মুখোস
পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই যে মুখে মুখোস পরিয়া ছদ্মবেশে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, এই গূঢ় তত্ত্বটির প্রতি সাধারণের সতর্ক মনোযোগ আকর্ষণ করা প্রয়োজন। আমি আপাতত মাত্র চারিটি চরিত্র নমুনাস্বরূপ সর্বসমক্ষে হাজির করিতেছি, আশা করিতেছি এই চারিটি ভাত টিপিলেই হাঁড়ির খবর আর কাহারও অবিদিত থাকিবে না।
অর্ধশতাব্দীকাল পৃথিবীতে বাস করা সত্ত্বেও নরেশবাবু শরীরটিকে দিব্য তাজা রাখিয়াছিলেন, চুলও যাহা পাকিয়াছিল তাহা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। তাঁহার সৌম্য সুদর্শন চেহারাখানি দেখিলে তাঁহাকে একটি পরম শুদ্ধাচারী ঋষি বলিয়া মনে হইত। অবশ্য গোঁফ-দাড়ির হাঙ্গামা ছিল না, তিনি প্রত্যহ সযত্নে ক্ষৌরকার্য করিতেন; সুচিক্কণ মুণ্ডিত মুখমণ্ডলে একটি স্নিগ্ধ সাত্ত্বিক হাসি সর্বদাই ক্রীড়া করিত। চোখের চাহনিতে এমন একটি স্বপ্নাতুর সুদূর-দুর্লভ আবেশ লাগিয়া থাকিত যে, মনে হইত তাঁহার প্রাণপুরুষ পৃথিবীর ধূলামাটি হইতে বহু উর্ধ্বে ত্রিগুণাতীত তুরীয়ানন্দে বিভোর হইয়া আছে। মোট কথা, তাঁহাকে দেখিলে মানুষের মনে স্বতঃই তাঁহার প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্ভ্রমের উদয় হইত।
নরেশবাবু বিবাহ করেন নাই। সারা জীবন বিদেশে থাকিয়া তিনি ব্যবসাদি দ্বারা ধনোপার্জন করিয়াছেন; এখন বোধ করি ‘পঞ্চাশোর্ধ্বে বনং ব্ৰজেৎ’ এই নীতিবাক্য স্মরণ করিয়া ব্যবসা-বাণিজ্য গুটাইয়া দেশে ফিরিয়াছেন, কলিকাতায় একটি বাসা ভাড়া লইয়া বাস করিতেছেন। নিরুদ্বেগ শান্তিতে জীবনের বাকি দিনগুলি উপভোগ করিবেন ইহাই ইচ্ছা।
বিদেশ হইতে নরেশবাবু একটি অনুচর সঙ্গে আনিয়াছেন, তাহার নাম বাঘাবৎ সিং সংক্ষেপে বাঘা সিং। নামটি যে বিন্দুমাত্র অত্যুক্তি নয় তাহা তাহার চেহারা দেখিলেই বুঝা যায়। বসন্তের গুটিচিহ্ন আঁকা হাঁড়ির মতো একটা মুখ, তাহার মধ্যে ছোট ছোট ধৃষ্টতাভরা চক্ষু দুটি সর্বদা ঘুরিতেছে, যেন একটা ছুতা পাইলেই টুঁটি কামড়াইয়া ধরিবে। দেহখানা আড়ে-দীঘে প্রায় সমান। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা কালো রঙের পাঞ্জাবি পরিয়া ও মাথায় প্রকাণ্ড পাগড়ি চড়াইয়া সে যখন বুক চিতাইয়া পথ দিয়া হাঁটে, তখন সম্মুখের ভদ্র পথিক অপমানের ভয়ে সশঙ্কে পথ ছাড়িয়া দেয়। বাঘা সিং নরেশবাবুর পুরাতন ভৃত্য। সে কোনও কাজ করে না, কেবল বাড়ির সদর দরজার পাশে টুল পাতিয়া বসিয়া থাকে; তাহার অনুমতি না লইয়া তাহাকে ডিঙাইয়া বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে এমন সাহস কাহারও নাই। সারাদিন টুলের উপর বসিয়া বাঘা সিং পান চিবায়, পানের গাঢ় রস তাহার কশ বাহিয়া গড়াইতে থাকে; যেন সে কাঁচা মাংস চিবাইতেছে।
নরেশবাবুর বাড়িটি ছোট, ছিমছাম, দ্বিতল। পাশেই আর একটি ছোট বাড়ি আছে, সেটি একতলা। পুরানো বাড়ি, উপরে কোমর পর্যন্ত পাঁচিল-ঘেরা ছাদ। এই বাড়িতে যিনি বাস করেন তাঁহার নাম দীননাথ। নিরীহ ভালমানুষ লোক, সামান্য কেরানিগিরি করেন। শীর্ণ কোলকুঁজো ধরনের চেহারা, মোটা চশমার ভিতর দিয়া যেভাবে পৃথিবীর দিকে তাকান তাহাতে মনে হয় তিনি পৃথিবীকে ভয় করিয়া চলেন। পৃথিবী তাঁহার সহিত সদয় ব্যবহার করে নাই, অবজ্ঞাভরে তাঁহাকে চিরদিন পিছনেই ফেলিয়া রাখিয়াছে; তাই তিনিও শামুকের মতো সসঙ্কোচে নিজেকে নিজের মধ্যে গুটাইয়া লইয়াছেন। তাঁহার পরিবারে যে একটি মেয়ে ছাড়া আর কেহ নাই এজন্যও তিনি মনে মনে ভগবানের কাছে কৃতজ্ঞ, কারণ সামান্য মাহিনা সত্ত্বেও তাঁহার ঘরে অনটন নাই। মেয়ের অবশ্য বিবাহ দিতে হইবে কিন্তু সেজন্য দীননাথ চিন্তিত নন; প্রভিডেন্ট ফাণ্ডে যে টাকা জমিয়াছে তাহাতে মেয়ের বিবাহ দেওয়া চলিবে।
মেয়েটির নাম অমলা। বয়স সতেরো বছর; একবার তাহার উপর চোখ পড়িলে আবার ফিরিয়া দেখিতে ইচ্ছা করে। নূতন যৌবনের দুর্নিবার বহির্মুখিতা পাকা ডালিমের মতো তাহার সারা দেহে যেন ফাটিয়া পড়িবার উপক্রম করিতেছে, চোখে মুখে চঞ্চল প্রগল্ভতা। অমলা নিজের রূপ-যৌবন সম্বন্ধে সম্ভবত অচেতন নয়; সে চোখ বাঁকাইয়া তাকায়, মুখ টিপিয়া হাসে, খোলা ছাদে দুপুরবেলা চুল এলো করিয়া চুল শুকায়। রাস্তায় একটু উঁচু শব্দ হইলে সে ছুটিয়া গিয়া আলিসার উপর বুক পর্যন্ত ঝুঁকাইয়া নীচে রাস্তার পানে তাকাইয়া দেখে; তাহার গায়ের কাপড় সব সময় ঠিক থাকে না, অতি তুচ্ছ কারণে অসম্বৃত হইয়া পড়ে।
নরেশবাবু নিজের দ্বিতলের জানালা হইতে অমলাকে দেখিয়াছিলেন এবং মনে মনে একটি মন্তব্য করিয়াছিলেন। মন্তব্যটি ঋষিজনোচিত কি না বলিতে পারি না, কারণ সেকালের মুনিঋষিরা নারীজাতি সম্বন্ধে মনে মনে কিরূপ মন্তব্য করিতেন তাহার কোনও নজির নাই। কিন্তু রবীন্দ্রোত্তর বাংলা ভাষায় উহা একেবারেই অচল। ছলনা’ শব্দটা অসভ্য ইতরজনের মুখে মুখে অপভ্রষ্ট হইয়া বড়ই বিশ্রী আকার ধারণ করিয়াছে।
অমলাও নরেশবাবুকে দেখিয়াছিল। অমলা ছাদে উঠিলেই নরেশবাবু নিজের জানালায় আসিয়া দাঁড়াইতেন; আকাশের পানে এমন মুগ্ধভাবে তাকাইয়া থাকিতেন যেন ঐ দূরবগাহ নীলিমার মধ্যে তাঁহার সাধনার পরম বস্তুকে খুঁজিয়া পাইয়াছেন। মাঝে মাঝে চক্ষু নীচের দিকে নামিত, মুখের হাসিটি আরও মুগ্ধ-মধুর হইয়া উঠিত। অমলার মনে বোধ করি শ্রদ্ধার উদয় হইত; সে সঙ্কুচিতভাবে গায়ের কাপড় সামলাইয়া, চলনভঙ্গিকে অতিশয় মন্থর করিয়া, পিছনে দু’একটি চকিত দৃষ্টি হানিতে হানিতে নীচে নামিয়া যাইত।
দীননাথ এসবের কিছুই খবর রাখিতেন না। অফিস হইতে ফিরিতে তাঁহার সন্ধ্যা হইয়া যাইত; তাড়াতাড়ি একপেয়ালা চা ও কিছু জলখাবার গলাধঃকরণ করিয়া তিনি বাহিরের ঘরের জানালার পাশে তক্তপোশে গিয়া বসিতেন, তাক হইতে একটি পেঙ্গুইন-মার্কা ইংরেজী ডিটেকটিভ উপন্যাস পাড়িয়া লইয়া তক্তপোশের উপর কাত হইয়া শুইয়া পড়িতে আরম্ভ করিতেন। অমলা আসিয়া তাঁহার সহিত কথা বলিলে তিনি নির্বিচারে হুঁ দিয়া যাইতেন, কারণ কথাগুলি তাঁহার এক কান দিয়া প্রবেশ করিয়া সোজা অন্য কান দিয়া বাহির হইয়া যাইত, ক্ষণেকের জন্যও মস্তিষ্কের কাছে গিয়া দাঁড়াইত না।
একদিন অমলা বলিল—‘বাবা, পাশের বাড়িতে নতুন ভাড়াটে এসেছে, তুমি দেখেছ?’
দীননাথ বলিলেন—‘হুঁ।’
অমলা বলিল—‘আমিও দেখেছি—বোধহয় খুব সাধু লোক। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আকাশের পানে চেয়ে থাকেন—’
‘হুঁ।’
‘ঝি বলছিল ওঁর বাড়ির দরজায় একটা দুশমনের মতো লোক বসে থাকে, দেখলেই ভয় করে।’
‘হুঁ হুঁ’ বলিয়া দীননাথ বইয়ের পাতা উল্টাইলেন।
এমনি ভাবে কয়েক হপ্তা কাটিবার পর একদিন সকালবেলা ছাদে কাপড় শুকাইতে দিকে গিয়া অমলা দেখিল, একটি কাগজের মোড়ক ছাদে পড়িয়া রহিয়াছে। তাড়াতাড়ি মোড়ক খুলিয়া দেখিল, ভিতরে একটি রাঙা টক্টকে গোলাপফুল। অমলা চোখ বাঁকাইয়া জানালার দিকে তাকাইল; নরেশবাবু স্নিগ্ধ হাসি-হাসি মুখে আকাশের পানে তাকাইয়া আছেন, তাঁহার গায়ে চাঁপা রঙের একটি সিল্কের কিমোনো সদ্যঃস্নাত তরুণ তাপসের অঙ্গে গৈরিক বসনের মতো শোভা পাইতেছে।
ফুলটিকে অমলা পূজার নির্মাল্য বলিয়া মনে করিল কিনা কে জানে; সে নরেশবাবুর দিকে চোখ তুলিয়া একটু হাসিল, তারপর ফুলের দীর্ঘ আঘ্রাণ গ্রহণ করিয়া সেটি খোঁপায় খুঁজিল। নরেশবাবু একবার চক্ষু নামাইলেন এবং মনে মনে একটি মন্তব্য করিলেন। লোহা গরম হইয়াছে বুঝিয়া তাঁহার মুখের হাসি আরও স্বর্গীয় সুষমাপূর্ণ হইয়া উঠিল।
অফিসে বড়সাহেবের শাশুড়ি মারা গিয়াছিল, এই আনন্দময় উপলক্ষে অর্ধদিনের ছুটি পাইয়া দীননাথ দ্বিপ্রহরেই বাড়ি ফিরিলেন। পথে আসিতে একটি ডাব কিনিয়া লইলেন। অমলা ডাব খাইতে চাহিয়াছিল, অমলা চিনি দিয়া ডাবের কচি শাঁস খাইতে ভালবাসে; ডাবের জলটা দীননাথ পান করেন।
বাড়ি আসিয়া দীননাথ ধড়াচূড়া ছাড়িলেন, তারপর দা লইয়া ডাব কাটিতে বসিলেন। অমলা গেলাস চাম্চে প্রভৃতি লইয়া কাছে বসিল। দু’জনের মুখেই হাসি। অমলা বলিল—‘খুব কচি ডাব, না বাবা?’
দীননাথ ডাবের মাথায় এক কোপ বসাইয়া বলিলেন—‘হুঁ। তুলতুলে শাঁস বেরুবে। আমাকে একটু দিস।’
অমলা বলিল—‘আচ্ছা। তুমিও আমাকে একটু জল দিও।’
এই সময় সদর দরজার কড়া নড়িল। ঝিয়ের এখনও আসিবার সময় হয় নাই, তবু ঝি আসিয়াছে মনে করিয়া অমলা দ্বার খুলিতে গেল।
মিনিটখানেক পরে অমলা ছুটিতে ছুটিতে ফিরিয়া আসিল; তাহার হাতে একটা দশ টাকার নোট ও গোলাপী রঙের একখানা চিঠি। সে কাঁপিতে কাঁপিতে বাপের পাশে বসিয়া পড়িয়া কাঁদিয়া উঠিল, ‘ও বাবা, এসব কী দ্যাখো!’
দীননাথ চিঠি পড়িলেন এবং নোট দেখিলেন; তারপর দা তুলিয়া লইয়া তীরবেগে বাহির হইলেন। বলা বাহুল্য, চিঠিখানি নরেশবাবুর লেখা ও নোটখানিও তাঁহারই—বাঘা সিং লইয়া আসিয়াছিল।
নরেশবাবু দ্বিতলের জানালায় দাঁড়াইয়া দীননাথের সদর দরজা লক্ষ্য করিতেছিলেন। হঠাৎ দেখিলেন, তাঁহার বাঘা সিং উঠিপড়ি করিয়া বাহির হইয়া আসিতেছে, পিছনে দা হস্তে দীননাথবাবু। বাঘা সিং বেশী দূর পলাইতে পারিল না, চৌকাঠে হোঁচট খাইয়া পড়িয়া গেল; দীননাথ ডালকুত্তার মতো তাহার ঘাড়ে লাফাইয়া পড়িলেন।
হৈ হৈ কাণ্ড; লোক জমিয়া গেল। দীননাথ বাঘা সিংয়ের বুকের উপর চাপিয়া বসিয়া এলোপাথাড়ি দা চালাইতেছেন। দুঃখের বিষয় তিনি ক্রোধান্ধ অবস্থায় দাটি উল্টা করিয়া ধরিয়াছিলেন, ধারের দিকটা বাঘা সিংয়ের গায়ে পড়িতেছিল না। সে কিন্তু পরিত্রাহি চিৎকার করিয়া চলিয়াছিল—‘বাপ রে! জান্ গিয়া! পুলিস! মার ডালা!—’
নরেশবাবু পাংশু মুখে জানালা বন্ধ করিয়া দিলেন। কী দুর্দৈব! মেয়েটা তো রাজীই ছিল; কে জানিত মড়া-খেকো বাপ্টা ইতিমধ্যে বাড়ি ফিরিয়াছে এবং তার এত বিক্রম।
ওদিকে অমলা বিছানায় পড়িয়া কাঁদিতেছিল, বালিশে মাথা গুঁজিয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতেছিল। এত নোংরা মানুষের মন! তাহার সতেরো বছরের নিস্পাপ জীবনে এমন জঘন্য ব্যাপার কখনও ঘটে নাই। আজ একি হইল! মানুষের সঙ্গে চোখাচোখি হইলে সে না হাসিয়া থাকিতে পারে না। ইহা কি মন্দ? তবে কেন লোকে তাহার সম্বন্ধে যা-তা ভাবিবে!
২১ শ্রাবণ ১৩৫২