৪
ডা. হারুনের কাছে মিসির আলি আমাকে নিয়ে গেলেন। এমনিতেই তাঁর চোখ দেখাবার কথা। সঙ্গে আমিও দেখাব। চোখ দেখাতে গিয়ে ডাক্তার সাহেবের আচার- আচরণ লক্ষ করব। তেমন সুযোগ হলে কিছু প্রশ্নও করব। তবে প্রশ্নের প্রয়োজন নেই। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত একজন মানুষকে দেখলেই চেনা যাবে। তাঁর চোখে থাকবে ভরসা হারানো দৃষ্টি।
.
যেমন ভেবেছি তেমনই দেখলাম। অস্থির ছটফটে একজন মানুষ। সারাক্ষণ ভুরু কুঁচকে আছেন। কথা বলছেন উঁচু গলায়। তাঁর টেবিলে একটা চায়ের কাপ। তিনি কাপ হাতে নিয়ে তীব্র গলায় বললেন, এই ফজলু, চায়ের কাপ সরাও নি কেন গাধা! বলেই দেরি করলেন না, চায়ের কাপ ওয়েস্ট পেপার বাসকেটে ফেলে দিলেন। অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড। তাঁর টেবিলে বরফ মেশানো হলুদ রঙের পানীয়। রঙ দেখে মনে হচ্ছে হুইস্কি। যদি হুইস্কি হয় তা হলে ব্যাপারটা অবশ্যই অস্বাভাবিক। কোনো ডাক্তারই হুইস্কি খেতে খেতে রোগী দেখতে পারেন না। আমি গ্লাসের দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, কী খাচ্ছেন?
ডা. হারুন আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে বললেন, হুইস্কি খাচ্ছি। আপনি খাবেন? আমি না-সূচক মাথা নাড়লাম।
খেয়ে দেখতে পারেন। খারাপ লাগবে না। দিনের শেষে ক্লান্তি নিবারক। আমি বললাম, আপনি ক্লান্তি নিবারণ করুন। আমি তেমন ক্লান্তি বোধ করছি না। ডাক্তার গ্লাসে চুমুক দিয়ে আমার চোখ দেখতে বসলেন। যত্ন করেই চোখ দেখলেন। বিল দিতে গেলাম। তিনি বললেন, মিসির আলি সাহেব আমার বন্ধু মানুষ। আপনাকে বিল দিতে হবে না।
আমি বললাম, আপনি কি বন্ধুর বন্ধুদের কাছ থেকে বিল নেন না?
না।
তা হলে তো একসময় দেখা যাবে, কারো কাছ থেকেই আপনি বিল নিতে পারছেন না। সবাই ফ্রি।
আমি এমন কোনো হাসির কথা বলি নি, কিন্তু ভদ্রলোক মনে হল খুব মজা পেলেন। এক চুমুকে গ্লাস শেষ করে অনেকক্ষণ হাসলেন। অ্যালকোহলের অ্যাফেক্টও হতে পারে। তিনি ফ্লাস্ক থেকে ঐ বস্তু আরো খানিকটা ঢালতে ঢালতে বললেন, আমি টিটাটোলার মদ সিগারেট কিছুই খাই না। গ্লাসে যে বস্তু দেখছেন তা হল তেঁতুলের পানি। তেঁতুলের পানি Arteriosclerosis কমায়। আমি যা করছি তা হল দেশীয় ভেষজের মাধ্যমে চিকিৎসা।
আমি বললাম, আপনি তেঁতুলের পানি খাচ্ছেন, আমাকে কেন বললেন হুইস্কি খাচ্ছি!
হারুন সাহেব বললেন, আপনি ভুরু কুঁচকে গ্লাসটার দিকে তাকাচ্ছিলেন। এই জন্যই বলেছি। আপনার আগেও কয়েকজন রোগী আপনার মতোই ভুরু কুঁচকে গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বলেছে, কী খাচ্ছেন? আমি তাদেরকেও বলেছি হুইস্কি খাচ্ছি।
তাদের ভুল ভাঙান নি?
না। শুধু আপনারটাই ভাঙিয়েছি।
আমার ভুল ভাঙালেন কেন?
ডাক্তার হাসতে হাসতে বললেন, আপনি বন্ধু মানুষ। বেহেশতে আমরা কিন্তু আত্মীয়স্বজন পুত্রকন্যা পাব না। বন্ধু পাব। আমাদেরকে দেয়া হবে সত্তর জন হুর। এরা সবাই বন্ধু। পবিত্র সঙ্গী। কেউ আত্মীয় না।
আপনি কি বেহেশত দোজখ এইসব বিশ্বাস করেন?
অবশ্যই করি।
নামাজ পড়েন?
সময়মতো পড়া হয় না, তবে রাতে ঘুমুবার আগে কাজা পড়ি।
বেহেশতে যাবার জন্য পড়েন?
ডাক্তার বেশকিছু সময় চুপ করে থেকে বললেন, বেহেশত দেখার প্রতি আমার আগ্রহ আছে। সেখানে যেসব পবিত্র সঙ্গিনী আছে, তাদের একজনকে আমি দেখেছি।
স্বপ্নে দেখেছেন?
স্বপ্নে না, ঘোরের মধ্যে দেখেছি।
কী রকম দেখতে জানতে পারি?
জানতে পারেন। জানতে চান?
জি চাই।
ডা. হারুন আগ্রহ নিয়ে গল্প শুরু করলেন। চেম্বারের সব ক’টা বাতি নিভিয়ে শুধু টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে রেখে আবহ তৈরি করলেন। ফজলু মিয়া নামের তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্টকে ডেকে বললেন, আর রোগী দেখব না। সবাইকে অন্য কোনো ডাক্তারের কাছে যেতে বল। আমি Dog tired.
তাঁকে তেমন টায়ার্ড দেখাচ্ছে না। যথেষ্টই এনার্জেটিক লাগছে। মনে হচ্ছে হুরের বর্ণনা করতে পেরে তিনি আনন্দিত।
এই চেম্বারেই দেখেছি। বছর দেড়েক আগের কথা। শায়লার সঙ্গে রাগ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাড়ি যাব না। রাতটা চেম্বারেই কাটাব। তখন আমার চেম্বারে একটা ইজিচেয়ার ছিল। কম্বল ছিল। রাতে যখন বাড়ি ফিরতাম না তখন কম্বল মুড়ি দিয়ে ইজিচেয়ারে শুয়ে ঘুমাতাম। সেই রাতেও তাই করেছি। শুয়ে পড়েছি। হাতের কাছেই টেবিল ল্যাম্পের সুইচ। বাতি নেভাতে যাব তখন তাকে দেখলাম। চোখ দেখার যন্ত্রটা দেখছেন না? সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। তার গা থেকে নীলাভ আলোর আভা আসছে। ফ্লোরেন্স আলোর মতো আলো, তবে তীব্রতা অনেক কম।
মিসির আলি বললেন, হুরটার গায়ে কাপড় ছিল?
ডা. হারুন বিরক্ত গলায় বললেন, অবশ্যই ছিল। আপনি কি ভেবেছেন সে নেংটা হয়ে আমার অফিসে আসবে? তার পরনে ছিল হালকা সবুজ রঙের শাড়ি। গা ভর্তি গয়না। পাথরের গয়না। গয়নার রঙও সবুজ। আমি চোখের ডাক্তার, প্রথমেই তাকালাম মেয়েটার চোখের দিকে। মেয়েটার চোখের সাদা অংশটা ঠিক সাদা না— একটু যেন লালচে। অনেকক্ষণ কাঁদলে মেয়েদের চোখ যেমন লালচে হয়ে যায় সেরকম।
আমি বললাম, কথা হয়েছে তার সঙ্গে?
হ্যাঁ হয়েছে। কিন্তু এই বিষয়ে আমি আর কিছু বলব না। এই বিষয়ে কথা বললে মা রাগ করেন। এখন আপনারা বিদায় হোন।
আমরা চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছি হঠাৎ ডাক্তার মিসির আলির দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার মা আমাকে জানিয়েছেন, আপনি এখন নিজের বাসায় থাকেন না। অন্য এক জায়গায় থাকেন। আপনি যে ঘরে থাকেন, সেখানে দেয়াল ঘড়ি আছে। ঘড়িটা বন্ধ। ঘড়িতে সব সময় তিনটা বেজে থাকে। আমার মা কি ঠিক বলছেন?
মিসির আলি চিন্তিত গলায় বললেন, হ্যাঁ।
এখন কি বিশ্বাস করছেন, আমার মা’র সঙ্গে আমার কথা হয়? দেখা হয়?
মিসির আলি বললেন, না।
কখন বিশ্বাস হবে?
যখন তাঁকে নিজে দেখব।
ডাক্তারের ঠোঁটের কোনায় হালকা হাসির আভাস দেখা গেল। যেন তিনি মজার কোনো কথা বলবেন বলে ভাবছেন। সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
মিসির আলি বললেন, আজ উঠি?
ডাক্তার বললেন, আরো কিছুক্ষণ বসুন, গাড়ি দিয়ে নামিয়ে দেব। একটা প্রশ্নের জবাব দিন, আপনি কি ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন বিশ্বাস করেন?
মিসির আলি বললেন, করি।
ডাক্তার বললেন, এদের তো আপনি চোখে দেখেন নি, তা হলে কেন বিশ্বাস করেন?
মিসির আলি বললেন, আমি চোখে না দেখলেও নানান যন্ত্রপাতি এদের অস্তিত্ব বের করেছে। একটি যন্ত্রের নাম সাইক্লট্রন। পৃথিবীর কোনো যন্ত্রপাতি মৃত মানুষের অস্তিত্ব বের করতে পারে না।
ডাক্তার বললেন, সেরকম যন্ত্রপাতি তৈরি হয় নি বলেই পারে না। আমার পড়াশোনা যদি পদার্থবিদ্যায় হত আমি নিজেই এরকম একটা যন্ত্র বানানোর চেষ্টা করতাম। যন্ত্রটার নাম দিতাম Soul Searcher. যে যন্ত্র আত্মা অনুসন্ধান করে বেড়াবে। মনে করা যাক এই ঘরে একটা আত্মা আছে, যন্ত্রের কাজ হবে ঘরের প্রতিটি স্কয়ার ইঞ্চির রেডিও অ্যাকটিভিটি মাপবে, তাপ মাপবে, ইলেকট্রিক্যাল চার্জ মাপবে, ম্যাগনেটিক বলরেখার ম্যাপ তৈরি করবে। সমস্ত ডাটা কম্পিউটার সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হবে। সফটওয়্যারের কাজ হবে anamoly detect করা।
ডাক্তার সাহেব প্রবল উৎসাহে বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন। যেন তিনি ক্লাস নিচ্ছেন, আমরা দুই মনোযোগী শ্রোতা। তাঁর ঘরে বোর্ড না থাকায় সামান্য সমস্যা হচ্ছে। যন্ত্রের খুঁটিনাটি বোর্ডে এঁকে দেখাতে পারছেন না। কাগজ-কলমে এঁকে দেখাতে হচ্ছে।
আমরা রাত সাড়ে এগারটায় ছাড়া পেলাম। ডাক্তার সাহেব নিজেই পৌঁছে দিলেন। তবে গাড়িতেও তিনি বকবক করতেই থাকলেন, এক মুহূর্তের জন্যও থামলেন না।
প্রথম যেটা করতে হবে তা হল ম্যাগনেটিক টানেল কিংবা Magnetic Cone তৈরি করা। আত্মাকে যদি কোনোক্রমে ভুলিয়ে-ভালিয়ে টানেলে ঢুকিয়ে ফেলা যায় তা হলেই কর্ম কাবার।
আমি বোকা বোকা মুখ করে বললাম, কর্ম কাবার মানে কী? আত্মা মারা যাবে? মানুষ মরে আত্মা হয়, আত্মা মরে কী হবে?
ভেবেছিলাম আমার রসিকতায় তিনি রাগ করবেন। ভাগ্য ভালো, রাগ করলেন না। তিনি বুঝাতে চেষ্টা করলেন আত্মা কী?
আত্মা হল পিওর ফরম অব এনার্জি। আমরা যেসব এনার্জির সঙ্গে পরিচিত তার বাইরের এনার্জি। আমাদের এনার্জির ট্রান্সফরমেশন হয়। এক ফরম থেকে অন্য ফরমে যেতে পারে। আত্মা নামক এনার্জির কোনো ট্রান্সফরমেশন নেই। বুঝতে পারছেন তো?
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, তারপরও প্রবল বেগে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম।
.
রাতে মিসির আলি সাহেবকে নিয়ে খেতে বসেছি। আয়োজন সামান্য। দুপুরের ডাল গরম করা হয়েছে। ডিম ভাজা হয়েছে। প্রচণ্ড গরমে ডাল টকে গেছে। মিসির আলি সাহেব ব্যাপারটা ধরতে পারছেন না। টক ডাল খেয়ে যাচ্ছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি আছেন গভীর চিন্তায়। আমি বললাম, মিসির আলি সাহেব, আপনি কি আত্মা বিশ্বাস করেন?
তিনি আমাকে চমকে দিয়ে বললেন, হ্যাঁ।
খুব যে ভেবেচিন্তে তিনি হ্যাঁ বললেন তা কিন্তু মনে হল না। বলতে হয় বলে বলা। আত্মা-বিষয়ক দ্বিতীয় প্রশ্ন করতে যাচ্ছি, তার আগেই মিসির আলি বললেন, ডাক্তার সাহেব গাড়ি করে আপনার বাসায় আমাদের পৌঁছে দিয়েছেন, ব্যাপারটা আপনার কেমন লেগেছে?
আমি বললাম, ভালো লেগেছে। ভদ্রলোক নিতান্তই ভালো মানুষ। ভালো মানুষরা পাগলাটে হয়, উনিও পাগলাটে।
মিসির আলি বললেন, উনার গাড়ির ড্রাইভার কিন্তু আপনার বাড়ির ঠিকানা জানতে চায় নি। সে ঠিকানা জানত। আগে এসেছে। ঠিক বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
আমি বললাম, তাই তো!
মিসির আলি বললেন, ডাক্তার সাহেব আপনাকে চেনেন না। আজই প্রথম চিনলেন। উনি আপনার বাড়ি চেনেন, কারণ উনি আমাকে অনুসরণ করছেন। আমার পেছনে লোক লাগিয়ে রেখেছেন।
আপনার পেছনে লোক লাগিয়ে রাখবে কেন?
সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
আমি বললাম, ঘড়ির ব্যাপারটা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উনি যে বলে দিলেন আপনার ঘরের ঘড়িটা বন্ধ। তিনটা বেজে আছে।
মিসির আলি বললেন, এটা তুচ্ছ বিষয়। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে চিন্তা করে সময় নষ্ট করার কিছু নেই।
আমি বললাম, তুচ্ছ বলছেন কেন? ঘড়িটা তো বাইরে থেকে দেখানো যায় না। এই ঘড়ি দেখতে হলে ঘরে ঢুকতে হবে। হবে না?
মিসির আলি আমার কথায় গুরুত্ব দিলেন না। বরং মনে হল কিছুটা বিরক্তই হলেন। আমাকে হতাশ গলায় বললেন, শরীরটা খারাপ লাগছে। ডালটা কি নষ্ট ছিল?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
মিসির আলি বললেন, আমার কাছে অবিশ্যি টকটক লাগছিল। আমি ভাবলাম কাঁচা আম দিয়ে ডাল টক করা হয়েছে।
এই সিজনে কাঁচা আম পাবেন কোথায়?
মিসির আলি বললেন, তাও তো কথা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর ভেদবমি শুরু হল। চোখ-মুখে উল্টে অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেন। সামান্য টক ডাল এই অবস্থা তৈরি করতে পারে তা আমার ধারণাতেও ছিল না।
বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবার মনে হয় কিছুটা উন্নতি হয়েছে। টেলিফোন করা মাত্র অ্যাম্বুলেন্স চলে এল। তাঁকে ক্লিনিকে ভর্তি করলাম। তাঁর জ্ঞান ফিরল ভোররাতে। জ্ঞান ফেরার পর প্রথম যে বাক্যটি বললেন তা হল—যে কোনো রহস্যের অনেক ডালপালা থাকে। রহস্যভেদের জন্য প্রতিটি ডালে চড়তে হয় না। বেছে বেছে ডালে চড়তে হয়। ‘ঘড়িতে তিনটা বাজে’ এটা রহস্যের এমন একটা শাখা যাতে আমাদের চড়তে হবে না।
আমি বললাম, ভাই আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন। রহস্য নিয়ে এখন আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না।
মিসির আলি চোখ বন্ধ করে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লেন।