মুড়কির হাঁড়ি – সৌমিত্র বসু

মুড়কির হাঁড়ি – সৌমিত্র বসু

বাসুদেব

বাসুদেবের বউ

নরোত্তম

দুর্গা

সিংহ

শিব

কার্তিক

গণেশ

ভূতপ্রেতের দল

প্রথম দৃশ্য

[ জঙ্গলের মধ্যে ভাঙাচোরা এক মন্দির। বিকেলের আলো এসে পড়েছে তার ওপরে। ক্লান্ত পায়ে ঢোকে বাসুদেব। ধপ করে বসে পড়ে মন্দিরের চাতালে ]

বাসুদেব। নাঃ, আর পারব না। মাথা ঘুরছে, পা টলছে, খিদেয় পেটের মধ্যে যেন বাঘ আঁচড়াচ্ছে। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় ঠিক করেছিলুম, থামব না। কোথাও থামব না, গ্রাম পার হয়ে জঙ্গল, জঙ্গল পার হয়ে আবার গ্রাম। তারপরে-কে জানে কী আছে তার পরে, সব পার হয়ে চলে যাব, কিন্তু কোথায় কী! বনটুকু পেরোতে না পেরোতেই-ওঃ। দেহ যখন চাইছে না, তখন এই চাতালে একটু জিরিয়ে নিই। তারপর আবার হাঁটা, পালানো, শাস্ত্রে যাকে বলে পলায়ন। কিন্তু যত দূরেই যাই, ভাগ্য কী আর আমার পিছু ছাড়বে! সে যে এঁটুলির মতো সঙ্গে লেগে আছে। এই তো কপালের নমুনা। জঙ্গলের মধ্যে যাও বা একটা মন্দির দেখলাম, দেবতা দেবী যা হোক কারুর কাছে দুঃখের কথাটা বলব, মনে শান্তি হবে-তো মন্দিরের চেহারা দেখলেই ভয় করে, এক্ষুনি ঘাড়ে ভেঙে পড়বে বুঝি। এই পোড়ো মন্দিরে কী আর দেবতা থাকে? দূর ছাই, না থাকে তো নাই থাকল, এ পোড়া কপালে মলম দেবার সাধ্যি আর কোন দেবতার আছে? তার চেয়ে একটু শুয়েই থাকি। চাই কী যদি একটু ঘুম আসে? নিদ্রার মতো দুঃখ দূর করার ওষুধ কি আর আছে?

[ মন্দিরের চাতালে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, উলটো দিক থেকে ঢোকেন দেবী দুর্গা। পরনের কাপড়টা ময়লা, গয়নার জেল্লা নেই ]

দুর্গা। কী গেরো বলো দিকিনি? দুটো মোটে গিঁট, তার জন্যে আটকে থাকতে হবে এই বিজন বনের মধ্যে। একটা লোক আসে না এই পথ দিয়ে, পথ ভুলেও যদি কেউ- (হঠাৎ চোখ পড়ে নিদ্রিত বাসুদেবের দিকে) একী, মেঘ চাইতে না চাইতেই জল। এ তো ঘুমিয়ে কাদা, ব্যাপারটা আগে বুঝে নিতে হচ্ছে। (ধাক্কা দিয়ে) এই যে, শুনছ? এই যে।

বাসুদেব। (ধড়মড় করে উঠে বসে) কে কে-আপনি? কী চাই?

দুর্গা। সেকথা তো আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করব। চাইটা কী তোমার? এই জঙ্গলের মধ্যে মন্দিরের চাতালে শুয়ে ঘুমোচ্ছ কেন?

বাসুদেব। ঘুমোচ্ছি কেন? এটা একটা প্রশ্ন হল? বলি লোকে ঘুমোয় কেন? ঘুম পায় বলে।

দুর্গা। ঘুম পায় বলে যেখানে-সেখানে ঘুমোবে? এটা কি তোমার বিছানা?

বাসুদেব। এই জঙ্গলের মধ্যে এর চেয়ে ভালো বিছানা আর পাচ্ছি কোথায়।

দুর্গা। মুখের ওপর অমন চ্যাট্যাং চ্যাট্যাং কথা বোলো না বলে দিলাম। এই জঙ্গলের মধ্যে তোমার আসবার দরকারটা কী ছিল? কোত্থেকে এলে তুমি?

বাসুদেব। জঙ্গলের ওপারে ওই গ্রাম থেকে।

দুর্গা। তা এলে কেন? এই বিজন বনে খামোখা আসবার দরকারটা কী পড়ল তোমার?

বাসুদেব। সে অনেক কথা। দুঃখু-কষ্টের কথা। তুমি আর শুনে কী করবে?

দুর্গা। (খুব উৎসাহ নিয়ে) দুঃখু-কষ্টের কথা? কীরকম কীরকম? শুনি তো?

বাসুদেব। এ আবার কী? দুঃখ-কষ্টের কথা শুনে তো আহ্লাদে গলে গলে পড়ছ যে। আমার দুঃখের কথা শুনে তোমার কী হবে?

দুর্গা। আরে বলোই না। কী হবে সে দেখতেই পাবে, খুব একটা খারাপ কিছু হবে না।

বাসুদেব। তোমার হাবভাব তো মোটেই সুবিধের লাগছে না! আচ্ছা, এত যে জেরা করছ, তোমার গল্পটা কী বলো দেখি, যাহোক তাহোক আমি তবু একটা পুরুষমানুষ, কিন্তু তুমি মেয়েলোক হয়ে এই জঙ্গলের মধ্যে ঘুরঘুর করছ কেন? বলি তোমার মতলবটা কী?

দুর্গা। মতলব! আমার মতলব!

বাসুদেব। হ্যাঁ হ্যাঁ-মতলব। উদ্দেশ্য, ধান্দা, একটু ঝেড়ে বলো দিকি!

দুর্গা। এ কী ভাষায় কথা বলছে? জীবনে কখনো কেউ আমাকে-

বাসুদেব। ও হো হো, ন্যাকা, উদয় হলে কোত্থেকে?

দুর্গা। খবরদার। এরকম অপমান করে কথা বললে-আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি বলে দিলাম।

বাসুদেব। রেগে যাচ্ছি! ইঃ, রেগে গিয়ে দশটা হাত-পা গজাচ্ছে ওঁর।

দুর্গা। এ অপমান তো আর সহ্য হয় না। কাত্তিক, গণেশ!

বাসুদেব। একী! কাদের ডাকছে আবার!

দুর্গা। কাদের ডাকছি দেখতেই পাবি। কাত্তিক, গণেশ-

বাসুদেব। এ যে তুই-তোকারি শুরু করল?

দুর্গা। ওরে তোরা কি সব মরলি নাকি? সাড়াটা অন্তত দে। একবার এসে দেখে যা, কোথা থেকে এক দুর্বৃত্ত , পামর-ওরে কাত্তিক, তোর অস্ত্রটা কি সাজিয়ে রাখবার জন্যে বাপ!

বাসুদেব। অস্ত্র? ওরে বাবা, অস্ত্রের কথা কেন? একি দস্যুরানি-টানি নাকি?

দুর্গা। (প্রচণ্ড জোরে) ওরে ও কাত্তিক, গণেশ!

[ মন্দিরের ভেতর থেকে খুব রোগা একটা সিংহ বেরিয়ে আসে বিরক্ত মুখে ]

সিংহ। কী হলটা কী? বিকেলবেলা চেঁচিয়ে একেবারে-

বাসুদেব। এটা আবার কী? বনবেড়াল?

সিংহ। অ্যাই, চোপ, বনবেড়াল কেন হতে যাব? আমি পশুরাজ? কেশর দেখতে পাচ্ছ না?

বাসুদেব। (ভয় পেয়ে) সিংহ? ওরে বাবা, সিংহ, নাঃ, ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। আরে, একী কাণ্ড, সিংহ মানুষের গলায় কথা বলছে?

দুর্গা। তুমি কেন বৎস? দাদাবাবুদের পাঠিয়ে দাও।

সিংহ। তেনারা আসবেন না।

বাসুদেব। কী পোষ মেনেছে রে বাবা, মানুষের গলায় কথা বলছে, কথা শুনছে- তাহলে আমাকে কিছু বলবে না।

দুর্গা। কেন? আসবেন না কেন? কোন রাজকার্যটা করছেন তাঁরা?

