মিসেস মেলনির গল্প – সুকুমার ভট্টাচার্য
বেশ সুন্দর সাজানো-গোছানো ঘর। জানলা দরজার সব পর্দাগুলোই নামানো। ঘরের মাঝ বরাবর ছোট দুটো টেবিল চেয়ার। দুটোর ওপরেই একটা করে টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। তারই একটাতে বসে মিসেস মেলনি ঘন ঘন ঘড়ি দেখছেন। সময় হয়েছে, এবার তার স্বামী ফিরবেন অফিস থেকে।
একটা স্মিত হাসি ছড়িয়ে আছে তার সারা মুখে। তিনি জানেন, ঘড়ির কাঁটা যত এগোবে, সে মানুষটির ফেরা ততই আসন্ন হবে। মাথা নিচু করে বোনার কাজটা করে যান তিনি। একটা ছোট মোজা বুনছেন। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় চকচক করছে কপালটা, লাবণ্য উছলে পড়ছে মুখের ওপর। মা হতে চলেছেন তিনি, আর মাত্র মাস চারেক বাকি। আসন্ন মাতৃত্বের কমনীয়তায় সমস্ত মুখটি কোমল।
ঘড়িতে তখনো পাঁচটা বাজতে দশ মিনিট বাকি, বাইরের বাগানে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। তারপরেই গাড়িটার দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ শুনতে পেলেন মিসেস মেলনি। বুঝলেন, স্বামী তার ফিরেছেন। যত যাই হোক, বাড়ি ফিরতে এক মিনিটেরও হেরফের হয় না ভদ্রলোকের। আর একটু পরে বাইরের দিক থেকে দরজার চাবি ঘোরানো হলো, হাতের বোনাটা টেবিলের ওপর রেখে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। সমস্ত দিনের অদর্শনের পর একটু সোহাগ না পেলেই নয়। ভদ্রলোক ঘরের ভেতর পা দিতেই তিনি বললেন, ‘হ্যাল্লো ডার্লিং!’
ভদ্রলোক ছোট করে জবাব দিলেন, ‘হ্যাল্লো!’
মিসেস মেলনি এগিয়ে গিয়ে স্বামীর গা থেকে কোটটা নামিয়ে নিলেন। সেটাকে হ্যাঙারে ঝুলিয়ে দিয়ে, গিয়ে দাঁড়ালেন কাবার্ডটার সামনে। সেটা খুলে কিছুটা পানীয় ঢাললেন দুটো গ্লাসে। তারপর ফিরে এসে গ্লাস দুটো টেবিলের ওপর রেখে বসলেন মুখোমুখি।
মিসেস মেলনি জানেন, স্বামী তার এ সময় মোটেই কথা বলেন না। পুরোপুরি একটা গ্লাস পেটে যাবার পর শুরু হবে যত কথা। অতএব তিনিও কথা না বলে শরীরটাকে এলিয়ে দেন চেয়ারে। আধবোনা মোজাটা তুলে নিয়ে বুনতে শুরু করেন।
কিন্তু ভদ্রলোকের মেজাজ যে আজ অন্য রকম, সেটা আর খেয়াল করেননি তিনি। গ্লাসটা হাতে ধরে চুপ করে বসে থাকেন ভদ্রলোক। হঠাৎ তার ওপর চোখ পড়তেই মিসেস মেলনি জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার, এমন চুপচাপ বসে যে? খুবই কি ঝক্কি গেছে অফিসে, ক্লান্ত?
বিরক্তির সঙ্গে মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক, হ্যাঁ, খুবই ক্লান্ত!
তারপর কখনো যা করেন না, হঠাৎ তা-ই করে বসলেন ভদ্রলোক। পায়ের। কাছে একটা নোংরা ফেলার বাক্স ছিল, পানীয়টা ধীরে ধীরে ফেলে দিলেন সেটার ভেতর। শশব্যস্তে উঠে দাঁড়ালেন মিসেস মেলনি, কি হলো, কিছু নোংরা পড়েছিল নাকি? ঠিক আছে, আমি আর এক গ্লাস এনে দিচ্ছি।
তার দরকার নেই, তুমি বসো।
ভদ্রলোক নিজেই গিয়ে হাজির হলেন কাবার্ডটার সামনে। যখন ফিরলেন, মিসেস মেলনি দেখলেন, গ্লাসটা আর শুন্য নয়। আগের থেকেও কড়া পানীয় সেটার ভেতর টলটল করছে। হঠাৎ চোখ পড়ল ভদ্রলোকের খালি পা দুটোর ওপর। বললেন, দাঁড়াও, তোমার চটিজোড়াটা এনে দিই!
