আমাদের বাড়ির পাশেই নবীন ঘোষের বাড়ি। একেবারে সংলগ্ন বলিলেই হয়।
আমি কখনো আমাদের বাড়ির ছাদে উঠি না, জানালায়ও দাঁড়াই না। আপন মনে গৃহকার্য করিয়া যাই।
নবীন ঘোষের বড়ো ছেলে মুকুন্দ ঘোষকে কখনো চক্ষে দেখি নাই।
কিন্তু মুকুন্দ ঘোষ কেন বাঁশি বাজায়! সকালে বাজায়, মধ্যাহ্নে বাজায়, সন্ধ্যাবেলায় বাজায়। আমার ঘর হইতে স্পষ্ট শোনা যায়।
আমি কবি নই, মাসিক পত্রিকার সম্পাদক নই, মনের ভাব সম্পূর্ণ ব্যক্ত করিয়া উঠিতে পারি না। কেবল সকালে কাঁদি, মধ্যাহ্নে কাঁদি, সন্ধ্যাবেলায় কাঁদি এবং ইচ্ছা করে ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া যাই।
বুঝিতে পারি রাধিকা কেন তাঁহার সখীকে সম্বোধন করিয়া কাতর স্বরে বলিয়াছিলেন “বারণ কর্ লো সই, আর যেন শ্যামের বাঁশি বাজে না বাজে না’।
বুঝিতে পারি চণ্ডীদাস কেন লিখিয়াছেন–
যে না দেশে বাঁশির ঘর সেই দেশে যাব,
ডালে মূলে উপাড়িয়া সাগরে ভাসাব।
কিন্তু পাঠক, আমার এ হৃদয়বেদনা তুমি কি বুঝিয়াছ?
উত্তর
আমি বুঝিয়াছি। যদিও আমি কুলবধূ নই। কারণ, আমি পুরুষমানুষ। কিন্তু আমার বাড়ির পাশেও একটি কন্সর্টের দল আছে। তাহার মধ্যে একটি ছোকরা নূতন বাঁশি অভ্যাস আরম্ভ করিয়াছে–প্রত্যুষ হইতে অর্ধরাত্রি পর্যন্ত সারিগম সাধিতেছে। পূর্বাপেক্ষা অনেকটা সড়গড় হইয়াছে; এখন প্রত্যেক সুরে কেবলমাত্র আধসুর সিকিসুর তফাত দিয়া যাইতেছে। কিন্তু আমার চিত্ত উদাসীন হইয়া উঠিয়াছে; ঘরে আর কিছুতে মন টেঁকে না। বুঝিতে পারিতেছি রাধিকা কেন বলিয়াছিলেন “বারণ কর্ লো সই, আর যেন শ্যামের বাঁশি বাজে না বাজে না’। শ্যাম বোধ করি তখন নূতন সারিগম সাধিতেছিলেন। বুঝিতে পারিতেছি চণ্ডীদাস কেন লিখিয়াছিলেন–
যে না দেশে বাঁশির ঘর সেই দেশে যাব,
ডালে মূলে উপাড়িয়া সাগরে ভাসাব।
বোধ হয় চণ্ডীদাসের বাসার পাশে কন্সর্টের দল ছিল।
আমার বাড়ির পাশে যে ছোকরা বাঁশি অভ্যাস করে বোধ হয় তাহারই নাম মুকুন্দ ঘোষ।
–শ্রীসংগীতপ্রিয়
আমার এ কী হইল! এ কী বেদনা! নিদ্রা নাই, আহার নাই, মনে সুখ নাই। থাকিয়া থাকিয়া “চমকি চমকি উঠি’।
কমলপত্র বীজন করিলে অসহ্য বোধ হয়, চন্দনপঙ্ক লেপন করিলে উপশম না হইয়া বিপরীত হয়।
শীতল সমীরণে সমস্ত জগতের তাপ নিবারণ করে, কেবল আমি হতভাগিনী সখীকে ডাকিয়া বলি, “উহু উহু, সখী, দ্বার রোধ করিয়া দাও’।
সখীরা স্নেহভরে দেহ স্পর্শ করিলে চমকিয়া হাত ঠেলিয়া দিই। না জানি কোন্ স্পর্শে আরাম পাইব।
মনোহরা শারদপূর্ণিমা কাহার না আনন্দদায়িনী! কেবল আমার কষ্ট কেন দ্বিগুণ বাড়াইয়া তোলে?
আমার ন্যায় আর-কোনো হতভাগিনী সম্বন্ধে জয়দেব লিখিয়াছেন–
নিন্দতি চন্দনমিন্দুকিরণমনুবিন্দতি খেদমধীরম্।
ব্যালনিলয়মিলনেন গরলমিব কলয়তি মলয়সমীরম্।
অন্যত্র লিখিয়াছেন “নিশি নিশি রুজমুপযাতি’। আমারও সেই দশা। রাত্রেই বাড়িয়া উঠে।
আমার এ কী হইল?
উত্তর
তোমার বাত হইয়াছে। অতএব পূবে হাওয়া বহিলে যে দ্বার রোধ করিয়া দাও সেটা ভালোই কর। পরীক্ষাস্বরূপে চন্দনপঙ্ক লেপন না করিলেই উত্তম করিতে। পূর্ণিমার সময় যে বেদনা বাড়ে সে তোমার একলার নহে, রোগটার ওই এক লক্ষণ। চাঁদের সহিত বিরহ বাত পয়ার এবং জোয়ার-ভাঁটার একটা যোগ আছে।
রাধিকার ন্যায় রাত্রে তোমার রোগ বৃদ্ধি হয়। কিন্তু রাধিকার সময় ভালো ডাক্তার ছিল না, তোমার সময়ে ডাক্তারের অভাব নাই। অতএব আমার ঠিকানা সম্পাদকের নিকট জানিয়া লইয়া অবিলম্বে চিকিৎসা আরম্ভ করিয়া দিবে।
–নূতন- উত্তীর্ণ ডাক্তার
১২৯৮