মুক্ত কারার গুপ্ত জ্ঞান
পশ্চিমবঙ্গের কারাগারগুলোর উপর থেকে লোকসংখ্যার চাপ কমানো এবং কয়েদীদের উপর কারাবাসের অশুভ প্রভাব দূরীকরণের জন্য কারা আইন সংস্কার কমিটি এই রাজ্যে ‘মুক্ত কারাগার স্থাপনের সুপারিশ করেন। কারামন্ত্রী শ্রীজ্ঞান সিং সোহনপাল সাংবাদিকদের এই কথাও কিছুদিন আগে জানিয়েছিলেন যে পশ্চিমবঙ্গের কারা দফতর এই প্রস্তাবটি বিবেচনা করে দেখার জন্য একটা স্পেশাল সেল গঠন করেছেন।
‘কারাগার, কারাবাস এবং কারাগৃহের আবাসিকদের সম্পর্কে আমাদের ধারণাই পালটে দেবে আমাদের এই মুক্ত কারাগার প্রকল্প।’ কারা বিশেষজ্ঞ শ্রীশোধন লাল জানালেন। ‘আমাদের মুক্ত কারা প্রকল্পে আমরা এমন সব ব্যবস্থা রেখেছি আমরা এমন সব ব্যবস্থা রেখেছি যেগুলি চালু হলে কয়েদী এবং অকয়েদীর শ্রেণীবৈষম্য ঘুচে যাবে। সামাজিক অস্পৃশ্যতা দূর হবে এবং কয়েদীরা হীনমন্যতার গ্লানিবোধ থেকে সম্পূর্ণ রূপে মুক্ত হয়ে আবার নানারকম অপরাধ করার মতো মনোবল ফিরে পাবে।
‘আমাদের প্রচলিত কারা ব্যবস্থার ত্রুটি কী ছিল?’ এই প্রশ্নের উত্তরে শ্রীশোধন লাল বলেন, ‘আমাদের প্রচলিত কারা ব্যবস্থার আগাগোড়া সবটাই ত্রুটিপূর্ণ। যেভাবে চলে আসছে এই ব্যবস্থা তাতে সরকারের লোকসান হচ্ছে প্রচুর, ভালো কোয়ালিটির অপরাধীদের আকর্ষণ করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি, কারাবাসকে যথেষ্ট জনপ্রিয় করে তুলতে পারা যায়নি। আরও অনেক দোষ এবং ত্রুটি আমাদের আছে এবং তার জন্য আমরা খুবই লজ্জিত।’
‘নিম্নমানের কয়েদীদের আধিক্যই কি আপনাদের বদনামের কারণ? ‘
‘একটা বড় কারণ তো বটেই,’ শ্রীশোধন লাল বললেন। তবে এর জন্য কিন্তু আমরা মোটেই দায়ী নই। আমাদের মস্ত বড় অসুবিধা কি জানেন? আমরা আমাদের পছন্দমত অপরাধীদের জেলে আবাসিক হিসাবে রিক্রুট করতে পারিনে। এ বিষয়ে আমরা বড়ই পরমুখাপেক্ষী। যা আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাদেরকেই আমাদের বাধ্য হয়ে গলাধঃকরণ করতে হয়। ফলে যত ছিঁচকে চোর, পকেটমার, বোকা ডাকাত, থার্ড ক্লাস বাটপাড় কি হঠকারী খুনে, এই সব এসে আমাদের ঘাড়ে চাপে। এদের যেমন বা বিদ্যের বহর, তেমনি বুদ্ধির বহর। এই কোয়ালিটির মাল দিয়ে যে-সব জেল ভরা, তাদের সুনাম কখনো হয়? বলুন?’
তা তো বটেই। কয়েদীই হল গে কারাগারের প্রাণ। সেই কয়েদীর মান উন্নত না হলে কারাগারের মান উন্নত হবে কী করে?
‘অথচ দেখুন, দেশে যে শিক্ষিত বুদ্ধিমান ভদ্রলোক অপরাধীর অভাব আছে, এটা তো আর বলতে পারবেন না।’
‘বাঃ! তা কী করে বলা যাবে?’
‘তবে! কিন্তু আমাদের প্রচলিত কারা ব্যবস্থার এই রকম জঘন্য পরিবেশে কোনও ভদ্রলোক আসতে চাইবে? বলুন?’
‘রাম কহো! এই রকম আন-কালচারড পরিবেশে কে আসবে মশাই।’
রাইট। সেইজন্যই তো আমরা কারাগারের কনসেপটটাই আমূল বদলে দিতে চাই। আমাদের মুক্ত কারার প্রকল্প তাই তো সম্পূর্ণ নতুন কনসেপটের উপর আমরা গড়ে তুলতে চাইছি।’
‘আপনাদের মুক্ত কারার ব্যাপারটা একটু বলুন তো শুনি।’
শ্রীশোধন লাল বললেন, ‘জেল বা কারাগার বলতে যে ছবি চোখে ভাসে অর্থাৎ বিরাট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটা জায়গা, উপরে কাঁটা তার, মাঝে মঝে পাহারাদারের টুঙি ঘর, সঙ্গীনধারী মোতায়েন সিপাই, জেলের তালাবন্ধ ফটক, তার ভিতরে ফটক, তার ভিতরে ফটক, তার ভিতরে তালা মারা ওয়ার্ড, তার ভিতরে কয়েদী, এসব কিছুই মুক্তকারায় থাকবে না।’
‘বটে! তবে কী থাকবে?’
‘বহুতলবিশিষ্ট আধুনিক ফ্ল্যাট। অপরাধীদের মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য ওন ইওর ওন ফ্ল্যাট বা নিজের ফ্ল্যাট নিজে কেনো স্কিম চালু করা যেতে পারে। আধুনিক শপিং সেন্টার, সিনেমা, থিয়েটার, রেস্তোরাঁ, সুইমিং পুল, মনোরম উদ্যান খেলার মাঠ বড় বড় রাস্তা, ট্রাম, বাস, মিনি বাস, ট্যাক্সি, পাতাল রেলের স্টেশন সব থাকবে। একেবারে পুরো সামাজিক পরিবেশ।
‘এতো চমৎকার বন্দোবস্ত। অপরাধীরা টেরই পাবে না যে তারা জেলখানায় আছে।’
‘সেই জন্যই তো এই মুক্ত কারা প্রকল্প করা মশাই। টের যাতে না পায় সেই জন্যই তো এত সব ব্যবস্থা করা। এই প্রকল্প ধোপে টিকবে কিনা তা যাচাই করার জন্য আমরা ভদ্রলোক অপরাধীদের ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে এই ধরনের মুক্ত কারায় রেখে দেখেছি তারা সব চমৎকার আছে। অদ্ভুত ভাবে তারা এই উন্নত ধরনের কারাগারের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। সব থেকে যা আমাদের আশ্চর্য করেছে তা এদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন।’
‘কী রকম? কী রকম?’
‘আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না, এই ধরনের সামাজিক পরিবেশে রাখলে অপরাধীদের কী আশ্চর্য পরিবর্তন হয়! কিছুদিনের মধ্যেই অপরাধীরা ভুলে যায় যে তারা সত্যিই কোনও অপরাধে লিপ্ত আছে। তারপর তাদের প্রতিবেশীরাও সে কথা ভুলে যায়। প্রচলিত জেলে যাদের রাখলে সমাজের যে-সব গেরস্থ লোকেরা তাদের সংস্রব বিষবৎ পরিত্যাগ করত, আমাদের এই নতুন ব্যবস্থায় সেইসব অপরাধীর সঙ্গে ওঠাবসা চলাফেরা এমন কি ছেলেমেয়ের বিয়ে দেওয়াটাও তারা সম্মানের কাজ বলে মনে করে।’
‘এতো দারুণ উন্নতি মশাই! তা এরা সব কোন ধরনের অপরাধী?’
‘অত্যন্ত উন্নত মানের। যদিও কেউ খুনী, কেউ ঠক, কেউ চোর, কেউ বা পকেটমার কিন্তু এদের টেকনিক এত উন্নত যে তা ধরে কার সাধ্য। ওই যে বললাম না, এরা নিজেরাও সে-কথা ভুলে যায়! কেউ মনে করে সে ব্যবসা করছে। এক একদিনে সে লক্ষ লোকের পকেট কাটে। কেউ ধরতে পারে! কেউ মনে করে সে অধ্যাপক, সে শিক্ষক। লক্ষ ছাত্রকে সে পঙ্গু করে দিচ্ছে। কারো সাধ্য আছে তা ধরে! তেমনি আবার কারো ধারণা সে শিল্পপতি, কেউ বা শ্রমিক নেতা, কেউ বা পদস্থ অফিসার, কেউ আইনের রক্ষক, কেউ বা মন্ত্রী, কেউ বিরোধী নেতা। আসলে সবাই মুক্ত কারার স্থায়ী আবাসিক। আমাদের পরীক্ষা এত সফল হয়েছে বলেই তো এবার ব্যাপকভাবে মুক্ত কারা প্রকল্প চালু করার সুপারিশ আমরা করেছি। গোটা পশ্চিমবঙ্গকেই আমরা মুক্ত কারায় পরিণত করে ফেলছি।’
‘তা বেশ করেছেন। তাহলে এবার পুরনো জেলগুলো কি ভেঙে ফেলবেন?’
‘খেপেছেন! যে-সব বোকা সোকা লোক এই নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে না, তাদের ছেড়ে রাখলে তারা সমাজের শান্তিভঙ্গ করবে না? হয়তো একজন মান্যগণ্য লোককে দেখে প্রকাশ্যেই চোর চোর বলে চেঁচিয়েই উঠল। এইসব লোকের চিকিৎসার জন্য আমরা পুরনো জেলগুলোকে কাজে লাগাব। মুক্ত কারায় যারা বাস করার উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে না তাদের আমরা ওখানে অনির্দিষ্টকাল পুরে রাখব। কেমন ব্যবস্থা?’
‘জবাব নেই।’
২৮ অগাস্ট ১৯৭৪