মুজাহেদিন
প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সংগঠনের ঢেউ উঠিয়াছে। ও-পাড়ার ব্রাহ্মণ-বৈদ্য সবাই মিলিয়া শুদ্রদের জলগ্রহণ করিবার জন্য দৃঢ়-সংকল্প হইয়াছে।
দেখাদেখি এ-পাড়ার মুসলমান যুবকদের মধ্যেও উৎসাহের বান ডাকিয়াছে। তারা ফুটবল ও তাশ খেলা ছাড়িয়া দিন-রাত সভা-সমিতি করিতেছে, তনযিম কমিটি গঠন করিতেছে, আখড়া স্থাপন করিতেছে, লাঠি ভাজিতেছে, ‘বেদে’ ‘হাজাম’ প্রভৃতি ‘অস্পৃশ্য’ মুসলমানদিগকে সমাজে গ্রহণ করিবার কথা প্রবীণদিগের নিকট পাড়িবার পরামর্শও করিতেছে।
তরুণের উৎসাহ ঝড়ের আগুন। যে আগুনে দেশের জনসাধারণও জ্বলিয়া উঠিল। তারা উৎসাহে মাতিয়া গেল। আহার-দ্রিা অবহেলিত হইল! দলে-দলে তরুণ বুড়া ‘আল্লাহু আকবার’ বলিয়া ভিক্ষায় বাহির হইল। ধান চাউল পাট কাঠ বাঁশ যে যা দিল, সবই গ্রহণ করিল। নিজেরা তা কাঁধে করিয়া এক ঠাই জড় করিল। সদলবলে জমিদারের বাড়ি ধন্না দিল। জমি আদায় করিল। ধান চাউল পাট বিক্রয় করিয়া সুতার ডাকিল। ঘর উঠিল।
যুবকেরা আবার বাড়ি বাড়ি দাওয়া করিল। ছেলে ধরিয়া আনিয়া এক সরগরম মাইনর স্কুল স্থাপন করিল। শহরে গিয়া স্কুল-পরিদর্শককে ধরিয়া আনিল। মাসে পঞ্চাশ টাকা করিয়া সাহায্য আদায় করিল।
এ সব ঝড়ের বেগেই হইয়া গেল। প্রবীণেরা বুঝিতেই পারিলেন না- কোথা দিয়া কি হইল।
তরুণদের উৎসাহে এবং জনমতের চাপে অবশেষে প্রবীণদের রক্তও উষ্ণ হইয়া উঠিল। মাইনর স্কুলকে কিভাবে হাইস্কুলে পরিণত করা যায় সে সম্বন্ধে কল্পনা-জল্পনা চলিতে লাগিল।
পাশের গ্রামে এক পুকুরপাড়ে অনাদিকাল হইতে একটি খারেজী’ মাদ্রাসা চলিয়া আসিতেছিল।
মৌলবী সাহেবের এলেমের দীর্ঘ-পাশ কতটা ছিল, তার এমতেহান লওয়ার সুযোগ কারো হয় নাই।
কারণ তালেব-এলেমদের পড়ান অপেক্ষা দাওয়াৎ খাওয়াতেই তার অধিক সময় ব্যয়িত হইত। তবু দাওয়াতের নাগাড় মরিত না। কারণ দাওয়াত সংগ্রহ করাই ছিল তালেব-এলেমদের প্রধান কাজ। এ কাজে তাদের উৎসাহ ছিল, কারণ মৌলবী সাহেবের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও থোড়াবহুৎ রুখসতি মিলিত। আর এ কাজে তাদের দক্ষতাও ছিল যথেষ্ট, কারণ তাদের অধিকাংশেরই এমন বয়স হইয়াছিল যা ছাত্র অপেক্ষা ছাত্রের বাপকেই মানায় ভাল।
যাক, সেটা আসল কথা নয়।
আসল কথা এই যে, ঐ মাদ্রাসার ব্যয়-নির্বাহের জন্য এ-অঞ্চলের অনেকখানি স্থান জুড়িয়া মুষ্টিভিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। মৌলবী সাহেব স্থানীয় মসজিদের ইমাম ছিলেন বলিয়া এবং তাল-বেলেমরা বাড়ি-বাড়ি হাঁটিয়া আদায় করিত বলিয়া, সে মুষ্টি আদায়ে কারও ভুল ক্রটি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। এতদ্ব্যতীত পাটের মওসুমে পাট, ধানের মওসুমে ধানও কিছু আদায় হইত। এতে করিয়া মৌলবী সাহেব মাসে ত্রিশ চল্লিশ টাকা রোজগার করিতেন।
এত কাছে স্কুল স্থাপিত হওয়াতে ছাত্রের দিক দিয়া এই মাদ্রাসার ক্ষতি হওয়ার কোন সম্ভাবনা না থাকিলেও আসল জায়গায় ক্ষতি হইল- মুষ্টি চাউলের আয় আক্রান্ত হইল। মৌলবী সাহেব ইহার যথাসাধ্য প্রতিবাদ করিলেন। কিন্তু গ্রামবাসী অধিকাংশের মত অনুসারে মাইনর স্কুলের তহবিলেই মুষ্টি চাউল দেওয়া হইতে লাগিল।
.
দুই
হঠাৎ সেই গ্রামে একজন জবরদস্ত আলেমের উদয় হইল। মাদ্রাসার মৌলবী সাহেব নবাগত আলেম সাহেবকে লইয়া বাড়ি বাড়ি দাওয়াত খাইতে লাগিলেন। তাঁকে মওলানা সাহেব’ বলিয়া সকলের নিকট পরিচিত করিয়া দিলেন।
মওলানা সাহেব শরা-শরিয়ৎ সম্বন্ধে ওয়াজ করিতে লাগিলেন। গ্রামের লোক অল্পদিনেই তাঁর লিয়াকতে আকৃষ্ট এবং ব্যবহারে মুগ্ধ হইল।
সকলেই যখন তাহাকে একজন বড়দরের আলেম বলিয়া বুঝিয়া ফেলিল ও তখন তিনি একদিন এক ওয়াজের মজলিসে অন্যান্য কথার পর বলিলেন : খোদার ফলে এ গ্রামের সকলেরই অবস্থা ভাল, অথচ দিনী এলেম শিক্ষার জন্য এখানে কোন মাদ্রাসা নাই; ইহা বড়ই আফসোসের কথা। এই প্রসঙ্গে খারেজী মাদ্রাসার কথা উঠিল। মওলানা সাহেব বলিলেন : বড়ই দুঃখের কথা, বেশুমার আফসোসের কথা, যেখানে খোদা-রসূলের এলেম শিক্ষা দেওয়া হয়, সেই মাদ্রাসার সাহায্য বন্ধ করিয়া, যেখানে বেদীন নাসারার ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়, যেখানে ছেলেদের ঈমান-আমান খাওয়ার কায়দা বালান হয়, হাযেরানে মজলিস কিনা সেই স্কুলে যাহায্য দিতেছেন।
ওয়াজের মহফেল বেশ বড়ই ছিল।
শ্ৰোতৃগণের কেহ কেহ এই প্রসঙ্গে কোন কথা বলিতে মওলানা সাহেবকে বারণ করিলেন।
মওলানা সাহেব গলা ভারী করিয়া বলিলেন : খোদার দীনের ইযযতের জন্য আমি তারই হুকুম তামিল করতে যাচ্ছিলাম, ওতে আমার ব্যক্তিগত স্বার্থ নাই। আপনাদেরই আখেরাতের নেকবিদি ওর উপর নির্ভর করছে। আপনারা যদি না হককথা শুনতে চান, আমি জোর করে তা বলতে চাই না।
সভাস্থ দুই একজন খুব জোরে চিৎকার করিয়া বলিল : মওলানা সাহেব, আপনি বলুন। এ বিষয়ে আপনাদের কর্তব্য কি তা আমরা জানতে চাই।
তখন মওলানা সাহেব খুব ওজস্বিনী সুরে হাদিস শরীফ হইতে বহু রেওয়ায়েৎ বয়ান করিয়া যা বলিলেন, ‘লেকেন’, ‘মগর’, ‘ইয়ানে’ ও ‘ওগায়রা’ গুলি বাদ দিলে তার অর্থ এই দাঁড়ায় : কেয়ামতের দিকে এমন এক যমানা আসিবে, যখন লোক আখেরাতের চিন্তা ছাড়িয়া কেবল দুনিয়াবী খেয়ালে মশগুল থাকিবে। খোদাকে ছাড়িয়া বনি-আদম ধন দওলতের এবাদত করিবে। মাদ্রাসা ভাঙ্গিয়া সেই জায়গায় স্কুল করিবে। মসজিদ ভাঙ্গিয়া
সে স্থলে তোক মদের দোকান খুলিবে। এই গ্রামের অবস্থা দেখিয়া মওলানা সাহেবের মনে হইতেছে, বুঝি বা সেদিন আসিয়া পড়িয়াছে। তিনি কেয়ামতের সমস্ত আলামত বয়ান করিয়া প্রমাণ করিলেন যে, খানে-দয়াল আসিবার আর অধিক দিন বাকি নাই। তার আগমনে মোমিন-মুসলমান ভাইদের উপর কি জুলুম-সেতম হইবে, ইসলামের কি বেইযতি হইবে, কাতর কণ্ঠে তার বিস্তারিত বয়ান করিতে করিতে মওলানা সাহেব চাওগার দামনে চোখ মুছিলেন। দেখাদেখি শ্লোতৃমণ্ডলির অনেকের চোখ ছলছল হইয়া উঠিল।
চোখ মুছার পর আবার তিনি ওয়াজ ধরিলেন। বলিলেন : দীনি-এলেম শিক্ষার মাদ্রাসা নষ্ট করিয়া নাসারার ভাষা শিক্ষার স্কুলে সাহায্য করা বহুত গোনার কাজ। ইহা আমার ঘরের কথা নয়- হাদিস কোরআনের কথা।
বিশেষ করিয়া আখেরী জমানায় আরবী শিক্ষার পক্ষে তিনি যেসব যুক্তি দেখাইলেন, তার মধ্যে সর্বপ্রধান যুক্তিটি হইতেছে এই : ইমাম মেহদি ও খানে-দয়ালের নাযিল হইবার আর বিলম্ব নাই! আরবী জানা না থাকিলে ইহাদিগকে চিনিতে পারা যাইবে না। কারণ আরবী ভাষাতেই দলের কপালে ‘কাফের’ এবং ইমাম মেহদির কপালে ‘মোমিন’ লেখা থাকিবে। উহারা কখন আসিয়া পড়েন, তার নিশ্চয়তা নাই। সেজন্য সকলেরই আরবী শিখিয়া সব সময় প্রস্তুত থাকা দরকার।
আর স্কুলের শিক্ষার বিরুদ্ধে মওলানা সাহেব যে সব যুক্তি প্রয়োগ করিলেন, তার মধ্যে সর্বপ্রথম যুক্তি এই : স্কুলসমূহএমন ধর্ম বিরুদ্ধে গাঁজাখোরি গল্পও শিক্ষা দেওয়া হয় যে, দুনিয়াটা গোল এবং তা ঘুরিতেছে। কোরআন-পাকে আল্লাহু-জলুশান সাফ ফরমাইয়াছেন : পৃথিবী ফরাশের মতো চ্যাপটা এবং স্থির। ছেলেবেলা হইতে কোরআনের খেলাফ শিক্ষা দান করিলে ছেলেরা কেন নাস্তিক হইবে না? ইহার জন্য দায়ী ছেলেরা নয় ছেলেদের অভিভাবকরা।
মওলানা সাহেব ওয়াজ খতম করিলেন। সকলে এক বাক্যে তাঁহার ওয়াজের তারিফ করিল।
কিন্তু আসল কাজের কিছু হইল না। গ্রামের মধ্যে একদল তাঁহার সমর্থক জুটিল বটে, কিন্তু মাতব্বরের অধিকাংশ মাইনর স্কুলের দিকে থাকায় মুষ্টি চাউলটা স্কুলের তহবিলে যাইতে থাকিল।
তাই মৌলবী ও মওলানা সাহেব ইসলামের ইজ্জতের জন্য নূতন উপায় চিন্তা করিতে লাগিলেন।
.
তিন
এই অঞ্চলে হানাফী ও মোহাম্মদী উভয় সম্প্রদায়ের বাস। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহ-শাদি সমাজ-নমাজ মিলিয়া-মিশিয়া চলিত, কোন কলহবিবাদ ছিল না।
মাদ্রাসাটি যে পাড়ায় ছিল, তা হানাফী পাড়া; স্কুলটি যে পাড়ায় স্থাপিত হইয়াছিল, উহা ছিল মোহাম্মদী পাড়া। স্কুল-কমিটির অধিকাংশ সদস্য হানাফী হইলেও সেক্রেটারি সাহেব। মোহাম্মদী।
নবাগত মওলানা সাহেব কয়েকদিন বিশেষ পর্যবেক্ষণের সহিত এই ব্যাপার লক্ষ্য করিয়া একদিন গোপনে মৌলবী সাহেবকে বলিলেন : আপনার উদ্দেশ্য সফল করতে হলে এখানে মযহাবের সওয়াল তোলা ছাড়া উপায় নাই।
মৌলবী সাহেব মাথা নাড়িয়া বলিলেন : আমি ত্রিশ বৎসর এ গ্রামে বাস করছি; কোন দিন হানাফী-মোহাম্মদী ঝগড়া দেখিনি। কাজেই এদিকে আমার ভরসা হচ্ছে না।
হাসিয়া মওলানা সাহেব বলিলেন : আপনার কিছু করতে হবে না; সব ব্যবস্থা আমি। করব।
ব্যস্ত হইয়া মৌলবী সাহেব বলিলেন : না না ও-কাজে আপনি হাত দেবেন না! শেষে আপনি বেইজ্জতি হবেন।
মওলানা সাহেব অধিকতর উচ্চ স্বরে হাসিয়া বলিলেন : আপনার কোন ভয় নেই। বাহাসের ব্যাপারটা বড়ই আজব। ও-কাজে আমি বিশেষ ওয়াকেফহাল আছি। মুখে মুখে বাহাসের বিরোধী সবাই, ইহাতককে আমি নিজেও লেকেন একবার একটা খোঁচা দিয়ে দিতে পারলে সবাই তাতে নেচে ওঠে। ও কাজে একটা নেশা আছে। আপনি ভাববেন। গ্রামকে গ্রাম যদি আমি নাচিয়ে না তুলতে পারি, তবে আমি বাপের পয়দাই নই।
মৌলবী সাহেব দেখিলেন, মওলানার কথাই সত্য। তিনি নিজে মযহাবি কলহের কথা স্বপ্নেও কল্পনা করেন নাই, অথচ আজ তার সম্ভাবনাতেই তাঁহার প্রাণ আনন্দে নাচিয়া উঠিয়াছে।
মওলানা সাহেব পরের জুমআতেই সুকৌশলে কথাটা পড়িলেন। তিনি বলিলেন ও হযরত নিজে বলে গিয়েছেন, তাঁর উম্মতের মধ্যে তেয়াতুর ফেরকা হবে; তেয়ারের মধ্যে সেরেফ এক ফেরকা বেহশতী, আর বাকি বাহাতুর ফেরকাই দুজখী। এখন সওয়াল এই যে, কোন্ ফেরকা.বেহেশতী?
মওলানা সাহেব জওয়াবের জন্য খানিকক্ষণ অপেক্ষা করিলেন। কিন্তু মুসল্লীদের নিকটই জওয়াব চাওয়া হইতেছে, এ কথা তাহারা কেউ বুঝিতে না পারায় কেউ জওয়াব দিল না। মওলানা সাহেব গর্জন করিয়া বলিলেন : আপনাদের ইমান কি এতই কমজোর? আপনারা যে মযহাবের পা-বন্দ সেই মহাব বেহেশতী কি দুজখী, সে সম্বন্ধে খোলাসা ধারণা আপনাদের নেই?
এইবার মুসল্লীদের-চৈতন্য হইল।
তাহারা বুঝিতে পারিল? প্রশ্ন তাহাদিগকেই করা হইতেছে।
সকলে প্রায় সমস্বরে বলিল : আমাদের মহাবই বরহক।
মওলানা সাহেব খুশি হইয়া বলিলেন : আমাদের মহাব যদি বরহক হয় তবে ঐ পাশের গ্রামের মোহাম্মদীরা দুজখী কি না?
বহু কণ্ঠে আপত্তি উঠিল? মোহাম্মদীদের বিরুদ্ধে কোন কথা বলবেন না। কে বেহেশতী কে দুখী, সে বিচার করবেন খোদা।
মওলানা সাহেব বলিলেন : আপনারা হাদিস মানেন; সেই হাদিসই খোলাসা বলে দিচ্ছে, এক ফেরকা মাত্র বেহেশতী! এই এক ফেরকা যদি হানাফী মাযহাব হয়, তবে মোহাম্মদীরা বেশক দোযখী। আর যদি মোহাম্মদীরা বেহেশতী ফেরকা হয়, তবে হানাফিরা নিশ্চয় দুখী। আপনাদের এ-ফেরকা ছেড়ে দিয়ে মোহাম্মদী হওয়া উচিত। আর কোন্ ফেরকা বেহেশতী তাতে যদি আপনাদের সন্দেহ থাকে তবে আপনারা মুসলমান নন– আপনাদের কোন বন্দেগি কবুল হয় না। দীন-ইসলামের কথা বহুৎ সহজ কথা; এতে ঘোর-পাঁচ চলে না। এতে দিনকে দিন, রাতকে রাত-বলতেই হবে। না-ইধার না-ওধার এ-রকম মোনাফেকি ইসলাম পছন্দ করে না।
গ্রাম্য অশিক্ষিত সরল-বুদ্ধি লোকেরা এই তর্কের জাল কাটিতে পারিল না। তাহারা দেখিল : মযহাবের সওয়ালটাকে তাহারা এ যাবৎ যতটা সোজা মনে করিয়া আসিতেছিল, বাস্তবিক উহা তত সোজা নয়।
তাহারা বিশেষ ভাবনায় পড়িল।
মওলানা সাহেব বলিয়া যাইতে লাগিলেন : আমি তসলিম করি, ওদেরকে সামনা সামনি দুখী বলে গাল দিয়ে ওদের মনে কষ্ট দেওয়া উচিত নয়। লেকেন দিলে-দিলে তাদেরকে দুখী বলে না জানলে আপনাদের নিজেদের মহাবে ইমাম পোখতা হবে না। যইফ-ইমান লোকের এবাদত আল্লাহর দরগায় কবুল হয় না। কাজেই আখেরাতে দুজখের আগুন থেকে বাঁচবার জন্য মোহাম্মদীকে আমাদের দুজখী জানতেই হবে। শুধু তাই নয়। আপনারা বেহেশতী ফেরকা; সুতরাং খোদার দরগায় আপনারা শরীফ। মোহাম্মদীরা দুজখী; সুতরাং খোদার তারা রযিল। রযিল লোক শরীফ লোকের আগে রাস্তা চলতে পারে না। যদি চলে এবং শরীফ লোক যদি বিনা-প্রতিবাদে রজিলের পিছনে যায়, তবে তাতে সেও রযিলের দরজায় নেমে যায়। সেইরূপ শরীফ লোকের পক্ষে রযিল লোকের সরদারি মেনে না নেওয়ার শানেও হাদিসে বহুৎ-বহুৎ খবর এসেছে। দুনিয়াবী শরাফতেরই যখন এত ইযযৎ, তখন দীনা শরাফতের কত ইষৎ হওয়া উচিত, তা আপনারাই খেয়াল করুন। আপনারা দীনা শরীফ ফেরকা হয়েও দীনা রযিল ফেরকার সরদারি মেনে নিয়েছেন। আপনাদের মধ্যে ধনী বেশি, আপনাদের ফেরকায় আলেম বেশি, দুনিয়ায় প্রায় সমস্ত মুসলমানই এই ফেরকা-ভুক্ত। তবু আপনারা কেন মোহাম্মদীদের তাঁবেদারি করছেন? তাদের গ্রামেই স্কুল হবে, সেইখানেই সাহেব-সুবা আসবে, সেখানেই সব; আপনারা যেন কেউ নন। কেন? আপনারা এত জিল্লত কেন বরদাশত করবেন? আপনারা ইচ্ছা করলে এ গ্রামে কি স্কুল স্থাপন করতে পারেন না? সাহেব সুবা কি আপনাদের গ্রামে আসতে পারে না?
মওলানা সাহেব দীনা শরাফতের যুক্তি শ্রোতাদের মনে বিশেষ আসর করিতে না পারিলেও দুনিয়াবী শরাফতের শেষ দিকটার যুক্তিটা অধিকাংশের ভাল লাগিল। তার ফল ফলিল–হাটে মাঠে রাস্তাঘাটে বৈঠকখানায় সর্বত্র দিনরাত এই আলোচনাই চলিতে লাগিল।
.
চার
মোহাম্মদীর সরদার-মৌলবী সাহেবের কানে এ-খবর পৌঁছিল।
তিনি জন-চার–পাঁচেক আসহাবা লইয়া তীরবেগে গ্রামে তশরিফ আনিলেন। মযহাবী কলহে তাঁহার ইচ্ছা নাই, এই অভিমত প্রকাশ করিয়াও তিনি মওলানা সাহেবের পিছনে ধাওয়া করিলেন। মওলানা সাহেবের নিকট সদলবলে হাজির হইয়া তিনি বলিলেন : আপনি মোহাম্মদীগণকে দুজখী বলেছেন। আপনার কথা হাদিস কোরআন থেকে আপনাকে প্রমাণ করতে হবে।
মওলানা সাহেব ইহাই চাহিতেছিলেন। তিনি বলিলেন : আলহামদুলিল্লাহ, আমি প্রস্তুত।
বাহাসের দিন-তারিখ ধার্য হইয়া গেল।
গ্রামের তরুণরা প্রবীণদের ধরিল; বাহাস হইলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মনোমানিন্য হইবে; তাতে স্কুলের ক্ষতি হইবে।
দুই-একজন মাতব্বর গ্রামে গ্রামে হাঁটিয়া বাহাসের অপকারিতা বুঝাইবার চেষ্টাও করিলেন।
কিন্তু সমস্ত লোক তখন বাহাসের নামে উন্মত্ত। অনেকে তাঁহাদের কথা শুনিলই না। যাহারা শুনিল তাহাদের অনেকেই তর্ক করিয়া বাহাসের সমর্থন করিল; যাহারা মুখে মুখে সায়ত্ত দিল, তাহারাও তলে তলে বাহাসের জন্য চাঁদা দিল।
গ্রামময় সাজ-সাজ সাড়া পড়িয়া গেল। চাঁদা আদায়ের ধুম লাগিয়া গেল। আশে পাশের দশ-বারখানা গ্রাম হইতে উভয় পক্ষে দশ হাজার টাকা চাঁদা উঠিয়া গেল। যাহারা অসচ্ছলতাহেতু স্কুলের তহবিলে এক পয়সাও চাঁদা দিতে পারেন নাই, নিতান্ত গরীব বলিয়া যাহারা মুষ্টিভিক্ষার দায় হইতেও রেহাই পাইয়াছিল, তাহারাও বাহাসের তহবিলে একটাকা চাঁদা দিয়া ফেলিল।
বাহাসের সমস্ত ঠিক হইয়া গেল।
এই মর্মে শর্তনামা দস্তখত ও রেজিস্টারী হইল : বাহাসের যে পক্ষ হারিবে সদলবলে তাহারা জয়ী পক্ষের মহাব গ্রহণ করিবে।
বিভিন্ন স্থানের উভয় সম্প্রদায়ের বড় বড় মওলানাকে দাওয়াৎ করা হইল। কোন মওলানার নযরানা ও গাড়ি ভাড়া বাবদ কত টাকা খরচ হইবে, তারও একটা বাজেট তৈয়ার হইয়া গেল। ন্যুরানা ও গাড়ি ভাড়ার টাকা অগ্রিম পাঠাইয়া দেওয়া হইল।
সর্বত্র উৎসাহের একটা তুফান বহিতে লাগিল।
প্রথম-প্রথম যাহারা বাহাসের বিরুদ্ধতা করিয়াছিল, শেষদিকে তাহারাও ভীষণ উৎসাহে কর্মক্ষেত্রে নামিয়া পড়িল।
তিন-চার দিন আগে হইতেই উভয় পক্ষের আলেমগণ সদলবলে তশরিফ আনিতে লাগিলেন। গ্রাম বড়-বড় পাগড়িতে ভরিয়া গেল। দেদার পোলাও-কোর্মা চলিতে লাগিল। পোলাও-কোর্মার খুশবুতে গ্রামের দীন-দরিদ্র ক্ষুধাকাতর হতভাগারা বাবুর্চিখানায় উঁকি মারিয়া মারিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়িতে লাগিল।
বিকালের দিকে মওলানারা দলে-দলে গ্রামের রাস্তায় ও মাঠে যখন বেড়াইতে বাহির হইতেন, তখন এই সমস্ত মুজাহেদিনে-ইসলামের সাদা পাগড়ি দেখিয়া মনে হইত জার্মান যুদ্ধের প্রাক্কালে গোরা সৈন্যরা কুচকাওয়াজ করিতেছে।
নির্ধারিত দিনের সকাল হইতেই প্যান্ডেল রচনা কার্য শুরু হইল। বিরাট শামিয়ানা খাটান হইল। যাত্রা গানের মঞ্চের ন্যায় আসরের মাঝখানে বিরাট মঞ্চ প্রস্তুত হইল। মঞ্চের দুই পাশে দুই সম্প্রদায়ের যথাক্রমে মুনশী মৌলবী, মওলানা ও হযরত মওলানাদের জন্য পদমর্যাদা অনুযায়ী আসন নির্দিষ্ট হইল।
দুই সম্প্রদায়ের গ্রাম্য মাতব্বরদের জন্য সম্মুখ ভাগে দুইটি পৃথক সতরঞ্চি বিছান হইল।
তার পিছনে সর্বসাধারণের বসিবার জন্য চাটাইর উপর ছালার চট দেওয়া হইল।
মোটকথা, মহফিলে ইসলামী শান-শওকতের কোন কমতি হইল না।
.
পাঁচ
যথা সময়ে সভা বসিল।
বহুলোকের সমাগম হইল।
বহু পুলিশসহ থানার বড় দারোগা সাহেবও উপস্থিত হইলেন। সংখ্যায় পুলিশের লাল পাগড়ি ও মওলানা সাহেবদের সাদা পাগড়িতে প্রতিযোগিতা চলিলেও আকারে মওলানা সাহেবদের পাগড়িই ইসলামের জয় ঘোষণা করিল।
তরুণদের নেতা সাদতই কেবল শেষ পর্যন্ত বাহাসে উৎসাহিত হইয়া উঠে নাই।
সে আগের দিন শহরে গিয়া জিলায় মুসলমান স্কুল ইনস্পেক্টরকে অনেক বলিয়া কহিয়া বাহাসের সভায় উপস্থিত করিল। দারোগা সাহেবও মুসলমান ছিলেন। তাঁহাকেও দুই-এক কথা বলিতে রাজি করিল।
ফলে সভা শুরু হইবার আগে স্কুল-ইনস্পেক্টর সাহেব ও দারোগা সাহেব দু’এক কথা বলিবার সুযোগ পাইলেন। তাঁহারা উভয়ে সাম্প্রদায়িক প্রীতি ও সামাজিক শান্তির দিক দিয়া এবং নব-প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি স্থায়িত্বের দিক দিয়া বাহাসের বিষময় ফলের কথা নানা যুক্তিতে বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন। জনতার উপর তার খানিকটা ক্রিয়াও হইল।
কিন্তু পর পর উভয়পক্ষের দুইজন মওলানা সাহেব উঠিয়া বলিলেন : এ সব শরিয়তের মসলা, এসব ব্যাপারে কথা বলিবার তাঁহাদের কোন অধিকার নাই। দুনিয়াবী মসলার উপর দীনি মামলার ফয়সলা করা ইসলামের খেলাফ। যে সমস্ত মুজাহেদিন ইসলামের জন্য জেহাদ করিয়াছেন, তাহারা দুনিয়ার ভালমন্দ চিন্তা করেন নাই।
বক্তৃতায় হানাফী মওলানা সাহেব ইনস্পেক্টর সাহেবকে বেনামাযী বলিয়া তাম্বিহ করিলেন এবং মোহাম্মদী মওলানা সাহেব দারোগা সাহেবের দাড়িহীনতা লইয়া রসিকতা করিলেন।
বাহাস হউক, জনতা এই অভিমত প্রকাশ করিল।
সাদতের তরুণ প্রাণে আর সহ্য হইল না। সে নিজেই বক্তৃতা করিতে দাঁড়াইল। প্রাণস্পর্শী ভাষায় সে হিন্দুদের শুদ্ধিসংগঠনের কথা বলিয়া তার সঙ্গে মুসলমানদের আত্মকলহের তুলনা করিল। অশুদ্ধ আরবী উচ্চারণ করিয়া সে ‘ওয়াতাসিমু বিহাবুলিল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর রশি ধরিবার সেই অতি পুরাতন আয়াতটি পর্যন্ত আবৃত্তি করিল।
কিন্তু কেহ তাহার কথা শুনিল না।
মওলানারা তাহাকে বেতমিষ বলিয়া বসাইয়া দিলেন।
বাহাসের অন্যতম শর্তরূপে নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে স্থানীয় জমিদারের হিন্দু নায়েব মহাশয় সভার বিচারক সভাপতি। তিনিও সভাপতির আসন গ্রহণ করিয়াই প্রথমে উভয় সম্প্রদায়ের মিলনের পক্ষে দু’চার কথা বলিতে শুরু করিলেন।
কিন্তু বাধা দিয়া মওলানাদের দু’চারজন সমস্বরে বলিলেন : এই কাজের জন্য তাহাকে সভাপতি করা হয় নাই।
তিনি অগত্যা নিরস্ত্র হইলেন এবং বাহাস আরন্তের আদেশ দিলেন।
বাহাস শুরু হইল।
প্রথমে দণ্ডায়মান হইলেন হানাফী পক্ষ হইতে মওলানা দুরায়েগায়ের মোকাল্লেদিন সাহেব। তিনি নাকি তাঁহার বাহাসে গায়েব-মোকাঁদেদিগকে ভাষার চাবুক মারিতে পারিতেন এবং বহু বাহাসের সভায় তা করিয়াছেনও। এটা তাহার নিজেরই দাবি; তাই তিনি নিজেই এই উপাধি গ্রহণ করিয়াছেন। কাজেই ভক্তদের মধ্যেও তিনি ঐ নামেই পরিচিত। তিনি দাঁড়াইয়া যথারীতি দাড়িতে হাত বুলাইয়া হামদু-সানা পাঠ করতঃ এরশাদ ফরমাইলেন : আমার প্রথম সওয়াল এই যে, গায়ের-মোকাঁদেরা যে নিজেদের মোহাম্মদী বলে, এ কোন মোহাম্মদ–জনাব পয়গম্বর সাহেব, না আবদুর ওহাবের পুত্র মোহাম্মদ?
সওয়াল শেষ করিয়া দুররা সাহেব দাঁড়াইয়া নিশ্চিত বিজয়-গর্বে মুচকি হাসিতে লাগিলেন।
মোহাম্মদী তরফ হইতে মওলানা দহশতে-মোকাল্লেদিন সাহেবই জওয়াব দিতে দণ্ডায়মান হইলেন। ইনি স্বীয় ভক্তদের মধ্যে ঐ নামেই বিখ্যাত, কারণ তাঁহার দশতে হানাফীরা থরথরি কম্পমান। তিনি মওলানা দুররার সওয়ালের কোন জওয়াব না দিয়া পাল্টা সওয়াল করিলেন। বলিলেন : আপনি আগে কোরআন শরীফ থেকে মযহাব সাবেত করুন।
মওলানা দুররা চিৎকার করিয়া বলিলেন : আমার সওয়ালের জওয়াব দিন।
মওলানা দহশত সমান জোরে চিৎকার করিলেন : আমার সওয়ালের জওয়াব দিন।
কেহ কাহারও জওয়াব দিলেন না। উভয়ে বলিলেন : অপর পক্ষ মোনতেক মানিতেছে না, কাজেই এভাবে বাহাস চলে না।
বলিলেন বটে চলে না, কিন্তু বাহাস চলিতে লাগিল। অর্থাৎ কাহারো কথা কেহ না শুনিয়া উভয়েই একসঙ্গে কথা বলিয়া যাইতে লাগিলেন। কেহ কিছু প্রমাণ করিলেন না। বটে, কিন্তু একপক্ষ যে রাফেযী, খারেজী, দুখী, জাহান্নামী এবং ইহাতকে কাফের, একথা অপর পক্ষ খুব জোরের সঙ্গেই ঘোষণা করিতে লাগিলেন।
মাঝে মাঝে উভয় পক্ষের অতি উৎসাহী কেহ-কেহ দুই মওলানার পিছনে জোর দিবার চেষ্টা করিল। ফলে একসঙ্গে একাধিক তার্কিকের মধ্যে তর্ক শুরু হইল। ক্রমে হযরত মওলানাদের সঙ্গে-সঙ্গে মওলানারা তারপরে মৌলবীরা এবং অবশেষে মুনসী সাহেবেরাও তর্কে যোগদান করিলেন।
সভাপতি চিৎকার করিয়া গলা ফাটাইলেন। কেহ তাহার কথা শুনিল না।
অবশেষে বিরক্তি ভরে তিনি কখন যে সভা ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন বাহাসরত মওলানারা তা টেরও পাইলেন না।
বিষম কোলাহলের আকারে বাহাস চলিতে লাগিল।
দেখিতে দেখিতে গ্রামের মাতব্বর সাহেবরাও তর্ক-যুদ্ধে অবতরণ করিলেন।
মাতব্বররা তর্কে অবতরণ করায় জনতাও নিজেদের অধিকার ও কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন হইয়া উঠিল।
সুতরাং তর্ক অধিকক্ষণ মুখে সীমাবদ্ধ থাকিল না। হাত মুখের স্থান অধিকার করিল। হাতাহাতি কিলঘুষি বেদেরেগ চলিতে লাগিল।
শুধু হাতে আর কতকক্ষণ বাহাস চলে? কাজেই দুই পক্ষই সামিয়ানার খুঁটি ভাঙ্গিয়া বাহাস চালাইতে লাগিল। এ সবেও যখন অকুলান হইল, তখন উভয় পক্ষই বাড়ি হইতে রশদ সরবরাহ করিতে লাগিল।
মওলানা সাহেবরা এইরূপ বেদাঅতি ধরনে বাহাস করিতে রাজি ছিলেন না বলিয়া সভাস্থল ত্যাগ করিলেন।
কিন্তু জনতার বাহাস চলিতে লাগিল।
পুলিশ কোন মতেই শান্তিরক্ষা করিয়া উঠিতে পারিল না। কারণ জেহাদরত এই বিরাট জনতার সাহসের সামনে ধর্মহীন ঐ গুটিকতক পুলিশের সাহস কিছুতেই যথেষ্ট বিবেচিত হইল না।
ঘটনার গুরুত্ব উপলব্ধি করিয়া দারোগা সাহেব কোতোয়ালিতে খবর দিতে নিজেই চলিয়া গেলেন।
দারোগা সাহেবের অনুপস্থিতিতে পুলিশরা দূরে দাঁড়াইয়া শান্তিরক্ষার উপায় চিন্তা করিতে লাগিলেন।
অবশেষে বাহাস থামিল। ততক্ষণ উভয় পক্ষে কয়েকজন হত এবং বহু আহত হইয়াছে। সুতরাং পুলিশের কর্তব্য সাধনে বিশেষ অসুবিধা হইল না। ইতিমধ্যে লাল পাগড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি হইল। তাহারা তখন সদম্ভে বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া গ্রেফতার ও খানাতল্লাশ করিতে লাগিল।
দেখা গেল, লাল পাগড়ির বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম একদম সাদাপাগড়ি শূন্য হইয়া গিয়াছে।
গ্রামের বহুলোককে গ্রেফতার করিয়া হতহতদের লাশ আসামিদের কাঁধে তুলিয়া পুলিশ যে রাস্তায় কোতোয়ালির দিকে রওয়ানা হইল, সেটা ছিল হিন্দু পাড়া। তখন সে পাড়ায় স্বামী বিবাদানন্দের সভাপতিত্বে হিন্দুদের এক বিরাট সভায় বিধবা-বিবাহ প্রচলন ও অস্পৃশ্যতা বর্জনের প্রস্তাব গৃহীত হইতেছিল। সভার লোক খানিকক্ষণ সভার কাজ স্থগিত রাখিয়া সারি বাঁধিয়া দাঁড়াইয়া কোমড়ে-দড়ি-বাঁধা-কাঁধে-লাশের-ডুলি-বওয়া মুসলমানদের মিছিল দেখিল।
দীর্ঘদিন ধরিয়া পুলিশের তদন্ত চলিল। খানাতল্লাশে গ্রামকে-গ্রাম চাষ করিয়া ফেলিল। মেয়েদের এ-বাড়ি হইতে ও-বাড়ি টানা হ্যাঁচড়া করা হইল; পুলিশের সামনে তাহাদের বে-আবরু করা হইল। ধান-চাউল, লবণ-চিনি একাকার হইল।
সরেজমিনে তদন্ত খানাতল্লাশ ও জবানবন্দির হিড়িক যখন কাটিল, তখন সদরের মামলা শুরু হইল।
বৎসরাধিককাল মামলা চলিল। উভয় পক্ষই পুলিশ ও উকিলের পায়ে বহু টাকা ঢালিল। কেহ জমি বিক্রয় করিল, কেহ বাড়ি বিক্রয় করিল, কেহ কেহ সর্বস্ব খোয়াইল; এবং পরিমাণে গ্রামের প্রায় সকলেরই অল্প-বিস্তর জেল-জরিমানা হইল।
যাহাদের জরিমানা হইল, তাহারা কষ্টে-সৃষ্টে জরিমানা আদায় করিল। যাহাদের জেল হইল, তাহারা আপিল করিল। আপিলে সর্বস্বান্ত হইয়া শেষ পর্যন্ত জন-পঞ্চাশের কারাদণ্ড বহাল থাকিল।
নির্ধারিত দিনে যখন গ্রামের যুবক-বৃদ্ধ প্রায় পঞ্চাশজন কয়েদী আত্মসমর্পণের জন্য সদরের দিকে রওয়ানা হইল, তখন হিন্দু-পাড়ায় সর্বজনীন দূর্গাপূজা হইতেছিল। এতকালের অস্পৃশ্যরাও ব্রাহ্মণ-কায়েতের সঙ্গে মন্দিরে প্রবেশ করিতেছিল।
সাদত একটা নদীর পারে স্কুল-গৃহের ছায়ায় বসিয়া সেইদিকে একদৃষ্টে চাহিয়াছিল। সে একবার কারাগামী মুসলমানদের মিছিলের দিকে, আরেকবার নদীর ওপারে সর্বজনীন পূজারত হিন্দুদের দিকে এবং সর্বশেষে নিজের মাথার উপরকার সদ্য-পরিত্যক্ত স্কুল গৃহটির দিকে চোখ ফিরাইল।
একবিন্দু অশ্রু অতি ধীরে-ধীরে তাহার গণ্ড বাহিয়া গড়াইয়া পড়িল।
ওদিকে উভয় সম্প্রদায়ের মওলানার বাহাস সভার বিবরণ দুইটি পৃথক পুস্তিকা বাহির করিয়া বিনামূল্যে বিতরণ করিলেন। দেখা গেল, উভয় পক্ষের পুস্তিকাতেই দাবি করা হইয়াছে যে বাহাসে তাহাদেরই জয় হইয়াছে।