৩
প্রিয় পাঠক, আপনারা ‘মিসির আলির চশমা’ বইটির প্রথম দু’টি অধ্যায় পড়েছেন। প্রথম অধ্যায় দু’টি হল প্রস্তাবনা এখন আমি মূল অংশে যাচ্ছি। এই অংশটি আমি উত্তম পুরুষে লিখছি। কারণ আমি নিজেও গল্পে যুক্ত।
.
একেকজন মানুষের গল্প বলার Style একেক রকম। অতি সাধারণ কথা মিসির আলি যখন বলেন তখন মনে হয় দারুণ রহস্যময় কোনোকিছুর বর্ণনা দিচ্ছেন। উদাহরণ দেই—একদিন তাঁর বাসায় গেছি। তিনি জানালার পাশে বসে গল্প করছেন। গল্পের এক পর্যায়ে বললেন’বুঝলেন ভাই! তখন জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি এত্ত বড় একটা চাঁদ।” “এত্ত বড় চাঁদ” কথাটা তিনি এমনভাবে বললেন যে শুনে আমার গা ছমছম করে উঠল। আমি চমকে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। অথচ চমকাবার কিছু নেই। পূর্ণিমার রাতে জানালা দিয়ে ‘এত্ত বড় চাঁদ’ দেখা যেতেই পারে।
এই মিসির আলি আবার অতি ভয়ংকর ব্যাপার এমন সাদামাটাভাবে বলেন যেন এটা কিছুই না। এরকম রোজই ঘটছে। এক সিরিয়াল কিলার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে হাই তুলতে তুলতে বললেন—’লোকটার অভ্যাস ছিল খেজুরের কাঁটা দিয়ে ভিকটিমের চোখ গেলে দেয়া।’ তাঁর বলার ভঙ্গি, বলতে বলতে হাই তোলা থেকে শ্রোতাদের ধারণা হবে—খেজুরের কাঁটা দিয়ে চোখ তোলা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এমন কিছু না।
আমি অনেক দিন থেকেই মিসির আলিকে বলছিলাম, তাঁর রহস্য সমাধানের প্রক্রিয়ায় খুব কাছ থেকে আমি যুক্ত হতে চাই। আমি দেখতে চাই তিনি কাজটা কীভাবে করেন। লজিকের সিঁড়ি কীভাবে পাতেন। রহস্যের প্রতি আমার তেমন আগ্রহ নেই। আমার আগ্রহ রহস্যভেদ প্রক্রিয়ার প্রতি। সুযোগ সে অর্থে আসে নি। আমি নিজে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকি, মিসির আলি ঘরকুনো মানুষ। তিনি নিজেও তাঁর মানসিক জগৎ নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের দু’জনের দেখা হয় না বললেই হয়।
এই সময় আমি আমার পারিবারিক ট্র্যাজেডির নায়ক হয়ে বসলাম। সমাজের একজন দুষ্ট মানুষ হিসেবে আমার পরিচয় ঘটল এবং মিটিং করে নিজের বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হল। পত্র-পত্রিকাগুলোতে ছাপার মতো খবর অনেক দিন ছিল না। তারা মনের আনন্দে আমাকে নিয়ে নানান গল্প ফাঁদতে লাগল। মিসির আলি সাহেবের যে গল্পটি এখানে লিখছি, সেখানে আমার ব্যক্তিগত গল্পের স্থান নেই বলেই নিজের গল্প বাদ থাকল। অন্য কোনো দিন সেই গল্প বলা হবে।
যাই হোক, আমি বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে কিছুদিন বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করলাম। বন্ধু-বান্ধবরা তেমন আগ্রহ দেখাল না। ‘মহাবিপদ’ কে সেধে পুষতে চায়? আমাকে দূরে রাখাই মঙ্গল। বাধ্য হয়ে উত্তরায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করলাম। তিন তলায় একা থাকি। দিনের বেলা অফিসের একজন পিয়ন থাকে। হোটেল থেকে খাবার এনে দিয়ে সন্ধ্যায় নিজের বাসায় চলে যায়। আমি তাকে চক্ষুলজ্জায় বলতে পারি না যে, তুমি থাক। এত বড় ফ্ল্যাটে একা থাকতে ভয় পাই।
ভয় পাওয়ার কারণ হচ্ছে, আমি মোটামুটি নিশ্চিত ফ্ল্যাটে আমি একা থাকি না। আমার সঙ্গে বিদেহী কোনো আত্মাও থাকেন। তিনি গভীর রাতে কাঠের মেঝেতে হাঁটাহাঁটি করেন। শব্দ করে নিঃশ্বাস নেন। রান্নাঘরে পানির ট্যাপ ছেড়ে হাতেমুখে পানি দেন। এক রাতের ঘটনা তো ভয়ংকর। রাত তিনটা বাজে। বাথরুমে যাবার জন্য বিছানা ছেড়ে নেমেছি, হঠাৎ দেখি ঘরের মধ্যে বেঁটে মতো এক ছায়ামূর্তি। সে আমার চোখের সামনে ঘরের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় চলে গেল। আমি বিকট চিৎকার দিতে গিয়েও দিলাম না। চিৎকার দিয়ে তো লাভ নেই। যে বিদেহী আত্মা আমার সঙ্গে বাস করেন, তিনি ছাড়া আমার চিৎকার কেউ শুনবে না।
এর পর থেকে ঐ বাড়িতে রাত কাটানো আমার জন্য বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। সন্ধ্যার পর প্রতিটি ঘরের বাতি জ্বালিয়ে রাখি। কারেন্ট চলে যেতে পারে এই ভয়ে সব ঘরেই চার্জার। আমার বালিশের নিচে থাকে টর্চলাইট। হাতের কাছে টেবিলে দিয়াশলাই এবং মোমবাতি। লোহা সঙ্গে রাখলে ভূত আসে না। আমার শোবার ঘরে এই কারণেই রড আয়রনের খাট কিনে সেট করা হল। তারপরও ভয় কাটে না। রাতগুলো বলতে গেলে জেগেই কাটাই।
আমার এই বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থায় মিসির আলি হঠাৎ খুঁজে খুঁজে বাসায় উপস্থিত হলেন। তিনি এসেছেন পত্রপত্রিকা পড়ে। মিসির আলি আবেগপ্রবণ মানুষ কখনো ছিলেন না। তাঁর আবেগ এবং উচ্ছ্বাস খুবই নিয়ন্ত্রিত। তারপরও তিনি যথেষ্ট আবেগ দেখালেন। আমাকে বললেন, আপনার মতো গৃহী মানুষকে ঘরছাড়া দেখে খারাপ লাগছে। বলুন আপনার জন্য কী করতে পারি? বলেই তিনি আমার মাথায় হাত রাখলেন। যেন আমি অল্পবয়সের অভিমানী কোনো যুবক। আমাকে সান্ত্বনা দেয়া প্রয়োজন।
আমি বললাম, আপাতত আপনি আমাকে ভূতের হাত থেকে বাঁচান। একটা ভূত আমাকে রাতে ঘুমোতে দিচ্ছে না। কাঠের ফ্লোরে সে রাতে হাঁটাহাঁটি করে। আমি নিজে ভূতটাকে দেখেছি।
মিসির আলি বললেন, কাঠ দিনের গরমে প্রসারিত হয়। রাতের ঠাণ্ডায় সঙ্কুচিত হয়। তখনই নানান শব্দ হয়।
আমি বললাম, কাঠের এই ব্যাপারটা মানলাম। কিন্তু রান্নাঘরে ভূতটা পানির কল ছাড়ে। ছড়ছড় করে পানি পড়ার শব্দ আমি রোজ রাতেই দুই তিনবার শুনি।
মিসির আলি শান্ত গলায় বললেন, রাতে চারদিকে থাকে নীরব। আপনার নিচের তলা বা উপরের তলার লোকজন যখন কল ছাড়ে তখন সেই শব্দ ভেসে আসে। এর বেশি কিছু না। আপনি ভূতের ভয়ে মানসিকভাবে উত্তেজিত থাকেন বলেই হালকা পানি পড়ার শব্দ বড় হয়ে কানে বাজে।
আমি বললাম, সরাসরি যে ভূত দেখেছি সেটা কী? বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে গেলাম, হাঁটু সাইজের একটা ভূত দেয়ালের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত গেল এবং মিলিয়ে গেল।
মিসির আলি বললেন, আপনি নিজের ছায়া দেয়ালে দেখেছেন। ঘরের সব বাতি নিভিয়ে দিন। ঐ রাতের মতো বিছানা থেকে নামুন। বাথরুমে যান। নিজের ছায়া দেখবেন।
আমি তাই করলাম। নিজের কোনো ছায়া দেখলাম না।
মিসির আলি মোটেই বিচলিত হলেন না। তিনি বললেন, ঐ রাতে নিশ্চয়ই আপনার TV খোলা ছিল। TV স্ক্রিন থেকে আসা আলোয় আপনার ছায়া পড়েছে। টিভি ছাড়ুন।
আমি টিভি ছাড়তেই দেয়ালে নিজের ছায়া দেখলাম।
মিসির আলি বললেন, হেঁটে বাথরুম পর্যন্ত যান। ছায়াকে হেঁটে যেতে দেখবেন।
আমি বললাম, এখন আর তার প্রয়োজন দেখছি না।
মিসির আলি বললেন, ভয় কেটেছে?
আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম।
মিসির আলি বললেন, এখন কি রাতে বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে পারবেন?
আমি বললাম, না।
মিসির আলি বললেন, বাতি জ্বালিয়েই ঘুমুবেন। সমস্যা কিছু নেই। ঘুমুবার জন্য অন্ধকার কোনো পূর্বশর্ত না। ভালো কথা, এ বাড়িতে গেস্টরুম আছে না?
আমি বললাম, আছে।
মিসির আলি বললেন, আগামী কয়েকদিন যদি আমি আপনার গেস্টরুমে বাস করি তা হলে কি কোনো সমস্যা হবে?
কেন থাকতে চাচ্ছেন?
এমনি। অনেক দিন একা বাস করছেন, একজন সঙ্গী পেলে আপনার ভালো লাগবে।
কবে থেকে থাকা শুরু করবেন?
আজ থেকেই। আমি প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় সঙ্গে করে এনেছি। শুধু টুথপেস্ট আনা হয় নি। টুথব্রাশ এনেছি। একটা টুথপেস্ট কিনতে হবে।
এতক্ষণ চোখে পড়ে নি এখন চোখে পড়ল, মিসির আলি ছোট্ট একটা চামড়ার সুটকেস এবং হাতব্যাগ নিয়ে এসেছেন। কাজটা তিনি করেছেন শুধুমাত্র আমাকে সঙ্গ দেবার জন্য। আনন্দে আমার চোখে পানি আসার জোগাড় হল। প্রিয়জনদের নিষ্ঠুরতায় মানসিকভাবে ক্ষুদ্র হয়ে ছিলাম। হঠাৎ করেই সেই ক্ষুদ্রতা দূর হল।
মিসির আলি বললেন, আপনি অনেক দিন থেকে বলছিলেন আমার কোনো একটা রহস্যভেদ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকতে চান। এই মুহূর্তে আমি একটা রহস্য নিয়ে ভাবছি। আপনি চাইলে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন।
আমি আগ্রহের সঙ্গে বললাম, অবশ্যই যুক্ত থাকতে চাই।
দশ পৃষ্ঠার একটা চিঠি এখন আপনাকে দিচ্ছি। রসায়নের একজন অধ্যাপিকা চিঠিটা দিয়েছেন। আপনি মন দিয়ে চিঠিটা তিনবার পড়বেন। ইতোমধ্যে আমি আপনার গেস্টরুমে স্থায়ী হচ্ছি। ভালো কথা, আপনার এখানে কি চা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে?
ব্যবস্থা নেই।
রাতে ঘুম না এলে আমাকে চা খেতে হয়। টি ব্যাগ, চা-চিনির ব্যবস্থা করা দরকার। রান্নার চুলা ঠিক আছে তো?
জানি না।
মিসির আলি বললেন, আপনি চিঠি পড়ুন, আমি পরিস্থিতি পর্যালোচনা করি।
আমি চিঠি নিয়ে বসলাম। যথেষ্ট মনোযোগ দিয়েই পড়তে শুরু করলাম। এক— দুই পৃষ্ঠা পড়ার পরই স্বীকার করতে বাধ্য হলাম, রসায়নের এই অধ্যাপিকার বাংলা গদ্যের ওপর ভালো দখল আছে। হাতের লেখাও গোটা গোটা। নির্ভুল বানান।
চিঠির মূল বক্তব্য সন্তানের মৃত্যুরহস্যের সমাধান। আমার কাছে সমাধান খুব কঠিন বলে মনে হল না। সন্তানের মা সমাধান নিজেই করেছেন। সমাধানের স্পষ্ট ইঙ্গিতও চিঠিতে দেয়া। ভদ্রমহিলা তাঁর শাশুড়িকে দায়ী করেছেন। সেটাই স্বাভাবিক। এই বৃদ্ধা হত্যাকাণ্ড নির্বিঘ্নে করার জন্য বাড়ির সবাইকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। খুনি বৃদ্ধার মোটিভও পরিষ্কার। এই বৃদ্ধা তাঁর ছেলেকে কাছে রাখতে চান। তিনি চান না ছেলে আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকুন। ছেলেকে পাশে রাখার জন্য যে ভয়ংকর পরিকল্পনা তিনি করেছেন তা কাজ করেছে। ছেলে নতুন ফ্ল্যাটে ওঠে নি।
যে রহস্যের কথা চিঠিতে বলা হয়েছে সেই রহস্য সাদামাটা রহস্য। রহস্যভেদের জন্য মিসির আলির মতো মানুষ লাগে না। আমার মতো গড়পড়তা মেধার যে কোনো মানুষই এই রহস্য ভেদ করবে।
.
অনেক দিন পর হোটেলের রান্নার বাইরে খাবার খেলাম। বাবুর্চি মিসির আলি সাহেব। চিকন চালের ভাত। আলু ভর্তা। ডিম ভাজি এবং ডাল। খেতে বসে মনে হল, অনেক দিন এত ভালো খাওয়া হয় নি।
মিসির আলি বললেন, বাঙালি রান্না দুই রকম। ব্যাপক আয়োজনের রান্না এবং আয়োজনহীন রান্না। আপনাকে কিছু রান্না আমি শিখিয়ে দেব। নিজে রাঁধবেন। নিজের রান্না খাবেন। আলু ভর্তার জন্য আলু আলাদা সিদ্ধ করতে হবে না। ভাতের সঙ্গে দিয়ে দেবেন। ডাল রান্নার মূলমন্ত্র হচ্ছে সিদ্ধ। যত সিদ্ধ হবে ডাল তত খেতে ভালো হবে। তবে তেলে বাগার দিতে হবে। সিদ্ধ হতে হতে ডাল যখন ‘কলয়েড’ ফর্মে চলে যাবে তখন বাগার প্রক্রিয়া শুরু করবেন। বাগারের কারণে তেল ডালের কণার উপর আস্তরণ তৈরি করবে। বাগারের তেলে বাঙালি মেয়েরা পেঁয়াজ-রসুন ভেজে নেয়। আমি তার প্রয়োজন দেখি না। পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া ডাল রাঁধে বিধবারা। সেই ডাল খেতে সুস্বাদু। ইলিশ মাছ খুব অল্প আঁচে সিদ্ধ হয়, এটা কি জানেন?
জানি না।
মশলা মেখে ইলিশ মাছের টুকরো রোদে রেখে দিলেও সিদ্ধ হয়ে যায়। আপনাকে রোদে রাখতে হবে না। গরম ভাতের উপর রেখে ঢাকনা দিয়ে রাখলেই হবে।
মশলা কী?
মশলা হচ্ছে লবণ। আর কিছু না। বাঙালি মেয়েরা ভাপা ইলিশে নানান মশলা দেয়। মশলা মাছের স্বাদ নষ্ট করে। কোনোরকম মশলা ছাড়া ভাপা ইলিশ একবার খেলেই আপনার আর মশলা খেতে ইচ্ছা করবে না।
আমি ঘোষণা করলাম, আগামীকাল রাতের সব রান্না আমি করব। মেনু ইলিশ মাছ, ডাল, আলু ভর্তা। ভালো ঘিও কিনে আনব। গরম ভাতের উপর এক চামচ ঘি ছেড়ে দেয়া হবে। ভাতের গন্ধের সঙ্গে ঘিয়ের গন্ধ মিশে অমৃতসম কিছু তৈরি হবার কথা। ভেবেই আনন্দ পাচ্ছি এবং এক ধরনের উত্তেজনাও বোধ করছি। দুপুরে বাজার করতে হবে। একটা ফ্রিজ কেনা দরকার।
মিসির আলি হঠাৎ বললেন, ব্যাচেলর জীবনে কিছু আনন্দ আছে, তাই না?
আমি ধাক্কার মতো খেলাম। আমার মনে হল, রান্নাবান্নার এই বিষয়টি মিসির আলি ইচ্ছা করে আমার ভেতর ঢুকিয়েছেন যেন আমি ব্যস্ত থাকতে পারি।
রাতের খাওয়া শেষে দু’জন বারান্দায় চেয়ার পেতে বসেছি। দক্ষিণমুখী বারান্দা। ভালো হাওয়া দিচ্ছে। দু’জনের হাতেই সিগারেট। মিসির আলি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, আজকাল সিগারেটের প্যাকেটে লেখা থাকে ‘ধূমপান মৃত্যু ঘটায়’। পড়েছেন?
আমি বললাম, পড়েছি।
মিসির আলি বললেন, আমার নিজের ধারণা সিগারেটের প্যাকেটে এই সতর্কবাণী দেয়ার পর থেকে সিগারেটের বিক্রি অনেকে বেড়েছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন?
মিসির আলি হাই তুলতে তুলতে বললেন, মানুষের মৃত্যু বিষয়ে আছে প্রচণ্ড ভীতি। সে মৃত্যু কী জানতে আগ্রহী। এই আগ্রহের কারণে অবচেতনভাবে মানুষ মৃত্যুর কাছাকাছি যেতে চায়। সিগারেট সেই কাছাকাছি থাকার সহজ উপায়।
আমি বললাম, যুক্তি খারাপ না।
মিসির আলি আগ্রহের সঙ্গে বললেন, যারা ছাদে বেড়াতে চায় তাদেরকে দেখবেন একসময় ছাদের রেলিংয়ে বসেছে। অতি বিপজ্জনক জেনেও এই কাজটা করছে। মূল কারণ একটাই, মৃত্যুর কাছাকাছি যাওয়া। মানুষ অতি বিচিত্র প্রাণী। ভালো কথা, আপনি কি আমার কন্যার চিঠিটা পড়েছেন?
তিনবার পড়তে বলেছিলেন, আমি দু’বার পড়েছি।
মিসির আলি আগ্রহ নিয়ে বললেন, চিঠি পড়ে কি কোনো খটকা লেগেছে?
আমি বললাম, হুট করে আপনাকে বাবা ডাকাটায় সামান্য খটকা লেগেছে। ‘বাবা’ ডাক ছাড়া চিঠিতে খটকা নেই। চিঠির রহস্য আপনার মতো মানুষের পক্ষে মুহূর্তেই বের করার কথা
মিসির আলি নিচু গলায় বললেন, রহস্য বের করেছি। একটা কাগজে লিখে খামে বন্ধ করে রেখেছি। খামটা আপনি রাখবেন, তবে খুলে এখন পড়বেন না।
কখন পড়ব?
আপনি নিজে যখন রহস্যভেদ করবেন তখন পড়বেন।
আমি রহস্যভেদ করব?
হ্যাঁ আপনি করবেন। আমি আপনাকে সাহায্য করব। আপনি একা বাস করছেন, রহস্য নিয়ে কিছুদিন ব্যস্ত থাকবেন। মানবমনের গতিপ্রকৃতি জানবেন। আপনি লেখক মানুষ, এতে আপনার লাভই হবে।
আমি বললাম, সাগর নামের বাচ্চাটা তার দাদির হাতে খুন হয়েছে—এটা তো বোঝা যাচ্ছে।
মিসির আলি বললেন, চট করে সিদ্ধান্তে যাবেন না। মানসিকভাবে সম্পূর্ণ অসুস্থ না হলে কেউ এই কাজ করতে পারে না। চিঠি পড়ে কি মনে হয় ছেলেটির দাদি মানসিকভাবে অসুস্থ?
তা মনে হয় না। তা হলে কি ছেলেটির বাবা মানসিক রোগী? চিঠিতে সে রকম আছে। হারুন নামের ডাক্তার তাঁর মা’কে দেখে এইসব।
মিসির আলি বললেন, এক কাজ করলে কেমন হয়? ডাক্তার ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করুন। তাঁকে চোখ দেখাতে যান। আপনি লেখক মানুষ। উনি আপনাকে চিনতে পারবেন। আমার ধারণা, উনি মন খুলে আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। রাত অনেক হয়েছে, চলুন ঘুমুতে যাওয়া যাক।
খামটা দিন।
মিসির আলি পাঞ্জাবির পকেট থেকে খাম বের করে দিলেন। তিনি খাম পকেটে নিয়েই গল্প করতে এসেছিলেন।
আমি বললাম, ধাঁধাটির উত্তর কী?
কোন ধাঁধা?
ঐ যে স্থলের প্রাণী জলে বাস করে। আবার জলের প্রাণী জীবন কাটায় স্থলে।
মিসির আলি বললেন, দু’টা একই প্রাণী। কল্পনার প্রাণী। জলের কোনো প্রাণী স্থলে বাস করে না। আবার স্থলের কোনো প্রাণী জলে বাস করে না। যান ঘুমুতে যান। ফালতু ধাঁধা নিয়ে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।