সিংহ। রাজকার্য আবার কী? দাদাবাবু-দিদিমণিরা সব পেটপুরে মুড়কি খেয়ে ঘুম দিচ্ছেন, আমাকে বললেন গিয়ে দেখতে।

দুর্গা। ঘুম দিচ্ছেন। ওঃ, এই হয়েছে এক মুড়কির হাঁড়ি। যখন ইচ্ছে হাঁড়ি থেকে মুড়কি বার করছে, আর-

বাসুদেব। কিছু আছে, না সব শেষ?

দুর্গা। কী আছে?

বাসুদেব। ওই যে বললেন মুড়কি? আছে?

দুর্গা। থাকবে না কেন? সে কি আর ফুরোবার?

বাসুদেব। ফুরোবারই নয়? মানে?

দুর্গা। মানেটা তোমাকে বলব কেন হে? তখন থেকে যা-তা বলে যাচ্ছ? দেবী বলে ভক্তিছেদ্দা না করো, মহিলা বলে তো একটা সম্মান করবে, নাকি?

বাসুদেব। দেবী? দেবী মানে?

সিংহ। দেবী মানে বোঝো না? গলায় পৈতে ঝুলিয়েছ, আর বাংলা কথা বুঝতে পারো না?

বাসুদেব। তার মানে-তবে বুঝি-কিন্তু ধ্যাৎ, তা কী করে হয়?

দুর্গা। বুঝছে বুঝছে। পেশো, চোখেমুখে জ্ঞানের আলো ফুটছে।

বাসুদেব। আপনি কে বলুন তো? জঙ্গলের মধ্যে, সিংহ কথা বলছে-ঠিক ঠিক, কাত্তিক-গণেশের কথাও যেন একবার-

দুর্গা। বাপরে, ধরতে এতক্ষণ লাগল?

সিংহ। তা ধরতে না পারারই বা দোষ কী? অপরাধ না নাও তো বলি, চেহারাখানা যা করে রেখেছ? মা দুর্গা না বনবিবি তা বোঝবার জো নেই।

বাসুদেব। মানে তুমি-না, আপনি-না, তুমি-

দুর্গা। তুমি তুমি, মাকে আবার আপনি কী রে পাগলা?

বাসুদেব। (পায়ের ওপর পড়ে) মা গো, চিনতে পারিনি মা, কত দোষঘাট হয়েছে আমার। কত কটু কথা বলেছি।

দুর্গা। থাক থাক, রাজ্যের ধুলো-মাখা পা-ওতেই হবে।

সিংহ। দেখলে? পুরোটাই একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছিল, শাড়ি-টাড়ি যা পরো, অন্তত বাকি আটটা হাতও যদি লাগিয়ে রাখতে-

দুর্গা। বাজে বকিসনি তো। এই গরমে দুটো হাতেই আইঢাই করে, আবার বলে জবরজঙ্গ দশভূজা সেজে বসে থাকতে। আর ভুল বোঝাবুঝি আবার কী? আমি তো ইচ্ছে করেই নিজের পরিচয় দিইনি, মানে ওকে পরীক্ষা করছিলুম আর কি! তুই লোকটা কেমন, বাজিয়ে দেখছিলুম।

বাসুদেব। তা বাজিয়ে কী বুঝলে মা!

দুর্গা। চলবে, একেবারে বেসুরো না।

বাসুদেব। কিন্তু মা, তুমি এই জঙ্গলের মধ্যে? তোমার তো রাজধানীতে গিয়ে মন্দির আলো করে থাকার কথা?

দুর্গা। পরীক্ষা করতে বাছা, শহরে গেলে তো অনেকেই আসবে। কিন্তু এখানে আমার খোঁজে কে আসে-

সিংহ। কেন গুল মারছ মা, সত্যি কথাটা খুলে বলোই না।

দুর্গা। এই চোপ,-না বাছা-

সিংহ। এই যে দেখছ জঙ্গল, বহুদিন আগে এখানে একটা শহর ছিল।

বাসুদেব। সে তো জানি, শুনেছি গপ্পোকথায়, মহামারিতে সব ধ্বংস হয়ে যায়।

সিংহ। এই মন্দির ছিল সে শহরের ঠিক মাঝখানটিতে। শহর ধ্বংস হল, বনজঙ্গলে ছেয়ে গেল দেশ, কিন্তু মা তো আর এখান থেকে বেরোতে পারে না।

বাসুদেব। কেন? বেরোতে পারেন না কেন?

দুর্গা। কী করে বেরোব? দুটো কাজ বাকি আছে যে?

বাসুদেব। দুটো কাজ? কী দুটো কাজ?

সিংহ। তার মধ্যে একটা কাজ বোধ হয় আজকেই শেষ হয়ে যাবে, কী বলো মা?

দুর্গা। মনে হচ্ছে।

বাসুদেব। কী কাজ মা? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

সিংহ। দেবদেবীদের সব কথা বুঝতে হবে এমন দিব্যি তোমাকে দিয়েছে কে?

দুর্গা। আমাদের সব কথা বোঝবার চেষ্টা করতে নেই বাছা। শুধু এইটুকু জেনে রাখো, কোটা পূরণ করতে আমার দুটো কাজ বাকি, সে দুটো শেষ না করে আমি ঠাঁইনাড়া হতে পারব না।

বাসুদেব। তাহলে মা ভালোই হয়েছে। ঠাঁইনাড়া হয়ে কোনো বড়ো শহরে চলে গেলে আমি তো আর তোমার দর্শন পেতাম না। এতক্ষণ ধরে কথা বলতে পারতাম না, আমার জীবন ধন্য হত না।

সিংহ। সেইজন্যেই বলে না, কারুর পৌষ মাস, আর কারুর সব্বোনাশ?

দুর্গা। ছিঃ বাবা পেশো, অমন করে বলে? আমাদেরও তো কত ভালো লাগল, কতদিন পরে নতুন কারুর মুখ দেখলাম, দুটো কথা কয়ে বাঁচলাম। তা হ্যাঁরে ছেলে, বল এবারে, এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কোথায় চলেছিস?

বাসুদেব। যেদিকে দু-চোখ যায়।

দুর্গা। কেন রে? কীসের দুঃখ তোর?

বাসুদেব। কী আর বলি মা, দুঃখের সমুদ্দুর?

সিংহ। দুঃখের সমুদ্দুর? মা গো, পাওয়া গেছে।

দুর্গা। বল দেখি তোর কীসের দুঃখ, সব দুঃখ মিটিয়ে দেব।

সিংহ। আর তোমার কাজটাও ফাঁকতালে হয়ে যাবে।

দুর্গা। আঃ, আশকারা দিয়ে দিয়ে বড্ড বাড় বেড়েছে তোর,-বল বাছা, বল, দুঃখের কথা বল।

সিংহ। বলো বলো, বুঝতে পাচ্ছ না, মা তোমাকে বর দেবে।

[ দৌড়ে ভেতরে যায়

বাসুদেব। দেবে মা, দেবে? তোমার এই গরিব ছেলেকে-

দুর্গা। দেব রে বাপু, দেব। তুই বল।

বাসুদেব। খেতে পাই না মা, বড্ড অভাব, খুদকুঁড়ো যা কিছু ছিল সব কেড়ে নিচ্ছে।

দুর্গা। কেড়ে নিচ্ছে? কে?

বাসুদেব। নরোত্তম কাকা, শহরের আদালতে নাকি পেশকার ছিল, যখন-তখন আসে, আর আইনের ভয় দেখিয়ে- কী বলব মা, বউটার শুকনো মুখ আর সহ্য করতে পারি না বলে-

দুর্গা। পালাচ্ছিলি? অনাথাকে একা ফেলে?

বাসুদেব। হ্যাঁ, কাজটা অন্যায্য হচ্ছিল ঠিক, কিন্তু-আমার আর জ্ঞানগম্যি ছিল না মা।

দুর্গা। ও। আমার সামনে বাবু হয়ে বোস।

বাসুদেব। কেন বাবু হয়ে কেন?

দুর্গা। বসতে হয়, তোকে তো আমি বর দেব, তা তপস্যা না করলে বরটা দেব কী করে? সে আইন নেই।

বাসুদেব। তপস্যা? এখন তপস্যা করতে হবে?

দুর্গা। ওরে না রে বাপু না, বাবু হয়ে হাত জোড় করে একটু বোস অন্তত, আইনটা বাঁচাই। (বাসুদেব বসে) হাত জোড়। (বাসুদেব তাই করে) এই রে, তোর নামটা তো জানাই হয়নি।

বাসুদেব। বাসুদেব।

দুর্গা। বাসুদেব। শোন, শোন, আমাদের কৃষ্ণের নামে নাম। তাহলে তো বর দিতেই হয়, কী বলিস? আমার হাতগুলো-

সিংহ। (ঢুকতে ঢুকতে) এই যে মা। ঝুল পড়ে গিয়েছিল, পরিষ্কার করে আনতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। দাঁড়াও লাগিয়ে দিই।

দুর্গা। শোন বৎস বাসুদেব, বলি তোরে আজি। তুষ্ট হয়ে তোর তপস্যায়, দিব বর করিয়াছি মনে। বল বৎস, কিবা তোর আকাঙ্ক্ষার ধন।

বাসুদেব। (হঠাৎ) মুড়কির হাঁড়ি।

সিংহ। ধুস।

দুর্গা। এটা তুই কী করলি? এক বরে রাজরাজেশ্বর হয়ে যেতে পারতিস, তা না-

বাসুদেব। তাই তো। বড্ড ভুল হয়ে গেল।

সিংহ। এরকম একটা ভুল মানুষের হয় কী করে অ্যাঁ? মা দুগগা বর দিচ্ছে আর চাইল কিনা-

বাসুদেব। আসলে কাত্তিক গণেশ হাঁড়ি থেকে মুড়কি খেয়ে ঘুম দিচ্ছেন, এটা শোনার পর থেকেই মাথার মধ্যে-

সিংহ। ওই মুড়কি পাক মারছে?

বাসুদেব। হ্যাঁ।

সিংহ। হেঁড়ে মাথা আর কাকে বলে!

দুর্গা। যাক গে, গতস্য শোচনা নাস্তি। পেশো, যা তো বাবা, আড়ায় হাঁড়িটা ঝোলানো আছে, নিয়ে আয় তো।

বাসুদেব। আমি আর একবার তপস্যা করতে বসি না মা? এবার যদি-

সিংহ। সেগুড়ে বালি। যা হবে একবারই, এখন বোঝো!

[ ভেতরে চলে যায়

বাসুদেব। আর বর পাব না, মা?

দুর্গা। বর কি অমন গন্ডায়-গন্ডায় পাওয়া যায় বাছা? তারও তো কোটা আছে?

বাসুদেব। কোটা?

দুর্গা। হ্যাঁ। একটা বর আর একটা অভিশাপের কোটা বাকি ছিল আমার, সেটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখান থেকে নড়তে পারছিলাম না। বরের কোটা শেষ হয়ে গেল, এখন দিলে তো অভিশাপ দিতে হয়।

সিংহ। (হাঁড়ি নিয়ে ঢোকে) তার চেয়ে যা পাচ্ছ তাই নিয়ে ভালোয় ভালোয় কেটে পড়ো দেখি। নাও মা, ওর হাতে দাও।

দুর্গা। তবে এও তোমার খারাপ হল না বাছা। তুমি গরিব বামুন, এক বরে রাজত্ব-টাজত্ব পেয়ে গেলে বদহজম হয়ে যেত, সামলাতে পারতে না, তার চেয়ে এই ভালো, হাঁড়ির ভেতর হাত ঢোকাও, আর মুড়কি বার করে খাও।

বাসুদেব। হাত ঢোকালেই মুড়কি?

দুর্গা। নিশ্চয়, অফুরান, যত চাইবে তত পাবে। শুধু হাঁড়িটার মধ্যে হাত ঢোকাতে হবে। ব্যস।

সিংহ। দেখো না, দেখো, পরীক্ষা করে দেখো।

বাসুদেব। (খায়) ওমা এ কী স্বাদ গো, অমৃত, অমৃত-

দুর্গা। ওরে অমন করে না, বিষম লেগে যাবে যে।

বাসুদেব। নাও, তোমরাও নাও-

সিংহ। কাণ্ড দেখো মা, তোমারই মুড়কির হাঁড়ি-

দুর্গা। আহা তাতে কী? বর পেয়ে গেছে, এখন ও হাঁড়ি ওর।

বাসুদেব। ঠিক ঠিক, তোমার সিংহটা একদম গাধা মা। তাহলে নাও, ছেলের হাতের মুড়কি।

দুর্গা। না বাছা, তুমি খাও।

বাসুদেব। কেন মা, খাও না, কম পড়ার তো ভয় নেই।

দুর্গা। ও আমরা অনেক খেয়েছি বাবা।

সিংহ। এ জঙ্গলে পুজো-টুজো তো জোটে না, ওই মুড়কি খেয়েই পেট চালাতে হত।

দুর্গা। আঃ, বড্ড বাজে বকে তো এটা!

সিংহ। যা বলে ঠিকই বলে মা। শোনো, এতদিন ধরে লাগাতার মুড়কি খেয়ে আমাদের সকলেরই একটু অম্বল মতো হয়েছে। ও আর কেউ খাবে না।

বাসুদেব। ও, বেশ, তাহলে মা, ফিরে যাই! তোমার বউমা আবার এতক্ষণে কী করছে কে জানে?

দুর্গা। যাও বাছা। পেশো, ওকে একটু পৌঁছে দিয়ে আয় তো? ওঠো বাবা, ওর পিঠে ওঠো, ও তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে।

বাসুদেব। ও আমাকে পিঠে নেবে? মানে, নিতে পারবে?

দুর্গা। পারবে না কেন? ও হচ্ছে পশুরাজ, সিংহ-

সিংহ। ছিলাম। একসময়, কৈলাশে থাকতে। এখন না খেয়ে খেয়ে আর অম্বলে ভুগে ভুগে বনবেড়াল হয়ে গেছি।

বাসুদেব। ঠিক। প্রথম যখন ভেতর থেকে বেরিয়ে এলে আমার তো দেখে বনবেড়ালই মনে হয়েছিল।

সিংহ। (প্রচণ্ড ধমকে) চোপ। ওঠো তো, ওঠো-পিঠে ওঠো। ওঠো শিগগির।

বাসুদেব। উঠব? কিন্তু-

সিংহ। খামোখা মাথা গরম করে দিয়ো না বলছি। ইয়ে ইজ্জত কা সওয়াল হ্যায়। বলে কিনা বনবেড়াল!

বাসুদেব। কী আশ্চর্য, প্রথমে তো তুমিই বললে? বললে না?

সিংহ। আমার নামে আমি যা ইচ্ছে তাই বলব, তাই বলে তুমি বলবার কে হে?

বাসুদেব। কিছু মনে কোরো না ভাই। আসলে-

সিংহ। চোপ, ওঠো।

[ বাসুদেব সিংহের পিঠে ওঠে, হাতে হাঁড়ি। অন্ধকার ]

দ্বিতীয় দৃশ্য

[ বাসুদেবের বাড়ি। উঠোনে বসে আছে বাসুদেব আর সিংহ। সিংহর সামনে খালি থালা, সে থাবা চাটছে, ভেতর থেকে আসে বাসুদেবের বউ ]

বউ। আর দুটি ভাত দিই?

সিংহ। না না-

বউ। তাহলে একটু সুক্তো, নাকি উচ্ছে ভাজা?

সিংহ। কিচ্ছু না কিচ্ছু না, ওরে ব্বাবা।

বউ। একি একটা খাওয়া হল? পশুরাজ সিংহ বলে কথা। তার ওপর এতটা পথ ওকে বয়ে নিয়ে এসেছেন।

সিংহ। আজকাল আর পারি না বউঠান, পেটে আর সয় না।

বউ। তার ওপরে খেলে তো শুধু উচ্ছে ভাজা আর সুক্তো। এত বড়ো উপকারটা করলে, কোথায় একটু মনের সাধে রেঁধে খাওয়াব-

সিংহ। কী বলছ কী বউঠান! এই যা রেঁধেছ আমি বাপের জন্মে খাইনি কখনো।

বাসুদেব। তা বটে। গিন্নির আমার রান্নার হাতটি খাসা। আশপাশের তিন-চারটে গাঁয়ে বিয়ে অন্নপ্রাশন পৈতে-কিছু একটা লাগলে তো আর কথা নেই। ওর খোঁজ পড়বেই।

বউ। থাক, তোমাকে আর ব্যাখ্যানা করতে হবে না।

সিংহ। ঠিকই তো বলেছে। ওঃ, সকালে মুড়কি, দুপুরে মুড়কি, বিকেল সন্দে রাত্তির সব মুড়কি মুড়কি মুড়কি-তেতো খেয়ে জিভটা ছাড়ল।

বউ। তবু-শুধু তেতো খাওয়ালুম? যা হোক দুটি ভালো-মন্দ-

বাসুদেব। তা গাঁয়ের মধ্যে ভালো-মন্দ পেতেই বা কোথায় এই রাত্তিরে? হরেন মুদির কাছে যা ছিল, মশলাপাতি, কাঁচকলা উচ্ছে বেগুন বরবটি তাই বলে ধারে নিয়ে-

বউ। তা হ্যাঁ গো, এত যে ধার নিলে, শোধ করবার কথা কিছু বললে না? চাইতেই দিয়ে দিলে?

বাসুদেব। তা কী আর দেয়? আদায় করতে হল। নানারকম সব কথা বলে-

সিংহ। নানারকম কথা না কচু। সে যে কী হম্বিতম্বি তা যদি দেখতে!

বউ। হে ভগবান, তোমার পিঠে চেপে হরেনের দোকানে গিয়েছিল নাকি?

বাসুদেব। আরে না না আমাকে তেমন গাধা পেয়েছ?

সিংহ। যেতে চেয়েছিল, আমিই বারণ করলাম। কী দরকার লোকের নজর টেনে।

বউ। সে তো ঠিকই।

বাসুদেব। বটেই তো। আমিও তো তাই ভাবছিলাম, শুধু ভদ্রতা করে বলে উঠতে পারছিলাম না।

সিংহ। ভ্যাট, মিথ্যুক। ওঃ, পিঠ থেকে নামতেই চায় না। আর আমার এদিকে-

বউ। কী?

সিংহ। না না কিছু না। কী আবার? আমি পশুরাজ সিংহ, এই তুচ্ছ নস্যির মতো একটা মানুষকে পিঠে নিতে আমার-উরি বাবা রে!

বউ। কী হল?

সিংহ। না, কিছু না।

বউ। যাক, তাহলে হরেনের দোকানে তুমি যাওনি। ভগবান রক্ষে করেছেন, তাহলে হরেনের সঙ্গে ওর কথাবার্তা সব শুনলে কী করে?

সিংহ। দোকানের পেছনে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম তো। বাব্বা, যা হম্বিতম্বি তোমার কত্তার, আরে দিয়ে দেব, দিয়ে দেব- সব ধার সুদসুদ্ধ মিটিয়ে দেব।-কি, ঠিক বলছি?

বাসুদেব। একদম। শুধু হরেন কেন? সেখানে আর যারা ছিল, ওই নরোত্তম কাকা অবধি, সবাইকে বলে দিয়েছি, দুঃখের দিন শেষ, এইবার আমরা কোটিপতি হয়ে যাচ্ছি। বুঝলে গো, শহরে গিয়ে একটা মুড়কির দোকান দেব। নাম হবে-মা দুর্গা মুড়কি স্টোর্স।

সিংহ। বাঃ বাঃ, চমৎকার।

বাসুদেব। বলো বলো, নামটা কীরকম দিলাম।

সিংহ। মোটেই ভালো দিলে না। মা দুর্গা মুড়কি স্টোর্স। আর আমি যে সেই জঙ্গলের ভেতর থেকে এতটা রাস্তা তোমাকে বয়ে নিয়ে এলাম?

বউ। সত্যি গায়ে হাতে ব্যথা হয়ে গেছে বেচারির।

সিংহ। (রেগে) কী আশ্চর্য, ব্যথা হবে কেন? ব্যথা হবার কিছু নয়। কিন্তু মানুষের একটা কৃতজ্ঞতা থাকবে না?

বউ। ঠিক ঠিক, ওগো, তুমি বরং দোকানটার নাম দাও-সিংহ স্টোর্স।

সিংহ। আমার তেমন কোনো ইচ্ছে নেই, তবে তোমরা যদি নিতান্ত অনুরোধ করো-আচ্ছা, সিংহ না বলে যদি পশুরাজ স্টোর্স বলা যায়!

বাসুদেব। কিন্তু তাতে যদি আবার মা দুর্গা রেগে যান? যত যাই হোক, হাঁড়িটা তো তাঁরই বর।

সিংহ। তা অবশ্য বটে!

বউ। তাহলে তো দুজনের নামেই-

বাসুদেব। সিংহ দুর্গা মুড়কি স্টোর্স?

সিংহ। না না, আমার নামটা আগে দিয়ো না, মা কী মনে করবে। বরং দুর্গা সিংহ মুড়কি-

বাসুদেব। ধ্যুৎ, এ তো মনে হচ্ছে সিঙ্গি বাড়ির ছেলেরা বুঝি দোকান দিয়েছে, আচ্ছা দুর্গা পশুরাজ-

বউ। কে কে? ওখানে কে?

বাসুদেব। কে?

বউ। ওই ওপাশে, কার যেন একটা ছায়া সরে গেল না?

বাসুদেব। দেখি তো! (উঁকি মেরে) নাঃ, কেউ তো নেই।

বউ। কিন্তু আমি যে দেখলুম!

বাসুদেব। ভুল দেখেছ। ওই অন্ধকার ঝোপের মধ্যে কে থাকবে?

সিংহ। নাঃ, উঠি এবার, অনেক রাত হল।

বউ। এইটে নিয়ে যাও ঠাকুরপো, মা বাবা আর ছেলেপুলেদের জন্যে, খুব লজ্জা করছে, উচ্ছে সুক্তো এসব-

সিংহ। আরে দুর্দান্ত, সাংঘাতিক মারকাটারি-একবার জিভে দিলে-

বাসুদেব। মুড়কির দোকানটা দিই, হাতে টাকাপয়সা আসুক, মাকে পেট পুরে পোলাও কালিয়া খাইয়ে দেব।

সিংহ। সবই মাকে দেবে?

বউ। না না, তোমাকেও দেব। সবাইকে-

সিংহ। দেখা যাবে, চলি গো। সাবধানে থেকো।

বাসুদেব। থাকব।

সিংহ। ওই হাঁড়িটা-

বউ। হ্যাঁ হ্যাঁ, এ জিনিস কেউ অযত্ন করে?

সিংহ। যাই তাহলে?

বউ। যাই বলতে নেই। বলো আসি। দুগগা, দুগগা, দুগগা-

সিংহ। মা এসেছে নাকি? কই, কোথায়?

বউ। না না, যাবার সময় বলতে হয়। দুগগা, দুগগা, দুগগা-

[ সিংহ বুঝতে পেরে চলে যায়

বউ। চলো, ঘরের ভেতরে যাই।

বাসুদেব। যাচ্ছি যাচ্ছি দাঁড়াও।

বউ। আবার ওটাকে নিয়ে কী করছ? ঘরে নিয়ে এসো।

বাসুদেব। একবার! একটিবার!

বউ। কী?

বাসুদেব। এই দেখো, ফাঁকা হাঁড়ি। হাত ঢোকালেই ম্যাজিক।

বউ। মুড়কি!

বাসুদেব। আহাহা, কী খেতে গো! ধরো ধরো- (নাচে) হাতে মুড়কির হাঁড়ি, কার কড়ি আর ধারি-

বউ। দেখো কাণ্ড! পাগল হয়ে গেলে নাকি?

বাসুদেব। ঠিক বলেছ? কেমন পাগল-পাগলই লাগছে বটে।

[ নেপথ্য থেকে ডাক শোনা যায় নরোত্তমের, বাসুদেব বাড়ি আছে নাকি হে, বাসুদেব? হরি হরি- হর হর- ]

বাসুদেব। সেরেছে। নরোত্তম কাকার গলা না? পালাও পালাও, এটিকে নিয়ে-

[ বলতে বলতেই ঢুকে পড়েছে নরোত্তম ]

নরোত্তম। হরি হরি হর হর- কী হল?

বাসুদেব। কী হল? কী হবে? কিছু না।

নরোত্তম। না না, কিছু তো হল? আমার গলার আওয়াজ পেয়ে-

বউ। কী?

নরোত্তম। কী যেন একটা বিচলিত, ব্যস্ত, ব্যাকুল-

বাসুদেব। না না, সেসব কিছু না। এই-ঘরের ভেতরে যাচ্ছিলাম আর কি।

নরোত্তম। ঘরের ভেতরে যাচ্ছিলে? কেন?

বউ। কেন আবার? খাব তারপর শুয়ে পড়ব?

নরোত্তম। খাবে? কী খাবে?

বউ। কী আর? দুটি ভাত!

নরোত্তম। (মেঝে থেকে সিংহের খাওয়া থালাটা তুলে) তাহলে এটা কী খেলে? অথবা কে খেল? একটা-দুটো ভাঙা ভাত, দু-এক কুচি উচ্ছে, সুক্তোর ঝোল।

বউ। ওটা ওটা আসলে-

বাসুদেব। আমিই খেয়েছিলাম। বেশ খোলা আকাশের নীচে, ইয়ের মধ্যে বসে-তারপর আপনার বউমা খাবে বলে ভেতরে যাচ্ছিল আর কি!

নরোত্তম। হরি হরি হর হর-আশ্চর্য, অদ্ভূত, অভাবিতপূর্ব!

বউ। কী হল কাকা?

নরোত্তম। সুক্তো দিয়ে ভাত খাবার পর আবার মুড়কি খাচ্ছ? পেট খারাপ হবে যে!

বাসুদেব। মু-মুড়কি?

নরোত্তম। ওই যে, তোমার মুখে লেগে আছে।

বাসুদেব। হ্যাঁ মুড়কি-খাচ্ছিলাম। আসলে-

বউ। মুড়কি খেতে বড্ড ভালোবাসে কিনা।

বাসুদেব। দেখলে আর লোভ সামলাতে পারি না।

বউ। খাবার পরেও খেয়ে ফেলে।

নরোত্তম। হরি হরি হর হর-তা পায় কোথায় মুড়কি?

বাসুদেব। কেন? হাঁড়িতে!

নরোত্তম। হাঁড়িতে! মানে, এই হাঁড়িতে?

বউ। হ্যাঁ কাকা, এই হাঁড়িতেই তো।

নরোত্তম। তা এখন তো হাঁড়িতে কিছুই নেই দেখছি।

বউ। না, কিছুই নেই। দেখুন না, সব খেয়ে শেষ করে দিয়েছে।

বাসুদেব। হ্যাঁ, হাঁড়ি একেবারে লেপাপেঁাছা।

নরোত্তম। শিহরণময়, রোমাঞ্চকর, তাৎপর্যপূর্ণ, মুড়কির হাঁড়িতে এক-আধটা মুড়কি থাকবে না, কিংবা গুড় লেগে একটু চটচটে থাকবে না? (শুঁকে) মুড়কির একটু গন্ধ পর্যন্ত হাঁড়িতে নেই, হরি হরি হর হর-

বাসুদেব। দিন। এবার ওটা আমায় দিন!

নরোত্তম। দেব? তোমায় দেব?

বাসুদেব। মাটির জিনিস, হাত থেকে পড়ে যদি ভেঙে-টেঙে যায়-

নরোত্তম। না না, হাত থেকে পড়বে কেন? এটাকে আমি খুব সাবধানে রাখব।

বউ। রাখবেন! রাখবেন মানে?

নরোত্তম। রাখব। হরি হরি হর হর-

বাসুদেব। কো-কোথায় রাখবেন?

নরোত্তম। ধরো, যদি থানায় নিয়ে গিয়ে রাখি?

বাসুদেব। কেন? থানায় কেন?

নরোত্তম। এমন একটা হাঁড়ি, ভেতরটা তকতকে অথচ সেটা নাকি ভরা ছিল মুড়কিতে-

বউ। তাতে কী হয়েছে?

নরোত্তম। এঁটোথালা পড়ে আছে, কে খেয়েছে কোনো হদিশ নেই!

বাসুদেব। বললাম তো আমি খেয়েছি।

নরোত্তম। ভাত খেয়ে মুড়কি খাওয়া-তদুপরি আজ সন্ধেবেলা হঠাৎ তাড়াহুড়ো করে হরেনের দোকান থেকে একগাদা তরিতরকারি কেনা-দুজনের সংসারে প্রায় এক মাসের খোরাক, তদুপরি ধার বাকির কথা তুলতে বারফট্টাই, আস্ফালন, হম্বিতম্বি সব নাকি মিটিয়ে দেওয়া হবে?

বাসুদেব। হবে, বলছি তো সব মিটিয়ে দেওয়া হবে।

নরোত্তম। কিন্তু কী করে? তার ওপর ওই ঝোপের মধ্যে থেকে দেখলাম, এখানে আর একজন কে বসে আছে, দূর থেকে ঠিক ঠাহর হল না, কিন্তু খুবই বিদঘুটে দেখতে, মানুষ বলে মনেই হয় না।

বউ। ও, আপনিই তখন ঝোপ থেকে উঁকি মারছিলেন?

নরোত্তম। মারতে হচ্ছিল, সন্দেহটা যখন জেগেছে তখন ভঞ্জন, অপনোদন, নিরসন করবার চেষ্টা না করলে তো-হরি হরি হর হর-উঠি।

বাসুদেব। ওকী! হাঁড়িটা নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?

নরোত্তম। বাড়ি-মানে, থানায়। দেখতে হবে-

বউ। কী দেখতে হবে?

নরোত্তম। ব্যাপারটা কী? খুঁজতে হবে-

বাসুদেব। কী?

নরোত্তম। এটা কোত্থেকে এল! মানে কোথা থেকে চুরি!

বাসুদেব। চুরি! চুরি কেন হতে যাবে? এ তো- (বউ চিমটি কাটে, চুপ করে যায় বাসুদেব, সেটা দেখে নরোত্তম)

নরোত্তম। সন্দেহজনক? খুব সন্দেহজনক। চিমটি কাটা। কথা বলতে বলতে চুপ করে যাওয়া, তারপরে ধরো, সকালবেলা খালি হাতে বাড়ি থেকে বেরোল, আর ফিরে এল এরকম একটা মুড়কির হাঁড়ি হাতে-কোথায় গিয়েছিল, কোত্থেকে পেল-আদালতে তো যেতেই হবে। হরি হরি হর হর-

বাসুদেব। শুনুন, শুনুন কাকা-

নরোত্তম। যা শোনবার থানায় শুনব, তারপর শুনব আদালতে। চলি।

[ চলে যায়

বউ। চলে গেল, ওগো, চলে গেল যে!

বাসুদেব। কপাল কপাল কপাল! মা দুর্গার বর পেয়েও রাখতে পারলুম না গো।

বউ। ও তো ধরে ফেলবে। হাঁড়ির ভেতর হাত ঢুকিয়ে যেই মুঠো করবে-

বাসুদেব। অমনি মুঠো ভরে যাবে মুড়কিতে। তারপর দুর্গা সিংহ বদলে নরোত্তম স্টোর্স। হায় হায় হায়-

[ কপাল চাপড়ায়, মাথা খোঁড়ে মাটিতে ]

বউ। শোনো, কপাল চাপড়ে কোনো লাভ নেই। তুমি আর একবার মা দুগগার কাছে যাও।

বাসুদেব। গিয়ে?

বউ। আর একবার ওইরকম একটা হাঁড়িকুড়ি কিছু বর চেয়ে নাও।

বাসুদেব। বলছ?

বউ। বলছি, আচ্ছা বেশ, না হয় আমিও যাই তোমার সঙ্গে। মায়ের কাছে গিয়ে কেঁদে পড়ি।

বাসুদেব। নাঃ, কোনো লাভ নেই।

বউ। একথা বোলো না। মায়ের এত দয়া-

বাসুদেব। আরে দয়া দিয়ে কী হবে? কোটা নেই তো!

বউ। কোটা? সে আবার কী?

বাসুদেব। ও, তোমাকে তো বলাই হয়নি, দেব-দেবীদের সব বর-অভিশাপের কোটা থাকে। মা দুগগার বরের কোটা শেষ। বাকি আছে অভিশাপের কোটা।

বউ। অভিশাপের কোটা?

বাসুদেব। হ্যাঁ, এখন গিয়ে বর চাইলে যদি অভিশাপ দিয়ে দেন?

বউ। ওরে বাবা! কী হবে তাহলে?

বাসুদেব। কী আবার হবে? যেমন চলছিল চলবে!

বউ। না, চলবে না। মুড়কির হাঁড়ির রহস্য জেনে ফেললে নরোত্তম কাকা তাই নিয়ে কম হইচই করবে বলে মনে করেছ?

বাসুদেব। হইচই করবে? অসম্ভব। এর কথা কাউকে জানতেই দেবে না।

বউ। কিন্তু থানায় নিয়ে গেল যে। সেখান থেকে আদালত।

বাসুদেব। সব মিথ্যে কথা। তবে বাধা দিলে চ্যাঁচামেচি করত, আমাদের বিপদে ফেলার চেষ্টা করত। চাই কী কায়দা-কানুন করে আমাদের জেলে পুরে দিত।

বউ। তাহলে কী করবে এখন?

বাসুদেব। শোনো।

বউ। কী?

বাসুদেব। যা থাকে কপালে, চলো, মা দুর্গার কাছেই যাই। গিয়ে সব খুলে বলি।

বউ। তারপর! বর তো দেবার খ্যামতা নেই বললে, যদি অভিশাপ দিয়ে দেন?

বাসুদেব। দিলে দেবেন।

বউ। দিলে দেবেন? অভিশাপ?

বাসুদেব। কী আর করব বলো, এরকমভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে অভিশাপ লেগে ভস্ম হয়ে যাওয়া অনেক ভালো।

বউ। বেশ, চলো তাহলে।

বাসুদেব। একী! তুমিও যাবে নাকি?

বউ। নয়তো কী। একা তুমি যাবে? শাপ লাগলে দুজনেরই লাগুক।

বাসুদেব। ও, তা বটে।

বউ। আর তা ছাড়া মা দুগগাকে একবার চোখের দেখা দেখব না?

বাসুদেব। ঠিক, ঠিক বলেছ, চলো তাহলে। ঘরদোর সব বন্ধ করো।

বউ। কী হবে?

বাসুদেব। সেকী? ঘর বন্ধ করবে না? চোরে যদি-

বউ। তোমার আমার চোখের সামনে থেকে হাঁড়িটা তো চুরি হয়ে গেল। ঠেকাতে পারলাম?-সব খোলাই থাক।

[ দুজনে বেরিয়ে যায়, পা টিপে টিপে ঢোকে নরোত্তম, মুড়কি খাচ্ছে, হাতে হাঁড়ি ]

নরোত্তম। হরি হরি হর হর

রাত বিরেতে বেরিয়ে পড়ো

মতলব ঠিক আছেই কিছু

ছাড়ব না তো তোদের পিছু।

তৃতীয় দৃশ্য

[ অন্ধকার রাত, জঙ্গলের মধ্যে সেই মন্দির, বাসুদেব আর তার বউ ঢোকে ]

বাসুদেব। এই সেই মন্দির।

বউ। মা দুগগা এখানে থাকেন?

বাসুদেব। হুঁ। সপরিবারে।

বউ। চারপাশে কোনো সাড়াশব্দ নেই।

বাসুদেব। এই চাতালটায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

বউ। তা এখনও কি সেই মতলব আঁটছ নাকি? মাকে ডাকো।

বাসুদেব। ডাকব?

বউ। ডাকবে না? এতটা রাস্তা এলুম?

বাসুদেব। রাত্তিরবেলা শুয়েছেন, ঘুম থেকে তোলাটা কি ঠিক হবে? তার চেয়ে বরং কাল সকালে এসে যদি-

বউ। কাল সকালে? এখন ফিরে গিয়ে আবার কাল সকালে আসবে?

বাসুদেব। তাও তো বটে। তাহলে এই চাতালে শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দিই। মা ঘুম থেকে উঠলে-

বউ। সেই ভালো, রাতটা কাটিয়েই দিই।

বাসুদেব। হয়তো এটাই শেষ রাত। কাল কী অভিশাপ কপালে নাচছে কে জানে। তবে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে কোনো বিচ্ছিরি শাপ হয়তো দিতে পারবে না। মানে, সকালবেলা মনটা একটু ইয়ে থাকে তো?

[ দুজনে শুয়ে পড়ে। বাজনা, আলো কমে আসে। জঙ্গলের ভেতর থেকে ভেসে আসে নানা জন্তুর ডাক। পা টিপে টিপে ঢোকে নরোত্তম, হাতে মুড়কির হাঁড়ি ]

নরোত্তম। হরি হরি হর হর-জঙ্গলের মধ্যে ভাঙা মন্দির। হুঁ অসামাজিক কাজকর্মের আখড়া হতে পারে, এরা দুটোতে কি ঘুমিয়েই পড়ল? তার মানে চোরাচালানটা হবে পরে, ভোরের দিকে, তাহলে তো সারারাত জেগে কাটাতে হবে? কী বিপদ! কী বিপদ! এদের মতো এই চাতালে শুয়ে রাত কাটানো ঘুমোনো তো আর আমার দ্বারা হবে না। তা ছাড়া গাঁয়ের মধ্যে ঠিক আছে, কিন্তু এই বিজন বনে যদি দুজনে মিলে আমার গলা টিপে মেরে রেখে দেয়, কাকপক্ষীতেও টের পাবে? -কী করব তাহলে? ফিরে যাব? এত দূরে এসে-(যে পথ দিয়ে এসেছিল সেই দিকটা দেখে) ওরে বাবা, এ তো ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। এখানে আসবার সময় সামনের দিকে ওরা ছিল। কিন্তু একা একা এর মধ্যে দিয়ে, তা ছাড়া এতটা হেঁটে পা-ও তো কনকন করছে। নাঃ, ঝোঁকের মাথায় এদের পিছু নিয়ে আসাটা মুখ্যুমিই হয়ে গেল দেখছি।

[ বউ হঠাৎ উঠে বসে। চট করে লুকিয়ে পড়ে নরোত্তম ]

বউ। কে? কে?-শুনছ? ওগো, শুনছ?

বাসুদেব। কী, কী হল?

বউ। ভূত।

বাসুদেব। কে?

বউ। ভূত, ভূত ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখলাম।

বাসুদেব। যাঃ!

বউ। না না, সত্যি, পষ্ট দেখলাম, ঘুমের মধ্যে।

বাসুদেব। ঘুমের মধ্যে কেউ পষ্ট দেখে না, স্বপ্ন দেখে।

বউ। স্বপ্ন? বলছ।

বাসুদেব। বলছি তো। শুয়ে পড়ো, শুয়ে পড়ো। রাত কাটতে ঢের দেরি।

[ দুজনে শুয়ে পড়ে। আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে নরোত্তম ]

নরোত্তম। বাবাঃ। এবারটা বেঁচে গেলাম। কিন্তু আর তো ঝুঁকি নেওয়া যায় না। এক কাজ করি, মন্দিরের মধ্যে ঢুকে ঘাপটি মেরে বসে থাকি। কিন্তু ভাঙা মন্দির, যদি সাপখোপ থাকে ভেতরে? (উঁকি মেরে দেখে) নাঃ, বেশ পরিষ্কারই তো আছে মনে হচ্ছে। তার মানে নিয়মিত এর মধ্যে যাতায়াত হয়। আলিবাবার গুহার ধনরত্ন লুকোনো আছে কি না কে বলতে পারে? দেখি তো?

[ ভেতরে ঢুকে যায়, উঠে বসে বাসুদেব আর তার বউ ]

বাসুদেব। কী বুঝলে?

বউ। কী সাংঘাতিক!

বাসুদেব। কী শয়তান ভাবো। আমাদের পিছু ধাওয়া করে করে এতদূরে এসেছে।

বউ। ভাগ্যিস ঘুমের মধ্যে দেখলাম।

বাসুদেব। কচু। আমি অনেকক্ষণ আগেই দেখেছি, মটকা মেরে পড়েছিলাম তো!

বউ। তাহলে তখন বললে কেন, স্বপ্ন দেখছি?

বাসুদেব। বাঃ, পুরোটা দেখতে হবে না? কাকা কদ্দূর কী করে?

বউ। কী হবে বলো তো এখন?

