1 of 2

মুখ – মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

মুখ – মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

অনেক, অনেকদিন কেটে যাবে তারপর। শেষে একদিন একটি সোনালী বিকেলে হয়তো সীতা নিঃশেষে ফুরিয়ে যাবে। আর, সেই ঝরে-যাওয়ার পরে কেউ কি মনে রাখবে যে এখানে একদা ভোরবেলাকার শিশির সূর্যের ছোঁয়া পেয়ে ঝলমল করে উঠেছিল। শুধু সেদিনকার সেই শিশিরের স্মৃতিতে দিন কয় হয়তো তাকিয়ে থাকবে নির্জন শিশুগাছটা। তারপর একসময়ে, শীতের সময়ে শিশুগাছের পাতা ঝরবে টুপটাপ, পড়ন্ত রোদের মিষ্টি আভার দিকে তাকিয়ে কিছুকাল মুহ্যমান থাকবে গাছটি, তারপর একদিন সকালের লালে সে নিজেই অবাক হয়ে যাবে—নতুন সবুজ পাতার রঙে রঙে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। তখন আর সেই নীল নির্জন মুহূর্তের কথা মনেও থাকবে না তার।

জানলার কাচের ওপাশে বিকেলের রোদ। এপাশে মারবেল পাথরের মেঝেয় তারই চৌকো আলো।

সাদা, নরম, দুধের বিছানা থেকে উঠল সীতা। রুগ্‌ণ পাণ্ডুর বি-রঙ হাতে খুলে দিল জানলাটা। নিটোল একটি বিকেল গড়িয়ে পড়ল মারবেল পাথরের মেঝেয়। জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে রইল সীতা, সেদিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। সুরকি-ঢালা ফুলের কেয়ারি-করা লন। দীঘল একসার বনঝাউ, লম্বা ঝাঁক বাঁধা বাদাম, আম গাছের সবুজ পাতায় ছায়ার আলপনা, শঙ্খলতা রাজকন্যার দীঘল নরম আঙুলের মত সোনালী রঙের চাঁপা গাছ। গাড়ি-বারান্দা, লন পেরিয়ে ফটক।

উঃ, কতদিন হল সীতা বেরোয়নি বাইরে! অনেকদিন বাদে সেদিন ফটক পর্যন্ত গিয়েছিল। মালিকে ডেকে কিছু একটা বলতেও যাচ্ছিল তখন, তারপর সেই মুখটা চোখের সামনে অসহ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠায় কিছুই করতে পারেনি। ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গিয়ে ফিরে এসেছিল। মারবেল পাথরের বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে ঢুকেছিল তেতলার এই ঘরটায়। তারপর নিজেকে এলিয়ে দিয়েছিল সাদা রবারের ফেনা জমানো বিছানায়। বালিশে মুখ গুঁজে অনেকক্ষণ ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল সেদিন।

কী করতে পারে এ-ছাড়া?

লাইব্রেরি থেকে প্রায় প্রত্যেক দিনের ডাকেই নতুন নতুন বই আসে। সুন্দর, ঝকঝকে কাচের মত সেলোফেনে মোড়া বই। দামী দামী। উঃ, কত কি লিখতে পারে লোকে! আজকাল সীতার আর পড়তেও ভাল লাগে না। একঘেয়ে লাগে। পানশে লাগে খবরকাগজও। চুপ করে কতক্ষণ আর ভাবা যায়? মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে, শীর্ণ গাল বেয়ে ধারাপাত হয় শ্রাবণের, তারপর ঠোঁটে যখন সেই জল এসে পড়ে, তখন বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা ছাড়া কী আর করবার থাকে ওর?

এত বড় বাড়িটা কী নির্জন!

সীতা জানলার শিক থেকে হাতটা সরিয়ে আনল, আকাশ থেকে ফিরিয়ে আনল চোখ। তাকাল ঘরের দেয়ালে। দেয়ালে এবং ঘড়িতে। বিকেল তখন। তাকাল সরোজের অয়েল পেন্টিংটার দিকে। সুন্দর, স্বাস্থ্যবান সরোজ। তাকাল টেবিলে। ফুলদানিতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা। নতুন ফুল। কখন যে মালি এসে ফুল বদলে দিয়ে গেছে জানে না সীতা। হয়তো ঘুমিয়েছিল তখন। সাদা টেবিল-ক্লথটায় সুন্দর একটা নকশা কাটা। সাদা লেসের। সীতারই করা।

পায়ে পায়ে টেবিলের কাছে এগিয়ে এল সীতা। সাদা শীর্ণ হাত বুলিয়ে নিল নকশাটার উপর।

কী করবে সীতা এখন? ঘরটা আবছা হয়ে আসছে। অন্ধকারে। সন্ধে নামছে তেতলার এই ছোট্ট ঘরে।

আলোটা জ্বালল সীতা। বোতাম টিপতেই ঝলমল করে উঠল সারা ঘর। এমনি করে হয়তো উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারত সীতার জীবন।

টেবিলের ড্রয়ার খুলল সীতা। একটা চৌকো নীল কাগজের বাক্স। চিঠির। আলগোছে একটা চিঠি তুলে নিল সীতা। কালির রং এখনও তো বিবর্ণ হয়নি, চিঠির মসৃণ কাগজটায় এখনও হালকা মিষ্টি একটা গন্ধ আছে। তবে কেন সীতার সব ফুরিয়ে গেল? কেন ফুরিয়ে গেল সীতার সবকিছু?

বিয়ের রাতে বিকাশ সীতাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল চিঠিগুলো। স্পষ্ট, তীক্ষ্ণ অক্ষরে লিখে দিয়েছিল একটা ছোট্ট গন্তব্য; ‘এখন আর কী দরকার আমার এই চিঠিগুলোয়? তোমার চিঠি তোমারই থাক।’

বিয়ের রাতের কথা মনে পড়তেই ফ্যাকাশে হয়ে এল সীতার শীর্ণ মুখ। তারপর আলতো হাতে একটা নীল কাগজ তুলে নিল সীতা। আবার পডুল নিজের লেখা অনেকবার পড়া চিঠিটা।

‘অনেক, অনেকদিন পর চিঠি লিখতে বসে ভাবছি, সবই তো বলা হয়েছে তবুও কেন আমার আকুলতা কমল না। প্রত্যেক ভোরে কোথায় যে ফুল পায় পূজারী, অথচ ফুল ছাড়া তার পুজো সারা হয় না। হেসো না। আমার হয়েছে মুশকিল। আমি চাই তোমাকে কিছু বলতে, এমন কিছু যে আমার ভাবনাটাকে সুন্দরতর করে গোছানো যায়, গুছিয়ে তোমার কাছে মেলে ধরা যায়, কিন্তু বড় এলোমেলো হয়ে পড়ে।

কত কথাই যে কত সময় ভাবি। তুমি যদি কোনরকমে আমার মনে একবার ঢুকতে পারতে, অবাক হয়ে যেতে হবে।

অসম্ভব মন কেমন করছে তোমার জন্যে।

স্নান করতে করতে উঠে এসে সোনালী বালুর ওপর শুয়ে থাকি মাঝে মাঝে। একা, একেবারে একা। দুই হাত মাথার নিচে দিয়ে তাকিয়ে থাকি সমুদ্রের ফেনার দিকে। সাদা সাদা ফেনার কুচি, ঠিক তোমার হাসির মত। সকালবেলার সচিত্র আলো আমার চোখে-মুখে। গাঙশালিকের কাঁপা ডানার পালকে রোদ্দুরের ঝালর। তোমায় মনে পড়ে। তখন মনে হয়, হয়তো চোখ ফিরিয়েই দেখব তুমি নিঃশব্দে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছ। কিংবা মনে হয় এখুনি তুমি টানবে আমার হাত ধরে। টানতে টানতে নিয়ে যাবে সমুদ্রের দিকে।

স্নান সেরে যখন বাড়ি ফিরি, ছপছপ করে তখন ভিজে শড়ি। চুল দিয়ে বালি ঝরে। ঝাউবনের পথ দিয়ে চলি। মনে হয় তুমিও চলেহ আমার পাশাপাশি। তখন আর আশেপাশে তাকাতে মন চায় না। তাকালেই দেখব তুমি নেই। সে তো চাই নে আমি। তুমি আছ। তুমি আছ আমার পাশে, আকাশের নীলে, হাওয়ায়, সব খানে, আমার মনে। ইচ্ছে হয়, পথ যেন আর না ফুরোয়।

কী করে হয় তা? বাড়ির গেট তো একটু পরেই। তুমিও নেই আমার পাশে। বাড়ি ঢুকে চান-ঘরের শাওয়ারের নিচে এলিয়ে দিই শরীর। তারপর একঘেয়ে দিন। ভাল লাগে না।

সত্যি কথা বিকাশ, বিশ্বাস কর তুমি। সেদিন সন্ধের সময় যখন বৃষ্টির নূপুর বাজল, আমার অসম্ভব মন কেমন করে উঠল ঝাউবনের আবছায়ার দিকে তাকিয়ে। স্পষ্ট যেন তোমার সিগারেটের গন্ধ পেলুম। তোমার গায়ের উত্তাপ আর সকৌতুক চাউনি অনুভব করলাম যেন সর্বাঙ্গে।

জীবনের কোথাও যেন বাঁক নেই, এই কথাটাই সবচেয়ে বেশি মনে হচ্ছে আজকাল। তাই মাঝে মাঝে অসহায় রাগ হয় আমার। ভীষণ। ভাবি, এমন একটা জায়গা কি থাকবে না, যেখানে শুধু আমি, শুধু আমার একলার সত্তা।

শুনলে হয়তো অবাক হবে। হয়তো-বা ঠোঁট চেপে একটু হেসেও নেবে একটা গল্প শুনলে। গল্পটা অবশ্য তোমার ভাবনা আমায় কেমন পেয়ে বসেছে তার একটা উজ্জ্বল নমুনা। কাল দুপুরবেলায় নতুন ধরনের একটা মাছ রান্না করা হয়েছিল শস্‌ দিয়ে। চমৎকার লাগল। খুব ভাল ভাবলাম, রান্নাটা শিখে নিই। তারপর মুহূর্তেই মনে হল, কবে যেন তুমি বলেছিলে, শস্ তোমার খুব বেশি একটা ভাল লাগে না। তবে আর শিখে কী লাভ? কোন উৎসাহ আর আমাকে ধন্য করতে পারল না। শেখা হল না রান্নার কায়দাটা।

খুব মজার গল্প সন্দেহ নেই, কিন্তু ভেবে দেখ তো কী করুণ অবস্থা আমার। নিজের যেটা ভাল লাগে তা-ও আমার কাছে নগণ্য, যদি মা তোমার মনের মত সেটা হয়।

এবার থেকে তোমার সব কথা মেনে নোব না, এমনি একটা সঙ্কল্প গ্রহণ করলে মন্দ হয় না। যা দেখছি, কোনদিন তোমারও হয়তো একঘেয়ে লাগবে এমন অনুগত সীতাকে পেয়ে। ঝগড়া করা তো দুজনেই বোধ হয় ভুলে গিয়েছি। এখন মনে হয়, লোকে কী করে ঝগড়া করে বাজে সময় নষ্ট করে।’

চোখের কালো মণি নীল কাগজটা থেকে উঠে এসে পড়ল জানলায়। একটানা অল্পক্ষণ বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকার পরে দৃষ্টিটা আবার ফিরে এল ঘরের ভিতরে। দেয়ালে আর ঘড়িতে। সরোজের ফটোতে। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই মুখ, সেই ভয়াবহ মুখটা ফুটে উঠল সীতার চোখের সামনে।

তাড়াতাড়ি টেবিলের দেরাজ বন্ধ করল সীতা। দৃষ্টিকে নামিয়ে আনতে চাইলে সরাজের ফটোটা থেকে। কিন্তু পারল না! চুম্বনের মত তাকে আকর্ষণ করল একটি মুখ, ভয়াবহ মুখ।

পরক্ষণেই সরোজ তার স্টাডি থেকে শুনতে পেল চিৎকারটা, যে চিৎকারটা আজকাল নিয়মিত হয়ে উঠেছে: ওই যে! ওই যে!

ছুটে এসে ঘরে ঢুকল সরোজ। তেতলার ঘরটায়। আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে সীতা। মেঝের ওপর।

সন্ধে সাতটার সময়ে ডক্টর রায় আসবেন। এক মিনিট এদিক-ওদিক হবার উপায় নেই। ভারি কড়া লোক! তিনি একাই রোগীর সঙ্গে কথা বলবেন, ঘরে আর কেউ থাকবে না। মানসিক চিকিৎসার ধারাই নাকি এই রকম—ডক্টর রায় আগেই জানিয়েছেন।

সীতার বিছানার পাশে সরোজ বসেছিল। সীতার জ্ঞান হয়েছে বটে কিন্তু চোখ বুজে শুয়ে আছে সে। সাতটা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। চাকর এসে খবর দিলে ফোন এসেছে। পা টিপে টিপে সন্তর্পণে সরোজ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

সীতা বিছানায় পাশ ফিরল। মাথার মধ্যে কী রকম একটা অস্বস্তি হচ্ছে। ঠিক যন্ত্রণা নয়, কিন্তু যন্ত্রণার চেয়েও যেন খারাপ। দেখল ঘরে কেউ নেই। সরোজ বোধ হয় কোন কাজে বাইরে গেছে। টেবিলের ওপরের ফুলদানির রজনীগন্ধা এখন গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে। পর্দার ফাঁকে এক ঝলক হাওয়া এসে ফুলের গন্ধ সারা ঘরে ছড়িয়ে দিল। দেয়ালের ঘড়িতে সাতটা বাজতে তেরো মিনিট বাকি। নিশ্বাস ফেলতে অসুবিধে হচ্ছে সীতার। রুমালটা নিয়ে ও ঘামে ভেজা কপালের ওপর বুলিয়ে নিল। রুমালে ল্যাভেণ্ডারের ভিজে ঠাণ্ডা গন্ধ। বোতাম টিপে সীতার কথামত ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়েছিল সরোজ। চোখে আলো এসে বড় লাগে। ঝোলানো বারান্দার ক্ষীণ আলো এসে পড়েছে পর্দার ফাঁক দিয়ে। সন্ধের অন্ধকারে অস্পষ্টের মত ঘরের সমস্ত জিনিস।

একটা গভীর নিশ্বেস ফেলে সীতা পাশ ফিরে শুলো। সন্ধের অন্ধকারে মাথার কাছে বিছানার ধারে সন্তর্পণ পায়ে যেন কে এসে দাঁড়াল। চোখ বুজেই সীতা শুধোল, কে?

নরম গলায় উত্তর এল, ব্যস্ত হবেন না। যেমন শুয়ে আছেন, থাকুন। আচ্ছা, আপনার অসুখের সব কথা আমার কাছে খুলে বলুন তো—কিছু বাদ দেবেন না।

ওঃ, ডক্টর রায়? বসুন।

থাক, থাক,—যেমন চোখ বুজে শুয়ে আছেন থাকুন।

মাথার ভিতরে খুব অস্বস্তি হচ্ছে সীতার। আর সহ্য হয় না।

আচ্ছা, শুনুন তাহলে। সব কথাই বলছি। প্রায় চার পাঁচ মাস হল এ ব্যাপারের শুরু হয়েছে। একদিন গীতবিতানের সঙ্গীত সম্মেলন থেকে ফিরছি, রাত প্রায় আটটা। সারকুলার রোড় আর চৌরঙ্গীর মোড়ের কাছে আমার গাড়ি দাঁড়াল লাল আলোর জন্যে। হঠাৎ দেখি গ্যাসপোস্টের তলায় একটা লোক আমার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে আছে। এত খারাপ লাগল, ভীষণ! রোগা লম্বা চেহারা। একদিকে চোখ ঝুলে নেমে এসেছে। কপালের ওপর এলোমেলো চুল। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোয়ালটা যেন আলগা, যেন অন্য কারও। মুখটা হাঁ হয়ে গেছে, জিভও একটু বেরিয়ে পড়েছে।

আপনি তো বেশ ভাল করেই লক্ষ্য করেছিলেন?

হ্যাঁ। নিস্তেজ গলায় বলতে থাকে সীতা: আর তাছাড়া একবার তো শুধু দেখিনি, তারপর অনেকবার। এত ভয় করছিল তখন! লোকটা আমার দিকে বিশ্রী উঁচু-নিচু দাঁত বের করে হেসেছিল। ময়লা ছেঁড়া স্যুট গায়ে ঝলমল করে আলগা হয়ে ঝুলছিল। ভয়ে শরীর আমার যেন কাঁটা দিয়ে উঠল। ড্রাইভারকে তাড়াতাড়ি গাড়ি চালিয়ে যেতে বললাম। কিন্তু সেই বিশ্রী ভয়ানক মুখ আমার স্বপ্ন-জাগরণ ছেয়ে থাকল। কখনও লোকটাকে দেখিনি, বারবার মনে হতে লাগল একে যেন চিনি। কী রকম বিশ্রী ভিজে ভিজে ফ্যাকাশে মুখ।

তারপর?

একটু দম নিল সীতা। কপালে তার ঘামের বিন্দু-বিন্দু। বোজা চোখের দু-পাশে গালের রগ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—নীল রুগ। একটা হাত বালিশের তলায় গুঁজে সীতা বলতে থাকল, তারপর যখনই বাড়ি থেকে বেরোই, মনে হয় লোটা বোধ হয় আমার জন্যে কোথাও দাঁড়িয়ে আছে। নিউ মার্কেট থেকে কিছু জিনিসপত্র কিনে হয়তো গাড়িতে উঠতে যাব, এমন সময় হয়তো চোখে পড়ল, সেই লোকটা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আমার দিকে মিটমিট করে তাকাচ্ছে, কিংবা কখনও অপলক স্থির চোখে। আমি হয়তো তখন তাড়াতাড়ি গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিলাম। তারপর থেকে মনে একটা দারুণ ভয় হল। অনেক দিন অনেক পথের মোড়ে দেখতে পেলাম এই লোকটাকে। একদিনের কথা বলছি। এক বান্ধবীর বাড়ি গিয়েছিলাম। সন্ধের পর বান্ধবীটি আমাকে বাড়ির কাছে নামিয়ে দিয়ে গেল। নির্জন শব্দহীন পথ। শুধু মাঝে মাঝে গ্যাসের আলো। হঠাৎ মনে হল, যদি সেই লোকটার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে শিরশিরিয়ে উঠল সারা গা। ভয়ে ভয়ে পিছন ফিরে দেখি পাঁচ সাত হাত দূরে লোকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসছে। ভয়ে যেন হাত-পা ঠাণ্ডা বরফ হয়ে গেল। প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ির দিকে এগোলাম। পিছনে একটানা খুঁড়িয়ে চলার শব্দ। বাড়ির গেট পার হয়ে ছুটতে ছুটতে হলঘরে এসে অজ্ঞান হয়ে পড়লাম।

সীতা একটু চুপ করে থাকল। উত্তেজনায় আর ভয়ে মুখ যেন ছাইয়ের মত ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ঘরে কোনও শব্দ নেই। নিচে সিঁড়ির পাশে সরোজের গলা শোনা যাচ্ছে। টেলিফোনে কথা বলছে। হাওয়ায় ঘরের পর্দা সামান্য দুলছে। ফুলের গন্ধে ঘরের হাওয়া ভারী হয়ে উঠেছে।

অনেকদিন—সীতা বলতে থাকল, আমার স্বামীকে কিছু বলিনি। নানা কাজে উনি ব্যস্ত, আমিও তাই। কিন্তু একদিন বললাম। উনি হেসেই উড়িয়ে দিলেন। বললেন, বয়েস হবার আগেই ভিমরতি হল? জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা শুরু করলে নাকি? বাড়ির গেটের কাছে এরকম কোন লোককে তো দরোয়ান দেখেনি। তুমি বরং দিন কতক বাড়িতে বিশ্রাম নাও! কিন্তু ডক্টর রায়, তারপর থেকেই আমি অসুস্থ বোধ করতে লাগলাম।

ধীর, স্পষ্ট গলায় উচ্চারিত হল, আচ্ছা, বলে যান—

তারপর রাস্তায় একদিন অ্যাকসিডেন্ট। একটি ছোট মেয়ে বাসের তলায় বীভৎসভাবে চাপা পড়েছে। লোকেরা ড্রাইভারকে ধরে মারতেই ব্যস্ত। ভিড়ের মধ্যে দেখি সেই লোকটা। ছোট মেয়েটার রক্তমাখা শরীরের দিকে লোলুপ চোখে তাকিয়ে আছে—চোখে-মুখে একটা কুৎসিত উল্লাস। ড্রাইভার মেয়েটিকে আমার গাড়িতে তুলে আনল হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্যে। দেখতে পেলাম লোকটা ভিড়ের ভেতর থেকে আঙুল তুলে আমাকে যেন শাসাচ্ছে। সেই রাত্রে, ডক্টর রায়, কী বিশ্রী যে স্বপ্ন দেখলাম! দেখলাম, আমি যেন হাসপাতালে অপারেশান টেবিলে শুয়ে আছি। ক্লোরোফর্ম দিতে কে যেন আমার মাথার কাছে এসে দাঁড়াল—তাকিয়ে দেখি সেই লোক। চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। তারপর থেকেই অসুখের খুব বাড়াবাড়ি। প্রায় সব সময়েই মনে হয় যেন সেই মুখ দেখা দেবে। রাত্রে ঘুম হয় না। হার্ট ভয়ানক দুর্বল হয়ে গেছে। আর সইতে পারি নে। ডক্টর রায়—সীতার উত্তেজিত গলা কথা কয়ে উঠল, ডক্টর রায়, হয় আমাকে সারিয়ে ফেলুন, নয়তো দ্রুত যেন আমার মৃত্যু হয়। এইভাবে আর পারি নে।

গভীর নিশ্বাস ফেলে সীতা তেমনি চোখ বুজে শুয়ে থাকল। সুন্দর ফরসা কপাল ঘামে ভিজে উঠেছে শ্রান্ত মুখ বড় করুণ। ঘর অন্ধকার। প্রায় কিছুই দেখা যায় না। শুধু ভোলা জানলার পর্দার ফাঁকে সামান্য একটু আলো বিছানার ওপর এসে পড়েছে।

আচ্ছ, সেই লোকটাকে আপনার বাড়িতে কখনও দেখেননি, না?

না, তাহলে মরেই যেতুম।

মুখটা কি খুব বিশ্রী?

ভীষণ! সে ভাষায় বোঝান যায় না!

দেখুন তো, এই কম কি?

একটা মুখ বিছানার ওপর ঝুঁকে পড়ল। চোখ খুলেই চিৎকার করে উঠল সীতা।

তীব্র ভয়ের সেই চিৎকার একবার যে শুনেছে, সে কখনো ভুলতে পারবে না।

সীতা! সীতা!—সরোজ টেলিফোন রেখে দ্রুত পায়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে উপরে ছুটে এল।

বিছানায় সীতার নিশ্চল স্পন্দনহীন দেহ। ঘরে কেউ নেই।

সীতার নিস্পন্দ বুকে স্পন্দনের ধ্বনি অনুভব করবার জন্যে সরোজ কান পাতল। কিন্তু কোনদিন যে ওই বুকে আর স্পন্দন শোনা যাবে না, এই কথা যখন সরোজ বুঝতে পারল, তখন তার বিস্ফারিত চোখের মণি অকস্মাৎ অদ্ভুত হয়ে উঠেছে।

নিচের হলঘরের ঘড়িতে সাতটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই ডক্টর বিকাশ রায়ের মোটরের হর্ন শোনা গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *