মুক্তিপণ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
সদাপ্রসন্নবাবু সকালবেলাতেই তার চিঠির বাক্সে একখানা চিঠি পেয়ে খুবই উদবিগ্ন হয়ে পড়লেন। একখানা হুমকির চিঠি। তাতে লেখা : ‘মহাশয়, আপনার কনিষ্ঠ পুত্রটিকে আমরা হরণ করিয়াছি। তাহার মুক্তিপণ বাবদ পাঁচ লক্ষ টাকা প্রস্তুত রাখিবেন। আমার লোক গিয়া লইয়া আসিবে। পুলিশে খবর দিয়া লাভ নাই। ফুলুদারোগা দারোগাকুলের কলঙ্ক। তাহার মতো অপদার্থ লোকের সাধ্য নাই আপনার পুত্রকে উদ্ধার করে। টাকাটা জোগাড় হইলে বাড়ির মাথায় একটা সাদা নিশান উড়াইয়া দিবেন।’
সদাপ্রসন্নর মুখ শুকিয়ে গেল। বুক ঢিব-ঢিব করতে লাগল। তিনি কালবিলম্ব না করে কাঁপতে-কাঁপতে থানায় গিয়ে হাজির হলেন।
‘দারোগাবাবু, সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে।’
ফুলুদারোগা অতি ব্যস্ত সমস্ত মানুষ। সমাজে যত অপরাধ বাড়ছে, দারোগাদের ততই খাওয়া-দাওয়ার সময়ে টান পড়ে যাচ্ছে। এই তো পরেশবাবু আর তাঁর ভাড়াটে যজ্ঞেশ্বরবাবুর মধ্যে হাঙ্গামা বেধেছে। পরেশবাবু নাকি যজ্ঞেশ্বরকে ঘুসো মেরেছেন। পরেশবাবু বলেছেন, ‘ওটা মোটেই ঘুসো নয়, ঠুসো। সকাল থেকে ফুলুবাবু পাঁচখানা বাংলা অভিধান ঘেঁটে ঘুসো আর ঠুসোর তফাত খুঁজে বেড়াচ্ছেন। হরিদাসী মন্ডলের ছেলে বিরিঞ্চি সেই ক্লাস ওয়ান থেকে প্রতি ক্লাসে দু-বার ফেল মেরে তিনবারের বার পরের ক্লাসে ওঠে। এটাই নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ক্লাস সেভেনে ওঠার পর দু-বার ফেল মেরে এবার তিনবারের বার ন্যায্যত তার ক্লাস এইটে ওঠার কথা। কিন্তু কী এক রহস্যময় কারণে সেএবারেও ফেল মেরেছে বলে হরিদাসী ব্রজমাস্টারকে কেন গ্রেফতার করা হবে না, এই দাবি নিয়ে সকাল থেকে থানায় হত্যে দিয়ে পড়ে আছে। পালপাড়ার নবীনবাবুর অভ্যাস কাকভোরে উঠে বারান্দায় গুনগুন করে রামপ্রসাদী গাইতে-গাইতে পায়চারি করা। কিন্তু তিনি গান গাইতে শুরু করলেই পাশে গন্ধর্ববাবুর বাড়ির অ্যালসেশিয়ান কুকুরটা এমন ঘাউ-ঘাউ করে ওঠে যে, তাতে সুর ঘেঁটে যায়। সুতরাং তিনি মানবাধিকারের দাবিতে থানায় এসেছেন নালিশ করতে। গন্ধর্ববাবুও ছাড়ার পাত্র নন। তিনিও এসে বসে আছেন এই নালিশ নিয়ে যে, নবীনবাবু বেসুরো গলায় গান গাওয়ার চেষ্টা করেন বলেই কুকুরটা ওরকম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
এইসব নানা অভিযোগ ও পালটা অভিযোগে ব্যতিব্যস্ত ফুলুদারোগা সদাপ্রসন্নর আর্তনাদ শুনেও প্রথমটায় গা করেননি। কিন্তু চিঠিটা পড়ে তিনি খাড়া হয়ে বসলেন এবং রাগে কাঁপতে লাগলেন। দাঁত কড়মড় করে বললেন, ‘কী, এত বড়ো আস্পদ্দা?’
সদাপ্রসন্ন কাঁচুমাচু মুখে বললেন, ‘আমারও সেই কথা! লোকটার স্পর্ধাটা একবার দেখুন!’
ফুলুদারোগা একটা খাতা খুলে কলম বাগিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, ছেলে কবে থেকে নিখাঁজ বলুন তো?’
সদাপ্রসন্নবাবু আমতা-আমতা করে বললেন, ‘বলা মুশকিল!’
‘বয়স কত?’
সদাপ্রসন্ন ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। আমতা-আমতা করে বললেন, ‘বয়স বলা শক্ত।’
‘আহা, আপনি সঠিক না জানলে ছেলের মাকে জিজ্ঞেস করে আসুন না!’
‘আজ্ঞে, সেটা আরও কঠিন কাজ।’
‘কেন মশাই, কঠিন কেন? তিনি কি রাগ করে বাপের বাড়ি গিয়েছেন?’
‘আজ্ঞে, সেটা বললে মিথ্যে বলা হবে।’
‘তা হলে ছেলের নামটা বলুন।’
‘আজ্ঞে, নাম আর রাখা হল কই?’
‘ছেলের নাম নেই? এ তো বড়ো আশ্চর্য কথা!’
নাতবউ মালপো ভেজে দেয়নি বলে চুড়োমাধব দাস এফ আই আর করতে এসেছে নাতবউয়ের নামে। সেপাশ থেকে বলে উঠল, ‘‘আহা, ওর ছোট ছেলে যে মোটে হয়ইনি।’’
ফুলুবাবু চটে উঠে বললেন, ‘‘তা হলে যে চিঠিতে আপনার ছোট ছেলের কথা লিখেছে?’’
‘আজ্ঞে, ছেলেধরা লিখলে আমার কী করবার আছে বলুন?’
‘অ, বুঝেছি। তা হলে কি মেজো ছেলেকেই ধরে নিয়ে গিয়েছে বলতে চান?’
‘আজ্ঞে, সেটাও তো সম্ভব নয়।’
‘ছেলে হারালে বাপের মাথার ঠিক থাকে না জানি, তা বলে এই বিপদের সময় তথ্য গোপন করাও তো কাজের কথা নয়। আপনার মোট কয় ছেলে বলুন তো?’
সদাপ্রসন্ন বিষণ্ণ মুখে মাথা নেড়ে বললেন, ‘ছেলে আর হল কই?’
‘অ্যাঁ, ছেলেই হয়নি! তবে কি ছেলে মনে করে আপনার মেয়েকেই ধরে নিয়ে গিয়েছে?’
‘সেটাই বা বলি কী করে?’
মাধব আর থাকতে না পেরে বলে উঠল, ‘ছেলেপুলে আসবে কোথা থেকে? সদাপ্রসন্নর যে বিয়েই হয়নি এখনও।’
ফুলুদারোগা হাঁ হয়ে গেলেন, তারপর বললেন, ‘তা হলে চুরি হল কে? পুষ্যিপুত্তুর নয় তো?’
সদাপ্রসন্ন বিষণ্ণ বদনে বললেন, ‘আজ্ঞে, পুষ্যি আমার কয়েকজন আছে বটে, তবে পুষ্যিপুত্তুর নেই!’
ফুলুদারোগা ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ‘তা হলে এই চিঠিটার মানে কী?’
‘আজ্ঞে, সেইটে জানতেই আপনার কাছে আসা।’
ফুলুবাবু ভারী খাপ্পা হয়ে বললেন, ‘আমি কি মানে-বই যে, আমার কাছে মানে জানতে এসেছেন? ঘুসো আর ঠুসো নিয়ে সকাল থেকে গলদঘর্ম হচ্ছি মশাই, মানে-টানে বলা আমার কর্ম নয়। তবে এ চিঠি যে লিখেছে, তার আমি মুন্ডু ছিঁড়ে নেব।’
একটু ভরসা পেয়ে সদাপ্রসন্নবাবু বাড়ি ফিরতেই তাঁর পুরোনো কাজের লোক হলধর এসে বলল, ‘তোমার আক্কেলটা কী বল তো দাদাবাবু? কার ছেলে কে চুরি করেছে তার ঠিক নেই, তুমি কেন থানা-পুলিশ করে বেড়াচ্ছ?’
‘আহা, যার ছেলেই হোক, চুরি তো হয়েছে। সেটাও কি দুশ্চিন্তার কথা নয়? এখন পাঁচ লাখ টাকা আমি পাই কোথায় তাই ভাবছি!’
‘তার মানে? ও টাকা কি তুমি দেবে নাকি?’
‘আমার কাছেই চেয়েছে যে!’
হলধর চোখ কপালে তুলে বলল, ‘অনেক আহাম্মক দেখেছি বটে, কিন্তু তোমার মতো দেখিনি বাপু!’
সদাপ্রসন্ন হলধরের কথায় কান দিলেন না। বসে-বসে পাঁচ লাখ টাকা জোগাড়ের কথা ভাবতে লাগলেন। তাঁর কিছু সোনাদানা আছে বটে কিন্তু তা মেরেকেটে কুড়ি-পঁচিশ হাজার টাকা হতে পারে। পুকুরটা বেচলে বড়োজোর হাজার পঞ্চাশেক আসবে। আর থাকে বাড়িটা। জমিসহ এই পুরোনো বাড়িটার দাম লাখ-দুয়েক উঠলেই ঢের। সব বেচেও পাঁচ লাখ ছোঁয়া যাবে না। তাই সদাপ্রসন্নর দুশ্চিন্তা বাড়ল।
তিনদিন পর দ্বিতীয় চিঠিটা এল : ‘মহাশয়, আপনার কি অপত্যস্নেহ বলিয়া কিছু নাই? আপনার মতো পাষন্ড বাপ থাকিলে পুত্রকন্যাদিগের যে কীরূপ দুরবস্থা হয়, তাহা ভাবিয়া হৃদকম্প হইতেছে। তবে বলিয়া রাখি, আপনার খোকাটিকে দত্তক লইবার জন্য বিলাতের এক নি:সন্তান সাহেব-দম্পতি দশ লক্ষ পাউণ্ড দিতে প্রস্তুত হইয়া সাধাসাধি করিতেছেন। দশ লক্ষ পাউণ্ডে কত টাকা হয় তাহা হিসেব করিয়া দেখিবেন। খোকাটিকে বিলেতে পাচার করিলে জীবনে আর তাহাকে দেখিতে পাইবেন বলিয়া আশা করেন কি? কিন্তু আমরা অতটা পাষন্ড নহি। পিতৃহৃদয় কীরকম উতলা হয়, তাহাও আমরা জানি। অনুমান করি, আপনি এখনও পাঁচ লক্ষ টাকা জোগাড় করিয়া উঠিতে পারেন নাই। মাগ্গিগন্ডার বাজারের কথা বিবেচনা করিয়া আপনার সুবিধার্থে আমরা আমাদের দাবি এক লক্ষ টাকা হ্রাস করিলাম। চার লক্ষ টাকা দিয়া খোকাটিকে তাহার মায়ের কোলে ফিরাইয়া দিন। দয়া করিয়া সাদা নিশানটি উড়াইতে ভুলিবেন না।’
চিঠিটা পেয়ে বুকের ভার খানিকটা কমল সদাপ্রসন্নবাবুর। যাক, এক লাখ টাকাও তো কম নয়। তবে চার লক্ষ টাকার জোগাড়ও শক্ত কাজ। কয়েকদিন ধরে খাওয়া-দাওয়া খুবই কমে গিয়েছিল তাঁর। এই চিঠি পাওয়ার পর দুপুরে এক মুঠো বেশি ভাত খেয়ে ফেললেন।
সদাপ্রসন্নর বুড়ি পিসির বয়স নব্বইয়ের উপর। চোখেও ভালো দেখেন না, কানেও ভালো শোনেন না। কাঁপা-কাঁপা গলায় বললেন, ‘ও বাবা সদু, বিয়ে বসলি, ছেলেপুলেও হল, কিন্তু বুড়ি পিসিটা পাশের ঘরে থেকেও টের পেল না বাপ! এ তোর কেমন ব্যাভার? বিয়ের ঢাকঢোল কানে এল না, রোশনচৌকি দিলি, হাজার লোক খাওয়ালি, রোশনাই ছিল, নতুন বউ এল, কিচ্ছুটি টের পেলুম না তো! এখন শুনছি, তোর ছোটো খোকাটাকে নাকি ধরে নিয়ে গিয়েছে? এসব কী কান্ড বুঝিয়ে বল তো বাছা!’
পিসিকে বোঝাবার চেষ্টা করা বৃথা। সদাপ্রসন্ন বরং টাকা জোগাড় করবার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু যাচাই করে দেখলেন, ঘরের সোনাদানার দর দশ হাজারও হচ্ছে না। পুকুরের দর উঠল মাত্র তেরো হাজার আর বাড়ির দর সত্তর হাজারও ছুঁতে পারল না।
গভীর রাতে উঠে একটা শাবল নিয়ে বাড়ির মেঝে ঠুকতে লাগলেন সদাপ্রসন্ন। পুরোনো বাড়িতে অনেক সময় গুপ্তধন পাওয়া যায় বলে শুনেছেন। যদি ঘড়া দু’য়েক মোহর পাওয়া যায়, তা হলেই মার দিয়া কেল্লা!
আরও দিন তিনেক বাদে তৃতীয় চিঠিও এসে হাজির: ‘মহাশয়, বাড়িতে কি এক টুকরা সাদা কাপড়ও জুটিল না? যদি না জোটে তবে একটি ধুতি উড়াইয়া দিলেও চলিবে। আমরা অবিবেচক নহি। বুঝিতেছি, চার লক্ষ টাকাও আপনার জোগাড় নাই। কাজটা সহজও তো নহে। যাহা হউক, সব দিক বিবেচনা করিয়া এবং আপনার মুখ চাহিয়া আমরা দাবির অর্থ আরও কমাইয়া দিলাম। তিন লক্ষ পাইলেই আমরা এখন খোকাটিকে ছাড়িয়া দিব। আমাদের দিকটাও দেখিবেন। খোকাটির ভরণপোষণের ব্যয় নিতান্ত কম নহে। দুই বেলায় আধা সের দুধ, চকোলেট, লজেন্স, খেলনা, অন্নবস্ত্রাদি, জুতা-মুজা, তেল, সাবানের নিমিত্ত আমাদের খরচ তো কম হইতেছে না। শীঘ্র করুন, নিশান উড়াইয়া দিন!’
চিঠিটা পেয়ে সদাপ্রসন্নর একটু আনন্দের ভাবই হল। দরটা বেশ অনেকটা নেমেছে।
এদিন তিনি দু-গ্রাস ভাত বেশি খেয়ে ফেললেন। তারপর টাকা জোগাড়ের উপায় ভাবতে বসলেন। তাঁর কয়েকজন অপোগন্ড পুষ্যির মধ্যে একজন হলেন বগলাখুড়ো। আপন খুড়ো নন, জ্ঞাতি। বগলাপতি বোকাসোকা, নির্বিরোধী মানুষ। সারাদিন মাটি কুপিয়ে বাগান করেন। বাগান নিয়েই তাঁর সময় কেটে যায়। আর কোনও দিকে দৃকপাত নেই। তবে লোকে বলাবলি করে যে, বগলাপতি বোকা সেজে থাকলে কী হয়, অনেক সুলুকসন্ধান জানেন। মরিয়া সদাপ্রসন্ন অগত্যা বগলাপতিকেই ধরে পড়লেন, ‘ও বগলাখুড়ো, লাখতিনেক টাকার বড়ো দরকার। কী করে জোগাড় করা যায় বলতে পারেন?’
বগলাপতি অতি মনোযোগে বেগুন গাছের মাটি তৈরি করছিলেন। কথাটা শুনে মাটিমাখা হাতে মাথাটা একটু চুলকে বললেন, ‘তাই তো? লাখতিনেক টাকা ঠিক কত টাকা বল তো?’
‘তা কি ছাই আমিই জানি! লোকের মুখে লাখ-বেলাখ শুনি বটে, কিন্তু আমারও আন্দাজ নেই।’
‘বড়োই মুশকিলে ফেললি বাপ! টাকা-পয়সার হিসেব বড়ো গোলমেলে। তবে অনেক টাকাই হবে বোধ হয়, তাই না?’
‘তা টাকাটা বেজায় বেশি বলেই মনে হচ্ছে খুড়ো।’
‘ওইখানেই তো মুশকিল। কম টাকার সঙ্গে আমি বেশ মানিয়ে-গুছিয়ে চলতে পারি। হিসেব রাখাও ভারি সোজা। কিন্তু বেশি টাকা যেন অকূলপাথার। তাই বেশি টাকাকে আমি বড্ড ভয় পাই। এই তো মাস দুই আগে ওই কেয়াঝোপের নীচে কোদাল চালাতে গিয়ে ঠং করে একটা শব্দ হল। মাটিটা একটু খুঁড়তেই দেখি, একটা কলসির কানা উঁচু হয়ে আছে। ভয়ে তাড়াতাড়ি মাটি চাপা দিয়ে ফেললাম। মাটির নীচে কলসি মানেই বিপজ্জনক ব্যাপার। সোনাদানা বেরিয়ে পড়লে যে অকূলপাথারে পড়ে যাব বাপ!’
সদাপ্রসন্ন হাঁ হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ‘তা আমাকে বলেননি কেন?’
‘বললে যদি লোক জানাজানি হয়ে যায়, তা হলে যে এখানে মানুষের মেলা বসে যাবে বাপ। ঘরদোরে আর শান্তি থাকবে না। তা ছাড়া ওখানে গোটা পাঁচ-সাত কেউটে সাপের আস্তানা। খোঁড়াখুঁড়ি করা হলে ধেড়ে সাপগুলো তাদের দেড়-দুশো কুসিকুসি ছানা নিয়ে কোথায় যাবে বলো তো? ওদের ভিটেছাড়া করা কি ভালো?’
সদাপ্রসন্ন খুব ভাবিত হলেন। ভেবেটেবে বললেন, ‘তা বটে, তবে থাক, কলসি টানাটানি না করাই ভালো।’
‘মহাশয় এখনও সাদা নিশানের দেখা নাই। আর কতদিন ধৈর্য ধরিব? বুঝিতেছি, আপনি কোনও কাজের নহেন। যাহা হউক, অবস্থাগতিক বিবেচনা করিয়া মনে হইল, বাজার এখন নিতান্তই দুর্মূল্য। আলু চারিটাকার নীচে নামিতেছে না। চাউল, ডাইল ইত্যাদিও উচ্চমার্গে অবস্থান করিতেছে। সুতরাং এমতাবস্থায় আপনারও সংগতির অভাব ঘটিতেছে। দয়া করিয়া আমাদের হৃদয়হীন, পাষন্ড ভাবিবেন না। আন্তর্জাতিক বাজারে খোকাটির দর আরও বাড়িয়াছে বটে, কিন্তু আমরা আপনার পিতৃহৃদয়ে শেল হানিতে চাহি না। তাই মুক্তিপণ মাত্র এক লক্ষ টাকা ধার্য করিলাম। শীঘ্র করুন। খোকাটিকে পালিতে-পুষিতে এই মহার্ঘ বাজারে আমাদের প্রচুর ব্যয় হইতেছে। শীঘ্র নিশান না উড়াইলে কিন্তু বিপদ!’
এক লাখ টাকা দেখে বেশ উল্লসিতই হয়ে পড়লেন সদাপ্রসন্ন। আর তাঁর হাসিখুশি ভাব দেখে একাধারে এ বাড়ির বাজার সরকার, হিসেবরক্ষক এবং সম্পর্কে সদাপ্রসন্নর মামা গোলোকবিহারী গম্ভীরভাবে বললেন, ‘দর আরও কমবে।’
‘অ্যাঁ, কী করে জানলেন? আপনাকে তো কিছুই বলিনি!’
গোলোকমামা এ কথার জবাব দিলেন না। তবে দিনসাতেক বাদে সত্যিই চিঠি এল: ‘মহাশয় বড়োই চিন্তায় ফেলিলেন। প্রতিদিন সাদা নিশান দেখিবার জন্য উদগ্রীব হইয়া চাহিয়া আছি, কিন্তু নিশান উড়িল না। আপনাকে ভালো ও বোকা লোক বলিয়া জানিতাম। এখন মনে হইতেছে আপনি একজন ঘড়িয়াল ও ধূর্ত মানুষ। খোকাটিকে আমাদের কাছে গছাইয়া দিব্য দিনাতিপাত করিতেছেন। যাহা হউক, আপনাকে আর একটি সুযোগ দিতেছি। ইহাই অন্তিম সুযোগ। মাত্র পাঁচ সহস্র দিলে আমরা খোকাটিকে ফিরত দিতে রাজি। যদিও তাহাকে পালিতে-পুষিতে আমাদের তদপেক্ষা অধিক ব্যয় হইয়াছে। এইবার নিশানটি উড়ান। বিলম্বে হতাশ হইবেন।’
এক লাখকে সদাপ্রসন্নর এখন নিতান্তই হাতের ময়লা বলে মনে হচ্ছে। দিয়ে ফেললেই ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু একটাই মুশকিল। খোকাটা কার? কার খোকা কে চুরি করল সেটা এখনও পর্যন্ত ভালো বোঝা যাচ্ছে না। কাছেপিঠে কারও খোকা বা খুকি চুরি যায়নি, সদাপ্রসন্ন খোঁজ নিয়ে দেখেছেন।
গোলোকমামা মানুষ একটু গেরামভারী বটে, কথাটথা বিশেষ আসে না, সর্বদাই হিসেবপত্র নিয়ে থাকতে ভালোবাসেন। সংসারের আয়-ব্যয়ের পাই-পয়সার অবধি হিসেব এদিক-ওদিক হওয়ার জো নেই।
সকালবেলায় গোলোকবিহারী হিসেবের খাতা খুলে বসে মন দিয়ে কাজ করছিলেন। সদাপ্রসন্ন গিয়ে চিঠি দেখিয়ে বললেন, ‘পাঁচ হাজারে নেমেছে।’
গোলোকবাবু তলচক্ষুতে একবার সদাপ্রসন্নকে দেখে নিয়ে বললেন, ‘নেমে যাওয়ারই কথা। মানুষের কি অত দাম হয়?’
‘আরও কি একটু কমবে বলে মনে হয় মামা?’
গোলোকবিহারী তাঁর আসনের তলা থেকে একটা খাম বের করে সদাপ্রসন্নর হাতে দিয়ে বললেন, ‘একটু আগে চিঠির বাক্সে এটা পেলাম। পড়ে দ্যাখ।’
চিঠিতে লেখা : ‘মহাশয়, স্থির করিয়াছি বিনা পণেই খোকাটিকে আপনার হাতে তুলিয়া দিব। তবে একটি শর্ত আছে। আপনাকে বিবাহ করিতে হইবে। বিবাহ না করিলে খোকাটিকে পালন-পোষণ করিবে কে? শর্ত পালন না করিলে খোকা পাইবেন না। ইহাই আমাদের শেষ কথা।’
সদাপ্রসন্ন অবাক হয়ে বললেন, ‘অ্যাঁ!’
গোলোকবিহারী তলচক্ষুতে আর একবার ভালো করে দেখে নিয়ে গম্ভীর মুখে বলে উঠলেন, ‘আমাদেরও ওই কথা!’