মুঘল শাজাদার শিক্ষা
আদাব-ই-আমগিরী নামক ফার্সী হস্তলিপিতে সম্রাট আওরংজীবের অনেক চিঠি সংগৃহীত আছে। এই সকল চিঠি পাঠে সপ্তদশ শতাব্দীর ভদ্রতা ও শীলতাজ্ঞান এবং মুঘল শাজাদাগণ কিরূপ ভাবে শিক্ষিত হইতেন তাহার অনেক খবর জানা যায়। ১৬৫৪ খ্রি: অক্টোবর মাসে আওরংজীব দাক্ষিণাত্যে রাজপ্রতিনিধি ছিলেন। তাঁর পুত্র মুহম্মদ সুলতানের বয়স তখন পঞ্চদশ বৎসর মাত্র। আওরংজীবের পুত্র তখন সম্রাট শাহজাহান সমীপে উপস্থিত হইবার জন্য আজমীরের উদ্দেশ্যে রওনা হইয়াছিলেন। যাহাতে পুত্র সম্রাটের কাছে সুনাম অর্জন করিতে পারে সে জন্য আওরংজীব উৎসুক হইয়া উঠিয়াছিলেন; পুত্রের জন্য পিতার এরূপ ঔৎসুক্যও স্বাভাবিক। শাহজাদার প্রত্যেক দিনের প্রত্যেক ঘণ্টার কাজের একটা পুঙ্খানুপুঙ্খ তালিকা করিয়া দেওয়া হইয়াছিল।
যথা :
বাড়ীতে কিম্বা কুচের সময় যে সময়ই হোক না কেন সূর্যোদয়ের ৭২ মিঃ পূর্ব্বে শয্যাত্যাগ করিবে। স্নান ও প্রসাধনের নিমিত্ত ৪৮ মি:র অধিক সময় ব্যয় করিবে না। স্নান ও প্রসাধন সারিয়া সকালের ফজর নমাজে যোগদান করিবে নমাজের শ্লোক (আয়াৎ) আওড়াইয়া কুরানের একটি অধ্যায় প্রত্যহ পড়িবে। যদি কুচের অবস্থায় থাক, তবে সূর্যোদয়ের ৪৮ মিঃ পরে অশ্বারোহণে যাত্রা করিবে। যদি পথে শিকার করিতে ইচ্ছা হয়, তবে সাবধান হইবে, যাহাতে নির্দ্দিষ্ট সময়ের পূর্ব্বনিৰ্দ্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হইতে পার। নির্দ্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হইয়া যদি ইচ্ছা হয় কিংবা সময় পাও তবে আরবী ভাষায় কিছু পাঠ করিবে। তারপর বিশ্রাম লইবে। দুপুরের ২৪শ মি: পরে তোমার শিবির হইতে বাহির হইয়া জোহর নমাজে যোগ দিবে। জোহর নমাজে উপস্থিত সকলের সঙ্গে করিবে। তারপর আহার করিয়া দিবানিদ্রা উপভোগ করিবে। সূর্যাস্তের ঘণ্টা দুই পূর্ব্বে উঠিয়া আসর নমাজ পড়িবে। যদি আহার করিয়াই শরীরের সমস্ত গ্লানি দূর হয় তবে আর নিদ্রা যাইও না। সেই সময়টা হাতের লেখা ভাল, চিঠি পত্রাদি লিখিতে অভ্যাস, এবং ফার্সী গদ্য পদ্য পাঠ করিও। আসর নামাজের পর কিছুক্ষণ আরবী পাঠ করিও। তারপর সূর্যাস্তের ২৪শ মি: পূর্ব্বে নির্ব্বাচিত মণ্ডলী (select audience) লইয়া দরবারে বসিবে। ২৮ মিঃ রাত্রি পর্য্যন্ত এই দরবারে থাকিবে। তারপর নিজ গৃহে ফিরিয়া কোরানের এক অধ্যায় পড়িবে। রাত্রি ৯টার সময় শুইতে যাইবে।
কুচের পথে–সেদিন যদি বিশ্রামের দিন হয় তবে-যে সব কাজ পূর্ব্বে বলা হইয়াছে সেই সব কাজ করিবে। অশ্বারোহণের পরিবর্তে ৪৮ মি: ধরিয়া তীর ছোঁড়া ও বন্দুকের গুলি দ্বারা লক্ষ্যভেদ করা অভ্যাস করিবে। সূর্যোদয়ের ১ ঘণ্টা দ্বারা লক্ষ্যভেদ করা অভ্যাস করিবে। সূর্যোদয়ের ১ ঘণ্টা ৪৮ মি: পরে দরবার বসাইবে। দরবার কাল ৪৮ মি: বা কাজের কমবেশী অনুযায়ী কমবেশী সময় হইবে। যদি কোন বিশেষ প্রয়োজনীয় কাজ থাকে তবে বিশ্বস্ত প্রধান কর্ম্মচারীদের লইয়া ঘণ্টাখানিক একটা গুপ্ত বৈঠক বসাইবে। এইরূপ কোন কাজ না থাকিলে এই চার ঘড়ি সময় আরবী পাঠে ব্যয় করিবে।
কুচের দিনে কুরানের দুই অধ্যায় ও বিশ্রামের দিনে তিন অধ্যায় পাঠ করিবে। যদি দূর পথ হয় তবে ফজর নমাজের পর পরই অশ্বারোহণে যাত্রা করিবে। পথেই আহার করিবে। তাহা সম্ভব না হইলে আহার শেষ করিয়া যাত্ৰা করিবে। সকালের আধ আলো আধ আঁধার অথবা ৯টার পর কখনও কোথাও যাত্রা করিবে না। পথে শিকারের ইচ্ছা হইলে সৈন্যদলকে সব চেয়ে সোজা পথে প্রধান বখ্শীর অধীনে গন্তব্যপথে প্রেরণ করিবে। কয়েকজন অনুচরকে সঙ্গে লইয়া শিকারে যাইবে।
ভারতবর্ষে মুঘল রাজত্ব সামরিক শক্তির উপরই প্রতিষ্ঠিত ছিল। সিংহাসনের স্থায়িত্ব সৈন্যদলের ও শাহজাদাগণের রণপাণ্ডিত্যের উপরই নির্ভর করিত। সুতরাং আওরংজীব পুত্রকে এ সম্বন্ধে উপদেশ দেন যে, “অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হইয়া থাকিতে ক্রমশ: অভ্যস্ত হইও। শিকারের সময়ের পরিশ্রমজনিত ঘাম না শুকাইবার আগে পোশাক পরিচ্ছদ খুলিয়া ফেলিও না বা শুইতে যাইও না। এইরূপ না করিলে অসুখ করিবে।” সৈন্যদের দৃঢ় নিয়মানুবর্তিতা বজায় রাখা বিশেষ দরকার এবং প্রত্যেকে যাহাতে স্ব স্ব স্থানে ঠিক থাকে সে দিকেও নজর দিতে হইবে। এই সম্বন্ধে আওরংজীবের আদেশ ছিল এই যে:
কুচের সময় আমার কর্মচারিগণের মধ্যে মুহম্মদ আহির (শাহজাদা অভিভাবক) ভিন্ন এবং সম্রাটের কর্ম্মচারিগণের মধ্যে দু’হাজারী মনসবদারগণের নিম্নপদস্থ কাহাকেও অশ্বপৃষ্ঠে সৈন্যগণের পুরোভাগে অগ্রসর হইতে দিবে না। নির্দিষ্ট কর্মচারীরা শাজাদার ডানে বাঁয়ে থাকিবে; তাহাদের সঙ্গে দুজনের অধিক খানসামা থাকিবে না। শাহজাদাকে এ সম্বন্ধে বিশেষ করিয়া আদেশ দেওয়া ছিল, ‘কারণ ছোটলোকদের সামনে ভীড় করিতে দিলে নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাভঙ্গ হইতে পারে।
“সৈন্যাধ্যক্ষগণের সৈন্যদের সঙ্গে কখনও অধিক মাত্রায় মেলামেশা করা উচিত নয়! ফলে তাহারা হুকুম গ্রাহ্য করিতে চায় না। সব সময়েই কুচকালীন কিংবা দরবারের সময় যা বলা দরকার তার বেশী কথা বলিবে না, যাদের সঙ্গে তোমার কথা বলা শোভা পায় না, কৌশল করিয়া ভদ্রভাবে তাহাদের সহিত বাক্যালাপ এড়াইয়া চলিবে। এইরূপ করিলে তাহারা ভয় ও ভক্তি করিবে। এই সঙ্গে একটি নকশা পাঠান হইল। তাহা হইতে বুঝিবে আম ও খাস দরবারের সময় কিভাবে আমীর ওমরাহগণকে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে বসাইতে হইবে।”
শাহজাদা মুহম্মদ সুলতান শিকার খুব পছন্দ করিতেন। পড়াশুনায় তাঁহার মনোযোগ ছিল না। সেই জন্য পিতা দুঃখিত চিত্তে লিখিতেছেন– আজ আমার দুঃখ হইতেছে এই কথা ভাবিয়া যে অত অল্প বয়সে আমি উহাকে সঙ্গে করিয়া শিকারে লইয়া গিয়া কি অন্যায় করিয়াছি। শিকারের আমোদ একবার পাইয়া বসিলে লেখাপড়া আর ভাল লাগে না। ইহার হইয়াছেও তাই।
মুঘল সরকারের অধীনে বহু তুর্কী সৈন্য ও সৈন্যাধ্যক্ষ ছিল। সেইজন্য মুঘল শাহজাদাগণের তুর্কীভাষা শিক্ষা বিশেষ প্রয়োজনীয় ছিল। মুহম্মদ সুলতান তুর্কী ভাষার উপর বিশেষ বিরূপ ছিলেন। উত্তর ভারতে গমন কালে নিজের তুর্কী শিক্ষককে ফেলিয়া রাখিয়া যাওয়ার জন্য শাহজাদাকে তিরস্কৃত হইতে হইয়াছিল। তিরস্কারের উত্তরে শাহজাদা জানান যে, শিক্ষক মহাশয় অতি বৃদ্ধ হইয়া পড়িয়াছেন, দীর্ঘ পথ ভ্রমণের ক্লেশ সহ্য করিতে পারিবেন না বলিয়া তাঁহাকে রাখিয়া আসা হইয়াছে। আওরংজীব রাগান্বিত হইয়া ইহার উত্তর দেন যে, আওরঙ্গাবাদে ঘরে থাকার সময় শাহজাদা শিক্ষককে তেমন আমল দেয় নাই। শিক্ষক মহাশয় এক বৎসরের জন্য নিযুক্ত হইয়াছেন, এ পৰ্য্যন্ত তাঁহাকে বহু অর্থ অনর্থক মাহিনা দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু তুমি তাঁর কাছে পড়ায় মনোযোগ দাও নাই; এর পর শাহজাদার উপর হুকুম হয়, শিক্ষককে তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে লইয়া যাইতে এবং তাঁহার সহিত তুর্কীভাষায় কথা কহিতে। রাগান্বিত পিতা লেখেন, “রাজা বা ভদ্রলোকের গুণাবলীতে ভূষিত হইতে তুমি চাও না। তাতে আমার কিইবা আসে যায়? তোমার বয়স হইয়াছে, তুমি নিজেই এখন সব ভালমন্দ বুঝিতে পার।”
শাহজাদাকে রীতিমত উপদেশ দেওয়া ছিল নির্ব্বাচিত মণ্ডলীতে কাহাকে আসিতে দেওয়া হইবে, দরবারে মনসবদারদের কি পর্যায়ে বসিতে দেওয়া হইবে, কাহার সঙ্গে কথা কহিতে হইবে, কাহার সঙ্গে নয়। পোশাক সম্বন্ধেও উপদেশ দেওয়া ছিল। “তোমার পিতা শুনিয়া বিস্মিত হইয়াছেন যে, তুমি এক রকম খালি গায়–কেবল মাত্র ওয়েস্ট কোট ও পায়জামা পরিয়া-নমাজে যাও! এটা খুবই আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, তুমি তোমার পিতার সঙ্গে অনেক দিন বাস করিয়া তাঁহার আচার ব্যবহার ও স্বভাব লক্ষ্য করিয়াও সেরূপভাবে চলিতে পার না।”
কথাবার্তার ধারার উপর বিশেষ লক্ষ্য রাখা হইত। “সময় ও সুযোগ মত আকবরনামা পড়িবে তাহা হইলে তোমার লেখার ও কথার ভাষা সুন্দর ও সুষ্ঠু হইবে। তুমি যে পর্য্যন্ত কোন্ কথা কোথায় প্রযোজ্য হইয়াছে এবং তাহার প্রকৃত অর্থ কি তাহা সম্পূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করিতে না পার, সে পর্য্যন্ত সেইসব কথা চিঠিপত্রাদিতে কিংবা আলাপে কোথাও প্রয়োগ করিবে না। যা বলিবে বা লিখিবে তাহা বেশ করিয়া ভাবিয়া বলিও ও লিখিও।”
এই উপদেশের ফলে একটা বড় হাস্যকর ঘটনা ঘটিয়াছিল। আকবরনামার লিখনপদ্ধতি জড়িত, পাণ্ডিত্য ও বাক্যালঙ্কারে পূর্ণ ও সফেন। সেই জন্য ইহা পাঠকদেরও ভাল লাগে না ও সমালোচকদের তীব্র সমালোচনার কারণ হয়। ১৪ বৎসর বয়সের একজন বালকের লিখনপদ্ধতির ইহা আদর্শ হইতে পারে না। মুহম্মদ সুলতান এই শেষোক্ত উপদেশের ফলে পিতাকে যে চিঠি লেখেন তাহা পড়িয়া আওরংজীব অবাক হইয়া যান। আবুল ফজলের মুশাবিদানুযায়ী আকবর প্রজাকে যে চিঠি লিখিয়াছিলেন কুমার সুলতান নিজ পিতাকে হুবহু তাহাই লিখিয়া পাঠান! চিঠির মাথায় প্রচলিত ‘বিশমুল্লা’ লিখিয়া আকবরের প্রথানুযায়ী ‘জিল্ল-ই-জালালুহ’ লেখা হইয়াছিল এবং যে সকল রাজকীয় শব্দ ও সম্বোধন ব্যবহৃত হইয়াছিল তাহাও এস্থলে ব্যবহৃত হয়। যদিও পুত্র পিতাকে এ পত্র লিখিতেছেন! ইহাতে অতিমাত্র বিরক্ত হইয়া আওরঙ্গজেব পুত্রকে লেখেন, “আমি তোমাকে আবুল ফজল লিখিত আকবরনামা পড়িতে বলিয়াছি এই উদ্দেশ্যে যে ইহার লিখনপদ্ধতি অনুকরণ করিবে। আবুল ফজল বিধর্মীদের অনেক প্রথা ধর্মে ঢুকাইয়া পবিত্র সুন্নিধর্ম্মকে নষ্ট করিয়াছে। আমি তোমাকে তোমার ধর্ম্মবিশ্বাস ত্যাগ করিয়া আবুল ফজলের ধর্মবিশ্বাস গ্রহণ করিতে বলি না। তুমি তোমার চিঠিখানায় সম্রাটের চিঠি (নিশান-ই-ওয়ালা) ও তোমার মোহরকে সম্রাটের মোহর (মোহর-ই-খাস) বলিয়া বর্ণনা লইয়াছ তাহাই যদি হয় তবে সম্রাটের চিঠি ও মোহরের কি নামকরণ করিবে?’
[প্রভাতি, মাঘ, ১৩৩০।
শিক্ষক, খণ্ড ৪, সংখ্যা ১১, ফাল্গুন, ১৩৩০-এ পুনঃমুদ্রিত।]