পরিশিষ্ট

মুদ্রিত বাংলা বইয়ের দৃষ্টিজগৎ এবং বিদ্যাসাগরের ভাবনা

মুদ্রিত বাংলা বইয়ের দৃষ্টিজগৎ এবং বিদ্যাসাগরের ভাবনা

ঐন্দ্রিলা মাইতি সুরাই

কথায় বলে কানে শোনা আর চোখে দেখা। এই দু’টি কাজের মধ্যে দ্বিতীয়টি জোরালো এবং যুক্তিগ্রাহ্য, কারণ তা নিশ্চিত, প্রকৃত, যথার্থ— এককথায় বাস্তবিক। অতএব, চাক্ষিক জগৎ আমাদের কাছে বিশ্বাসী এবং নির্ভরযোগ্য এক স্থান। এই কারণে, উনিশ শতকের শ্রুতি এবং স্মৃতি নির্ভর গুরুমুখী শিক্ষার প্রথাকে অস্বীকার করে যখন শিক্ষার মাধ্যম বই হয়ে ওঠে, তখন তা চাক্ষিক, মূর্ত এবং বলা বাহুল্য, নির্ভরযোগ্য একটি রূপ হয়ে ধরা দেয় পাঠকের সামনে। এ কথা বলছি উনিশ শতকের প্রকাশনা জগতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান প্রসঙ্গে— যার বেশ খানিকটা জুড়ে রয়েছে বাংলা প্রাইমার-এর ইতিহাস এবং তাঁর রচিত অন্যান্য বাংলা গদ্য ঘিরে দৃশ্যকল্প, দৃশ্যজগৎ, এবং সে যুগের দেখার মনস্তত্ত্ব ইত্যাদির নিরিখে এক চাক্ষিক চর্চা।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শিল্পী ছিলেন না ঠিকই, কিন্তু চাক্ষিক বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন একটি মন তাঁর অবশ্যই ছিল, যার ফলস্বরূপ লেখার হরফে, ছাপাই মাধ্যমে এবং প্রকাশনার কাজে (এককথায়, print culture) তাঁর অসীম যত্ন, পরিশ্রম এবং নিরলস প্রচেষ্টা সুবিদিত। যে সময়ে তিনি ছাত্র, সেই সময় শিক্ষার মাধ্যম চাক্ষিক নয়। তা শ্রুতি এবং স্মৃতির। শুভংকরী আর্যা, নামতা, চৌতিশা, ইত্যাদি শোনা এবং মনে রাখার মতো বিষয়গুলি কখনওই ভ্রান্তিবিহীন বা নির্ভুল হতে পারে না কারণ স্মৃতি পরিবর্তনশীল; শ্রবণের ক্ষেত্রেও ফাঁক থেকেই যায়। একইভাবে সেই সময়ে পর্যাপ্ত বাংলা প্রতিশব্দেরও অভাব চোখে পড়ে। এই অনুপস্থিতি বিদ্যাসাগর অনুভব করছেন, অর্থাৎ, তিনি এক barren space-কে প্রত্যক্ষ করছেন এবং তাকে cultural space-এ পরিণত করছেন। যা নেই, তাকে বাস্তবায়িত করছেন এবং ফাঁক ভরাট করার উদ্দেশ্যে বারংবার বেছে নিচ্ছেন গ্রন্থনা, গ্রন্থ রচনা এবং প্রকাশনার মতো কাজ। অর্থাৎ, চাক্ষিক মাধ্যম।

বিদ্যাসাগর দয়ার সাগর। এমন কথায় আমাদের মনের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই এক করুণার আধারের ছবি তৈরি হয়। মনে হয় যেন তিনি নিজের জন্য পাই-পয়সাটি না রেখে, সবই দানের উদ্দেশ্যে বিলিয়ে দিতেন। কিন্তু তাঁর জীবনীকারেরা প্রায় প্রত্যেকেই লিখছেন স্পষ্ট করে— কী অসামান্য যুক্তির নিরিখে তিনি প্রতিটি পাই-পয়সা হিসেব করে খরচ করছেন দানের দরুন বা তার থেকে বিরত থাকছেন। এমনকী অপত্য স্নেহের ক্ষেত্রেও আবেগতাড়িত হওয়ার বদলে দেখতে পাই যুক্তিবাদী এক মন। এই বোধ, যুক্তি, বিচারক্ষমতার উদাহরণ বিদ্যাসাগরের প্রতিটি কাজে ও চিন্তায়, তর্কে ও চিঠিতে। এই যুক্তিবাদী মন দিয়েই তিনি দেখার কাজটি করেছেন— একাধিক ক্ষেত্রে সরলীকরণ করেছেন জটিল রূপগুলির, বাংলা গদ্য এবং পুরনো বাংলা হরফকে মুক্ত করেছেন সেই রূপটি থেকে— চাক্ষিকতার নিরিখে যা অযথা জটিল।

যদিও এই চাক্ষিক যুক্তির ব্যবহারে বাংলা অক্ষরের, ভাষার বা পদবিন্যাসের রূপের সরলীকরণ করছেন, অন্যদিকে তিনি নিজের লেখা গদ্যের ক্ষেত্রে (ছোটবেলায় লেখা সংস্কৃত পদ্যেও) যে ধরনের দৃশ্যজগৎ সৃষ্টি করছেন তা মূলত কল্পনার। এবং, সেই কল্পজগতে যুক্তির চেয়ে অনেক বেশি দ্রষ্টব্য এক আবেগার্দ্র দৃষ্টিভঙ্গি— যা অন্তরমহল বা বহির্জগৎ, শয্যাদৃশ্য থেকে দুর্ঘটনা, এইসব স্থান/বিষয়গুলির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রচয়িতার/চরিত্রদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও বহুবিধ পরিপ্রেক্ষিত থেকে পর্যবেক্ষিত। এর সঙ্গে জুড়ে রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গির আদান-প্রদান (‘exchange of gaze’); অবলোকন; পুরুষের দৃষ্টি দিয়ে দেখা (‘male gaze’); অনুসন্ধান; ‘অন্তরঙ্গ বহিরাগত’র (the ‘intimate outsider’) দৃষ্টি এবং আত্ম-অন্বেষণ। বিদ্যাসাগর অভাবনীয়ভাবে সেই দৃষ্টির প্রতি সজাগ ও একইসঙ্গে বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং সাবলীল তার উপস্থাপনায়। পরবর্তীতে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় আমরা আবার ফিরে আসব।

বিদ্যাসাগরের এই চাক্ষিক বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন গুণটিই পরে মুদ্রণের মতো দৃষ্টিনির্ভর কাজে ব্যবহৃত হয়ে শিক্ষাব্যবস্থার অভাবপূরণের কাজ সম্পন্ন করে। তবে এমন যুক্তিতে আসার আগে বলা দরকার এমন যুক্তিতে আমরা আসছি কী থেকে। এই প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগরের জীবনের কয়েকটি ঘটনার বিবরণ দেওয়া যেতে পারে।

প্রথমটি সেই বিখ্যাত মাইলস্টোন থেকে ইংরিজি সংখ্যা চেনার ঘটনা। বালক বিদ্যাসাগরকে কলকাতার প্রতিষ্ঠানে ভরতি করবেন ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সুবাদে কলকাতায় পাড়ি দেওয়ার পথে সিয়াখালার কাছে সালিখার বাঁধানো রাস্তায় ওঠার পর মশলা বাটার শিলের মতো কিছু জিনিস, রাস্তার ধারে ধারে পোঁতা আবিষ্কার করলে কৌতূহলী বিদ্যাসাগরকে বাবা বুঝিয়ে দেন মাইলস্টোনের গুরুত্ব। পাথরের ফলকের ওপর ইংরিজিতে সংখ্যা লেখা আছে। উনিশ সংখ্যাটিতে পাশাপাশি এক ও নয় আছে। উনিশ মাইল অর্থাৎ নয় ক্রোশ। নামতার হিসেবে এখান থেকে বিদ্যাসাগরের নিজে নিজেই শেখার শুরু। দশ সংখ্যায় পৌঁছে তিনি বাবাকে সে কথা জানালে এবার পরীক্ষা নেওয়ার পালা। নয়, আট, সাত— বিদ্যাসাগরকে যে সংখ্যা নিয়েই প্রশ্ন করেন বাবা, তার সঠিক উত্তর আসে। কিন্তু তাতেও পুত্র ফাঁকি দিচ্ছে কি না, সেই সন্দেহের নিরসনের জন্য ঠাকুরদাস ফাঁকি দিয়ে পাঁচের অঙ্কে এসে তা পুত্রের হিসেবে কত হয় জানতে চাইলে বছর আটেকের বিদ্যাসাগর জানান, ‘বাবা এটা হবে ছয়ের অঙ্ক, কিন্তু, ভুলে পাঁচ লিখিয়াছে।’ একটু খেয়াল করলে বোঝা যাবে আট বছরের বালক অপরিচিত বস্তুর (মাইলস্টোন) কেমন সাদৃশ্য খুঁজে নিচ্ছে পরিচিত বস্তুর (শিল) সঙ্গে। ইংরিজি পরিভাষায় যা হল mnemonic। অর্থাৎ, নতুন বস্তুকে সে মনে রাখছে কীভাবে। এই চাক্ষিক যুক্তিকেই নিশ্চয় সে ব্যবহার করে থাকবে অপরিচিত ভাষা/রূপকে (এক্ষেত্রে, ইংরিজি সংখ্যা) পরিচিত কোনও রূপ দিয়ে মনে রাখার কাজে। ঠাকুরদাস প্রতিনিয়ত যে পড়া ধরতেন; নিখুঁত মুখস্থ হল কি না যাচাই করতেন, বিদ্যাসাগর কলেজে প্রবেশের পরেও সেই রীতি জারি ছিল। ছোটবেলা থেকে পিতার এই যাচাই করা এবং পুত্রের নিখুঁত উত্তরের চর্চাই পরবর্তীকালে উনিশ শতকের শিশুদের বিদ্যাচর্চায় এক যথার্থ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির রাস্তা খুলে দিয়েছিল। বর্ণপরিচয়-এর প্রথম ভাগ, প্রথম পাঠ-ই তার প্রমাণ।

বিদ্যাসাগর বালক বয়সে যেভাবে দেখার চেষ্টা করছেন, তা আমরা ক্যামিল শুলম্যান-এর ‘এলিমেন্টারি স্টুডেন্টস স্ট্র্যাটেজিস ফর সলভিং ভিস্যুয়াল লজিক টাস্কস’ প্রবন্ধটি দিয়ে একবার বোঝার চেষ্টা করতে পারি। শুলম্যান বলছেন, অঙ্কের ক্ষেত্রে দু’ ধরনের যুক্তি কাজ করে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বা অনুমিতিতে আসার জন্য— অনুমানজনক বা অপবাহিক (inductive) এবং ন্যায়িক (deductive)। হেলক-এর মতামত তুলে ধরছেন শুলম্যান: বিভিন্ন ধারার সরলীকরণ করে ভবিষ্যতে ঘটবে এমন অনেক ঘটনার ইঙ্গিত দেওয়া অপবাহিক বা অনুমানজনক সিদ্ধান্তের কাজ। কিন্তু যে-কোনও মুহূর্তেই তাকে পালটা যুক্তি দিয়ে ভুল প্রমাণ করা যায়। অন্যদিকে ন্যায়িক উপসংহার যথাযথ যুক্তি খাড়া করে, বিশ্লেষণের দ্বারা সমস্যার সমাধান করে প্রমাণ করে যে সে অকাট্য। তর্ক, প্রামাণ্য বিষয় এবং অঙ্ক ন্যায়িক যুক্তি ব্যতীত সম্ভব নয়। প্রত্যেক দাবির পেছনে নিখুঁত এবং সঠিক সমর্থন থাকতেই হবে, যুক্তিকে আনতে গেলে।

