মুখবন্ধ
আমাদের সংস্কৃতির চরিত্র নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে এখন যে বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে তা দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যে আমরা এখনো যথাযথভাবে নিজেদের জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় নির্ধারণে সমর্থ হইনি। এসব ক্ষেত্রে যে বিভ্রান্তি, নৈরাজ্য এবং হতবুদ্ধিতা আজ পরিলক্ষিত হচ্ছে তার উৎপত্তি আমাদের বহুদিনের কুসংস্কার ও হীনমন্যতার মধ্যে। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও ধর্মকে ক্ষুদ্র স্বার্থসাধনের কাজে ব্যবহার করার ব্যাপারটি নোতুন কোন ঘটনা নয়। এই পুরাতন অভ্যাসের জোরেই এখন এক শ্রেণীর লোকে সাংস্কৃতিক আলোচনার ক্ষেত্রে ধর্মকে নিয়ে অনেক অবান্তর বিতর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। ধর্মের একটি বিশিষ্ট স্থান অনেকের জীবনে আছে এবং সে কারণে তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনও ধর্মনিষ্ঠ। এঁরা ব্যক্তিগত জীবনের বাইরে ধর্মকে নিয়ে টানাটানি করেন না এবং এঁদের ধর্মচর্চার দ্বারা সমাজের প্রগতিও ব্যাহত হয় না। সেটা হয় তাদের দ্বারা যারা ধর্মকে টেনে আনে অন্যান্য ক্ষেত্রে। এ মনোবৃত্তি এবং প্রচেষ্টার নামই সাম্প্রদায়িকতা।
সাম্প্রদায়িকতার দ্বারা ধর্মের গৌরব বৃদ্ধি তো হয়ই না উপরন্তু সত্যিকার ধর্মচর্চা তার দ্বারা ব্যাহত হয় এবং ধার্মিক লোকেরা তার দ্বারা লাভবান হয় তাদের নিজেদের জীবন আর যাই হোক ধর্মগত নয়। তারা যে বস্তুগত জীবনের বিবিধ উপকরণসমূহ এবং পার্থিব জীবনের মোহের প্রতি উদাসীন ও অনাসক্ত একথা বললেও সত্যের যথেষ্ট অপলাপ হবে। ধর্মের প্রতি আমাদের দেশের অসংখ্য সৎ এবং বিশ্বাসপ্রবণ মানুষের যে দুর্বলতা আছে তাকে নানাভাবে ব্যবহার করতে তারা দ্বিধা অথবা সঙ্কোচ বোধ করে না। এজন্যেই অনেক সময় সাম্প্রদায়িক হিন্দু-মুসলমান ধর্মের নামে হাজার রকম সমাজবিরোধী কাজকর্ম তো করেই এমনকি নিরপরাধ মানুষের জীবননাশ থেকেও বিরত হয় না।
সংস্কৃতি-প্রসঙ্গে বর্তমানে যে আলোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়েছে সে আলোচনা ও স্বার্থচিন্তা ও কুসংস্কারের পরিবর্তে যুক্তি বিবেচনা এবং সমাজ ও ইতিহাস চেতনার দ্বারা পরিচালিত হলে তার মাধ্যমে পাকিস্তানের বাংলাভাষাভাষী জনসাধারণ নিজেদের সত্যিকার ঐতিহ্যিক ও সাংস্কৃতিক চরিত্রের সাথে পরিচিত হতে সক্ষম হবে। এ প্রচেষ্টার গুরুত্ব এখন অত্যন্ত বেশী। সমস্যাটির সমগ্র রূপের চেতনা মধ্যবিত্তশ্রেণীর এক অংশের মধ্যে দেখা দিলেও আমাদের দেশের অগণিত দরিদ্র ও নিপীড়িত জনগণের স্বার্থও এই সমস্যার সাথে জড়িত। বর্তমানে এই সাংস্কৃতিক চেতনা ও বিতর্ককে মধ্যবিত্তসুলভ বিলাসপ্রবণতা বলে বর্ণনা করলে মারাত্মক ভুল করা হবে। এর অসম্প্রদায়িক চরিত্র শুধু যে এ দেশের সাংস্কৃতিক আকাশকেই দুর্যোগমুক্ত করবে তাই নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও এর সুফল অবশ্যম্ভাবী। কাজেই সংস্কৃতিকে সাম্প্রদায়িক প্রভাবমুক্ত করার প্রচেষ্টা সমগ্র পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষার প্রচেষ্টা। এ আন্দোলনে তাই যাঁরা সত্য অর্থে ধর্মনিষ্ঠ এবং যাঁরা ধর্ম নিরপেক্ষ তাঁরা উভয়েই সমান উপযোগিতার সাথে অংশগ্রহণ করতে পারেন।
