মুখোশ
সেদিন কুলেপাড়া ক্লাব-এর সঙ্গে চন্দ্রভানু শিল্ড ফাইনালের খেলায় আমরা গোহারান হেরে গেলাম। এমনভাবে হারতে হবে তা আমরা কোনদিনই ভাবিনি।
ক্লাবের জামতলার ঘাসে চুপচাপ পড়ে আছে পটলা। সে ক্লাবের গোলকিপার, তিন তিন খানা গোল খেয়ে লটকে পড়েছে।
হোঁৎকা গজরাচ্ছে। ও ব্যাকে খেলে। দারুণ স্টেডি প্লেয়ার। প্রথম দিকেই তাই ওকে যুৎসই মেরে বাইরে পাঠিয়েছিল কুলেপাড়া ক্লাবের এক ভাড়াটে মারকুটে প্লেয়ার।
পটলা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,—খেলার বিভাগই তুলে দেব। এত ব-বড় অপমান সইতে হবে ওই নিতু মিত্তিরের কাছে? এর চেয়ে ডে-ডেথই ভালো।
পটলার ‘ডেথ’ মানে আমাদের পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবেরই ‘ডেথ’। সুতরাং ওটা মেনে নিতে পারি না ।
হোঁৎকা চোট খেয়ে গজরাতে গজরাতে বলে,–এর শোধ লমুই। তুই চুপ কইরা দ্যাখ পটলা, ওই নিতু মিত্তিরের খুব ফাঁট্ হইছে, দুইডা পইসা কামাইয়া—
ফটিক বলে,—নিতু মিত্তিরই এবার এখানের সবাইকে হটাতে চায় টাকার জোরে। ইস্কুলের ভোটেও নাকি দাঁড়াচ্ছে।
—ইস্কুলের ভোটের কথা পরে। এখন নিতু মিত্তির তার ছেলে চিতুকে দিয়ে আমাদের ক্লাব লাটে তুলতে চায়।
পটলার অবস্থা তখন শক্তিশেল খাওয়া লক্ষ্মণের মত। আমরা কোনরকমে ওকে ধরে নিয়ে চলেছি।
ওদিকে তখন ব্যান্ডপার্টি, তাসাপার্টি নিয়ে পেল্লায় শিল্ডটাকে মালা পরিয়ে ঠ্যালাগাড়িতে তুলে নিতু মিত্তির পাড়া প্রদক্ষিণ করছে। সঙ্গে তস্য পুত্র চিতু।
আমাদের দেখে ওদের নাচের বহর বেড়ে গেছে। সিটি বাজিয়ে তুমুল নাচছে ক্যাবলা, মদন, নটবর ও আরও অনেকে। আর নিতু মিত্তির গাড়িতে বসে দেখছে তার অনুচরদের এই বিজয় উৎসব।
কয়েক বছরের মধ্যেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে এই নিতু মিত্তিরের। কলকাতার লাগোয়া অঞ্চল। নিতু মিত্তির বসিরহাট অঞ্চলের লোক। এখানে এসে প্রথম প্রথম আবাদ অঞ্চলের কাঠ, গোলপাতা এসব নিয়ে ব্যবসা করত। দেখতে দেখতে এখন বেশ গুছিয়ে নিয়েছে। বিরাট শেড তুলে, সেখানে নানা মালপত্র রেখে, ট্রাকযোগে আবাদের বিভিন্ন মোকামে সাপ্লাই দেয়।
আগেকার খোলার চালের বাড়ির বদলে এখন নিতু মিত্তিরের তিনমহলা প্রাসাদ। চারিদিকে উঁচু পাঁচিল।
ইদানীং পাড়ার বেশ কিছু ছেলেদেরও সে কাজে লাগায়। বলে, – বেকার সমস্যা দূর করতেই হবে। খাটো, রোজগার করো আর আনন্দ করো।
তারই পক্ষছায়ায় গজিয়ে উঠেছে ওই কুলেপাড়া ক্লাব। দুহাতে সেখানে টাকা খরচা করে চিতু। ফলে সেখানেই ভিড় বাড়ছে ছেলেদের। এতে নিতু মিত্তিরের প্রভাবই শুধু বাড়ছে না, ব্যবসাও চলছে রমরম করে।
পরদিন ক্লাবে আলোচনা হচ্ছে আমাদের মধ্যে নাইট স্কুল চালাবার ব্যাপার নিয়ে। এমন সময় হঠাৎ একটা গাড়ির চড়া হর্ন শুনে চেয়ে দেখি, স্বয়ং নিতু মিত্তির গাড়ি থেকে নেমে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। মুখে একগাল হাসি। সঙ্গে মদনা আর ক্যাবলা। ক্যাবলার এ পাড়ায় অনেক বদনাম। ক্যাবলা দেখছে আমাদের। কারণ ওকে আমরাই সেবার এক ভদ্রলোকের উপর অত্যাচার করার জন্য চাঁদা করে মেরেছিলাম।
নিতু মিত্তির অমায়িক ভদ্রলোকের মত বলে,—সব ভালো আছো তো?
পটলা বলে,—ভালোই ।
নিতু মিত্তির বলে,—সমাজের মঙ্গল করতে চাই। দেশ সেবা। তাই তোমাদেরও সাহায্য আমার দরকার। তোমরা ইয়ং ম্যান। আমি চাই, ভেদাভেদ ভুলে দুনিয়ার ইয়ংম্যান এক হও। আর আমি তোমাদের সেবা করে ধন্য হই ।
ওর চামচেদের দল হাততালি দেয়।
আমরা হতবাক। যেন ভূতের মুখে রাম নাম শুনছি। নিতু মিত্তির বলে,—তাহলে একদিন আমার বাড়িতে এসো তোমরা। এ নিয়ে বিশদ আলোচনা করে কাজে নেমে পড়তে হবে। নিতু মিত্তির সদলে বিদায় নেবার পর বলি,—কিছু বুঝলি মতলবটা !
হোঁৎকা বলে, বুঝছি। ওরেও বুঝাইমু।
সকালের দিকে বহু ছেলেরাই আসে নিতু মিত্তিরের দরবারে। কাজকর্মের সন্ধানে। হোঁৎকা পাড়ার মাতব্বর গোছের। একদিন সকালে তাই প্রতিপক্ষ দলের হোঁৎকাকে নিতু মিত্তির তার কাছে আসতে দেখে, মনে মনে খুশিই হয়। হোঁৎকাকে হাতে আনতে পারলে তার সুবিধাই হবে।
হোঁৎকা বলে,—আপনার কাছেই আইলাম ছার। কাজকাম কিছু নাই। হক্কলেই কয় আপনি দয়ালু সজ্জন।
বিনয়ের সঙ্গে নিতু মিত্তির বলে, – সাধ্যমত সকলেরই উপকার করতে চাই।
চিতুও এসে হাজির হয়েছে সেখানে। হোঁৎকার মত ছেলেকে তার পিতৃদেবের সামনে বশ্যতা স্বীকার করতে দেখে খুশিই হয়। হোঁৎকা কুলেপাড়ার তাবড় ছেলেদের অস্বীকৃত নেতা তাকে হাতে পেলে পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবকে ডকে তুলে দেওয়া যাবে। তাই চিতুও বলে,–বিপদে পড়ে এসেছে হোঁৎকা, ওকে একটু হেল্প করা উচিত বাবা।
হোঁৎকা তার কাতরতার মাত্রা আর এক ডিগ্রি বাড়িয়ে বলে,—একটু দ্যাখেন ছার, তালি পড়াশুনাটা করতি পারি।
নিতু মিত্তির এবার বরাভয় দেবার ভঙ্গিতে বলে,—ঠিক আছে, দেখি যদি কিছু রোজগারের পথ করে দিতে পারি।
গালকাটা ক্যাবলা আশেপাশেই ছিল। প্রভুর ডাকে পোষা বুলডগের মত এসে দাঁড়ায়। ইয়া জুলপি, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, পরনে রঙ-ওঠা নীলচে টাইট জিনস্।
নিতু মিত্তির বলে,—বিকাশ বাবাজি এসেছে। ওর খুব বিপদ। ওকে একটু কাজপত্তর দিতে হবে। শিখিয়ে পড়িয়ে নিবি। খুব ভালো ছেলে বিকাশ বাবাজি।
বিকাশ হোঁৎকার ভালো নাম।
নিতু মিত্তির তারপরই ব্যবসার কাজে ডুবে যায়।
ম্যানেজার বলে,কাল আমাদের গাড়ি আটকেছিল পথে।
চমকে ওঠে নিতু মিত্তির। তার ট্রাকে নানা ধরনের মাল দেওয়া নেওয়া হয় ।
হঠাৎ ক্যাবলাকে ঢুকতে দেখে মুখ তুলে চাইল সে। নিতু মিত্তির জানে ক্যাবলাই তার বিশ্বস্ত অধিনায়ক। ওর গুণের শেষ নেই। আগে ওয়াগান ভেঙে মাল পাচারকারী দলের নেতা ছিল সে।
ক্যাবলা বলে,–আজও কিছু মাল আসবে ।
খুশি হয় নিতু ওর কথায়। বলে,-সাবধানে আনবি। আমিও লাইন কিলিয়ার করে রাখব । আর—ক্যাবলা আরও কিছু বলতে চায়। ওই হোঁৎকাকে নিলেন ?
নিতু মিত্তিরও কথাটা ভেবেছে। বলে,—একটু নজরে রাখবি। ওকে আসল ব্যাপার না জানিয়ে মাঝে মাঝে ট্রাকে মালের সঙ্গে পাহারা দিতে পাঠাবি ।
যদি কিছু জানতে পারে?—ক্যাবলা শুধোয়।
নিতু মিত্তির গভীর জলের মাছ। হোঁৎকাকে দলে আনতে চায়। বলে,— একবার এখানে পা দিলে সহজে বেরুতে পারবে নারে। আর বেগড়বাই করলে, ফাঁদে ফেলে দিবি। যাক পুলিশের খপ্পরে।
হোঁৎকাও নজর রেখেছিল চারিদিকে। ক্যাবলা ও ঘরে ঢুকতে, পা টিপে টিপে এসে দাঁড়িয়েছিল দরজার বাইরে। ওদের কথাগুলো শুনেছে হোঁৎকা
–এ্যাই ! নিতুদা বলেছে কাল একবার বসিরহাটে গিয়ে এক ট্রাক পাট আসবে, নে আসবি। ধর পঞ্চাশ টাকা খোরাকি ।
হোঁৎকা জানে তাকে দু-একটা কাজে পাঠানো হবে। সে-ও তাই চায় । টাকাটা পকেটে পুরে ক্যাবলাকে শুধোয়,—কখন যাওন লাগবে ক্যাবলাদা ?
ক্যাবলার প্রথম থেকেই হোঁৎকাকে ভালো লাগেনি। তবু নিতুদার কথার উপর কা চলে না। তাই ক্যাবলা বলে,—কাল সকালেই ট্রাক যাবে। ওতে গিয়ে রাতে মাল নে গুদামে ফিরবি । এর আগে বসিরহাটে দু-একবার এসেছে হোঁৎকা। এইদিকে পলাদের আদি বাড়ি। কিন্তু এখন ওদের ওখানে যাওয়া যাবে না। হোঁৎকাকে অবশ্য একা পাঠায়নি ক্যাবলা। সঙ্গে দলের মদনাকেও পাঠিয়েছে।
ওরা ট্রাক নিয়ে এসেছে।
নদীর ধারে একটা পোড়ো বাড়ি। পাশে আমবাগান আর বাঁশবনের জটলা।
মদনা বলে,–খেয়ে দেয়ে দুপুরে শুয়ে পড় হোঁৎকা, রাতে মাল বোঝাই হলে বেরুবো। গুদামের চেহারা দেখে একটু ঘাবড়ে গেছে হোঁৎকা !
কয়েকখানা ঘরকে কোনরকমে মেরামত করে ঠেকা দিয়ে রাখা হয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে ছাদটা ভেঙে ঘাড়ে না পড়ে।
হোঁৎকা মনে মনে জায়গাটার একটি ছবি এঁকে নেয়।
একসময় পায়ে পায়ে আগাছার বন পার হয়ে বাড়ির বাইরে আসে। দেখা যায় একজন লোককে। সে এগিয়ে এসে বলে, – বাইরে যাবে না।
অর্থাৎ তার বাইরে যাওয়ারও হুকুম নেই ।
রাত্রি নামতে দেরি হয় না। হোঁৎকা বেশ বুঝতে পারে এদের কর্মব্যস্ততা হঠাৎ বেড়ে ওঠে। অন্ধকারে তারাজ্বলা আলোয় আবছা দেখা যায়। নদীতে দু-একটা নৌকা এসে থেমেছে। ছায়ামূর্তির দল অন্ধকারে কি সব মালপত্র নামাচ্ছে আর ট্রাকে তুলছে।
মদনা সারাদিন কোথায় ছিল কে জানে, এবার তার গলাও শোনা যায়।
হোঁৎকা ব্যাপারটা দেখেছে দোতলার জানলা থেকে। শুনেছে ইছামতী নদীর ওপারেই বাংলাদেশ। এই জায়গাটা সীমান্তের কাছেই। রাতের অন্ধকারে আসা নৌকাগুলোয় নিশ্চয়ই ওদেশ থেকে আনা বেআইনি মালপত্র থাকে।
ট্রাকটা ফিরছে কলকাতার দিকে। ট্রাকে চাপানো আছে পাটের গাঁট। নিশ্চয়ই এই গাঁটের মধ্যে কৌশল করে মূল্যবান বিদেশি জিনিস পাচার করা হচ্ছে।
নিতু মিত্তিরের আসল ব্যবসার খবর পেয়েছে এবার হোঁৎকা। লুকিয়ে সস্তায় বিদেশি জিনিস এনে নিতু মিত্তির তার লাভের পুঁজি বাড়াচ্ছে আর মুখে দেশপ্রেমের বুকনি দিচ্ছে।
নিরাপদে এত মালপত্র এসে পৌঁছতে দেখে খুশি হয়ে নিতু মিত্তির বলে,—তুই তো বেশ পয়মন্ত রে। কাজের ছেলে। নে পঞ্চাশ টাকা রাখ। মিষ্টি খাবি। আর শোন, মন দিয়ে কাজকম্মো কর। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। আমি চাই দেশের ইয়ংম্যানরা সবাই কর্মবীর হোক। তবেই তো দেশের, সমাজের উন্নতি হবে।
ক্যাবলাও দেখেছে নিতু মিত্তির হোঁৎকাকে খাতির করছে। আড়ালে ক্যাবলা বলে,—কত্তা কত দিল রে?
হোঁৎকা টাকাটা বের করে তা থেকে ক্যাবলাকে দশ টাকা দিতে ক্যাবলাও খুশি হয়। বলে, —আবার পাঠাব তোকে। আর শোন, ব্যাটা মদনার দিকেও নজর রাখবি। ও মাল সরায়-টরায় কি না দেখবি।
হোঁৎকা এবার তার মত বলে,— মদনা তো তোমাকেই আউট করতে চায় ক্যাবলাদা।
ক্যাবলা অবশ্য সেটা অনুমান করেছে। এরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। যেন-একপাল হিংস্র কুকুরের দল, এক টুকরো মাংসের জন্য যখন তখন যার তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। নিতু মিত্তিরের মত লোক দেশের যুবশক্তিকে এমনি করে অন্ধকার পথে নামিয়েছে নিজের রোজগারের স্বার্থে। হোঁৎকা সমাজের এই অন্ধকার রূপটাকে দেখে শিউরে উঠেছে। এই নিতু মিত্তিরের মত কসাইদের মুখোশ খুলে দেবে হোঁৎকা। তার জন্যই সে সাবধানে ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে।
ক্লাবের মাঠে আমরা চিৎপাত হয়ে শুয়ে আছি। কেউ কেউ ঘাস চিবুচ্ছে।
পটলা হতাশভাবে বলে,—কা-ক্লাব তুলে দেব! গোবরা বাধা দিয়ে বলে,—হোঁৎকা গেছে যাক। তাই বলে হেরে যাব? নেভার। নতুন কত মেম্বার আসবে।
সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের ক্লাব ঝিমিয়ে পড়েছে। যে কোনদিন ঝাঁপ বন্ধ করে দিতে হবে। সব ছেলেরা এখন নিতুদার নামে অজ্ঞান!
হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে কাকে আসতে দেখে সবাই মিলে একসঙ্গে তাকালাম। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারি না। হোঁৎকা এসেছে।
অবাক হই,–তুই!
পটলা বলে,—আর কেন এলি? ক্যাবলা, নিতু মিত্তির আমাদের ক্লাব তুলে দেবে।
হোঁৎকা বলে,—ছাড়, ছাড়। পঞ্চপাণ্ডব ক্লাব তুলবে নিতু মিত্তির ?
হোঁৎকার কথা শুনে অবাক হই। হোঁৎকা তাহলে আমাদের ছেড়ে যায়নি।
সব শুনে-টুনে গোবরা বলে,—এত বড় শয়তান ঐ নিতু মিত্তির? এ আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি।
পটলা মন্তব্য করে,—ওর প-পরিচয়টা প্রকাশ ক-করতেই হবে ।
হোঁৎকা শোনায়,–ক্যাবলা আর মদনাকে লড়ায়ে দিচ্ছি। ওরা দুজনে ফাইটে লাইগা গেছে। ওদের দিই কাজ হাসিল করুম। তগোর একটু হেল্প করন লাগবে। আর আমি তো আছিই ।
আমাদের সঙ্গে খানিকক্ষণ জল্পনা-টল্পনা করে হোঁৎকা আরো বলে,—তরা ঐ প্ল্যান মত কাজ কর গিয়া, আমারে দেখলেও চিনবি না। আমিও ওগোর কারো সামনে তগোর সাথে কথাই কইমু না। শুধু সিগন্যাল দিমু দু-আঙুল নাড়াইয়া ।
কদিন ছুটি বাকি আছে সামারের, আমরা চারজন চলেছি বসিরহাটে পটলাদের দেশের বাড়িতে। হোঁৎকা সঙ্গে নেই। মনে মনে তার অভাব অনুভব করছি। ও থাকলে খাবার খরচা কিছু হয় সত্যি, কিন্তু সাহস বাড়ে।
পটলাদের বাড়িতে এসে কিছুটা নিশ্চিন্তবোধ করি। বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে বাড়িটা, সাবেককালের দোতলা বাড়ি। পিছনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে সাজানো আম, লিচু, কাঁঠাল, নারকেল বাগান ।
পটলার খুড়তুতো ভাই ভজুও খুশি হয় আমাদের দেখে। এর আগেও দু-একবার আমের সময়ে এসেছি। তাই ভজু বলে,—কই হোঁৎকাকে দেখছি না? পঞ্চপাণ্ডবের চারজন এলি, সেটি কই ?
সব কথা শুনে ভজুদা বলে, তাই নাকি, এতসব !
শহরের সীমানা ছাড়িয়ে নদীপথে আমরা চলেছি দূরের বাগান ঘেরা ওই বাড়িটার দিকে। ভজুদা নিজেদের নৌকা নিয়ে চলেছে, ওতে নদীটাও দেখা যাবে।
ভজুদা বলে, ওপারে একটু গেলেই বাংলাদেশ। এ গাং-এ কোনটা আসল জেলেদের নৌকা আর কোনটা নয়, তা বোঝার উপায় নেই। রাতের অন্ধকারে এখানে বিদেশি মালপত্রের লেনদেন হয় প্রচুর
একটু পরে বাগানের মধ্যে একটা পুরানো বাড়ি দেখিয়ে ভজুদা বলে,—খুব সম্ভবত এই বাড়িটা। নদীর ভাঙনে কিছুটা এলাকা ভেসে যেতে, এ বাড়ি ছেড়ে পালায় সকলে।
বুঝতে পারি এই বাড়িটার কথাই বলছিল হোঁৎকা ।
ডিঙি থেকে কিছুদূরে নেমে, আমরা এগিয়ে আসি বাড়িটার দিকে। দেখা যায়, একটা ট্রাক আসছে ধুলো উড়িয়ে। আর ঐ ট্রাকে গালকাটা ক্যাবলা, ও আরও একজনের সঙ্গে বসে আছে হোঁৎকা। ওরা তিনজনে বসে গল্প করছে।
আমাদের মধ্যে চোখাচোখি হয়ে যায়। অর্থাৎ অঙ্ক ঠিকই মিলছে। সব প্ল্যানও ঠিকমত চলছে। হোঁৎকা সেটা জানাবার জন্য একনজর আমাদের দেখে, বাইরে হাত বার করে সংকেত দেয়।
এবার আমাদেরও প্ল্যান মত এগোতে হবে।
ভজুদা বলে,—কিছু ভাবিস না। ঠিক মত ব্যবস্থাই করছি। একবার প্রদীপদার কাছে চল। প্রদীপ বোস এখানে নতুন পুলিশ ইন্সপেক্টর। ভজুদার চেনা। ওঁর কাছেই সবাই চললাম আমরা ।
এদিকে হোঁৎকা এখন নিতু মিত্তিরের বিশ্বস্ত অনুচর হয়ে উঠেছে। আবার নিতু মিত্তিরের ক্যাবলাকেও দরকার। ও দুঃসাহসী। বোমা, ছুরি, পিস্তল চালাতে পারে। রাতের অন্ধকারের লাখ লাখ টাকা বিদেশি মালের আমদানির কাজে এসব লোকেরও দরকার। তার ওপর এ সপ্তাহে প্রচুর মাল আসছে। তাই ক্যাবলাকেও মদনের সঙ্গে দিয়েছে, হোঁৎকা তো আছেই ।
এই ব্যবস্থাতেই মদনের সন্দেহটা ঘনীভূত হয়। নিতু মিত্তিরকে বোধহয় ক্যাবলাই ওর সম্বন্ধে কিছু খবর দিয়েছে। আর ক্যাবলাও হোঁৎকার কাছে শুনেছে মদনার মনোভাবের কথা । তাকে টপকাতে চায়। নিজেই নাকি এই ব্যবসাতে নামবে।
হোঁৎকা নীরবে দেখছে দুজনকে। দুটো যেন রাগে ফুলে ওঠা হুলোবিড়াল, কখন যে কে কার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কে জানে।
ইতিমধ্যে গুদামবাড়িটায় এসে উঠেছে ওরা। আজ রাতেই সেই বড় চালানটা আসবে। সবাই ব্যস্ত, গুদামে রাশ রাশ পাটের বাণ্ডিল খোলা হচ্ছে, মাল এলে প্যাক করা হবে পাটের বাণ্ডিলের মধ্যে।
হোঁৎকা এর মধ্যে নীচে নেমে এসেছে। নাহ্, এদিকে বিশেষ কেউ নেই। এই ফাঁকে সে বাঁশবনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে।
পটলাদের বাড়ির বাইরের মহলে তখন পুকুরের মাছ ভাজা দিয়ে চা পর্ব চলছে। হোঁৎকাকে ঢুকতে দেখে খুশি হয়ে বলি,—আয়, আয়! বোস!
খানকয়েক মাছ ভাজা দ্রুত মুখে পুরে দিয়ে হোঁৎকা বলে, – বসার সময় নাই রে। তরা রেডি থাক অ্যাকসন শুরু করন লাগবে। আজই ফাইনাল গেম। জেতা চাই-ই।
রাত্রি নেমেছে। ক্যাবলা, মদনা, হোঁৎকা এসেছে নৌকায়।
রাতের অন্ধকারে ছায়ামূর্তির দল নৌকা থেকে সাইকেলের টায়ারের বাণ্ডিল, বিড়ির পাতার বস্তা, কাপড়ের গাঁটরি নামাচ্ছে নদীর ওপারে। আর নৌকায় তুলছে বিদেশি দামি যন্ত্রপাতি এবং আরো অনেক কিছু।
নিরাপদে মাল বোঝাই হবার পর এরা অপেক্ষা করে এদিকের অন্ধকারে। একটা টর্চের জ্বলা-নেভা সংকেতের জন্য। সেই সংকেত পেলেই এদিকের তীর নিরাপদ মনে করে এরা পাড়ি দেবে।
ব্যাপারটা আগে থেকেই জানা ছিল আমাদের। হোঁৎকাই ওদের সব প্ল্যানের ছকটা দিয়েছিল। সেইমত আমরাও বের হয়েছি। গোবরা, পটলা, আমি, ফটিক ছাড়া রয়েছে ভজুদা। পিছনে দূরে রয়েছেন প্রদীপবাবু। দরকার মত তিনি এসে পড়বেন।
আমরা চুপিসারে এসে হাজির হয়েছি পোড়ো সেই ভূতুড়ে বাড়ির এদিকে, নদীর ধারে।
দূরে ওপারে দেখা যায় কালো বিন্দুর মত নৌকাগুলোকে। ওই যে দূরে বাংলাদেশের সীমান্ত । সেখান থেকে দু-একটা কথার টুকরো ভেসে আসছে মাঝে মাঝে আলোর সংকেত পেয়ে ওপার থেকেও আলো জ্বলে ওঠে, আবার নিভে যায়। তারপরই শোনা যায় নদীর জলে দাঁড়ের শব্দ। ছপ ছপ করে দাঁড় বেয়ে বিচিত্র মাল বোঝাই নৌকো এপারের দিকে এগিয়ে আসছে।
হঠাৎ গোবর্ধনের হাতের প্রচণ্ড ঘুসি খেয়ে ছিটকে পড়ে একটা লোক আর তার হাতের টর্চটা। বুঝতে পারি, এ-ই আলোর সংকেত দিচ্ছিল। আমরাও সঙ্গে সঙ্গে তার ছিটকে পড়া দেহটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওরই গামছা দিয়ে ওর হাত পা বেঁধে ফেলি।
লোকটা ভাবতেও পারেনি, এমনিভাবে কেউ তাকে বিপর্যস্ত করে তুলবে।
এমন সময় ওদিকের মাটির সড়কে একটা গাড়ির শব্দ পেলাম। পথটা এসেছে গুদাম বাড়ি অবধি ৷
ওই পথের মুখে আমাদের পাহারা রয়েছে। আজ রাতে নিতু মিত্তির স্বয়ং আসছে। কারণ চালানটা খুবই বড়, তাই নিজেও আশপাশে থাকবে।
পটলা চাপা স্বরে বলে,–নি-নিতু মিত্তিরও এসে গ্যাছে!
আমি জানাই,—ওটাকেও জালে জড়াতে হবে।
নদীটা বেশ চওড়া এখানে। ভাঁটার টান, তাই স্রোতও বেশি। নৌকা দুটো ভেসে ভেসে নীচের দিকেই গেছে একটু। সেখান থেকে বেয়ে এই ঘাটে এসে লাগবে।
ওদিকে মদনা, ক্যাবলারা চেয়ে আছে তীরের দিকে। তারা আশা করছে আর একটা আলোর সংকেতের। কিন্তু সেই সংকেত আসে না। কানে আসে, নিতু মিত্তিরের গাড়ির শব্দটা। ওই শব্দ ক্যাবলার চেনা।
ক্যাবলা বলে,-নিতুদাও এসে গেছে, তাহলে লাইন কিলিয়ার। নৌকা ধারে লাগা । প্রতিবাদ করে মদনা,—না। ইশারা না পেলে নৌকা নিয়ে যাব না ওদিকে।
ক্যাবলা বলে,–চুপ কর তুই। মাঝি, ধারে নে চল !
মদনা তবুও বলে,—ক্যাবলাদা।
ক্যাবলা গর্জে ওঠে,—তুই চুপ থাক। যেভাবে হোক তাড়াতাড়ি মাল নামাতে হবে। তোর মতলব বুঝেছি।
সঙ্গে সঙ্গে চটে ওঠে মদনা, –আনসান বলবে না।
হোঁৎকা দেখছে ওদের দুজনকে। ওরা এখন কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। তবু ক্যাবলাই দলনেতা, তার কথামত নৌকা দুটো ধারে এসে ভিড়েছে।
আমরা একটু দূরে বাঁশবন আর ঘেঁটু ঝোপের মধ্যে বসে আছি গা ঢাকা দিয়ে ।
ওদিকে তখন নৌকা থেকে মাল খালাসের কাজ শুরু হয়েছে, নিতু মিত্তিরও এসে হাজির। ক্যাবলা বলে,—ওই মদনার মতলব সুবিধার নয় কত্তা, ও মাল নে কেটে পড়ার তালেই ছিল।
নিতু মিত্তির গর্জে ওঠে,ওটাকেই কেটে গাং-এর জলে ভাসিয়ে দেব আজ।
মদনও গর্জে ওঠে বিপদের গুরুত্ব বুঝে,—যা তা বলবি না ক্যাবলা, তোর লাশই গিরিয়ে দেব।
নেহাৎ দুজন ধরে ফেলে নাহলে মদনা বোধহয় তখনই ক্যাবলার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। এবার খেয়াল হয় ওদের। এপারের সংকেতকারী সেই লোকটা নেই।
নিতু গর্জে ওঠে,–এইসব কাঁচা কাজ করিস ?
ক্যাবলা বলে,—ছিল তো। ওই মদনার দলের লোক সেটা। তাই সরে গেছে। মদনা। —নিতু মিত্তিরের গর্জন শুনতে পাই ।
হঠাৎ ঝোপের মধ্যে কাকে ঢুকতে দেখে চমকে উঠেছি। আমাদের খবর পেয়ে ওরা বোধহয় এবার আমাদেরই আক্রমণ করতে চায় ।
চাপা কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম। ওদের লড়াই জমার ফাঁকতালে হোঁৎকা এসে
সেঁদিয়েছে আমাদের দলে।
হোঁৎকা চাপা স্বরে বলে,—চুপ কইরা থাক। ওগোর মধ্যি, দ্যাখ হালায় একখান লাশ পড়বো। তর ভজুদার অ্যাকসন কখন শুরু হইব? চারে সব মাছ আইনা দিছি, এহন জাল ফ্যালবি আর তোলবি।
হঠাৎ অন্ধকারে নদীর বুকে কয়েকটা সার্চ লাইটের তীব্র আলো ঝলসে ওঠে। দু তিনটে জিপ। হেড লাইটের আলোয় অন্ধকার মুছে গেছে। দেখা যায়, মালপত্র ফেলে লোকজন দৌড়চ্ছে। কিন্তু ভজুদার ক্লাবের ছেলেরাও অন্ধকারে বাঁশবন, আমবাগানে ছড়িয়ে ছিল। লাফ দিয়ে ঘিরে ফেলেছে ওদের।
ক্যাবলাও এই গোলমালে তার বোমার থলিটা বের করে। আলোয় দেখা যায় ক্যাবলা বোম ছুঁড়তে যাচ্ছে। চমকে উঠি—বোম মেরে শেষ করবে আমাদের?
হোঁৎকা বলে,—ওটারে লেঙ্গি মাইরা ফ্যাল গোবরা, ওতে বোম আর নাই, আমি আসল বোম ফেইল্যা ওতে পাটের গোল্লা পুইরা রাখছি। কচু হইব ওতে।
নিতু মিত্তির বেগতিক দেখে পালাবার চেষ্টা করে। আর ঠিক সেই সময়েই প্রদীপদার টর্চের আলো পড়ে মুখের ওপর। থমকে দাঁড়ায় নিতু মিত্তির। মরিয়া হয়ে রিভলবার বার করে। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে প্রদীপদার নিরেট পুলিশি ঘুসিতে একেবারে ধরাশায়ী নিতু মিত্তির।
আধ ঘণ্টার মধ্যে সারা শহরের লোকজন জুটে যায়। কয়েকটা হ্যাজাকের আলোয় ওই বিরাট বিদেশি মালের চোরা চালান গ্যাং সমেত ধরা পড়ে।
কুলেপাড়া অঞ্চলে আবার শান্তি ফিরে এসেছে। হঠাৎ জেগে ওঠা ক্যাবলা মদনাদের মত যুব কর্মী, নিতু মিত্তিরের মত দেশসেবক এখন সরকারের জেলে। উঠে গেছে ওদের ক্লাবও।