মিসির আলির চশমা – ৫

দু’ধরনের মানুষের মধ্যে পাগলামি প্রকাশিত হয়। প্রতিভাবান মানুষ এবং কর্মশূন্য মানুষ। মিসির আলি প্রতিভাবান মানুষ। তাঁর মধ্যে পাগলামি প্রকাশিত হওয়াটাই স্বাভাবিক এবং হাসপাতালের বিছানায় তা পূর্ণমাত্রায় প্রকাশিত হল। তিনি এত বিষয় থাকতে ‘ভূত’ নিয়ে প্রবন্ধ লেখা শুরু করলেন। অতি ব্যস্ত প্রবন্ধকার। যখনই তাঁর কাছে যাই তাঁকে প্রবন্ধের কোনো বিষয় নিয়ে ব্যস্ত দেখি।

হাসপাতালে তাঁর কিছু ভক্ত জুটে গেল। এর মধ্যে একজন নার্স, নাম—মিতি। তার প্রধান এবং একমাত্র দায়িত্ব হয়ে দাঁড়াল মিসির আলিকে ভূতের গল্প শোনানো। জানা গেল তার গ্রামের বাড়ি (নয়াবাড়ি, শ্রীপুর) ভূতের হোস্টেল। এমন কোনো ভূত নাই যে এই মেয়ের গ্রামের বাড়িতে থাকে না। ‘কুয়াভূত’ নামে এক ভূতের নাম তার কাছেই শুনলাম। এই ভূত থাকে কুয়ায়। হঠাৎ হঠাৎ কুয়া থেকে উঠে কুয়ার পাড়ে বসে চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ায়। মানুষজনের শব্দ শুনলে ঝপাং করে কুয়ায় ঝাঁপ দিয়ে পড়ে।

‘তেঁতুল ভূত’ বলে এক ধরনের ভূতের কথা শোনা গেল, তারা থাকে তেঁতুল গাছে। এপ্রিল-মে মাসে যখন তেঁতুলের হলুদ ফুল ফোটে তখন তারা তেঁতুল ফুল চুষে ফুলের মধু খায়। যেসব গাছে তেঁতুল ভূত থাকে সেসব গাছে এই কারণেই তেঁতুল হয় না। মিতিদের গ্রামের বাড়িতে তিনটি তেঁতুল গাছের কোনোটিতেই তেঁতুল হয় না। বিশাল গাছ, প্রচুর ফুল ফোটে, কিন্তু তেঁতুল হয় না।

মিসির আলি এইসব উদ্ভট গল্প যে শুনছেন তা-না, রীতিমতো নোট করছেন। নানা মন্তব্যে খাতা ভর্তি করছেন। কুয়াভূত বিষয়ে তাঁর মন্তব্যের পাতাগুলো পড়লাম—

কুয়াভূত
পানিতে বাস করে এমন প্রজাতি
নারীধর্মী

কারণ কুয়াভূতকে সব সময় কুয়ার পাড়ে চুল আঁচড়াতে দেখা যায়। তবে এমনও হতে পারে পানিজীবী এই ভূতশ্রেণীর সবারই লম্বা চুল। সবাই চুল আঁচড়াতে পছন্দ করে।

প্রকৃতি : ভিতু প্রকৃতির। মানুষের আগমনের ইশারা পেলেই এরা কুয়াতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

কর্মকাণ্ড : এদের প্রধান কর্মকাণ্ড কুয়ার পানিতে ছোটাছুটি করা এবং পানি ছিটাছিটির খেলা করা।

চরিত্র : উপকারী চরিত্রের ভূত। মিতির এক খালার ছোট ছেলে একবার পানিতে পড়ে গিয়েছিল। কুয়াভূতরা বাচ্চাটিকে ঘাড়ে ধরে ঝুলিয়ে রেখেছিল। বালতি নামিয়ে দিলে কুয়াভূতরা বাচ্চাটাকে বালতিতে তুলে দেয়।

গন্ধ : কুয়াভূতদের গায়ে পুরোনো শ্যাওলার গন্ধ। কেউ কেউ বলে মাছের গন্ধ।

খাদ্য : এদের খাদ্য সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ওদেরকে কুয়ার পাড়ে বসে পান-সুপারির মতো কী যেন চিবাতে দেখা গেছে।

পোশাক : এদের প্রিয় এবং একমাত্র পোশাক সাদা রঙের। সাদা রঙের কাপড় ছাড়া এদেরকে কেউ অন্য কোনো রঙের কাপড়ে দেখে নি।

কথাবার্তা : এদের কথাবার্তা কেউ কখনো শোনে নি, তবে হাসির শব্দ অনেকেই শুনেছে।

আমি কিছুতেই ভেবে পাই না মিসির আলির মতো অতি বুদ্ধিমান একজন মানুষ কুয়াভূত বিষয়ে এতগুলো কথা এত গুরুত্বের সঙ্গে কেন লিখছেন! আমি জিজ্ঞেস করলাম, ভাই আপনি কি কুয়াভূতের ব্যাপারটা বিশ্বাস করছেন?

মিসির আলি বললেন, আমি বিশ্বাসও করছি না, আবার অবিশ্বাসও করছি না। মিতি মেয়েটা বানিয়ে বানিয়ে ভূত বিষয়ে এত কথা কেন বলবে?

আমি বললাম, মানুষ বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলে না? মানুষ প্রয়োজনে মিথ্যা বলে, অপ্রয়োজনে মিথ্যা বলে, বানিয়ে বলে, অন্যকে বিপদে ফেলার জন্য বলে।

মিসির আলি বললেন, আপনার কি ধারণা মিতি মেয়েটা আমাকে বিপদে ফেলার জন্য ‘কুয়াভূত’ নামক মিথ্যা বলছে?

আমি হাল ছেড়ে চুপ করে গেলাম। মিসির আলিকে যে রোগের কারণে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, সেই রোগ তাঁর সেরে গেছে, তবে দেখা গেছে তিনি নানা ধরনের রোগে ভুগছেন। শরীরের বেশিরভাগ যন্ত্রপাতিই নাকি নষ্ট। দু’টা কিডনির একটা যায় যায় অবস্থায় আছে। লিভারে জমেছে ফ্যাট। তাঁর চিকিৎসা ডাক্তাররা মহাউৎসাহে চালাচ্ছেন। মিতি নামের নার্স চালাচ্ছে ‘ভূত-চিকিৎসা’।

মিসির আলি একদিন আগ্রহ নিয়ে বললেন, মেয়েটার গ্রামের বাড়িতে একদিন বেড়াতে গেলে কেমন হয়?

আমি বললাম, আপনি মিতির গ্রামের বাড়িতে যেতে চাচ্ছেন?

হ্যাঁ। কুয়ার পাড়ে সারা রাত বসে থাকব। কুয়াভূতের হাসি শুনব। তারা জলকেলি করবে, সেই শব্দও শুনব।

আপনি কি সত্যি যেতে চাচ্ছেন?

অবশ্যই!

চোখের ডাক্তার সাহেবের সমস্যা বিষয়ে এখন তা হলে ভাবছেন না?

মিসির আলি বললেন, সেই সমস্যার সমাধান তো করেছি। আর কী?

তাদের তো কিছু জানাচ্ছেন না!

মিসির আলি বললেন, আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। আপনি যুক্তির উপর যুক্তি দাঁড় করিয়ে সমস্যার সমাধান করে গভীর আনন্দ পাবেন। আপনার আনন্দ দেখতে ইচ্ছা করছে।

মিসির আলি হঠাৎ গলা নামিয়ে বললেন, একটা অদ্ভুত ব্যাপার কী জানেন? অনেক বড় রহস্য লুকিয়ে আছে মিতির কাছে।

আমি বললাম, কী রহস্য?

