মুখ
খবরের কাগজের উপর দিয়ে একটা ভারি খুদে ছাইরঙা পোকা গুড়গুড় করে হেঁটে যাচ্ছে। ছাপা অক্ষরের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে মাঝে—মাঝে, দেখা যাচ্ছে না। ফের দেখা যাচ্ছে— ওই যে চলেছে, কোনাকুনি। কোথায় যাচ্ছে তা কি নিজেই জানে? তবু যাচ্ছে। এত খুদে যে, খুব ঠাহর করে দেখতে হয়। শচীন দেখছিল। খুব মন দিয়েই দেখছিল। ওটার হাঁটারও যেমন মানে হয় না, বেঁচে থাকারও তেমনি মানে হয় না। কোন ফল হবে ওটাতে দিয়ে? পোকা বলে কথা, মা—বাপ—ভাই—বোন নেই, ফ্যামিলি লাইফ নেই, শুধু ক—টা দিন উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে, খামোখা বেঁচে থেকে, হয় অপঘাতে নয়তো এমনিতেই মরে যাবে।
অধিকারী বলছে, চৈতলপাড়া হল গে তাঁবার টাট। এই চোত—বোশেকে সেখানে তপ্ত বালির উপর একখানা আলু ফেলে রাখো, বিকেলে দেখবে দিব্যি পোড়া—পোড়া ভাব হয়েছে। তেল—নুন মেখে দিব্যি খেয়ে নিতে পারবে। চৈতলপাড়া নামটাও তো মনে হয় ওই চোত মাস থেকেই হল। পুকুর—টুকুর সব শুকিয়ে ঝামা। মাঠ দেখগে যাও, ফেটে একেবারে চৌচির হয়ে আছে। এক বালতি জল ফেললে চোঁ শব্দ করে টেনে নেয়।
শচীন অনেকক্ষণ ধরে চৈতলপুরের বৃত্তান্ত শুনছে। এবার বলল, ওটা কী পোকা বলো তো অধিকারীদাদা!
কোন পোকাটা?
ওই যে, ঢক্কানিনাদের ঢক্কার ওপর বসে আছে।
অধিকারী ঝুঁকে একটু দেখার চেষ্টা করে বলল, তা ভগবানের রাজ্যে কতরকম আছে। সব কি আর চিনি রে ভাই! তা হবে কোনো পোকা। তার কাণ্ডই আলাদা। বলছি চৈতলপাড়ার কথা, আর তুই পোকা নিয়ে পড়ে আছিস।
ভাবছি কি জানো, এ পোকাটা বেঁচে আছে কীজন্য বলো তো।
বললুম তো, ভগবানের রাজ্যে কত জীবই তো বেঁচে আছে।
আচ্ছা ওর তো কোনো নামও নেই। ধরো যদু, মধু, শচীন বা অধিকারী এসব বলে তো ডাকেও না কেউ ওকে।
পোকার আবার নাম!
সেইটেই তো বলছি। নাম নেই, ঠিকানা নেই, বাপ—মায়ের ঠিক নেই, কোথায় যাচ্ছে, কী করছে তাও বুঝবার মতো মগজ নেই, বেঁচে যে আছে তাও তো বুঝি সবসময়ে টের পায় না। ঠিক তো। তবে বেঁচে আছেই বা কেন?
রোদ আসছে রে, ওধারটায় একটু চেপে বোস। চোতের রোদে বড্ড ঝাঁঝ। তা কাগজে লিখেছে কী করে বাপ, একটু বলবি?
এ তো বাসি খবরের কাগজ অধিকারীদা। বোচনের বাপ রোজ নিয়ে আসে কলকাতা থেকে। আমি সকালে চেয়ে আনি। লিখেছে মেলা কথা, সব তুমি বুঝবে না।
অধিকারী বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল, বুঝে কাজও নেই। দুনিয়ায় কত কী হয়ে যাচ্ছে রোজ। সেদিন শুনলুম, কোথায় একটা ক্ষেপে গিয়ে সাতটা লোককে মেরেছে। তা এরকম কত কী হয়ে যাচ্ছে। আমাদের পৈলেনের দিকটায় হাতিটাতি নেই।
কথাটার কোনো মানে হয় না। পৈলেনে হাতি নেই, এটা কী কোনো খবর হল। অধিকারীর তোম্বা মুখটার দিকে চেয়ে শচীন হেসে ফেলল। বলল তার চেয়ে চৈতলপাড়ার কথা যা হচ্ছিল সেটাই চালিয়ে যাও অধিকারীদা।
সেটাই তো বলছিলুম রে। কথার মধ্যে পোকা পড়ল। বলছিলুম যে এই পৈলেনের মতো সরেস জায়গা নয়। পৈলেনেও শুখো বছর যায় বটে, কিন্তু চৈতলপাড়ার দিকটা হল একেবারে পাঁপড়ভাজা। গাছের পাতাটা অবধি শুকিয়ে মুচমুচ করছে।
লোকে সেখানেও তো বাস করছে।
ধুঁকতে ধুঁকতে। বছর চারেক আগে শুখোর সময়ে বিন্দির শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সে কী দুর্গতি হল বলার নয়। জলশৌচ অবধি করতে পারি না। তিন দিন চান না করে গায়ে পোকা পড়ার জোগাড়।
তবু তো লোকে বাস করছে।
তা কী করবে বলো। বাপ—পিতেমোর ভিটে ছেড়ে যাবে কোথা?
তুমি তাহলে গঙ্গারামপুর ছাড়লে কেন বলো। সেও তো তোমার বাপ—পিতেমোর জায়গা।
সে অন্য বৃত্তান্ত। আমি আর ছাড়লুম! আমাকে ছাড়ানো হল! সবাই সেকথা জানে। জ্ঞাতিরা যা উস্তম—কুস্তম করলে আমাকে। তা বাপু আমার কোনো গিঁট নেই। বাপ—পিতেমোর জায়গা বলে গঙ্গারামপুরের জন্য হেঁদিয়ে মরব আমি তেমন ঘরপোষা গেরস্ত নই। এই যে কাঁধে গামছাখানা দেখছিস এখানা যেখানে—সেখানে পেতে শুয়ে পড়ি, আর সে—ই জায়গাই আমার গঙ্গারামপুর।
এই গোটা দুনিয়াটাই।
বুঝলুম গো অধিকারীদাদা।
আমি হলুম গে তোর ওই পোকাটার মতো। লোক না পোক।
বড্ড চটেছো গো অধিকারীদা।
কথাটা শেষ করতে দিবি, নাকি! আসল কথাটাই তো বলতে দিলি না।
বলো। শুনছি।
তা সেই চৈতলপাড়ায় সেই চোত মাসেই এক সাধু এসে পাঁচ—পাঁচটা ধুনি চারদিকে জ্বেলে তপস্যায় বসে গেল। চৈতলপাড়ার ওই সাঙ্ঘাতিক মোষ—খ্যাপা গরমে। আমাদের মতো লোক হলে শুকিয়ে চামচিকে হয়ে ঢেঁসে যেত। সাধু বলে কথা। সাত দিনে গা ঝলসে কালো হয়ে গেল। শরীর শুকিয়ে হত্তুকি। তবু গা—ঝাড়া দিয়ে উঠল। সে কী যজ্ঞি বাবা জানি না, তবে যজ্ঞির পর নাকি বামুন খাওয়ানোর নিয়ম। তা সাধু গিয়ে বামুনপাড়ায় হাতজোড় করে জনে জনে নেমন্তন্ন করল। তা চৈতলপাড়ার বামুনরাও ট্যাটন। তারা পষ্টাপষ্টি বলে দিলে, সাধুর জাতধর্ম নেই, আমরা সাধুর নেমন্তন্নে যাব না। তখন সাধু রেগেমেগে করলে কী জানিস। গাছে গাছে যত হনুমান ছিল সবাইকে নেমন্তন্ন করে এল। তারপর সে কী কাণ্ড! পরদিন সাধু নিজের হাতে রান্না করছে আর দলে দলে হনুমান মেয়েমদ্দা ছানাপোনা সব হাজির। একেবারে পঙক্তি ভোজনের কায়দায় বসে গেল সব সারসার। তৃপ্তি করে খেল। ভোজনদক্ষিণাও নিল। চৈতলপাড়ার লোক কাণ্ড দেখে হাঁ। সেই থেকে চোতমাসে সেখানে হনুমান—মেলা হয়। কালো সাধুর মেলাও বলে লোকে। টানা একশো বছর ধরে হয়ে আসছে।
পোকাটা কাগজের একেবারে কানায় গিয়ে ঝুঁকে তলাটা একটু নিরিখ করল। তারপর আবার উলটোবাগে ফিরে আসছে। কী করবে, কোথায় যাবে কিছু বুঝতে পারছে না আহাম্মকটা।
আচ্ছা, পোকারা কী খায় বলো তো অধিকারীদা।
তোর মাথা থেকে পোকাটা যাচ্ছে না দেখছি।
ভাবছি, এইটুকুন তো পোকা, এর পেটটাই বা কতটুকু! খায় কী।
ওসব ভগবানের লীলা রে ভাই। দুনিয়াতে হাতির যেমন বন্দোবস্ত আছে, তেমনি পোকার জন্যও আছে।
সে না হয় বুঝলুম। কিন্তু ভগবানের লীলারও তো মানে হবে নাকি! তুমিই বলো এই পোকাটাকে দিয়ে ভগবানের কোন কাজটা হচ্ছে। সব কাজেরই একটা মানে থাকবে তো। নইলে বলতে হয়, আমার ভগবানের মাথায় বেশ একটু ছিট আছে বাপু।
তা মন্দ বলিসনি। আমারও মাঝে—মাঝে মনে হয় লোকটা একটু ছিটিয়ালই বটে। নইলে দেখিস না কোথাও গন্ধমাদন, কোথাও কেঁচোর ঢিবি। মদন তফাদারকে দেখ, টাকার পাহাড়ে চড়ে দিব্যি ফুরফুরে হাওয়া খাচ্ছে, আর আমাদের দেখ অবস্থা কেরাসিন।
তুমি বড্ড মোটা দাগের লোক অধিকারীদা। কোথায় একটা গুরুতর কথা বললুম, তাই নিয়ে পাঁচটা মিনিট ঝিম ধরে বসে ভাববে। তা নয়, কোথায় কার টাকা আছে, কার নেই তাই নিয়ে পড়লে।
ও বাবা, তোর পোকামাকড় নিয়ে বসে ভাবতে হবে নাকি? আমার কি আর খেয়ে—দেয়ে কাজ নেই! পোকামাকড় নিয়ে তুই ভাব গে যা। হুঃ মোটা দাগের লোক!
শচীন হেসে ফেলল, তোমার চৈতলপাড়ার বৃত্তান্ত শেষ হয়েছে?
বৃত্তান্ত আবার কী। কথাটা উঠল তাই বললুম। লোকে তো পাঁচটা জিনিস নিয়ে কথা বলবে, নাকি! চুপ করে থেকে কী শেষে দম বন্ধ হয়ে মরতে হবে? আর চৈতলপাড়ার কথাটা এমন খারাপ বা কী বললুম।
তুমি কেন মোটা দাগের লোক তা জানো? গুহ্য কথাটা বুঝতে পারো না বলে।
এই যে পোকাটা খামোখা বেঁচে আছে, খামোখা খবরের কাগজের ওপর হেঁটে হেঁটে সময় নষ্ট করছে, আমরাও ওর চেয়ে বেশি কিছু করছি না।
কথাটা তো আমিই আগে বললুম রে। লোক না পোক। তুই নতুন কথাটা আর কী বললি? এখন কাজের কথায় আয় দিকি বাপ। চৈতলপাড়া যাচ্ছিস কোন মতলবে?
মতলব একখানা আছে শচীনের। কিন্তু সে কথা ভাঙে কী করে? অধিকারী হল হাটের খোলা হাঁড়ি। তার পেটের কথা মুখে ভুড়ভুড়ি না কাটলে পেট ফাঁপে, বায়ু হয়। কথাটা চেপে শচীন বলল, মাঝে—মাঝে জায়গা বদলানো ভালো। তোমার সরেস পৈলেনে আমার তো তেমন সুবিধে হল না।
লটারির কারবারটা তুলে দিয়েই তো ভুলটা করলি। দু—পাঁচ টাকা তো আসছিল।
কচু। কত টিকিট বেচলুম। একটা লোকও পাঁচটা টাকা অবধি প্রাইজ পেল না। আজকাল লোকে ওসব ধরে ফেলেছে। গাঁটের পয়সা খরচ করে টিকিট কেটে আকাশের দিকে হাঁ করে চেয়ে বসে থাকা— এটা কথা হল? খরচের কথাটাও ভাবো।
শুনেছি লটারিওয়ালারা মাঝে—মাঝে নিজেরাই না—বিকোনো টিকিটের প্রাইজ পেয়ে যায়।
সেসব কপাল আলাদা, আমাদের কপাল একেবারে সিলমোহর আঁটা। আর লটারিতে কে না ঢুকছে বলো। সনাতন, হারু, পতিতপাবন, রাখোহরি, শুধু পৈলেনেরই দশ—পনেরোজন হবে। তার মধ্যে সনাতনের মাইকওয়ালা গাড়ি আছে, হারুর গাড়ি নেই কিন্তু মাইকওয়ালা রিকশা দাবড়ায়। গদাই মণ্ডল ধারবাকিতে টিকিট দিতে চাইছিলও না ইদানীং।
কিন্তু এই পৈলেন হল সোনার দেশ, এই তোকে বলে রাখলুম। এমন সরেস জায়গাটা ছেড়ে যাবি?
কী আছে, তোমার পৈলেনে? একটু ভেবে দেখ।
অত কথা কী, ওই পুলিনের শশার মাচানটাই দেখ চেয়ে। অতবড়ো নধর শশা ফলে কোথাও? ঘাসটা দেখ, পাতাটা দেখ, কেমন তেজালো সব ফলন। এ মাটির নীচে মা লক্ষ্মী আছেন রে। দুঃখকষ্ট যা হচ্ছে হতে দে, দেখবি চেপে বসে থাকলে বরাত একদিন ফিরবেই।
তোমার যতসব তাজ্জব কথা। তুমি পৈলেনে মাথা মুড়িয়েছ বলে কী আমাকেও মোড়াতে হবে নাকি? তুমি মাটি কামড়ে পড়ে থাকো এখানে।
অধিকারী এ কথার টপ করে জবাব দিল না। কিন্তু মিটিমিটি চেয়ে তার স্যাঙাতটিকে জরিপ করার চেষ্টা করলে অনেকক্ষণ। তারপর গলার স্বরটা থেকে আবেগ বাদ দিয়ে একটু আহ্লাদ খেলিয়ে বলল, গুহ্য কথাটি ফাঁস করবি না তো বাপ! জানি। চৈতলপাড়ায় একখানা দাঁও তুই মেরেছিস তাহলে!
অধিকারী নানারকম গলা করতে পারে। পৈলেন—কুমড়োহাটি সরস্বতী অপেরার সে বাঁধা অ্যাকটর। বড়ো বড়ো পার্টও করে। তার দুঃখের কথা, গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। পৈলেন—কুমড়োহাটির কর্ণার্জুন বা কংকাবতী বা সিরাজদ্দৌলা এখন আর বায়না পায় না। গাঁয়ের লোক কলকাতার অপেরা ধরে ধরে এনে যাত্রা দেখছে। টিকিট নিয়ে মারপিট। অধিকারী কলকাতার দলে ঢুকতে চেষ্টা করেছিল, যেমন সবাই করে। সুবিধে করতে পারেনি। সরস্বতী অপেরার এখন যা—দশা।
শচীন পোকাটাকে ফের দেখছে। আচ্ছা ও শালাও কি দেখছে শচীনকে? ব্যাটা এখন কাগজের মাঝ—বরাবর। শচীন কাগজটাকে একটু ভাঁজ করে নৌকোর মতো করে ধরে রেখে পোকাটাকে দেখছে।
ইঃ বাবা, কতটুকু রে। অ্যাঁ! কতটুকু!
কথাটা শুনেছ অধিকারীদা, এই যে পোকাটা দেখছ এর চেয়েও হাজার ভাগ ছোটো সব পোকা নাকি আছে। তারাই শরীরে ঢুকে নানা রোগ বাধায়।
অধিকারী একটা শ্বাস ফেলে বলল, জানি। আজকাল সবাই বৃত্তান্ত জানে কিনা। চাঁদে মানুষ যায়, অ্যাটম বোমা হয়, কত কী হচ্ছে দুনিয়ায়। হচ্ছে হোক, তোর আমার কী?
তা বটে। মানুষ চাঁদেই যাক আর অ্যাটম বোমাই ফাটাক, তোমার পৈলেনে শশার ফলনটা ভালো হলেই হল। কী বলো!
তাই বললুম বুঝি! কপালটাই খারাপ রে ভাই, আমার কথা সবাই আজকাল উলটো করে ধরে। বেলা হল, উঠি। তা কবে যাচ্ছিস?
যাব একদিন, টেরও পাবে না।
টের পাব না মানে?
শচীন মিটিমিটি হেসে বলে, টেরটা পাবে কী করে বলো। সামন্তমশাই কাশী গেলেন, সঙ্গে এক গোরুর গাড়ি বোঝাই জিনিসপত্র, হাঁড়ি—কুড়ি—বালতি অবধি। আমার তো আর তৈজসপত্র নেই। একখানা টিনের বাক্স বগলে করে বেরিয়ে পড়ব, পিছনে থাকবে এই ভাঙা ঘরখানা শুধু। সাপখোপের আস্তানা হয়ে থাকবে। কেউ টের পাবে না গো অধিকারীদাদা।
অধিকারী উঠে পড়ল। পৈলেনের একটা লোক কমে যাচ্ছে, এটা তার কাছে যত গুরুতর সংবাদ, অন্য কারও কাছে ততটা নয়। তবু খবরটা পাঁচকান না করলে তার পেটটা বড়ো ফেঁপে উঠবে। বড়ো আইঢাই হবে। তাকে সবাই পেটপাতলা লোক ভাবে বটে, কিন্তু আর অসুবিধের কথাটা কেউ ভাবে না।
শচীন বাইরের রোদটার দিকে খানিক চেয়ে রইল। বড্ড ফর্সা রোদ, সাবানে কাচা, ধপধপে, মুচমুচে। টিনের চালে শালিক লাফাচ্ছে। কুচকুচ শব্দ। শুকনো গলায় একটা কাক তখন থেকে নিমগাছে বসে নাগাড়ে ডাকছে। পাঁশুটে আকাশে একফোঁটা মেঘ নেই। খয়েরপুরের বাস ওই ধুলো উড়িয়ে চলে গেল। কিছু দেখা আর কিছু শোনা নিয়েই তো দুনিয়াখানা নাকি? অনন্ত শচীন তো তাই জানে বরাবর। কিছু দেখ, কিছু শোনো। এর বাইরে আর কী আছে? আছে আর একখানা জিনিস। সে হল ভাবনা। তা সেও ওই শোনা আর দেখার মধ্যেই পড়ে। ঠেসে ভাবলে কত পুরোনো দিনের কথার শব্দ পাওয়া যায়, কত হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখাও যায়।
এই যেমন এখন ভাবতে গিয়ে দা হাতে তার মরা বাপকে স্পষ্ট দেখতে পেল শচীন। উত্তরধারে ঘরের কানাচে দাঁড়িয়ে ভাঙা বেড়া বাঁধছে। গায়ে ঘাম, মুখে নিভে যাওয়া বিড়ি, গলায় মৃদুমন্দ যাত্রার কোনো গান। যেখানটায় রান্নাঘর ছিল সেখানে এখন আগাছা বুকসমান। তবু শচীনের চোখের সামনে রান্নাঘরখানা ভেসে উঠল। মায়ের শাড়ির সবজে আঁচলখানা অবধি দেখা যাচ্ছে। আর নিমপাতা ভাজার মিঠে বাস আসছে খুব। চোতমাসে নিম—বেগুন ছিল বাঁধা। তা শুধু ওই নিম—বেগুনই। তাই দিয়েই ভাতের ঢিবি তুলে ফেলত বাপে—ব্যাটায়। কাঁচা লঙ্কা থাকত। আর কী চাই? গরিব বাপ গরিবই রেখে গেল তাকে। মা—ও গত হল। তারপর থেকেই যেন ঠেকনোর অভাবে বাড়িটা হেলে পড়তে লাগল। মাটির দাওয়ায় ইঁদুরের গর্তে সাপখোপও কি নেই! কাঠা তিনেক জমি নিয়ে এই বাড়িখানা কি কাঁদবে শচীনের জন্য। বাড়ি কি কাঁদে?
খবরের কাগজের ভাঁজে পোকাটা ঝিম মেরে আছে এখনও। এ ব্যাটার কি কোনো বাড়িঘর আছে! তা ধরা যায় এই খবরের কাগজের ভাঁজখানাই ওর বাড়ি। এর বেশি আহাম্মকটা আর জানেও না কিছু। টুসকি মেরে ফেলে দিলে যেখানে পড়বে সেটাই ফের ওর বাড়ি। শচীনেরও তাই। পৈলেন যতদিন ছিল ততদিন পৈলেন, নইলে চৈতলপাড়া। দুটোতেই ঐ—কার আছে। ভারি অদ্ভুত। ঐ—কার বড়ো একটা থাকে না যেখানে—সেখানে।
পৈলেনে এখন জমির দাম কত করে কাঠা যাচ্ছে কে জানে। তবে বেশি নয়, আর কেনার লোকও চট করে পাওয়া যাবে না। পেলেও দাম কষবে। তার চেয়ে থাক পড়ে। মাঝে—মাঝে তো ভাবতে পারবে, আমার একখানা বাড়ি ওই হোথায়, পৈলেনে!
লটারির ব্যাবসাটা কোনো কাজের ছিল না। গুচ্ছের বাতিল টিকিট এখনও জমে আছে ঘরে। ফেলতে মায়া হয়েছিল বড়ো।
কথাটা ভাঙেনি অধিকারীর কাছে। সে চৈতলপাড়া আজই রওনা হচ্ছে আর এবেলাই। বেলা দেড়টায় একখানা বাস যায় ওদিকে। রোদ খেতে খেতে একেবারে তপ্ত চাটুটি হয়ে এসে পৌঁছোয় খয়েরপুর থেকে। পুঁটিমারি, হাশিমের চর, বাগদাখাল, জিনপুর হয়ে নবীনগর। সেখান থেকে বাস বদলে নতুন রাস্তা ধরে আরও চার ঘণ্টার পথ।
কপালের ওপর বিশ্বাস নেই শচীনের। কপালে ভর দিয়ে অনেক কাটল। লাভ হল লবডঙ্কা। তবে খবর পাকা হলে, কোনো রসের নাগর রসিকতা না করে থাকলে, তার একজন মাসির খবর পাওয়া গেছে। শচীনের তিনকুলে কেউ আছে বলে সে জানত না। হঠাৎ একদিন আগে একখানা তোবড়ানো পোস্টকার্ড এসে হাজির। হাতের লেখা এমন জড়ানো যে সেটা হাবশি ভাষাও হতে পারে। রায়বাড়ির পরমেশ তার আতসকাচ দিয়ে অতি কষ্টে পাঠোদ্ধার করেছিল। ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে চৈতলপাড়ার পুঁটুমাসি জানিয়েছে যে, সে শচীনের এক মাসিই বটে। শচীনের সঙ্গে তার ভারি একটা দরকার। চিঠিতে কথাটা লেখা যায় না। শচীন যেন কাজ—কারবার ফেলে এখনই পত্রপাঠ চৈতলপাড়া চলে আসে। মাইমগঞ্জের মোড়ে নেমে নারান হালদারের নাম বললেই যে—কেউ বাড়ি দেখিয়ে দেবে।
মোদ্দা কথাটা হল এই। তা এ চিঠির ওপর কথাটা ভরসা করা যায় কে জানে!
পরমেশ বলল, চিঠির ভাবখানা যা বুঝছি মাসি তোকে সম্পত্তি দিতে চায়। বোধহয় সন্তান—টন্তান নেই। যা দুর্গা বলে ঝুলে পড়।
কথা তা নয়। পুঁটুমাসি তার আপনার মাসি হলে এক—আধবার কী মায়ের মুখে নামটা শুনত না শচীন? চিঠির ভাবখানা এমন যে, একেবারে মায়ের সাক্ষাৎ সহোদরা। ধন্দটা এখানেই লাগছে শচীনের।
রোদটা আরও তেজালো হলে শচীন ঘরে এসে তার মাচানটায় শুয়ে একটু ঠ্যাং নাচাল। ভাবগতিক কেমন যেন ঠেকছে তার! ভালো, না মন্দ? পোস্টকার্ডখানা টিনের তোরঙ্গে ছিল। উঠে সেটা বের করে ফের আলোয় ধরে পড়ল শচীন। ‘…তুমি আমাকে চিনিবে না। আমি তোমার মাসি হই। সম্পর্ক খুবই নিকট।’
ঘরের বেড়ায় অনেক ভোগলা। সারাবার সাধ্য শচীনের নেই। শেয়াল—কুকুর ইচ্ছে করলেই ঢুকে পড়তে পারে। ঢোকেও। প্রায়ই বাইরে বাইরে ঘুরতে হয় শচীনকে। এসে মাঝে—মাঝেই দেখে দু—তিনটে নেড়ি কুত্তা দিব্যি জমিয়ে বসে গেছে। বাচ্চাও দেয়। পাখি বাসা করে বসবাস করছে বহুকাল ধরে। বর্ষাকালে টিনের অজস্র ফুটো দিয়ে জল পড়ে, শীতকালে উত্তুরে হাওয়া বিনা বাধায় হা—হা করে বয়ে যায়। গতবারও ঝড়ে চালের টিন উড়ে গিয়েছিল। শচীন কুড়িয়ে এনে ফের লাগায়। তো এই হল শচীনের ঘর। এর জন্য মায়া করে আর লাভ কী?
তার বাক্স গোছানো হয়ে গেছে। থালা, গেলাস আর ঘটি চটের ব্যাগে ঢুকেছে। বিছানা বলতে একখানা শতরঞ্চি, ছেঁড়া বেডকভার আর তেলচিটে শক্ত বালিশখানা। তা সেটা এখনও দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়নি। হয়ে যাবে।
ও শচীন, আছিস নাকি?
শচীন বেজার মুখে উঠল। এ হল নরেনকাকা। ধারে লটারির টিকিট নিত একসময়ে। এখনও চোদ্দো টাকা শচীন পায়। নরেনকাকা লোকটা সুবিধের নয় মোটেই। ধান্ধাবাজ এক নম্বরের।
মানে যাই থাক, মুখে আদিখ্যেতা দেখাতেই হয়। শচীন উঠল। মুখে একটু হাসি খেলিয়ে বলল, আসুন কাকা, খবর সব ভালো?
নরেন সাপুঁই ঘরে ঢুকে চারদিকটা চেয়ে বলল, অধিকারী তাহলে মিথ্যে বলেনি! তুই তাহলে চৈতলপাড়ায় যাচ্ছিস। কেন বাপ, এ দিকটায় কি সুবিধে হচ্ছিল না? আমরা পাঁচজন তো ছিলুম পেছনে।
শচীন খুব লজ্জার ভাব দেখিয়ে জিব কেটে বলে, আপনারাও রইলেন, আমিও রইলুম। চৈতলপাড়া তো মোটে একবেলার পথ। ঘুরেও আসা হবে একটু।
মাসির সম্পত্তি পাচ্ছিস যে শুনেছি। তা কীরকম সম্পত্তি? বেশ একটা মোটা দাগে মারলি নাকি কিস্তিটা!
গিয়ে দেখতে হবে ব্যাপারখানা কী!
চিঠিতে কী লিখেছে? একটু ইশারা তো থাকবে।
শেষ দিকটা লেখা বড্ড জড়ানো, পড়াই যাইনি। তবে সম্পত্তির কথা কী যেন আছে একটু।
বাঃ এ তো তোফা হল রে। বাকি জীবনটা পায়ের উপর পা দিয়ে বসে বসে খাবি। অধিকারীও বলছিল বটে, দোতলা পাকা বাড়ি, বত্রিশ বিঘে ধানজমি, চালের কল, আমবাগান, তেজারতি কারবার, নগদ পঞ্চাশ হাজার আর সত্তর ভরি সোনা।
ওই যাঃ হাতিশালে হাতি আর ময়ূর সিংহাসনটার কথা ভুলেই মেরে দিয়েছে তাহলে! আর হাওয়াগাড়ি!
নরেনকাকা মুখখানা তোম্বা করে বলে, তা ওর কথা কি ধরি নাকি? গর্ভস্রাব আর কাকে বলে! বরাবর অধিকারীর কথার ন—আনা বাদ দিয়ে সাত—আনা ধরি।
আজই রওনা হচ্ছিস বুঝি! দুর্গা দুর্গা। তাহলে বাড়ির বিলিব্যবস্থা কী হচ্ছে?
হচ্ছে না কাকা। বাড়ি পড়ে থাকবে।
লাভ কী? পিছন দিকটায় তোর দু—বিঘে জমি ছিল না?
সে কবে বেচে খেয়েছি। পশুপতি ওদিকে গোয়ালঘর তুলল যে!
অ। তা বাড়িখানার তো ভারি দুর্দশা করে রেখেছিস বাপ।
অনেকদিন ধরেই দুর্দশা চলছে কাকা।
টিন ক—খানা আর খুঁটিগুলি যা কিছু কাজে লাগতে পারে। এমনিতেও খুলে নেবে লোকে। দশটা টাকা দেবো’খন—
বেচব না কাকা। চৈতলপাড়ায় কী হয় না হয় কে জানে। ঘর আমার যেমন আছে থাক।
থাক। তবে বন্দোবস্তটা আমার সঙ্গেই করিস, বলে রাখলুম। যদি ওদিকটায় তোর সুবিধে হয়েই যায়, চৈতলপাড়াতেই যদি চেপে বসিস তাহলে একটু জানাস বাপ।
সে পরে ভেবে দেখা যাবে।
তাল আর নারকোল গাছগুলির কীরকম বন্দোবস্ত করলি?
যেমন আছে থাকবে। যার খুশি পেড়ে খাবে। এমনিতেই খায়, আমি তো আর বাড়িতে থাকি না, এধার—সেধার ঘুরে বেড়াই পেটের ধান্দায়।
নরেশ সাঁপুই যেন কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। গাঁ থেকে একটা লোক চলে যাচ্ছে, সুতরাং কিছু ধান্দা করা যায় কিনা দেখতে এসেছিল। কিন্তু কোন দিকটায় যে সুবিধে হবে তা বুঝতে পারছে না। লোকটা সুবিধের নয় ঠিকই, তবে বোকা। বুদ্ধি না থাকলে খুব একটা ফেরেব্বাজও হওয়া যায় না।
নরেন সাঁপুই কয়েকবার ঢোক গিলে বলল, গোটা পাঁচেক টাকা হবে বাপ?
কাকা, আপনার কাছে আমি এখনও কিছু পাই।
সে কী আর মনে নেই রে। বড্ড ঠেকায় পড়ে গেলুম আজ। সামনে সংক্রান্তি। সংক্রান্তিতে নরেনকাকার কোন মোচ্ছব কে জানে। একটা অজুহাত খাড়া করতে হয় বলে করা। বোকা লোক। নরেন সাঁপুইয়ের জন্য আজ হঠাৎ মায়া হল শচীনের। পুরো পাঁচটা টাকাই বের করে হাতে দিয়ে বলল, এ আর শোধ দিতে হবে না।
নরেন একটু হাঁ হয়ে গেল। সে চাউন্তি লোক। মানুষ দেখলেই চায়। তা বলে সবাই কি আর দেয়! দশজনের কাছে চাইলে একজন হয়তো দেয়। তাও পুরোটা নয়। নরেন সাঁপুইয়ের চাওয়ার কোনো ঠিক নেই। কার কাছে কী চাইবে তাও আগে থেকে ঠিক করা থাকে না। কোনটা চাইবে তারও কিছু ঠিক নেই। নিশিকান্তর কাছে হয়তো পাঁচটা আলু চাইল, নীলমণির কাছ থেকে চাইল নারকোলের দড়ি, পটলের কাছ থেকে দোয়াতের খানিকটা কালি। খুব একটা কাজের জিনিস নয়, লাগেও না তার কাজে। তবু চাওয়ার অভ্যাসটা রাখে। অধিকাংশ সময়েই পায় না কিছু। আজ ঝড়াক করে পাঁচটা টাকা পেয়ে গিয়ে ভারি থতমত খেল সে। টাকাটা ট্যাঁকে গুঁজে ফেলল চোখের পলকে। তার একটা মেয়ে আছে। বিন্দু। বাপকে খুব উস্তম—কুস্তম করে বকে এই স্বভাবের জন্য, তা বকুক। এভাবেও তো ঘরে কিছু আসে। যা আসে তাই লক্ষ্মী। এই পাঁচটা টাকা চলে এল— এ কি চাট্টিখানি কথা! কেমন হেসে হেসে চলে এল। গায়ে ঘামটুকু হল না।
নরেন সাঁপুই টাকাটা না পেলে শচীনের পেতলের ঘটিখানা চাইত।
নরেন সাঁপুই একটু দেঁতো হাসি হেসে বিদেয় হওয়ার পর বেলাটা একটু ঠাহর করে দেখল শচীন। একটু আগে ঠেসে পান্তা খেয়েছে। এবেলা আর খাওয়ার বায়নাক্কা নেই। চৈতলপাড়া পৌঁছোতে রাত হবে। তা হোক, তার আবার দিনই বা কী, রাতই বা কী? নারান হালদারের বাড়ি পৌঁছোতে পারলেই হল।
একটু ভয় ভয় করছে অবশ্য। ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারছে না এরকমটা হচ্ছে কেন? হঠাৎ একখানা পোস্টকার্ড আসবার দরকারটাই বা কী ছিল?
খবরের কাগজখানা বোচনের বাপকে ফিরিয়ে দিতে হবে। বোচনের মা আবার ঠোঙা বানিয়ে বেচে। কাগজের খুব হিসেব। হাড়কেপ্পন লোক।
বিছানাটা ধীরেসুস্থে গুটিয়ে নারকোলের দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল শচীন! একরত্তি একখানা জিনিস হল। দুনিয়ায় তার তৈজসপত্রের পরিমাণ কোথায় এসে ঠেকেছে দেখে শচীন আপনমনেই হাসল। অবস্থাটা খুব খারাপ যাচ্ছে ইদানীং।
বাক্স—বিছানা নিয়ে হেলেদুলে বেরিয়ে পড়ল শচীন। তার কোনো দুঃখ হচ্ছে না, কষ্ট হচ্ছে না, মন কেমন করছে না। লোকের নানারকম শেকড়বাকড় থাকে, আঁকুসি থাকে, বাড়ি ছেড়ে যেতে কষ্ট হয়, গাঁ ছেড়ে যেতে কষ্ট হয়। শচীনের সেরকমধারা কিছু হচ্ছেই না মোটে। তার কাছে পৈলেনও যা, চৈতলপাড়াও তাই।
শীতলাবাড়িতে একটা পেন্নাম অবশ্য ঠুকল শচীন, দেখো মা, যেন বেঘোরে না পড়ি। একটা আধুলি প্রণামীও ঠুকে দিল। কম হল কি? কিন্তু আর দিতে সাহস হল না। পকেটে মোটে এগারো টাকা চার আনা আছে, বাসভাড়া বাদে। টাকাটা রাখা দরকার।
শীতলাবাড়ির পিছনে শ্রীপতির পুকুর ঘুরে গেলে উত্তরে বোচনদের বাড়ি। বেশ বাড়ি। পাকা দালান। সামনে একটা বাড়ি, মাঝখানে উঠোন ছেড়ে পিছনে আর একখানা। একটা মাটকোঠাও আছে।
শচীনকে দেখে বোচনের মা কুলোঝাড়া থামিয়ে অবাক হয়ে বলল, এ কী রে, বাক্স—টাক্স নিয়ে কোথায় চললি?
শচীন একটু লজ্জা পেল। মা মরে ইস্তক আর কারও কাছে না হোক বোচনের মায়ের কাছে তার একটু কদর ছিল। অনেক উপোসের দিনে এই মাসি তাকে ডেকে ভাত দিয়েছে। পাল—পার্বণে নেমন্তন্ন ছিল বাঁধা, বদলে শচীন মাঝে—মাঝে গতরে খেটে দিয়ে ঋণ শোধ করে বটে, কিন্তু শোধ হয় না। মায়ার একটা দেনা আছে।
শচীন বলল, এই যাচ্ছি একটু চৈতলপাড়া। এক মাসি খোঁজ করেছে।
তা যাবি। কিন্তু ব্যাক্স—প্যাঁটরা নিয়ে কেন? আর মাসিই বা হঠাৎ উদয় হল কোত্থেকে? তোর মায়ের তো নাড়িনক্ষত্র জানি। আমার বাড়িতে ঢেঁকি কুটত, ধান ভানত, খই—মুড়ি ভাজত, আর মনের প্রাণের কত কথা বলত। তোর মাসি এল কোত্থেকে বল তো!
সেটা তো আমিও জানি না মাসি। একটা চিঠি এসেছে।
কী লিখেছে চিঠিতে?
বিষয়—সম্পত্তির কথা কিছু আছে। ভালো বোঝা যাচ্ছে না।
সে কী করে? বোঝা যাচ্ছে না মানেটা আবার কী?
মনে হচ্ছে চিঠিতে ভাঙতে চাইছে না।
বোস ওখানে। একটু কথা বলি। ও বোচন, দে তো শচীনকে একঘটি জল। দুটি মোয়া দিস। শচীন বারণ করল না। অনেক দূরের পথ। ততক্ষণে পেটের পান্তা জল হয়ে যাবে। যা বোঝাই করে নেওয়া যায় তাই কাজে লাগবে। গরিবের পেটও বটে, মেলা জায়গা, কত যে আঁটে তার ঠিক নেই বাবা।
বোচন এসে ছোটো ধামায় কয়েকটা মোয়া আর কুয়োর ঠান্ডা জল রেখে গেল।
মাসি খানিকক্ষণ কুলো আপসে সব সরিয়ে রেখো মোড়া পেতে সামনে এসে বসল। ফর্সা মুখে ঘাম জমেছে টসটসে। মোটা মানুষের গ্রীষ্মকালে ভারি কষ্ট।
মাসির বিষয়—সম্পত্তি পাবি নাকি?
সেরকমই মনে হচ্ছে। তবে ঠিক বুঝতে পারছি না।
মাসি আঁচল দিয়ে ঘাম মুছে হাতপাখা নাড়তে নাড়তে বলে, চিরকালের মতো যাচ্ছিস নাকি?
না। একটু বুঝে আসি গিয়ে।
গাঁ ছেড়ে যাবি, তা অমন হুট করে যেতে আছে? মাতব্বর—মরুব্বিদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করতে হয়, পাঁচজনকে জানাতে হয়, তবে না! ও কীরকম অলক্ষুণে যাওয়া তোর!
শচীন মোয়া খেতে খেতে বলল, মাতব্বরেরা তো খোঁজখবরও নেয় না। পৈলেনে আর আমার আছেটা কে! এই আপনিই যা একটু ডাকখোঁজ করেন।
তা আমাকেও তো বলতে পারতি একবার। তোকে নিয়ে যে কত কী ভেবে রেখেছিলুম! শচীন একটু অবাক হল, আমাকে নিয়ে আবার ভাবনার কী মাসি? আমি নিজেই তো ভাবি না কিছু।
সে আছে রে। তোর মেসোকেও তো ক—দিন ধরে জ্বালিয়ে মারছি, ওগো, আমাদের শচীনের জন্য একটু ভেবো। তা তার মাথায় নানা ফিকির। তার কি আর সময় আছে আমার কথা কানে তোলার?
শচীন লজ্জায় অধোবদন হল। তার জন্য যে কেউ ভাবে, এটা তার কাছে বড়ো নতুন কথা।
ঘাড়গলার ঘাম মুখে মাসি বলল, কথা আরও আছে।
কী কথা মাসি?
তোকে সেকথা বলি কী করে? তোর মা হলে কথাটা পাড়তে সুবিধে হত। তা সে আবাগীর বেটি কোন সকালে ভবনদী পেরিয়ে গেল। এখন ছাই বলিই বা কাকে! এদিকে তুই নিজেও আবার বিবাগী হচ্ছিস।
কথাটা আমার জানতে নেই বুঝি?
জেনে তো বড্ড লায়েক হবি বাছা। তবে অনেকদিন ধরে কথাটা ভেবে রেখেছিলুম। বোচন ডাগরটি হওয়ার পর থেকেই। কিন্তু আমার ভাবায় হবেটা কী? সংসারে পেষাই হচ্ছি দিনরাত, আমার ভাবাভাবি সব ভেতরে ভেতরে ভেপে ওঠে। বোচনের বাপ কোন কথাটা কানে তুলছে আমার বল তো!
না, মাসি ততটা ভেঙে বলেননি। তবু শচীন একেবারে পা থেকে মাথা অবধি শিউরে উঠল।
বাপ রে! ঠিক শুনেছে তো সে! কথার ভিতরকার মানে ধরতে পারছে তো! বোচন ডাগর হওয়ার পর থেকে মাসির মতলবখানা কোনদিকে যাচ্ছে?
মোয়া এমন জিনিস সে, হুড়োহুড়ি করে খাওয়া যায় না। অথচ ধামায় এখনও চার—চারটে পড়ে আছে। হাতছিপ্পু করে মোয়া ক—টা তুলে পকেটে পুরে নিল শচীন। মাসি খুদকুঁড়ো জড়ো করছে নীচু হয়ে। এই সুযোগ। ভিতরটা বড্ড শুকিয়ে উঠল হঠাৎ। শচীন জলের ঘটিটা গলায় প্রায় উপুড় করে ধরে সবটা ঢকঢক করে খেয়ে নিল।
উঠলুম মাসি।
উঠবি মানে?
দেড়টার বাসটা ধরতে হবে।
চৈতলপাড়া বললি তো!
হ্যাঁ।
কত দূর এখান থেকে?
ঘণ্টা ছয়েকের পথ।
ও বাবা! তাহলে তো বেশ দূর!
তা আছে।
কবে আসবি আবার?
তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
মাসি কেমন যেন কাহিল হতাশ মুখে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল। শচীন একটা পেন্নাম ঠুকে উঠে পড়ল।
আজ যা রোদ উঠেছে, একেবারে চাষাড়ে রোদে। আকাশে একটা পিঙলে ভাব। চারিদিকটা যেন ঝিমঝিম করছে তেতে। চৈতলপাড়া নাকি এর চেয়েও শুখো। তা অধিকারীদাদা আগড়ম—বাগড়ম অনেক কথা বলে। তার কথার কিছু ঠিক নেই।
শচীন গুটি গুটি বাস রাস্তার কদমতলার ছায়ায় এসে দাঁড়াল। ছায়ায় দাঁড়িয়ে লাভ হল না কিছু। সান্ত্বনা হল। বাক্সটা পেতে চেপে বসল শচীন। দেড়টার বাস আসতে এখনও ঢের দেরি।
এই গরমের দুপুরে আর কোনো প্যাসেঞ্জার নেই। শচীন বসে বসে ভাবতে লাগল।
বোচন! কোনোদিন বোচনের কথা তেমন করে ভাবেনি শচীন, মুখটাও দেখেনি মন দিয়ে। কেমন মেয়েটা? শচীন চোখ বুজে ভাবার চেষ্টা করল। ভালো করে মনে পড়ল না। অথচ একটু আগে বোচন তাকে মোয়া আর জলের ঘটি দিয়ে গেছে। তবে মনে পড়ছে না কেন?
না। ভালো করে ভাবতে হবে।
মুশকিল হল, যতই ভাবতে যায় ততই পিছলে যায় ব্যাপারটা। জ্বালাতন আর কাকে বলে!
ওপাশে খয়েরপুরের বাস ধরতে একটা পরিবার এসে জড়ো হয়েছে, স্বামী—স্ত্রী আর গোটাকয় বাচ্চা। চাষিবাসী লোক। গাছতলায় চেপে বসে আছে। লোকটা বিড়ি ধরিয়েছে, বউটা কোলের বাচ্চাকে ওরই মধ্যে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে। দৃশ্যটা আজ তেমন খারাপ লাগল না শচীনের। হাঁ করে দেখল। কয়েকটা মানুষ মিলে মোয়া বেঁধেছে যেন। চিটটা যে কীসের সেটাই বাইরে থেকে বোঝা যায় না।
হ্যাঁ, বোচনের কথা। কী যেন বলছিল মাসি! ঠিক শুনেছে তো! মানেটা ঠিক ঠিক ধরতে পারছে তো! এই গাঁয়ের ওই একটিমাত্র মানুষ— অর্থাৎ বোচনের মা তার যা হোক একটু খোঁজখবর যে করত, তারও তো একটা মানে আছে। এমনি এমনি তো করত না!
শচীন ফের চোখ বুঝল। বোচনের মুখখানা কেমন? নাক, চোখ, ঠোঁট, চুল— কিছু একটা তো মনে পড়বে! রোজ দেখছে, তবু মাথাটা একদম ফর্সা শচীনের। কিছুই মনে আসছে না। বোধহয় এই গরমে আর রোদেই এমনধারা হচ্ছে।
অনেকক্ষণ বাদে একটা কথা শচীনের মনে পড়ল। বোচন বছরটাক হল ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরেছে। আর নিমতলায় আজকাল আর তাকে এক্কাদোক্কা খেলতে দেখা যায় না।
খয়েরপুরের দিক থেকে একটা বিকট হর্নের শব্দ এল। বাস আসছে। বিশাল ধুলো উড়ছে বাসের পিছনে! একেবারে গন্ধমাদন।
শচীন উঠল। বড্ড গরম। শেষবারের মতো বোচনের মুখটা মনে করার খুব চেষ্টা করল সে। এত চেষ্টা করল যে, বাসটা সামনে এসে দাঁড়ানোর পর একমুঠো ধুলো মুখে নিয়ে সে চেতন হল। দাঁত কিচকিচ করছে ধুলোয়।
কন্ডাক্টর চেঁচাচ্ছে, পুঁটিমারি, হাশিমের চর, বাগদাখাল, জিনপুর, নবীনগর….
শচীন তিন পা পিছিয়ে এল। আর প্যাসেঞ্জার নেই বলে কন্ডাক্টর তার দিকেই চেয়ে চেঁচাচ্ছে।
শচীনেরও ওঠাই উচিত। তার কারণ এ বাস ছাড়লে আজ আর পৌঁছোনোর আশা নেই। তবে কিছুতেই সে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডেলটা ধরে পা—দানিতে পা দিয়ে উঠে পড়ার মতো সহজ কাজটাও করে উঠতে পারল না।
উঠবে তো, নাকি! কন্ডাক্টর এবার বলেই ফেলল।
শচীন কাঁচুমাচু হয়ে বলল, যেতুম তো ভাই, কিন্তু একটা জিনিস যে ফেলে এসেছি।
অ, তাই বলো! বলে কন্ডাক্টর ঘণ্টি মেরে দিল।
নাঃ, ভারি লজ্জা করছে শচীনের। ওপাশ থেকে চাষি আর চাষি—বউও তাকে দেখছে।
শচীন আর দেরি করল না। জিনিসপত্র নিয়ে উঠে পড়ল। লোকে ঠিক বুঝবে না তার সমস্যাটা কোথায়। ওই যে বোচনকে কিছুতেই মনে করতে পারল না, এ লক্ষণটা শচীনের ভালো ঠেকছে না। এই গুরুতর স্মৃতিভ্রংশ অবস্থায় সে যায়ই বা কী করে?
আর কাণ্ডখানাই বা কী? মেয়েটার মুখটা মনে করতে পারল নাই বা কেন সে?
গুটি গুটি ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল শচীন। একটা কুকুর ঢুকে পড়েছিল, তাকে দেখে বেরিয়ে গেল লজ্জা পেয়ে। জিনিসগুলি যেমন ছিল তেমনি আবার রাখল শচীন। বিছানাটাও পাতল। তারপর শুয়ে শুয়ে ঠ্যাং নাচাতে নাচাতে ভাবল, আজ বিকেলে জলের ঘাটে গিয়ে মেয়েটাকে ভালো করে দেখতে হবে।
আজ আর যাওয়া হল না শচীনের। কালও হবে কি না কে জানে!