5 of 8

মুড়ি-মিছরি

মুড়ি-মিছরি

আগে একটা কথা ছিল ‘মুড়ি-মিছরির এক দর’ অর্থাৎ ছোট-বড়, খারাপ-ভাল, উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্ট সবই যেখানে একদর অথবা যখন একদর, কিংবা সেই সময়টা মোটেই সুবিধের নয়। মুড়ি-মিছরির একদর হওয়া উচিত নয়।

একালে কিন্তু একথা আর বলা যাবে না।

একদা মুড়ি ছিল সহজলভ্য, গরিবানা খাবার। দামে কম। আর মিছরি ছিল দুর্লভ। দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হত। অনেকে বলেন, মিশর থেকে আসত বলে মিছরি। যেমন চিন থেকে চিনি, গৌড় থেকে গুড়।

সে যা হোক মিছরি ছিল সে আমলে, মুড়ির তুলনায় অনেক বেশি মহার্ঘ। তার ব্যবহার ছিল বড়লোকের শরবতে আর ঠাকুরঘরের প্রসাদে। দেবভোগ্য মিছরি আর শস্তা মুড়ির একদর হলে আশঙ্কারই কথা।

কিন্তু এখন তো তাই হয়েছে। মুড়ি-মিছরি একদর হয়ে গেছে। দুয়েরই দাম কুড়িটাকা কেজি। কোথাও কোথাও সামান্য কম বা বেশি হতে পারে।

শুধু মুড়ি-মিছরি নয়। প্রৌঢ় পাঠক আরেকটু মনে করুন। আমাদের বাল্যকালে চিকেন বা মুরগির মাংস ছিল দুর্লভ ও দুর্মূল্য। হোটেলে রেস্তোরাঁয়, সাহেব আধাসাহেবদের ডাইনিং রুমে দেখা মিলত এই সুখাদ্যের।

আমাদের মতো ব্রাত্যজনের জন্য ছিল পাঁঠা-খাসির শস্তা মাংস। এই সেদিনও, মাত্র চল্লিশ বছর আগে এই মাংস ছিল দুটাকা-আড়াই টাকা সের। সে জায়গায় একটা আধসেরি দিশি মুরগির দাম পড়ত চার-পাঁচ টাকা।

সব কিছুরই কালক্রমে দাম বেড়েছে। পঞ্চাশের মন্বন্তরে চালের দাম সবচেয়ে বেশি হয়েছিল টাকা-টাকা সের। এখন তো, সদাসর্বদা এর থেকে পনেরো-বিশগুণ দাম দিয়ে চাল কিনতে হয়।

যে বাংলা উপন্যাসের দাম ছিল দুই কিংবা আড়াই টাকা এখন তার দাম ষাট টাকা। আপনি ইস্কুলে দেড় টাকা মাস মাইনে দিয়ে পড়েছেন, আপনার নাতির জন্যে মাস মাইনে সাতশো টাকা।

সাধারণ জিনিস থেকে সোনাদানায় যাই। আমার একটা রেকর্ড আছে। আগে বিখ্যাত সুরের ডায়েরিতে পুরনো দিনের সোনার দামের বিবরণ ছাপা হত। সুরের ডায়েরি বহুমূল্য হয়ে যাওয়ার পর এবং চমৎকার সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ডায়েরি উপহারে সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় আজকাল আর সুরের ডায়েরি দৃষ্টিগোচর হয় না। সুতরাং জানি না সেই স্বর্ণ বিবরণী এখনও দেওয়া হয় কি না।

আমার কাছে একটা পুরনো ডায়েরি কী করে রয়ে গেছে, সেখানে সোনার দামের একটা হিসেব দেখছি, প্রায় ষাট বছরের মূল্য তালিকা।

১৯৪০ সালে পুজোর সময় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের গোড়ার দিকে এক ভরি গয়নার সোনার দাম পঁয়ত্রিশ টাকা। যুদ্ধের বাজারে দাম ওঠানামা করতে করতে পঁয়তাল্লিশ সালের শেষে সোনার দাম দ্বিগুণ হল। চিন যুদ্ধের সময় বাষট্টি সালে সোনার দাম আবার ডবল হয়ে ভরি প্রতি দাম দাঁড়াল প্রায় সোয়াশো টাকা। বাড়তে বাড়তে বাংলাদেশ যুদ্ধের ঠিক আগে এক ভরি সোনার দাম প্রায় দুশো টাকায় পৌঁছোল। অবশেষে বাড়তে বাড়তে এখন তো প্রতি ভরির দাম এর পঁচিশ গুণ।

সোনাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। দু’হাজার টাম বিঘে মানে একশো টাকা কাঠার জমি এখন লক্ষ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

শুধু সোনা বা মাটি নয়, বাড়ি ভাড়া বা গাড়ি ভাড়া নয়, মাছ-মাংস, তরি-তরিকারি, জামা-কাপড়, ওষুধ-ডাক্তার সব কিছুর মূল্য বাড়ছে তো বাড়ছেই।

কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর এক প্রতিবেদনে একদা চমৎকার বলেছিলেন,

‘আগে পকেট ভরা টাকা নিয়ে বাজারে গিয়ে ব্যাগ ভরে জিনিস কিনে আনতাম। এমন দিন আসছে যখন ব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে বাজারে গিয়ে পকেট ভর্তি জিনিস কিনে আনতে হবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *