিশন করা।
দরজা খুলল একটা লোক। হাতে তার লোহার ডাণ্ডা, কোমরে রিভলভার। ড্রাক্সের পেছন পেছন ছোটো একটা ঘরের মধ্যে গেল বন্ড। সেই ঘরে শুধু একটা বেঞ্চি আর এক সারি ফেল্টের নতুন চটি। বেঞ্চিতে বসে জুতা খুলতে খুলতে ড্রাক্স বললেন, এই চটিগুলো পরতে হবে। তোমার কোটটাও খোলা। বেশ গরম।
নিজের বগলের মধ্যে লুকোনো পিস্তলের কথা মনে পড়ায় বন্ড বলল, ধন্যবাদ। আমার কিন্তু গরম লাগছে না। বন্ডের মনে হল সে যেন কোন হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে এসেছে। ড্রাক্সের পেছন পেছন একটা দরজা দিয়ে সে বেরিয়ে এল লোহার সরু এক প্ল্যাটফর্মে। স্পট লাইটের অত্যুজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাধিয়ে গেল। চোখে হাত চাপা দিয়ে সে চেপে ধরল সামনের লোহার রেলিং। চোখ থেকে হাত নামাবার পর এমন একটা জমকালো দৃশ্য সে দেখতে পেল, যা তার কল্পনার অতীত। কয়েক মিনিটের জন্য সে যেন বোবা হয়ে গেল। পৃথিবীর সবচেয়ে বিশাল মরাণাস্ত্রের ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য ধাধিয়ে দিল তার চোখ দুটো।
.
মুনরেকার
বন্ডের মনে হল যেন একটা প্রকাণ্ড কামানের ঝকঝকে পালিশ-করা নলের মধ্যে সে এসে পড়েছে। মেঝে চল্লিশ ফুট নিচে।
পালিশ করা ধাতুর গোলাকার দেয়াল সেখান থেকে উপর পর্যন্ত উঠে এসেছে। সেখানে ড্রাক্স আর বন্ডকে দেখাচ্ছে যেন দুটো ক্ষুদে ক্ষুদে মাছি। গর্তটা প্রায় ত্রিশ ফুট চওড়া।
রকেটটা ঝকঝক করছে। জাফরি-কাটা গোলাকার ইস্পাতের ফ্রেমের উপর সেটা বসানো। লম্বায় প্রায় পঞ্চাশ ফুট। ঝকঝকে ক্রোম স্টিল দিয়ে তৈরি। দেয়াল থেকে বেরিয়ে আসা দুটো ক্রেনের পুরু রবার মোড়া সরু সরু আঙুল চেপে ধরে রয়েছে রকেটের মাঝখানটা। ড্রাক্স বললেন, সম্ভবত ট্যাঙ্ক থেকে জ্বালানি যাবার জায়গাটা পরীক্ষা করে দেখছে। ডিজাইনটা ভারি জটিল। কেমন দেখছ?
বন্ডের বিস্ময় স্তব্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে ড্রাক্স খুশি হলেন। বন্ড বলল, এরকম অদ্ভুত সুন্দর জিনিস জীবনে দেখিনি। ইস্পাতের সেই বিরাট গর্তের মধ্যে বলতে গেলে কোন শব্দই নেই। রকেটের পেছন দিকের লোকগুলোর খুব চাপা অস্পষ্ট কথাবার্তা শুধু গুন গুন করছে। ওপর দিকে আঙুল তুলে ড্রাক্স বললেন, রকেটের সামনের দিকটা এখন পরীক্ষামূলক যন্ত্রপাতি দিয়ে ঠাসা। আমাদের সামনে রয়েছে নানারকমের জাইরো। তারপর নিচ পর্যন্ত প্রায় সবটা জুড়ে জ্বালানির ট্যাঙ্ক। ল্যাজের কাছে আছে টারবাইনগুলো। হাইড্রোজেন পেরোক্সাইড ভেঙে খুব গরম বাষ্প পাওয়া যায়। সেই বাষ্প দিয়ে টারবাইনগুলো ঘোরে। ক্লোরিন আর হাইড্রোজেন মিশিয়ে জ্বালানি তৈরি করা হয়েছে।
বন্ডের দিকে কটমট করে তাকিয়ে তিনি বললেন, মনে রেখো, এটা একেবারে গোপন কথা। বাইরের কেউ জানে না। সেই জ্বালানি টিউব দিয়ে উঠে আসে। মোটরের মধ্যে পৌঁছলেই সেগুলো জ্বলে ওঠে। সেই বিস্ফোরণই রকেটটাকে শূন্যে ছুঁড়ে দেয়। রকেটের তলাকার ইস্পাতের মেঝেটা সরে যায়। নিচে একটা প্রকাণ্ড গহ্বর আছে। পাহাড়ের তলায়। কাল সেটা দেখবে। প্রকাণ্ড একটা গুহার মত দেখতে। সেদিন আমরা যখন পরীক্ষা করি, খড়ি পাথর পানির মত গলে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। রকেটটা ছোঁড়ার সময় আশা করি এই বিখ্যাত পাহাড়গুলো জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে না।
কারখানাটা দেখতে চাও?
ইস্পাতের দেয়ালটার পাশ দিয়ে খাড়া একটা লোহার সিঁড়ি নেমে গেছে। ড্রাক্সের পিছু পিছু চুপচাপ সেই সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল বন্ড। এই মানুষটার কাণ্ডকারখানা দেখে শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে তার মন ভরে উঠল। তাসের টেবিলে ড্রাক্সের ছেলেমানুষি দেখে সে চটে গিয়েছিল ভেবে মনে মনে একটু যেন লজ্জিতই হল সে। এ তো জানা কথা–মহৎ লোকদেরও নানা দুর্বলতা থাকে। ড্রাক্সের মাথায় সাংঘাতিক একটা দায়িত্ব। সেই কারণে তার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা থাকা এবং সেই উত্তেজনাকে লাঘব করার একটা পথ খোঁজা তার পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। ডিনারের সময়কার কথাবার্তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় দুশ্চিন্তায় উদ্ভ্রান্ত সহকারীর উপর তিনি বিশেষ নির্ভর করতে পারেন না। পুরো দলটাকে উদ্বুদ্ধ করার দায়িত্ব একা তার। বন্ড ভাবল, এত বড় একটা ঝুঁকি নিলে গলগল করে ঘামা আর দাঁতে নখ কাটা খুবই স্বাভাবিক। দীর্ঘ ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে তারা নামতে লাগল। রকেটটার ঝকঝকে ক্রোমিয়ামের গায়ে তাদের প্রতিবিম্বিত ছায়াগুলো দেখতে লাগল কিম্ভুতকিমাকার। জনসাধারণ এই মানুষটাকে যে রকম ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে– সেই রকম ভালবাসা ও শ্রদ্ধায় ভরে উঠল বন্ডের মন। অথচ এই মানুষটারই চুলচেরা বিচার করেছিল সে, প্রায় ঘৃণাই করেছিল মানুষটাকে। ভাবতে গিয়ে অবাক হল বন্ড। লজ্জিত হল। কুণ্ঠা বোধ করল।
শাফট-এর ইস্পাতের মেঝেয় এসে ড্রাক্স থামলেন। তাকালেন উপর দিকে। বন্ডও সেদিকে তাকাল। চারদিকে চোখ ঝলসানো আলো। মাঝে মাঝে লালচে শিখা যেন ঝলসে ঝলসে উঠছে।
অ্যাসবেস্টসের স্যুট পরা একটা লোক একটা আগুন নেভানো যন্ত্রের লালচে নল তুলে ধরেছে। নলটা রকেটের নিচের দিকে।
কল্পনাই করা যায় না–এ রকম একটা সূক্ষ্ম যন্ত্র শুক্রবার আকাশে উড়বে। উড়বে ঘণ্টায় পনের হাজার মাইল বেগে। মনে হল বন্ডের মনের কথা ড্রাক্স যেন পড়ে ফেলেছেন। বললেন। সর্বনাশা কাণ্ড–তাই ভাবছ তো? ওয়াল্টার, এখানে এস। ওয়াল্টার এল।
ড্রাক্স তাকে বললেন, ওয়াল্টার–আমাদের এই দোস্ত, বন্ডকে বলেছিলাম, মুনরেকারটাকে আকাশে ছোঁড়া প্রায় গণহত্যার শামিল।
ওয়াল্টারের মুখের বিহ্বল ভাব দেখে বন্ড অবাক হল না। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ড্রাক্স বললেন, অতশত ভাবছটা কি? জেগে ওঠ।
আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠল ওয়াল্টারের মুখ। ড্রাক্সের কথায় তার মুখে কাষ্ঠ-হাসি ফুটে উঠল। বলল, খুন?–খুন কথাটা মজাদার।–হা-হা-হা-হো-হো-হো–স্যার হিউগো!
লোকজনদের কি হাসাই না হাসাতে পারেন।…
বকবক করে চলল লোকটা। বক্ করতে করতেই রকেটের লেজের কাছে ড্রাক্সকে নিয়ে এল ওয়াল্টার। পেছনে বন্ড। সেখানকার দশটা লোক তাদের দিকে তাকাল। ড্রাক্স পরিচয় করিয়ে দিলেন, কমান্ডার বন্ড, আমাদের নতুন সিকিউরিটি অফিসার।
লোকগুলো কোন কথা না বলে বন্ডের দিকে তাকাল। সেই দশটা লোকের বিশটা চোখে কোন রকম কৌতূহল নেই।
গ্রাফাইট, গ্রাফাইট-ব্যাপারটা কি?
ওয়াল্টার আর ড্রাক্সের কাছে ঘেঁষে এল লোকেরা। একা দাঁড়িয়ে রইল বন্ড। তাকে কেউ দেখেও দেখল না দেখে বন্ড অবাক হল না। তার নিজের ডিপার্টমেন্টে বাইরের কোন অনভিজ্ঞ লোক এলে ঠিক এদের মতই সে নির্বিকার। থাকত। হয়ত বিরক্ত বোধও করত। লোকগুলোর সম্বন্ধে তার মায়া হল। মাসের পর মাস বেচারাদের জীবনে জটিল বৈজ্ঞানিক কাজ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কাজটা এখন শেষ হয়ে এসেছে। মুক্তি তাদের নাগালের মধ্যে। তা সত্ত্বেও তারা জানে? বন্ড এখানে এসেছে ভারি একটা গুরুদায়িত্ব নিয়ে। তাদের কেউ কি জানে তাদের মধ্যে কোন গোপন শত্রু আছে, রকেটের দুর্বলতার কথাটা কে জানে? বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় এটা নিখুঁত একটা দল। কিন্তু চুপচাপ সমস্ত পরিকল্পনাটাকে বানচাল করার কেউ কি চেষ্টা করছে না? তাদের মধ্যে কোন লোক? যাকে ধরতে এসেছে এই লোকটা–বন্ড? রকেটের ডানার তিনটে কোণ একটা ত্রিভুজ সৃষ্টি করেছে। খুব স্বাভাবিক পায়ে বন্ড সেখানে খানিক ঘোরাঘুরি করল। কিন্তু লোকগুলোর দিকে তাকাতে লাগল বিভিন্ন জায়গা থেকে।
ড্রাক্স ছাড়া সবাইকার পরনেই সেই একই ধরনের নাইলনের আঁটসাঁট ওভারঅল আর প্লাস্টিকের জিপ। কোন রকম ধাতুর কোন চিহ্ন নেই, কোথাও কারোর চোখে চশমা নেই। ওয়াল্টার আর ক্রেবস-এর মত সবার মাথাতেই কদমছাট। বন্ড ভাবল ও যন্ত্রপাতির মধ্যে একগাছা চুল যাতে না পড়ে তার জন্যই এই ব্যবস্থা। তবু, তবু কেমন যেন ভূতুড়ে গোছের ব্যাপারটা, ভাবল বন্ড। কি খাপছাড়া কাণ্ড–সবাইকার মুখেই কিন্তু ঝোড়া ঝোড়া গোফ, অথচ মাথায় চুল নেই। লোকগুলোর নানা ধাচের গোঁফ-কারোর কাইজার, কারোর হিটলারের মত। গোফগুলোর নানান ছাট।
অবাক হয়ে ভাবল বন্ড ও কারখানার সবাই গোঁফ রাখে কেন? মাথাগুলো প্রায় কামানো, অথচ ঝোড়া গোঁফ! ব্যাপারটা কি? কেমন যেন কুৎসিত। সবাইকার গোঁফজোড়া একভাবে ছাঁটা থাকলেও তবু না হয় বলার কিছু থাকত। কিন্তু এই বিভিন্ন ছাঁটের গোঁফগুলো দেখলে যে কোন মানুষের মন বিদ্রোহ করতে বাধ্য। লক্ষ্য করার আর কিছু ছিল না। লোকগুলো প্রায় একই মাপের, ছিপছিপে গড়নের। বন্ডের মনে হল, এই কাজের জন্য তাদের যেন কেটে হেঁটে তৈরি করা হয়েছে। ক্রেনগুলোর মধ্যে হাঁটবার আর নিচু নিচু দরজা দিয়ে রকেটের ছোট ছোট খুপরিতে ঢোকার জন্য ছিমছাম চটপটে শরীরের দরকার। তাদের হাতগুলো ধবধবে পরিষ্কার, পায়ে ফেল্টের চটি। কেউ একবারও তার দিকে তাকাল না। তিন দিনের মধ্যে যন্ত্রমানবের মত এই পঞ্চাশ জন জার্মানের আসল মনোভাব আবিষ্কার করা একেবারে অসম্ভব বলে মনে হল। তারপর কথাটা তার মনে পড়ল। এখন আর পঞ্চাশ নয়। ঊনপঞ্চাশ। রোবটদের একজন মুখে বন্দুক দিয়ে ট্রিগার টেনে নিজের খুলিটা উড়িয়ে দিয়েছে।
সেই বারৎস্ লোকটার মনে কি ভাবনা ছিল? শুধু কি একটা মেয়ের জন্য কামনা-বাসনা আর হাই হিটলার? মুনরেকার ছাড়া এই বাকি উনপঞ্চাশটা লোকের মনেও কি সেই একই ভাবনাগুলো রয়েছে।
ডক্টর ওয়াল্টার। এটা আমার আদেশ। কাজ শুরু কর। অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। চাপা রাগে ভরা ড্রাক্সের স্বর শুনে বন্ডের চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল। কোলামবাইট দিয়ে তৈরি রকেটের তীক্ষ্ণ লেজটা সে তখন হাত দিয়ে পরীক্ষা। করছিল।
লোকগুলো চটপট নিজেদের কাজে চলে গেল। রকেটের এক্সস্টের কাছে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল ওয়াল্টার।
বন্ডের কাছে এলেন ড্রাক্স। মুখটা তার রাগে থমথম করছে।
বিড়বিড় করে তিনি বললেন, গাধা কোথাকার! সব সময়েই ঘাবড়ে রয়েছে।
তারপর মন থেকে তার সহকারীর কথা ঝেড়ে ফেলার জন্যই যেন আচমকা বলে উঠলেন, আমার অফিসে এসো। রকেটের গতিপথটা তোমাকে দেখব। তারপর ঘুমোতে যাবে।
বন্ড ড্রাক্সের পেছন পেছন গেল। ইস্পাতের দেওয়ালের গায়ে আটকানো একটা হাতল তিনি ঘোরালেন। হুশ করে একটা দরজা খুলে গেল। তিন ফুট দূরে আরও একটা ইস্পাতের দরজা। বন্ড লক্ষ্য করল দুটো দরজার কিনারাই রবার দিয়ে মোড়া। বাতাস যাতায়াত বন্ধ। বাইরের দরজাটা বন্ধ করার আগে দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে ইস্পাতের গোলাকার দেওয়ালের ওপরকার আরও কতকগুলো চ্যাপ্টা হাতল দেখিয়ে ড্রাক্স বললেন, নানান কারখানার দরজা। ইলেকট্রিশিয়ানুস জেনারেটার, ফুয়েলিং কন্ট্রোল, ওয়াশরুম, স্টোর, পাশের দরজাটা খোলার আগে বাইরের দরজাটা তিনি বন্ধ করলেন। তারপর নিজের অফিস ঘরে এসে বন্ধ করলেন দ্বিতীয় দরজাটা।
ঘরটা অনাড়ম্বর। রঙ ফ্যাকাশে ধূসর। বড় একটা ডেস্ক, ইস্পাতের টিউব আর গাঢ় নীল ক্যাম্বিস কাপড়ের কয়েকটা চেয়ার। মেঝেয় ছাই রঙা কারপেট। দুটো সবুজ ফাইলিট ক্যাবিনেট। একটা প্রকাণ্ড রেডিও-সেট। আধ খোলা একটা দরজা দিয়ে টালির মেঝের বাথরুমের খানিকটা চোখে পড়ে। ডেস্কের সামনে প্রকাণ্ড ফাঁকা একটা দেয়াল। মনে হয়। অস্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে তৈরি।
দেয়ালটার কাছে গিয়ে ডানদিকের স্যুইচ তিনি টিপলেন। পুরো দেয়ালটা আলোকিত হয়ে উঠল। বন্ড দেখতে পেল দুটো ম্যাপলম্বায় আর চওড়ায় প্রায় ছ-ফুট। কাঁচটার পেছনে সেগুলো আঁকা। বাঁ দিকের ম্যাপ ইংলন্ডের পূর্বাঞ্চলের, পোর্টসমাউথ থেকে হাল্ আর সংলগ্ন সমুদ্রের ল্যাটিচিউড ৫০ থেকে ৫৫। ডোভারের কাছে লাল একটা ফুটকি। মুনরেকারের সেইখানে অবস্থিতি। সেই ফুটকি থেকে নানা বৃত্তের বক্ররেখা দিয়ে ম্যাপের উপর দশ মাইল অন্তর দুরত্ব আঁকা। ফ্রিজিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে হাল এর মাঝখানে, মুনরেকারের অবস্থান থেকে আশি মাইল দূরে সমুদ্রের মাঝখানে হীরের আকারের লার একটা চিহ্ন।
ম্যাপটার ডানপাশে নানা গাণিতিক চিহ্ন আর কম্পাসের হিসেব। ড্রাক্স সেগুলো দেখিয়ে বললেন, বাতাসের গতিবেগ, আবহাওয়ার চাপ–উইরোগুলোর জন্য নানা হিসেবের ফর্দ। রকেটের গতি আর পাল্লা স্থির ধরে নিয়ে ঐ সব হিসেব পত্র করা হয়েছে। এবার মিনিস্ট্রি আর বিমান বাহিনীর জেট প্লেন থেকে দৈনিক আমরা আবহাওয়ার খবর পাই। জেটপ্লেনগুলো যথাসম্ভব উপরে উঠে হিলিয়াম গ্যাস ভরা বেলুন ছাড়ে। সেগুলো আরও উপরে উঠতে পারে। পৃথিবীর আবহাওয়া প্রায় পঞ্চাশ মাইল উপর পর্যন্ত বিস্তৃত। কুড়ি মাইল উপরে বায়ুস্তর খুবই হালকা। মুনরেকারকে বাধা দিতে পারবে না। প্রায় বায়ুশূন্য আকাশের মধ্যে দিয়ে মুনরেকা ছুটবে। প্রথম কুড়ি মাইল ওঠাই সমস্যা। আর একটা সমস্যা হচ্ছে মাধ্যাকর্ষণ। তুমি জানতে চাইলে ওসব ব্যাপার ওয়ালটার তোমাকে বুঝিয়ে দেবে। শুক্রবার শেষ কয়েক ঘণ্টা ঘরে ক্রমাগত আবহাওয়ার খবর আসবে। ছোঁড়ার ঠিক আগে জাইরোগুলো আমরা সেট করব। এখন প্রতি সকালে মিস ব্র্যান্ড সমস্ত খবরগুলো জড় করে জাইরোসেটিং-এর জন্য একটা ছক তৈরি করে।
দ্বিতীয় ম্যাপটা ড্রাক্স দেখালেন। সেটা রকেটের ছোড়বার জায়গা থেকে লক্ষ্যবস্তু পর্যন্ত উপবৃত্তীয় যাত্রাপথ। সেখানে আরও অনেক সংখ্যা ছড়ানো। ড্রাক্স বললেন, রকেটের বক্র গতিপথের উপর পৃথিবীর গতি প্রভাব আছে। রকেট যখন উড়বে পৃথিবী তখন ঘুরবে পূর্বদিকে। সে হিসেবটা মেলাতে হবে অন্য ম্যাপের সংখ্যাগুলোর সঙ্গে। ভারি জটিল ব্যাপার। সৌভাগ্যের বিষয় তোমাকে ওগুলো বুঝতে হবে না। ঐ সব হিসেব করার ভার মিস্ ব্র্যান্ডের উপর। আলোর স্যুইচগুলো তিনি নেভালেন। সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালটা ফাঁকা হয়ে গেল। আর কোন প্রশ্ন আছে? তোমার বিশেষ কিছু করণীয় আছে বলে মনে হয় না। তুমি তো দেখতেই পাচ্ছ এখানকার নিরাপত্তার ব্যাপারে কি রকম কড়াকড়ি। গোড়া থেকেই নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর সরকার খুব জোর দিয়েছিল। বন্ড বলল, মনে হচ্ছে সব কিছু ঠিকঠাক আছে। ড্রাক্সের দিকে তাকাল সে। দেখল তার ভাল চোখটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। একটু থেমে বন্ড প্রশ্ন করল, আপনার কি মনে হয় আপনার সেক্রেটারি আর মেজর ট্যালনের মধ্যে কোন সম্পর্ক ছিল?
সহজ গলায় ড্রাক্স বললেন, থাকা খুবই স্বাভাবিক। মেয়েটি সুন্দরী। এক সঙ্গে তাদের বহু সময় কাজ করতে হয়েছে। মনে তো হয় বারস-এর মাথা সে ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
বন্ড বলল, শুনেছি বন্দুকের নলটা মুখে ভরবার আগে বারৎস্ স্যালুট করে চেঁচিয়ে উঠেছিল হাইল হিটলার বলে। স্থির গলায় ড্রাক্স বললেন, তাই তো শুনেছি। কিন্তু তাতে কি যায় আসে?
ড্রাক্সের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বন্ড জিজ্ঞেস করল, আপনার সব কর্মচারিরা গোঁফ রেখেছে কেন? বন্ডের মনে হল তার প্রশ্নে ড্রাক্স অস্বস্তি পেয়েছেন। পরক্ষণেই তিনি গলা ফাটিয়ে হেসে উঠলেন। বললেন, ওই বুদ্ধিটা আমার নিজস্ব। সব লোকগুলোর মাথা কামানো। সবার পরনেই একধনের ওভারঅল। চেনা কঠিন। তাই সবাইকে বলেছিলাম গোঁফ রাখতে। ওটা এখন একটা প্রায় বাতিক দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ বিমানবহরের মধ্যে যেমন দাঁড়িয়েছিল। ও ব্যাপারটায় কোন গলদ আছে বলে তোমার মনে হয়?
বন্ড বল উঠল, না না। প্রথম দেখলে চমকে উঠতে হয়। মনে হয় প্রত্যেক শিফট-এর জন্য আলাদা আলাদা রঙের বড় বড় হরফে এক একটা সংখ্যা ওদের স্যুটে লেখা থাকলে কাজের অনেক বেশি সুবিধে হত।
আলোচনাটা বন্ধ করার জন্যই দরজার দিকে ফিরে ড্রাক্স বললেন, আমি বলেছিলাম গোঁফ রাখতে। তাই গোঁফ। এর ওপর কথা নেই।