মীন দ্বীপের ভূত

মীন দ্বীপের ভূত

মীন দ্বীপের মাটিতে পা দেওয়ার পর থেকে আমার মনে হচ্ছিল, টুরাকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়া ঠিক না। এত যদি ভয় তো বাড়িতে বসে থাকলেই পারত! নদীর খাঁড়িটা যেখানে দ্বীপের মাটিকে লাঙলের ফলার মতো দু-ভাগ করে শেষ হয়েছে, সেখানে দাঁড়িয়ে আমি টুরাকে বললাম, ‘তোর যদি এত ভয় তো, যা, বাংলোয় মা-র কাছে চলে যা। ফাইভে পড়িস, এখনও এত ভূতের ভয় তোর? তাও আবার দিনের বেলা?’

টুরা একটু উদাস হয়ে গেল যেন। এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, ‘না, আসলে ভয় নয় কুশলদা, দ্বীপটা একদম নির্জন তো!’

আমি হাসি চাপতে পারলাম না। বললাম, ‘নির্জন হলেই ভূত, রাম-সীতার পুত! সত্যি টুরা, তুই গল্প লেখক হতে পারবি বড়ো হলে। আর কী কী হলে ভূত হয় টুরা?’

মেঘের আড়াল থেকে চাঁদের উঁকি দেওয়ার মতো ম্লান একটু হাসল টুরা। বলল, ‘আমার খুব খিদে পেয়ে গেছে কুশলদা। চলো, এখন বাংলোয় ফিরে যাই। খেয়ে-দেয়ে দুপুরে বেড়াতে আসব বরং।’

আমি বেশ হতাশ। কিছুটা কষ্টও হচ্ছিল। মীন দ্বীপে বেড়াতে আসার ইচ্ছে সেই কবে থেকে। এমন একটা নতুন দ্বীপ, ডাঙায় সাপ নেই, বাঘ-ভালুক নেই, জলে কুমির-হাঙর নেই। শুধু দূরে দূরে এলোমেলো দু-দশটা খাঁড়ি আর অগোছালো সবুজ ঝোপঝাড় ছড়িয়ে আছে খুচরো পয়সার মতো। খুব বেড়াব, অ্যাডভেঞ্চার হবে খুব। তা না, টুরার ভূতের ভয় আর বুবুনের নৌকোর দুলুনিতে মাথা ঘোরার জন্য ভালো লাগছে না। এর চেয়ে আমাদের বাড়ির সামনের মাঠে ক্রিকেট খেলা ঢের ভালো ছিল। বললাম, ‘চল তা হলে। বুবুনকে নিয়ে আমরা দুপুরে বেড়াতে বেরোব।’

আমি টুরা ও বুবুন ফিরে আসছিলাম বাংলোয়। হঠাৎ একটা বুনো ঝোপ প্রথমে চোখে পড়ল টুরার। আমার হাতটা চেপে ধরে টুরা বলল, ‘দ্যাখো কুশলদা, ঝোপটা কীরকম!’

আমি হেসে বললাম, ‘তোর বুঝি ভয় করছে? না, তোকে নিয়ে আর পারা যায় না। সেভেনে পড়ি, আমি তো কই ভয় পায় না। ফাইভে পড়িস বলেই কি তোর যত ভয়? চল না, ঝোপটার কাছে যাই।’

টুরা আমার পিঠের জামায় খামচে ধরে টান দিল। বলল, ‘ওটা কী ঝোপ বলো তো? ওর মধ্যে সাপটাপ তো থাকতেই পারে। কী দরকার…..।’

আমি ঝোপটার দিকে এগোতে এগোতে বললাম, ‘সাপের তো আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই, একলা এসেছে এই নির্জন দ্বীপে বেড়াতে। এখানে সাপ থাকতেই পারে না।’

আমরা যখন ঝোপটার খুব কাছাকাছি গিয়েছি, দেখলাম কীরকম অদ্ভুত রঙের ফুল ফুটে আছে।ফুলগুলো দেখতে ঠিক যেন আধখানা চাঁদের মতো। ঝোপটার ঘন সবুজ পাতাগুলো যেন কালচে মেঘের দল। আর মাঝে বেগনি রঙের ঘাসজাতীয় পাতাগুলো আঁকিবুকি কেটে রেখেছে, দেখলে মনে হয়, যেন এইমাত্র সূর্যাস্তের শেষ আলো ছড়িয়ে পড়েছে। তারপরে ফুলগুলোর দিকে চোখ পড়তেই মনে হল, ওমা, আধখানা রুপোর চাঁদও উঠে পড়েছে কখন! একটা-দুটো নয়, অনেক ক-টা আধখানা রুপোর চাঁদ। আমি টুরার হাত ধরে আরও কিছুটা এগোলাম ঝোপের দিকে। বললাম, ‘জানিস টুরা, এখানে কাদের যেন আজ বসে আঁকো ছিল।’

টুরা আমার কথার মানে বুঝতে পারল না, নাকি শুনতেই পেল না, বোঝা গেল না। শুধু টানতে থাকল পিছনে।

হঠাৎ ঝোপের ফাঁক দিয়ে ভিতরের দিকে তাকাতেই দেখি দুটো বড়ো বড়ো চোখ। পেছন থেকে উঁকি দিয়েছিল টুরা ও বুবুন। তাদেরও চোখ এড়ায়নি। টুরা এক হাতে আমার পিঠের জামাটা ভীষণ জোরে খামচে ধরল। আর এক হাতে দু-চোখ ঢেকে প্রায় কেঁদেই ফেলল। আমি পলকে দেখে নিলাম, প্রাণীটা পেঙ্গুইনের মতো দেখতে। দু-পা পিছিয়ে এসে বললাম, ‘চল, বাংলোয় ফিরে যাই।’

টুরার কপালে ঘাম ফুটে উঠেছে গাছের পাতায় ভোরের শিশিরের মতো। বলল, ‘কুশলদা, ওটা কীসের চোখ?’

আমি বললাম, ‘ও কিছু না। পেঙ্গুইনের মতো দেখতে সমুদ্রের কোনো পাখিটাখি হবে হয়তো।’

বুবুন বলল, ‘পেঙ্গুইন নয় তো?’

আমি বললাম, ‘দূর, পেঙ্গুইন থাকে শীতের দেশে বরফের রাজ্যে। সে এই হলদিয়া বন্দরের সামনের দ্বীপে আসতে যাবে কেন? এলেও বাঁচবে না তো। অন্য কোনো পাখি বা সমুদ্রের হাঁসটাসও হতে পারে।’

আমরা হাঁটতে লাগলাম। উঁচু-নীচু দ্বীপের মাটি। ঠিকমতো পা ফেলা যায় না। আমি ধরে আছি টুরার হাত। বাংলো দেখা যাচ্ছে। এমন সময় টুরা আমার হাতে একটু চাপ দিয়ে বলল, ‘চোখ দুটো না ঠিক সেই ই টি-র মতো। তাই না কুশলদা?’

টুরার কথা শুনে বুঝলাম, ওর মন থেকে এখনও ভয় যায়নি। ‘ই টি’ সিনেমাটা দেখার পরও টুরা বেশ ভয় পেয়েছিল মনে আছে। আমি অন্যমনস্কের মতো বললাম, ‘হুঁ।’

টুরা বলল, ‘আচ্ছা কুশলদা, ওটা যদি ই টি হয়? হতেও তো পারে। দূরের কোনো একটা গ্রহ থেকে এসে এই দ্বীপে….।’

আমি হেসে উঠলাম। বললাম, ‘আগে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করুন যে, পৃথিবী ছাড়া অন্য গ্রহে প্রাণী আছে। তারপর নয় ভয় পাস। আমার মতো সেভেনে যখন পড়বি, তখন এসব বুঝবি। ই টি তো নিছক কল্পনা। টুরা, তুই ভাবতেও পারিস বটে!’

আমরা বাংলোয় এসে গেলাম। এসে বুবুন বসে গেল ঝিনুক দিয়ে একটা গর্ত খুঁড়তে। এখন নিশ্চয়ই আর নৌকোর দুলুনিটা বুবুনের মাথায় নেই।

টুরা বলল, ‘জানিস বুবুন, আমরা ঝোপের আড়ালে পেঙ্গুইনের মতো যে-প্রাণীটা দেখলাম, তার চোখ দুটো ঠিক ই টি-র মতো, বড়ো, আর গোল, আর কীরকম যেন।’

বুবুন হাঁ করে তাকিয়ে রইল টুরার দিকে। আমি বললাম, ‘বুবুন, তোর আবার ভূতের ভয় নেই তো রে?’

বুবুন ঘাড় দোলাল দু-দিকে, না নেই। আমি বললাম, ‘টুরার মতো ভয় পাস না যেন। আমরা দুপুরে খাওয়ার পর বেড়াতে যাব আবার। তুইও যাবি সঙ্গে।’

মীন দ্বীপটা নতুন গড়ে উঠেছে। এখনও তেমন জনবসতি গড়ে ওঠেনি। এই দ্বীপে আসারও কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই বাবা একটা নৌকো ভাড়া করে আসার পরিকল্পনা করেছিলেন। সেইমতো টুরার বাবা-মা, বোসকাকু ও কাকিমা আর বুবুনের বাবা-মা, সামন্তকাকু ও কাকিমা এবং বাবা-মা-র সঙ্গে আমি বেড়াতে এসেছি এই মীন দ্বীপে। মা তো গোড়া থেকেই আপত্তি করেছিলেন। ‘কী দরকার, কোথায় কী বিপদে পড়ব। লোকজন নেই, কারও সাহায্যও তো পাওয়া যাবে না। সঙ্গে তো ছোটো ছেলে-মেয়েরা যাবে।’ মায়ের আপত্তি শোনেননি বাবা। বাবার মনের মধ্যে একটা অ্যাডভেঞ্চারের ইচ্ছে লুকিয়ে থাকে সবসময়। আর এই জন্যই বাবাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে।

নৌকোয় আসার সময় বাবা বলেছিলেন, ‘দ্বীপটা অনেকটা মাছের মতো দেখতে। হলদিয়া বন্দরের দিকটা মাছের মুখের মতো। ল্যাজটা সরু হয়ে চলে গেছে বঙ্গোপসাগরের দিকে। তাই দ্বীপটার নাম মীন দ্বীপ। দ্বীপটার একটা ডাকনামও আছে, নয়াচর।’

বাবার কথা শুনতে শুনতে আমার মনে হয়েছিল, এ-সেই টিনটিনের কৃষ্ণদ্বীপ অভিযানের মতো। সঙ্গে আমাদেরও একটা কুট্টুস থাকলে ভালো হত!

মা, বাবা, কাকু, কাকিমারা এখন রান্নায় ব্যস্ত। আমি একটা ছোটো বুনো গাছের তলায় বসে ভাবছিলাম। এমন সময় টুরা ছুটতে ছুটতে এসে বলল, ‘কুশলদা, চলো একটা অদ্ভুত জিনিস দেখাব।’

আমি টুরার সঙ্গে গেলাম বাংলোর পেছনে, অনেকটা দূরে। টুরা আঙুল তুলে দেখাল ঝিলের জলের ওপরে বুজকুড়ি উঠছে। টুরা বলল, ‘অনেকক্ষণ থেকে আমি দেখছি জলের নীচে কী যেন আছে।’

আমি বললাম, ‘থাকবে আবার কী? ও এমনিই হচ্ছে।’

বুবুন ঝোপে ঝোপে ঘুরে গঙ্গাফড়িং ধরছিল। সেও এসে বলল, ‘কুশলদা, টুরাদি, তোমরা দেখবে চলো, একটা লঙ্কাজবার গাছে না অনেক ফুল!’

টুরা বলল, ‘চলো তো কুশলদা।’

আমরা গিয়ে দেখলাম একটা লঙ্কাজবার গাছের ডাল ফুলের ভারে যেন জলে নুয়ে পড়ছে। জলে তিরতির করে কাঁপছে তার ছায়া। সত্যিই অনেক ফুল ফুটেছে।

টুরা বলল, ‘আমি বলছি কুশলদা, এই দ্বীপটার সব কিছুই যেন অন্যরকম। কেমন ভয়-ভয়।’

বুবুনও সায় দিয়ে ঘাড় নাড়ল টুরার কথায়। আমি হেসে বললাম, ‘তোর মাথা আর বুবুনের মুন্ডু। গাছে ফুল ফুটেছে, তাতেই ভয়।’

আমরা হাঁটতে হাঁটতে তিনজন একদম নদীর ধারে। এদিকটার নদীর নাম হুগলি। আর আমরা হলদিয়া টাউনশিপ থেকে যে নদী দিয়ে নৌকোয় করে এলাম, তার নাম হলদি। দুটো নদীই দ্বীপের দু-পাশ দিয়ে বয়ে গিয়ে পরে একসঙ্গে মিশেছে। তারপর সোজা বঙ্গোপসাগরে। বুবুন হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওই দ্যাখো টুরাদি, দূরে একটা জাহাজ।’

টুরা সে-কথার উত্তর দিল না। নদীর ঢালু পাড়ে কী যেন দেখছিল। আমি বললাম, ‘এ্যাই টুরা, এদিকে আয়, দ্যাখ, কত বড়ো একটা সমুদ্র-কাঁকড়া।’

বুবুন ছুটে এল। টুরা মুখ তুলে শুধু তাকাল একবার। গোটা ফ্রকটাই কাদায় ভরতি। থমথমে গলায় বলল, ‘কুশলদা, এদিকে এসো তো!’

আমি আর বুবুন টুরার কাছে যেতেই টুরা দেখাল কাদায় একটা মানুষের পায়ের ছাপ ক্রমশ জলের দিকে গিয়ে ডুব দিয়েছে নদীতে। আমি বললাম, ‘তুই এত ভয় পাস কেন? ওটা তো একটা মানুষের পায়ের ছাপ। কেউ জলে নেমেছিল হয়তো!’

টুরা দু-দিকে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘মানুষের পায়ের ছাপ এত বড়ো হতেই পারে না। এটা অন্য কিছু। তুমি ভালো করে দ্যাখো কুশলদা, পায়ের ছাপটা কেমন অন্যরকম।’

আমি হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘অন্য আবার কীরকম?’

টুরা বলল, ‘এই দ্যাখো না, গোড়ালির ছাপটা কেমন সামনের দিকে।’

আমিও ভালো করে দেখলাম। হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু পায়ের ছাপটা ভূতের বলে মানতে মন চাইছে না। বললাম, ‘তা হলে কেউ জল থেকে উঠে এসেছে দ্বীপে। কাদা তো তাই…’

টুরা এসে খামচে ধরল আমার জামা। আর বুবুন জাপটে ধরল আমার বাঁহাত। আমি বললাম, ‘ভূতের পায়ের গোড়ালি সামনের দিকে থাকে আমিও গল্পে পড়েছি। তবে এখানে ভূত আসবে কোত্থেকে!’

এমন সময় বাংলোর দিক থেকে বাবার ডাক শুনলাম। আমি বললাম, ‘চল, খাওয়ার জন্য ডাক পড়েছে।’

বুবুন কোথা থেকে একগোছা ধুতুরা ফুল পেড়েছিল। ফুলগুলো পায়ের ছাপের দিকে ছুড়ে দিয়ে ছড়া কাটল বুবুন— ‘ধুতুরা ফুল খা, শিবের কাছে যা।’

পায়ের ছাপটা শিবের কাছে যাক না যাক, আমরা বাংলোয় ফিরে এলাম। টুরার চোখে-মুখে যতখানি ভয়ের মেঘ, বুবুনের তার চেয়েও বেশি। আমার তেমন ভয় কিছু লাগেনি। আমার মনে হল, বড়ো হলে একদিন যাব সেই জায়গায়, যেখানে ভূত আছে বলে অনেক গল্প শোনা যায়, দেখব, সত্যি ভূত আছে কি না।

খাওয়া-দাওয়া হল খুব। সামন্তকাকিমা মাংসটা যা রেঁধেছেন, এককথায় দারুণ। বুবুন আর টুরা একদম ঝাল খেতে পারে না। তাই ওদের ঝালহীন মাংস রান্না হয়েছে। বড়োদের খেতে সময় লাগছিল, ওঁরা সব নানারকম গল্প করছিলেন। মীন দ্বীপে একটা হাওয়াকল বসানো হয়েছে বাংলোয় আলোর ব্যবস্থা করার জন্য, এইসব গল্প।

এগল্প আমাদের ভালো লাগছিল না। আমি টুরা আর বুবুনকে রাজি করিয়ে মাকে গিয়ে বললাম, ‘মা, আমরা বেড়াতে যাচ্ছি।’

মা তখন কী একটা কথার পিঠে বেদম হাসছিলেন। বাবা বললেন, ‘বেশি দূর যেয়ো না কিন্তু! একটু পরেই বেরিয়ে পড়তে হবে, সন্ধ্যের আগে-আগেই।’

আমি সায় দিয়ে ঘাড় নেড়ে ছুট। টুরা একটু পিছিয়ে পড়েছিল। বলল, ‘ওদিকে যাব না কুশলদা। ওদিকে তো সেই অদ্ভুত পায়ের ছাপটা আছে!’

আমি দু-হাত ঝাঁকিয়ে বললাম, ‘তুই সত্যি পারিস টুরা। আয় বুবুন।’ তারপর আমরা সবাই মাছের ল্যাজের মতো দ্বীপের দিকটায় হাঁটতে লাগলাম। বেশ কিছুটা হাঁটার পর বুবুনই প্রথম আবিষ্কার করল অদ্ভুত দেখতে একটা বড়ো পাথর। তিরের ফলার মতো গাঁথা হয়ে আছে দ্বীপের মাটিতে। পাথরটা দেখে আমার মনে হল, উল্কা আকাশ থেকে খসে পড়েছে মাটিতে। তখনই আমার মনে পড়ে গেল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা একটা গল্পের কথা। সেই গল্পেও মীন দ্বীপের একটা পাথরের কথা ছিল। তা হলে কি সেই পাথরটাই এই পাথরটা? বা:, বেশ তো!

টুরা অবশ্য বলল, ‘কুশলদা, এই বিচ্ছিরি দেখতে পাথরটা ছাড়া দ্বীপের এই দিকটা বেশ ভালো। সকালে এদিকে বেড়াতে এলেই ভালো হত।’

বুবুন একটু দূর থেকে চেঁচিয়ে উঠল, ‘টুরাদি, কত লাল কাঁকড়া দেখবে এসো।’

আমরা বুবুনের কাছে গেলাম। দেখলাম, সত্যি এ যেন লাল কাঁকড়ার দেশ। কী সুন্দর পুট পুট করে ঢুকে পড়ছে ছোটো ছোটো গর্তে। কাঁকড়াগুলোর গায়ের রংও কী সুন্দর।

দু-পাশে ছোটো ছোটো ঝোপ, তার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে রাস্তা। আসলে রাস্তা নয়, কেউ রাস্তার মতো করে বানায়ওনি। তবু দেখলে মনে হয় এক সুন্দর বনপথ চলে গেছে দূরে। অনেকটা দূরে গিয়ে ঝাঁপ দিয়েছে নদীতে। তার সঙ্গী কেবল নির্জনতা।

আমরা সেই বনপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম নদীর প্রান্তে। বুবুন দু-হাত ভরে তুলেছে অনেক বনফুল, তার কিছ টুরাকেও রাখতে দিয়েছে। নদীর দিকে তাকিয়ে টুরা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওই দ্যাখ বুবুন, দ্যাখো কুশলদা, একটা লোক নৌকোয় চড়ে নদীতে…..।’

আমিও দেখলাম। বললাম, ‘ও, লোকটা মাছ ধরছে জাল ফেলে।’ তখনই আমার মনে পড়ে গেল, বাবা বলেছিলেন, দ্বীপটায় কোনো মানুষ নেই, শুধু বাংলোর দু-জন কাজের লোক ছাড়া। তারা বাংলোয় আছে দেখে এসেছি। তা হলে এই লোকটা এল কোত্থেকে?

টুরা বলল, ‘যাবে কুশলদা, লোকটার কাছে? বুবুন, যাবি?’

আমিও উৎসাহে বললাম, ‘চল দেখি, লোকটা কী মাছ ধরছে।’

আমরা লোকটার কাছাকাছি হতেই দেখলাম, একটা ভাঙা নৌকোয় চড়ে নদীর খাঁড়িতে জাল ফেলছে লোকটা। হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল, আমরা যখন নৌকোয় চড়ে দ্বীপে এসেছিলাম, তখন একটা খাঁড়ির মুখে মাটিতে একটা ভাঙা নৌকো পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। নৌকোর দু-পাশের কাঠ ভাঙা, হালটাও অর্ধেকটা নেই। লোকটা যে-নৌকোয় চড়ে মাছ ধরছে, অনেকটা সেই নৌকোর মতো। ভালো করে তাকিয়ে দেখেই আমার হাত-পা অবশ হয়ে গেল। হ্যাঁ, ওটা সেই ডাঙায় পড়ে থাকা ভাঙা নৌকোটাই। কিন্তু আশ্চর্য, নৌকোয় জল ঢুকছে না তো। নৌকোটা জলে ভেসে আছে কী করে?

এমন সময় টুরা আমার কানে কানে বলল, ‘কুশলদা, নৌকোটা কেমন ভাঙা দ্যাখো। জলে ভেসে …।’

আমি হাত দিয়ে টুরার মুখটা চেপে ধরলাম। দরকার কী ওসব কথা বলার। লোকটা শুনতে পেলে?

বুবুন তখন ঝিনুক খোঁজায় ব্যস্ত। একটা বড়ো রঙিন ঝিনুক পেয়ে গেছে, তাই তার আনন্দের সীমা নেই।

লোকটা আমাদের দিকে তাকাচ্ছে না। নিজের মনে জাল ফেলে যাচ্ছে। লোকটার মুখও ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। নদীর দিকে লোকটার মুখ। আমি সাহস দেখানোর জন্য চেঁচিয়ে লোকটাকে বললাম, ‘ও কাকু, কী মাছ পেলে?’

লোকটা কোনো উত্তর দিল না। তা হলে কি আমার কথা শুনতে পায়নি। আমি যে ভয় পাচ্ছি, টুরা যেন বুঝতে না পারে, তাই আরও জোরে বললাম, ‘ও কাকু, তুমি যে মাছ ধরছ তোমার মাছ কই?’

তখনও কোনো উত্তর এল না। আমি মনে মনে ভাবলাম, লোকটা কেমন! এমন সময় আমি লোকটার পায়ের দিকে তাকাতেই আমার দমবন্ধ হয়ে গেল। কোনোরকমে একহাতে টুরাকে, অন্য হাতে বুবুনকে ধরে নিয়ে প্রাণপণে ছুটতে লাগলাম। টুরা আর বুবুন জিজ্ঞেস করছে, ‘ও কুশলদা, তুমি এত জোরে ছুটছ কেন? কী দেখেছ?’

আমি সেই সরু বনপথ ধরে অনেকক্ষণ ছোটার পর ভীষণ হাঁপিয়ে পড়েছি। শুধু পেছন ফিরে একবার তাকালাম। দেখি কোনো নৌকোও নেই, আর কোনো লোকও জাল ফেলে মাছ ধরছে না।

আবারও ছুটতে লাগলাম। বুবুন এবং টুরার হাত আমার দু-হাতে। ওরা মাঝে মাঝেই চেঁচিয়ে বলছে, ‘ও কুশলদা, বলো না কী দেখলে, বলো না।’

যখন বাংলোর প্রায় কাছে চলে এসেছি, পলকের জন্য থামলাম। টুরা ও বুবুনকে বললাম, ‘যে লোকটা মাছ ধরছিল তার পায়ের গোড়ালি দুটো সামনের দিকে।’

টুরা বলল, ‘আমি তো নদীর পাড়ে তা হলে তখন এরই পায়ের ছাপ দেখেছি। তুমি তো তখন আমার কথা বিশ্বাস….।’

বুবুনও চেঁচিয়ে কী বলতে যাচ্ছিল। আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘কাউকে কিচ্ছু বলবি না। ভালোয় ভালোয় হলদিয়া ফিরে যাই, তারপর।’

টুরা ও বুবুন ঘাড় নেড়ে সায় দিল। আমরা যখন বাংলোয় ফিরে এলাম, তিনজনেরই জামা ঘামে ভিজে গেছে। আমাদের ভয় পাওয়া থমথমে মুখ-চোখ দেখে মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা এত ছোটাছুটি করেছ যে, জামাটামা একদম ভিজে গেছে ঘামে।’

বোসকাকিমা বললেন, ‘তোমাদের কখন থেকে ডাকছি আমরা। কোথায় গিয়েছিলে সব? কারও মুখে যে আর কথা নেই।’

আমাদের কারও মুখ থেকেই কোনো কথা সরল না। সব গোছগাছ করাই ছিল। সবাই এসে নৌকোয় উঠলাম। আমাদের নৌকোর মাঝি সুদর্শন গায়েন নৌকো ছেড়ে দিল।

পশ্চিমে হলদিয়া বন্দরের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা জাহাজগুলোর মাথায় রঙিন আলো ছড়িয়ে সূর্য ডুবছে। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, অনেকটাই আবছা হয়ে এসেছে মীন দ্বীপ। সামন্তকাকিমা গলা ছেড়ে রবীন্দ্রসংগীত গাইছেন। কিন্তু আমাদের তিনজনের কারও মুখে কোনো কথা নেই।

নৌকো এসে পৌঁছোল পাতিখালি। আমরা মাটিতে পা দিয়ে হাঁপ ছাড়লাম। আমি বাবাকে বললাম, ‘মীন দ্বীপে আমরা একটা ভূত দেখেছি বাবা।’

বাবা হেসে বললেন, ‘ভূত আবার মীন দ্বীপে আসবে কোত্থেকে? ভূত বলে সত্যিই কিছু আছে নাকি?’

আমার গলায় উত্তেজনা, ‘হ্যাঁ বাবা, আমরা দেখেছি একটা ভাঙা নৌকোয় চড়ে একটা লোক জাল ফেলে মাছ ধরছে। তার পায়ের গোড়ালি দুটো সামনের দিকে।’

টুরা আর বুবুন একসঙ্গে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, ভূত।’

আমাদের তিনজনের কথায় বড়োরা সবাই হোহো করে হেসে উঠলেন।

সুদর্শন গায়েন নৌকো থেকে আমাদের জিনিস নামাতে নামাতে বলল, ‘তোমরা তা হলে তেনাকে দেখেছ।’

টুরা আর বুবুন আমার গা-ঘেঁষে হাঁটতে লাগল। নদীর ঢালু বেয়ে আমরা ওপরে উঠছি। আমি আর একবার মীন দ্বীপের দিকে তাকালাম। সন্ধ্যার অন্ধকারে কোথায় মুখ লুকিয়েছে মীন দ্বীপ। দূরে শুধু দু-তিনটে বয়ার আলো। মাঝে মাঝে জ্বলছে-নিভছে।

মনে মনে ভাবলাম, বড়োরা যতই হেসে উড়িয়ে দিন, আমি আর কোনোদিন মীন দ্বীপে যাব না, এমনকী, বড়ো হলেও না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *