মুক্তি
প্রমথবাবু বললেন, ‘পুলিনবাবু, ভূত বলতে আপনি কী বোঝেন?’
‘দেহমুক্ত আত্মা। নশ্বর দেহের অস্তিত্ব না থাকলেও যে আবার দেহ ধারণ করে পৃথিবীর মানুষকে দেখা দেয়।’
‘কিন্তু আমি যদি ও-কথা না মানি? আমি যদি বলি, মৃত্যু হচ্ছে চিরনিদ্রা? মৃত্যুর পর মানুষের আত্মা আর জাগে না?’
আমি সবিস্ময়ে বললুম, ‘এ-কথা আপনি বলবেন কেমন করে? সকলেই জানে, আপনি হচ্ছেন একজন বিখ্যাত প্রেততত্ত্ববিদ। প্রেতের অস্তিত্ব না থাকলে আপনি প্রেততত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করে সময় নষ্ট করতেন না।’
প্রমথবাবু একটু হেসে বললেন, ‘প্রেততত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেই আমি এই সিদ্ধান্তে এসে উপস্থিত হয়েছি যে মৃত্যুর পরে মানুষের আত্মা চিরকালের জন্যে ঘুমিয়ে পড়ে। সে আর জাগে না, জাগতে পারে না।’
‘তাহলে মানুষ মরা লোককে আবার দেখতে পায় কেন?’
‘আপনারা যাকে বলেন ভূত, আমার মনে সেটা হচ্ছে প্রপঞ্চ বা ”ইলিউসান”।’
‘অর্থাৎ মিথ্যা মায়া।’
‘ঠিক তাই।’
‘তাহলে ভূত বলে কিছুই নেই?’
‘একটা-কিছু আছে বই কী! কিন্তু লোকে যাকে ভূত বলে আমি তাকে বলি চিন্তার মূর্তি।’
‘চিন্তার মূর্তি?’
‘হ্যাঁ।’
‘মানে বুঝলুম না।’
‘মুখের কথায় সহজে বুঝতে পারবেন না। তবে এইরকম মূর্তি যদি স্বচক্ষে দেখতে চান, আমি আপনাকে দেখাতে পারি।’
‘কোথায়?’
‘কাঁচড়াপাড়ায় একখানা বাড়ি ”হানাবাড়ি” বলে বিখ্যাত। প্রতি বৎসর কালীপুজোর রাত্রে সেখানে একই দৃশ্যের পুনরাভিনয় হয়। গেল বছরে আমি নিজে সেখানে উপস্থিত থেকে সেই দৃশ্য দেখে এসেছি। আর সাত দিন পরে এ বছরের কালীপুজো। আপনিও কি সেই দৃশ্য দেখতে চান?’
‘বিপদে পড়ব না তো?’
‘বিপদ? এরকম দৃশ্য দেখে মানুষ বিপদে পড়ে নিজেই ভয় পেয়ে। নির্ভীকের বিপদ নেই। বিশেষ, আমি যখন সঙ্গে আছি, ভূতের পড়বার বা ভয় পাওয়ার কোনো কারণই নেই।’
ভূত মানি, কিন্তু ভূত কখনো দেখিনি, আর দেখবার ভরসাও নেই। কিন্তু প্রমথবাবুর কথায় মনে জাগল কৌতূহল। একটু ইতস্তত করে রাজি হয়ে গেলুম।
দুই
কালীপুজোর দিন। বৈকাল বেলা। পুরাতন কাঁচড়াপাড়ার একটি প্রশস্ত রাজপথ। লোকজনের চলাচল খুব কম। সারি সারি বাড়ির-পর-বাড়ি, অনেক বাড়িই প্রাসাদের মতো বৃহৎ। কিন্তু প্রত্যেক বাড়িই পরিত্যক্ত, বাসিন্দারা ম্যালেরিয়ায় ভয়ে বসতবাড়ি ছেড়ে পলায়ন করেছে। বাড়িগুলোর চারদিক বেষ্টন করে আছে ঘন জঙ্গল। তাদের বিবর্ণ দেয়ালগুলো ফুঁড়ে আত্মপ্রকাশ করেছে অশ্বত্থ, বট ও নিম গাছের জঙ্গল। এই নিস্তব্ধ, নির্জন, মৃত শহরের ভেতর থেকে মাঝে মাঝে কেবল ভেসে আসছে ঘুঘুর করুণ কান্নার সুর।
ওমর খৈয়ামের লাইন মনে পড়ল—
রাজার বাড়ির থামের সারি আকাশ-ছোঁয়া তুলত মাথা,
রতন-মুকুট পরে হোথায় সোনার তোরণ ধরত ছাতা।
আজ সেখানে আঁধুল মায়ায় বিজন ছায়া দুলিয়ে দিয়ে
‘ঘুঘুঘুঘু’-র অকুল স্বরে গাইছে কপোত কাতর গাথা।
বললুম, ‘প্রমথবাবু, এমন জায়গায় ভূত থাকবে না তো আর কোথায় থাকবে বলুন?’
সে কথার কোনো জবাব না-দিয়ে একদিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে তিনি বললেন, ‘আমরা আজ ওই বাড়িখানার ভেতরে রাত্রিবাস করব।’
সে-খানাও মস্তবড়ো বাড়ি। তারও সর্বাঙ্গে আশ্রয় নিয়েছে বন্য গাছের দল এবং তাকেও লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে রীতিমতো একটি অরণ্য। বহুস্থলেই চুন-বালি খসে বেরিয়ে পড়েছে বুড়ো বাড়ির ইষ্টক কঙ্কাল! দেখলেই বুক ছাৎ-ছাৎ করে। মনে হয় ওটা যেন অভিশপ্ত বাড়ি। মানুষ হচ্ছে বসতবাড়ির আত্মার মতো। জনশূন্য বাড়ি দেখলে আমার আত্মাহীন মৃতদেহের কথা মনে হয়। হাহা করতে থাকে মন।
প্রমথবাবু বললেন, ‘চলুন, এখন আমার বন্ধু সুবোধের ওখানে গিয়ে উঠি। আমার চিঠি পেয়ে নিশ্চয়ই সে হানাবাড়ির একখানা ঘর আমাদের রাত্রিবাসের উপযোগী করে রেখেছে। সন্ধ্যা বেলাতেই আহারাদি সেরে নিয়ে যথাস্থানে উপস্থিত হয়ে যেকোনো দৃশ্য দেখবার জন্যে প্রস্তুত থাকব।’
তিন
দুজনেই একটা করে হারিকেন লন্ঠন হাতে নিয়ে, সাবধানে নড়বড়ে সিঁড়ি মাড়িয়ে দোতলায় উঠে একখানা ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলুম।
রাত তখন আটটা। এরই মধ্যে একেবারে নীরব হয়ে পড়েছে মানুষের কণ্ঠস্বর এবং আশপাশ থেকে ঝিল্লিরা শুরু করেছে তাদের কণ্ঠসাধনা। ঘুটঘুটে অন্ধকারমাখা রাত্রি, মাঝে মাঝে শোনা যায় বাদুড়দের ডানার ঝটপটানি।
প্রকাণ্ড হলঘর। পঙ্কের কাজ করা দেওয়াল অযত্নে মলিন। মার্বেল পাথরের মেঝে, কিন্তু তার ওপরে বিছানো আছে কত কাল ধরে সঞ্চিত ধুলোর আস্তরণ। কোথাও কোনো আসবাব নেই। জানলাগুলোর কোনোটা খোলা, কোনোটা বন্ধ।
ঘরের একটা কোণ আমাদের জন্যে পরিষ্কার করে রাখা হয়েছে। আর আছে দু-খানা ইজিচেয়ার।
আমার হাত ধরে প্রমথবাবু বললেন, ‘চলুন, পাশের ঘরখানা দেখে আসি।’
এ ঘরের ভেতর দিয়েই পাশের ঘরে যাওয়ার দরজা।
পুরু ধুলোয় ভরা ছোটো ঘর। আসবাবের মধ্যে একখানা শয্যাহীন সেকেলে পালঙ্ক। জানলাগুলো বন্ধ।
আচম্বিতে আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল, গায়ে দিলে কাঁটা! মনে হল এ-ঘরের বন্ধ বাতাসের মধ্যে সজাগ হয়ে আছে কোনো অজানা ও অদৃশ্য আতঙ্ক!
প্রমথবাবু ফিরে আমার কাঁধের ওপরে একখানা হাত রেখে শুধোলেন, ‘কিছু অনুভব করছেন?’
‘করছি।’
‘আমরা ছাড়া অন্য কারুর উপস্থিতি।’
‘হ্যাঁ।’
‘চলুন, হলঘরে গিয়ে বসি।’
হলঘরে এলুম। দুজনে দখল করলুম এক-একখানা ইজিচেয়ার। নিস্তব্ধতার মধ্য দিয়ে কেটে গেল প্রায় দশ-বারো মিনিট। কথা বলবার ইচ্ছেও হল না। মনের ভেতরে কেমন একটা অহেতুকী অস্বাচ্ছন্দ্য।
জানলার ভেতর দিয়ে বাইরের দিকে তাকালুম। কষ্টিপাথরের মতো জমাট অন্ধকার। থেকে-থেকে গায়ে এসে লাগছে একটা শীতার্ত বাতাসের কনকনে নিশ্বাস।
হঠাৎ মনে হল, আমার চোখের সামনে নেমে এসেছে যেন পাতলা কাচের মতো স্বচ্ছ পরদা এবং তারই ভেতর দিয়ে দেখছি ঘরের অন্য অংশটা।
প্রমথবাবুর দিকে ফিরে দেখলুম। কোনোদিকে দৃকপাত না-করে স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন তিনি।
তারপরেই সচমকে আমি নিজের পা দুটো চেয়ারের ওপরে তুলে ফেললুম।
প্রমথবাবু বললেন, ‘কী?’
‘আমার পা ধরে কে টানছে!’
‘টানছে?’
‘না, ঠিক তা নয়। আমি কারুর হাতের স্পর্শ পাইনি। কিন্তু কী এক আকর্ষণে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেও পা দুটো চেয়ারের তলায় চলে যাচ্ছিল!’
প্রমথবাবু একটু হেসে বললেন, ‘মনের ভ্রম ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা অস্বাভাবিক কিছু দেখবার আশায় অপেক্ষা করছি। এ-সময়ে ও-রকম মনের ভ্রম হতে পারে।’
হোকগে মনের ভ্রম। আমি আর নীচে পা নামালুম না।
চার
তারপর, এই খানিক আগে পাশের যে খালি ছোটো ঘরখানায় গিয়েছিলুম, তার ভেতর থেকে পেলুম দুটো গলায় আওয়াজ! একজন স্ত্রীলোক, ও একজন পুরুষ কথা কইছে অত্যন্ত উত্তেজিত স্বরে।
প্রমথবাবু শান্তভাবে বললেন, গেল বছর কালীপুজোর রাত্রেও আমি ওই দুটো গলার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলুম।
তাঁর মুখের কথা শেষ হতে-না-হতেই ভয়াবহ নারীকণ্ঠের আর্তনাদের-পর-আর্তনাদে রাত্রির স্তব্ধতা যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল! প্রথমে অত্যন্ত উচ্চস্বরে জেগে উঠে, তারপর ধীরে ধীরে মন্দীভূত হয়ে এল সে চিৎকার। একেবারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল আমার সর্বাঙ্গ।
হঠাৎ পাশের ঘরের দরজাটা খুলে গেল সশব্দে। ঝড়ের মতো বেগে বেরিয়ে এল একটা উন্মত্তের মতো বীভৎস মূর্তি! হাতে তার রক্তাক্ত শাণিত ছোরা! সে তাড়াতাড়ি ছুটে একটা জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, বাইরের দিকে ঝুঁকে পড়ে কী দেখলে, আবার দ্রুতপদে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে পড়ল, তারপর আবার ছুটে ফিরে এল ঘরের ভেতরে এবং পরমুহূর্তে ছোরাখানা সজোরে আমূল বসিয়ে দিলে নিজের বুকের ওপরে! তারপর মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বার কয়েক ছটফট করে মূর্তিটা স্থির হয়ে গেল। তার বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল ঝলকে ঝলকে রক্ত!
এক লাফে আমি চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠলুম উদভ্রান্তের মতো।
প্রমথবাবু বললেন, ‘ওকী, কোথা যান?’
আমি আর্তস্বরে বললুম, ‘এ দৃশ্য দেখবার পর আমি আর এখানে থাকতে পারব না।’
‘দৃশ্য? এখানে আর কোনো দৃশ্যই নেই। ফিরে দেখুন।’
ফিরে দেখে আমি একেবারে হতভম্ব। ঘরের ভেতরে কোথায় সেই ভয়ানক দৃশ্য, কোথায় সেই বীভৎস মূর্তি, কোথায় সেই রক্তের ধারা? কিছুই নেই, সব অদৃশ্য!
বাধো বাধো গলায় বললুম, ‘এতক্ষণ কি আমি স্বপ্ন দেখছিলুম?’
প্রমথবাবু বললেন, ‘প্রপঞ্চ। আর এখানে কিছুই দেখা যাবে না। নিন, এইবারে ইজিচেয়ারে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।’
‘অসম্ভব! এখানে আমার চোখে আর ঘুম আসবে না।’
‘উত্তম। তাহলে জেগে জেগে আমার নাসিকার সংগীত শ্রবণ করুন।’
পাঁচ
সকাল বেলায় প্রমথবাবু বললেন, ‘কত বছর আগে তা জানি না, এই বাড়িতে কালীপুজোর রাত্রে একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে হত্যা করেছিল। স্ত্রীর অর্তনাদ শুনে চারদিক থেকে পাড়াপড়শিরা এসে পড়ে। হত্যাকারী জানলা দিয়ে তাদের দেখে বাড়ির ভেতরের অন্য পথ দিয়ে পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু সে পথও বন্ধ দেখে শেষটা সে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়।’
আমি বললুম, ‘আমরা কি আজ তারই প্রেতাত্মা দেখলুম?’
‘প্রেতাত্মার নয়, তার চিন্তার মূর্তি।’
‘চিন্তার মূর্তি কী?’
‘উগ্র বা তীব্র বা প্রচণ্ড চিন্তা ঈথরের (ether) ভেতরে একটা ছাপ রেখে যায়। মানুষের দেহ নষ্ট হলেও ঈথরের ভেতরে সেই চিন্তার অস্তিত্ব লোপ পায় না। ক্ষেত্রবিশেষে নির্দিষ্ট দিনে আবার তা মূর্তি ধরে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।’
‘এ কী অসম্ভব কথা!’
‘বেতারে মানুষের কণ্ঠস্বর আর মূর্তি ধরে বিলাত থেকে এদেশেও পাঠানো হচ্ছে। তার রেকর্ড চিরস্থায়ী করে রাখা যায়। সেটা আপনারা অসম্ভব মনে করেন না। তবে ঈথারের মধ্যেই বা চিন্তার মূর্তি ধরে রাখা যাবে না কেন?’
আমি বৈজ্ঞানিকও নই, প্রেতত্ত্ববিদও নই, কাজেই এ-জিজ্ঞাসার জবাব দিতে পারলুম না।