এ বইটির প্রবন্ধগুলির মধ্যে ‘ঊনিশ শতকে মুসলিম শিক্ষা ও মাতৃভাষা চর্চা’ ব্যতীত অন্য সবগুলি ইতিপূর্বে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত পূর্বমেঘ, বনানী ও উত্তর-অন্বেষাতে এবং চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত সংকলন পদাতিক ও বাইশে শ্রাবণে প্রকাশিত হয়েছে। ‘বাঙালী সংস্কৃতির সংকট’ প্রবন্ধটি আহমেদুর রহমানের প্রথম মৃত্যু-বার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকাতে আয়োজিত একটি আলোচনা সভায় মূল ভাষণ হিসাবে গঠিত এবং ‘স্মরণ’ নামক সংকলনে প্রকাশিত হয়।
প্রবন্ধগুলি লেখার সময় যাঁদের উপদেশ ও সমালোচনা দ্বারা সব থেকে বেশী উপকৃত হয়েছি তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের নাম প্রথমেই উল্লেখযোগ্য। ‘ঊনিশ শতকে মুসলিম শিক্ষা ও মাতৃভাষা চর্চা’ প্রবন্ধটি লেখার প্রয়োজনীয়তা তাঁর সাথে আলোচনার ফলেই সঠিকভাবে উপলব্ধি করি। অন্যান্যের মধ্যে অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ এবং অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের কাছেও আমি যথেষ্ট কৃতজ্ঞ। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শুধু যে তাঁর মূল্যবান সমালোচনা দ্বারা কতকগুলি ভুলত্রুটি সংশোধনে আমাকে সাহায্য করেছেন তাই নয়, নিজের অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করে বইটির প্রুফও দেখে দিয়েছে। এ সবকিছুর জন্য তাঁর কাছে আমার ব্যক্তিগত ঋণ অপরিশোধ্য। এ বইয়ে যে মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার নিজের।
স্নেহভাজন আবু নাহিদ বইটি তাড়াতাড়ি প্রকাশ করার জন্য আমাকে যে শুধু তাগিদ দিয়েছে তা নয়, নিজেই তার প্রকাশনার ভারও গ্রহণ করেছে। এজন্য তার কাছেও আমি কৃতজ্ঞ।
বদরুদ্দীন উমর
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
২৬ শে অক্টোবর, ১৯৬৭
তৃতীয় মুদ্রণের ভূমিকা
‘সংস্কৃতির সংকট’ ১৯৬৭ সালে যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তখন পূর্ব বাঙলার কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের জাতিগত নিপীড়নের নীতি ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্প, সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রেই একটা নির্দ্দিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করেছিলো। সে সময়ে সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি প্রচারের প্রচেষ্টা সরাসরি সরকারী তত্ত্বাবধানে অনেকখানি সংগঠিত হয়েছিলো এবং অনেক বিচিত্র পথে সংস্কৃতিক্ষেত্রে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে নিযুক্ত ছিলো।
এই নৈরাজ্যের প্রত্যক্ষ শিকার তখন মূলতঃ ছিলো মধ্যশ্রেণী। আসলে সেই পর্যায়ে মুসলিম লীগের দ্বিজাতি তত্ত্ব মধ্যশ্রেণীর মধ্যে পূর্বের থেকে অনেক ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছিলো এবং সরকারও ভাষাভিত্তিক জাতীয় চেতনার উন্মেষকে ধর্ম সম্প্রদায় ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রচারণার দ্বারা মোকাবেলা করা ও বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো।
পূর্ব বাঙলা পাকিস্তানের অন্তর্গত হওয়ার পর থেকেই সংস্কৃতিক্ষেত্রে যে সংকটের সূত্রপাত সাধারণভাবে হয়েছিলো সেই সংকটই তখন একটা তীব্র আকার ধারণ করেছিলো। ‘আমরা বাঙালী না পাকিস্তানী না মুসলমান’— এই প্রশ্নের মধ্যেই সেই সংকটের সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি ঘটেছিলো।
বাঙলাদেশে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অনেকে ভেবেছিলেন যে ‘আমরা বাঙালী না পাকিস্তানী না মুসলমান’, এই প্রশ্নের সুষ্ঠু মীমাংসা হয়ে গেছে। অর্থাৎ বাঙালীত্বের জয় মুসলমানত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ধর্ম ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বস্তুতে পরিণত হয়ে রাজনীতির অঙ্গন থেকে বিদায় নিয়েছে অর্থাৎ এদেশ সাম্প্রদায়িকতা ও জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক চিন্তার অবসান ঘটেছে।
কিন্তু অল্পকাল পরেই ১৯৭২ সালের মধ্যেই দেখা গেলো যে বাস্তবতঃ তা ঘটে নি। বাঙলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা পূর্বের মতো প্রবল প্রতাপান্বিত না হলেও তার প্রভাব যথেষ্ট প্রবল আছে এবং জনগণের চিন্তা ক্ষেত্রে তা এখনো পর্যন্ত নানান বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। সরকার বাহ্যতঃ একটা ধর্মনিরপেক্ষ এবং অসাম্প্রদায়িক চরিত্র পরিগ্রহ করলেও জাতীয়তাবাদকে বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের একটা ভিত্তি হিসেবে দাঁড় করানোর পর থেকে এই বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ পূর্ব বাঙলায় বাঙলাদেশ নামে যে নোতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে রাষ্ট্রের অধিবাসীদেরকে একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে কিন্তু কি ভিত্তিতে তারা হঠাৎ একটা জাতিতে পরিণত হলো তার কোন ব্যাখ্যা দেওয়া হয় নি।
পূর্ব বাঙলার অধিবাসীরা বাঙালী, এই কথা বলে আমরা ‘বাঙালী না মুসলমান না পাকিস্তানী’ এ প্রশ্নের যে সমাধানের চেষ্টা হয়েছিলো পূর্ব বাঙলার অধিবাসীদেরকে একটি পৃথক জাতি হিসেবে ঘোষণা করায় সে ক্ষেত্রে আবার নোতুন এক জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।
এই জটিলতার কারণ পূর্ব বাঙলা অর্থাৎ বর্তমান বাঙলাদেশের বাইরে পশ্চিম বাঙলা, ত্রিপুরা ইত্যাদি ভারতের অন্তর্ভুক্ত এলাকাতেও বাঙালীদের বসবাস আছে এবং তাঁরাও নিজেদেরকে বাঙালী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। পূর্ব বাঙলার লোকদেরকে একটি পৃথক জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করে সেই আখ্যার ভিত্তিতে এখানে একটা পৃথক জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব এবং জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র খাড়া করার চেষ্টা করলে দেখাতে হবে বাঙলাদেশের বাঙলাভাষী জনগণের সাথে পশ্চিম বাঙলা, ত্রিপুরা প্রভৃতি এলাকার বাঙলাভাষী জনগণের পার্থক্য কোথায়।
এই পার্থক্যের কথা ১৯৪৭ সালে কেউ উল্লেখ করেনি অর্থাৎ সে সময় এখানকার বাঙালীদেরকে কেউ একটা পৃথক জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করে নি। করলে তা পাগলামীর শামিল হতো। কিন্তু ১৯৭২ সালে তাকে সরকারীভাবে এখানে তাই বলা হচ্ছে।
কিন্তু কেন তা বলা হচ্ছে এবং এই বক্তব্যের পরিণতি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে কি দাঁড়াচ্ছে? ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে কি এমন ঘটলো যার ফলে পূর্ব বাঙলার যে বাঙলাভাষী জনগণকে অন্যান্য এলাকার বাঙালীদের থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র একটি জাতি হিসেবে ১৯৪৭ সালে আখ্যায়িত করা যেতো না, তাদেরকে ১৯৭১ সালের পর সেইভাবে আখ্যায়িত করা সম্ভব হলো?
এখানে একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে সমাজের মধ্যে, জনগণের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের মধ্যে, সে ধরনের কোন মৌলিক পরিবর্তনই এই মধ্যবর্তী সময়ে সাধিত হয় নি। অর্থনীতি ক্ষেত্রে শিল্প বিকাশ সামান্য কিছু ঘটলেও তার প্রভাব সমাজে সুদূরপ্রসারী নয়। ভূমি মালিকানা এবং কৃষিউৎপাদন সম্পর্কের মধ্যেও কোন মৌলিক পরিবর্ত্তন কিছু ঘটে নি। ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা। কিন্তু অর্থনীতির কোন ক্ষেত্রেই মৌলিক পরিবর্তন না ঘটলেও পাকিস্তানী আমলে একটি জিনিষ ঘটেছিলো। শোষক শ্রেণীর সম্প্রদায়গত চরিত্র ইংরেজ আমলে যা ছিলো তার মধ্যে একটা মৌলিক ও তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছিলো। হিন্দুরা এক্ষেত্রে যেখানে প্রধান, সংখ্যাগুরু ও শীর্ষস্থানীয় ছিলো সেখানে মুসলমানরা শুধু প্রধান, সংখ্যাগুরু ও শীর্ষস্থানীয় হলো না। তারা পরিণত হলো এদিক দিয়ে একটি একচ্ছত্র সম্প্রদায়ে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কৃষি, ব্যবসা বাণিজ্য ও শিল্প ক্ষেত্রে শোষণের চাবিকাঠি তাদের হাতেই এসে গেলো।
অর্থনীতিক্ষেত্রে শোষক শ্রেণীসমূহের সাম্প্রদায়িক চরিত্র পরিবর্তিত হলো, মুসলমানরা শিক্ষাদীক্ষায় এবং সংস্কৃতি চর্চায় অধিক সংখ্যায় অংশগ্রহণ করলো। কিন্তু এছাড়া এমন কোন মৌলিক পরিবর্ত্তন সমাজের মধ্যে সাধিত অথবা সূচিত হলো না, যার ভিত্তিতে এই অঞ্চলের বাঙালীরা একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে পরিচিত হতে পারতেন। সে পরিচয় আবিষ্কার, উদ্ঘাটন অথবা প্রচারের কথা কেউ পাকিস্তানী আমলে চিন্তাও করে নি।
কিন্তু বাঙলাদেশ হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার পূর্ব বাঙলার বাঙালীদেরকে বাঙলাদেশী জাতি অর্থাৎ পশ্চিম বাঙলা ও অন্যান্য অঞ্চলের বাঙালীদের থেকে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করলেন, বাঙলাদেশকে একটি জাতীয় রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করলেন। তাহলে এই বাঙলাদেশের বাঙালীদের সাথে অন্যান্য এলাকার বাঙালীদের পার্থক্য আসলে কি দাঁড়ালো যার ফলে বাঙলাদেশের অধিবাসীরা স্বতন্ত্র বাঙালী এবং বাঙলাদেশ একটি জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হলো? এক্ষেত্রে যেটা দেখা যাচ্ছে তা হলো এই যে, এখানকার শোষক শ্রেণীর সাম্প্রদায়িক চরিত্র পরিবর্তনই একমাত্র জিনিষ যেটা উল্লেখ যোগ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ। অন্য কোন কিছুই পাকিস্তানী আমলে ঘটেনি, এমন কোন মৌলিক পরিবর্তনই সাধিত হয় নি সে পরিবর্তন ১৯৭১ সারে বাঙালীদের একটি অংশকে অপর একটি অংশ থেকে পৃথক করে একটি স্বতন্ত্র জাতিতে পরিণত করতে পারে।
এই অবস্থায় মধ্যশ্রেণীর কর্তৃত্বাধীন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চিন্তা ক্ষেত্রে যে নোতুন এক জটিলতার সৃষ্টি হবে তাতে আর সন্দেহ কি? এই জটিলতাকে একটি প্রশ্নের আকারে উপস্থিত করলে দাঁড়ায়: ‘বাঙলাদেশের বাঙালীরা কি ধরনের বাঙালী?’ এর একটিমাত্র জবাবই আছে তারা মুসলমান বাঙালী!
একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, পাকিস্তানী আমলে জাতি সমস্যার ক্ষেত্রে যে মৌলিক জটিলতা ছিলো, সংস্কৃতি ক্ষেত্রে নৈরাজ্য সৃষ্টির যে বাস্তব ভিত্তি ও সম্ভাবনা ছিলো তার সবটুকুই এখনো পর্যন্ত “ধর্মনিরপেক্ষ” রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত এই নোতুন রাষ্ট্রটিতে বর্তমান আছে। সাম্প্রদায়িকতা পাকিস্তানী আমলে সরাসরিভাবে ধর্মকে অবলম্বন করে দাঁড়িয়েছিলো। আর বাঙলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তা এখন দাঁড়িয়ে আছে “ধর্মনিরপেক্ষতাকে অবলম্বন করে। এই ভেল্কিবাজী কি করে সম্ভব হলো? এটা সম্ভব হওয়ার প্রধান এবং মৌলিক কারণ পূর্ব বাঙলা অর্থাৎ বৰ্ত্তমান বাঙলাদেশে সামস্ত সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব ও প্রাধান্য। এই সামন্ত সংস্কৃতিকে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মাধ্যমে যে ভাবে আঘাত করা দরকার ছিলো সেভাবে আঘাত এখানে করা হয় নি। শুধু তাই নয়। এখানে সামন্ত সংস্কৃতি এখনো পর্যন্ত যথেষ্ট প্রবল থাকার জন্যে তার থেকে অনেক বৈচিত্রপূর্ণ চিন্তা ও নীতির জন্ম ও বিকাশ লাভ ঘটছে। এজন্যেই দেখা যাচ্ছে যে, এই সংস্কৃতির ভিত্তি থেকে একদিকে যেমন নগ্ন সাম্প্রদায়িকতার নোতুন উত্থান ঘটছে অন্যদিকে তেমনি বৰ্ত্তমান শাসক শোষক শ্ৰেণী সেই ভিত্তিকেই অবলম্বন করে “ধর্মনিরপেক্ষতার” ভেল্কিবাজীর দ্বারা সাম্প্রদায়িকতাকে অতি সূক্ষ্মভাবে সমাজের মধ্যে জীইয়ে রাখা ও সুকৌশলে নানাভাবে ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হচ্ছে।
এ সব কারণেই স্পষ্টতঃ দেখা যাচ্ছে যে, সামন্তবাদী সংস্কৃতি এদেশে পাকিস্তানী আমলে যে সংকট সৃষ্টি করেছিলো সে সংকট এখনো পর্যন্ত নিরসন তো হয়ই নি, উপরন্তু তার প্রভাব ও প্রতাপ এখনো পর্যন্ত বজায় আছে। এই প্রভাব ও প্রতাপকে খর্ব করা, তার ওপরে আঘাত হানা এবং তাকে নির্মূল করা তাই এখনো পর্যন্ত এদেশের গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের এক অপরিহার্য দায়িত্ব।
বদরুদ্দীন উমর
ঢাকা
১১. ৫. ১৯৭৪