বাসুদেব। দেখা যাক, মন্দিরের মধ্যে তো ঢুকল।

[ হঠাৎ প্রচণ্ড চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে আসে নরোত্তম, তার ধুতিটা কামড়ে ধরে আছে সিংহ ]

নরোত্তম। ওরে বাবারে, এটা কী রে! (ভালো করে দেখে) এই বনবেড়ালটা তো ভারী বেয়াদপ। এই হেট হেট, ভাগ!

সিংহ। বনবেড়াল! তবে রে!

[ সিংহ মুখ খুলতেই ছাড়া পেয়ে গেছে নরোত্তম, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সিংহ আবার এক লাফে ধুতি চেপে ধরে ]

নরোত্তম। ওরে মারে, ওরে পিসিমারে, ওরে জেঠিমারে-

[ সিংহর মুখ বন্ধ। সে শুধু গর্জন করছে আর লাফাচ্ছে। চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে আসে কার্তিক আর গণেশ ]

কার্তিক। কে কে কে- কী হল, কী হল?

গণেশ। চোর, চোর ঢুকেছিল মন্দিরে।

নরোত্তম। আমি চোর নই, আমি চোর ধরতে এসেছিলাম।

কার্তিক। রাত্তির বেলা চুপিচুপি চোর ধরতে ঢুকেছিলে? গণশা, ধর তো ব্যাটাকে চেপে ধর।

[ নরোত্তম গণেশকে দেখে পালাতে যায়, হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায় হাঁড়ি ]

গণেশ। হাঁড়ি!

কার্তিক। এ তো মুড়কির হাঁড়ি!

সিংহ। এ হাঁড়ি ওর কাছে গেল কী করে? এ তো মা সেই বামুন আর তার বউকে-

বাসুদেব। কেড়ে নিয়েছে।

গণেশ। একী! তোমরা?

কার্তিক। তোমরা কারা? এত রাত্তিরে এই জঙ্গলের মধ্যে- কী মতলব?

সিংহ। আরে! তোমরা!

কার্তিক। পেশো? তুই এদের চিনিস?

সিংহ। চিনব না কেন? এই তো সেই বামুন, মা যাকে ওই মুড়কির হাঁড়ি বর দিয়েছিল।

কার্তিক। ও, তুমিই সেই।

গণেশ। আর তুমি বুঝি ওর গিন্নি? ওঃ, যা একখানা সুক্তো আর উচ্ছেভাজা খাইয়েছিলে-পাগলা!

কার্তিক। কিন্তু তোমাদের মুড়কির হাঁড়ি ওর হাতে গেল কী করে?

নরোত্তম। দিয়েছে।

সিংহ। দিয়েছে?

নরোত্তম। হ্যাঁ। গরিব কাকাকে জ-জ-জন্মদিনের উপহার।

বাসুদেব। মিথ্যে কথা। আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। মা দুর্গার বর কখনো কেউ কাউকে বিলিয়ে দেয়?

নরোত্তম। না না, সত্যি দিয়েছে। এই পাজি, দিয়ে ফিরিয়ে নিলে কী হয় জানিস না? কালিঘাটের কুকুর-

সিংহ। চোপ!

নরোত্তম। না না, সত্যি।

কার্তিক। আবার কথা?

নরোত্তম। বিশ্বাস করুন-

গণেশ। দেব নাকি শুঁড় দিয়ে গলাটা পেঁচিয়ে।

সিংহ। দাও না দাও, মজা বুঝুক।

[ সবাই মিলে তেড়ে যায়, ধরে ফেলে নরোত্তমকে ]

নরোত্তম। বাঁচাও, বাঁচাও!

কার্তিক। আমাদের হাত থেকে কে তোকে বাঁচাবে রে-

সিংহ। ব্যাটা চোর ডাকাত গুন্ডা-

নরোত্তম। কী বিপদেই পড়লুম। হরি হরি হর হর-

শিব। (ভেতর থেকে) কে? কে ডাকে আমায়?

গণেশ। খেয়েছে। বাবা।

কার্তিক। ঘুমটা ভাঙালি তো?

গণেশ। তুই-ই তো চ্যাঁচামেচি করে-

[ চোখ মুছতে মুছতে শিব ঢোকেন, পেছন পেছন দুর্গা ]

শিব। এত রাত্তিরে বনের মধ্যে আমার নাম ধরে ডাকলি কে রে?

সিংহ। এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন বাবাঠাকুর!

শিব। উঠব না? বলিস কী? আমার ভক্ত এই ঘোর জঙ্গলে আসতে পারে শুধু আমাকে ডাকার জন্যে, আর আমি একটু বিছানা ছেড়ে উঠে তাকে দর্শন দিতে পারব না? কে? কে ডাকছিলি বাপ?

নরোত্তম। আমি প্রভু। হরি হরি হর হর-

বাসুদেব। না, উনি ঠিক আপনাকে ডাকেননি।

শিব। আলবাত ডাকল। এই মাত্র ডাকল। আমাকে কি কালা পেয়েছ নাকি? শোনো বাপু, হরি অবশ্য এখানে থাকে না, তা না থাক, আমি হর তো আছি, আমিই তোমাকে না হয়-

দুর্গা। তুমি যাও দেখি, ভেতরে যাও, কাঁচা ঘুম ভেঙে উঠে এসে-

শিব। আরে ধ্যুৎ, কোথায় যাব, আমি এখন ওকে বর দেব।

নরোত্তম। বর দেবেন প্রভু! কী কপাল আমার-

শিব। বল, কী চাই তোর?

কার্তিক। সেরেছে।

নরোত্তম। কী চাই? আমি চাই-আমি চাই-আমি চাই-

সিংহ। (পেছন থেকে কোঁতকা মেরে) হাঁড়ি।

নরোত্তম। হাঁড়ি। -যাঃ!

শিব। তথাস্তু। পেশো, যা নিয়ে আয়।

সিংহ। কী?

শিব। হাঁড়ি, হাঁড়ি। মুড়কির হাঁড়িটা আড়ায় ঝোলানো আছে না, সেইটা এনে আমার এই ভক্তকে দে।

গণেশ। কিন্তু সে হাঁড়ি তো-

কার্তিক। চেপে যা না। গোবর গণেশ!

শিব। আহাহা, কতকাল পরে এই আকুল করা ডাক শুনলাম গো! বলো তো বাপধন, আর একবার বলো তো?

নরোত্তম। আজ্ঞে, হর হর-

শিব। প্রাণ জুড়িয়ে গেল। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে, হাঁড়িটা ভক্তকে দিয়েই আমি- (হাই তুলে তুড়ি দেয়)

দুর্গা। কী হল, যা? হাঁড়িটা নিয়ে এসে তোর বাবাকে দে।

শিব। দে দে, তাড়াতাড়ি কর।

দুর্গা। হাঁড়িটা? বুঝলি তো? হাঁড়িটা নিয়ে আয়, কী বুঝলি?

সিংহ। বুঝেছি বুঝেছি, আর বেশি বুঝিয়ো না, তাহলে বাবাসুদ্ধু বুঝে যাবে।

[ সিংহ ভেতরে যায়

শিব। কী হল, কী হল? বাবাসুদ্ধু কী বুঝে যাবে?

দুঃ,কাঃ,গণেশ। না না, কিছু না, কিছু না।

শিব। না না, কিছু একটা তো বটেই। কী একটা বোঝার কথা-। ধ্যুৎ, ঘুমচোখে কি আর মাথা কাজ করে? (সিংহ হাঁড়ি নিয়ে ঢোকে) হ্যাঁ, দে, এই নাও বাপু তোমার বর। এমনিতে তো দেখছ বেশ ফাঁকা, কিন্তু হাঁড়ির ভেতরে হাত ঢোকালেই-

নরোত্তম। মুড়কি?

