মুক্তি, না মৃত্যু?
প্যাট্রিক হেনরি ছিলেন একজন আমেরিকান দেশপ্রেমিক। আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন তিনি। মানুষ তাঁকে মনে রেখেছে মুখ্যত তার সেই সুবিখ্যাত ঘোষণার জন্য; হয় আমাকে মুক্তি দাও, নয়তো দাও মৃত্যু। কট্টর কমিউনিস্ট-বিরোধীদের মুখে এই স্লোগানের অর্থ দাঁড়িয়েছে- যে দুনিয়ার কোনো মানুষ থাকবে না, সেই দুনিয়াই কমিউনিস্ট দুনিয়া হতে পারে। প্যাট্রিক হেনরি কিন্তু কথাগুলো উচ্চারণ করছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে। এক ন্যায্য উদ্দেশ্যের স্বপক্ষে প্রচার করছিলেন তিনি এবং ব্রিটিশদের বৈরিতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে উদ্দেশ্য সফল হতে পারত আমেরিকানদের জীবনের বিনিময়েই। সুতরাং তাঁর মৃত্যু আমেরিকানদের জীবনের বিনিময়েই। সুতরাং তাঁর মৃত্যু আমেরিকানদের মুক্তিকে কিছুটা অন্তত এগিয়ে আনতে পারত। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তার স্লোগানকে গ্রহণ করাটা অবশ্যই সঠিক।
কিন্তু এই স্লোগানকেই যখন কাজে লাগানো হয় পারমাণবিক যুদ্ধকে ন্যায্য প্রতিপন্ন করার জন্য, তখন পরিস্থিতিটা একবারেই ভিন্ন হয়ে যায়। পারমাণবিক যুদ্ধের ফল কি হবে আমাদের জানা নেই। যাবতীয় সামাজিক বন্ধন হারিয়ে ফেলা এক পৃথিবীতে ছড়ানো-ছিটানো কয়েক দল লুঠেরা হয়তো ঘুরে বেড়াবে। কিংবা সবথেকে ভালো যা ঘটতে পারে তা হলো: অত্যন্ত কঠোর স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু হবে এবং জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিসপত্রের যোগান পুরো পুরি বেঁধে দেওয়া হবে। হের্মান কাহ্ যিনি বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে পারমাণবিক যুদ্ধকে ন্যায্য বলে মনে করেন, বলেছেন যে এর পরিণতি হবে বিপর্যয়ের সমাজতন্ত্র (পৃঃ ৪৩৮)। পারমাণবিক যুদ্ধের পরিণতিতে যে জিনিসটা সম্ভবত পাওয়া যাবে না তা হলো মুক্তিযে-মুক্তি প্যাট্রিক হেনরি চেয়েছিলেন এবং তাঁর আধুনিক ভক্তরা চাওয়ার ভান করে থাকেন।
কোনো শুভ উদ্দেশ্যের জন্য প্রাণ দেওয়া অবশ্যই মহৎ ব্যাপার। কোনো শুভ উদ্দেশ্যের জন্য কেউ প্রাণ দিলে উদ্দেশ্যটা লক্ষ্যের দিকে আরও এগিয়ে যায়। যদি নিশ্চিতভাবে বোঝা যায় যে কারোর মৃত্যু উদ্দেশ্যকে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে দেবে না, তাহলে তা জেনেও সেই উদ্দেশ্যের জন্য প্রাণ দিতে চাওয়াটা যুক্তিহীন উন্মাদনা ছাড়া আর কিছু নয়। যারা প্রকাশ্যেই বলে বেড়ান কমিউনিস্টদের বিজয়ের থেকে মানবজাতির বিলুপ্তিই তাঁদের কাছে বেশি কাম্য, অথবা যারা বলে বেড়ান কমিউনিস্ট বিরোধীদের বিজয়ের থেকে মানবজাতির ধ্বংসই তাদের কাছে বেশি বাঞ্ছিত, তাঁদের ক্ষেত্রে এ কথাটা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। ধরা যাক কমিউনিজমের ঘোরতর শত্রুদের কথাটাই সত্যি, কমিউনিজম সত্যিই খুব খারাপ। কিন্তু ভবিষ্যতে তার উন্নত হয়ে ওঠাটা তো অসম্ভব কিছু নয়। ধরে নেওয়া যাক কট্টর স্তালিসপন্থিদের কথাটাই সঠিক, কমিউনজম-বিরোধী মতাদর্শ সত্যিই একটা জঘন্য ব্যাপার। কিন্তু সে মতাদর্শও তো ভবিষ্যতে উন্নত হয়ে উঠতে পারে। ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে অনেক ভয়াবহ একনায়কতন্ত্রের কথা জানতে পারি আমরা, কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেগুলো হয় পরিবর্তিত হয়েছে নয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পৃথিবীতে যতদিন মানুষ থাকবে, ততদিন অগ্রগতিও ঘটবে। কিন্তু কমিউনিজম বা কমিউনিজম-বিরোধী মতাদর্শ, কোনোটাই মৃতদেহময় পৃথিবীতে গড়ে তোলা যাবে না।
যারা মুক্ত দুনিয়ার কথা বলেন এবং কমিউনিজমের বিরুদ্ধে সবথেকে বেশি ঘৃণা ছড়িয়ে বেড়ান, তাঁদের নানান কাজকর্ম থেকে বোঝা যায় নিজেদের ঘোষিত নীতির প্রতি তাঁরা মোটেই খুন একনিষ্ঠ নন। ব্রিটিশ সরকার সম্প্রতি পর্তুগালের প্রতি মিত্রতার মনোভাব প্রকাশ করেছেন, যদিও পর্তুগাল এই মুহূর্তে অ্যাঙ্গোলার অশ্বেতকায় বাসিন্দাদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালাচ্ছে। ফ্রাঙ্কোর স্পেনে ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্রুশ্চেভের রাশিয়ার মতোই সীমিত, তথাপি পশ্চিমী দেশগুলো সবরকমে স্পেনের প্রতি মিত্রতা দেখিয়ে যাচ্ছে। ইঙ্গ-ফরাসি সুয়েজ অভিযানের উদ্দেশ্যটা হাঙ্গেরীয় বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য রাশিয়ার অভিযানের মতোই খারাপ ছিল, যদিও এই অভিযান ব্যর্থ হয়েছে বলে ক্ষতিটা অনেক কম হয়েছে। কিউবা গুয়াতেমালা আর ব্রিটিশ গায়নাতে পশ্চিমী দেশগুলো যে ধরনের কাজকর্ম করছে তা থেকে বোঝা যায় যে সম্ভব হলে এবং ওই দেশগুলোকে পশ্চিমী শিবিরের মধ্যে ধরে রাখার জন্য প্রয়োজন হলে সেখানকার বাসিন্দাদের আশা আকাঙ্ক্ষাকে পদ্দলিত করতে তারা ইতস্তত করবে না। সম্প্রতি আমেরিকায় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়াকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে–শাস্তির হাত থেকে রেহাই পাবেন একমাত্র তারাই যারা প্রমাণ করতে পারবেন কমিউনিজম যে একটা ধ্বংসাত্মক মতবাদ তা তাদের জানা ছিল না। এইসব স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অপরাধ ছাড়া আর কিছুই নয়। পরিস্থিতি যতই উত্তেজনাময় হয়ে উঠবে, ততই এ ধরনের অপরাধকে স্বাধীনতার পক্ষে আরও বেশি করে ন্যায্য বলে মনে করা হবে।
সাধারণত যতটা জানা যায় তার থেকে অনেক কঠোর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং সরকারি ভ্রান্ত প্রচার চালু আছে পশ্চিমী দেশগুলোয়। এইসব বিধিনিষেধ প্রাচ্যের সঙ্গে পশ্চিমের পার্থক্যকে কোনোভাবেই ঘুচিয়ে তো দেয়ইনি, বরং নিজেদের মুক্ত দুনিয়া হিসেবে দাবি করার পশ্চিমী বাগাড়ম্বরকে একটা হাস্যকর ব্যাপারে পর্যবসিত করেছে।
দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্রিটেনে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটিগুলোর কথা উল্লেখ করা যায়। এ রকম প্রতিটি ঘাঁটিতে যে বেশ কয়েকজন করে সুদক্ষ বৈমানিক আছেন এবং তারা এতটাই উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যে সতর্কবার্তা পাওয়ার দু-এক মিনিটের মধ্যেই বিমান নিয়ে আকাশে পাড়ি দিতে সক্ষম, সে-কথা কজন জানেন? ঘাটির কেন্দ্রস্বরূপ এই বৈমানিকদের ঘাঁটির অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখা হয়, অন্যরা এঁদের কাছে যেতে পারেন না। এঁদের আলাদা মেস, ডরমিটরি, লাইব্রেরি, সিনেমা ইত্যাদি আছে এবং ঘাঁটির অন্য আমেরিকানরা যাতে এঁদের কাছে পৌঁছতে না পারে তার জন্য অস্ত্রধারী প্রহরীও আছে। এক বা দু-মাস অন্তর কমান্ডার-সহ এই বাহিনীর প্রত্যেককে আমেরিকায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, তাদের জায়গায় আসে নতুন একদল বৈমানিক। এই বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা মূল ঘাঁটির অন্য আমেরিকানদের সঙ্গে প্রায় কোনো যোগাযোগ রাখতে পারে না, এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে তো একেবারেই নয়।
এই কঠোর গোপনীয়তার উদ্দেশ্য হলো একদিকে ব্রিটিশ নাগরিকদের এ ব্যাপারে কিছু জানতে না-দেওয়া, অন্যদিকে যেকোনো নির্দেশ বা প্রচারে ওই বাহিনীর সদস্যদের পুরোপুরি যান্ত্রিকভাবে সাড়া দেওয়ার ক্ষমতাটা বজায় রাখা তাদের গোটা প্রশিক্ষণটা যে উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখেই সাজানো হয়েছে। অধিকন্তু, এই বাহিনীকে কোনো নির্দেশ দেওয়ার অধিকার তাদের কমান্ডান্টের নেই, নির্দেশ আসে খোদ ওয়াশিংটন থেকে। ওয়াশিংটন যে সব নির্দেশ পাঠায়, সেগুলোর ওপর কোনো সংকটের মুহূর্তে ব্রিটিশ সরকারের কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ থাকতে পারে ভাবাটা নিছক আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। ওয়াশিংটন যেকোনো মুহূর্তে এমন কোনো নির্দেশও পাঠাতে পারে যার বদলা নেওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে সোভিয়েত রাশিয়া, আর তার ফলস্বরূপ এক ঘণ্টার মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ব্রিটেনের বাসিন্দারা।
আমেরিকায় সরকারের ক্ষমতা কতখানি তার জ্বলন্ত উদাহরণ হল ক্লদ ইদার্লির মামলা। হিরোশিমায় পরমাণু বোমা ফেলার সঙ্কেত দিয়েছিলেন এই ক্লদ ইদার্লি। তার মামলা থেকে এ-ও বোঝা যায় যে আজকের এই জগতে প্রায়শই আইন লঙ্ঘন করেই কোনো মানুষ নৃশংস কোনো অপরাধ করার হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। বোমাটির প্রতিক্রিয়া কি হবে তা ইদার্লিকে জানানো হয়নি। বিস্ফোরণের পর নিজের কৃতকর্মের প্রতিক্রিয়া দেখে আতঙ্কে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তারপর বেশ কয়েক বছর ধরে নানাভাবে আইন অমান্য করেন ইদার্লি। উদ্দেশ্য ছিল পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতার দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং নিজের অপরাধবোধের প্রায়শ্চিত্ত করা, কারণ কিছু না করলে ওই অপরাধবোধ তাকে মানসিকভাবে ধ্বংস করে দিত। এই অবস্থায় সরকারি কর্তারা তাকে উন্মাদ হিসেবে প্রতিপন্ন করার সিদ্ধান্ত নেন। সরকারের ধামাধরা একদল বিশিষ্ট মনস্তত্ত্ববিদ এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে ইদার্লিকে উন্মাদ হিসেবে ঘোষণা করেন। ইদার্লি অনুতপ্ত এবং তাকে উন্মাদ হিসেবে ঘোষণা করা হলো, ট্রম্যান অনুতাপহীন এবং তাকে উন্মাদ হিসেবে ঘোষণা করা হলো না। ইদার্লির বেশ কিছু বিবৃতি আমি দেখেছি যেখানে তিনি নিজের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন। এই বিবৃতিগুলোর মধ্যে কোথাও কোনো অপ্রকৃতিস্থতার লক্ষণ নেই। কিন্তু মিথ্যা প্রচারের ক্ষমতা এতই বেশি যে প্রায় প্রত্যেকেই, এমনকি আমি নিজেও, ইদার্লিকে পাগল বলেই ধরে নিয়েছিলাম।
ইদার্লির মামলা নিয়ে প্রচারের ফলে সম্প্রতি ওয়াশিংটনের অ্যাটর্নি জেনারেল বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেন। তার ফলে ছ-মাস ধরে সর্বাধিক নিরাপত্তা ওয়ার্ডে বন্দি থাকার পর হাসপাতালের একটা বিভাগে স্থানান্তরিত করা হয় ইদার্লিকে। সেখানে তাকে প্রচুর সুযোগসুবিধা দেওয়া হয় এবং বলা হয় আর কোনো শুনানি হবে না, কিছুদিনের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যাবেন তিনি। ছাড়া তিনি পাননি, তবে কিছুদিনের জন্য রেহাই পেয়েছেন।
আচ্ছা, এবার একটু দেখা যাক অ-আমেরিকান কার্যকলাপের জন্য হাউস কমিটির তদন্তের সময় কি ধরনের ব্যাপারস্যাপার ঘটে। ধরা যাক কোনো মধ্যবয়সী মানুষ এই কমিটির সামনে হাজিরা দিলেন এবং যে কোনো কারণে এই কমিটি তাকে অপছন্দ করে। এক্ষেত্রে যা ঘটে তা এইরকম:
প্রশ্ন : আজ থেকে তিরিশ বছর আগে, যখন আপনি ছাত্র ছিলেন, তখন। কোনো কমিউনিস্টকে চিনতেন?
উত্তর : চিনতাম।
প্রশ্ন: আপনি কি তাদের নামগুলো বলবেন?
উত্তর : না।*
[* অনেকের ধারণা, সিনেটর ম্যাকার্থি মারা যাওয়ার পর এ-ধরনের ঘটনা বন্ধ হয়ে গেছে। ধারণাটা আদৌ সত্য নয়। আমার জানা এ-ধরনের শেষ ঘটনাটা ঘটেছে। ১৯৬১ সালের ৪ এপ্রিল তারিখে। ওইদিন ঠিক এই ধরনের অভিযোগ এনেই এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল লোকসঙ্গীত-গায়ক পিট সিগারকে।]
হতভাগ্য মানুষটিকে তখন কংগ্রেস অবমাননার দায়ে কারাগারে পাঠানো হবে। বাঁচার উপায় একটাই-কমিটির সামনে নিজের বন্ধুদের নামগুলো বলে দেওয়া। তাদের সম্বন্ধে কিছু মিথ্যা অভিযোগ খাড়া করতে পারলে আরও ভালো হয়। এই কার্যপদ্ধতিকেও স্বাধীনতার পবিত্র নামে ন্যায়সঙ্গত বলে চালানো হচ্ছে।
এ-সব কথা বলে সোভিয়েত রাশিয়াকে আড়াল করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও আমার নেই। বিশেষত হাঙ্গেরি আর পূর্ব জার্মানিতে সোভিয়েত রাশিয়া যা করেছে, তাতে যাদের ওপর তারা অত্যাচার চালিয়েছে তাদের প্রতি রাশিয়ার চূড়ান্ত আশ্রদ্ধা আর নির্মমতাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পশ্চিমী দেশগুলোর মতো রাশিয়াকেও এখন ভণ্ডই বলতে হবে: পুরোপুরিভাবে রাশিয়ান সামরিক শক্তির মদতে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব জার্মানির সরকারকে চিহ্নিত করা হচ্ছে জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র নামে। কিন্তু প্রাচ্যের এই অপরাধ দিয়ে পাশ্চাত্যকে নির্দোষ হিসেবে প্রতিপন্ন করা যায় না। উভয় পক্ষই নিজেদের সবকিছুকে সঠিক বলে দাবি করে এবং দুটোই সমান ক্ষতিকর।
পারমাণবিক অস্ত্রের একটা ভয়ংকর দিক হলো–এ-অস্ত্র ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হলে শুধু যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদেরই বিপুল ক্ষতি হবে না, ক্ষতি হবে নিরপেক্ষদেরও। সুতরাং আত্মরক্ষার স্বার্থেই পারমাণবিক যুদ্ধকে প্রতিহত করার মৌলিক অধিকার নিরপেক্ষ দেশগুলোর আছে। বৈদেশিক বিরোধিতার সম্মুখিন হলে নিজেদের শাসনব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার অধিকার যে কোনো দেশেরই আছে, কিন্তু তাই বলে যে-সব দেশ এই বিবাদের বাইরে থাকতে চায় সেইসব দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করার কোনো অধিকার তাদের থাকতে পারে না। আমাদের মধ্যে অনেকেই কমিউনিজমকে অপছন্দ করেন, কিন্তু তা থেকে কি এমন যুক্তি খাড়া করা যায় যে ভারত ও আফ্রিকার যে অসংখ্য অধিবাসী শুধুমাত্র নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে টিকে থাকতে চান তাদের হত্যা করার অধিকার আমাদের আছে? এমন দাবি কি তোলা যায় যে এটাই হচ্ছে গণতন্ত্র? নিরপেক্ষ দেশগুলোকে তাদের সম্মতি ছাড়া কোনো বিবাদে জড়ানো যাবে না– এটাই কি গণতন্ত্রের দাবি নয়?
দৃষ্টান্তস্বরূপ বার্লিনের সমস্যাটার কথা ভাবুন। গভীর উদ্বেগের সঙ্গে আমি লক্ষ করছি আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়েই বারবার পারমাণবিক যুদ্ধের ব্যাপারে নিজেদের তৈরি থাকার কথা ঘোষণা করেছে কিন্তু সমস্যার কোনো সমাধানসূত্র উত্থাপন করেনি, কারণ সমাধান তারা চায় না। সারা পৃথিবীকে অকল্পনীয় আতঙ্কের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিতবাহী এই ধরনের ঘোষণাগুলোকে আদপেই বরদাস্ত করা যায় না। উভয় পক্ষই যে নাটক করে চলেছে, এইসব ঘোষণা তারই ফল। ক্রেমলিন অথবা ওয়াল স্ট্রিটের এই মন্দবুদ্ধি আসলে উভয় পক্ষের কট্টরদের এক ধরনের গোঁড়ামি এবং এই গোঁড়ামির ফলে উভয় পক্ষই যদি সুস্থবুদ্ধিসম্পন্ন ইতো, তাহলে তারা পরস্পরকে শত্রু বলে মনে করে হাইড্রোজেন বোমাকেই উভয় পক্ষের সাধারণ শত্রু হিসেবে বিবেচনা করত। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের একটা সাধারণ স্বার্থ আছে এবং সেই স্বার্থ হলো আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র যে সার্বিক ধ্বংসকে ডেকে আনতে পারে তার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া। কিন্তু উভয় পক্ষের দৃষ্টি পারস্পরিক ঘৃণায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে বলে এই সাধারণ স্বার্থটা তাদের নজরে পড়ছে না। আলোচনার সময় ঐক্যমত্যে পৌঁছানোর আন্তরিক ইচ্ছে কোনো পক্ষেরই থাকে না, অপর পক্ষের যে কোনো রকম কুটনৈতিক জয় ঠেকানোর কাজেই ব্যস্ত থাকে দুপক্ষ।
এই পারস্পরিক শত্রুতার পিছনে কিছু মানবিক আবেগ আছে, যার মধ্যে প্রধান হলো গর্ব, সন্দেহ, ভীতি এবং ক্ষমতালিপ্সা। আলোচনা যারা চালান তারা মনে করেন এমনকি যুক্তিসম্মত কোনো ছাড়াও না দেওয়ার মধ্যে তাদের গর্বিত হওয়ার হেতু আছে এবং এ ব্যাপারে স্বদেশের জনমতও তাঁদের সিদ্ধান্তকে সাধারণত সমর্থনই করে থাকে। উভয় পক্ষের বর্তমান মানসিকতা অপরিবর্তিত থাকলে সন্দেহও থাকবেই। এই সন্দেহের ফলে উভয় পক্ষই অপর পক্ষের যে কোনো বক্তব্যকে এক ধরনের ফাঁদ বলে মনে করে আর ভাবে অপর পক্ষ তাদের শয়তানি ধূর্ততার জাল বিছিয়ে আমাদের সরল আলোচনাকারীদের বিপথে পরিচালিত করবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভীতিও কোনো অযৌক্তিক ব্যাপার নয়। আর এই ভীতি থেকেই নানারকম যুক্তিহীন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়-ভীতি থেকে বহু ক্ষেত্রেই যা ঘটে থাকে। এবং তার ফলে বিপদের সম্ভাবনা আরও বেড়েই যায়। মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে এটা একটা সার্বজনীন ঘটনা যা মনস্তত্ত্ববিদদের কাছে খুবই সুপরিচিত। আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে অধিকাংশ মানুষই সুস্থ মস্তিষ্কে চিন্তা করতে পারে না, বরং পশুসুলভ সহজাত প্রবৃত্তির বশে কাজ করে। এক সময় আমার একটা গাধা ছিল। গাধাটা একটা আস্তাবলে থাকত। আস্তাবলে একদিন আগুন লেগে যায়। সেই সময় গাধাটা ওখান থেকে টেনে বার করে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসার জন্য বেশ কয়েকজন শক্তিশালী মানুষকে বিস্তর মেহনত করতে হয়েছিল। গাধাটাকে নিজের মতো করে থাকতে দিলে সে নির্ঘাত আতঙ্কে নিশ্চল হয়ে যেত এবং পুড়ে মরত। আজকের দিনের বৃহৎ শক্তিগুলোর অবস্থাও অনেকটা এইরকম। নিরস্ত্রীকরণের ব্যাপারে কথাটা বিশেষভাবে সত্য। উভয় পক্ষই প্রতিপক্ষের পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্রের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে আছে এবং নিজের পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্রের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে তুলে সেই আতঙ্কের হাত থেকে বাঁচতে চাইছে। তার প্রতিক্রিয়ায় বিপরীত পক্ষও নিজের পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভার বাড়িয়ে তুলছে। ফলস্বরূপ পারমাণবিক অস্ত্রের বিপদ হ্রাস করার জন্য যা কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তা সেই বিপদকে আরও বাড়িয়েই দিচ্ছে।
অযৌক্তিক নীতি অনুসরণ করার ব্যাপারে ভীতির থেকে ক্ষমতালিপ্সা সম্ভবত অনেক জোরদার চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে থাকে। ব্যক্তিগত আত্মম্ভরিতাকে একটা বদভ্যাস বলে মনে করা হলেও জাতিগত আত্মম্ভরিতার প্রচারকরা তাদের দেশবাসীদের কাছ থেকে শ্রদ্ধাই পেয়ে থাকে। ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে বড় বড় দেশগুলো তাদের ক্ষমতার সীমাকে স্বীকার করে নিতে না চাওয়ার ফলে ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছে। বিশ্বজয়ের খোয়ব আলেয়ার মতো একের পর এক দেশকে ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে গেছে। এর সাম্প্রতিকতম নজির হলো হিটলারের জার্মানি। ইতিহাসের পথরেখা ধরে পিছু হাঁটলে এ-রকম আরও অনেক নজির খুঁজে পাওয়া যাবে, যাদের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য হলেন নেপোলিয়ান, চেঙ্গিস খান এবং অ্যাটিলা। বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্বকে (Genesis) যারা প্রামাণ্য ইতিহাস বলে মনে করেন, তাঁরা এর প্রথম দৃষ্টান্ত হিসেবে কেইন-কে ধরতে পারেন: সে ভাবত অ্যাবেল সরে গেলে সেই শাসন চালাতে পারব ভবিষ্যতের মানুষের ওপর। ক্রুশ্চেভ যখন পাশ্চাত্যকে ধ্বংস করার হুমকি দেন আর ডালেস যখন বলেন উষ্ণযুদ্ধে আমরা জয় লাভ করতে পারি, তখন অতীতের একই ধরনের মূর্খতার দৃষ্টান্তগুলো মনে পড়ে যায় আমার।
শুধু মূর্খতা নয়, চরম মূর্খতা। এমনকি সঙ্কীর্ণতম আত্মস্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও ব্যাপাটাকে চরম মূর্খতা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। নিজের দেশে এবং সেই সঙ্গেই শত্রুর দেশে ধ্বংস, দুর্দশা আর মৃত্যু ছড়িয়ে বেড়ানোটা উন্মাদের কাজ। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য যদি নিজেদের মধ্যেকার বৈরিতার অবসান ঘটাতে পারে, তাহলে তারা তাদের বৈজ্ঞানিক দক্ষতাকে নিজেদের কল্যাণের কাজে লাগাতে পারবে, নিজেদের মূর্খতার ফলে ভীতির যে বোঝা তাদের ওপর চেপে বসেছে তার হাত থেকে মুক্তি পেতে পারবে। আসলে মানুষের অন্তরের মধ্যেই নিহিত থাকে অশুভ আকাঙ্ক্ষার দল। আতঙ্কের যে বিপুল উপকরণসমূহ তৈরি হয়েছে তা আসলে আমাদের সেই সব অশুভ আকাক্ষারই বাহ্যিক স্মারক। না-মানব জগতে চিরস্থায়ী বৈরিতা গড়ে ওঠার মতো কোনো কারণের অস্তিত্ব নেই। আমাদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা নিহিত থাকে মানুষের মনের গহনে, তাই মানুষের মনকে উন্নত করে তোলার পথ বেয়েই এ সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে।
অনেকে বলেন, যুদ্ধপ্রবৃত্তি মানবচরিত্রের অঙ্গ, আর মানবচরিত্রের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়। যুদ্ধের অর্থ যদি মানুষের চরম ধ্বংসই হয়, তাহলে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলা আর সত্যকে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না আমাদের। এ ধরনের কথা তারাই বলে যাদের দীর্ঘশ্বাসের আড়ালে লুকিয়ে থাকে ভণ্ডামি। কিছু কিছু মানুষ ও কিছু কিছু দেশের কাছে হিংসা যে খুব আকর্ষণীয় বস্তু, তা অনস্বীকার্য। কিন্তু মানবচরিত্রের অন্তর্নিহিত কোনো বৈশিষ্ট্যের দরুন এইসব মানুষ ও দেশকে সংযত করা অসম্ভব, এ এক অবাস্তব কথা। যে সব মানুষের মধ্যে নরহত্যার প্রবণতা থাকে তাদের ফৌজদারি আইনের সাহায্যে সংযত করা যায় এবং কাউকে হত্যা করতে না-পারার ফলে জীবন অসহ্য হয়ে উঠছে এমন অনুভূতি খুব কম জনেরই হয়। দেশের ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য যুদ্ধবাজরা তা স্বীকার না করলেও সত্যটা সত্যই থাকে। ১৮১৪ সালের পর থেকে সুইডেন আর কোনো যুদ্ধে জড়ায়নি। যুদ্ধ করতে না পারার অবদমিত প্রবৃত্তির চাপে ভুগছে, আমার পরিচিত সুইডিশদের মধ্যে এমন কারুর দেখা আমি পাইনি। শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতার এমন অনেক ধরন আছে যেগুলো মোটেই ক্ষতিকর নয়। এই ধরনের প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়েই তো মানুষের সহজাত প্রতিদ্বন্দ্বিতা-প্রবণতা পুরোপুরি তৃপ্ত হতে পারে। সভ্য দেশগুলোতে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে এমন অনেক সমস্যা দেখা দেয় যে সমস্যা দুটি ভিন্ন দেশের মধ্যে দেখা দিলে যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। গণতন্ত্রপ্রিয় রাজনৈতিকবিদরা আইন কর্তৃক আরোপিত বিধিনিষেধে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিবাদের নিষ্পত্তি করার মতো কোনো রাজনৈতিক সংস্থা থাকলে এবং তাকে মেনে চলতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা বাস্তব হয়ে উঠত। কিছুদিন আগেও ব্যক্তিগত নানান বিবাদের নিষ্পত্তি করা হতো দ্বন্দ্বযুদ্ধের সাহায্যে। দ্বন্দ্বযুদ্ধের সমর্থকরা বলত এই রীতি বন্ধ করে দেওয়াটা মানবচরিত্রের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়াবে। তারা ভুলে যেত, ঠিক যেমন আজকের দিনের যুদ্ধপন্থীরাও ভুলে যায়, যুদ্ধে মানবচরিত্র হচ্ছে মুখ্যত বিভিন্ন প্রথা, ঐতিহ্য ও শিক্ষার ফসল এবং সভ্য মানুষদের মধ্যে আদিম প্রবৃত্তির নিতান্ত সামান্য কিছু লক্ষণই শুধু টিকে থাকে। আগামী কয়েক প্রজন্মের সময়কালে পৃথিবীতে যদি কোনো যুদ্ধ না হয় তাহলে যুদ্ধ ব্যাপারটা ঠিক ততটাই অবাস্তব হয়ে উঠবে যতটা অবাস্তব হিসেবে দ্বন্দ্বযুদ্ধ আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়। নরহত্যার উন্মাদনাগ্রস্ত কিছু মানুষ তখনও রয়ে যাবে ঠিকই, তবে তারা আর সরকারের প্রধান হতে পারবে না।