মিসির আলি তাঁর বিখ্যাত রহস্যময় হাসি হেসে বললেন, আপনি চুপচাপ বসে না থেকে আমার চিঠিকন্যার সঙ্গে দেখা করে আসুন না। প্রাথমিক তদন্ত। আপনি আপনার মতো কথা বলবেন, প্রশ্ন করবেন। শুধু একটা প্রশ্ন আমি শিখিয়ে দেব।

কোথায় দেখা করব, তাঁর বাসায়?

না। তাঁর কলেজে। তিনি চাচ্ছেন না তাঁর স্বামী চিঠির ব্যাপারটা জানুক। কাজেই মিটিং অফিসে হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

.

অধ্যাপিকা শায়লা আমাকে দেখে যথেষ্টই বিরক্ত হলেন। শিক্ষিত মানুষরা সুগার কোটেড কুইনাইনের মতো বিরক্তি আড়াল করে সহজ ভঙ্গিতে হাসতে পারেন। ভদ্রমহিলা ভদ্রভাবে আমাকে বসালেন। বেয়ারা ডেকে চা বিস্কিট দিলেন। আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছি, তখন তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, শার্লক হোমসের সঙ্গে একজন সহকারী থাকেন। উনি অনেক বোকামি করেন। পাঠকরা তার বোকামি এবং ভুল লজিক পড়ে মজা পায়। আপনিও কি এমন একজন?

ভদ্রমহিলার কথায় অনেকটা থতমত খেয়ে গেলাম। যেসব কথা বলব বলে গুছিয়ে রেখেছিলাম, সবই এলোমেলো হয়ে গেল। আমি আমতা-আমতা করে বললাম, মিসির আলি সাহেব অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাকে একটা প্রশ্ন করার জন্য।

একটা প্রশ্ন?

জি একটাই প্রশ্ন।

এই প্রশ্নটা তো তিনি টেলিফোনেও করতে পারতেন। তা না করে আপনাকে কেন পাঠালেন?

শায়লার এই প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারলাম না। আরো হকচকিয়ে গেলাম।

শায়লা বললেন, চা খান। চা ঠাণ্ডা হচ্ছে।

আমি চায়ের কাপে চুমুক দিলাম।

শায়লা বললেন, আমার একটা ক্লাস আছে। ক্লাসে যেতে হবে। হাতে সময় আছে সাত মিনিটের মতো। প্রশ্নটা করুন। একটাই প্রশ্ন করতে হবে তা-না। সাত মিনিটে যে কয়টা প্রশ্ন করতে চান করুন

মিসির আলির শিখিয়ে দেয়া প্রশ্নটা করলাম। আমি নিজে যেসব প্রশ্ন করব বলে ঠিক করে রেখেছি সবই কর্পূরের মতো উবে গেল।

আমি চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বললাম, আপনি মিসির আলি সাহেবের কাছে লেখা চিঠিতে লিখেছেন এপ্রিল মাসের এক তারিখ দুর্ঘটনা ঘটেছিল। তারিখ ঠিক আছে তো?

অবশ্যই ঠিক আছে। April fools day —ভুল হবার কথা না।

আমি বললাম, আপনি নিশ্চয় জানেন মিসির আলি সাহেব অনুসন্ধানের ব্যাপারে অত্যন্ত meticulus. তিনি খোঁজখবর করে জেনেছেন আপনার দুর্ঘটনার বছরের পহেলা এপ্রিল সরকারি ছুটি ছিল।

শায়লা বললেন, অবশ্যই না।

আমি বললাম, আমি ঐ বছরের একটা ক্যালেন্ডার নিয়ে এসেছি। আপনাকে কি দেখাব?

শায়লা হ্যাঁ-না বলার আগেই আমি কাঁধে ঝোলানো চটের ব্যাগ থেকে একটা ডেস্ক ক্যালেন্ডার বের করে তাঁকে দেখালাম। এপ্রিলের এক তারিখে লাল গোল চিহ্ন দেয়া। সরকারি ছুটি।

ভদ্রমহিলা থতমত খেলেন না। কঠিন মুখ করে বসে রইলেন। আমি বললাম, যদি অনুমতি দেন তা হলে উঠব। ভদ্রমহিলা এই প্রশ্নেরও উত্তর দিলেন না। আমার ডেস্ক ক্যালেন্ডার হাতে নিয়ে বসে রইলেন। তাঁর ভাবভঙ্গি থেকে মনে হচ্ছে এই ক্যালেন্ডারটা তিনি হাতছাড়া করতে চান না। আমি ক্যালেন্ডার রেখেই ঘর থেকে বের হলাম।

মিসির আলি বলে দিয়েছিলেন শায়লার সঙ্গে দেখা করার পরপরই যেন আমি ডাক্তার হারুনের সঙ্গে কথা বলি এবং তাকে জিজ্ঞেস করি, কোন তারিখে আপনার বাচ্চাটা মারা গিয়েছিল? তারিখ জানা খুব জরুরি আমার ধারণা ছিল ডাক্তার হারুন আমাকে চিনতে পারবেন না। তিনি শুধু যে চিনলেন তা-না, আমাকে মহাসমাদর করে বসালেন। যেন দীর্ঘদিন পর তিনি তাঁর প্রিয় মানুষটার দেখা পেয়েছেন। সব কাজকর্ম ফেলে এখন তিনি জমিয়ে আড্ডা দেবেন।

আমাকে হাত ধরে বসাতে বসাতে বললেন, ভাই কেমন আছেন বলুন তো?

আমি খানিকটা বিব্রত গলাতেই বললাম, ভালো।

খবর পেয়েছি মিসির আলি সাহেব হাসপাতালে। উনাকে আমার খুব দেখতে যাবার ইচ্ছা, সময় করতে পারছি না। উনি আছেন কেমন?

আমি বললাম, ভালো আছেন। পানিভূত নিয়ে একটা গবেষণাধর্মী প্ৰবন্ধ লিখছেন।

পানিভূতটা কী?

এরা পানিতে থাকে। প্রবহমান পানিতে না। দিঘিতে কিংবা পুরোনো কুয়াতে। জানতাম না তো!

হারুন এমনভাবে ‘জানতাম না তো’ বললেন, যেন পৃথিবীর অতি গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান থেকে তাঁকে ইচ্ছা করে বঞ্চিত করা হয়েছে। আমি বললাম, ভূত প্রসঙ্গ থাক। আপনার যে ছেলেটি মারা গেছে তার সম্পর্কে বলুন। সে কবে মারা গেছে?

হারুন হতভম্ব গলায় বললেন, আমার তো কোনো ছেলেমেয়েই হয় নি। মারা যাবে কীভাবে?

আমি পুরোপুরি হকচকিয়ে গেলাম।

হারুন বললেন, সন্তান না হবার সমস্যাটা আমার। আমার স্ত্রীর না। আমার Sperm count খুব নিচে। ডাক্তার হিসেবে এই তথ্য আমি জানি। ভবিষ্যতেও যে আমার কোনো ছেলেমেয়ে হবে তা-না। আমার ছেলে মারা গেছে এই তথ্য আপনাকে কে দিল?

আমি আমতা-আমতা করে বললাম, ভুল হয়েছে। কিছু মনে করবেন না।

হারুন বললেন, কিছু মনে করছি না। মানুষ ভুল করবে এটাই স্বাভাবিক। এখন বলুন, কী খাবেন? চা নাকি কফি। এক কাজ করুন, দুটাই খান। প্রথমে চা তারপরে কফি। চা-কফি খেতে খেতে পানিভূত বিষয়ে কী জানেন বলুন তো।

আমি বললাম, আমি কিছুই জানি না। জানতে চাচ্ছিও না। এইসব অতিপ্রাকৃত বিষয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই।

হারুন মহাউৎসাহে বললেন, আগ্রহ কেন থাকবে না? আপনার কি ধারণা ভূত- প্রেত নেই? রবীন্দ্রনাথ ভূত বিশ্বাস করতেন, এটা জানেন? প্ল্যানচেট করে আত্মা আনতে পছন্দ করতেন। তিনি তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে পরিষ্কার লিখেছেন। আপনি ‘জীবনস্মৃতি’ পড়েন নি? আমার কাছে আছে, আপনি ধার নিতে পারেন। তবে বই ধার নিলে কেউ ফেরত দেয় না, এটাই সমস্যা।

পুলিশ তদন্ত করে ফাইনাল রিপোর্ট দেয়, আমিও শায়লার সন্তান বিষয়ে একটা ফাইনাল রিপোর্ট তৈরি করলাম। মিসির আলি সাহেবকে রিপোর্ট দেখিয়ে চমকে দেব এটাই আমার বাসনা। আমার ধারণা রিপোর্টটা ভালো লিখেছি।

ডা. হারুনের সন্তানের মৃত্যুবিষয়ক জটিলতা

(ক) ডা. হারুনের কোনো সন্তান নেই, সন্তানের মৃত্যুর প্রশ্নও সেই কারণেই নেই।

ডা. হারুনের প্রকৃতি ভালো মানুষের প্রকৃতি। ভালো মানুষরা নিজের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, এই ভদ্রলোকও সেরকম। ভূত- প্রেত-আত্মা এইসব বিষয়ে তাঁর বিশ্বাস আছে। বিশ্বাস রক্ষার ব্যাপারে তিনি যত্নশীল। এটা দোষের কিছু না। এ ধরনের মানুষরা অপ্রয়োজনীয় মিথ্যা বলেন না। কাজেই তাঁর কোনো সন্তান নেই—এমন মিথ্যা তিনি বলবেন না।

তারপরেও হারুন সাহেবের কথার সত্যতা সম্পর্কে পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হবার জন্য আমি দু’জনের সঙ্গে কথা বলেছি। একজন হারুন সাহেবের গাড়ির ড্রাইভার এবং অন্যজন হারুন সাহেবের বাড়ির কেয়ারটেকার নাজমুল।

নাজমুলের অনেক বয়স। হারুনের জন্মের আগে থেকেই তাঁদের বাড়ির কেয়ারটেকার। স্ট্রোকের কারণে ডানহাত এবং পা নাড়াতে পারেন না। মুখের কথাও অস্পষ্ট এবং জড়ানো। তবে তার সেন্সেস পুরোপুরি কাজ করছে। আমার প্রশ্নের জবাবে বললেন—

আমার নিজের কোনো ছেলেমেয়ে নাই। আমি বিবাহ করি নাই। আমি মনে করি আমার ছেলে হারুন। আমি তাঁকে কোলেপিঠে বড় করেছি। ঘাড়ে করে স্কুলে নিয়ে গেছি। স্কুল থেকে এনেছি। তাঁর কোনো সন্তানাদি হয় নাই, এই দুঃখ হারুনের চেয়ে আমার অনেক বেশি। আর অল্প কিছুদিন বেঁচে থাকব—হারুনের বাচ্চার মুখে দাদু ডাক শুনব না, এই কষ্টের কোনো সীমা নাই।

ডা. হারুনের ড্রাইভারের সাথে আমার যে কথা হয়েছে তা এরকম-

আমি : তোমার নাম?

ড্রাইভার : স্যার, আমার নাম ফজলু। ফজলু মিয়া।

আমি : তুমি ডাক্তার সাহেবের গাড়ি কতদিন ধরে চালাচ্ছ?

ড্রাইভার : হিসাব নাই। কাজ শিখার পরে প্রথম স্যারের এখানে কাজ নেই। খুব কম হইলেও দশ বছর ধইরা স্যারের সাথে আছি।

আমি : তোমার ডিউটি কেমন?

ড্রাইভার : আমার ডিউটি নাই বললেই চলে। স্যারের সন্তানাদি নাই, ইস্কুল ডিউটিও নাই।

আমি : ম্যাডামের ডিউটি কর না?

ড্রাইভার : ম্যাডামের আলাদা গাড়ি। আলাদা ড্রাইভার।

(খ) সন্তানবিষয়ক মিথ্যা কথাটা শায়লা বানিয়ে বলেছেন। এমন একটা ভয়ংকর কথা উনি কেন বানালেন সেটা খুব পরিষ্কার না আমার ধারণা তিনি মিসির আলি সাহেবের সঙ্গে একটা বুদ্ধির খেলা খেলেছেন। মিসির আলি একজনকে শিশুর হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করার পর তিনি বলবেন, কোনো শিশুর অস্তিত্বই নাই। সম্মানিত মানুষকে ছোট করে অনেকে আনন্দ পায়। শায়লা সেরকম একজন বলে আমার ধারণা।

মিসির আলি আগ্রহ নিয়ে আমার রিপোর্ট পড়লেন। এবং হাসিমুখে বললেন, রিপোর্ট ঠিক আছে, তবে…।

আমি বললাম, রিপোর্ট ঠিক থাকলে তবে আসবে কেন?

মিসির আলি বললেন, তবে আসছে, কারণ হারুন সাহেবের কোনো ছেলে পহেলা এপ্রিল মারা যায় নি বলে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা যুক্তিনির্ভর না। আপনি হারুন সাহেবের কথা, তাঁর কেয়ারটেকার এবং ড্রাইভারের কথা সত্যি বলে ধরে নিয়েছেন।

তারা কেন মিথ্যা বলবে?

হারুন সাহেবের স্ত্রীইবা কেন মিথ্যা বলবে?

আমি বললাম, হারুন সাহেবের স্ত্রীর মিথ্যা বলার কারণ কিন্তু আমি ব্যাখ্যা করেছি। তিনি আপনার সঙ্গে একটা খেলা খেলছেন।

মিসির আলি বললেন, এই খেলা তো হারুন সাহেবও খেলতে পারেন। পারেন না?

আমি বললাম, তাঁর বাড়ির বাকি দু’জন তো কোনো খেলা খেলবে না। তাদের স্বাৰ্থ কী?

অন্নদাতা মুনিবকে রক্ষা করা স্বার্থ হতে পারে। বাড়ির বিশ্বাসী পুরোনো লোকজন মুনিবের প্রতি Loyal থাকে।

আমি বললাম, আপনি কি তা হলে ধারণা করছেন যে পহেলা এপ্রিল সত্যি সত্যি বাচ্চাটা খুন হয়েছে?

মিসির আলি বললেন, সেরকম ধারণাও করছি না। তবে আমি মনে করি ঐ তারিখে ডাক্তার হারুনের কোনো বাচ্চা মারা গিয়েছিল কি না সেই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়াটা খুব জরুরি।

আমি বললাম, কীভাবে নিশ্চিত হব? বাংলাদেশে তো জন্ম-মৃত্যুর কোনো রেকর্ড থাকে না।

মিসির আলি বললেন, জন্মরেকর্ড থাকে না, মৃত্যুরেকর্ড কিন্তু থাকে। গোরস্থানে থাকে। গোরস্থানের অফিসে কার কবর হল তা লেখা থাকবে।

আমাকে এখন গোরস্থানে গোরস্থানে ঘুরতে হবে?

মিসির আলি হাসতে হাসতে বললেন, অবশ্যই। আপনি একটা রহস্যের মীমাংসা করবেন বিনা পরিশ্রমে তা কি হয়?

আমি বললাম, আপনি তো বিনা পরিশ্রমেই রহস্যের মীমাংসা করে ফেলেছেন। অনেক আগেই খামে লিখে আমাকে দিয়েছেন।

মিসির আলি বললেন, বিনা পরিশ্রমে করি নি। অনেক পরিশ্রম করেই সিদ্ধান্তে এসেছি। কঠিন এক অঙ্ক ধাপে ধাপে করে সিদ্ধান্তে এসেছি। আপনার পক্ষে গোরস্থানে গোরস্থানে ঘোরা সম্ভব হবে না আমি বুঝতে পারছি। এক কাজ করুন, কিছু টাকাপয়সা দিয়ে কাউকে লাগিয়ে দিন, যে আপনার হয়ে কাজটা করবে। পাঁচশ টাকা খরচ করলেই হবে।

আমাকে এক হাজার টাকা খরচ করতে হল। গোরস্থান থেকে গোরস্থানে যাবার ভাড়া পাঁচশ টাকা। কাজটার জন্য পাঁচশ টাকা। জানতে পারলাম ঢাকা শহরে ঐ তারিখে এগারজন শিশু মারা গেছে। এর মধ্যে পাঁচজন মেয়ে। ছয়জন ছেলের মধ্যে চারজনের বয়স চার বছরের বেশি। এরা বাদ। বাকি দু’জনের একজন জন্মের পরপরই মারা গেছে। সেও বাদ। একজন শুধু মারা গেছে এক বছর বয়সে। তার নাম মিজান। তার বাবা আলহাজ আব্দুল লতিফ। থাকেন পুরোনো ঢাকায়।

আমি আমার রিপোর্টে লিখলাম—নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি পহেলা এপ্রিলে হারুন সাহেবের কোনো সন্তান মারা যায় নি।

রিপোর্টটা লিখে শান্তি পেলাম না। মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগল। আমার ধারণা এর মধ্যেও মিসির আলি কিছু ভুল বের করে ফেলবেন। আবার আমাকে নতুন করে ছোটাছুটি শুরু করতে হবে। হয়তো মিসির আলি বলবেন, আলহাজ আব্দুল লতিফ সাহেবের ইন্টারভ্যু নিতে।

নানানভাবে চিন্তা করলাম। গুরুত্বপূর্ণ কিছু কি বাদ দিয়েছি? মানুষের স্বভাব হচ্ছে চোখের সামনে যে জিনিস থাকে তাই চোখে পড়ে না। আমার বেলায় তেমন কিছু কি ঘটেছে?

মিসির আলি সাহেব বলেছেন মিতির মধ্যে অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে। মিতির মধ্যে কী রহস্য থাকবে? সে তার গ্রামের বাড়িতে ভূত দেখে। তার গ্রামের বাড়ির ভূতের সঙ্গে ডা. হারুন বা তাঁর স্ত্রী শায়লার সম্পর্ক কী?

ইংরেজিতে একটা কথা আছে Left no stone unturned. প্রতিটি পাথর উল্টে দেখতে হবে। মিতি নামক পাথর উল্টে দেখার জন্য একদিন হাসপাতালে তার সঙ্গেও দেখা করতে গেলাম। সে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে যে ভূত বাস করে তার গল্প শুরু করল। এটা নাকি ঠিক ভূতও না। অনেকটা জন্তুর মতো। মৃত রোগীর পায়ের পাতা চাটে। তার গায়ে লাশের গন্ধ।

পাতা চাটা ভৌতিক প্রাণীর গল্প শোনার মানে হয় না। বিরক্ত হয়ে চলে এসেছি। মনে হচ্ছে রহস্য সমাধানের পথ খুবই জটিল পথ।

.

অনেক চিন্তাভাবনা করে আমি একটা সহজ পথ বেছে নিলাম। মিসির আলি সাহেবের খামটা খুলে ফেললাম। সেখানে লেখা—

ধৈর্য ধরতে পারলেন না? আগেভাগেই খাম খুলে ফেললেন? যাই হোক, হত্যাকারীর নাম লিখছি। সাংকেতিকভাবে লিখছি। দেখি সংকেত ভেদ করতে পারেন কি না। হত্যাকারীর নাম—

‘আ মারপ ত্রক ন্যা।’

আমার মাথায় হাত দিয়ে বসা ছাড়া উপায় রইল না। সাংকেতিক ভাষা উদ্ধার আমার কর্ম না। মিসির আলি সাহেবের নির্দেশমতো অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া এরচে’ সহজ। মনে হচ্ছে পেতেছি সমুদ্র শয্যা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *