মুখ এবং মুখোশ

মুখ এবং মুখোশ

সাদা চাদরটা টান মেরে সরিয়ে নেওয়া হল অরবিন্দের দেহ থেকে।

সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল গুঞ্জনের। কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল মুখটাও। অস্ফুটে শুধু একবার বলতে পারল, ‘স্যর, আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। অভিযুক্তের মুখে এমন কথা খুশিতে ভরিয়ে তুলল পুলিশ কর্তাদের মুখ। গত পনের দিন ধরে স্রেফ যার আত্মবিশ্বাস এবং চতুরতার কাছে বার বার ধোঁকা খাচ্ছিলেন দুঁদে গোয়েন্দারা, এবার তাঁরা বুঝে গেলেন, জটিল এই মামলার সমাধান এখন শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। আর হবে নাই বা কেন? ভবানী ভবনে টানা দশদিন ধরে পুলিশের শিল্পীকে দিয়ে কৌশলে স্কেচ আঁকিয়ে নিয়েছে রোগাসোগা চেহারার একটা ছেলে, গুঞ্জন ঘোষ। কার স্কেচ? যার দেহ কি না বেওয়ারিশ হিসেবে শোয়ানো রয়েছে লাশকাটা ঘরে।

বিকেল হলেই এডিজি আর কে মোহান্তির ঘরে চলে আসতেন সিআইডির আঁকিয়ে। গুঞ্জনকে সামনে বসিয়ে শুরু করতেন তাঁর কাজ। কথোপকথন চলত দু’জনের মধ্যে:

“দেখ তো মুখটা এরকম কিনা?

—না স্যর, মুখটা গোল নয়। একটু লম্বা মতো। “আচ্ছা, এবার?

—এবারও হয়নি। চুলটা মাথা থেকে একটু নেমে এসেছে।

‘তাই করে দিচ্ছি। গোঁফটা ঠিক আছে?’

—একটু সরু মতো হবে। দাড়ি নেই কিন্তু।

রোজ সন্ধ্যায় আঁকার পর্ব শেষ হলে পুলিশ কর্তারা সাংবাদিকদের হাতে। সেই স্কেচ তুলে দিতেন। যাতে পর দিন কাগজে তা ছাপা হয় তদন্তকারীরা আশায় আশায় থাকতেন, হয়ত একদিন ওই ছবির ভিত্তিতে মিললেও মিলিতে পারে অরবিন্দকে!

এক একটি খুনের মামলার কখনও এমন সময় আসে, যখন দুঁদে পুলিশ কর্মীরা পর্যন্ত নাজেহাল হয়ে যান। তদন্তের একটা পর্বের পর থেকে তাঁদের মধ্যে হতাশার অনুপ্রবেশ ঘটে। দিন যত কাটছিল, অরবিন্দ নামের অভিযুক্তকে না পেয়ে ধৈর্য্য কমে আসছিল তদন্তকারীদের। এতদিন ফুরফুরে থাকা গুঞ্জনের এই আচমকা বদলে যাওয়া, একটা আলোর দিশা নতুন করে দেখাল যেন। সল্টলেকের রোমা ঝাওয়ার অপহরণ মামলা। ২০০৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি।

সকাল সোয়া আটটা। নিজেদের ইন্ডিকা চেপে কলেজের দিকে রওনা দিয়েছিল সল্টলেকের ডিএ ব্লকের বাসিন্দা রোমা। বয়স ১৮/২০—র মধ্যে। পাশে বসে বান্ধবী শর্বরী। গাড়ির স্টিয়ারিং চালক সুকুমার মণ্ডলের হাতে। বাড়ির সামনে আইল্যান্ডটা এক চক্কর ঘুরতেই ক্রিম কালারের ইন্ডিকার সামনে মূর্তিমান দৈত্যর মতো রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে গেল একটা মারুতি ভ্যান। চোখের পলক ফেলার আগে সেই ভ্যান থেকে নেমে এল চারজন যুবক। পথচারিরা কিছু বুঝে ওঠার আগে তড়িঘড়ি দরজার লক খুলে টেনে আনা হল রোমাকে। চিৎকার করার কোনও সুযোগ পেল না সে। বরং তাঁর গালে সজোরে একটা থাপ্পড় মেরে প্রায় ছুড়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হল মারুতি ভ্যানের ভিতর। নিজের গাড়িতে পড়ে রইল একপাটি জুতো, কলেজের ব্যাগ। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেল গাড়িতে বসে থাকা বান্ধবী শর্বরী। তাঁর দিকে ফিরেও তাকাল না অপহরণকারীরা।

সকালবেলার ওই সময়টায় সল্টলেকে অটো, বাস, অন্য গাড়ির দাপাদাপি। কে কাকে টেক্কা মেরে আগে বেরিয়ে যাবে তারই অঘোষিত প্রতিযোগিতা। অফিস টাইম বলে কথা।

সবাইকে ডানপাশ—বাঁপাশ করে কাটিয়ে ঘন্টায় একশ কিলোমিটারের বেশি গতি তুলে মারুতি ভ্যান ছুটে চলল সল্টলেক ছেড়ে। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে তুলে দেওয়া হল জানলার কাচ। যাতে ভিতরে কোনও রকম চিৎকার হলেও সেই আওয়াজ বাইরে আসতে না পারে। গাড়ির মধ্যে বসে থাকা বছর কুড়ির যুবক মুন্না রোমার পরনের জিন্সের পকেট থেকে বার করে নিল মোবাইল ফোনটা। পিছনে বসে থাকা দু’জন ঘাড়ের কাছে ধরে রোমার মাথাটাও নামিয়ে রাখল সিটের নিচের দিকে। জোর করে খুলে নেওয়া হল রোমার সোনার হার, কানের দুল সহ আরও বেশ কিছু অলঙ্কার। অল্প সময়ে গাড়ি পেরিয়ে গেল সল্টলেকের সীমানা। আধঘণ্টার মধ্যে শহরের কোণায় কোণায় রটে গেল এই খবর। রোমার দাদা রাজেশ ঝাওয়ার বিধাননগর উত্তর থানায় তাঁর বোনের অপহরণের বিষয়টি জানিয়ে পুলিশের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করলেন।

সালটা যেহেতু ২০০৪, সিসিটিভি নামের তৃতীয় নয়ন অতটা অপরিহার্য হয়নি পুলিশের কাজে। বলা ভালো, তখনও পর্যন্ত পুলিশের কাজকর্ম ছিল অনেকটাই সোর্স নির্ভর। রাজ্যের পুলিশি সিস্টেমে প্রযুক্তি তখনও আক্ষরিক অর্থেই নবাগত। কাজেই অতটা রাস্তা পেরিয়ে এলেও কোনও সিসিটিভি ফুটেজে পাওয়া গেল না গাড়ির ছবি। তাহলে? একেবারে শুরুর তদন্তে প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান হয়ে উঠল পুলিশের ভরসা। তাঁদের কথাতেই আন্দাজ পাওয়া গেল, গাড়ি বাঁক নিয়েছে সায়েন্স সিটি থেকে ডানদিকে পার্ক সাকাসের দিকে। এরপর কোনদিকে, তা আর কারও জানা নেই। জানাও প্রায় অসম্ভব। হাজার হাজার গাড়ির ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া একটা মারুতি ভ্যান খুঁজে পাওয়া চাট্টিখানি বিষয় নাকি?