সিংহ। আঃ, মুড়কি না সন্দেশ সে তো দেখতেই পাবে। বুড়ো মানুষ ঘুম থেকে উঠে এসেছে, শতেক জেরা।

শিব। ব্যস, বর-টর যা দেবার হয়ে গেল, যাও বাপু, খুশি মনে বাড়ি চলে যাও। আর শোনো, ফের যেন মাঝরাত্তিরে ডাকাডাকি কোরো না। এটা-ওটা খাই তো, কাঁচা ঘুম ভেঙে গেলে কষ্ট হয়, যাও।

নরোত্তম। নে, এই নে তোদের মুড়কির হাঁড়ি, আর এই হল আমার হাঁড়ি। শিবের বর। একবার হাত ঢোকালেই-

[ হাঁড়ির মধ্যে হাত ঢোকায়। সঙ্গে সঙ্গে আলোয় বাজনায় চিৎকারে লন্ডভন্ড বেঁধে যায়। কোথা থেকে মঞ্চে ঢুকে পড়ে ভূতপ্রেতের দল। তারা নাচতে থাকে, গান গায় আর নরোত্তমকে বেজায় মারে ]

ভূতদের গান। এইবার একে বাগেতে পেয়েছি বজ্জাতটাকে পেটাব

এদ্দিন ধরে আটকে থাকার রাগঝাল সব মেটাব।

চুলগুলো ধর শক্ত মুঠোয় পিঠে গুমাগুম মার কিল।

গাঁটে গাঁটে মেরে খুলে ফেলে দেব হাতের পায়ের সব খিল।

ব্যাটা পাষণ্ড অতি শয়তান তাই তো পেয়েছে অভিশাপ

একমাস ধরে বিছানায় শুয়ে করুক এবার বাপ বাপ।

[ ভূতের দল মিলিয়ে গেলে আলো স্বাভাবিক হল। নরোত্তম মাটিতে পড়ে আছে, অজ্ঞান ]

বউ। এসব কী গো?

বাসুদেব। উরিব্বাপ!

সিংহ। অভিশাপ।

বউ। কাকা, ও কাকা?

কার্তিক। থাক না, আবার খোঁচাখুঁচি করছ কেন?

বউ। না না, মানুষটা এরকম অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকবে-

বাসুদেব। যত যাই হোক, আমাদেরই তো জ্ঞাতি। কাকা, কাকা-

বউ। কাকা-কাকা-

নরোত্তম। (জ্ঞান ফিরছে।) ভূ-ভূ-ভূ-

বউ। চলে গেছে। আর নেই কাকা!

নরোত্তম। দই-দই-দই-

গণেশ। কী?

নরোত্তম। দই-দই-

বাসুদেব। দই খাবেন?

গণেশ। কারবার দেখো। এই অবস্থাতেও দই খেতে চাইছে। কী লোক রে?

নরোত্তম। (নরোত্তম হঠাৎ ধড়ফড় করে উঠে বসে) ভূত, প্রেত, দৈত্য। উরি বাবারে-

[ দৌড় দেয়। সোজা মঞ্চের বাইরে

বউ। ও কাকা, খোঁড়াচ্ছেন যে!

বাসুদেব। পড়ে যাবেন যে, ও কাকা?

দুর্গা। কিছু হবে না, কিছু হবে না, ঠিক নিজের গাঁয়ে ফিরে যেতে পারবে। যাক গে, তা বাবা পেশো, কার্তিক গণেশ, গোছগাছ শুরু করো, ভোরেই তো আবার রওনা দিতে হবে। রাত শেষ হয়ে এল, আর সময় নেই।

বউ। কোথায় যাবে মা?

দুর্গা। কোথায় আবার, শহরে? এ জঙ্গলে থাকার পালা শেষ; এবার শহরের মন্দিরে যেতে হবে না?

গণেশ। শহরের মন্দিরে?

কার্তিক। তাই তো, বরদান, অভিশাপ দান দুটোর কোটাই তো শেষ। এবার তাহলে শহরের মন্দির।

গণেশ। ওঃ, দাদারে। (কার্তিককে জড়িয়ে ধরে)

কার্তিক। আরে ধ্যাৎ, তোর শুঁড়টা সামলা। নরম নরম, কাতুকুতু লাগে না?

সিংহ। কিন্তু মা, বাবা যদি সব জানতে পারে?

দুর্গা। দূর! তুইও যেমন? অ্যাদ্দিনেও ওঁকে চিনলি না? ঘুমের ঘোরে কী বর দিয়েছেন, ঘুম ভাঙলে সেসব মনে থাকবে নাকি? তাহলে আর আমার ভাবনা ছিল না। নে নে, বকাস না, ভেতরে চল। রাজ্যের গোছগাছ সব বাকি-

গণেশ। যাই, ইঁদুরটাকে ঘুম থেকে তুলি।

কার্তিক। হ্যাঁ, ময়ূরটাকেও-

[ বলতে বলতে দুজনে ভেতরে চলে যায়, দুর্গাও পা বাড়ান, এমন সময়- ]

বাসুদেব। মা!

দুর্গা। কী বাছা? তোমাদের আবার কী হল?

বাসুদেব। কিছুই তো হল না মা, মুড়কির হাঁড়িটা ভেঙে গেল, ও দিয়ে কি আর কিছু কাজ হবে?

দুর্গা। ওঃ, তাই তো, বেরোবার সময় এ আবার কী জ্বালাতন?

সিংহ। জ্বালাতন না জ্বালাতন, তোমরা এরকম এঁটুলির মতো কেন বলো দেখি!

দুর্গা। ওকী কথা পেশো? গরিব মানুষকে ওরকম করে কেউ বলে?

সিংহ। গরিব মানুষ তো কী? সব সময় গরিব গরিব ভাব করে থাকলে আর বড়োলোক হতে হয় না। কেন, মা তো মুড়কির হাঁড়ি দিয়েছিল, রাখতে পারলে না কেন? নরোত্তম কাকা এসে নিয়ে চলে গেল, কচি খোকাটি।

বউ। তা কী করব?

সিংহ। দেখেছ মা? কীরকম পিত্তি জ্বালানো কথা? কী আবার করবে, আটকাবে? তোমরা দুজন ও একা, তোমরা জোয়ান ও বুড়ো-আটকাতে পারনি?

বাসুদেব। ভয় দেখাল যে, আইন, আদালত-বলল পুলিশে খবর দেবে।

সিংহ। দেবে। সে যা করবার করত, তোমরা যা করবার করতে। পুলিশের ভয়ে হাঁড়িটা ওর হাতে তুলে দিয়ে কী মোক্ষলাভ হল তোমাদের? যত্তসব।

দুর্গা। পেশো ঠিকই বলেছে। নিজেদের ভালোটা নিজেদেরই দেখতে হয়। বাইরে থেকে বর নিয়ে কি আর জীবন চলে বাছা?

বাসুদেব। বলতে খুব সহজ! করব কী সেটা তো কেউ বলে দেয় না।

দুর্গা। কেন? তোমার রান্নার হাতটি তো খাসা, তাই দিয়ে কিছু করা যায় না?

সিংহ। ঠিক ঠিক, এর বাড়িতে ওমুক, ওর বাড়িতে তমুক-চারদিকে ঘুরে ঘুরে তুমি অর্ডার আনবে, আর তুমি রান্না করে দেবে। আস্তে আস্তে নাম ছড়াবে, টাকা হবে, ব্যবসা বাড়বে-তারপর-

দুর্গা। আর তারপর নেই। ভোর হয়ে গেল, পাখি ডাকছে। যত দেরি করবি তত রোদ চড়ে যাবে, চল, ভেতরে চল-

বাসুদেব। মা গো, আমাদের আশীর্বাদ করছ তো?

দুর্গা। করছি বাছা করছি। দু-হাত তুলে আশীর্বাদ করছি, কিন্তু আর বর দিতে পারব না, চল।

[ সিংহ আর দুর্গা তড়িঘড়ি ভেতরে চলে যায়

বাসুদেব। কী বুঝলে বলো তো?

বউ। বুঝেছি গো, বুঝেছি, আসল কথাটাই বুঝেছি।

বাসুদেব। সেই আসল কথাটা কী?

বউ। হাঁড়ি-টাঁড়ি কিছু নয়, ওই পরামর্শটাই হল বর, আসল বর, চলো।

[ দুজনে যেতে যায়, হঠাৎ বাসুদেবের পায়ে লাগে ভাঙা হাঁড়ির একটা টুকরো, তুলে নিয়ে দেখে, তারপর ছুঁড়ে ফেলে দেয় জঙ্গলে। দুজনে হেসে ওঠে। ভোরের আলো এসে পড়েছে ওদের ওপর। জঙ্গল জুড়ে পাখি ডাকছে ]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *