মীরার প্রেম
ভোর সাড়ে চারটে৷ গঙ্গার ওপরের পুবদিকের আকাশ একটু একটু করে ফর্সা হচ্ছে৷ সূর্যের হাল্কা কমলা আভা গঙ্গায় পড়ে অপার্থিব এক রঙের সৃষ্টি করেছে, কিন্তু প্রকৃতিকে উপভোগ করার মতো সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই উপস্থিত লোকজনের নেই, তারা অন্য জিনিস দেখতে মশগুল৷ এ ওর গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে উপরদিকে দেখছে, কয়েকজনের হাতে আবার মেলা থেকে কেনা সস্তা দূরবিন৷
হাওড়া ব্রিজের একটা প্রান্তে দাঁড়িয়ে ইন্সপেক্টর তালুকদার জোরে জোরে ওয়াকিটকিতে কাউকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন, ‘‘হ্যালো, হ্যালো ওয়ান সেভেন টু নাইন… হ্যালো, প্রশান্ত, শুনতে পাচ্ছ? শোনো রাইট টার্ন নিয়ে সোজা ওপরে উঠে যাও, বাঁদিকের লিভারটা দেখে…… হ্যালো হ্যালো!’’
কনস্টেবল অজয় ছুটে এল ইনস্পেক্টরের দিকে, ‘‘স্যার, নামিয়ে ফেলেছে! ওই যে, দ্যাখা যাচ্ছে! আপনি লাইনটা বরং ডিসকানেক্ট করে দিন…৷’’
ইন্সপেক্টর ত্রিদিব তালুকদার শশব্যস্ত হয়ে ব্রিজ থেকে অনেকটা সরে প্রায় হাওড়া স্টেশনের সামনে এসে চোখের ওপর হাত রেখে দেখলেন অজয় ঠিকই বলেছে৷ হাওড়া ব্রিজের একদম ওপরে পিঁপড়ের মতো হলেও বোঝা যাচ্ছে প্রশান্ত সাবধানে দড়ির ক্লাইম্বারটা বেয়ে নামছে, পিঠে মেয়েটা৷ ত্রিদিব একটা নিঃশ্বাস ফেললেন৷ রিটায়ারমেন্টের আর বছর তিনেক বাকি৷ বত্রিশ বছরের সুদীর্ঘ পুলিশি কেরিয়ারে এরকম কেস তিনি কোনোদিন দেখেননি৷ মাঝরাতের অসম্পূর্ণ ঘুমটা এতক্ষণে যেন আবার ফিরে আসতে চাইছে, চোখ দুটোকে কচলে মনের জোরে ক্লান্তিটাকে দূর করে চারপাশে তাকালেন ত্রিদিব৷
আকাশ প্রায় ফর্সা হয়ে আসছে৷ পাঁচটা নাগাদ ডাউন লোকালগুলো স্টেশনে ঢোকা শুরু করবে, তার আগেই এখানটা পুরো ক্লিয়ার করে ফেলতে হবে৷ এখনো খুব বেশি লোক জড়ো হয়নি, তবে যারা হয়েছে তারা সোৎসাহে অন্যদের ডেকে আনছে৷ দূরপাল্লার ট্রেনের যাত্রীরাও ভোরবেলা নেমেই ভিড় করছে৷ অবশ্য ভিড় করবারই কথা৷ মাঝে মাঝে খবরের কাগজে এক-আধটা পাগলের সবার চোখ এড়িয়ে হাওড়া ব্রিজে উঠে পড়াটা সকলেরই জানা, কিন্তু ভোররাতে একটা ঠিকঠাক পোশাক পরা সুস্থ যুবতি ভদ্রপরিবারের মেয়ে হাওড়া ব্রিজের টঙে উঠে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর চিৎকার করে কাঁদছে, এ ঘটনা অভূতপূর্ব বটে!
প্রায় ঘণ্টাদুয়েক বাদে সব ঝামেলা ঝঞ্ঝাট পেরিয়ে সদর থানায় ত্রিদিব যখন মেয়েটাকে ওসির সামনের চেয়ারে এসে বসালেন, তখন প্রায় সাড়ে সাতটা৷ ওসি সুরজিৎ চক্রবর্তী তাঁর অভিজ্ঞ দৃষ্টি দিয়ে জরিপ করছিলেন মেয়েটাকে৷ বয়স আন্দাজ ত্রিশ-বত্রিশ, শরীরে শাঁখা-পলা সিঁদুর জাতীয় কিছু নেই, কাজেই বিয়ে হয়েছে কি না বোঝা যাচ্ছে না, গায়ের রং চাপা হলেও মুখের মধ্যে একটা আলগা কমনীয়তা আছে, আবার একইসঙ্গে সে মুখে জীবনযুদ্ধে নানা সংগ্রামের ছাপ৷ জংলা প্রিন্টের একটা খাদির সালোয়ার কামিজ পরনে, পায়ে সস্তা রবারের জুতো৷ মেয়েটা এখন আর না কাঁদলেও ফোঁপাচ্ছে থেকে থেকেই, চোখ মুখ ফুলে উঠেছে৷
দেখে তো ভদ্র মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে৷
মুশকিল হল, এখন এই সাতসকালে মহিলা পুলিশ থানায় কেউ নেই, থাকার কথা ছিল দুজনের, কিন্তু তাদের অন্য একটা জরুরি কাজে হঠাৎ তলব পড়েছে৷ কাজেই মেয়েটাকে এখন এখানে কিছুক্ষণ আটকে রাখতে হবে৷
সুরজিৎ চোখের ইঙ্গিতে ত্রিদিবকে এখানেই থাকার নির্দেশ দিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ঈষৎ গলাখাঁকারি দিয়ে শুরু করলেন, ‘‘আপনার নাম কী?’’
মেয়েটা প্রথমে উত্তরও দিল না, মুখও তুলল না৷ বারদুয়েক প্রশ্নের পর মুখটা ধীরে ধীরে উপরদিকে তুলে অস্ফুটে বলল, ‘‘কানুপ্রিয়া৷ আ-আমার নাম কানুপ্রিয়া ঘোষ৷ ডাকনাম মীরা৷’’
সুরজিৎ ভ্রূ কুঁচকোলেন, বাবা এ যে একদম জয়দেবের গীতগোবিন্দ থেকে উঠে এসেছে! তাঁর নিজের বই পড়ার ভীষণ শখ, তিনি সোজা হয়ে বসলেন৷ রাধার আরেক নাম কানুপ্রিয়া হলেও খুবই আনকমন নাম, সচরাচর বাঙালি পরিবারে এই নাম খুব একটা শোনা যায় না৷ মেয়েটি আর যাই হোক একদম অশিক্ষিত পরিবারের নয় বলেই মনে হচ্ছে৷ বৈষ্ণব হয়তো৷
তিনি নরম গলায় বললেন, ‘‘আপনি কাঁদছেন কেন? আর হাওড়া ব্রিজেই বা উঠেছিলেন কেন? আর উঠলেনই বা কী করে!’’
মেয়েটির কান্নার দমক হঠাৎ বেড়ে গেল৷ এবার আর ফোঁপানি নয়, জোরে জোরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘‘পার্থসারথিকে বাঁচাতে উঠেছিলাম স্যার, কিন্তু পারলাম না! ও……ও আর নেই স্যার, তলিয়ে গেছে গঙ্গায়! আমিও আর বাঁচব না ওকে ছাড়া!’’
পরবর্তী দু-ঘণ্টা ধরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জেরা করে যা জানা গেল, তাতে সুরজিৎ আর ত্রিদিব দুজনেই নড়েচড়ে বসলেন৷ না, ব্যাপারটা তো অন্য কোনো পাগলের ব্রিজে ওঠার মতো কেস নয়!
ততক্ষণে কনস্টেবল বাসন্তীদি এসে পড়েছে৷ সুরজিৎ মেয়েটাকে ভেতরে নিয়ে বসাতে আদেশ দিয়ে ত্রিদিবের দিকে তাকালেন, ‘‘জলদি পুরো কেসটা লিখে ফ্যালো ত্রিদিব ইন ডিটেইল৷ আর লালবাজার কন্ট্রোলে খবর দাও!’’
ত্রিদিব দ্রুত চিন্তা করতে লাগলেন৷ হাওড়া ব্রিজে উঠেছে, তারপর সঙ্গের ছেলেটা নাকি জলে ঝাঁপ দিয়েছে৷ এমনিতে এখানে গঙ্গার দায়িত্বে থাকেন কলকাতা পুলিশের বন্দর বিভাগের অফিসারেরা, কিন্তু এই কেসটায় সেইসঙ্গে রিভার ট্রাফিক পুলিশকেও খবর দিতে হবে, ওঁদের আন্ডারে বাইশটা মতো নটিক্যাল এরিয়া রয়েছে, আর চব্বিশ ঘণ্টার জওয়ান বাহিনীও আছে, বডি খুঁজে পেতে সুবিধা হবে৷
ত্রিদিব ফোনগুলো মিটিয়েই ঝড়ের গতিতে ফাইলে লিখতে লাগলেন, ‘‘কানুপ্রিয়া ঘোষ ওরফে মীরা৷ বয়স তেত্রিশ৷ অবিবাহিত৷ বাগবাজারে বাড়ি৷ বাড়িতে আছেন বাবা৷ মা মারা গেছেন৷ বাবার শ্যামবাজারে ছোট স্টেশনারি দোকান, ভালো চলে না৷ কানুপ্রিয়া নিজে বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করে৷ সাত-আট বছর আগে পর্যন্ত তার বিয়ের দেখাশোনা হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নানা কারণে বিয়ে হয়নি৷ মাস চারেক আগে ওর সাথে পরিচয় হয় পার্থসারথি বলে একটা ছেলের৷ পার্থসারথি হাওড়ার সালকিয়ায় থাকে,কাজ করে বেসরকারি একটা কুরিয়ারে৷ কানুপ্রিয়ার বাবা ওদের দুজনের বিয়েতে কোনো কারণে মত না দেওয়ায় গতকাল রাতে পার্থসারথি কানুপ্রিয়ার বাড়ি গিয়ে অপমানিত হয়৷ রাতে ফোনে দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য হয়, শেষে হাওড়া ব্রিজে দুজনে মিট করতে আসে৷ কানুপ্রিয়ার বয়ান অনুযায়ী পার্থসারথি আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে ব্রিজের পিলারগুলো দিয়ে উপরে উঠতে থাকে, পেছন পেছন কানুপ্রিয়াও৷ কানুপ্রিয়া উপরে উঠতেই পার্থসারথি ব্রিজ থেকে নীচে ঝাঁপ দেয় আন্দাজ ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ৷’’
এই পর্যন্ত লিখে ত্রিদিব একটু থামলেন, ‘‘স্যার, পার্থসারথি আবার কৃষ্ণের নাম, আর কানুপ্রিয়া মানে আপনি বললেন রাধা, এ তো রাধা কৃষ্ণের লীলা স্যার!’’
সুরজিৎ হাসলেন, ‘‘যা বলেছ!’’
ত্রিদিব আবার লেখাটার দিকে তাকালেন, একটু ন্যারেটিভ করতে হবে রিপোর্টটা৷ কেটে লিখতে যাবেন, এমন সময় কনস্টেবল অজয় ছুটতে ছুটতে এল, ‘‘স্যার, বাসন্তীদি ডাকছে আপনাকে! কাকে নাকি খুন করেছে মেয়েটা, বিড়বিড় করে বকছে!’’
সুরজিৎ দৌড়লেন ইনভেস্টিগেশন রুমের দিকে, কে আবার কাকে খুন করল!
ত্রিদিব এডিটিং শেষ করে যখন পৌঁছলেন, সুরজিৎ তখন রীতিমতো কড়া ভাষায় জেরা করছেন কানুপ্রিয়াকে, ‘‘ঠিকঠাক করে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলো, না হলে এক্ষুনি তোমাকে অ্যারেস্ট করা হবে! বাবার বডিটা কোথায় রয়েছে?’’
কানুপ্রিয়া বলে মেয়েটার দু-গাল বেয়ে জলের ধারা নামছিল, তার মধ্যেই ফুঁসে উঠে বলল, ‘‘স্যার, আ-আমার কোনো দোষ নেই! আপনি জানেন না, বাবা ছোট থেকে কোনোদিনও আমায় ভালোবাসেনি, মা মরে যাওয়ার পর থেকে খেটে খেটে মরেছি, ইচ্ছে করে বিয়ে দিল না আমার! আমার সব বন্ধুর বিয়ে হয়ে গেছে কত্তদিন আগে, আ-আমি পুরো একা হয়ে গেছিলাম স্যার! এতদিন বাদে একজনকে পেলাম, পার্থসারথি এত ভালো, এত ভালোবাসে আমায়, তবু ও এসে কাল বিয়ের কথা বলতেই বাবা বিচ্ছিরিভাবে অপমান করল ওকে! বাবা চায় না আমি ভালো থাকি৷’’
সুরজিৎ ত্রিদিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘গাড়ি বের করতে বলো কুইক৷ বডি আছে বাড়িতে৷’’
রাস্তায় যাওয়ার সময় বিশেষ কোনো কথা হল না৷ কানুপ্রিয়া আর কয়েকজন পুলিশকে নিয়ে ভ্যানটা আগে আগে চলছিল, পেছনে ত্রিদিবদের জিপটা৷ সুরজিৎ বললেন, ‘‘যতদূর মনে হচ্ছে, কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার, বুঝলে! মেয়েটা মনে হয় সত্যিই বলছে৷ ওই পার্থসারথি ছেলেটাই উসকেছে বাবাকে খুন করতে অথবা সে নিজেই মার্ডারটা করেছে৷ কিন্তু মালটা এত কিছুর পর ব্রিজ থেকে ঝাঁপ মারল কেন!’’
ত্রিদিব বললেন, ‘‘স্যার, আমার মনে হয় কী জানেন, মেয়েটা এমনিই ডিপ্রেশনে ভুগছিল৷ তার ওপর ওই ছেলেটা দিনের পর দিন ওকে প্রোভোক করেছে৷’’
সুরজিৎ অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘‘হুম৷ কিন্তু গঙ্গা থেকে এখনো কোনো খবর এল না কেন! বডি তো এতক্ষণে পেয়ে যাওয়ার কথা!’’
ত্রিদিব মোবাইলে নম্বর টিপলেন, ‘‘হ্যাঁ রঞ্জন, আমি ত্রিদিবদা কথা বলছি৷ পেলে বডি?’’
ফোনটা রেখে ত্রিদিব বললেন, ‘‘নো আপডেট৷ স্যার, ছেলেটা অন্যদিক দিয়ে নেমে পালায়নি তো! পাঁচ-ছ’ঘণ্টা আগে ঝাঁপ দিলে তো এতক্ষণে পেয়ে যাওয়ার কথা৷’’
কানুপ্রিয়ার দেখানো রাস্তা অনুসারে বাগবাজারের অলিগলি পেরিয়ে যে বাড়িটার সামনে ওদের গাড়ি দুটো দাঁড়াল, সেটাকে বাড়ি না বলে পোড়োবাড়ি বলাই ভালো৷ অবহেলায় অনাদরে হাড় পাঁজরা বেরিয়ে পড়েছে, তাতে থাবা বসিয়েছে বট অশ্বত্থের ডাল৷ আশপাশে তেমন কোনো বাড়ি নেই, দুপাশে নির্মীয়মাণ বাড়ি অসমাপ্ত হয়ে পড়ে আছে৷ কাছেপিঠে দোকান বলতে একটা চায়ের গুমটি৷
সুরজিৎ নেমেই সবাইকে আদেশ দিলেন বাইরে ওয়েট করার জন্য, বাকিরা বলতে দুজন মহিলা পুলিশ আর দুজন কনস্টেবল৷ তারা বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল৷
শুধু ত্রিদিব আর কানুপ্রিয়াকে নিয়ে সুরজিৎ ঢুকলেন ভেতরে৷ তালাচাবির কোনো ব্যাপারই নেই, হাল্কা ঠেলতেই একটা আর্তনাদ করে দরজাটা খুলে গেল৷ আর একটা ভ্যাপসা জঘন্য গন্ধ ভক করে এসে নাকে লাগল৷
ত্রিদিব নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বলল, ‘‘রাইগার মরটিস শুরু হয়ে গেছে মনে হচ্ছে স্যার!’’
কানুপ্রিয়া ঘ্যানঘ্যান করে বলেই যাচ্ছিল, ‘‘স্যার, আমাকে যা শাস্তি দেবেন দিন, পার্থসারথিকে কিছু দেবেন না, ওর কিছু হলে আমি বাঁচব না!’’
ভেতরে দুটো ঘর, সেগুলোতে মাকড়সা ভর্তি, কোথাওই কোনো লাশ চোখে পড়ল না৷ কিন্তু গন্ধটা যেন বেড়েই চলেছে৷
গোটা বাড়িটায় দীনতার ছাপ স্পষ্ট৷
সুরজিৎ বললেন, ‘‘লাশ কোথায় রেখেছিলে?’’
কানুপ্রিয়া কেমন হিস্টিরিয়া রুগির মতো কাঁপছিল, ‘‘স্যা-স্যার, আ-আমি এই প্রথম কারও ভালোবাসা পেয়েছি স্যার, আমার জীবনটা শেষ করে দেবেন না! আপনার দুটি পায়ে পড়ি স্যার!’’
সুরজিৎ প্রকাণ্ড একটা ধমক দিয়ে বললেন, ‘‘বডিটা কোথায় রেখেছ?’’
কানুপ্রিয়া ভয়ে ভয়ে রান্নাঘরের দিকে আঙুল তুলতেই দুজনে এগিয়ে গেলেন রান্নাঘরের দিকে৷
কানুপ্রিয়াও পেছন পেছন যাচ্ছিল, হঠাৎ পেছন থেকে কাঁধে কার স্পর্শ পেয়ে মুখ ফিরিয়ে দ্যাখে, পার্থসারথি!
কানুপ্রিয়ার চোখ দুটো আনন্দে বড় বড় হয়ে উঠল, আজন্ম উপোসি শরীরটা সামান্য পুরুষস্পর্শে কেঁপে উঠল যেন, উদ্ভাসিত হয়ে ও জড়িয়ে ধরল পার্থসারথিকে, ‘‘তুমি ফিরে এসেছ? তোমার কিছু হয়নি তো সোনা?’’
পার্থসারথি ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘‘না! তোমাকে ছেড়ে কি আমি কোথাও যেতে পারি?’’ তারপর ওর গাল দুটো শক্ত করে ধরে চোখে চোখ রাখল, ‘‘এই পুলিশ দুটোর জন্য কিন্তু আমাদের বিয়ে হবে না মীরা!’’
কানুপ্রিয়া আর্তনাদ করে উঠল, ‘‘না! সে কিছুতেই হতে পারে না! আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না! তুমি কেন কাল আমার সঙ্গে ঝগড়া করে বললে মরে যাবে?’’ বলতে বলতে ও কেঁদে ফেলল৷
পার্থসারথি বলল, ‘‘সে তো রাগের কথা৷ তোমার বাবা যেমন আমাদের সম্পর্কটাকে তোমার মাথার দোষ বলে উড়িয়ে দিয়েছিল, এরাও তেমনি দেবে! উল্টে তোমায় অ্যারেস্ট করবে৷’’ ও এগিয়ে এসে কানুপ্রিয়ার কাঁধ দুটোকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, ‘‘মীরা, আমাদের সেই স্বপ্নের সংসারটা…সেই সংসারটা আর কোনোদিনও তৈরি হবে না!’’
কানুপ্রিয়া থেবড়ে বসে পড়ে জোরে জোরে মাথা নাড়াল, ‘‘সেটা আমি কিছুতেই হতে দেব না পার্থসারথি! তোমাকে আমার কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না!’’
পার্থসারথি সম্মোহনী গলায় আঙুল তুলল, ‘‘তবে যাও!’’
কানুপ্রিয়া কেমন শূন্য দৃষ্টিতে বলল, ‘‘কোথায়?’’
‘‘যে বঁটিটা দিয়ে কাল বাবার গলায় কোপ মেরেছিলে, সেটা নিয়ে শেষ করে দাও এই দুজনকে!’’ পার্থসারথির গলাটা যেন অনেক দূর থেকে ভেসে এল৷
কানুপ্রিয়া উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে গেল পাশের ঘরে, হাতড়ে হাতড়ে খাটের তলা থেকে বের করে আনল রক্তমাখা বঁটিটা, কাল পার্থসারথির কথামতো সেখানেই লুকিয়ে রেখেছিল সেটা, তারপর ছুটে গেল রান্নাঘরে৷
পেছন থেকে পার্থসারথি কাতরভাবে বলে উঠল, ‘‘আমি তোমায় ভালোবাসি মীরা! তোমার সঙ্গেই সারাটা জীবন কাটাতে চাই৷’’
ত্রিদিব আর সুরজিৎ তখন কাল রাতের মার্ডারড বডিটা উবু হয়ে দেখছিলেন, প্রায় বারো ঘণ্টা আগে খুন হওয়া বয়স্ক লোকটার ঘাড়ে ধারালো কোপ৷ রক্ত গড়িয়ে পড়ে জমাট বেঁধে চলে গেছে নর্দমার দিকে৷
ত্রিদিব সুরজিৎকে বলতে গেলেন, ‘‘কাটারি হতে পারে কি?’’ কিন্তু কথাটা শেষ করতে পারার আগেই জান্তব একটা চিৎকার করে বঁটিটা নিয়ে পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কানুপ্রিয়া ত্রিদিবের ঘাড়ে একটা কোপ চালিয়ে বঁটিটাকে বসিয়ে দিল৷
অস্ফুট একটা আর্তনাদ করে ত্রিদিব লুটিয়ে পড়লেন কাল রাতের মৃতদেহটার পাশে৷
সুরজিৎ একঝলক ত্রিদিবের দিকে তাকিয়েই রিভলভারটা বের করে সোজা গুলি চালালেন৷ পরপর দুবার৷ নির্ভুল লক্ষ্যে সে দুটো গিয়ে একটা ফুঁড়ে দিল কানুপ্রিয়ার বুকের পাঁজরগুলোকে, অন্যটা ডান হাতের কবজিতে৷
গোটা রান্নাঘরটা রক্তে ভেসে যাচ্ছিল৷ আর তারই মধ্যে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল ত্রিদিবের৷ সুরজিৎ হুইসল বাজিয়ে দিয়েছিলেন, ছুটে এসেছে অন্যরা৷
জ্ঞান হারাবার আগে ত্রিদিব দেখলেন, কানুপ্রিয়ার বুক থেকে রক্ত ছলকে বেরোচ্ছে, মহিলা পুলিশ দুজন ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছে ওকে, তার মধ্যেও কানুপ্রিয়া গোঙাতে গোঙাতে বিকৃতভাবে বলছে, ‘‘আমার পাগলামি, আমার কল্পনা, না? এ-এত সুন্দর রাজপুত্তুরের মতো বর হবে আমার, আর কেউ হিংসায় সহ্য করতে পারছে না! আ-আমি সব বুঝি! আমার জন্য, শুধু আমার জন্য সোনা তুমি গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েও বেঁচে ফিরে এসেছ? এত ভালো আমায় কেউ কোনোদিন বাসেনি, আর বাবা বলছিল তুমিই নাকি নেই? সব হিংসা! দিয়েছি সববাইকে শেষ করে!’’
সুরজিৎ রিভলভারটা আস্তে আস্তে পকেটে ভরলেন৷ এই বেখাপ্পা সময়ে তাঁর সাহিত্যপ্রীতি ফিরে এল হঠাৎ৷ তাঁর মনে পড়ে গেল, অতীতের মীরাবাইও কৃষ্ণপ্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন, দ্বারকার মন্দিরের গর্ভগৃহে কৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরে বিলীন হয়েছিলেন নাকি তিনি, সেটাও কি স্কিজোফ্রেনিয়া থেকেই?
দারিদ্র্য, তীব্র মানসিক অবসাদ, সংসার করার প্রবল ইচ্ছে, হীনম্মন্যতা এই গরিব মেয়েটাকে একজন কাল্পনিক প্রেমিক উপহার দিয়েছিল, যার অস্তিত্বকে অস্বীকার করলে তাকে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করছে না সে৷
সুরজিৎ একালের মীরাবাইয়ের দিকে তাকালেন, তীব্র ব্যথার মধ্যেও মহিলা পুলিশ দুটোর বাধা এড়িয়ে কানুপ্রিয়া তখন আপ্রাণ চেষ্টা করছে শূন্যের মধ্যেই কাউকে একটা জড়িয়ে ধরার৷ হাপুস নয়নে কান্নার মাঝেই শূন্যে কাকে যেন প্রবল আশ্লেষে চুমু খেয়ে চলেছে সে৷
তার এত কষ্টে পাওয়া সংসারটাকে সে কিছুতেই শেষ হয়ে যেতে দেবে না!
—