ন্-না, তার দরকার নেই। তুমি বসো।
এরপর আর কিছু করার নেই মিসেস মেলনির। বসে পড়লেন চেয়ারে। কোনো কথাই বার হলো না মুখ দিয়ে। ভদ্রলোকও কোনো কথা না বলে একটার পর একটা চুমুক দিতে লাগলেন গ্লাসে। বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল সারা মুখে। মিসেস মেলনি জানেন ওটা কড়া পানীয়র জের ছাড়া আর কিছুই নয়।
যাই বলল, এতটা ক্লান্ত হওয়া উচিত নয় তোমার। পুলিশের সিনিয়র গোয়েন্দা হিসেবে ঝামেলা ঝঞ্জাট তো থাকবেই। দরকার পড়লে সারাদিন ছুটতে হতে পারে।
এ কথারও কোনো জবাব দিলেন না ভদ্রলোক। বাধ্য হয়ে মিসেস মেলনি টেনে নিলেন হাতের বোনাটা। হঠাৎ এক সময় মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, কিছু খাবে,
এনে দেব? যেহেতু আজ বৃহস্পতিবার তাই কিছু রাঁধিনি।
‘উঁহু, খিদে নেই।
না কেন! সমস্ত দিনের পর ক্লান্তি তো স্বাভাবিক। বরং এক কাজ করা যাক, আজ আর হোটেলে গিয়ে কাজ নেই। বাড়িতে সবকিছুই আছে, রাতও এমন কিছু হয়নি—যদি বলো তো রান্নার ব্যবস্থা করি।
মহিলা ভেবেছিলেন, এবার ভদ্রলোক বুঝি হাসবেন। কিংবা নড়েচড়ে বসবেন। কিন্তু তার কোনো লক্ষণই দেখা গেল না। রীতিমত অবাক হলেন মিসেস মেলনি। বলেন, কিন্তু খালি পেটে অমন কড়া জিনিস খাওয়া ঠিক নয়। যা পাই, তাই-ই এনে দিচ্ছি কিচেন থেকে।
না না, তার দরকার নেই।
এবার স্থিরচোখে ভদ্রলোকের দিকে তাকালেন মিসেস মেলনি। মনে হলো, একটু যেন অন্যমনস্ক। বললেন, ‘আজ তোমার কি হয়েছে জানিনা। তবে যাইই হোক, খিদে চেপে রাখার কোনো কারণ দেখি না। দু-তিন রকমের মাংস আছে ডিপ-ফ্রিজে।
যেটা বলবে সেটাই বেঁধে দিতে পারি।
বলেছি তো, ওসবের কোনো দরকার নেই।
বাজে কথা বলো না। সমস্ত দিন খেটেখুটে এসে না খেয়ে থাকবে নাকি? যেমনি হোক, আমি ঠিকই রাঁধব, তারপর খাওয়া না খাওয়া তোমার ব্যাপার।
হাতের বোনাটা টেবিলের ওপর রেখে উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রমহিলা।
‘অত ব্যস্ত হবার কিছু নেই। অন্তত আরো মিনিট কয়েক বসো।‘
মিসেস মেলনির মনে হলো, স্বামীর গলাটা কেমন যেন গম্ভীর। বুকটা দুরদুর করে উঠল তাঁর।
‘কি হলো, বসো।‘
ভদ্রলোকের কথায় চেয়ারে বসে পড়লেন মিসেস মেলনি। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠল বিস্ময়ে। গ্লাসের পানীয়টা শেষ করে ভদ্রলোক বললেন, কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে তোমার সঙ্গে।
‘কি এমন কথা, যার জন্যে—’
বলছি।
কিন্তু বুও কোনো কথা না বলে, মাথা নিচু করে বসে রইলেন ভদ্রলোক। বোধহয় বক্তব্যটা মনে মনে গুছিয়ে নেবার জন্যেই। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় মাথার চুলগুলোকচক করছে। চোখ থেকে থুতনির নিচ পর্যন্ত অন্ধকার। বেশ কয়েক সেকেন্ড পর মেলনি দেখলেন, ওনার ঠোঁট দুটো যেন নড়ছে।
আমার কথায় যে দুঃখ পাবে, তা আমি জানি। কিন্তু না বলে আমার উপায় নেই—আমায় বলতেই হবে। আশা করব, কোনোরকম ভুল বুঝবে না।
এই সামান্য ভূমিকার পর তিনি মুখ খুললেন। একটানা অনেকক্ষণ যে কথা বললেন, এমন নয়। মাত্র চার-পাঁচ মিনিট। তাই শুনে মিসেস মেলরি শরীরটা কেঁপে উঠল বারবার। একদৃষ্টে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাথাটায় যেন আগুন জ্বলে উঠল। মানসচক্ষে দেখলেন, রেসের ঘোড়ার মতো স্বামী তার ক্রমশই দুরে সরে যাচ্ছেন।
সবশেষে ভদ্রলোক বললেন, এই হলো ব্যাপার। যদিও আমি স্বীকার করি, এসব কথা এখন না বলে, আরো মাস চারেক পরে বললেই ভাল হতো। কিন্তু অতদিন সবুর করার ধৈর্য নেই আমার। যে চাকরি করি, তাতে ব্যক্তিগত মানসম্মানের একটা মস্ত ভূমিকা আছে। কোনো কারণেই সেটাকে বিসর্জন দেয়া যায় না। তবে হ্যাঁ, টাকাকড়ির ব্যাপারে চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি কথা দিচ্ছি, সেটা যুগিয়ে যাব। শুধু তাই নয়, পরে বাচ্চা নিয়ে যাতে অসুবিধেয় না পড়ে, সেদিকেও লক্ষ্য রাব্ব।
কথাগুলো কানে গেলেও, সত্যি বলে মনেই হয়নি মিসেস মেলনির। ভেবেছিলেন, স্বামী বুঝি তার সঙ্গে রসিকতা করছেন, কিন্তু কথাগুলো শেষ হবার পর সে সন্দেহ আর রইল না। ভেতরে ভেতরে মনটা কঠোর হয়ে উঠল। বু, যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব দেখিয়ে বললেন, ‘আমি উঠছি, রান্না করতে হবে।‘
এবার সত্যি সত্যিই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। স্বামী ভদ্রলোকও আর তাকে বসতে বললেন না।
ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। হলে হবে কি, শরীরটা আর নিজের বশে নেই। চোখ-মুখ দিয়ে আগুন ছুটছে। পা দুটো যেন আর মাটিতে নেই। সামনের দালানটা পেরিয়ে ঝড়ের মতো কিচেনে গিয়ে ঢুকলেন। ঘরটা অন্ধকার। এক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে সুইচটা মেরে দিলেন। আলো ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। ডিপ ফ্রিজটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। একটানে ডালাটা খুলেই ভেতরে হাত বাড়ালেন। মুঠির ভেত্র যেটা পড়ল সেটাকেই টেনে বার করলেন বাইরে। দেখলেন, ব্রাউন পেপার জড়ানো লম্বা মন কি যেন একটা। ফরফর করে মোড়কটা ছিঁড়ে ফেলতেই, আলোয় কচক করে উঠল ভেতরের জিনিসটা। সেটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ দুটি ছোট হয়ে এল মিসেস মেলনির।
জিনিসটা আর কিছুই নয়, একটা আস্ত ভেড়ার ঠ্যাং। কদিন আগে কিনে আনা হয়েছিল মিটশপ থেকে। ডিপ-ফ্রিজে পড়ে থাকার ফলে শুকিয়ে শক্ত লোহার মতো হয়ে গেছে।
এতেই হবে। এটা দিয়েই সারতে হবে কাজটা। মনে মনে বললেন মহিলা। ঠ্যাংটার নিচের দিকটা বেশ সরু। সেই জায়গাটাই দু হাতে ধরে বসার ঘরে দরজায় এসে দাঁড়ালেন তিনি। দেখলেন, ভদ্রলোক আর চেয়ারে নেই। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশের তারা গুনছেন।
যতই পা টিপে টিপে ঢুকুন না কেন, তিনি যে ঘরে ঢুকেছেন ভদ্রলোক টের পেলেন। কিন্তু পিছু না ফিরে আগের মতোই তাকিয়ে রইলেন আকাশের দিকে। বললেন, ‘আর যাই করো, আমার জন্যে যেন রান্না করো না। ও কাজটা আমি বাইরেই সেরে আসব।’
মিসেস মেলনি ততক্ষণে তার পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। দু হাতে চেপে ধরা জানোয়ারের ঠ্যাংটা ওপরে তুলেই সজোরে বসিয়ে দিলেন স্বামীর মাথায়। ঢপ করে একটা আওয়াজ হলো। পরে পরেই দু’পা পিছিয়ে গেলেন তিনি। অবস্থাটা কি হয় দেখার জন্যে। বেশি নয়, চার-পাঁচ সেকেন্ড দাঁড়াবার পর দেখলেন, ভদ্রলোক লুটিয়ে পড়লেন মেঝেতে। পাশে, একটা টেবিল ছিল, ধাক্কা খেয়ে সেটা ছিটকে গেল দূরে।
এবার মেজাজটা একটু শান্ত হলো মিসেস মেলনির। মাটিতে পড়ে থাকা স্বামীর দিকে তাকিয়ে কাজটার গুরুত্ব টের পেলেন তিনি। ধীরপায়ে বার হয়ে গেলেন ঘর থেকে। বিড়বিড় করে বললেন, ব্যাপারটা কি দাঁড়াল? দাঁড়াল, আমি আমার স্বামীকে নিজের হাতে খুন করলাম।
অসম্ভব হলেও, ঘটনাটা সত্যি। কিন্তু এ কাজের পরিণাম কি? রীতিমত চিন্তিত হয়ে পড়লেন মিসেস মেলনি। পুলিসের এক জাঁদরেল গোয়েন্দা অফিসারের স্ত্রী হিসেবে তিনি বেশ ভালই জানেন, এ অপরাধের শাস্তি কি। কিন্তু এ মুহূর্তে সে ভয়টাকে খুব বড় বলে মনে হয় না। প্যাট্রিককে ছেড়ে বেঁচে থাকার চাইতে, সে শাস্তি অনেক ভাল। ভানা হলো আর একজনকে নিয়ে। যে সন্তান আলোর অপেক্ষায় দিন। গুনছে, চিন্তাটা তাকে নিয়ে। আচ্ছা, আইন কি বলে? দুজনের প্রাণদণ্ড কি একসঙ্গেই দেবে? নাকি সামনের বাকি দিন ক’টা তাকে বাঁচিয়ে রাখা হবে?
আইনকানুনের কিছুই জানেন না তিনি। অতএব কাল জোব্বার মালিকদের হাতে নিজের স্বকিছু ছেড়ে দিতে তিনি রাজি নন। যে ভাবেই হোক, অভিযোগ এড়িয়ে যেতে হবে, না হলে নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাবেন তিনি।
ভেড়ার ঠ্যাংটা নিয়ে কিচেনে ফিরলেন মিসেস মেলনি। গ্যাস ওভেনের পাল্লাটা খুলে গোটা ঠ্যাংটাই সেটার ভেতর রেখে আগুনটা জ্বালিয়ে দিলেন। তারপর ভাল করে হাত-মুখ ধুয়ে নিজের ঘরে গেলেন। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে দেখলেন মিসেস মেলনি। মাথার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। ঘামে মুখের প্রসাধন প্রায় ধুয়ে গেছে। দ্রুত হাতে পাউডার পাফ বুলিয়ে সেটুকু সামলে নিলেন। তিনি। লিপস্টিকটা ঠোঁটের ওপর বুলিয়ে নিয়ে হাসবার চেষ্টা করলেন তিনি। হাসি হলো, কিন্তু সে হাসি পছন্দ হলো না তার। বারবার একটানা চেষ্টা করার পর কিছুটা স্বাভাবিক হাসি হাসতে পারলেন। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বললেন ‘হ্যাল্লো!
পরমুহূর্তে মনে হলো গলার স্বরটা বড় বেসুরো। বারকয়েক গলা ঝেড়ে নিয়ে তাকালেন আয়নার দিকে। বললেন, ‘হ্যাল্লো স্যাম, আমায় কিছু ভাল আলু দিতে পারো? আর হ্যাঁ, কিছু মটর কড়াই?’
তারপরই কেমন যেন মনে হলো তাঁর। বলার ধরনটা খুব একটা স্বাভাবিক হয়নি। অতএব আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার মহড়া দিতে লাগলেন। অনেক পরে নিজেকে স্বাভাবিক মনে হতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন মিসেস মেলনি। সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নেমে পিছনের দরজা দিয়ে একেবারে গ্যারেজে। নিজের গাড়িতে বসে স্টার্ট নিলেন সজোরে।
দুটো বাজতে তখন কিছু বাকি। যে দোকান থেকে বারবার বাড়ির জিনিসপত্তর কেনা হয়, সেটার সামনে গিয়ে ব্রেক করলেন, ‘হ্যাল্লো স্যাম—’
কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দোকানদারের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, ‘মিসেস মেলনি, আপনি! গুড ইভনিং, কেমন আছেন?’
‘ভাল ভাল, বেশ ভাল। তোমার খবর কি?’
‘ওই একরকম।‘
‘দেখো স্যাম, আমায় কিছু ভাল আলু দিতে পার?—আর হ্যাঁ, ভাল মটরদানা আছে? থাকে তো তা-ও এক প্যাকেট দাও।
দোকানদার তাক থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে কাউন্টারের ওপর রাখলেন।
‘বৃহস্পতিবার হলে আমরা সাধারণত হোটেলে খাই। ঘরে আর বাঁধি না। কিন্তু প্যাট্রিক আজ এত ক্লান্ত যে, বাইরে যেতে চাইল না। বলল, বাড়িতেই যা তোক কিছু রাঁধো। এদিকে সবজি কিছুই নেই বাড়িতে।‘
‘আলু মটরের সমস্যা না হয় মিটল, কিন্তু মাংসের কি করবেন?’
‘ওটা আছে। একটা আস্ত ভেঁড়ার ঠ্যাং ডিপ ফ্রিজ থেকে বার করেছি।‘
‘তাহলে আর কি?’
‘যদিও ফ্রিজের মাংস আমার তেমন ভাল লাগে না। কেমন যেন শুকনো মতন। তুমি কি মনে করো, খুব বাজে একটা কিছু হবে?’
‘তফাত তেমন কিছু হয় না। কিন্তু তারপর?’
‘তারপর বলতে?’
‘শেষ পাতে কি দেবেন তাঁকে?’
‘সেটা তো ভাবিনি। তুমি কি দিতে বলো?’
‘আমি বলি পুডিং। আমি জানি, ও জিনিসটা মিঃ প্যাট্রিকের খুব পছন্দ।‘
‘বলছ? তাহলে তাই-ই দাও।’
গাড়িতে বসে আবার স্টার্ট নিলেন মিসেস মেলনি। ভাবলেন, এবার আরো সাবধান হতে হবে। চোখে-মুখে এমন ভাব বজায় রাখতে হবে যাতে কেউ কোনো সন্দেহ করতে না পারে। এমনভাবে বাড়ি ফিরতে হবে, যেন সেখানকার অবস্থা তিনি কিছুই জানেন না। কিন্তু বাড়ি ফিরে যখন সেই বাজে দৃশ্যটা দেখবেন, একমাত্র তখনি তিনি ভেঙে পড়তে পারেন। তাহলে উপস্থিত তার ভূমিকা কি? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলেন মিসেস মেলনি। জবাবটাও নিজেই দিলেন। তিনি হলেন মিসেস প্যাট্রিক মেলনি। পুলিশের এক জাঁদরেল গোয়েন্দা অফিসারের স্ত্রী। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দোকান থেকে ফিরছেন তিনি। উদ্দেশ্য, ক্লান্ত স্বামীকে যত শীগগির সম্ভব কিছু বেঁধে খেতে দেয়া। হ্যাঁ, মনের এই ভাবটাই নিখুতভাবে বজায় রাখতে হবে সব দিক থেকে। না হলেই বিপদ।
তাই-ই করলেন মিসেস মেলনি। পিছনের দরজা দিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বাড়ি ঢুকলেন তিনি। প্রথমেই গেলেনে কিচেনে। সেখান থেকে গলা চড়িয়ে বললেন, ‘প্যাট্রিক, আমি এই ফিরলাম। তোমার খবর কি? একা একা খুব খারাপ লাগছে তো?’
স্বাভাবিকভাবেই কোনো জবাব এল না প্যাট্রিকের তরফ থেকে। আনা জিনিসগুলো টেবিলের ওপর রেখে বসার ঘরে ঢুকলেন মিসেস মেলনি। সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলেন প্যাট্রিককে। দু’পা মুড়ে একটা হাতের ওপর দেহের সব ভার দিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন। মিসেস মেলনির মনটা আপনা হতেই হুহু করে উঠল।
অভিনয়ের আর প্রয়োজন হলো না। ব্রিাহিত জীবনের নানা স্মৃতি মনে ভিড় করে। আসতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। ঝরঝর করে জল ঝরে পড়ল চোখ দিয়ে। ছুটে গিয়ে বসে পড়লেন স্বামীর পাশে।
অনেক পরে নিজেকে শক্ত করে উঠে দাঁড়ালেন। টেলিফোনটার কাছে গিয়ে রিসিভারটা তুলে নিলেন। প্যাট্রিকের দৌলতে পুলিশ স্টেশনের নম্বরটা তার জানা। ডায়াল করতেই সেদিককার সাড়া পাওয়া গেল, হ্যালো
‘এখখুনি আমার বাড়িতে আসুন, এখখুনি! আমার স্বামী,— মানে প্যাট্রিককে, কে বা কারা খুন করে গেছে।‘
‘কিন্তু তার আগে বলুন, আপনি কে? কোথা থেকে কথা বলছেন?’
‘আ-আমি, মানে মিসেস মেলনি।’
‘মিসেস প্যাট্রিক মেলনি?’
‘হ্যাঁ।‘
‘কি বলছেন আপনি! প্যাট্রিক খুন হয়েছে?’
‘আমার সেই রকম মনে হচ্ছে!’
‘সে কি! আচ্ছা ঠিক আছে—আমরা এখুনি যাচ্ছি।‘
কিছু পরেই পুলিশের জিপ এসে দাঁড়াল বাগানে। পায়ের আওয়াজ শোনা গেল সিঁড়িতে। মিসেস মেলনি দরজার মুখে গিয়ে দাঁড়াতেই দু’জন পুলিশ অফিসারের সামনে পড়লেন। স্বামীর সহকর্মী হিসেবে দু’জনেই পরিচিত। হলে হবে কি, কোনোরকম সম্ভাষণ জানানোর আগেই মাথাট বোঁও করে ঘুরে গেল। কিন্তু মেঝেতে আছড়ে পড়ার আগেই জ্যাক নূন্নান তাকে ধরে পেললেন। সন্তর্পণে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলেন একটা চেয়ারে। দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন মিঃ ও ম্যালে। তিনি ততক্ষণে প্যাট্রিককে পরীক্ষা করতে শুরু করেছে। একটু সুস্থির হবার পর মিসেস মেলনি জিজ্ঞেস করেন, ‘ও কি সত্যিই আর নেই?’
‘সেই রকমই মনে হচ্ছে। কিন্তু ঘটনাটা কি?’
উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠায় মিসেস মেলনির অবস্থা খুব কাহিল। গলা দিয়ে স্বর বার হয় না। তবু সংক্ষেপে সব কথাই বললেন তিনি। চোখের জল ঝরে পড়ল দু’গাল বেয়ে।
সেই সময় আরো দু’চারজন ঘরের ভেতরে এসে দাঁড়ালেন। তাঁদের কেউ ডাক্তার, কেউ ফটোগ্রাফার, কেউ বা ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ। প্যাট্রিককে কেন্দ্র করে যে যার কাজ শুরু করে দিলেন। গোয়েন্দাদের একজন আবার মিসেস মেলনির খুবই পরিচিত। নাম মিঃ ল্যাটের। ভদ্রলোক খুব নরম গলায় জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। বাধ্য হয়ে আবার মুখ খুলতে হলো মিসেস মেলনিকে। কাহিনী শেষ করতেই মিঃ ল্যাটের জিজ্ঞেস করলেন, কোন দোকানে গেছিলেন?
মিসেস মেলনি নাম বললেন দোকানটার।
হাত কয়েক দূরে গোয়েন্দাদের ক’জন সহকারী দাঁড়িয়েছিলেন। দোকানের নামটা কানে যেতেই তারা নিচু গলায় কি বলাবলি করলেন নিজেদের মধ্যে।
পরক্ষণেই একজনকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখলেন মিসেস মেলনি।
মিনিট পনের পরে সে মানুষটিকে ফিরে আসতে দেখলেন মিসেস মেলনি। ঘরের সবকটি মানুষ তাঁকে ঘিরে দাঁড়ালেন। নিচু গলায় তিনি তাঁর রিপোর্ট পেশ করলেন। কান পাতলেন মহিলা।
‘ন্-না, দোকানদার ওনাকে বেশ হাসিখুশিই দেখেছেন…. রীতিমত স্বাভাবিক। …আলু আর মটর কড়াই নিয়েছেন।…. না, আন্তরিকতার কোনো অভাব চোখে পড়েনি। আমার মনে হয়, এ কাজ ওনার পক্ষে অসম্ভব।‘
কিছু পরে ডাক্তার আর বিশেষজ্ঞর দল বার হয়ে গেলেন ঘর থেকে। স্ট্রেচার হাতে এসে হাজির হলো দু’জন,—প্যাট্রিকের দেহটা নিয়ে চলে গেল তারা। দু’জন সিপাহি আর দু’জন গোয়েন্দা শুধু রয়ে গেলেন ঘরের ভেতর। গোয়েন্দা দু’জন খুবই ভাল। মিসেস মেলনির মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে, তারা মহিলাকে তাঁর বড় বোনের বাড়ি পৌঁছে দেবার প্রস্তাব করলেন। সেখানে যাবার ইচ্ছা না হলে, তারা মহিলাকে নিজেদের বাড়ি নিয়ে গিয়ে রাখতে পারেন। সেখানে তাদের স্ত্রী আছেন, দেখাশোনার কোনো ত্রুটি হবে না।
সব ব্যাপারেই নিজের অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন মিসেস মেলনি। না, এই মুহূর্তে এ বাড়ি ছেড়ে তিনি কোথাও যেতে রাজি নন।
তাহলে এক কাজ করুন, এভাবে বসে না থেকে একটু বরং শুয়ে পড়ুন।
জ্যাক নুন্নানের প্রস্তাবে মাথা নাড়লেন মিসেস মেলনি, না, এই বেশ আছি। শরীরটা সামলে গেলে উঠে পড়ব।
বাধ্য হয়ে গোয়েন্দারা তাকে একলা রেখেই নিজেদের কাজে লেগে পড়লেন। তাদের চলাফেরা বা কথাবার্তার ধরন দেখে মিসেস মেলনির মনে হলো, তারা কিছু একটা খুঁজছেন!
কিছু না পেয়ে এক সময় দাঁড়িয়ে পড়লেন মিঃ ল্যাটের। জ্যাক মুন্নানের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার ধারণা, আততায়ী পিছন দিকে থেকে প্যাট্রিককে আঘাত করেছে। লোহার রড বা ওই রকমই কোনো ভেঁতা কিছু দিয়ে কাজটা সারা হয়েছে। কিন্তু ঘরের ভেত্র সেরকম কিছু যখন দেখছি না, তখন বুঝতে হবে খুনী সেটা সঙ্গে করেই নিয়ে গেছে। যদিও অমন একটা জিনিস হাতে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়া অসম্ভব। অতএব, খুনী যে সেটা বাড়িরই কোথাও না কোথাও ফেলে গেছে, তাতে আমি নিঃসন্দেহ।
‘আমিও তাই মনে করি।’ মিঃ নুন্নান বললেন, শুধু তাই নয়, খুব ঠাণ্ডা মাথায় সুপরিকল্পিতভাবে যে কাজটা করা হয়েছে তা নয়। হঠাৎ ঝোকের বশে এ কাজটা হয়ে গেছে। যাই হোক, অস্ত্রটার সন্ধান পেলেই খুনীকে হাতেনাতে ধরে ফেলা সম্ভব হবে।
মিসেস মেলনি আগের মতোই চেয়ারে বসে। একেবারে চুপচাপ। সহকারী গোয়েন্দারা যে বাড়ির বাকি ঘরগুলোয় তল্লাশি করছে, সেটা তিনি বুঝতেই পারছেন। অবিরাম খুটখাট চেয়ার টেবিল নাড়াচাড়া করার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। অনেক পরে মিঃ ল্যাটের ঘরে এসে মিসেস মেলনির চেয়ারের পাশে ধপ করে বসে পড়লেন।
‘নাঃ, কিছুই চোখে পড়ল না।’
এ কথার কি জবাব দেবেন মিসেস মেলনি! চুপ। মিঃ ল্যাটের জিজ্ঞেস করলেন, ‘লোহার রড বা ওই ধরনের কিছু ছিল বাড়িতে? একটু ভেবে দেখুন তো!’
মাথা নাড়লেন মিসেস মেলনি, ‘উঁহু, ঘরের ভেতর তেমন কিছু ছিল না। তবে—’
‘তবে?’
‘গ্যারেজে অমন অনেক কিছুই রাখা আছে। আপনারা সে জায়গাটা দেখেছেন?’
সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লেন মিঃ ল্যাটের। দ্রুত বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
গ্যারেজঘর তন্নতন্ন করে দেখা হলো, বাগানটাও বাদ গেল না। মিসেস মেলনি চেয়ারটায় অনড় হয়ে বসে থাকলেও সবকিছু আন্দাজ করতে পারেন। অস্ত্রটা খুঁজে বার করতে ত্রুটি করছে না কেউ। বাগানটা চষে ফেলছে বলতে গেলে। জানলার পর্দার ওপাশে চমকে চমকে উঠছে টর্চের আলো।
একসময় ঢং ঢং করে ন’টার ঘণ্টা বাজল ওয়াল-ক্লকটায়।
আরো কিছু পরে মিঃ নুন্নান ঘরে ঢুকলেন, সঙ্গে জনা দুই অফিসার। সকলের মুখ চিন্তিত। সকলেই খুব গম্ভীর। মিসেস মেলনি বুঝলেন, সকলেই হতাশ হয়েছে। করুণা হলো মিসেস মেলনির। নরম গলায় বললেন, জ্যাক, একটা অনুরোধ করব, রাখবেন?
ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মিঃ নুন্নান। সপ্রতিভভাবে বলেলন, ‘নিশ্চয়! কি অনুরোধ বলুন?’
আইনগত কোনো বাধা না থাকলে আমায় একটু পানীয় দিতে পারেন? গলাটা বড় শুকিয়ে গেছে।‘
‘এ আর এমন কি ব্যাপার, আমি এখনি দিচ্ছি।‘
এ বাড়ির কোথায় কি থাকে, তা অজানা নয় মিঃ নূন্নানের। প্যাট্রিকের সঙ্গে এসে দিনের পর দিন ঘন্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে গেছেন এ বাড়িতে। বলেন, ‘কি দেব, হুইস্কি?’
‘তাই-ই দিন, তবে খুব সামান্য।‘
মিঃ নুন্নান কাবার্ড খুলে গ্লাসে পানীয় ঢাললেন। পরে ফিরে এসে গ্লাসটা মিসেস মেলনির হাতে দিতেই, তিনি বললেন, আপনি নিলেন না? সেই সন্ধ্যে থেকে একটানা ধকল যাচ্ছে,–আপনিও তোত ক্লান্ত।
‘বেশ, বলছে যখন নিচ্ছি,–তবে সামান্য নেব। শুধুমাত্র নিজেকে খাড়া রাখার জন্যে যতটা দরকার, ততটুকুই।‘
‘তাই-ই নিন।‘
এই সময় আরো অনেকেই এসে হাজির হলেন ঘরে। মিসেস মেলনির অনুরোধে তারাও একটা করে গ্লাস নিলেন। দৃশ্যের বদল হলো। দেখা গেল সকলের হাতেই গ্লাস। সকলেই ঘিরে আছে মিসেস মেলনিকে। নানাভাবে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছেন সকলে।
মিঃ নুন্নান কখন ঘর থেকে বেরিয়ে গেছিলেন, খেয়াল করেননি মহিলা। তিনি আবার ঘরে ঢুকলেন। বললেন, মিসেস মেলনি, কিচেনে ঢুকে দেখি, উনুনটা এখনো জ্বলছে বোধহয় মাংস বসিয়েছিলেন, তাই না? বেশ ভুরভুরে গন্ধ বেরিয়েছে।
‘হ্যাঁ, তাই তো। ইস্, ওটার কথা একেবারে খেয়াল নেই।‘
‘যদি বলেন তো, উনুনটা নিভিয়ে দিই?’
‘তাহলে তো ভালই হয়! সত্যি, কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব—’
বেরিয়ে গেলেন মিঃ নুন্নান। কিছু পরে কিচেন থেকে ফিরে আসতেই মিসেস মেলনি বললেন, ‘জ্যাক, এতেই যখন করলেন, তখন আর একটা অনুরোধ করব? রাখবেন?’
‘যদি সম্ভব হয়, নিশ্চয় রাখব।‘
‘বেশ।’ বলে একটু থামলেন মিসেস মেলনি। সমবেত সকলের মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আপনারা সকলেই আমার স্বামীর বিশেষ বন্ধু। প্যাট্রিকের হত্যাকারীকে খুঁজে বার করতে সেই সন্ধে থেকে যা করছেন, তার জন্যে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু কথা হচ্ছে, সবকিছুই একটা সীমা আছে। আপনারা ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত। এই সময় আমার যা কর্তব্য তা যদি না করি, তো প্যাট্রিকের আত্মা শান্তি পাবে না। তাই বলি, উনুনে রোস্ট তো একরকম তৈরিই,—এখন সকলে মিলে যদি সেটার সদ্ব্যবহার করেন—’
‘কি বলছেন আপনি?’ বিস্মিত নুন্নান।
‘প্লিজ, একটু ভেবে দেখুন,—ও জিনিসটার কি হবে? ফেলা যাবে? আমার পক্ষে ও জিনিস মুখে ভোলা অসম্ভব। কিন্তু আপনারা তাঁর বন্ধু–তার জন্যে যে জিনিস তৈরি হয়েছে, সে জিনিস খেতে আপনাদের আপত্তি কিসের? দয়া করে খান, বিশ্রাম করুন, তারপর আবার কাজ শুরু করুন।‘
সকলেরই খিদে পেয়েছিল। একটা দোটানার ভাব দেখা গেল সবার মধ্যে। মিসেস মেলনি বললেন, ‘এত সংকোচের কি আছে? এ বাড়িতে আপনারা কেউ নতুন নন। নিন শুরু করুন তো।‘
এর ওপর আর কথা চলে না। জ্যাক মুন্নান সকলকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলেন। মিঃ ল্যাটের কিচেন থেকে রোস্টের খণ্ডটা নিয়ে এসে রাখলেন সবার সামনে। মিসেস মেলনি আর উঠলেন না। আগের মতোই চেয়ারে বসে স্বামীর সহকর্মীদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারা তখন গোগ্রাসে খেতে শুরু করেছেন ভেটর ঠ্যাংটা।
চার্লি, তোমায় আর একটু মাংস দিই?’ জ্যাকের অনুরোধ।
‘উঁহু, সবাই মিলে সবটা উড়িয়ে দেয়া ঠিক নয়।‘
‘এটা একটা কথা হলো? শুনলে তো,ভদ্রমহিলা সেটাই চান।‘
‘তাহলে দাও আর একটু।’
তাদের দিকে অপলকে তাকিয়ে কান পেতে বসে থাকেন মিসেস মেলনি। একজন বললেন, ‘যাই বলো, আমার মনে হয়, অস্ত্রটা বেশ ভারি ছিল। ডাক্তার বলছিলেন, মাথার খুলিটা একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।‘
অতএব অস্ত্রটা যে বেশ ভারি ছিল, তাতে কোনো সন্দেহই নেই। আর অমন ভারি জিনিস কি লুকিয়ে রাখা সম্ভব?
‘মোটেই নয়।‘
আর একজন ঢেঁকুর তুলে বললেন, আমার ধারণা, জিনিসটা এ বাড়িরই কোথাও না কোথাও আছে।
বিচিত্র কিছু নয়। হয়ত দেখবে, নাকের ডগাতেই পড়ে আছে। আর সেই কারণেই চোখে পড়ছে না। তুমি কি বলো? জ্যাক?
তাঁদের কোনো কথাই অস্পষ্ট নয় মিসেস মেলনির কাছে। পাশের ঘরে বসে বসে শোনেন আর ফিকফিক করে হাসেন মহিলা।
——–
রোয়াল্ড ডাল-এর ‘ল্যাম্ব টু দি স্লটার’ অবলম্বনে।