ওই বাজারে ২৪ ঘণ্টার নিউজ চ্যানেল বলতে কিছুই তখন চালু হয়নি। ফলে ক্যামেরা নিয়ে পুলিশের নজরদারি ভ্যান তাড়া করার হুজুগ নেই সংবাদ মাধ্যমের। কিন্তু শহরের মধ্যে দিয়ে একটা মারুতি ভ্যান আচমকা কোথায় গায়েব হয়ে গেল, সেটার হদিশ পেতে কালঘাম ছুটে গেল পুলিশের। সোর্সরা তখন কার্যত বোবা, তারাও যেন স্থবির হয়ে গিয়েছে। অপহরণকারীরা আধঘণ্টা কেটে গেলেও একবারও রোমার বাড়িতে ফোন না করায় মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের প্রযুক্তিও কাজে লাগানো গেল না সঙ্গে সঙ্গে। ধৈর্য্য এবং একমাত্র ধৈর্য্যই তখন পুলিশ কর্তাদের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

এরপর শুরু অপেক্ষার!

কখন যে অপহৃতের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে দুষ্কৃতীরা? সময় কেটে যায়, সেই ফোন আর আসার নাম নেই। তাহলে কেন অপহরণ করা হল রোমাকে? পুরোটাই কি আইওয়াশ? দু’জনের মধ্যে কোনও সম্পর্ক কি রয়েছে? শুরু হল এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পর্ব। এই ধরণের তদন্তে সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী, অপহৃতের বাড়ির ল্যান্ডলাইন এবং পরিচিতদের মোবাইল ফোনগুলিতে শুরু হয় পুলিশের নজরদারির কাজ। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হল না। ওঁৎ পেতে থাকার পর প্রথম ফোনটা এল অপহরণের প্রায় আধঘণ্টা বাদে। তাতে স্পষ্ট বলা হল, টাকার জন্য রোমাকে অপহরণ করা হয়েছে। আর কোনও উদ্দেশ্য নেই। কাজেই বাড়ির লোকেরা যেন পরবর্তী ফোনের অপেক্ষায় থাকেন।

বিকেল পাঁচটা বেজে ৩৭ মিনিট।

ফোন এল আবারও। কথাও শুরু হল এভাবে: ২০ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দিতে হবে। কোথায়, কীভাবে, তা ঠিক সময়ে আমরা জানিয়ে দেব। ফোন করলে তা ধরবেন। তবে বেশি চালাকি করে পুলিশে খবর দেবেন না। তাহলে মুশকিলে পড়তে হবে।’

দ্বিতীয় ফোনটাও বেশ খানিক্ষণ অপেক্ষার পর, রাত আটটা দশ মিনিটে। একই কায়দায়, ল্যান্ডলাইনে। ধরলেন রোমার দাদা রাজেশ ঝাওয়ার। বলা হল, “টাকা রেডি করতে থাকুন। আমরা পরবর্তী ফোনে জানিয়ে দিচ্ছি।’ ফের তৃতীয় ফোন। রাত এগারোটা ২৮ মিনিটে। টাকা রেডি তো? পুলিশকে জানিয়েছেন?’ এবার বাড়ি থেকে পাল্টা উত্তর গেল, একটু যদি কমানো যায় তাহলে সুবিধা হত। আসলে এত টাকার বিষয় তো!’ ওপ্রান্ত থেকে হুমকির সুর, ‘এসব চলবে না। আমাদের এক জবান। টাকা দিলে ছেড়ে দেব। না হলে বুঝতেই পারছেন। ভদ্রতা দেখিয়ে রোমার আপাতত কোনও অসুবিধে আমরা করিনি। কথাও বলতে পারেন।’

ফোনে ভেসে এল রোমার গলা। অপহৃত হওয়ার পর প্রথমবারের জন্য। তাতে এটা মালুম হল, সে ঠিকঠাক আছে ‘ভাইয়াদের’ সঙ্গে।

সমস্ত কর্মকাণ্ডের আড়ালে ঘাপটি মেরে পুলিশ অফিসারেরা আড়ি পেতে বসেছিলেন ছিপ ফেলে রাখার মতো। এবার তাঁরা বুঝতে পারলেন সোদপুর এলাকার একটি এসটিডি বুথ থেকে ফোনগুলি করা হচ্ছে। অর্থাৎ দুষ্কৃতীদের অবস্থান সম্পর্কে প্রায় ন’ঘণ্টা বাদে নিশ্চিত হওয়া গেল অনেকটা। কন্ট্রোলরুমে শুরু হল জোরদার তৎপরতা।

রাত ১২টা তিন মিনিট। চতুর্থবারের জন্য রোমার দাদার মোবাইল ফের একবার বেজে উঠল। তবে এবার নতুন একটি নম্বর থেকে। সেই প্রথম নির্দেশ এল কীভাবে পৌছে দিতে হবে মুক্তিপণের টাকা।

কী বলা হল ফোনে? আপনাদের পক্ষ থেকে যিনি টাকা নিয়ে যাবেন তাঁর নম্বর বলুন, আমরা সেখানে যোগাযোগ করে নেব।

দেওয়া হল রোমার তুতো দাদা সন্দীপের মোবাইল নম্বর। টাকা পৌঁছে দেওয়ার ভার ঘাড়ে নিলেন তিনি। ওই ফোনের আধঘণ্টা পর বাড়ি থেকে রওনা দেওয়ার আগে গাড়িতে তুলে নেওয়া হল একটা ব্রাউন কালারের ব্রিফকেস এবং দুটি কার্টুন।

রাত একটা। সারা কলকাতা তখন দিনের যাবতীয় ক্লান্তি কাটাতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তবে সবাই হয়ত নয়। হাতে গোণা কিছু নিশাচর তখনও জেগে শহরময়। এবং বিশেষ একটি বাড়ির সদস্যরাও দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি। কারণ, তাঁদের বাড়ির মেয়ে সেই যে সাত সকালে বেরিয়েছে, তখনও ফেরেনি। অন্যদিকে, আরও একদল চরম উত্তেজনা এবং ব্যস্ততার মধ্যে, যাঁরা প্রতি সেকেন্ডে ঘুম ভুলে কান পেতে রেখেছেন কয়েকটি মেশিনে। যা অনবরত রেকর্ড করে চলেছে বিশেষ কিছু কথোপকথন। আর মোবাইলে পরবর্তী নির্দেশ আসার পর সন্দীপের গাড়ি ততক্ষণে ঝড়ের গতিতে ছুটে চলেছে ফুলবাগান বাটার কাছে। মাঝপথে আরও একবার আওয়াজ করল মুঠোফোন।’

‘শুনুন, সোজা চলে আসুন এনআরএস হাসপাতালের এমারজেন্সি গেটের কাছে। তারপর বলছি।’

সেই নির্দেশ পালন করতে হাসপাতালের গেট দিয়ে দ্রুতবেগে সবে ঢুকছে গাড়ি। কিন্তু এবার?

রিং হল সন্দীপের মোবাইলে।

‘আপনি বরং সোজা চলে যান সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনের কাছে। ওখানে আমাদের লোক অপেক্ষা করছে।’

“ঠিক আছে।’ বললেন সন্দীপ। তখন তাঁর আর কী বলার থাকতে পারে? বুঝে গেলেন আজ চরকি পাক লেখা কপালে।

এসএন ব্যানার্জি রোড ধরে ধর্মতলার দিকে ডানদিকে টার্ন নিতে রাস্তা ফাঁকা দেখে গাড়ির এস্কেলেটরে চাপ দিয়েছিলেন তিনি। আরও একবার বেজে উঠল ড্যাশবোর্ডে রাখা কালো ছোট্ট মোবাইলটা।

‘হ্যালো। সঙ্গে কেউ নেই তো? পুলিশকে কিছু জানালে সমস্যায় পড়ে যাবেন। যা বলছি, মন দিয়ে শুনুন। আপনি গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা চলে যান নিমতলা ঘাটের কাছে ভূতনাথ মন্দিরের সামনে। তারপর নিজের গাড়িটা ছেড়ে দেবেন। দেখবেন, সাইড করে একটা হলুদ ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে রয়েছে। টাকার ব্যাগ নিয়ে কোনওদিকে না তাকিয়ে সেই গাড়িতে গিয়ে বসে যাবেন চুপচাপ। কোনও প্রশ্ন করার প্রয়োজন নেই।’

সেই মুহূর্তে নির্দেশ পালন করা ছাড়া আর অন্য কোনও উপায় ছিল না সন্দীপের। মনে মনে বিরক্ত হলেন বটে। যে রাস্তায় ঢুকে পড়েছেন সেখান থেকে ইউটার্ন করা অসম্ভব। ফলে গাড়ির গতি আরও বাড়িয়ে দিতে হল। তবে কপাল ভালো, শীতের রাস্তায় লোকজন, গাড়িঘোড়া কম থাকায় তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলেন নির্দিষ্ট জায়গায়। এবং কী আশ্চর্য, তিনি ট্যাক্সিতে ওঠা মাত্র চালক মুখে কিছু না বলে রওনা দিলেন রোবটের মতো। সন্দীপের দামি গাড়িটি পড়ে রইল রাস্তার ধারে। প্রায় বেওয়ারিশ ভাবে।

আগাগোড়া তাঁর মোবাইলটি খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছিল অপহরণকারীরা। গাড়ি চলতে শুরু করা মাত্র বাজল ফোন, ‘ট্যাক্সিতে উঠেছেন তো? সোজা চলে আসুন কলকাতা মেডিকেল কলেজের গেটের সামনে।’

তাই সই। অতএব যাত্রা শুরু। গন্তব্য আর খুব বেশি দূর নয়। ঠিক তখন, ওপার থেকে আবার এল নতুন হুকুম, ‘পৌঁছে গিয়েছেন? যদি না পৌছন, তাহলে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যান কাঁকুরগাছির রোজ রেস্টুরেন্টের সামনে।’

সেগুলো শুনে পিছন সিট থেকে পর পর ধারাবিবরণী দিয়ে যাচ্ছিলেন সন্দীপ। আর চালক মুখে কোনও কথা না বলে নির্দেশ পালন করে চলছিলেন।

এবার গাড়ি ঘুরিয়ে যেতে হল সেদিকে। তাতেও অবশ্য নিস্তার নেই। আধঘণ্টা পর নতুন নম্বর থেকে নতুন গলা, ‘কোথায়, রেস্টুরেন্টের সামনে আছেন?’

এপার থেকে উত্তর গেল, ‘হ্যাঁ, ওখানে।’

শেষ পর্যন্ত, দীর্ঘ সময় ধরে শহরটাকে প্রায় এক পাক দেওয়ার পর, চূড়ান্ত ভাবে জানিয়ে দেওয়া হল, ‘ট্যাক্সিটাকে রাইট টার্ন করে সামনের গলিতে মধুবন রেস্টুরেন্টের কাছে যান। এই কলটি ছোট নয়, বরং আরও বেশি কিছু নির্দেশ দিতে চায়।

‘গাড়ি থেকে নেমে আপনি টাকার ব্যাগ নিয়ে রাস্তার উল্টোদিকের ফাঁকা ফুটপাতে গিয়ে গাছের গোড়ায় রেখে দিন। কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করে সোজা গাড়িতে আবার উঠে পড়বেন। ড্রাইভার নামিয়ে দেবে। বাকিটা আমরা বুঝে নেব। রোমাকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফেরত পেয়ে যাবেন।’

শীতের ভোরে একটা ব্যস্ত দিন শুরুর আগে কলকাতা তখন সবে আড়মোড়া ভাঙছে। ঠাণ্ডাটা অন্যবারের তুলনায় যেন একটু বেশি। আর কুয়াশা মোড়া শহরে তখন চলছিল এসব কাণ্ডকারখানা।

পুলিশ কর্তারা হিসেব কষে দেখতে পেলেন, অপহরণ হওয়ার দিন বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে পরদিন ভোর পৌনে চারটা পর্যন্ত মোট ১৭ বার কথা হল দু’পক্ষের মধ্যে।

সোজা বাংলায় বলতে গেলে, অপহরণকারীরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এতক্ষণ ধরে পুরো বিষয়টি কার্যত নিয়ন্ত্রণ করছিল। আর অন্য প্রান্তে তাদের একটা সামান্য খুঁত ধরার জন্য ওঁৎ পেতে ছিলেন দুঁদে পুলিশ কর্তারা। এই চোর পুলিশ খেলায় কারা শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে তা নির্ধারণ করা যাচ্ছিল না, ১২ ঘণ্টার বেশি সময় কেটে যাওয়ার পরও।

কাজ শেষ করে সন্দীপ সল্টলেকে নিজের বাড়িতে ফিরে এলেন। মুখে চোখে একটু জল দিয়ে একগ্লাস গরম চা খেয়ে খানিকক্ষণ পর ফের এক ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন শহরে। এবার সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা গোণার পালা শুরু ঝাওয়ার পরিবারে।

শীতকালের সকাল। ঝকঝকে হতে খানিকটা আলসেপনা করে। কাঁপুনিটা বেশি শুরু হয় ভোর থেকে। স্বাভাবিক নিয়মে এই সময় একটু ঝিমুনি আসে।

কিন্তু একটা ঘটনা সল্টলেকের ব্যবসায়ী পরিবারে সবার চোখ থেকে ঘুম শব্দটা বেমক্কা উধাও করে দিয়েছে। বাড়ি ভর্তি সবার নজর শান্ত হয়ে থাকা একটা নিথর বস্তুর দিকে। সেটা ফোন। কখন যে তার ঘুম ভাঙবে কে জানে! হয়ত, ওখানেই আসতে পারে পরবর্তী নির্দেশ। তা অবশ্য এল, ঠিক সাড়ে পাঁচটার সময়। তবে ল্যান্ড লাইন নয়, বেশ জোরে আওয়াজ দিয়ে নিজেকে জানান দিল সন্দীপের মোবাইল।

চমক আরও বাকি ছিল। কারণ, সেই ফোনে রুক্ষ গলার আওয়াজ নয়, বরং ভেসে এল রোমার ক্লান্ত কণ্ঠস্বর—‘আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমি ফুলবাগান মোড়ের কাছে অপেক্ষা করছি।’ গাড়ি নিয়ে সন্দীপ ততক্ষণে বাড়ি থেকে শহরের রাস্তায়। ফুলবাগান বাটা অনেকটা কাছাকাছি। ওখানে এসে দেখা গেল রোমা দু’জন পুলিশ কর্মীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে। খানিকটা যেন বিধ্বস্ত। রাতজাগা চোখমুখ।

কথা না বাড়িয়ে তাঁকে সোজা নিয়ে যাওয়া হল সল্টলেকে নিজেদের বাড়িতে।

সাত সকালে একটা নতুন দিন শুরু হতে না হতে, শহর জেনে গেল ঘরে ফিরে এসেছেন রোমা ঝাওয়ার। বিষয়টা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু হল না। আর যদি হত, তাহলে লেখার পরবর্তী ধাপের কোনও প্রয়োজন ছিল না। অপরাধ বিজ্ঞান বলে, অপরাধী যত সেয়ানা হোক না কেন, নিজের অজান্তে এমন কিছু ক্লু ছেড়ে যায়, যা তাকে চুম্বকের মতো টেনে নেয় শ্রীঘরের দিকে।

‘রোমা ঝাওয়ার অপহরণ কাণ্ডে গ্রেপ্তার মূল অভিযুক্ত গুঞ্জন ঘোষ’ ঘটনার একদিন পর ছোট—বড় সব সংবাদপত্রে মোটামুটি এই শিরোনামে যে খবর সামনে এল, তাতে মোদ্দা বিষয় ঘুরে ফিরে এক।

সবার নজর ঘুরে গেল গুঞ্জনের দিকে। কে এই নব্য অপরাধী? যার নাম কস্মিনকালেও শোনা যায়নি। কার্যকারণে নিজের নামেই শহরময় গুঞ্জন তৈরি করল এক যুবক। চমকে গেলেন পোড়খাওয়া পুলিশ কর্তারাও। তাহলে এত হেভিওয়েটের ভিড়ে গোকুলে বাড়ছিল এই ‘স্যাম্পেল’!

খবরে জানা গেল, গুঞ্জন ঘোষ নামে স্মার্ট ছেলেটি থাকে বাগুইআটিতে।

বিভিন্ন স্কুলে পুল কারের ব্যবসায় যুক্ত। ঠোঁটে সব সময় হাসি লেগে। মুখ দেখে একটা আদ্যন্ত ভালো ছেলে ছাড়া কিছু মনে হতে পারে না। বছর তিরিশের কাছাকাছি বয়স। বিবাহিত। স্ত্রীর নাম রুমেলা। অপূর্ব সুন্দরী। গুঞ্জনের বাবা বিশ্বজিৎ ঘোষ। মা কৃষ্ণা মিত্র। কয়েক বছর ধরে মা—বাবার মধ্যে সমস্যা থাকায়, সে বিয়ের পর মায়ের কাছে স্ত্রীকে নিয়ে থাকে। সফল অপারেশন শেষ করে দুপুরবেলা স্ত্রীর সঙ্গে বসে সিনেমা দেখার সময় পুলিশ তাকে তুলে নিয়ে আসে।

দীর্ঘদিন বাদে শহরে সাড়া জাগানো এমন একটা অপরাধে পর পর ধরপাকড়ের ঘটনা যখন শুরু হয়েছে, তার আগেই তদন্তের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে সিআইডি। পুরো বিষয়টি দেখাশোনার ভার খোদ ডিআইজি, সিআইডি(অপারেশনস)—এর উপর।

নিয়ম মেনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্তদের হাজির করার পাশাপাশি আদালতে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হল, গুঞ্জনের কাছ থেকে মুক্তিপণ বাবদ নেওয়া প্রায় আট লক্ষ টাকা উদ্ধার করা গিয়েছে। এই ঘটনায়, আদায় করা টাকার মোটা অংশ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে অন্য অভিযুক্তদের ভাড়া করেছিল সে। যদিও প্রায় সকলেই তার আগে নানা ছোটখাট অপরাধে হাত পাকিয়েছে। মুক্তিপণের যে টাকার বান্ডিল ধৃতদের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল দেখা গেল, তাতে রোমার বাড়ির লোকেদের সই রয়েছে। অর্থাৎ তাঁরাও মুক্তিপণ দেওয়ার প্রমাণ রাখতে চেয়েছেন। যা আদালতে জমা দেওয়া হল প্রামান্য নথি হিসেবে।

স্বাভাবিক নিয়মে, প্রথম দফায় পুলিশ হেফাজতে যেতে হল অভিযুক্তদের। তবে জেরা শুরুর প্রথম কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তদন্তকারীরা বুঝে গেলেন, গুঞ্জন অন্য পাঁচটা অপরাধীর মতো নয়, বেশ ধুরন্ধর। কথার প্যাঁচপয়জার ভালোই জানে।

একটানা প্রশ্নের মুখে আগাগোড়া মাথা ঠাণ্ডা রেখে বার বার তদন্তকারীদের বিভ্রান্ত করাও শুরু করল। প্রথম থেকে অনড় রইল একটা যুক্তিতে, সে শুধুমাত্র ভাড়া করা সৈন্য। এই অপহরণ কাণ্ডের মূল চক্রী আদতে ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা অরবিন্দ প্রসাদ নামে বছর তিরিশের এক যুবক। মাস্টারমাইন্ড অরবিন্দ এই অপারেশনের জন্য স্রেফ গাড়ি ভাড়া করেছিল গুঞ্জনের কাছ থেকে। এপর্যন্তই। কাজ শেষ হতেই পাওনাগন্ডা বুঝে নিয়ে, নিজের হকের টাকা পকেটস্থ করে ওই অরবিন্দ নাকি কেটে পড়েছে অজানা কোথাও। শুরু হল অরবিন্দের খোঁজে তল্লাশি। এখান থেকেই অভিমুখ ঘুরে গেল মূল তদন্তের। বাকি অভিযুক্তরা ধরা পড়লেও প্রত্যেকেই তাল মেলালো গুঞ্জনের সঙ্গে।

এবার ঘটনাটার শুরুর দিকে একটু যাওয়া যাক।

রোমাকে সল্টলেক থেকে তুলে নিয়ে সে দিন গুঞ্জনরা সোজা চলে যায় সোদপুরের একটি কলোনি এলাকায়। আগে থেকে ঠিক করে রাখা একটি বাড়িতে তোলা হয়েছিল তাঁকে। দুপুরে খাবারও দেওয়া হয়। টিভিতে সিনেমা দেখেন রোমা। পর্যায়ক্রমে দু’জনকে তাঁর নজরদারির জন্য রাখা হয়েছিল। অন্যদিকে, স্থানীয় একটি টেলিফোন বুথ থেকে কয়েকবার ফোন করার পর গুঞ্জনরা তাদের স্ট্রাটেজি পাল্টে ফেলে। এবারে একেকবার একটি করে সিম কিনে তা থেকে ফোন করা শুরু হয়। ওই চক্রের কয়েকজনের মোবাইল এবং গুঞ্জনের নিজের সেট ব্যবহার করে যোগাযোগ রাখা হতে থাকে রোমার বাড়িতে। আর ফোন করার পর সেই সিম খুলে নেওয়া হয় সেট থেকে। প্রতিবারই নতুন কোনও সেটে নতুন সিম ভরে পরবর্তী ফোন করার এই অদ্ভুত পদ্ধতিতে ‘চকমা’ খেয়ে যায় পুলিশও। একটি নম্বর ট্র্যাক করতে না করতেই পরের ফোন আসা শুরু করে নতুন নম্বর থেকে। একটা সময় মাঝপথে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছিলেন তদন্তকারীরা। ওই সব মোবাইলের টাওয়ার কিছুতেই লোকেট করা যাচ্ছিল না। এ দিকে রোমার মোবাইলটি কেড়ে নেওয়ার পর তা সুইচ অফ করে দেওয়া হয়েছিল সাত সকালেই। ফলে প্রযুক্তিও তালগোল পাকিয়ে ফেলছিল আসল সময়।

তাহলে কি আর কিছুই হল না? হল, এবং যা হল তা একটা তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। একাধিক বার ফোন করা এবং কাজ মসৃণ ভাবে এগোতে থাকায় অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এই সময় ভর করল গুঞ্জনদের উপর। শীতের দিন। ফলে শিকারকে সঙ্গে নিয়ে বেশিক্ষণ যে ঘোরা যাবেনা তা বুঝে গিয়েছিল অপহরণকারীরা। অত্যধিক তাড়াহুড়োয় এবার বড়সড় ভুল হয়ে যায় তাদের চালে। হাতের সামনে থাকা রোমার মোবাইলটা নিয়ে অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অন করে দেয় গুঞ্জন। সিম খুলে ফেলে দিয়ে তাতে ঢোকানো হয় নতুন সিম। এবার সেটা থেকে সোজা ফোন করা হয় সন্দীপের মোবাইলে। ঠিক এই ধরনের একটা ভুলের অপেক্ষায় ছিলেন তদন্তকারীরা। যেহেতু রোমার ফোনের আইইএমআই নম্বর তারা আগে জোগাড় করে রেখেছিলেন, ফলে অবস্থান জানার কাজটা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে গেল এবার। এখানেই শেষ নয়, গুঞ্জনরা আরও একটা ভুল করল। সেটার ফল হল মারাত্মক। রোমার ফোনটি অন অবস্থাতেই সঙ্গে রেখে দিল নিজেদের গাড়িতে। ফলে পর পর দুটি ক্রটি তাদের সহজেই পুলিশের রেডারে এনে দিল। ফোনের টাওয়ার চিহ্নিত করে দেওয়া শুরু করল তাদের সঠিক অবস্থান।

এদিকে, বেশি রাতে ঝাওয়ার পরিবার থেকে পাওয়া টাকার হিসসাটা ভাগ করে নেওয়া হল দ্রুত, তারপর একটি ট্যাক্সি করে রোমাকে ছেড়ে দেওয়া হল ফুলবাগানে। ভাড়া করা মারুতি ভ্যান আর ট্যাক্সি ফেরত চলে এল কাঁকুরগাছির গ্যারাজে। সফল অপারেশন সেরে নিজেদের গন্তব্যে চলেও গেল যে যার মতো। আসল কাজ শুরু হল রাতজাগা তদন্তকারীদের।

পরের দিন, ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা পর প্রথমেই জালে তোলা হয় গুঞ্জনকে। তারপর একে একে অন্যরা। শুরুর দিকে প্রায় সবাই নির্লিপ্তভাবে জানাল, গুঞ্জনের সঙ্গে রোমার সম্পর্ক রয়েছে। ফলে রোমার ইচ্ছে এবং গুঞ্জনের পরিকল্পনায় ওই অপহরণের নাটকে অভিনয় করতে হয়েছিল তাদের। ধৃতেরা বয়ান দিল, সল্টলেক থেকে তুলে নেওয়ার পর গাড়ি করে দু’জন দক্ষিণেশ্বর এবং বেলুড় মঠেও বেড়াতে যায় সেদিন। একসঙ্গে লুডােও খেলে। খানিকটা ঘোরাঘুরির পর ভোরবেলা রোমাকে নামিয়ে দেওয়া হয় ফুলবাগানে। তাহলে টাকা? গুঞ্জনের জবাব ছিল, ‘ব্যবসার কাজে সাহায্য করার জন্য টাকাটা নেওয়া হয়েছিল। পরে ফেরত দেওয়া হবে এই শর্তে।’

সেই যুক্তি অবশ্য ধোপে টিকল না। কিন্তু অরবিন্দকে খুঁজে পাওয়াটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল সেই মুহূর্তে। অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানোর চেয়ে সহজ পদ্ধতি বার করতে সিআইডি অফিসারেরা ডেকে পাঠালেন তাদের শিল্পীকে। যিনি গুঞ্জনের বয়ানের উপর ভিত্তি করে মুখের ছবি ফুটিয়ে তুলতে পারেন পলাতক অরবিন্দের।

পুলিশের তদন্তে যদিও এটা নতুন কোনও বিষয় নয়। বহু ক্ষেত্রে অপরাধীদের ছবি এভাবে স্কেচ করিয়ে তারপর তাদের খোঁজ করে সাফল্যও মিলেছে দেশে বিদেশে।

টানা দশদিন ধরে চলল স্কেচ আঁকানোর কাজ। রোজ বিকেলে লকআপ থেকে বেরিয়ে এসে গুঞ্জন বুঝিয়ে চলত, শিল্পী এঁকে যেতেন মুখের নানা ভঙ্গির ছবি। আঁকা শেষ হলে গম্ভীর মুখ করে সে দেখত, তারপর খুঁত ধরত নানা রকম। কোনও দিন মুখটা একটু গোল মতো, আবার কোনওদিন গালের কাছে কাটা দাগের নতুন তথ্যে রোজ বিভ্রান্ত হতেন তদন্তকারীরা।

এভাবে কাটতে লাগল এক একটা দিন। অন্যদিকে ফুরিয়ে আসার সময় হয়ে এল গুঞ্জনের পুলিশ হেফাজতের মেয়াদও। কিন্তু মূল অপরাধীকে ধরতে না পারার তাড়া যেন কুরে খাচ্ছিল তদন্তকারীদের। অরবিন্দের সন্ধানে দিনরাত এক করে খড়ের গাঁদায় সূচ খোঁজার কাজ শুরু করলেন তাঁরা। স্কেচ ছড়িয়ে দেওয়া হল কলকাতা, জেলা এমনকী আশেপাশের রাজ্যগুলিতেও। খবরের কাগজের পাতায় ছাপা হল সেই স্কেচ। কাজের কাজ অবশ্য কিছুই হল না তাতে।

ফুলবাগান এলাকা কলকাতা পুলিশের ডিসি(ইএসডি)—র মধ্যে পড়ে। দক্ষ অফিসার হিসেবে সুনাম রয়েছে ডিসির। এই মামলার তদন্তে আদৌ কোনও ভাবে যুক্ত না থাকলেও সিআইডিকে প্রথম একটা আলোর রেখা দেখালেন তিনিই। একদিন দুপুরে বেলেঘাটা মেন রোডে নিজের দপ্তরে বসে কাজ করছিলেন। আর্দালি এসে খবর দিল, ‘স্যর, কাল্লু বলে একজন আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।’

‘হ্যাঁ, ওকে ভিতরে পাঠিয়ে দাও।’ বললেন ডিসি।

মনে মনে ভাবলেন, কাল্লু কেন হঠাৎ এই সময়ে? তবে কি সে রকম ভাইটাল কোনও তথ্য আছে ছেলেটার কাছে? এটাও তো ঠিক, সোর্স হিসেবে একদম পাক্কা। দুরন্ত সব ইনপুট এনে থালায় যেন সাজিয়ে দেয়। তাই তাকে বাড়তি খাতিরও করেন দুঁদে আইপিএস কর্তা।

কাল্লু ঘরে ঢুকে প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘স্যর। একটা খবর পেলাম, তাই ছুটে এলাম আপনার কাছে। একটা মার্ডার হয়েছে স্যর। কেউ জানে না।’

ওর চোখ পাকিয়ে বলার ধরন দেখে ডিসি পাল্টা জানতে চাইলেন, ‘কে আবার মার্ডার হল? সোজাসুজি বল। অত ঘুরিয়ে বললে চলবে না।’

‘স্যর,আমি ফুলবাগানের একটা গ্যারাজে গাড়ি ধোওয়ার কাজ করি সেটা তো আপনি জানেন। তো, আজ সকালে একটা মারুতি ভ্যান ধুতে গিয়ে দেখলাম ভিতরে আবছা রক্তের দাগ। আমার ভয় লেগে গেল। তাই বাবুদার(মানে, গ্যারেজ মালিক) কাছে জানতে চাওয়ায় বলল গাড়িটায় একটা মেয়েকে তোলার জন্য ভাড়া নিয়েছিল কয়েকজন। তারপর রাতের দিকে গাড়ির মধ্যে কাউকে গুলি চালিয়ে মার্ডার করে বডি বাইপাসের ধারে কোথাও ফেলে দিয়েছে। আপনি দেখুন স্যর। পেমেন্ট নাকি ভালো দিয়েছে, তাই বাবুদা কেসটা চাপলিশে সাল্টাতে চাইছে।’ ততক্ষণে উত্তেজনায় যেন হাঁপাচ্ছে কাল্লু। ঠাণ্ডা মাথায় ডিসি বললেন, ‘যা বলেছিস, তা আমি না বলা পর্যন্ত, আর কাউকে কিছু জানাবি না। চেপে যা।’ ‘মায়ের দিব্বি স্যর। আর কাউকে বলব না। ঘর থেকে চুপচাপ বেরিয়ে গেল সে।’

বেলেঘাটা মেন রোডের ডিসি অফিস থেকে ভবানী ভবনের দূরত্ব মেরেকেটে দশ কিলোমিটার। তবে ওই পথটা উজিয়ে না গিয়ে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ফোনটা গেল ডিআইজি(সিআইডি) অপারেশনসের ঘরে। অসম্ভব ভাইটাল একটা সূত্রের হদিশ পেয়ে তৎপরতা শুরু হল বাইপাস লাগোয়া শহরতলির থানাগুলিতে। ওই এলাকা তখনও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা পুলিশের অধীনে।

