প্রথম সংস্করণের মুখবন্ধ
ডক্টর সৈয়দ আলী আশরাফ অল্প কিছুদিন পূর্বে আমাকে বলেছিলেন যে সংস্কৃতি নিয়ে আমার সাথে কথা বলার অসুবিধে এই যে আলোচনাকালে একটা বিশেষবিন্দুকে কেন্দ্র করে আমি ঘুরতে থাকি এবং সেই কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হতে রাজী হই না। এক্ষেত্রে কক্ষপথে আবর্তনের অর্থ কি, সেটা দেখা দরকার।
হিন্দু মুসলমান ধর্মীয় সমাজের অন্তর্গত মানুষদের মধ্যে সংস্কৃতিগত পার্থক্য নেই, একথা আমি কোথাও বলিনি। এ বিষয়ে আমার বক্তব্যকে মোটামুটি দুইভাবে বিভক্ত করা চলে। প্রথমতঃ ‘হিন্দু’ অথবা ‘মুসলমান’ কোন্ শ্রেণীভুক্ত একথা উল্লেখ না করে শুধু ‘হিন্দু” অথবা ‘মুসলমান’ সংস্কৃতির আলোচনা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক এবং বিভ্রান্তিকর। দ্বিতীয়তঃ, পূর্বকালে অথবা বর্তমানে একই শ্রেণীভুক্ত হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে যে পার্থক্য, বিরোধ ও বৈষম্য দেখা গেছে, তার মধ্যেও মাত্রা এবং গুরুত্বের যথেষ্ট প্রভেদ। এই প্রভেদের কারণ উভয়ের মধ্যেকার পার্থক্য, বিরোধ এবং বৈষম্য মৌলিক নয়, তার প্রায় ষোল আনাই স্থান কাল এবং আর্থিক জীবনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এবং একারণেই তারা শাশ্বত নয়, সর্বাংশে পরিবর্তন-সাপেক্ষ।
আমার উপরিউক্ত দুই বক্তব্যই বস্তুতঃ একই সূত্রে গাঁথা এবং সেই সূত্রটি হচ্ছে এই যে, সংস্কৃতির মূল ভিত্তি ধর্ম, বর্ণ, বংশ ইত্যাদি নয় সে ভিত্তি মানুষের আর্থিক জীবন। আমার এই বক্তব্যই সেই কেন্দ্রবিন্দু, যার থেকে আমি বিচ্যুত হতে প্রস্তুত নই বলে আলী আশরাফ সাহেব অভিযোগ করেছিলেন।
কতকগুলি প্রাসঙ্গিক প্রশ্নকে যথার্থভাবে বিশ্লেষণ করলে এই বিন্দুটির গুরুত্ব সহজেই চোখে পড়বে। যেমন :
ক. একই গ্রামের মুসলমান কৃষক, জমিদার এবং মহাজনের জীবন ও সংস্কৃতি কি এক?
খ. যে কোন গ্রামের দরিদ্র হিন্দু কৃষকের এবং মুসলমান জমিদার মহাজনের জীবন ও সংস্কৃতি, কোনটির সাথে সেই গ্রামের দরিদ্র মুসলমান কৃষকের জীবন ও সংস্কৃতির যোগসূত্র ঘনিষ্ঠতর?
গ. একজন উচ্চশিক্ষিত নগরবাসী হিন্দু এবং একজন অল্পশিক্ষিত গ্রাম্য মুসলমান মহাজন, এ দুইয়ের মধ্যে কার সান্নিধ্য ও সাহচর্যে আলী আশরাফ সাহেবদের মতো একজন উচ্চশিক্ষিত নাগরিক মুসলমান ঘনিষ্ঠ হতে না পারলেও অন্ততঃপক্ষে অধিকতর ‘স্বস্তি বোধ করবেন?
ঘ. ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বাঙলাদেশ এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক চেতনার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ কেন দেখা গেলো?
ঙ. সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত প্রায় সব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাই প্রধানতঃ নগরকেন্দ্রিক এবং নাগরিক ষড়যন্ত্র থেকে উদ্ভূত কেন?
চ. স্বাধীনতাপূর্ব যুগে দাক্ষিণাত্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সংখ্যা এতো কম এবং উত্তর ভারতে তার সংখ্যা এতো বেশী হয়েছিলো কেন?
এ জাতীয় প্রশ্নের অন্ত নেই। কিন্তু এই ধরনের বাস্তব প্রশ্নগুলিকে পরীক্ষা করলেই আর্থিক জীবনের অপরিসীম গুরুত্ব এবং হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতি ও সম্পর্কের সত্যিকার চরিত্র উদ্ঘাটিত হবে।
আলী আশরাফ সাহেব আর একটি বিষয়ের উল্লেখ করে বলেছিলেন, “হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যদি মৌলিক পার্থক্য নাই থাকবে, তাহলে ইংরেজ রাজত্বকালে তাদের আর্থিক জীবন এবং রাজনীতি এতো ভিন্ন হবে কেন? সাংস্কৃতিক পার্থক্য থেকেই তো তার উৎপত্তি।’ একথা এক হিসাবে সত্যি, কিন্তু আর এক হিসাবে মিথ্যা। কারণ, সত্য বহু প্রকারের হতে পারে। যেমন: (ক) দুই দুইয়ে চার হয়। (খ) মানুষ মরণশীল (গ) পৃথিবী সূর্যের চতুর্দিকে আবর্তন করে (ঘ) পদ্মানদী রাজশাহী শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত। আমরা মনে করি আলী আশরাফ সাহেবের বক্তব্য (ঘ) শ্রেণীর সত্য, কিন্তু তাঁরা তাকে মনে করেন (ক) শ্রেণীর। কাজেই যে সত্য অপসৃয়মান এবং স্থানকাল নির্ভর তাকেই তাঁরা শাশ্বত আখ্যা দিয়ে নানা বিষয়ের নিত্য নোতুন ব্যাখ্যা দানে প্রবৃত্ত হন।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় কারণে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীভুক্ত হিন্দু মুসলমানদের সামাজিক জীবনের মধ্যে অল্পবিস্তর পার্থক্য বরাবরই থেকেছে। কিন্তু সে পার্থক্যগুলি মোটেই মৌলিক নয় এবং সেগুলির কারণেই মূলতঃ হিন্দু-মুসলমান বিভেদের উৎপত্তি হয়নি। ভারতবর্ষে মোগল আমলে উচ্চশ্রেণীর যে মুসলমানেরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং যাঁরা ইংরেজ রাজত্বে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন, তাঁরা নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষার্থে এক ঝুড়ি মিথ্যার জন্ম দান করেছিলেন। এই মিথ্যা প্রচারণার ফলে সামগ্রিকভাবে মুসলমানরা কতকগুলি ভুল করে বসেন। এ জাতীয় ভুল ইতিহাসে শুধু যে মুসলমানরাই করেছিলেন, তা নয়। তুলনীয় অবস্থায় এ জাতীয় ভুল করাটাই নিয়ম এবং না করাই ব্যতিক্রম। এজন্যে সাধারণ মুসলমানেরা শুধু যে ইংরেজ রাজত্বের প্রথম দিকেই এ ধরনের মিথ্যার মোহে আচ্ছন্ন ও বিভ্রান্ত হয়েছিলেন তা নয়। এ বিভ্রান্তি তাঁদের ইংরেজ রাজত্বের শেষ পর্বেও হয়েছিলো। এই মিথ্যার মহিমাতেই বাঙলাদেশের সাধারণ মুসলমান কৃষক-শ্রমিকরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার কথা চিন্তা করে সমবেত হয়েছিলেন মুসলিম লীগের পতাকাতলে।
ইংরেজ রাজত্বের প্রথম অধ্যায়ে ক্ষয়িষ্ণু মুসলমান সামন্তশক্তি এবং তাদের তাবেদাররা যে মিথ্যাগুলি প্রচার করেছিলো তার মধ্যে প্রধান ছিলো ‘মুসলমানদের’ সাম্রাজ্য হারানোর কথা। মোগল সাম্রাজ্যের দেশীয় চরিত্রকে অগ্রাহ্য করে তার ধর্মীয় চরিত্রের উপরই এক্ষেত্রে তারা গুরুত্ব আরোপ করেছিলো। অর্থাৎ তাদের মতে মোগল সাম্রাজ্য আসলে ভারতীয় ছিলো না, ছিলো মুসলমানদের রাজ্য। কাজেই ইংরেজ রাজত্বে সমস্ত মুসলমান সমাজই হলো রাজ্যহারা ‘রাজার জাতি’ থেকে তারা পরিণত হলো প্রজার জাতিতে।
ইংরেজ রাজত্বের প্রতি সাধারণ হিন্দুদের এই মনোভাবের কোন কারণই ছিলো না, তাই তারা নোতুন পরিস্থিতির সাথে সহজেই নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিলো। এজন্যেই মুসলমানদের সাথে ইংরেজ এবং সেই সঙ্গে হিন্দুদের শুরু হলো এক বৈরিতার সম্পর্ক।
অধিকৃত অবস্থায় ইংরেজদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক তিনটি পর্যায় উত্তীর্ণ হয়। প্রথম পর্যায়ে বৈরিতা, দ্বিতীয় পর্যায়ে সহযোগিতা এবং তৃতীয় ও শেষ পর্যায়ে আবার বৈরিতা। ইংরেজদের সাথে হিন্দুদের এই সম্পর্কের প্রধানতঃ দুই পর্যায়। প্রথম পর্যায়ে সহযোগিতা, দ্বিতীয় পর্যায়ে অসহযোগিতা ও বৈরিতা।
কাজেই মুসলমানরা ইংরেজদের বিরোধিতা করেছে এবং হিন্দুরা তাদের পদলেহনে ব্যস্ত থেকেছে, এ তথ্যবিবৃতি মোটেই ঐতিহাসিক নয়। ইংরেজদের সাথে যে সহযোগিতার প্রয়োজন হিন্দুরা প্রথম দিকে অনুভব করেছিলো, সেই সহযোগিতার আবেদনেই স্যার সৈয়দ আহমদ, নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখ মুসলমান নেতারা ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। কাজেই ইংরেজদের সাথে সহযোগিতা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কেই করতে হয়েছে। শুধু এখানেই শেষ নয়। যে শ্রেণীর হিন্দুরা ইংরেজদের সাথে এই সহযোগিতা করেছে সেই শ্রেণীর মুসলমানরাই এগিয়ে গেছে সেই একই সহযোগিতার উদ্দেশ্যে। আবার যে মুসলমান সামন্ত ভূস্বামী এবং ফৌজী আমলারাও ইংরেজদের বিরোধিতা করেছিলো, সেই শ্রেণীর হিন্দু সামন্ত ভূস্বামী এবং ফৌজী আমলারাও বিরোধিতা করেছিলো ইংরেজদের। এ কথাও ঐতিহাসিক সত্য এবং ১৮৫৭ সালের সিপাহী অভ্যুত্থানই তার সর্বপ্রধান উদাহরণ।
ইংরেজদের সাথে হিন্দুদের যে সহযোগিতার কথা বলা হয় সেটা পুরাতন হিন্দু সামন্ত শক্তির থেকে আসেনি এবং তা আসেনি বলেই তারা ব্যবস্থা করেছিলো ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের। এ প্রয়োজন বাঙলাদেশে বিশেষভাবে অনুভূত হওয়ায় এখানেই তারা সে ব্যবস্থা কায়েম করেছিলো। এর ফলে যে রাজস্ব আদায়ের সুবিধা হয়েছিলো তা অস্বীকারের উপায় অথবা প্রয়োজন কোনটাই নেই। কিন্তু এছাড়াও তাদের প্রধান রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিলো নোতুন একটি পরাভূত দেশে তাদের সমর্থক ও সাহায্যকারী একশ্রেণীর কায়েমী স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করা। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে যে জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব হলো, তারা হিন্দু-মুসলমান, যাই হোক, তাতে ইংরেজের কোন আপত্তি ছিলো না। কিন্তু বাস্তবতঃ দেখা গেলো যে তাদের মধ্যে বিপুল অধিকাংশই হলো হিন্দু। ইংরেজদের মুসলমান বিরোধিতার ফলে সেটা হয়নি। তার আসল কারণ, নোতুন বন্দোবস্ত নেওয়ার জন্যে যে টাকার দরকার, সেটা মুসলমানদের হাতে ছিলো না। শুধু মুসলমানদের কেন, মোগলযুগের হিন্দু জমিদার ফৌজী অফিসার অথবা আমলাদের পরিবারভুক্ত লোকদের হাতেও সে টাকা ছিলো না।
যে সমস্ত হিন্দু নোতুন ব্যবস্থায় জমিদার হলো তাদের পূর্ব পুরুষরা জমিদার ছিলো না। তারা ছিলো প্রধানতঃ বেনিয়ান মহাজন শ্রেণীভুক্ত। মহাজনী ও ব্যবসার দ্বারা অর্থ উপার্জনের ফলে তাদের হাতে নগদ টাকা ছিলো এবং সেই অর্থ দিয়েই তারা নোতুন বন্দোবস্তে জমিদারি স্বত্ব লাভ করেছিলো। মুসলমানরা ধর্মীয় নিষেধের জন্যে সুদের কারবার থেকে বিরত থাকার ফলে তাদের হাতে এ জাতীয় অর্থ ছিলো না, কাজেই তারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলভোগ থেকে বঞ্চিত হলো।
এর থেকে কিন্তু একথা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, মুসলমানদের সাথে হিন্দু এবং ইংরেজদের সংঘর্ষ ও মনোমালিন্যের প্রধান কারণ ধর্মীয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তু সম্পর্কে উপর্যুক্ত বক্তব্যের পর এই মন্তব্যকে প্রথম দৃষ্টিতে স্ববিরোধী মনে হলেও মন্তব্যটিকে বিশ্লেষণ করলে তার অর্থ বোঝা সহজ হবে।
মোগল, পাঠান ইত্যাদি মুসলমান আমলে উচ্চ ও মধ্য শ্রেণীর মুসলমানদের সর্বপ্রকার বাণিজ্যিক, সামন্ততান্ত্রিক ও আমলাতান্ত্রিক শোষণকার্যের সুবিধার ফলে তাদের মধ্যে মহাজনী সুদী কারবারের দ্বারা অর্থ রোজগারের কোন তাগিদ ছিলো না। এজন্যেই সুদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে তাদের অসুবিধা হতো না। কিন্তু আফগানিস্তানের অনুর্বর ভূমি এবং দুরূহ জীবনযাত্রা সুদের প্রতি সে দেশের সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে অন্যভাবে গঠন করেছিলো। তাদের আর্থিক কাঠামোর বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে কেন সেখানকার সাধারণ মুসলমানরাও অনেকে বিদেশে সুদী কারবারে অভ্যস্ত। এই সুদখোর কাবলীওয়ালারা মুসলমান নয়, একথা বললে ভুল করা হবে। একদিকে তারা সুদ গ্রহণ থেকে বিরত থাকার কোন কারণ যেমন দেখে না, অন্যদিকে তেমনি কোথাও ইসলামের সামান্য অবমাননা ঘটলে তারা জীবন দান করতে পর্যন্ত প্রস্তুত থাকে।
কিন্তু শুধু কাবলীওয়ালারা কেন, আমাদের দেশের মুসলমানরা মোগল-পাঠান আমলে সুদ খেতো না, একথা সত্যি হলেও মুসলমানরা যে সুদ একেবারে না খাওয়ার পক্ষপাতী, সেটাও ঠিক নয়। পূর্বে যে কাজ তাদের দ্বারা সম্ভব হতো না, বর্তমানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সে কাজই তাদের দ্বারা সম্ভব হচ্ছে। আলী আশরাফ সাহেবদের মতো বিপুলসংখ্যক পরহেজগার মুসলমান “ইসলামী’ রাষ্ট্র পাকিস্তানের ব্যাংকসমূহে নিজেদের টাকা রেখে তার থেকে উপযুক্ত সুদ নিতে আজ আর আপত্তি করছেন না। কাজেই বৈজ্ঞানিক বিচার- বিশ্লেষণের পথে অগ্রসর হলে দেখা যাবে যে, মুসলমানদের সুদ খাওয়া-না-খাওয়ার বিষয়টি কোন অলঙ্ঘ্য নিয়মে বাধা অথবা মৌলিক ব্যাপার নয়। মুসলমানরা সুদ খাবে, কি খাবে না, সেটা নির্ভর করবে ঐতিহাসিক পরিস্থিতির উপর। সামন্ততান্ত্রিক মোগল সাম্রাজ্যে এবং ইংরেজ রাজত্বের প্রারম্ভে সুযোগ ও প্রয়োজনের অভাবে যে কাজ করতে তারা নারাজ ছিলো, পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তারা সে কাজ করতে রাজী। দু’চারজন নগণ্য ব্যতিক্রম ব্যতীত এদিক দিয়ে এখন হিন্দু-মুসলমান বিত্তশালী লোকদের মধ্যে ধর্মপার্থক্য সত্ত্বেও কোন তফাৎ নেই।
এজন্যেই পূর্বে উল্লেখ করেছি যে, হিন্দু-মুসলমানদের অনেক পার্থক্য আমাদের চোখে পড়ে এবং সেগুলি সত্য হলেও তা কোন অর্থেই মৌলিক নয়, সর্বাংশে পরিবর্তনসাপেক্ষ এবং দেশকালের উপর নির্ভরশীল। সুদ খেতে ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানের পরহেজগার মুসলমানরা আজ আপত্তি করেন না, কিন্তু ইচ্ছা সত্ত্বেও সেই সুদ খাওয়ার মতো সাহস মোগল যুগের সামাজিক অবস্থায় ধর্মে অবহেলাকারী কোন মুসলমানেরও ছিলনা। যে ধর্মীয় অনুশাসন সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় আর্থিক জীবনকে পর্যন্ত কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতো, সেই অনুশাসনই নোতুন ও বৃহত্তর আর্থিক ব্যবস্থায় যে ধর্মীয় আচরণ সম্ভব ছিলো, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেটা আর সম্ভব নয়।
এটা যে শুধু মুসলমানদের ক্ষেত্রেই ঘটেছে, তা নয়। ইউরোপীয় খৃষ্টানদের ক্ষেত্রেও ঠিক এই জিনিসই ঘটতে দেখা গেছে। সামন্তযুগে তারাও সুদ গ্রহণের দারুণ বিরোধী ছিলো। কিন্তু ইউরোপে বাণিজ্য ও শিল্পের প্রসার ও উন্নতির সাথে সাথে সুদের প্রতি তাদের মনোভাবও পরিবর্তিত হয়েছিলো এবং সুদ খাওয়ার ‘নিয়ত’ করে নিয়েই তারা প্রবৃত্ত হয়েছিলো সুদের প্রকারভেদ নির্ণয় দ্বারা সুদ সম্পর্কিত নিত্য নোতুন তত্ত্ব আবিষ্কারে যেমনটি আজকাল দেখা যাচ্ছে মুসলমান তাত্ত্বিকদের মধ্যেও। এখানে তত্ত্বটা আসল কথা নয়। আসল কথা হলো সুদ খাওয়ার সিদ্ধান্ত। সামন্ততান্ত্রিক আর্থিক জীবনে ভারতীয় মুসলমানদের যা প্রয়োজন ছিলো না, তাই প্রয়োজনীয় এবং অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ালো ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। এই প্রয়োজনের তাগিদেই সুদ সম্পর্কিত নানা নোতুন তত্ত্বের আবির্ভাব, ধর্মীয় তাগিদে নয়।
ইসলামী ধর্মশাস্ত্র মতে সুদের প্রশ্ন নিঃসন্দেহে মৌলিক। সেই সুদ খাওয়া অথবা না খাওয়ার প্রশ্নটি পর্যন্ত যখন দেশের আর্থিক অবস্থার উপর নির্ভরশীল, তখন চোগাচাপকান পরা, শুক্রবারে আদম সন্তানকে ভিক্ষাদান করা, ডিমকে আণ্ডা বলা, গোঁফ কামিয়ে দাড়ি রাখা ইত্যাদি মুসলিম সংস্কৃতির তথাকথিত বৈশিষ্ট্যগুলির বাস্তব ভিত্তি যে কত দুর্বল এবং অপসৃয়মান, সে কথা বলাই বাহুল্য।
অনেকের মতে, আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে লেখালেখির আর প্রয়োজন নেই, কারণ এদেশে তার প্রতাপ নিশ্চিহ্ন হয়েছে। এ জাতীয় বক্তব্য সত্যি হলে সুখের বিষয় হতো কিন্তু বাস্তব অবস্থার দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, সাম্প্রদায়িকতার শক্তিকে অবহেলা করা অথবা তার সম্পর্কে উদাসীন থাকার মতো অবস্থা আমাদের দেশে এখনো সৃষ্টি হয়নি।
একথা অবশ্য অনস্বীকার্য যে, সাম্প্রদায়িকতার চরিত্র ও ভূমিকা পূর্বের তুলনায় অনেকাংশ পরিবর্তিত হয়েছে। এবং এই পরিবর্তনই অনেকের মনে উপরোক্ত বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্যে দায়ী। স্বাধীনতার পূর্বে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার মুনাফাভোগী ছিলো সমগ্র হিন্দু মুসলমান বুর্জোয়া শ্রেণী। তাতে কৃষক-শ্রমিকের কোন লাভ ছিলো না। কিন্তু তবু তারা সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলির সাথে যুক্ত হয়েছিলো বিভ্রান্তিকর প্রচারণার ফলে। এর দ্বারা আর্থিক দাবীদাওয়ার ভিত্তিতে যে সমস্ত আন্দোলন অথবা দাঙ্গা হাঙ্গামা হতো, সেগুলোকেও সাম্প্রদায়িক বলে চালিয়ে দেওয়া হতো। এই প্রচেষ্টা ঊনিশ শতকের আশির দশক থেকে আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে।
যে কোন আন্দোলনের সাফল্যের জন্যে বাস্তব ও বিষয়ীভূত, এই দুই অবস্থা সৃষ্টির প্রয়োজন। প্রথম অবস্থা ব্যতীত দ্বিতীয় অবস্থার উদ্ভব সম্ভব নয়, কাজেই সেদিক থেকে তার গুরুত্ব মৌলিক হলেও দ্বিতীয়টি ব্যতীত কোন আন্দোলনকেই তার সঠিক পরিণতির দিকে এগিয়ে নেওয়া চলে না। এই বিষয়ীভূত অবস্থা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের গুরুত্ব সর্বাধিক। সাংস্কৃতিক আন্দোলন বলতে অবশ্য এক্ষেত্রে শুধু সাহিত্য-সঙ্গীত-নৃত্যচর্চা না বুঝিয়ে বোঝায় সমগ্র মানসিক পরিমণ্ডলকে উপযুক্তভাবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা।
স্বাধীনতাপূর্ব যুগে সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে হিন্দু-মুসলমান বুর্জোয়ারা তাদের শ্রেণীগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে যে আন্দোলন করেছিলো সেখানে প্রয়োজন ছিলো উপযুক্ত মানসিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে কৃষক শ্রমিকের দৃষ্টিকে যথাসম্ভব শ্রেণী-সংগ্রামের পথ থেকে বিচ্যুত করে তাকে সাম্প্রদায়িক কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ রাখা। এইভাবেই মালাবারের মোপলা উত্থানকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে ১৯২১ সালের গণ আন্দোলনকে ধ্বংস করা হয়েছিলো। এইভাবেই বাঙলাদেশের কৃষকদের শ্রেণী সংগ্রামকে তিরিশের যুগের কৃষক আন্দোলনের ‘প্রাতঃস্মরণীয়’ নেতারা মধ্যবিত্ত স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে নিজেদের সাম্প্রদায়িক আবর্তের মধ্যে সুকৌশলে আকর্ষণ করেছিলেন। সেই একইভাবে স্বাধীনতা উত্তরকালে সাম্প্রদায়িকতার আবর্তের মধ্যে পূর্ব বাঙলার জনসাধারণকে নিক্ষেপ করে মুসলিম লীগ সরকার তাদের জিহ্বা ছেদনের চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে যা সম্ভব হয়েছিলো, জবানের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়নি। তার প্রধান কারণ, জিহ্বা ও খাদ্যের সম্পর্ক যেমন ঘনিষ্ঠ – ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে সমগ্র আর্থিক জীবনের সম্পর্ক তেমনি নিবিড় এবং গভীর – এই সত্যের উপলব্ধি তাদের মধ্যে এসেছিলো। কাজেই শেষ পর্যন্ত ইসলামী তমদ্দুনের নামে উর্দুকে বাঙলা ভাষাভাষী পাকিস্তানীদের উপর চাপানোর সাম্প্রদায়িক প্রচেষ্টা এদেশে ব্যর্থ হলো। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের এখানেই অপরিসীম গুরুত্ব। এর মাধ্যমে পূর্ব বাঙলার মুসলমান মধ্যবিত্তরা সর্বপ্রথম লাভ করলো একটা নোতুন পরিপ্রেক্ষিত এবং তাদের মধ্যে এলো অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি ও রাজনীতি চর্চার এক নোতুন এবং অভূতপূর্ব প্রেরণা। এই প্রেরণা তাদের মধ্যে অকারণে আসেনি। স্বাধীনতাপূর্ব যুগে সাম্প্রদায়িকতার মূল ভিত্তি ছিলো মুসলমান মধ্যবিত্তের আর্থিক জীবনের বৈষম্য। এই বৈষম্য দূর করার জন্যেই প্রধানতঃ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা। তাই পাকিস্তানের নোতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হিন্দু মধ্যবিত্তের থেকে এ জাতীয় কোন বাধা বিপত্তির সম্ভাবনা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হলো। কিন্তু সে বাধা বিপত্তি নোতুন করে দেখা দিলো পশ্চিম পাকিস্তান কেন্দ্রিক বুর্জোয়া, আমলা, বেনিয়া, রাজনীতিকদের থেকে। কাজেই পূর্ব বাঙলার মুসলমান মধ্যবিত্তের দৃষ্টি হিন্দুদের থেকে ধীরে ধীরে অপসারিত হয়ে নিবদ্ধ হলো এই নোতুন উৎপাতের প্রতি। এভাবেই ১৯৪৭ সালের পর মুসলমান বাঙালী মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে সূত্রপাত হলো এক নোতুন চেতনার। এর ফলে এদেশের মধ্যবিত্তের জীবনে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মূল ভিত্তি অপসারিত হলো সত্যি কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত না হয়ে তা পরোক্ষভাবে জীবন্ত রইল এবং এই নোতুন পরিস্থিতিতে তার উৎসভূমি হলো পাকিস্তানের বৃহৎ বুর্জোয়া। এই স্বার্থের তাগিদেই আজ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতাকে জীবন্ত রাখা হয়েছে এবং সর্বক্ষেত্রের মতো সাংস্কৃতিক জীবনেও নানা প্রকার সাম্প্রদায়িক এবং অগণতান্ত্রিক আন্দোলনের আবর্তে ফেলে বিষাক্ত করে তোলার আয়োজন চলেছে। এজন্যে দেখা যায় যে, ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে পাকিস্তানে আমলা- বেনিয়া-বৃহৎ বুর্জোয়া প্ররোচিত সমস্ত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বাহ্যিক রূপ যাই হোক, তার প্রধান ভিত্তি হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা অর্থাৎ শ্রেণীস্বার্থ। এই সাম্প্রদায়িকতার অস্ত্র নিক্ষেপ করেই তারা ভাষাভিত্তিক জাতীয় চেতনাকে ধ্বংস করতে চায়। সেদিক থেকে এই শ্রেণীর ভূমিকা আজ পর্যন্ত অপরিবর্তিতই আছে।
সাধারণ মানুষের দৃষ্টির অন্তরালবর্তী এলাকা থেকে আজ সাম্প্রদায়িক চক্রান্তের দিক নির্দেশের ফলে অনেকে বিভ্রান্তিবশতঃ মনে করেছেন যে, এদেশে সাম্প্রদায়িকতার ক্ষতিসাধন-ক্ষমতা লুপ্ত হয়েছে। কিন্তু আমাদের বর্তমান সাংস্কৃতিক জীবনের বিবিধ আন্দোলনের বিশ্লেষণ করলে এই ভ্রান্তি সহজেই দূর হবে এবং এই কর্তব্যে গাফলতী দেখা দিলে এদেশে প্রগতিশীল আন্দোলন সর্বক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়বে।
এ বইয়ের প্রবন্ধগুলির মধ্যে ‘মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ এবং ‘ভাষা ও বানান সংস্কারের রাজনীতি’ দৈনিক সংবাদে, ‘বাঙলা ভাষায় বিদেশী শব্দ’ এবং ‘অক্টোবর বিপ্লব ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে’ সৃজনী শিল্পী ও সাহিত্য গোষ্ঠির সংকলন সৃজনী ও জয়ধ্বনীতে, ‘বাঙলা সাহিত্যে বিদেশী প্রভাব’ চট্টগ্রাম ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে প্রকাশিত সংকলন পদাতিকে, ‘গোর্কী জন্মশতবার্ষিকীতে’ রাজশাহী থেকে প্রকাশিত বনানীতে এবং ‘সমাজতান্ত্রিক চিন্তার ঐতিহাসিক পটভূমি’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত পত্রিকা ইতিহাসে ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে। শেষোক্ত প্রবন্ধটি অনেকাংশে ফ্রেডারিক এঙ্গেলসের ‘সমাজতন্ত্র : কল্পলৌকিক ও বৈজ্ঞানিক-এর অনুসরণে লিখিত। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র সম্পর্কে অবশ্য এতে কোন আলোচনা নেই কারণ সমাজতান্ত্রিক চিন্তার পটভূমি আলোচনাই প্রবন্ধটির উদ্দেশ্য। এই আলোচনার ফলে আমাদের দেশের বর্তমান সাংস্কৃতিক, আধিমানসিক ও রাজনৈতিক অবস্থাকে তার যথার্থ ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করার সুবিধা হবে বলে আশা করি।
বইটি ছাপার সময় শ্রীমান শুভ রহমান ও শ্রীমতি লুসিল সাদিকিন প্রুফ দেখার কাজে আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। মুদ্রক হিসাবে শ্রীমান সাদিকিনকে অনেক অতিরিক্ত ঝামেলা সহ্য করতে হয়েছে। শ্রীমান নিয়ামত হোসেন বইটির প্রচ্ছদ অল্প সময়ের মধ্যে এঁকে না দিলে এর প্রকাশনা আরও বিলম্বিত হতো। এদের সকলের কাছেই আমি কৃতজ্ঞ। ছাপার ব্যবস্থা করতে গিয়ে প্রকাশক শ্রীমান আবু নাহিদকে যে পরিশ্রম স্বীকার করতে হয়েছে তার জন্যেও আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ।
বদরুদ্দীন উমর
ঢাকা
২রা ডিসেম্বর ১৯৬৮
দ্বিতীয় সংস্করণের মুখবন্ধ
এদেশে সাম্প্রদায়িকতার মূল অর্থনৈতিক ভিত্তি পাকিস্তানী আমলেই অপসারিত হয়েছিলো এবং তার ফলে সেই আমলেই অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি এখানে প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিলো। কিন্তু সেই বিশেষ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব দ্রুত কমে এলেও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই যে কত দুর্বল ছিলো তা বাঙলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সুস্পষ্ট হলো। ভারত সরকার বিরোধিতার সাথে হিন্দু বিরোধিতা একাকার হয়ে এদেশে আবার নব পর্যায়ে উত্থান ঘটলো সাম্প্রদায়িকতার। সাংস্কৃতিক এবং আদর্শগত ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়কিতার বিভিন্নমুখী চরিত্র ও প্রভাব সম্পর্কে সজ্ঞান ও সচেতন হওয়ার গুরুত্ব যে পাকিস্তানী আমলের থেকে বাঙলাদেশে কিছুমাত্র কমেনি, উপরন্তু বৃদ্ধি পেয়েছে, এখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে সেটা বোঝার কোন অসুবিধে আর নেই।
সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতাতে যে সমস্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করা হয়েছে তার গুরুত্ব আমাদের সমাজে আগের মতই বর্তমান আছে। সেদিক থেকে বইটির পুনঃপ্রকাশ আশা করি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ অনেক আগেই প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু নানা বাস্তব অসুবিধার জন্যে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। দায়িত্ব নিয়ে এটি প্রকাশ করার জন্যে আমি আহমদ আতিকুল মাওলার কাছে কৃতজ্ঞ।
বদরুদ্দীন উমর
ঢাকা
০৭.০৯. ১৯৭৩
পঞ্চম সংস্করণের মুখবন্ধ
১৯৬৬ সালে সাম্প্রদায়িকতা, ১৯৬৭ সালে সংস্কৃতির সংকট, ১৯৬৮ সালে সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা নামে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর আমার তিনটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছিলো। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরী ছাড়ার চিন্তা ও পরিকল্পনা আগেই করেছিলাম, কিন্তু ওপরের তিনটি বই তৎকালীন শাসকশ্রেণী মহলে খুব বিরুদ্ধ ও ক্রুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলে আমি ১৯৬৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরী থেকে পদত্যাগ করি। আইনগতভাবে সরকার আমার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিতে না পারলেও অন্যভাবে আমার জীবন তারা দুর্বিষহ করেছিলো। যেহেতু চাকরী পরিত্যাগ করে রাজনৈতিক কাজে নিযুক্ত হওয়ার চিন্তা ও পরিকল্পনা আমার আগেই ছিলো, সে কারণে আমার নির্ধারিত সময়ের কিছু আগে হলেও সে সময় আমি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এসব কথা বলার উদ্দেশ্য হলো, ষাটের দশকে পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচরণের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কত প্রতিকূল ছিলো সেটাই প্রকাশ করা।
অনেকে আশা করেছিলেন যে, এ অঞ্চল থেকে পাকিস্তান উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর এদেশে একটি গণতান্ত্রিক সমাজের ও তার সাথে সমাজের সঙ্গতিপূর্ণ সাংস্কৃতিক পরিবেশের দেখা পাওয়া যাবে। কিন্তু আজকের বাঙলাদেশের দিকে তাকালে মনে হবে এখনকার পরিস্থিতি পাকিস্তানের পরিস্থিতির থেকেও অনেকাংশে রীতিমতো ভয়াবহ।
পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের সময় ধর্মীয় এবং জাতীয় প্রশ্ন মানুষের চেতনায় ক্রমশঃ বিচ্ছিন্ন হচ্ছিলো এবং তার ফলে পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ, যা ছিলো ধর্ম ও জাতীয়তার এক কৃত্রিম মিশ্রণ, দুর্বল হতে হতে শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে জাতীয় চিন্তা থেকে ধর্মীয় উপাদান বিযুক্ত হয়েছিলো। এ কারণেই বাঙলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ তার রাষ্ট্রীয় নীতির একটি হিসেবে সংবিধানে বিধিবদ্ধ হয়েছিলো।
কিন্তু এ অঞ্চল থেকে পাকিস্তান উচ্ছেদ হওয়া এবং ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার আইনতঃ নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তৎকালীন শাসকচক্র ১৯৭২ সালের পর থেকে নোতুন করে নানা কৌশলে কিভাবে আবার ধর্মকে রাজনীতি ক্ষেত্রে টেনে আনতে নিযুক্ত হয়েছিলো তার ইতিহাস সুবিদিত।
সরকারী অনুষ্ঠানে মিলাদ মাহফিল, রেডিও টেলিভিশনের প্রোগ্রামের শুরু ও শেষে খোদা হাফেজ বলা, মাদ্রাসা শিক্ষা উচ্ছেদ করে বিজ্ঞানসম্মত অভিন্ন পাঠ্যসূচীর ভিত্তিতে শিক্ষা ব্যবস্থা ধর্মনিরপেক্ষ করার পরিবর্তে মাদ্রাসা শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা, রাজাকার আলবদর ও জামাতে ইসলামীর সকল রকম অপরাধীদেরকে দেশ থেকে মুক্তি প্রদান করে তাদের প্রতি দেশ গড়ার আহ্বান জানানো, হিন্দুদের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ উচ্ছেদ না করে নোতুনভাবে অর্জিত সম্পত্তি বলবৎ করা ইত্যাদির মাধ্যমে রাজনীতিক্ষেত্রে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা আমদানীর পরিকল্পিত প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিলো। ১৯৭৫ সালের পর আওয়ামী লীগ পরবর্তী সরকারগুলির প্রত্যেকটি আওয়ামী লীগ অনুসৃত উপর্যুক্ত নীতি ও কার্যকলাপের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও সাধারণভাবে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যাপক ও প্রায় অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করে এসেছে। এদিক দিয়ে একুশ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে আসা নোতুন আওয়ামী লীগ সরকারও কোন ব্যতিক্রম নয়। ব্যতিক্রম হওয়ার কোন কারণও তাদের নেই এজন্য যে, বাঙলাদেশে ক্ষমতাসীন হওয়ার অব্যবহিত পর থেকেই আওয়ামী লীগ তাদের অনেক বাহ্য ঘোষণা সত্ত্বেও কার্যতঃ যে নীতি অনুসরণ করছিলো সেটা প্রকৃতপক্ষে কোন বিশেষ দলের নীতি ছিলো না। সেটা ছিলো বাঙলাদেশের নব্য শাসকশ্রেণীর শোষণ শাসন স্বার্থের প্রয়োজনে গঠিত এবং অনুসৃত নীতি। কাজেই সেই নীতির ধারাবাহিকতা যে তারা রক্ষা করবে, এমনকি পরিস্থিতি পরিবর্তনের সাথে সাথে পূর্ববর্তী অ-আওয়ামী লীগ সরকারগুলোর থেকে অধিক মাত্রায় ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার করবে তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এদিক দিয়ে বাঙলাদেশের পরিস্থিতির ক্রমশঃ অবনতিই ঘটছে।
এর অর্থ হলো, পাকিস্তানী আমলে এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ধর্মীয় উপাদানের যে প্রাধান্য ছিলো দীর্ঘ একটানা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ১৯৭১ সালে সেটা আর না থাকলেও সমাজের ভিত্তিভূমিতে, সাধারণ সংস্কৃতির মধ্যে, এমন কোন পরিবর্তন এবং ওলটপালট ১৯৭১ সালের যুদ্ধের মাধ্যমে হয়নি যার ফলে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার একেবারে বন্ধ হওয়া সম্ভব ছিলো।
এ প্রসঙ্গে আর একটি বিষয়ও উল্লেখ করা দরকার। ১৯৭২ সালে সংবিধানে আওয়ামী লীগ জাতীয়তাবাদকে বাঙলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতির অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিধিবদ্ধ করার মধ্যেই সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের বীজ নিহিত ছিলো, যদিও একই সঙ্গে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাও রাষ্ট্রীয় নীতির চার স্তম্ভের একটি হিসেবে গৃহীত হয়েছিলো।
এখানে একটু ব্যাখ্যা দরকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পর জার্মানী ও কোরিয়া এবং কিছু পরে ভিয়েতনাম দুইভাগে বিভক্ত হয়েছিলো। তাদের প্রত্যেকের একটি অংশে পুঁজিবাদী এবং অন্য অংশে সমাজতন্ত্রী ব্যবস্থা থাকলেও জার্মানী, কোরিয়া ও ভিয়েতনামের কোন অংশেই নিজেকে পৃথক জাতি হিসেবে বিবেচনা করে কোন জাতীয়তাবাদ প্রচার করেনি। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মৌলিক পার্থক্য সত্ত্বেও তাদের প্রত্যেকের দুই অংশই ছিলো একই মাটির অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু ১৯৭১ সালের পর বাঙলাদেশের বাঙালীদেরকে বাঙলাদেশ-বহির্ভূত বাঙালীদের থেকে পৃথক করে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে ঘোষণা করে এখানে একটি জাতীয় রাষ্ট্রের কথা বলা হলো। একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে যে, বাঙলাদেশ ও বাঙলাদেশ-বহির্ভূত অঞ্চলের বাঙালীদের মধ্যে জাতিগতভাবে কোন পার্থক্য না থাকলেও তাদের মধ্যে একমাত্র উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হলো, বাঙলাদেশের বাঙালীদের অধিকাংশ হলো মুসলমান এবং এখানকার শাসন ক্ষমতা এই মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্তদেরই হাতে। অর্থাৎ বাঙলাদেশী এবং অ-বাঙালীদের মধ্যে পার্থক্য হলো ধর্মীয়, অন্য কিছু নয়, এবং সামান্য পার্থক্য কিছু থাকলেও সেটা অনুল্লেখযোগ্য।
এ কারণে ১৯৭২ সালের সংবিধানে বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের যে জাতীয়তাবাদের কথা রাখা হয়েছে সে জাতীয়তাবাদ মুখ্যতঃ ও মূলতঃ হলো ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ। এই সত্যটি নানাভাবে আড়াল করার চেষ্টা হলেও আমি নিজে ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণীত হওয়ার সময় থেকেই বরাবর বলে এসেছি যে, আওয়ামী লীগের এই জাতীয়তাবাদ প্রকৃতপক্ষে এমন এক বাঙলাদেশী জাতীয়তাবাদ যার চরিত্র সাম্প্রদায়িক এবং এই জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে যে রাষ্ট্রের গঠন কাজ শুরু হয়েছে সেটা ১৯৪০ এর পাকিস্তান প্রস্তাবে ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমে যে দুই পাকিস্তানের কথা বলা হয়েছিলো তারই একটি ছাড়া অন্য কিছু নয়। অর্থাৎ ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত এখানে পূর্ব পাকিস্তান ছিলো পাকিস্তান রাষ্ট্রের একটি অংশ; কিন্তু ১৯৭১ সালে এই অঞ্চলে যে স্বাধীন বাঙলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে সেটা প্রকৃতপক্ষে হলো একটি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্র, যার নির্মাণকর্তা হলো আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্ব। এটা কোন অসম্ভব তত্ত্বচর্চা নয়। এ হলো এমন এক কঠিন বাস্তবতা যা অনেক বিজ্ঞ জাতীয়তাবাদীর পক্ষে মেনে নেওয়া খুবই কঠিন, এমনকি অসম্ভব।
১৯৭২ সালের সংবিধানে আওয়ামী লীগ যে সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় রাষ্ট্রের ভিত্তি নোতুনভাবে স্থাপন করেছিলো সেই রাষ্ট্রই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার বি.এন.পি. ও জাতীয় পার্টির সরকারের অনুসৃত নানা নোতুন নীতির মাধ্যমে বিকশিত হয়ে বর্তমানে এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রীর হাতে তসবী ও মাথায় কালো ধর্মীয় পট্টি শোভা পাচ্ছে!! বক্তৃতা শুরুর আগে প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখে ঘন ঘন উচ্চারিত হচ্ছে ‘বিসমিল্লাহ’!!!
এই পরিস্থিতিতে ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত আমার সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা নামক এই প্ৰবন্ধ সংকলনটির অর্থাৎ এতে আলোচ্য বিষয়গুলির গুরুত্ব কোন অংশেই কমেনি। পাকিস্তান আমলের মতো বাঙলাদেশ নামে এই নোতুন পূর্ব পাকিস্তানেও তার গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা আগের মতই আছে।
এই বইয়ের পঞ্চম সংস্করণ প্রকাশের জন্য লেনিন আজাদকে ধন্যবাদ।
বদরুদ্দীন উমর
রূপনগর, মীরপুর
ঢাকা।
১১. ২. ১৯৯৭