সুইস উন্নতিমূলক মনস্তত্ত্ববিদ জ্যঁ পিয়াজে-ই সর্বপ্রথম দাবি করেন যে শিশুরা সাত বছরে বয়সের আগে যুক্তিসহকারে কারণ দর্শাতে পারে না। তবে সাত থেকে আট বছরের শিশু তা পারে কেবলমাত্র ব্যক্তিগতভাবে জড়িত কোনও ঘটনাকে ভিত্তি করে, পূর্ণবয়স্ক হয়ে ওঠা পর্যন্ত।১০ পিয়াজে-র এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী গবেষকরা কাজ করেছেন। বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে যদি মাইলস্টোন এবং ইংরিজি সংখ্যা চাক্ষুষ করাকালীন প্রথমে অনুমানজনক বা অপবাহিক (inductive) যুক্তি কাজ করে থাকে, পরে তবে অঙ্ক শেখার/মেলাবার ক্ষেত্রে ন্যায়িক (deductive) যুক্তিই কাজ করেছে। এর সঙ্গে মনে রাখার প্রক্রিয়ার যেদিকটি বারংবার বিদ্যাসাগরের নানা রচনায় ফিরে এসেছে, ইংরিজি পরিভাষায় তা হল mnemonic।

দ্বিতীয় ঘটনাটি পুথি কেনার। চতুষ্পাঠীতে পড়ার সুবাদে পাওয়া বৃত্তি দিয়ে বাবা ঠাকুরদাসের ইচ্ছেতে দু’টি জিনিস কিনছেন বিদ্যাসাগর: জমি এবং সংস্কৃত পুথি।১১ দুই-ই ভবিষ্যতে ছাত্রদের জন্য একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরির উদ্দেশ্যে। এর থেকে কিছুটা হলেও বোঝা যায় যে, futuristic project, এমনকী তা অসাধিত থেকে গেলেও তার বীজ যেভাবে গাঁথা হয়— অর্থাৎ, মনে মনে ভাবা বা visualization–এর কাজটিকে রূপ দেওয়ার প্রয়াস ছিল। তা ছাড়া, গুরুমুখী বিদ্যার পথে না গিয়ে একটি স্পষ্ট চাক্ষিক রূপকে বেছে নিচ্ছেন, কিনছেন পুথি। এ কথা যদি ধরেও নিই যে তিনি সংস্কৃত পণ্ডিত, অতএব, পুথিই তো পড়াবেন ও কিনবেন, তবু, শ্রুতি ও স্মৃতির মতো বিমূর্ত একটি প্রচলিত মাধ্যমের পথে না গিয়ে, চাক্ষিক একটি মাধ্যম যে বাছলেন, তার পেছনে কি ভবিষ্যতে বই আকারে শব্দকে স্পষ্ট করে দেখার বাসনার বীজটি লুকিয়ে ছিল না?১২

তৃতীয়টি, বিদ্যাসাগরের রচনায় চরিত্রচিত্রণ। বিশেষত স্ত্রীজাতিকে চাক্ষুষ করার অভিজ্ঞতা বা বিদ্যাসাগরের কল্পনায় মহিলাদের সৌন্দর্য— বিষয় হিসেবে কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। তা ব্যতিরেকে কৌতূহলোদ্দীপকও। একদিকে তা যেমন বিদ্যাসাগরের রাশভারী, জেদি, বাহুল্যবর্জিত চরিত্রটির অনাবিষ্কৃত একটি দিকের ওপর আলোকপাত করে, অন্যদিকে মহিলাদের তিনি দেখছেন কীভাবে, সেই চাক্ষিক চর্চার গতি-প্রকৃতি, ঝোঁক, ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে বঙ্গীয় রেনেসাঁসের নিরিখে মহিলাদের সামাজিক অবস্থানের কথাও জানান দেয়। বিদ্যাসাগর নারী এবং সাহিত্যে নারীচরিত্রদের প্রধানত দেখছেন সৌন্দর্য, আদর্শ বা ট্রাজিক চরিত্র হিসেবে। তবে voyeuristic বা ঈক্ষণকামীর দৃষ্টি দিয়ে দেখার উদাহরণও তাঁর রচনায় নিতান্ত কম নয়। নারীচরিত্রদের দেখতে গিয়ে শব্দে আঁকছেন যেভাবে, তার একটি নমুনা এখানে তুলে দেওয়া গেল। বাকি আরও কিছু উদাহরণ আলোচিত হবে এই সন্দর্ভেরই পরবর্তী অংশে। কলকাতায় আসার পর জগদ্দুর্লভ সিংহের বাড়িতে আতিথ্যে থেকে বালক বিদ্যাসাগরের পঠনপাঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ওই পরিবারে অত্যন্ত স্নেহ এবং আন্তরিকতার মধ্যে বেড়ে উঠছিলেন ঠিকই, তবু, পিতামহীর অত্যন্ত স্নেহের পাত্র ও অনুগামী বিদ্যাসাগর গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে স্থানচ্যুত হওয়ার কারণে স্বভাবতই বিচলিত হয়েছিলেন। জগদ্দুর্লভের ছোট বোন রাইমণির কিছু বাড়তি স্নেহ ছিল বিদ্যাসাগরের প্রতি। রাইমণির নিজের পুত্র গোপালচন্দ্র ঘোষ ও বিদ্যাসাগর ছিলেন প্রায় সমবয়সি। কিন্তু দু’জনের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ রাখেননি রাইমণি। রাইমণিকেই আঁকড়ে ধরবে আট বছরের বালক; তাঁর মধ্যেই মা/পিতামহীকে খুঁজবে সে, বলা বাহুল্য। ফলত, স্নেহ, দয়া, সৌজন্য, ইত্যাদির বোধ বিদ্যাসাগরের মধ্যে তৈরি হয় মূলত এই সম্পর্কটির মধ্যে দিয়ে।১৩ তাঁর আত্মজীবনীতে বিদ্যাসাগর এ কথা সবিস্তারে জানিয়েছেন:

… ফলকথা এই, স্নেহ, দয়া, সৌজন্য, অমায়িকতা, সদ্বিবেচনা, প্রভৃতি সদ্‌গুণ বিষয়ে রাইমণির সমকক্ষ স্ত্রীলোক এ পর্য্যন্ত আমার নয়নগোচর হয় নাই। এই দয়াময়ীর সৌম্য-মূর্ত্তি, আমার হৃদয়-মন্দিরে, দেবী-মূর্ত্তির ন্যায় বিরাজমান হইয়া প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। প্রসঙ্গক্রমে তাঁহার কথা উপস্থিত হইলে, তদীয় অপ্রতিম গুণের কীর্ত্তন করিতে করিতে, অশ্রুপাত না করিয়া থাকিতে পারিনা। আমি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী বলিয়া অনেকে নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। আমার বোধ হয়, সে নির্দ্দেশ অসঙ্গত নহে। যে ব্যক্তি রাইমণির সেই দয়া, সৌজন্য প্রভৃতি প্রত্যক্ষ করিয়াছে, এবং ওই সমস্ত সদ্‌গুণের ফলভোগী হইয়াছে, সে যদি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী না হয়, তাহা হইলে তাহার তুল্য কৃতঘ্ন, পামর ভূমণ্ডলে নাই।১৪

বিদ্যাসাগর গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে গৃহকাতরতা ও স্থানচ্যুত হওয়ার সংকট কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন রাইমণির কারণেই। রাইমণিকে শুধু ‘স্নেহ, দয়া, সৌজন্য, অমায়িকতা, সদ্বিবেচনা’র চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা হিসেবেই নয়, তাঁর ‘দয়াময়ীর সৌম্য-মূর্ত্তি’ বিদ্যাসাগর দেখেছিলেন একটি রূপের আকারে; দেবী-মূর্তির সাদৃশ্যে। হৃদয়-মন্দিরে গেঁথে নিয়েছিলেন সেই ছবি।

চতুর্থ ঘটনা: হডসন্ সাহেবকে দিয়ে বাবা-মায়ের প্রতিকৃতি আঁকানোর পরিপ্রেক্ষিতে উনিশ শতকের রক্ষণশীল বাঙালি সমাজে বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গে কথোপকথন। পাইকপাড়া রাজবাড়িতে সে যুগের প্রখ্যাত প্রতিকৃতি-শিল্পী হডসন্ সাহেব এসেছেন বাড়ির সদস্যদের প্রতিকৃতি আঁকার জন্যে। তাঁর পারিশ্রমিকও অত্যন্ত বেশি। সে বাড়িতেই বিদ্যাসাগরের মতো যশস্বীর প্রতিকৃতি সাহেব বিনা পারিশ্রমিকে স্বেচ্ছায় এঁকে দেন। অনেক ওজর-আপত্তি সত্ত্বেও সাহেব টাকা নিতে রাজি না হওয়ায় শেষে বাবা এবং মায়ের প্রতিকৃতি বহুমূল্য ব্যয় করে সাহেবকে দিয়ে আঁকিয়ে নেবেন ঠিক করেন বিদ্যাসাগর। বীরসিংহ থেকে কলকাতায় যেতে হবে ভেবে ভগবতী দেবী প্রথমে গররাজি ছিলেন:

মা।। দু্র্, আমার আবার ছবি কি হবে, ছি-ছি।

ঈ।। ছবি কি তোমার জন্যে? ছবি আমার জন্যে; একখানা ছবি থাকলে, যখন যেখানে থাকি, প্রাণটা কেমন ক’রলে একবার দেখবো।১৫

তাতেও মা আপত্তি করলে উত্তরে বিদ্যাসাগর অকাট্য যুক্তি দেখিয়ে বলছেন, কলকাতায় ‘সব যোগাড় আছে’, তবে, ‘সে আড্ডা ভাঙ্গিয়া এখানে আন্‌তে গেলে, হয়ত ছবি ভাল হবে না।’ ছেলের এমন কথা মা ফেলতে পারেননি। ফলত, হডসন্ সাহেবের আঁকা ভগবতী দেবীর ছবিটি আমাদের পক্ষে দেখা সম্ভব হয় চণ্ডীচরণের বইতে। মায়ের শারীরিক অনুপস্থিতিতে তাঁর অসদ্‌বিম্বটিই চাক্ষিক ঘাটতি পূরণ করবে, এ কথা যদি মায়ের মন ভোলানোর জন্য এবং সেই ঘটনায় মান বাঁচানোর জন্য তিনি বলেও থাকেন, তা হলেও আড্ডা ভঙ্গ হলে ছবি ভাল হবে না এমন আশঙ্কা তিনি মাত্রেই করবেন যিনি প্রকৃত শিল্পী, অথবা, যাঁর শিল্পচর্চা কদর করার রুচি ও ক্ষমতা, দুই-ই আছে। এমনকী, সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উপাদান সংগ্রহের প্রসঙ্গে তাঁর এই মনটিতে এক ‘শিল্পীজনোচিত বেদনাবোধ’ আছে বলে রবীন্দ্রনাথও মনে করছেন।১৬

এ ছাড়া, ইন্দ্রমিত্র তাঁর করুণাসাগর বিদ্যাসাগর জীবনীগ্রন্থতে শশিভূষণ বসুর অভিজ্ঞতা বিবৃত করে জানাচ্ছেন: বিদ্যাসাগরের লাইব্রেরিতে বিদেশ থেকে ভাল বই বেরলে তা বাঁধিয়ে পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া ছিল বিক্রেতাদের। এর মধ্যে আরভিং-এর স্কেচ-বুকও ছিল তাঁর লাইব্রেরিতে। যার বাঁধাইয়ের দাম বইটির চেয়ে ঢের বেশি। সম্ভবত এই স্কেচ-বুক উনিশ শতকীয় ব্রিটিশ আর্টিস্ট ব্রুস আরভিং-এর।১৭

এই কয়েকটি ঘটনার সাপেক্ষে অনুমান করা অসম্ভব নয় যে চাক্ষিক চর্চার প্রতি বিশ্বাস এবং ঝোঁক বিদ্যাসাগরের ছিল। ফলত, শিল্পরসে তাঁর অনাগ্রহ ছিল, এমন কথাও বলা যাচ্ছে না। এই যুক্তির পথ ধরেই বিদ্যাসাগর রচিত চাক্ষিক জগতের নিরিখে আঁচ করা যায় উনিশ শতকের সাংস্কৃতিক মনস্তত্ত্বর ধারাটি— সে যুগের কল্পনাশক্তি, উদ্ভাবন ও ইউটোপিয়া এবং সমসাময়িকতার নিরিখে বিদ্যাসাগর কীসের অনুপস্থিতি লক্ষ করে কোন উপাদানের সাহায্যে সেই সেই ফাঁকগুলি ভরাট করলেন।১৮

রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিদ্যাসাগরচরিত (আনু. ১৯০৯ খ্রি.) গ্রন্থে লিখছেন:

বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। তৎপূর্বে বাংলায় গদ্যসাহিত্যের সূচনা হইয়াছিল, কিন্তু তিনিই সর্বপ্রথমে বাংলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন।… তিনি দেখাইয়াছিলেন যে, যতটুকু বক্তব্য তাহা সরল করিয়া, সুন্দর করিয়া এবং সুশৃঙ্খল করিয়া, ব্যক্ত করিতে হইবে। (পৃ. ৮)

পাঠক খেয়াল করবেন, ‘শিল্পী’ এবং ‘কলানৈপুণ্য’ শব্দ দু’টির ব্যবহার। রবীন্দ্রনাথ নিজে পরবর্তীকালে শিল্পচর্চা করেছেন বলে নয়, সততই তিনি বিদ্যাসাগরের গদ্যের চাক্ষিক রূপটিও (visual form) খেয়াল করছেন এবং বর্ণনা দিচ্ছেন এই বলে:

… সমাজবন্ধন যেমন মনুষ্যত্ববিকাশের পক্ষে অত্যাবশ্যক তেমনি ভাষাকে কলাবন্ধনের দ্বারা সুন্দররূপে সংযমিত না করিলে সে ভাষা হইতে কদাচ প্রকৃত সাহিত্যের উদ্ভব হইতে পারে না।… বিদ্যাসাগর বাংলাগদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন এবং সুসংযত করিয়া তাহাকে সহজ গতি ও কার্যকুশলতা দান করিয়াছেন। (বিদ্যাসাগরচরিত, পৃ. ৯)

এই দেখা শুধু রবীন্দ্রনাথের নয়, আগেই বলেছি— বিদ্যাসাগরেরও সেই চাক্ষিক যুক্তিবোধ ছিল। ফলে শব্দ লেখার সময় চোখের আরামের প্রতিও তিনি সতর্ক হবেন না এবং একটি নির্মেদ ফরম্যাট সৃষ্টিতে সচেষ্ট হবেন না, এমনটা আশা করা যায় না।

পড়তে গিয়ে যাতে হোঁচট না খায় চোখ, সেজন্য বিদ্যাসাগর বেতালপঞ্চবিংশতি-র দশম সংস্করণে ইংরিজি ছেদচিহ্ন ব্যবহার করতে শুরু করেন। দশম সংস্করণের বিজ্ঞাপনে বলা হল:

বেতালপঞ্চবিংশতি দশমবার প্রচারিত হইল। এই পুস্তক, এতদিন, বাঙ্গালা ভাষার প্রণালী অনুসারে, মুদ্রিত হইয়াছিল; সুতরাং, ইঙ্গরেজী পুস্তকে যে সকল বিরামচিহ্ন ব্যবহৃত হইয়া থাকে, পূর্ব্ব পূর্ব্ব পুস্তকে সে সমুদয় পরিগৃহীত হয় নাই। এ সংস্করণে সে সমস্ত সন্নিবেশিত হইল।১৯

যদিও বাংলা গদ্যে ইংরিজি ছেদচিহ্নের ব্যবহার বিদ্যাসাগরের বহু আগে থেকে রয়েছে, তবু এর উল্লেখ থেকে বিরত থাকা কঠিন, কারণ, নিজের রচনাতেও তিনি অনুভব করছেন পড়তে গিয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়ার যথার্থ একটি চাক্ষুষ সংকেতের অনুপস্থিতি। ফলত, এই adaptation।

এ বিষয়ে আরও একজন আমাদের সন্দেহের নিরসন করছেন। তিনি চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিদ্যাসাগর রচিত বেতালপঞ্চবিংশতি প্রকাশের পর তিনি জানাচ্ছেন:

বেতালপঞ্চবিংশতির প্রথম সংস্করণের ভাষা তাদৃশ প্রাঞ্জল হয় নাই। সংস্কৃতমূলক কঠিন শব্দসকল ঐ পুস্তকের অঙ্গাভরণ রূপে বিরাজিত ছিল, উদাহরণস্থলে উল্লেখ করা যাইতে পারে— ‘উত্তালতরঙ্গমালাসঙ্কুল উৎফুল্লফেননিচয়চুম্বিত ভয়ঙ্কর তিমিমকরনক্রচক্রভীষণ স্রোতস্বতীপতিপ্রবাহ মধ্য হইতে সহসা এক দিব্য তরু উদ্ভূত হইল।’ এরূপ বহুসমাসসমন্বিত পদাবলী যে পাঠকের রুচিকর হইবে না, তাহা তিনি ত্বরায় বুঝিতে পারিয়াছিলেন। এই জন্য বেতালের পরবর্তী সংস্করণ সকলে ক্রমে ক্রমে ঐরূপ স্থানগুলি পরিবর্ত্তিত হইয়াছে। বর্ত্তমান সংস্করণের ভাষা প্রাঞ্জল ও লালিত্যপূর্ণ।২০

শুধুমাত্র ‘ভাষা প্রাঞ্জল ও লালিত্যপূর্ণ’ হওয়া ছাড়াও বেতালের যে পদবিন্যাসকে ‘সুমধুর’ আখ্যা দিচ্ছেন চণ্ডীচরণ, দৃশ্যত তার সরলীকরণ করেছেন বিদ্যাসাগর। পরবর্তী সংস্করণে আমূল পালটে যাচ্ছে পদের ফর্ম্যাল চেহারা, সংস্কৃতমূলক কঠিন শব্দের বদলে সরাসরি ব্যবহৃত হয়েছে বাংলা ভাষার সাধু রূপটি, যার ফলে যেকোনও অংশ পড়ামাত্র পাঠকের ‘তৃপ্তিলাভ’ হয় বলে দাবি করেছেন চণ্ডীচরণ। অসীম সাহস ছাড়া এই আমূল পরিবর্তন পরের সংস্করণেই সম্ভব হত না। সেই জেদ এবং সাহস বিদ্যাসাগরের যে ছিল, বলা বাহুল্য।২১ পরবর্তী সংস্করণে বেতালের গদ্য এইরকম:

এই সময়ে সেই সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী রমণী, রাজার সম্মুখে আসিয়া দণ্ডায়মান হইল; এবং তদীয় সৌন্দর্য্য দর্শনে মোহিত হইয়া কহিল, মহারাজ! আমার প্রতি যে আজ্ঞা করিবেন তাহাই শিরোধার্য্য করিব।২২

এমন শ্রুতিমধুর, নির্মেদ গদ্যের সঙ্গে পাঠকের আত্মীয়তা যে গড়ে উঠবেই তাতে সন্দেহ নেই। ‘সংস্কৃতমূলক কঠিন শব্দ’-র বদলে আকারে ছোট পদগুলি এই নির্মেদ রূপ তৈরিতে সাহায্য করেছে। এ ছাড়া চাক্ষিক মাধ্যমের পূর্ববর্তী যুগে যে visual reference-এর এবং আবহের (mood) প্রয়োজন ছিল, তা তাঁর আগে কখনও দেখা যায়নি বাংলা গদ্যে, চণ্ডীচরণ এমনও দাবি করছেন:

এইরূপ সুমধুর পদবিন্যাস, ভাষা ও ভাবের সমাবেশ ইতিপূর্ব্বে কোন গ্রন্থেই পরিলক্ষিত হয় নাই। রচনা বিষয়ে বেতাল সে সময়ের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ পুস্তক। ভাষা বিষয়ে বেতালই বর্ত্তমান বাঙ্গালা সাহিত্যের সর্ব্ব প্রথম গ্রন্থ।২৩

বিষয়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, বিদ্যাসাগরের রচনাশৈলীও পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন, টান টান উত্তেজনার আবহ বা দৃশ্যকল্প দেখতে পাই ভ্রান্তিবিলাস-এ (সংবৎ ১৯৩২) দুর্যোগে জাহাজের দুর্ঘটনার বর্ণনায়, সোমদত্তর বয়ানে:

মলয়পুর ত্যাগ করিয়া যোজনমাত্র গমন করিয়াছি, এমন সময়ে অকস্মাৎ গগনমণ্ডল নিবিড় ঘনঘটায় আচ্ছন্ন হইল, প্রবল বেগে প্রচণ্ড বাত্যা বহিতে লাগিল, সমুদ্র উত্তাল তরঙ্গমালায় আন্দোলিত হইয়া উঠিল। আমরা জীবনের আশায় বিসর্জন দিয়া, প্রতি ক্ষণেই মৃত্যুপ্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম।২৪

এরপর জাহাজ জলমগ্ন হয়ে যাওয়াতে নাবিকেরা প্রাণ বাঁচাতে, ডিঙি নৌকাতে চড়ে পালিয়ে যায়। আর উপায়ান্তর না দেখে সোমদত্ত এক উপায় বার করলেন:

অর্ণবপোতে দুটি অতিরিক্ত গুণবৃক্ষ ছিল; একের প্রান্তভাগে জ্যেষ্ঠ পুত্র ও জ্যেষ্ঠ ক্রীত শিশুকে, অপরটির প্রান্তভাগে কনিষ্ঠ পুত্র ও কনিষ্ঠ ক্রীত শিশুকে বন্ধনপূর্ব্বক আমরা স্ত্রীপুরুষে একৈকের ওপর প্রান্তভাগে এক এক জন করিয়া আপনাদিগকে বদ্ধ করিলাম। দুই গুণবৃক্ষ, স্রোতের অনুবর্ত্তী হইয়া, ভাসিতে ভাসিতে চলিল। বোধ হইল, আমরা কর্ণপুর অভিমুখে নীত হইতেছি। কিয়ৎক্ষণ পরে, সূর্য্যদেবের আবির্ভাব ও ব্যাত্যার তিরোভাব হইল।২৫

ঝড়, মৃত্যুর মোকাবিলা, বিচ্ছেদের ইঙ্গিত সংবলিত ঘটনার বর্ণনার পাশাপাশি দেখার মজা না থাকলে, বা কল্পনাজগৎকে উৎসাহিত না করলে উনিশ শতকের পাঠকের কাছে তা উপভোগ্য হয়ে উঠত না।

এ ব্যতিরেকে, শেক্সপিয়র-এর দ্য কমেডি অব এররস-এর চরিত্রদের নাম বদলে ভ্রান্তিবিলাস-এর চরিত্র/স্থানের নামের তালিকাটি এমন: ইজিয়ন (Egeon) হয়েছেন সোমদত্ত; সোলিনাস (Solinus) বিজয়বল্লভ; এফেসাস (Ephesus) হয়েছে জয়স্থল; এপিড্যামনাম (Epidamnum) মলয়পুর২৬; সাইরাকিউস (Syracuse) হেমকূট। এই আত্তীকরণ, এই mnemonic, এও তো দেখারই ফল। স্মর্তব্য, এই চরিত্র/স্থানের নাম পাঠক পড়তে গিয়ে শোনার সঙ্গে চাক্ষুষ করবেন এবং বলা বাহুল্য বিজাতীয় বলে তাঁদের দূরে সরিয়ে দেবেন না।

গ্রিক নামগুলিকে বিদ্যাসাগর একেবারে বাংলায় রূপান্তরিত করে দিলেন নির্দ্বিধায়, মানচিত্রের সমস্ত ভেদাভেদ ঘুচিয়ে, রাজনৈতিক সীমারেখা মুছে ফেলে; এক সাংস্কৃতিক অভিযোজনের (acculturation) মধ্যে দিয়ে। এমনকী, নামের আদ্যক্ষরে পর্যন্ত মিল নেই! অথচ, এই অভিযোজন হচ্ছে এমন এক সময়ে, যখন ঔপনিবেশিকতা আমাদের ঘাড়ে চেপে বসায় ভারতীয় ইতিহাস মুছে যায় প্রায়। বিদেশি শাসক এদেশে ধাতস্থ (acclimatized) হতে চাওয়ার ফলে তাদের হাতে তখন আমরাই পোশাক-আশাকে, চালচলনে re-created হচ্ছি।২৭ নিজের দেশের জলহাওয়াতে সৃষ্ট নামগুলি নেওয়ার সপক্ষে বিদ্যাসাগর ভ্রান্তিবিলাস-এর বিজ্ঞাপনে যুক্তি দিচ্ছেন এই বলে:

বাঙ্গালাপুস্তকে ইয়ুরোপীয় নাম সুশ্রাব্য হয় না; বিশেষতঃ, যাঁহারা ইঙ্গরেজী জানেন না, তাদৃশ পাঠকগণের পক্ষে বিলক্ষণ বিরক্তির হইয়া উঠে। এই দোষের পরিহারবাসনায়, ভ্রান্তিবিলাসে সেই সেই নামের স্থলে এতদ্দেশীয় নাম নিবেশিত হইয়াছে। উপাখ্যানে এবংবিধ প্রণালী অবলম্বন করা কোনও অংশে হানিকর বা দোষাবহ হইতে পারে না। ইতিহাসে বা জীবনচরিতে নামের যেরূপ উপযোগিতা আছে, উপাখ্যানে সেরূপ নহে।২৮

বিদ্যাসাগরের দৃশ্যকল্প শুধুমাত্র মূল কাহিনিগুলি থেকে হুবহু নেওয়া হয়েছে এমন ভাবা অনুচিত হবে। বিশেষত যখন সংকলিত গদ্যের ক্ষেত্রেও আত্তীকরণের প্রতি তাঁর তীব্র ঝোঁক বোঝা যায়। অনুমেয়, এই দৃশ্যকল্প অনেকাংশেই তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি। দৃশ্যকল্পের অগুনতি অতুলনীয় বর্ণনা— ‘মেঘ’, ‘অগ্নীধ্র রাজার উপাখ্যান’, ‘কবি-প্রতিভা’, ইত্যাদি— বালক বিদ্যাসাগর রচিত সংস্কৃত পদ্যে পাওয়া যায় (বিহারীলাল সরকার, বিদ্যাসাগর, পৃ. ৯৭-১১০)। এর বাইরে, সংস্কৃত কলেজের প্রথম বর্ষে তিনি পড়েছেন রঘুবংশ, কুমারসম্ভব প্রভৃতি। দ্বিতীয় বর্ষে মাঘ, ভারবি, মেঘদূত, শকুন্তলা ইত্যাদি। পনেরো বছর বয়সে সংস্কৃত পাঠের সময় যে বৃত্তি পেয়েছিলেন তিনি, তাতে সেই সময় অর্থের সঙ্গে পুস্তক দেওয়ার রীতি ছিল। বিদ্যাসাগর পুস্তকের মধ্যে পেয়েছিলেন রঘুবংশ, সাহিত্যদর্পণ, রত্নাবলী, মালতীমাধব, মৃচ্ছকটিক, মুদ্রারাক্ষস, বিক্রমোর্বশী (বিহারীলাল সরকার, বিদ্যাসাগর, পৃ. ৮২-৮৩)। এহেন রচনায় দৃশ্যকল্প এবং দীর্ঘ বর্ণনা হল কেন্দ্রীয় উপাদান। এগুলি তাঁর মতো উৎসাহী পাঠকের কল্পনাকে উদ্বুদ্ধ করবে না ভাবা কষ্টকর। সে যুগের অন্যান্য পুস্তকও তিনি নিশ্চয় পড়ে উপভোগ করেছেন।

বিদ্যাসাগরের লেখায় তাঁর চরিত্রদের ছবিটি ফুটিয়ে তোলার (বা শব্দে এঁকে দেওয়ার) মধ্যে দিয়েও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। নারীচরিত্রকে তিনি কেমনভাবে দেখছেন তার অনেকটা দ্রষ্টব্য সীতা বা শকুন্তলার বর্ণনায়। রামচন্দ্র বা দুষ্মন্তের মধ্য দিয়ে পুরুষের দৃষ্টি বা সংকটের মতো বিষয়গুলির সম্মুখীন হচ্ছেন কেমন করে; উনিশ শতকের যৌনতা, নারীর শুচিতা রক্ষা, পাতিব্রত্য বা নারীকে বস্তু হিসেবে দর্শনের মতো বিষয়গুলি বিদ্যাসাগরের গদ্যে উপস্থাপিত হচ্ছে যেভাবে, তাতে বিস্ময়ের অবকাশ থাকে না।

ধরা যাক অন্তঃসত্ত্বা সীতার প্রতি বিদ্যাসাগরের আচরণ। সীতার বনবাস (সং ১৯৫৮)-এর প্রথম পরিচ্ছেদ-এ উল্লেখ করা হচ্ছে সীতার ‘গর্ভলক্ষণ’ দেখা দেওয়ার কথা:

কালক্রমে, জানকীর গর্ভলক্ষণ আবির্ভূত হইল। তদ্দর্শনে রামের ও রামজননী কৌশল্যার আহ্লাদের সীমা রহিল না; সমস্ত রাজভবন উৎসবে পূর্ণ হইল…২৯

এর পরের পৃষ্ঠাতে বলা হচ্ছে কিছুদিন পর মহর্ষি ঋষ্যশৃঙ্গ এক যজ্ঞের আয়োজন করেন, তাতে রাজা রাম এবং তাঁর পরিবারবর্গ নিমন্ত্রিত হয়েছেন কিন্তু ‘এই সময়ে জানকীর গর্ভ প্রায় পূর্ণ অবস্থায় উপস্থিত; এজন্য তিনি এবং, তদনুরোধে রাম ও লক্ষ্মণ, নিমন্ত্রণরক্ষা করিতে পারিলেন না;…’

এর ফলে বাকি অগ্রজরা নিমরাজি হয়ে গেলেন সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। এর কিছুদিন আগেই রাজা জনক এসেছিলেন মেয়ে-জামাইকে দেখতে, কিন্তু কৌশল্যারা সবাই যজ্ঞে যাবেন দেখে তিনিও মিথিলায় ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। একে তো ওই অবস্থা, তাতে শ্বশুরবাড়ির সকলকে বিদায় দিয়ে বাপের বাড়ির লোকেদেরকেও ছেড়ে থাকতে হবে ভেবে জানকীর ভারী মনখারাপ। আশঙ্কার কথা এই যে—

পূর্ণগর্ভ অবস্থায় শোকমোহাদি দ্বারা অভিভূত হইলে, অনিষ্টাপাতের বিলক্ষণ সম্ভাবনা; এজন্য রামচন্দ্র, সর্ব্বকর্ম্মপরিত্যাগপূর্ব্বক, সীতার সান্ত্বনার নিমিত্ত সতত তৎসন্নিধানে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন।

বিদ্যাসাগর যেন সেই গার্হস্থ্য জগতের এক বাসিন্দা। কীভাবেই-বা এই অবস্থায় সীতাকে ফেলে রেখে যাওয়া যায়? তাঁর আবদার, আশঙ্কা, পরিবারের লোকেদের উদ্বেগ, হাজারো মাথাব্যথা, সব যেন বিদ্যাসাগর দেখছেন এক স্বাভাবিক অন্তরঙ্গতায়, পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যের মতোই (এমনকী গর্ভাবস্থা এবং গর্ভপাত বিষয়েও যিনি উদ্বিগ্ন)।

যদিও যে সময় বিদ্যাসাগরের নারীচরিত্ররা সৃষ্ট হচ্ছেন, সেটা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময়। সেই সময়ের নিরিখে দেশবাসীর কল্পনায় এবং সাংস্কৃতিক মনস্তত্ত্বে দেশমাতৃকা, বা দেবীমূর্তি পরাজয়ের গ্লানি থেকে উত্তরণের পথের দিশা হয়ে ওঠে। একটি জাতির রন্ধ্রে আদর্শ নারীমূর্তির ভাবধারার নৈতিক বার্তা পৌঁছে দেবার কাজটি সম্পন্ন হয়। সুতরাং, সৌন্দর্য এবং আদর্শের ওপর বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া সে যুগের রীতি। তবে এই প্রথাগত দৃষ্টান্তের ব্যতিরেকেও বিদ্যাসাগর যত ধরনের পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখছেন/দেখাচ্ছেন নারীচরিত্রদের, তার বহুস্তরীয় ধরনটি আমাদের বিস্মিত করে।

শকুন্তলা লেখার সময় তিনি বিলক্ষণ জানেন যে, কালিদাসের মূল সংস্কৃত থেকে নিয়ে তাঁর সরলীকরণ করা মূল রচনাটি যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা ভাল চোখে তা নেবেন না। তাই শকুন্তলা-র ‘বিজ্ঞাপন’-এ তিনি জানাচ্ছেন:

যাঁহারা অভিজ্ঞানশকুন্তল পাঠ করিয়াছেন, এবং এই উপাখ্যান পাঠ করিবেন, চমৎকারিত্ব বিষয়ে উভয়ের কত অন্তর তাহা অনায়াসে বুঝিতে পারিবেন; এবং, সংস্কৃতানভিজ্ঞ পাঠকবর্গের নিকট, কালিদাসের ও অভিজ্ঞানশকুন্তলের এই রূপে পরিচয় দিলাম বলিয়া, মনে মনে, কত শত বার, আমায় তিরস্কার করিবেন।

দেখা যাক শকুন্তলা-য় দেখার কাজটি (‘gaze’) সম্পাদন হচ্ছে কীভাবে। রাজা দুষ্মন্ত মৃগয়ায় এসে তপোবনে প্রবেশের পর, সখীদের সঙ্গে শকুন্তলাকে আবিষ্কার করে অভিভূত হয়ে ভাবছেন:

… ইহারা আশ্রমবাসিনী; ইহারা যেরূপ, এরূপ রূপবতী রমণী আমার অন্তঃপুরে নাই। বুঝিলাম, আজি উদ্যানলতা সৌন্দর্য্যগুণে বনলতার নিকট পরাজিত হইল। এই বলিয়া তরুচ্ছায়ায় দণ্ডায়মান হইয়া তাহাদিগকে অবলোকন করিতে লাগিলেন।৩০

এরপর শকুন্তলা আশ্রমের গাছগুলিতে জল দিতে এলে, তাঁকে চিনতে পেরে দুষ্মন্ত অনুতাপ করে বলছেন:

এই সেই কণ্বতনয়া শকুন্তলা! হায়! মহর্ষি অতি অবিবেচক, এমন শরীরে বল্কল পরাইয়াছেন। কিন্তু, যেমন প্রফুল্ল কমল শৈবালযোগেও বিলক্ষণ শোভা পায়, যেমন পূর্ণ শশধর কলঙ্কসম্পর্কেও সাতিশয় শোভমান হয়, সেইরূপ এই কৃশাঙ্গী বল্কল পরিধান করিয়া যার পর নাই মনোহারিণী হইয়াছেন। যাহাদের আকার স্বভাবসুন্দর, তাহাদের কি না অলঙ্কারের কার্য্য করে।

দুই পুরুষ বন্ধুর মধ্যে কথোপকথনের বিষয় যখন শকুন্তলা, তখন male gaze-এর ধরনটি জানতে আমাদের কৌতূহল থাকবেই। ফিরে গিয়ে দুষ্মন্ত বন্ধু মাধব্যকে শকুন্তলার বর্ণনা দিচ্ছেন:

বয়স্য! অধিক আর কি বলিব, তার শরীর মনে করিলে মনে এই উদয় হয়, বুঝি বিধাতা প্রথমতঃ চিত্রপটে চিত্রিত করিয়া পরে জীবনদান করিয়াছেন, অথবা, মনে মনে মনোমত উপকরণসামগ্রী সকল সঙ্কলন করিয়া, মনে মনে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি যথাস্থানে বিন্যাসপূর্ব্বক, মনে মনেই তাহার শরীর নির্মাণ করিয়াছেন, হস্ত দ্বারা নির্মিত হইলে শরীরের সেরূপ মার্দ্দব ও রূপলাবণ্যের সেরূপ মাধুরী সম্ভাবিত না। ফলতঃ, ভাই রে, সে এক অভূতপূর্ব্ব স্ত্রীরত্নসৃষ্টি।

এই বর্ণনা শুনে মাধব্যের ধারণা হল যে শকুন্তলা ‘যাবতীয় রূপবতীদিগের পরাভবস্থান’। দুষ্মন্ত তাঁকে আরও জানান যে:

তাহার রূপ অনাঘ্রাত প্রফুল্ল পুষ্প স্বরূপ, নখাঘাতবর্জ্জিত নব পল্লব স্বরূপ, অপরিহিত নূতন রত্ন স্বরূপ, অনাস্বাদিত অভিনব মধু স্বরূপ, জন্মান্তরীণ পুণ্যরাশির অখণ্ড ফল স্বরূপ; জানি না, কোন ভাগ্যবানের ভাগ্যে সেই নির্মল রূপের ভোগ আছে।

শেষের এই তিনটি অকপট বর্ণনার ক্ষেত্রে কিন্তু বিদ্যাসাগর আর সেই পরিবারের অন্দরের সমঝদার সদস্যটি নন। দুষ্মন্তর চোখ দিয়ে, একেবারে voyeuristic বা scopophilic দৃষ্টি দিয়েই দেখছেন অক্ষতযোনি শকুন্তলাকে। সীতার বনবাস বা শকুন্তলা সচিত্র ছিল না। কিন্তু লেখার গুণে পাঠকের পক্ষে ঠাহর (visualize) করে নিতে বেগ পেতে হয় না দৃশ্যগুলি। অন্য দিকে, চরিত্রদের বিচরণক্ষেত্রগুলি পালটে গেলে৩১ দেখা এবং লেখার গুণে অন্দরমহলের আন্তরিকতার বেষ্টনী ভেঙে আগন্তুকের ঈক্ষণকামী দৃষ্টিতে পৌঁছতে অনায়াস বিদ্যাসাগর।

এই চাক্ষিকতার প্রসঙ্গে শকুন্তলা থেকে আরও একটি ঘটনা উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করা সম্ভব হল না। এতে, বিদ্যাসাগর যে নিতান্ত বেরসিক ছিলেন না তার কিছুটা নজির মিলবে। রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে তাঁর নামাঙ্কিত অঙ্গুরীয় দিয়ে ‘ঋণ মুক্ত’ করার পরও শকুন্তলা তাঁকে ছেড়ে সেই জায়গা থেকে যেতে পারছেন না। এতে দুষ্মন্ত মনে মনে ভাবছেন:

… আমি ইহার প্রতি যেরূপ, এ আমার প্রতি সেরূপ কি না, বুঝিতে পারিতেছি না। অথবা, আর সন্দেহের বিষয় কি? কারণ, আমার সহিত কথা কহিতেছে না, অথচ আমি কথা কহিতে আরম্ভ করিলে অনন্যচিত্ত হইয়া স্থির কর্ণে শ্রবণ করে, নয়নে নয়নে সঙ্গত হইলে, তৎক্ষণাৎ মুখ ফিরাইয়া লয়, অথচ অন্যদিকেও অধিক ক্ষণ চাহিয়া থাকে না। অন্তঃকরণে অনুরাগসঞ্চার না হইলে এরূপ ভাব হয়…

সীতার বনবাস-এ চিত্রদর্শন পর্বটি বিস্ময়করভাবে চার পাতা জোড়া এক পর্ব। লক্ষ্মণ, অতীতের কিছু ঘটনাবলির এক ‘আলেখ্য’— সীতার অগ্নিপরিশুদ্ধিকাণ্ড পর্যন্ত— এক চিত্রকরকে দিয়ে আঁকিয়ে রাম ও সীতাকে দেখাতে এনেছেন। তাতে তাড়কাবধের সময় রামচন্দ্রকে দেবতাদের দেওয়া অস্ত্রবিশেষ; মিথিলাবৃত্তান্ততে হরধনুভঙ্গ বা বিবাহসভায় চার ভাইয়ের ছবি দেখতে দেখতে সীতা মন্তব্য করছেন: ‘চিত্র দেখিয়া বোধ হইতেছে, যেন সেই প্রদেশে ও সেই সময়ে বিদ্যমান রহিয়াছি।’

অর্থাৎ, সেই ছবি স্থান ও কাল (time and space)-এর ধারণা দেয় বা বিভ্রম (illusion) তৈরি করে। অর্থাৎ, তা প্রামাণিক (documentary) এবং নিঃসন্দেহে আর্কাইভ্যাল গুণযুক্ত, কারণ তা স্মৃতিচারণ এবং ফ্যান্টাসির মাধ্যম হয়ে ওঠে। তার ব্যতিরেকে, সেই চিত্রদর্শনের মধ্যে দিয়ে চরিত্রগুলির পুনর্নির্মাণও হয়। যেমন, ‘অগ্নিপরিশুদ্ধিকাণ্ড’-র কথা শোনা মাত্র রাম ক্ষুব্ধ হচ্ছেন ও লক্ষ্মণকে বলছেন:

বৎস, তুমি আমার সম্মুখে আর ও কথা মুখে আনিও না; ও কথা শুনিলে, অথবা মনে হইলে, আমি সাতিশয় লজ্জিত ও কুণ্ঠিত হই। কি আক্ষেপের বিষয়! যিনি জন্মপরিগ্রহ করাতে জগৎ পবিত্র হইয়াছে, তাঁহাকে আবার অন্য পাবন দ্বারা পূত করিতে হইয়াছিল। হায়! লোকরঞ্জন কি দুরূহ ব্রত!

অথচ, সেই লোকরঞ্জনের জন্যই অন্তঃসত্ত্বা সীতাকে পরিহার করছেন রামচন্দ্র, এই বলে:

যদি রাজা হইয়া প্রজারঞ্জন করিতে না পারিলাম, তাহা হইলে জীবনধারণের ফল কী? দেখ, প্রজালোকে, সীতা অসতী বলিয়া, সিদ্ধান্ত করিয়া রাখিয়াছে; তাহাদের অন্তঃকরণ হইতে সেই সিদ্ধান্ত অপসারিত করা কোনও মতে সম্ভাবিত নহে। সুতরাং, সীতাকে গৃহে রাখিলে, তাহারা আমাকে অসতীসংসর্গী বলিয়া ঘৃণা করিবে। যাবজ্জীবন ঘৃণাস্পদ হওয়া অপেক্ষা প্রাণত্যাগ করা ভাল। আমি, প্রজারঞ্জনের অনুরোধে; প্রাণত্যাগে পরাঙ্মুখ নহি; তোমরা আমার প্রাণাধিক;… সে বিবেচনায়, সীতাপরিত্যাগ তাদৃশ দুরূহ ব্যাপার নহে। অতএব, তোমরা যত বল না কেন, ও যত অন্যায় হউক না কেন, আমি, সীতাকে গৃহ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া, কুলের কলঙ্কবিমোচন করিব, নিশ্চয় করিয়াছি।

চিত্রের সূত্রেই আমরা চাক্ষুষ করছি দ্বিতীয় এক রামচন্দ্রকে— male chauvinist, হৃদয়হীন, এবং নিতান্ত আত্মগত। চিত্রের এই অতীতচারিতার মধ্যে দিয়ে বিদ্যাসাগর স্মৃতির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করবেন না এমন ভাবা কষ্টকর কারণ, অনুপস্থিতি বা অতীতকে কাছে পেতে যে ছবি (আমি ফোটোগ্রাফির কথাও ধরছি)/আর্কাইভের গুরুত্ব অপরিসীম, তা ভগবতী দেবীর সঙ্গে প্রতিকৃতি আঁকানোর প্রসঙ্গে তাঁর কথোপকথনে আমরা পেয়েছি। বস্তুত ফোটোগ্রাফি নিয়ে বিস্তৃত পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন বিংশ শতাব্দীর যে মার্কিন দার্শনিক-প্রাবন্ধিক, সেই সুজান সনট্যাগ-এর সঙ্গে বিদ্যাসাগর চেতনার নিরিখে অতি প্রাচীন, এমনটাও মনে হয় না। অন্তত সনট্যাগ-এর লেখা অন ফোটোগ্রাফি (২০০৫) থেকে এই অংশটি পড়লে তাই-ই মনে হওয়া স্বাভাবিক:

Photographs really are experience captured, and the camera is the ideal arm of consciousness in its acquisitive mood. To photograph is to appropriate the thing photographed. It means putting oneself into a certain relation to the world that feels like knowledge—and, therefore, like power. … photographic images, which now provide most of the knowledge people have about the look of the past and the reach of the present.৩২

আবারও দেখি প্রতিকৃতি (এক্ষেত্রে ভাস্কর্য) কী জরুরি এক ভূমিকা নিচ্ছে অশ্বমেধ যজ্ঞে। রামচন্দ্র রাজ্যভার গ্রহণের পর যা-কিছু অনুষ্ঠান করণীয় ছিল, তার সব ক’টি-ই সম্পাদন করেছেন, বাকি শুধু অশ্বমেধ যজ্ঞ। যা শেষ হলে ধর্মকার্যও সম্পূর্ণ হয়। কিন্তু ঋষি বশিষ্ঠ স্মরণ করিয়ে দেন— ধর্মকার্য করতে গেলে সস্ত্রীক করতে হয়, কিন্তু সীতা বনবাসী হয়েছেন। অতএব রামচন্দ্রের দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ ছাড়া উপায় নেই। হৃদয়ে সীতা ব্যতীত অন্য কাউকে সে জায়গা ছাড়তে নারাজ রামচন্দ্র। শেষে, অনেক বাকবিতণ্ডার পর, সীতার ‘হিরণ্ময়ী প্রতিকৃতি’ ব্যবহার করেই সেই যজ্ঞ সম্পাদন করা হবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় (সীতার বনবাস, পৃ. ৮২)। ঋষি বাল্মীকি সেই যজ্ঞের আমন্ত্রণ পেয়ে ঠিক করলেন লব ও কুশকে নিয়ে সেখানে যাবেন। নিমন্ত্রণকারী পত্রবাহকটিকে জিজ্ঞেস করে লব ও কুশ জানতে পারে যে রামচন্দ্র দ্বিতীয় বিবাহ করেননি। ‘সীতার হিরণ্ময়ী প্রতিকৃতি নির্ম্মিত হইয়াছে; সেই প্রতিকৃতি সহধর্ম্মিণীর কার্য্যনির্বাহ করিবে’ (পৃ. ৮৯)। বলা বাহুল্য, এই নির্মিত ভাস্কর্যটিই সীতা, লব-কুশ এবং পাঠকের (বিশেষত উনিশ শতকীয়) মনে আশ্বাস এবং রামচন্দ্রের ওপর আস্থা ফিরিয়ে দেয়। লব এবং কুশ অগুনতি রাজা এবং মহাপুরুষের কথা শুনে থাকলেও ‘কিন্তু কেহই, কোন অংশে, রাজা রামচন্দ্রের সমকক্ষ নহেন’ (পৃ. ৮৩)। এর কারণ ওই ভাস্কর্য। প্রজারঞ্জনের কারণে স্ত্রী-পরিত্যাগ কিন্তু দারপরিগ্রহ না করেই এতকাল কাটানো, ‘এ উভয়ই অভূতপূর্ব্ব ব্যাপার’।

যে সীতা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় রাজপ্রাসাদে আলস্যের কবলে পড়লে রামচন্দ্র নিজের বাহু বাড়িয়ে দিয়েছেন, এবং বলছেন, সীতা যেন তাঁর হাত দু’টি দিয়ে রামচন্দ্রের গলা জড়িয়ে ধরে তাঁর বাহুর ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন; যে সীতার হাতের স্পর্শে রামচন্দ্রের মনে হচ্ছে তাঁর সারা শরীরে ‘অমৃতধারার বর্ষণ হইতেছে’; তাঁর সমস্ত ইন্দ্রিয় এক ‘অভূতপূর্ব্ব রসাবেশে অবশ’ হয়ে আসছে; তাঁর ‘চেতনা বিলুপ্তপ্রায় হইতেছে’, সেই সীতা রামচন্দ্রের এই অভিব্যক্তিতে ‘প্রার্থনা’ করছেন যেন ‘চির দিন এইরূপ স্নেহ ও অনুগ্রহ থাকে’। স্বামীর যৌন উত্তেজনাকে সীতা দেখছেন নিজের প্রতি ‘স্নেহ ও অনুগ্রহ’ হিসেবে। স্বামীর সেবাই তাঁর অভীষ্ট। তাঁর নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছে, কামনা-বাসনার কোনও নমুনা পাওয়া যায় না। অথচ, এই সীতাকেই পরিহারের পর তাঁর দীর্ঘ অনুপস্থিতিকে রামচন্দ্র রাজপ্রাসাদে বসে বসেই ধরে নিচ্ছেন ‘হয় তিনি আত্মঘাতিনী হইয়াছেন, নয় কোন দুরন্ত হিংস্র জন্তু তাঁহার প্রাণ সংহার করিয়াছে’। তা ভাবলে পাঠক শিউরে ওঠেন। একবার সীতাকে খুঁজতে দূতও পাঠাচ্ছেন না রামচন্দ্র। অথচ সমগ্র ভারতবর্ষের রাজা হয়েছেন তিনি; কিছুই তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়। সেই সীতাকেই আমরা আবিষ্কার করি রাম-বিয়োগের ফলে ক্ষয়িষ্ণু রূপে। লব-কুশ কৌশল্যাকে সীতার শারীরিক অবস্থা জানাচ্ছেন এই বলে যে, তিনি যেন ‘সর্ব্বদাই জীবন্মৃতপ্রায়’ এবং ‘দিন দিন ক্ষীণ হইতেছেন’; ‘তাহাতে বোধ হয় অধিক দিন বাঁচিবেন না’, ইত্যাদি। মহিলারা উপবাসী থাকবেন; প্রান্তিক কোনও জায়গায় বা জনান্তিকে থাকবেন; অপেক্ষা করবেন স্বামী/সমাজের স্বীকৃতির জন্য; তিনি ‘সর্ব্বগুণসম্পন্না’ হয়েও ‘দুঃখভাগিনী’ হলে তবেই আদর্শ চরিত্রে উন্নীত হতে পারছেন সাহিত্যে। এই চারিত্রিক দিকগুলি একত্রিত করে বিদ্যাসাগর সীতা প্রসঙ্গে উপনীত হচ্ছেন এই মন্তব্যে: ‘… বোধ হয়, দেবতা, মানব জাতিকে পতিব্রতাধর্ম্মে উপদেশ দিবার নিমিত্ত, সীতার সৃষ্ট করিয়াছিলেন।’

সীতার শরীর যেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ছেলেখেলার ক্ষেত্র। সে সমাজের খেয়ালমাফিক তাঁর শরীর কেন্দ্র থেকে প্রান্ততে যায় এক এক ভৌগোলিক সীমা পেরিয়ে— স্বামীর সঙ্গে নির্বাসনে জঙ্গলে; অপহৃত হয়ে লঙ্কায়, অশোক বনে (রাজপ্রাসাদে নয়); প্রজারঞ্জনের কারণে ভাগীরথী পেরিয়ে চোখের আড়ালে, বাল্মীকির তপোবনে এবং এর মধ্যেই সামাজিক স্বীকৃতির সুবাদে বার তিনেক সীতা অযোধ্যায় ফিরতে পেরেছেন। সীতা ‘অপবিত্র’ তাই তাঁকে দূরত্বে রাখা হচ্ছে। মিশেল ফুকো-র ‘অব আদার স্পেসেস’ (১৯৬৭) প্রবন্ধে আমরা যে ‘crisis heterotopia’ পাই, তাতে যেসমস্ত মানুষ, বিশেষত মহিলারা, কোনও সংকটের মধ্যে দিয়ে গেলে (ঋতুমতী হলে, বা বয়ঃসন্ধিকালে; গর্ভাবস্থায় বা প্রসবকালে আঁতুড়ঘরে; স্ত্রী/মেয়েটির কৌমার্যহরণের জন্য বাসস্থান থেকে অন্যত্র আয়োজন করা হয় মধুচন্দ্রিমা যাপনের, ইত্যাদি) তাঁদের বসবাসের জন্য এমন অপর স্থানের বন্দোবস্ত হয়। চোখের অন্তরালে এমন স্থানের কোনও ভৌগোলিক বিদ্যমানতা নেই (‘nowhere’)। সমাজের দৃষ্টিতে যা-কিছু অস্বীকৃত, যা অপবিত্র, তা-ই এই স্থানে প্রেরিত হয়। তেমনি, সীতাও প্রেরিত হচ্ছেন সেই অদৃশ্য স্থানে।৩৩

শেষ পর্যায়ে সীতাকে দেখতে পাই কঙ্কালসার অবস্থায় অযোধ্যার রাজপ্রাসাদে ফিরে আসতে এবং তাঁকে দ্বিতীয়বার গ্রহণে প্রজারা পুরোপুরি সায় না দেওয়ায়, বাল্মীকির অনুরোধে আবারও কোনও প্রমাণ দেবার বদলে অচৈতন্য হয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করতে। এই কঙ্কালসার রুগ্‌ণ শরীরটি আত্মবলিদান, পাতিব্রত্য ও শুচিতার এক প্রতিমূর্তি হয়ে দাঁড়ায় উনিশ শতকের পাঠকের কাছে।

বর্ণপরিচয় বিদ্যাসাগরের লেখা একমাত্র পুস্তক যা তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে সচিত্র আকারে প্রকাশ পায়। কিন্তু সেই একটি কারণবশত এই নিবন্ধে তা উল্লিখিত হল, এমন নয়। বরং, অনামা শিল্পীর অলংকরণ ব্যতিরেকে শিশুপাঠ্যে যে দৃশ্যজগৎ ফুটিয়ে তুলেছিলেন বিদ্যাসাগর, তার বহুস্তরীয় বিস্তারের জন্য তা উল্লেখযোগ্য।

প্রথম ভাগের শুরুতে স্বরবর্ণগুলি সাজানো হয় এমনভাবে:

এবং বাকি স্বরবর্ণের ক্ষেত্রেও আদ্যক্ষর দিয়ে একটি করে শব্দ, স্বরের ব্যবহার বোঝানোর জন্য। ছাত্ররা এতে স্বরের সঙ্গে সম্পর্কিত বস্তুসমূহের সঙ্গে সাদৃশ্য স্থাপনে উদ্যোগী হবে। Mnemonic-এর গুরুত্ব তিনি ছেলেবেলা থেকেই বুঝেছিলেন। বস্তুত, বিদ্যাসাগরই প্রথম ব্যক্তি যিনি ‘স্বরের অ’, ‘স্বরের আ’ পড়ার প্রথাটি পালটে সরাসরি ‘অ’, ‘আ’, উচ্চারণ প্রথা চালু করেন।

ব্যঞ্জনবর্ণের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। প্রথম বর্গটি এমন:

স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের শেষে যথাক্রমে একটি করে ‘পরীক্ষা’ পর্ব রয়েছে। এলোমেলোভাবে বসানো রয়েছে:

অ এ ঋ ই ও ঌ ঐ ঊ ঔ ঈ আ উ

অথবা,

ব র ক ধ ঝ জ য য় ষ, ইত্যাদি।

অর্থাৎ, ছাত্রটি অক্ষরের সূক্ষ্ম পার্থক্য বুঝতে পারছে কি না, তা যাচাই করা। এখানেই ঠাকুরদাসের যাচাই পদ্ধতি মনে পড়ে যায় আমাদের। এবং এই visual rational কীভাবে বিদ্যাসাগরের মজ্জাগত হয়ে গুরুমুখী শিক্ষার পরম্পরাকে চ্যালেঞ্জ করছে, তা বুঝে নিতে দ্বিধা হয় না ।

এভাবে পাঠের সংখ্যা যত এগিয়েছে, অক্ষর থেকে শব্দ, শব্দ থেকে বাক্যে তা বিস্তৃত হয়েছে। যেমন, প্রথম ভাগের তৃতীয় পাঠে:

কথা কয়। জল পড়ে। মেঘ ডাকে। হাত নাড়ে।

সপ্তম পাঠে তা হয়ে দাঁড়ায়:

আমরা যাইতেছি। তিনি গিয়াছেন। তাহারা আসিতেছে। ইত্যাদি।

অর্থাৎ, ন্যারেটিভের শুরু। শিশুরা দৃষ্টিচর্চা এবং কল্পনার সাহায্যে শিখবে। একটি বিস্তৃত জগতের সঙ্গে তাদের পরিচয় হবে। এভাবে ক্রমান্বয়ে শব্দ-সমষ্টি বেড়েছে। সবশেষে একুশ পাঠে পাচ্ছি ১ থেকে ১০ পর্যন্ত সংখ্যা।

বিদ্যাসাগর তাঁর জীবদ্দশায় বর্ণপরিচয়-কে সচিত্র করেননি। তবে, ১৮৯৬ নাগাদ বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রথম এবং দ্বিতীয় ভাগে হস্তক্ষেপ ঘটল বিদ্যাসাগর-পুত্র নারায়ণের। এবং সেইসময় বর্ণপরিচয়-এ চিত্রের অনুপ্রবেশ ঘটল। অ-য়ে অজগর, আ-য়ে আম, ক-য়ে কোকিল, খ-য়ে খরগোশ-এর নীচে এইসব পশুপাখি, ফলমূল, বাড়িঘরের ছবি দেখা গেল।

সেই বর্ণপরিচয়-এর অলংকরণ কোন শিল্পীকে দিয়ে করানো হয়েছিল তা এখনও অবধি নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। বহু অনুসন্ধানের পর গুটিকয়েক পত্র-পত্রিকা ও প্রবন্ধের ওপর ভিত্তি করে কিছু অনুমান করা যায় মাত্র।

কলকাতা থেকে প্রচারিত দ্য টেলিগ্রাফ দৈনিকে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে, উনিশ শতকের কাঠ-খোদাই ছবির প্রকাশকরা পঞ্জিকার জন্য ব্যবহৃত ছবিকে পঞ্জিকা ছেপে বেরবার পর অন্যত্রও ব্যবহার করতেন— ছোটদের প্রাইমার বা ওই জাতীয় বইতে। বর্ণপরিচয়-এ ব্যবহৃত ছবিগুলিও তেমনি।৩৪

অসিত পাল মহাশয় জানাচ্ছেন যে, সেই সময় যেসমস্ত শিল্পী বটতলায় কাঠ-খোদাই করতেন, তাঁরা নিজেদের নাম ছবির নীচে খোদাই করলেও সবসময় যে তাঁরা সেই ছবিগুলির মূল রচয়িতা এমন ভাবা ভুল। বহু ক্ষেত্রেই তাঁরা হয়তো লেখক বা প্রকাশকের মর্জিমাফিক, বায়না অনুযায়ী নকশা বা ছবিটি জোগান দিয়েছেন মাত্র।

পূর্ণেন্দু পত্রী লিখছেন, বিহারীলাল সরকার রচিত জীবনীগ্রন্থ বিদ্যাসাগর-এর অলংকরণ কাঠখোদাইয়ে করেছিলেন হরিদাস সেন। কিন্তু পরের বাক্যটিতে বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়-এর অলংকরণ করেন কে তা নির্দিষ্ট করে বলেননি। শুধুমাত্র বলা আছে যে বর্ণপরিচয়-এর সমস্ত অলংকরণ হয়েছিল বটতলার কাঠখোদাই দিয়ে।৩৫

যা আমাদের আজও বিস্মিত করে, তা হল যে, বিদ্যাসাগর চাক্ষিক চর্চাকে প্রাধান্য দিয়েছেন বরাবর; যিনি বাবা-মায়ের প্রতিকৃতি আঁকানো থেকে শুরু করে আরভিং-এর মুদ্রিত স্কেচবুক বাঁধাই করিয়ে এনে নিজের লাইব্রেরিতে রাখেন; যাঁর রচনায় দৃশ্যজগৎ অবিচ্ছেদ্য এক অঙ্গ হয়ে ওঠে, সেই বিদ্যাসাগরই সচিত্র শিশুশিক্ষা ছেপে বেরবার ছ’বছর বাদে কেন বর্ণপরিচয় রচনা করলেন অচিত্র আকারে? মদনমোহনের সঙ্গে বিচ্ছেদই কি কোনওভাবে তাঁকে অস্থির করে তুলেছিল? শিশুদের কাছে চিত্রের গুরুত্ব কতখানি, তা তাঁর চেয়ে বেশি আর কেই-বা উপলব্ধি করে থাকবেন সে যুগে?

সন্দেহ নেই চাক্ষিক চর্চার প্রতি একটি অমোঘ ঝোঁক বিদ্যাসাগরের ছিল বাল্যকাল থেকেই। এবং পরবর্তীকালে বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর শিল্পরসিক মননের। তেজি, জেদি, বাহুল্যবর্জিত, শিক্ষাবিদ, দয়ালু, সমাজ সংস্কারক, বিধবাবিবাহের প্রবর্তক ইত্যাদি বিশেষণ-সংবলিত চরিত্রের বাইরেও তাঁর অনাবিষ্কৃত একটি আবেগঘন মন— যেখানে তিনি কখনও যুগের নীতিবোধ মেনে পুরুষতান্ত্রিকতাকে মেনে নিচ্ছেন; কখনও প্রেমিক; কখনও নীরব সাক্ষী— উন্মোচিত হয় এই দৃশ্যচর্চার মধ্যে দিয়েই।

বিদ্যাসাগর চিত্রবিহীন ছাপা বইয়ের সাদামাটা জগতে এক অনন্য দৃশ্যজগৎ সৃষ্টি করেছেন, যা উনিশ শতকের পাঠকের চাহিদা পূরণ করে দৃশ্যকল্পের আকর হয়ে ওঠে। ইংরিজিতে যাঁদের ‘visionary reformer’ বলা হয়, বিদ্যাসাগর ছিলেন তাঁদেরই একজন। ‘visionary’ বা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বললে সাধারণত ভবিষ্যতের কথা বোঝায়। কিন্তু, বিদ্যাসাগরের রচনায়, কাজে, যুক্তিতে যে দৃষ্টিভঙ্গির নমুনা পাওয়া যায়, তা কেবলমাত্র ভবিষ্যৎ দর্শনের কথা বলে না। সেই দৃষ্টিভঙ্গি বহুস্তরীয়। তা একদিকে সামাজিক ফাঁকগুলি (fissures) চাক্ষুষ করে তাকে পূরণ করার চেষ্টা করেছে; অর্থাৎ, অনুসন্ধান, অন্বেষণ, গবেষণা; অন্যদিকে, পাঠককে উপহার দিয়েছে একটি সরস, উপভোগ্য জগতের দৃশ্যকল্প, যেখানে কখনও সেই চোখ ‘অন্তরঙ্গ’ আগন্তুকের; কখনও-বা অতন্দ্র গৃহসদস্যটির; কখনও ইক্ষণকামীর। সে চোখে নারী হয়েছে কখনও দেবী; কখনও প্রেয়সী। এর বিপরীতে নারীর তির্যক দৃষ্টিতে পুরুষের সমালোচনা; কখনও-বা নারীর আত্ম-অন্বেষণ, কিংবা পুরুষের আত্মগ্লানির বহিঃপ্রকাশ— এই দৃষ্টিভঙ্গিমাও বিদ্যাসাগরের এক-একটি চরিত্রকে আত্তীকরণের ফলস্বরূপ। তাঁর চাক্ষিক গুণের কারণেই জটিল সংস্কৃত পদবিন্যাসকে ভেঙে তিনি সরল রূপ তৈরি করেছেন বাংলা গদ্যের। এর সঙ্গে বাংলা বর্ণবিন্যাসের আধুনিক রূপটিও গঠিত হচ্ছে তাঁর হাত ধরে। প্রখ্যাত ইতালীয় দার্শনিক জিওর্জিও অ্যাগাম্বেন তাঁর প্রবন্ধ ‘হোয়াট ইজ় দ্য কনটেম্পোরারি’৩৬-তে কে সমসাময়িক, তার সংজ্ঞা দিচ্ছেন:

The contemporary is the one whose eyes are struck by the beam of darkness that comes from his own time.

কিন্তু এতেই সমসাময়িক হয়ে ওঠার কাজটি শেষ হয়ে যায় না। অ্যাগাম্বেন আরও জানাচ্ছেন, সমসাময়িক হতে গেলে সেই আঁধারের মধ্যেই, এক অসীম দূরত্বে থাকা আলোটি খুঁজে নিতে হবে আমাদের:

… but also to perceive in this darkness a light, while directed toward us, infinitely distances itself from us.

বলা বাহুল্য, সেই আলো এবং নিজের সময়ের অন্ধকারের মধ্যে দূরত্ব ঘোচানোই সমসাময়িকের কাজ। সেই সেতুবন্ধনের কাজ প্রত্যেক যুগেই করে থাকেন সমসাময়িক ব্যক্তিত্বরা। বিদ্যাসাগর আঁধার আর আলোর দূরত্ব ঘোচাতে যে চাক্ষিক চর্চাকে ব্যবহার করেছিলেন, তা প্রত্যক্ষকরণে, পর্যবেক্ষণে, কল্পনায়, অবলোকনে যেমন অনায়াস, তেমনই গতিময়।

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

. ‘চাক্ষিক’ শব্দটি আভিধানিক নয়। শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন বলে জানা যায়। বাংলা ভাষায় শব্দটির প্রভূত ব্যবহার বিশেষত দেখা যায় কলাচর্চার ক্ষেত্রে। এই প্রবন্ধে শব্দটি সেই ব্যবহারের ভিত্তিতেই গৃহীত হয়েছে মুখ্যত ইংরিজি ‘visual’-এর প্রতিশব্দ হিসেবে।

. জীবনচরিত (১৮৫৯) লেখার সময় বিদ্যাসাগর যে এই প্রতিশব্দ/পারিভাষিক শব্দর অভাব অনুভব করছেন এবং তা পূরণের উদ্দেশ্যে বইয়ের শেষে একটি পরিশিষ্ট জুড়ে দিচ্ছেন ‘দুরূহ ও সঙ্কলিত নূতন শব্দের অর্থ’-এর, যেমন: ঔপনিবেশিক (Colonial); পারিপার্শ্বিক (Satellite), ইত্যাদি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জীবনচরিত (কলকাতা: সংস্কৃত যন্ত্র, ১৮৫৯)।

. একজন বহিরাগত যখন নিজের জায়গা ব্যতীত অন্যত্র এসে বসবাস করেন, তখন তাঁর দৃষ্টিতে আঁকা হতে থাকে সেই আশ্রয়স্থলটি। বিদ্যাসাগর যেন অযোধ্যার রাজপরিবারের তেমনই এক সদস্য হয়ে দেখছেন সেখানকার অন্দরমহল। Silvija Jestrovic. ‘Introduction’, Performance, Space, Utopia: Cities of War, Cities of Exile. 2013. Palgrave Macmillan দ্রষ্টব্য।

. চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর (এলাহাবাদ: ইন্ডিয়ান প্রেস, ১৯০৯), পৃ. ৩১।

. Ashish Ranpura. ‘How We Remember Why We Forget’. Source: https://brainconnection.brainhq.com/2013/03/12/how-we-remember-and-why-we-forget/. Page last accessed on 06.06.2019.

. চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর, পৃ. ৩৯-৪০।

. Camille Schulman. ‘Elementary Students’ Strategies for Solving Visual Logic Tasks’. 2014. Undergraduate Honors Program. Theses and Project. Virtual Commons—Bridgewater State University. Source: https://vc.bridgew.edu/cgi/viewcontent.cgi?referer=https://www.google.com/%20&httpsredir=1&article=1061&context=honors_proj.pdf.

. Haylock, D. & Thangata, F. ‘Deductive and inductive reasoning’. In: Key Concepts in Teaching Primary Mathematics. (London: SAGE Publications Ltd., 2007), pp. 53-58.

. শুলম্যান, এর পাশাপাশি রীড (২০০২)-এর বক্তব্য উল্লেখ করে, ‘ওয়ান-স্টেপ ডিডাক্টিভ রিজনিং’-এর কথা বলছেন, যেক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট কারণ বা যুক্তিতে আসার পদ্ধতিটি একাধিক ক্ষেত্র থেকে নির্মিত এবং এইভাবে একাধিক ‘ওয়ান-স্টেপ ডিডাক্টিভ রিজনিং’ জুড়ে আরও জটিল নির্মাণের দিকে। এই নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও গবেষকরা একটি ক্ষেত্রে একমত যে, অঙ্কে পারঙ্গম হতে গেলে ন্যায়িক যুক্তি এবং প্রমাণের দ্বারাই তা হতে হবে। তবুও নানা মতামতের মধ্যে একাংশ, যেমন সুইস উন্নতিমূলক মনস্তত্ত্ববিদ জ্যঁ পিয়াজে ও মনস্তত্ত্বের মার্কিন অধ্যাপক হেনরি মার্কোভিটস মনে করেন শিশুরা বয়ঃসন্ধির গোড়াতে এসে তবেই ন্যায়িক সিদ্ধান্তে আসার মতো কাজ করতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে, হকিন্স, রিচার্ডস, স্যান্ডারসন প্রমুখ মনে করেন স্কুলে যাওয়ার আগেই শিশুরা পরিচিত বিষয়বস্তুর নিরিখে ন্যায়িক সিদ্ধান্তে বা যুক্তিযুক্ত কারণে পৌঁছনোর গুণটি অর্জন করে। এঁদের মধ্যে পিয়াজে-ই সর্বপ্রথম দাবি করেন যে, শিশুরা সাত বছরে বয়সের আগে যুক্তিসহকারে কারণ দর্শাতে পারে না। বিস্তারিত জানতে দেখুন: https://vc.bridgew.edu/cgi/viewcontent.cgi?referer=https://www.google.com/&httpsredir=1&article=1061&context =honors_proj

১০. Inhelder, B. & Piaget, J. (1958). The Growth of Logical Thinking: From Childhood to Adolescence. N.p.: Basic Books.

১১. চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর, পৃ. ৪৯।

১২. বিহারীলাল সরকার জানাচ্ছেন, এই বিদ্যালয়ে প্রথমে বিশুদ্ধ সংস্কৃত শিক্ষাই দেওয়া হত। পরে সংস্কৃত কলেজে ইংরিজি প্রবর্তিত হওয়াতে এই বিদ্যালয়েও ইংরিজি শিক্ষা প্রবর্তিত হয়। বিহারীলাল অনুমান করছেন: ‘ঠাকুরদাস কি জানিতেন যে, তাঁহার পুত্র ভবিষ্যজীবনে টোলের পরিবর্তে গ্রামে উচ্চশ্রেণীর ইংরাজী বিদ্যালয় স্থাপিত করিতে পারিবেন?’ দ্র. বিহারীলাল সরকার, বিদ্যাসাগর: সমালোচনা সংবলিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনী (কলকাতা: শাস্ত্র-প্রকাশ কার্য্যালয়, চতুর্থ সংস্করণ, ১৩২৯ ব.), পৃ. ৮৩-৮৪।

১৩. উল্লেখ্য, রাইমণির আগে নিজের মা এবং ঠাকুরমার স্নেহ তিনি পেয়েছেন, অথচ তাঁর আত্মজীবনীতে এই বোধোদয়ের কথা রাইমণির প্রসঙ্গের আগে উল্লিখিত হয়নি।

১৪. চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর, পৃ. ৩৩।

১৫. তদেব, পৃ. ৩৯৯।

১৬. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘বিদ্যাসাগরস্মৃতি’, বিদ্যাসাগরচরিত (কলকাতা: বিশ্বভারতী, ভাদ্র ১৪০০), পৃ. ৮২। https://archive.org/details/bub_man_845ce445e87566b51a795ee13047faf7/page/n7। তথ্য সংগ্রহের তারিখ: ১০.০৫.২০১৯।

১৭. ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, অষ্টম মুদ্রণ, ২০১৪), পৃ. ২৯।

১৮. এই নিয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুন: Giorgio Agamben. ‘What is the Contemporary’. What is an Apparatus? And Other Essays. Trans. by David Kishik and Stefan Pedatella (Stanford University Press, 2009).

১৯. ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, পৃ. ১৩৫।

২০. চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর, পৃ. ১৬৭।

২১. জীবনচরিত-এ বিদ্যাসাগর গালিলিও সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলছেন: ‘ইয়ুরোপীয় পণ্ডিতেরা সর্ব্বত্র লাটিন ভাষাতেই উপদেশ দিতেন; গালিলিও তাহা পরিত্যাগ করিয়া ইটালীয় ভাষায় আরম্ভ করিলেন। তৎকালে এই নূতন প্রণালী অবলম্বন করাও এক প্রকার সাহসের কর্ম্ম বলিয়া পরিগণিত হইয়াছিল।’ (পৃ. ১০)। অতএব, নিজে সংস্কৃত থেকে এক ধাক্কায় বাংলা ভাষাকে সাহিত্যের ভাষা বানিয়ে ফেলার সাহস সম্ভবত এমনই কোনো উৎস থেকে পেয়েও থাকতে পারেন বলে আমার অনুমান। সূত্র: জীবনচরিত, ১৮৫৭, পঞ্চম মুদ্রণ, সংস্কৃত যন্ত্র, কলকাতা। পিডিএফ। উইকিমিডিয়া।

২২. চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর, পৃ. ১৬৭।

২৩. তদেব।

২৪. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (সংকলিত), ভ্রান্তিবিলাস: সেক্সপীর প্রণীত ভ্রান্তিপ্রহসনের উপাখ্যানভাগ (কলকাতা: সংস্কৃত যন্ত্র, দ্বিতীয় সংস্করণ, সংবৎ ১৯৩২), পৃ. ১৫। পিডিএফ। উইকিমিডিয়া।

২৫. তদেব।

২৬. শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন রচিত বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত (১৮৯১ খ্রি.)–এ মলয়পুর গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। দামোদর নদের পূর্বাংশের রেলপথ রক্ষার্থে নদীর পশ্চিমাংশের সেতু খুলে দেওয়ার ফলস্বরূপ বর্ষাকালে মলয়পুরে বন্যা হতে শুরু করে। গ্রামবাসীদের অনেকেই পৈতৃক বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র থাকতে শুরু করেন। এঁদের মধ্যে অধরচন্দ্র ভট্টাচার্য্য, যজ্ঞেশ্বর ভট্টাচার্য্য, বনরাম ভট্টাচার্য্য প্রমুখ, বন্যার সময় প্রায় চার মাস কলকাতায় বিদ্যাসাগরের বাড়িতে বসবাস করেন বলে জানা যায়। (শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, ‘মলয়পুর’, বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাস, সম্পাদনা: ড. কুমুদরঞ্জন ভট্টাচার্য্য। পৃ. ১৭২। চিরায়ত প্রকাশন, কলকাতা। প্রথম চিরায়ত সংস্করণ: মে ১৯৯২।)

২৭. হ্যালিডে সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় বিদ্যাসাগর বার তিনেক চোগা-চাপকান ও পাগড়ি পরে গিয়েছিলেন। যদিও পরে তা নিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করেছিলেন হ্যালিডে-র কাছে, জানাচ্ছেন ইন্দ্রমিত্র তাঁর করুণাসাগর বিদ্যাসাগর-এ।

২৮. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ‘বিজ্ঞাপন’, ভ্রান্তিবিলাস, দ্বিতীয় সংস্করণ, সংবৎ ১৯৩২, পৃ. ৬।

২৯. সীতার বনবাস-এর যাবতীয় উদ্ধৃতি গৃহীত হয়েছে https://upload.wikimedia.org/wikipedia/.pdf থেকে, যা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কৃত সীতার বনবাস, আনন্দমঠ প্রেস, সং ১৯৫৪, সপ্তবিংশ সংস্করণ-এর ডিজিটাল কপি।

৩০. শকুন্তলা-র যাবতীয় উদ্ধৃতির জন্য দ্রষ্টব্য: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, শকুন্তলা (কলিকাতা: সংস্কৃত যন্ত্র, সং ১৯১১)।

৩১. অর্থাৎ, স্থান-কাল-পাত্রের বদলের সঙ্গে সঙ্গে দেখার ধরনের যে পরিবর্তন ঘটছে, তাতে ‘exchange of gaze’-ও পালটাচ্ছে। বিদ্যাসাগর সেই দেখার ধরনটিও পালটে ফেলছেন চরিত্ররা পালটে গেলে।

৩২. Susan Sontag, ‘In Plato’s Cave’, On Photography, p. 2. First electronic edition published 2005 by Rosetta Books LLC, New York. pdf.: http://www.lab404.com/3741/readings/sontag.pdf. Accessed on 14.05.2019.

৩৩. Michel Foucault, ‘Of Other Spaces’ in The Visual Culture Reader (ed. Nicholas Mirzoeff), 2nd Edition, 2002.

৩৪. স্বচ্ছসলিলা বসুর লেখায় উল্লিখিত অসিত পালের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে। Basu, Swachchhasalila. ‘Art Anoymous’. The Telegraph. West Bengal. Online edition. Web. https://www.telegraphindia.com/states/west-bengal/art-anonymous/cid/1456694. Published on 20.05.2018. Accessed on 27.04.2019.

৩৫. Purnendu Pattrea, ‘The Continuity of the Battala Tradition: An aesthetic revaluation’, Woodcut Prints of Nineteenth Century Calcutta. Ed. Asit Paul (Calcutta: Seagull Books, 1983) p. 78.

৩৬. এই সংক্রান্ত সমস্ত আলোচনায় ব্যবহৃত হয়েছে: Giorgio Agamben. ‘What is the Contemporary’, What is an Apparatus? and Other Essays. 2009. Trans. by David Kishik and Stefan Pedatella. Stanford University.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *