মুখবন্ধ (Preface)
বাঙালির ধর্মচিন্তা একটি পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণা গ্রন্থ। আমার নিজস্ব উপলব্ধি ও বিশ্বাসের ভিত্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের সারবস্তু,
নবী-রসূল, মুনি-ঋষিসহ সকল ধর্মের সত্যদ্রষ্টার চিন্তার নির্যাস, তথা ধর্ম-দর্শন-বিজ্ঞানের সারাৎসার নিড়ে সকল বৈশ্বিক সমুন্নত চিন্তার অঙ্গিভূত অবলোকন এই গ্রন্থ। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পূর্বাপর সকল মনীষী মন্তব্যের প্রাসঙ্গিক উল্লেখ এবং বিশ্লেষণও সংযোজিত হয়েছে এই গ্রন্থে। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন শক্তির প্রয়োজন হয়, তেমনি বিশ্বাসের ভিত্তি নির্মাণের জন্য যুক্তির প্রয়োজন হয়। যুক্তিছাড়া মুক্তি নাই। পবিত্র কোরআনেও বিশ্বাস স্থাপনের জন্য তা যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিতে পরোক্ষ নির্দেশ রয়েছে (৪৫ : ২৫)। কেননা স্পষ্ট জ্ঞান ব্যতীত অনুমান দ্বারা পরিচালিত হওয়া কোরআন মতে নিষিদ্ধ। এই বিশ্বের সকল বস্তুর অস্তিত্ব বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। এদিক থেকে বিশ্বাস একটি শক্তি— বিশ্বাস একটি বিজ্ঞান। কিন্তু বিশ্বাস জ্ঞান দ্বারা পরিচালিত না হলে সেই বিশ্বাস বিপন্ন হয়। তাই মানুষের জীবনে একটি ধর্মীয় প্রজ্ঞার স্থিতি না থাকলে মানুষও বিপর্যস্ত হয়। তবে কারো বিশ্বাসকে প্রভাবিত করা নয়, কারো বিশ্বাসকে প্রতারিত করা নয়, প্রতিহত করা নয়, সঠিক সুবিন্যস্ত করার লক্ষ্যে চিন্তার বিশ্ব বাগান থেকে চয়ন করা হয়েছে এই গ্রন্থের যৌক্তিক উপাদান। কেননা যৌক্তিক বিচার বিশ্লেষণ ছাড়া কোন মতবাদ বা চিন্তাকেই গ্রহণ করে নেয়া প্রজ্ঞার পরিচয় নয়।
বাঙালির ধর্মচিন্তা গ্রন্থে বাঙালি জনজীবনে অনুসৃত প্রধান চারটি (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্ট ও ইসলাম) ধর্মের দর্শনগত দিক সন্ধান সাপেক্ষে এর সামাজিক প্রভাব উপস্থাপনের মাধ্যমে সম্প্রদায় সম্প্রীতি ও সর্বোপরি মানব ঐক্য রচনাই মুখ্য উদ্দেশ্য। আর এ উদ্দেশ্য পূরণে বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে বসবাসরত অপরাপর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির আচরিত ধর্মজীবনের সমাজদর্শন সম্পৃক্ত করে বাঙালির ধর্মজীবনে এক অখণ্ড মানবমণ্ডলীর অবয়ব উপস্থাপনের সদিচ্ছা প্রতিফলিত হয়েছে। তাই সঙ্গত কারণেই গ্রন্থের উপস্থাপন চারিত্রে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অবয়বটি প্রাধান্য পেয়েছে। কেননা তুলনামূলক ধর্মালোচনার মধ্য দিয়েই পরধর্ম সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি ও সম্প্রীতি সম্প্রসারণের লক্ষ্য অর্জনের একটি অন্যতম সহায়ক পথ। ইতোমধ্যে আমার সম্পাদনায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে ধর্মের নানা দিগন্ত বিশ্লেষণমূলক সুবৃহৎ ১৪ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে বাঙালির ধর্মচিন্তা।
২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে সূচীপত্র প্রকাশনার প্রধান নির্বাহী শিশুসাহিত্যিক সাঈদ বারী পরিকল্পিত আমার সম্পাদনায় ৪৯ জন বিশিষ্ট বাঙালির চিন্তার নির্বাচিত প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশিত হয় বাঙালির ধর্মচিন্তা। বর্তমানে ওই সম্পাদিত গ্রন্থের চতুর্থ মুদ্রণ সম্পন্ন হয়েছে। ওই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত ছিল আমার ১০৮ পৃষ্ঠার একটি দীর্ঘ ভূমিকা। ধর্মচিন্তার নানা দিগন্ত উন্মোচনের প্রয়াস ছিল ওই ভূমিকায়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই গ্রন্থের পাঠ প্রতিক্রিয়ার আলোচনা সংবাদ প্রচারিত হয়। বিভিন্ন পাক্ষিক ও দৈনিকের সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত হয় গ্রন্থটির নানামুখী আলোচনা। সে সময়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মৌলিক গ্রন্থ প্রণয়নের অপূর্ণতা থেকেই ওই ভূমিকার অবতারণা। বর্তমান গ্রন্থটি মূলত ওই ভূমিকারই সম্প্রসারিত সংস্করণ। ওই বছর প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের তালিকায় নির্বাচিত হয় বাঙালির ধর্মচিন্তা।
আলোচকরা এই গ্রন্থের সার্বিক আলোচনার আলোকে গ্রন্থটিকে মৌলিক রূপে উপস্থাপনের পরামর্শ দেন। সেই সাথে জার্মানির ফ্রাঙ্কফ্রুট বইমেলার আয়োজকদের পক্ষ থেকে বর্তমান গ্রন্থকারকে গ্রন্থটির মৌলিক রূপ দিয়ে এর ইংলিশ ভার্সন প্রকাশের জন্য এগিয়ে আসেন। যেহেতু গ্রন্থটিতে ধর্মের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের জনজীবনের ধর্মদর্শন— বিশেষত বাংলাদেশে আচরিত হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মের পাশাপাশি বাঙালি সমাজে অনুসৃত বাহাই ধর্ম, শিখধর্মসহ প্রায় সকল লোকধর্মের ধর্মাদর্শ বিশ্লেষিত হয়েছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এই জনপদের মানুষের ধর্মচেতনার বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করতে হলে সংশ্লিষ্ট চিন্তার সুবিন্যস্ত ও বিশ্লেষণধর্মী কোন গবেষণা নেই। এই উপলব্ধি ও উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষেই বর্তমান গ্রন্থের মৌলিক রূপের সৃষ্টি। আঠারটি অধ্যায়ে সন্নিবেশিত এই গ্রন্থে আস্তিক, নাস্তিক, যৌক্তিক, অজ্ঞেয়— সকল চিন্তাদর্শনের বিশ্লেষণ আছে— বিষয় বিন্যাসেও ধর্মের বহুমুখী দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। ইতপূর্বে বাংলাভাষায় ধর্মের স্বাতন্ত্রিক সীমানায় বহু গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও ধর্মের বহুমুখী দর্শন নিয়ে সর্বোপরি ধর্মের এ্যাকাডেমিক উপস্থাপনামূলক গ্রন্থ এই প্রথম। ইতোমধ্যেই গ্রন্থটির পরিমার্জিত ইংরেজি সংস্করণ আন্তর্জাতিক প্রকাশনায় অধিভুক্ত হয়েছে। আশা করি বাঙালির ধর্মচিন্তা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
মোহাম্মদ আবদুল হাই
মোহাম্মদপুর, ঢাকা
অক্টোবর, ২০২১