দশদিনে ঘটে যাওয়া আন—ন্যাচরাল ডেথ অর্থাৎ অস্বাভাবিক মৃত্যুর সব খতিয়ান চেয়ে থানায় থানায় পাঠানো হল রাজ্য গোয়েন্দা দপ্তরের নির্দেশিকা। নিয়ম অনুযায়ী, যে সব দেহ বেওয়ারিশ হিসেবে পাওয়া যায় তাদের অন্তত সাতদিনের হিসেব রাখার জন্য একটা খেরোখাতা ব্যবহার হয় পুলিশ মহলে। এই খোঁজখবর করতে গিয়ে জানা গেল একটা চাপা পড়ে থাকা তথ্য। পরমা আইল্যান্ড থেকে সায়েন্স সিটি পেরিয়ে কলকাতা বোটিং ক্লাবের একটু আগে ৫ তারিখ এক অজ্ঞাত পরিচয় যুবকের দেহ পাওয়া গিয়েছিল রক্তাক্ত অবস্থায়। প্রাথমিক রিপোর্ট যদিও বলছে, সম্ভবত গাড়ির নীচে চাপা পড়া ওই যুবকের মৃত্যুর প্রধান কারণ। তাই ময়নাতদন্তের রিপোর্ট নিয়ে তেমন মাথা ঘামাননি অফিসারেরা। তবে মালিকানাহীন মৃতদেহটি সেই থেকে রাখা কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লাশকাটা ঘরে। আর ঝুঁকি নিলেন না তদন্তকারী অফিসারেরা। হেফাজতে থাকা গুঞ্জনকে নিয়ে ভবাণী ভবন থেকে দ্রুত রওনা দিলেন মেডিকেলের পথে।

শুরুতে যে দৃশ্যের কথা বলেছি, এবার ঠিক তাই হল। সাদা চাদরে মোড়া মৃতদেহটি দেখে কেঁপে উঠল গুঞ্জন। বোঝা গেল ওটি আসলে অরবিন্দের দেহ।

কিন্তু সত্যি কি গুঞ্জন জানত অরবিন্দ মারা গিয়েছে? সন্দেহ দূর করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে চিকিৎসকদের পরামর্শ নিলেন পুলিশ কর্তারা। নতুন একটি বিষয় উঠে এল তাতে। জানা গেল, আদৌ পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়নি অরবিন্দের। কানের ঠিক নিচের অংশে একটা গভীর ক্ষতের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। ওখানে ততদিনে একদলা শুকনো রক্ত জমাট বেঁধেছে। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা রায় দিলেন, ডান দিক দিয়ে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে কানের পাশে গুলি করে খুন করা হয়েছে তাকে। খুব মন দিয়ে নজর না করলে যা বোঝা সম্ভব নয়।

তাহলে কে খুন করল অরবিন্দকে? ভবানী ভবনে মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে পুলিশি কায়দায় জেরা শুরু হল গুঞ্জনের। প্রথম দিকে নার্ভ ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও বেশিক্ষণ তা স্থায়ী হল না। শেষ পর্যন্ত আসল ঘটনা বেরিয়ে এল প্রবল চাপের মুখে। উপায় না দেখে প্রায় তোতাপাখির মত কথা বলা শুরু করল সে।

‘স্যর। আমি ঘটনার রাতে চলন্ত গাড়িতে গুলি করে মেরেছি অরবিন্দকে। বাকিরা সবাই ওখানে ছিল। সত্যি কথা বলতে, ওকে মারার কোনও প্ল্যান ছিল না। গাড়ির ব্যবসার সূত্রে আমার সঙ্গে পরিচয়। কাজটা ঠিকমতো হওয়ায় প্রত্যেকেই বেশ ভালো টাকার ভাগ পেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু এত ফুর্তির মধ্যেও টাকার পিশাচ অরবিন্দ একাই পঞ্চাশ শতাংশ দাবি করছিল। ওর নাকি সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম হয়েছে। তবুও বলেছিলাম, পরে আরও কিছু দিয়ে দেব। শালার তর সইছিল না। তারপর আবার হুমকি দেওয়া শুরু করে, পুলিশকে সব জানিয়ে দেবে। আর সহ্য হয় বলুন? মটকাটা গরম হয়ে গেল।’

সিআইডির এক ইন্সপেক্টর বললেন, ‘এসব তোর যুক্তি। আমাদের জানার আগ্রহ নেই। জলদি পরের ধাপটা বল।’ জেরায় জেরায় জেরবার গুঞ্জনের মুখটা ততক্ষণে অনেকটা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে বলে চলল নিজের কীর্তির কথা। বুঝে গিয়েছিলাম অরবিন্দ ঝামেলাটা বাড়াবে তাই ওকে পাল্টা একটা টোপ দিলাম। বললাম, ‘চল, সবাই মিলে গাড়িটা নিয়ে একটু নিশ্চিন্তে শহরটাকে চক্কর মেরে আসি। আজ শহরে আমরাই রাজা। গাড়ি চালাচ্ছিলাম আমি। অরবিন্দ সামনে বসল। তারপর আবার শুরু করল সেই টাকার কথা। বোঝালেও না বুঝে এক নাগাড়ে তর্ক করছিল। কোনও ঝামেলা হতে পারে ভেবে সকাল থেকেই কোমরে একটা পিস্তল গুঁজে রেখেছিলাম। বাইপাস ধরে চায়না টাউন যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সারাদিনের টেনশন শেষে আর ক্যাচাল ভালো লাগছিল না। একটা সময় পিস্তল বার করে বাঁ হাতে ওর কানের পাশে গুলি চালিয়ে দিলাম। এক গুলিতে শেষ। মরে যাওয়ার পর ভয় ধরে গেল। তাই বডিটা ভিতরে রেখে গাড়ি সাইড করে খানিকক্ষণ ভাবনাচিন্তা করলাম। শেষ পর্যন্ত ভোরের দিকে বাইপাসে রাস্তার উপর বডি শুইয়ে দিয়ে তিনবার উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিয়েছিলাম। যাতে সবাই দেখে ভাবে রাতে কোনও গাড়ি চাপা দিয়ে চলে গিয়েছে। ওদিকটায় এরকম অ্যাক্সিডেন্ট অনেক হয়। সেটা কাজেও লেগে গিয়েছিল।’

সিআইডি অফিসাররা সামনে বসে থ হয়ে গিয়েছেন। ছেলেটা বলে কী? আঁধো অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে টেবিলে রাখা জলের গ্লাসটা এক ঢোঁকে শেষ করে দেয় গুঞ্জন। আবার একটু লম্বা দম নিয়ে বলা শুরু করে, আজ যেন খই ফুটছে তার মুখে, ‘বহু ব্যাঙ্কের কাছে চেয়েছিলাম, লোন দিচ্ছিল না। তাই এই টাকাটা দিয়ে নিজের ব্যবসাটা আরও বড় করার কথা ভেবেছিলাম। বাকিদের সঙ্গে কথা বলে দেখুন স্যর, কে কত টাকা নেবে, সব সন্ধ্যার মধ্যে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। অরবিন্দ তখন কিছু বলেনি। পরে সমস্যা তৈরি করে।’

গুঞ্জনের কথা বলা বন্ধ হতেই অফিসারদের চোখেমুখে যেন যুদ্ধ জয়ের আনন্দ। ধৃত বাকি পাঁচজনকে জেরা করে পুরো ঘটনার একটা নাট্য রূপান্তর বানিয়ে নিতেও তদন্তকারীদের বেশি সময় লাগল না। ছানবিন করে দেখা গেল, অরবিন্দ নয়, ঘটনার আসল মাস্টার মাইন্ড আসলে গুঞ্জন নিজে। অন্য সঙ্গীদের টাকার লোভ দেখিয়ে সে কাছে টেনে নেয়। কাজ শেষে নিজে টাকার ভাগ নিয়েছিল সবচেয়ে বেশি। ২০ লক্ষের মধ্যে একাই ৯ লক্ষ টাকা।

রাত তখন সাড়ে তিনটে। ভবানী ভবনের লকআপে গুঞ্জনকে নিয়ে যাওয়ার সময় এক তদন্তকারী অফিসার তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, একটা প্রবাদ তো তোর জানার কথা। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। শূন্যে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনও উত্তর ছিল না ‘স্মার্ট’ গুঞ্জনের মুখে।

এতটা পড়ে নেওয়ার পর এটাই স্বাভাবিক প্রশ্ন যে, সারাদিন ধরে রোমাকে তাহলে কোথায় রাখা হয়েছিল? ঘটনা ঘটে যাওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ বাদে কলকাতার একটি ইংরেজি কাগজকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন রোমা। তিনি যা বলেছিলেন তার নির্যাস: ফুলবাগান থেকে গাড়িতে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যে গুঞ্জন একটি ছেলের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, এমবিবিএস এবার সিরিঞ্জটা বার কর। আমি ইঞ্জেকশনটা দিয়ে দিই। আমি ‘ভাইয়া’ বলে সম্বােধন করে বলি, সূচ ফোটাতে আমার প্রচণ্ড ভয় লাগে। সম্ভবত ওরা ব্যাপারটা বুঝতে পারে তাই আমাকে আর তা দেওয়া হয়নি। গাড়িটা চলতে চলতে সম্ভবত পার্ক সার্কাসের কাছে এসে একটু থামিয়ে আমাকে দই খেতে দেওয়া হয়। ওটা খাওয়ার পর ঘুম ঘুম পেতে থাকে। ফলে বাকি রাস্তার অনেকটা বুঝতে পারিনি। প্রায় দু’ঘণ্টা গাড়ি চলার পর গ্রামের মতো জায়গায় সরু গলি দিয়ে আমাকে রীতিমত চ্যাংদোলা করে একটি ইটের গাঁথনি দেওয়া ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ভিতরে একটি বাচ্চা ছেলে এবং তার মা বসে ছিল। তবে এরমধ্যে গুঞ্জন বার দুয়েক এটা বলে যে তোমার ভাই পুলিশকে খবর দিয়ে খুব ভুল কাজ করেছে। ততক্ষণে বুঝে গিয়েছিলাম, অপহরণের বিষয়টা হয়ত জানাজানি হয়ে গিয়েছে। ঘরে থাকা ভদ্রমহিলাকে বললাম, ‘টিভিটা একটু চালিয়ে দেবেন?’ উনি জানালেন, কেবল কানেকশন নেই। তবে তুমি কি সিনেমা দেখতে চাও? ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাতেই আমাকে অবাক করে দিয়ে একটা ডিভিডি প্লেয়ারে ‘শোলে’ সিনেমাটা চালিয়ে দিলেন। খানিকক্ষণ পর ঘরে থাকা বাচ্চাটি আমার সামনে এসে প্রশ্ন করল, ‘আমার সঙ্গে লুডাে খেলবে?’ তখনই মনে হল, ওই পরিবারটির সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠতা এরা পছন্দ করছে না।

আমাকে দুই যুবক টানা নজরে রাখছিল। ঘরটা একটু ফাঁকা হতে একজন ফিসফিসিয়ে বলে গেল, ‘আমরা তোমাকে অপহরণ করে এনেছি এটা এরা জানে না। সুতরাং স্বাভাবিক আচরণ করে যাবে।’ খানিক বাদে খিদের কথা বলাতে আমাকে এক প্যাকেট ম্যাগিও বানিয়ে দেওয়া হল। ওটা খাওয়ার পর একটা চটের ঘেরা মত জায়গায় আমি বাথরুমে যাই। আর তখন মনে পড়ল কথাটা। আরে, পকেটে ঠিক আগের দিন এক বান্ধবীর দেওয়া মোবাইলটা রয়ে গিয়েছে। সেটা বার করে ওই বান্ধবীকে ফিসফিস করে ফোনে বললাম আমার সঠিক লোকেশনটা একবার দেখবি কোথায় দেখাচ্ছে? এসব করতে গিয়ে দেরি হয়ে যাচ্ছিল। ফলে হুড়মুড়িয়ে চোখেমুখে জল দিয়ে বেরিয়ে এলাম। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ অন্য একটি গাড়িতে আমাকে ফের তোলা হল। গাড়ি চলতে শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যে গুঞ্জন আমার কাছে ৩০০ টাকা চাইল। ওই টাকা দিয়ে কেনা নতুন সিমের মাধ্যমেই কথা বলতে পারলাম বাবার সঙ্গে। গাড়িতে বসে কানে এল মুক্তিপণ নিয়ে দরাদরি চলছে। কোথা দিয়ে কোথায় চলেছি কিছুই বোঝার উপায় ছিল না। একটু রাতের দিকে ওই গাড়ি থেকে নামিয়ে একটি ট্যাক্সিতে তুলে দেওয়া হল আমাকে। গাড়িটা ঢুকে পড়ল ফুলবাগান এলাকার একটা গ্যারাজের ভিতর। সেখানে গুঞ্জন জানাল সে টাকা আদায় করতে যাচ্ছে। ঠিক ভাবে কাজ শেষ হলে বাড়ি যেতে দেওয়া হবে। তারপর দীর্ঘ প্রতীক্ষা। প্রায় তিন ঘণ্টা বাদে ফিরে এসে টাকার ভাগাভাগি চলল আরও কিছুক্ষণ। ভোরের দিকে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হল ফুলবাগান বাটার কাছে। সেখানেই দেখা পেলাম ভাইয়ের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *