মিষ্টি মেয়ে রুথ
‘অ্যানা, ডালখানা টেনে ধর-না বোন, প্যাঁট প্যাঁট করে কাঁটা বিঁধছে আমার গালে!’
‘অ্যানা এখন কী করে যায় শুনি? আমি একা একা পারি কখনো এই গোলাপের ঝাড় সামলাতে?’
ঝগড়া বেড়েই চলে।
কথাটা এই, অ্যাম্বার্লি গির্জায় নতুন পাদরি এসেছেন স্ট্রিটফিল্ড। তিন মেয়ে তাঁর, অ্যানা, সারা, ইথেল। বারো, দশ, আট ওদের বয়স।
গির্জার গায়ে পাদরির বাড়ি। বেশ বড়ো বাড়ি, বাড়ির লাগোয়া বাগানখানাও বড়ো। কারণ, গির্জার ভিতরে অ্যাম্বার্লি গির্জা অনেকখানি আভিজাত্যের অধিকারী। এখানকার বড়ো পাদরিরা লর্ড বিশপ ছাড়া আর কারও চেয়ে পদমর্যাদায় খাটো নন।
স্ট্রিটফিল্ড আসবার আগে কিছুদিন এখানে বড়ো পাদরির পদটি খালি ছিল। মেজো, সেজো, ছোটো পাদরিরা গির্জার কাজগুলি ঠিকই চালিয়ে দিয়েছেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু বড়ো পাদরির বাড়িঘর বাগানের খবরদারিটাকে তাঁরা নিজেদের কর্তব্যের অংশ বলে মনে করেননি কোনোদিন। ফলে বাগানখানা পরিণত হয়েছে হাফ-জঙ্গলে।
অ্যানা, সারা, ইথেল এসেই নেমে পড়ল বাগানে। নিজেরা যতটা পারে সাফসুতরো করার চেষ্টা করলে দোষ কী? মালী যতদিন না আসছে একজন, অন্তত এই গোলাপের গাছগুলোর তদবির তারা করবে। ভালো মালী জোটানো খুব সোজা নয়, কোনো জায়গাতেই নয়। বিশেষ করে, অ্যাম্বার্লির মতো শহরতলিতে তো নয়ই। অগুন্তি কলকারখানা চারিধারে। মানুষ সেখানে যা রোজগার করবে, মালীগিরিতে তার আর্ধেকও পাবে না কোনোদিন।
সত্যি, কী চমৎকার এই গোলাপের ঝাড়গুলি! লাল গোলাপ, সাদা গোলাপ, গোলাপি- বেগুনি-কালচে গোলাপ। যেমন তাদের রং, তেমনি তাদের গন্ধ। চারদিকের ঘাস উপড়ে ফেলা, আর আগাছাগুলো কেটে দেওয়া— এই করতে পারলেই আপাতত বাগানের এই অংশটা, অন্তত গোলাপের এই কেয়ারিগুলো দাঁড়িয়ে দেখার মতো জিনিস হয়ে দাঁড়ায়।
এক-একটা ঝাড়ে দু-জন না-হলে কাজ করা খুব বেকায়দা। একজন উঁচু করবে ডালগুলো, একজন তার নীচেটা পরিষ্কার করবে। তা না-হলে কাঁটায় কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হওয়া তার অনিবার্য। অ্যানা আর সারা লেগে পড়েছে একটা সাদা গোলাপের ঝাড়ে, ইথেল পড়েছে মুশকিলে তার লাল গোলাপের ঝাড়টা নিয়ে। একা একা এ কাজ করা বাচ্চাদের পক্ষে শক্ত। জোয়ান লোকের পক্ষে এক হাতে ডাল ঠেলে রেখে আর এক হাতে আগাছা টেনে তোলা সম্ভব হতে পারে, কিন্তু দশ বছরের একটা মেয়ে তা পারে কখনো?
তাই ইথেল ডাকাডাকি করছে অ্যানাকে, আর সারা উঠছে খিঁচিয়ে, ‘অ্যানা, এখন কী করে যায় শুনি?’
ইথেল মুষড়ে গেল। লাল গোলাপটা সাফ করা তার ভাগ্যে নেই। অথচ করে উঠতে পারলে কী সুন্দর যে হত! ঠিক এইখানেই একখানা কাঠের বেঞ্চিও পাতা আছে। বাবাকে এনে সেই বেঞ্চিতে বসানোও যেত বিকেল বেলায়। আরামে বসে ঠিক সমুখেই একটা ঝাড়ে দু-শোটা ইয়া বড়ো বড়ো লাল গোলাপ দেখলে কী খুশিই যে হতেন বাবা! হল না তা আর। ওই একচোখা অ্যানার জন্যই হল না। ও সারাকে যা ভালোবাসে, ইথেলকে তার সিকির-সিকিও ভালোবাসে না। বাসলে কি আর ওই বিচ্ছিরি সাদা গোলাপের ঝাড় কামড়ে বসে থাকে দু-ঘণ্টা ধরে? ইথেলের এত ডাকাডাকি কানে না-তুলে?
রাগের চোটে চোখে জল এসে গিয়েছিল ছোট্ট ইথেলের। চোখে ফ্রকের ঝুলটাই তুলেছিল জলটা মুছে ফেলবার জন্য। সেটা নামিয়ে দিয়ে ভালো করে ডান দিকে তাকাতেই সে অবাক। কে গো? এ আবার কে? এই মেয়েটি? ফুটফুটে ঝরঝরে মেয়েটি? ঠিক ইথেলের বয়সিই হবে না? নিশ্চয় তাই!
মিষ্টি মেয়েটি মিষ্টি মিষ্টি হাসছে ইথেলের দিকে তাকিয়ে। দু-খানি ছোট্ট হাত দিয়ে গোলাপঝাড়ের একখানা ঝাঁকড়া ডাল সাবধানে উঁচু করে তুলেছে, আর হাসিমাখা চোখের ইশারায় ইথেলকে বলছে, ‘নাও, চট করে এখানটা সাফ করে ফ্যালো ভাই!’
ইথেল অবাক হয়েছিল, কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়। অবিশ্যি এটি আশপাশের কোনো বাড়িরই মেয়ে। ইথেলরা তো এখনও চেনে না কাউকে! পাশের কোনো বাড়ির মেয়ে নিশ্চয়। ইথেলরা এসেছে শুনে ছুটে এসেছে আলাপ করতে। এরকমভাবে কোনো মেয়ের একা একা বেড়াতে আসা অবিশ্যি রেওয়াজ নয় সমাজে, কিন্তু ছোটো মেয়েদের সমাজ একটা আলাদা জিনিস। সেখানে রেওয়াজ না-মেনে চলাটা খুব বিরল নয়। মেয়েটি হয়তো বাড়িতে কাউকে না-বলে কয়েই সটকে পড়েছে ইথেলদের সঙ্গে আলাপ করবার জন্য।
ইথেলের আনন্দ ধরে না। সারা, অ্যানার উপরে টেক্কা দিয়েছে সে। তার লাল গোলাপের ঝাড়ের চেহারা খুলে যাচ্ছে কী সুন্দর! চকচক ঝকঝক চারিধার। ফুল সব নতুন বাহার নিয়ে হাওয়ায় দুলছে, দেমাকভরে মুখ তুলে তাকাচ্ছে অপরাহ্ন সূর্যের পানে। একটু বাদেই বাবা আসবেন গির্জা থেকে। তক্ষুনি তাঁকে বাগানে ধরে আনবে ইথেল। আলাপ করিয়ে দেবে তার নতুন সখীর সঙ্গে।
ওই যাঃ, নিজের সঙ্গেই তো আলাপ হল না ওর এখনও। ইথেল কাজের ফাঁকে দুই-চারটি কথা না-কয়েছে তা নয়। জবাবও দিয়েছে সে। নাম বলেছে রুথ। বাড়ি? আঙুল দিয়ে পিঠের দিকে কোনো অনির্দেশ্য জায়গার পানে ইঙ্গিত করেছে সে, ঠিক বোধগম্য হয়নি ইথেলের। কয় ভাই-বোন? জিজ্ঞাসা করতেই ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে রুথ বলেছে, ‘এখন আর কেউ নেই ভাই।’
ইথেলকে জব্দ করার জন্য অ্যানা আর সারা ওর দিকে একদম পিছন ফিরে বসে কাজ করছিল। কাজেই রুথের হঠাৎ আবির্ভাব তাদের চোখে পড়েনি। কথাও ইথেলরা কইছিল খুব নীচু গলায়, কারণ প্রথম পরিচয়ের কালে কিশোরীরা লাজুক ভাবটা কাটিয়ে উঠতেই বেশ খানিকটা সময় নেয়।
না, ইথেল যে জব্দ হয়নি, আচমকা একটা দোসর পেয়ে গিয়ে সে যে ওদের চেয়ে সরেস কাজ দেখাচ্ছে নিজস্ব কোণটিতে, তা সারা অ্যানা স্রেফ টের পায়নি। এখন ওই গির্জার বড়ো ঘড়িতে তিনটে বাজল টং টং করে। বাবা এসে পড়বেন এক্ষুনি। তার আগেই বাড়ি ফিরে হাতে-পায়ে সাবান দিয়ে ফিটফাট হওয়া দরকার। এখন কাজে কাজেই ইথেলের একটা খবর নিতে বাধ্য হল ওরা।
‘কী রে ইথেল, তোর হল?’ নিজেরা কাজ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে ওরা, আর অ্যানা ঘাড় ফিরিয়ে ডাকছে, ‘চলরে, বাড়ি যেতে হবে ইথেল—’
ঘাড়টা অল্পই ফিরিয়েছিল প্রথমটায়, কিন্তু হঠাৎ এবার পুরোপুরিই ফেরাতে হল। শুধু ঘাড় নয়, সম্পূর্ণ দেহটাই। তাকে দস্তুরমতো চমক খেতে হয়েছে একটা। একা সে চমক পরিপাক করবে কেমন করে অ্যানা, সারার ঘাড় ধরে জোর করেই ঘুরিয়ে দিল, ‘দেখেছিস?’
একা একা ইথেল এ কাণ্ড কেমন করে করল? লাল গোলাপের ঝাড়টার যে শ্রীই ফিরিয়ে দিয়েছে একেবারে! একটা কেয়ারির ভিতর ওই একটাই ঝাড়, চারদিকে ইটের ঘের। তার পরিমাণ অন্তত এদিকে আট ফুট, ওদিকে আট ফুট। গোলাপঝাড়ের চারপাশে ফাঁকা জায়গা বেশ খানিকটা। তা ভরতি ছিল ঘাসে আর আগাছায়। নেই, একগাছি ঘাস, বা একটা আগাছা কোথাও নেই। ঝাড়ের নীচে তো নয়ই। এমন পরিষ্কার যে বিছানা পেতে শুয়ে পড়া যায় সেখানে।
‘কীরে? তুই একা একা?’— সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল দুই বোন, অ্যানা-সারা।
ওদের কথা শেষ করতে দিল না ইথেল। সখী রুথের সাহায্য না-পেলে সে কিছুই করতে পারত না, এই মালীগিরির বাহাদুরি যে পুরো আর্ধেক রুথেরই ন্যায্য পাওনা, সেটা বোনেদের সমঝিয়ে না-দিলে রুথের উপরে অবিচার করা হয় যে!
সুতরাং ইথেল রুথের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘একা একা কী বলছিস রে? চোখের মাথা খেয়েছিস নাকি? দেখছিস না রুথকে? তোরা তো আমায় বাতিল করবার তালে ছিলি, আমি নতুন বোন পেয়ে গেলাম একটা, কত কাঁটা যে ফুটেছে ওর গায়ে—’
‘তুই ক্ষেপে গেলি নাকি ইথেল?’— ধমকে উঠল সারা, ‘কাকে তুই রুথ বলছিস! নতুন বোন কী বলছিস? কার কথা বলছিস?’
‘কী মুশকিল দ্যাখ-তো!’— রেগে ওঠে ইথেল, ‘আমি ক্ষেপে গেছি? না, তোরা কানা হয়ে গেছিস? মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছিস না? এই যে, আমার থেকে দুই ফুট দূরে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে?’
অ্যানা তাকায় সারার দিকে, সারা তাকায় অ্যানার দিকে। তারপর দু-জনই হাঁউমাঁউ করে ককিয়ে উঠে দে দৌড় বাড়ির দিকে, ‘মা! মা! ও মাগো! ইথেল পাগল হয়ে গিয়েছে!’
ওদের দিকে তাকিয়ে ওদের দৌড়ই দেখছিল ইথেল, খানিকটা হতভম্ব হয়েই। এ কী ব্যাপার? ওরা কি সত্যিই দেখতে পায়নি রুথকে? কেন দেখতে পায়নি? ব্যাপারটা কী হতে পারে? হ্যাঁ, কয়েক সেকেন্ড সে অবাক হয়ে ওদের দিকেই তাকিয়ে ছিল, তাতে ভুল নেই। কিন্তু রুথের দিকে ফিরলও তখনই। আর ফিরে সে অবাক হল আরও বেশি। রুথ নেই তো!
বাড়ি চলে গেল? এর মধ্যে কোথায় গেল? কত দূর যেতে পারে এর মধ্যে? কোনো দিকেই তো চোখে পড়ছে না কোনো মেয়ে! ঝোপঝাড় এদিকে-ওদিকে নেই, তা নয়। কিন্তু তা বেশিক্ষণ কাউকে চোখের আড়াল করে রাখতে পারে না। বেঞ্চিটার উপরে উঠে দাঁড়াল ইথেল। ঝোপজঙ্গলের মাথার উপর দিয়েই গোটা বাগানটা চোখে পড়ল তার। নেই, রুথ কোথাও নেই।
ইথেল এইবার চেঁচিয়ে উঠল, ‘রুথ’ বলে? এক বার, দুই বার, তিন বার। তৃতীয় বারের ডাক যখন হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে বসেছে, একটুখানি সাড়া পেল তখনই। সাড়াটা আর কিছু নয়— একটুখানি খিলখিল হাসি—।
এক ঝলক হাসি, তা ছাড়া আর কিছু নয়। তারপর সব চুপচাপ।
এইবার, এতক্ষণে যেন কেমন গা-ছমছম করে উঠল ইথেলের। এ কাণ্ডখানা তো ঠিক স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না! অ্যানা-সারা মোটে দেখতেই পেল না রুথকে। ইথেল পেল গোড়ায় গোড়ায়, বেশ ভালোভাবে অনেকক্ষণ ধরেই পেল, একসাথে বসে কাজ করল ফুলগাছের তলায়, কিন্তু এমন দেখ, ইথেলও তাকে চকিতে হারিয়ে ফেলল। না, আটপৌরে জিনিস এটা নয়। ইথেল নিজে এভাবে হঠাৎ উবে যেতে পারত না, এ বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ।
গা-ছমছম করছে বটে, কিন্তু তা বলে ছুটে পালিয়ে গেল না ইথেল। অবাক লাগছে বটে, কিন্তু তা ভয় পাওয়ার মতো কিছু নয়। যা বোঝা যাচ্ছে না, তাকেই ভয় করতে হবে— এমন কথা সে মা-বাবার কাছে শেখেনি, শোনেনি ইশকুলের দিদিমণিদের কাছেও। হ্যাঁ, আগে যেখানে ছিল ওরা, সেই মেসনভিল গাঁয়েতেও ছিল ইশকুল, পড়ত ওরা সেখানে। এখানেও পড়বে নিশ্চয়।
এ সব ইশকুলের খরচা চালানো হয় গির্জার তহবিল থেকেই। কাজেই ধর্মকর্মের উপরে জোর একটু বেশি এ সবে। বাইবেলের ক্লাস নিয়মমতো। বাইবেলে ভূতের কথা আছে দুই-এক জায়গায়। সেই সূত্রে ভূত নিয়ে আলোচনা হয়েছিল একদিন মেসনভিল ইশকুলে। এসথার দিদিমণি সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ভূতের ব্যাপারটা। ওরা যে ভয় করবার মতো জিনিস আদৌ নয়— এ কথাই তিনি বলেছিলেন বার বার। স্বয়ং দয়ার পাত্র ওরা। বেশ মনে আছে, ইথেলের বেশ মনে আছে সেই শেষ কথাগুলি এসথার দিদিমণির। ‘ভূত দেখতে পাওয়া কদাচিৎ কারও বরাতে ঘটে। তোমরাও হয়তো কেউ দেখবে না কোনোদিন। যদি দেখ, জানবে ওরা সুখে নেই। মৃত্যুর পরেও পৃথিবীর বাঁধনে যারা বাঁধা থাকে, তারা কষ্ট পায় শিকলে-বাঁধা বন্দির মতো। সে অবস্থায় তোমাদের কর্তব্য হবে ওদের মুক্তির জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করা।’
ইথেল বাড়ি ফিরল ওই সংকল্প নিয়ে। রাত্রিতে যখন ও শুতে যাবে, বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে যখন ভগবানকে ডাকবে নিজের মা-বাবা, বোনেদের, সারা জগতের মঙ্গলের জন্য, তখন রুথের নামটাও সে বিশেষ করে করবে এখন থেকে। সে যদি ভূতই হয়! তাহলে তার মুক্তির জন্যই দরকার সে প্রার্থনা। আর ভূত না-হয়ে যদি জ্যান্ত মানুষই হয় সে, তাহলেও তো এমন কথা নিশ্চয়ই কেউ বলতে পারবে না যে, ভগবানের দয়া তার দরকার নেই!
অ্যানা-সারা আগেই বাড়ি পৌঁছে গিয়েছে। মায়ের কাছে চেঁচিয়ে-ককিয়ে কেঁদে দুই বোনে যা খবর পরিবেশন করছে, তাতে অবাক যতই হন, ভয় তিনি মোটেই পাননি। ইথেল পাগল হয়ে গিয়েছে? এও কি একটা বিশ্বাস করবার মতো কথা নাকি? এই তো বেলা একটার সময় ইথেল তাঁর সমুখে বসে স্যান্ডউইচ খেল গপগপ করে লাঞ্চের টেবিলে! কোনোরকম পাগলামির লক্ষণ তো তার ভিতর দেখা যায়নি তখন!
হঠাৎ? হ্যাঁ, হঠাৎও মানুষে পাগল হতে পারে বই কী! কিন্তু তা হতে পারে, শুধু হঠাৎ সাংঘাতিক একটা আঘাত যদি মনে লাগে, তবেই। ফুলবাগানের কেয়ারি সাফ করতে করতে সেরকম আঘাত লাগতে পারে না কারও মনে। ‘তোদের সব বাজে কথা’— বলে হেসেই মা উড়িয়ে দিয়েছেন অ্যানা-সারার কান্নাকাটি।
অবশেষে ইথেলও এল। মা চোখা নজরে তাকিয়ে রইলেন ওর দিকে। পাগল? ওর ভিতর পাগলের কোন লক্ষণটা আছে? একটু অবশ্য চিন্তিত ওকে দেখাচ্ছে। তা শোনা যাক, চিন্তার হেতুটা কী?
‘কী রে? কী হয়েছে ইথেল?’— অতি সাদামাটা একটা প্রশ্ন করলেন মা। উদবেগ বা উত্তাপ কোনো কিছুর আভাস নেই তাঁর কথায়।
ইথেল আগাগোড়া সবটা ইতিহাসই বলে গেল মায়ের কাছে, ‘এটা হল কী মা? আমি তো বুঝতে পারছি না কিছুই। প্রথমত অ্যানা-সারা তাকে দেখতে পেল না, দ্বিতীয়ত আমার সামনাসামনি যে দাঁড়িয়েছিল, আমি পিছন ফেরামাত্র এক পলকের মধ্যে সে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। তারপর সেই খিলখিল হাসি—’
মাও চিন্তায় পড়লেন। ‘ও কিছু নয়’— বলে কথাটা উড়িয়ে দিতে তাঁর মন চাইল না। মেয়েকে ধোঁকা দেওয়ার পক্ষপাতিনী তিনি নন।
‘মেয়েটার চেহারা কেমন, কথাবার্তা কী বলেছিল’— এইরকম দুই-একটা প্রশ্ন করার পরে তিনি অবশেষে বললেন, ‘এখন তো মা ও বিষয়ে তোমায় নিশ্চয় করে কিছু বলতে পারছি না। মেয়েটি রক্তমাংসের দেহ নিয়েই এসেছিল তোমার কাছে— এইটিই ধরে রাখো এখন। দেহ না-থাকলে সে তোমার কাজে সাহায্য করল কেমন করে? গাছের ডাল উঁচু করে ধরল কী করে? দুই-একদিনের ভিতরই, আমার তো মনে হয় ওকে আবার দেখতে পাবে। আমরাও অবশ্য খোঁজ নিতে থাকব। আশেপাশে কোনো বাড়িতে আছে কিনা ওরকম কোনো মেয়ে—’
দুই-একদিন দেরি করতে হল না। সেইদিনই, সেই অপরাহ্নেই—
মিস্টার স্ট্রিটফিল্ড গির্জা থেকে ফিরে এলেন, মেয়েদের তাগিদে বাগানেও গেলেন একবার, পাঁচ মিনিট বসতেও তাঁকে হল বেঞ্চির উপরে, লাল গোলাপের ঝাড়টার জৌলুস দেখবার জন্য। আর সেই ফাঁকে ইথেল তাঁকে শুনিয়ে দিল রুথের কাহিনি। অ্যানা-সারাও তাদের তরফের বক্তব্য না-শুনিয়ে ছাড়েনি বাবাকে। তাদের এখনও ধারণা, পাগলই হয়েছে ইথেল, বা হতে যাচ্ছে।
স্ট্রিটফিল্ড জবাব দেওয়ার আগে একবার বাগানটার চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে এলেন। নীরবে চিন্তা করলেন দুই মিনিট। তারপর ‘বোঝা যাচ্ছে না’— বলে মেয়েদের নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন মাঠের দিকে, ‘মাঠের পারে ওই যে একটা টিলা দেখছ, ওর উপর থেকে সূর্যাস্ত বড়ো চমৎকার দেখায়। চলো, দেখে আসি, আজ মেঘ বাদলা নেই, পরিষ্কার দেখতে পাবে।’
স্ত্রীকেও ডাকলেন স্ট্রিটফিল্ড, কিন্তু তাঁর যাওয়া সম্ভব হল না। লনড্রিতে খবর দেওয়া আছে, তাদের গাড়ি আসবে একটু বাদেই, ময়লা কাপড়চোপড় হিসাব করে গুনে দিতে হবে তাদের। তেমন কাজের লোক দাসীদের ভিতর কেউ নেই, থাকলে গৃহস্বামিনীকে এসব খুচরো ঝামেলা কেন পোয়াতে হবে?
মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে স্বামী মাঠ পেরিয়ে চলে যাচ্ছেন টিলার দিকে। সূর্য পড়ে আছে টিলার আড়ালে। নীচের জানালা থেকে মিসেস স্ট্রিটফিল্ড তাকে আদৌ দেখতে পাচ্ছেন না। সন্ধ্যা হতে এখনও ঘণ্টাখানেক দেরি তো বটেই, এরই মধ্যে কিন্তু ছায়া নেমে এসেছে এদিকটাতে, যা-কিছু রোদ্দুর, তা শুধু গির্জার মাথায় আর বড়ো গাছগুলোর তেতলার ডালে ডালে।
লনড্রির গাড়ি যতক্ষণ-না আসছে, কোনো কাজই নেই গৃহিণীর হাতে। একটা চেয়ার টেনে ড্রয়িংরুমের জানালাতে ঘাঁটি হয়ে আসনগ্রহণ করলেন তিনি। বসে বসে একবার মাঠের দিকে তাকিয়ে লক্ষ করছেন মেয়ে তিনটি কেমন হরিণশিশুর মতো লাফাতে লাফাতে পথ চলছে তাদের বাবাকে বেষ্টন করে করে, আবার পরক্ষণেই চোখ তুলে চাইছেন রৌদ্রালোকিত বাদাম গাছটার মাথায়— বেলা শেষে যেখানে ডানার ঝটপটি শুরু হয়ে গিয়েছে গৃহমুখী পাখির ঝাঁকের। বেশ লাগছে গৃহিণীর।
কিন্তু এ ব্যাপার কী? অত উঁচু ডালে একটা মেয়ে কোথা থেকে আসবে? নিজের দুই চোখ জোরে জোরে কচলে নিলেন মিসেস। ইথেলের কথা মনে পড়ে গেল। সেও মেয়ে দেখেছে একটি ফুলবাগানে। এ সেই মেয়েই। ইথেলেরই বয়সি মেয়ে। ফুটফুটে চেহারা। যেমন যেমন বর্ণনা পাওয়া গিয়েছিল ইথেলের মুখ থেকে, এ সে-ই নিশ্চয়।
মাটির সঙ্গে সমান্তরাল, তেতলার উঁচু ডাল। চারিদিকে পাখির আনাগোনা, তারই মধ্যে মেয়েটা খাড়া দাঁড়িয়ে আছে ডালের উপরে। দাঁড়াবার জন্য কোনো অবলম্বন তার দরকার হয়নি। সটান সোজা দাঁড়িয়ে মাঠের দিকেই যেন তাকিয়ে আছে। ইথেলের দিকেই তাকিয়ে আছে কি? গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতে চায় মিসেসের। তাঁর ইথেলের উপর প্রেতযোনির নজর পড়ল নাকি? প্রেতযোনি? নিঃসন্দেহ। গাছের মগডালের ও মেয়ে কখনো জ্যান্ত মানুষ হতে পারে না।
পাড়াগাঁয়ের মেয়ে গাছে উঠতে পারবে, এটা অসম্ভব কিছু নয়। ছেলেবেলায় মিসেস স্ট্রিটফিল্ড নিজেও কোন না-উঠেছেন বাগানের ছোটো ছোটো পিচ বা পিয়ারের গাছে! কিন্তু সে ওঠা আর এ ওঠা? তেতলা বাড়ির ছাদ সমান উঁচু ওই ডাল, পায়ের তলায় এন্তার ফাঁকা, মাটির বুক পর্যন্ত। অমন জায়গায় ওভাবে সটান দাঁড়িয়ে থাকা সার্কাসের খেলোয়াড় ছাড়া আর কারও কাজ নয়।
মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে দাঁড়িয়ে আছে, মিলিয়ে গেল হঠাৎ। মিসেসের চোখের সামনেই পলকের ভিতর মিলিয়ে গেল। মিসেস আঙুল দিয়ে ক্রশ আঁকলের বুকের উপরে। ভগবানের নাম করতে লাগলেন মনে মনে—
যাক ওই লনড্রির গাড়ি।
তারপর মিনিট দশেক খুবই ব্যস্ত রইলেন মিসেস স্ট্রিটফিল্ড। ডাঁই-প্রমাণ কাপড় গুনে গুনে বুঝিয়ে দেওয়া, রসিদ বুঝে নেওয়া রীতিমতো গলদঘর্ম ব্যাপার একখানা। যাহোক, সব কাজই মিটল একসময়, গাড়ি চলে গেল অন্য বাড়িতে গড়গড়িয়ে। মিসেস রুমালে মুখ মুছে আবার এসে বসলেন জানালার ধারে।
কী আশ্চর্য! গেট দিয়ে একটি মেয়ে হেঁটে আসছে বাড়ির দিকেই। সেই মেয়েটাই না?
সেই মেয়েই যে, কোনো সন্দেহই নেই। এইমাত্র গাছের মাথায় তাকে দেখা গেল যে বেশে, হুবহু সেই বেশই তার পরনে রয়েছে এখনও।
মিসেস ঘামছেন চেয়ারে বসে। চোখ ঠিকরে বেরুচ্ছে তাঁর। এ কী দস্যি ভূত রে বাবা, যে অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা করে না, ভর দিনের বেলায় হানা দিয়ে বেড়ায় বাড়িতে-বাগানে-গাছের মাথায়!
মেয়েটা এল, মিসেসের জানালার নীচে দিয়েই চলে গেল রান্নাবাড়ির দিকে। একটু আগে ওকে হাওয়ার রাজ্যে চরে বেড়াতে না-দেখলে গৃহিণী নিশ্চয় মনে করতেন যে, পাড়ারই কোনো বালিকা দাসীদের কারও কাছে এসেছে কোনো বিশেষ কাজে। কিন্তু এখন তো তা মনে করবার জো নেই!
কিছুক্ষণ কেটে গেল, ঘণ্টা বাড়িয়ে দিলেন মিসেস স্ট্রিটফিল্ড। সুজান হল হেড দাসী, বাইরের মহল থেকে ঘণ্টা বাজলে তারই ছুটে আসার কথা। এলও সে।
‘কোনো মেয়ে, মানে পাড়ার কোনো মেয়ে এ বাড়িতে এইমাত্র এল কি?’— তাকে জিজ্ঞাস করলেন মিসেস, বিশেষ কোনো উত্তেজনা প্রকাশ না-করে।
সুজানের চাউনিতে বিশেষ একটা অর্থ যেন এই মুহূর্তে দেখতে পেলেন গৃহিণী। তবে উত্তর সে দিল বেশ ঠান্ডাভাবেই, ‘মেয়ে? না তো! পাড়ার মেয়েরা এমন অসময়ে আসবে কেন? আর একা একাই বা আসবে কেন? তেমন রেওয়াজ নয় এদিকে।’
‘কিন্তু আমি যে দেখলাম, বছর দশেকের মেয়ে একটি। সোনালি চুল, লাল উলের ফ্রক পরনে—’
‘হয়েছে তাহলে, মাদাম তাহলে তাকেই দেখেছেন— রুথকে।’
‘কে রুথ?’— নামটা ইথেলের মুখ থেকে আগেই তো শুনেছেন কর্ত্রী।
‘রুথ কে, তা কেমন করে বলব মাদাম! আজ এক-শো বছর ধরে বড়ো পাদরির বাড়িতে ঘোরাফেরা করছে ও। সময় সময় একটু-আধটু উৎপাত না-করে তা নয়, তবে অনিষ্ট করে না কিছু। ভয় পর্যন্ত দেখায় না কাউকে—’
‘হুঁ, ওর ইতিহাস কিছু জানো না?’
‘কেউ জানে না মাদাম! আমি এ বাড়িতে কাজ করছি বারো বছর। আমার আগে করত আমার মাসি। সে করে গিয়েছে প্রায় কুড়ি বছর। এই ধরুন, বত্রিশ বছর ধরে মাসিতে আমাতে রুথকে তো আমরা হামেশাই দেখছি। ওই দশ বছরের ফুটফুটে মেয়ে, ওই সোনালি চুল, ওই লাল ফ্রক। কখনো এর হেরফের নেই। কে ও, কেন ও শান্তি পায়নি, কে তা বলবে?’
‘এর আগে তো অনেক পাদরিই এ বাড়িতে এলেন গেলেন, তাঁরা কি কেউ ওর জন্যে কিছুই করতে পারেননি?’— একটু যেন বিস্ময়ের, একটু যেন বিরক্তির আভাস মাদামের কথায়।
‘কী করবেন?’ সুজান জবাব দিল সঙ্গে সঙ্গেই, ‘করবার কী-ই বা ছিল? কিছু করতে গেলে হয়তো উলটো উৎপত্তি হত। ওর দিকে কেউ বেশি নজর দিলে ও তা পছন্দ করে না। ওই যে বলছিলাম, অল্পস্বল্প উৎপাতের কথা, সেটা ও কখন করে জানেন? কেউ গায়ে পড়ে ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করতে গেলে তবেই।’
‘কীরকম উৎপাতের কথা বলছ?’— জিজ্ঞাসা করেন মাদাম।
‘তা মারাত্মক কিছু নয়। রাগলে ওর মামুলি অভ্যেস যা, তা হল রান্নাঘরে গিয়ে তাক থেকে ভারী ভারী বাসনগুলো টেনে টেনে ছুড়ে ফেলে দেওয়া মেজেতে। কিন্তু কেমন ওর বিবেচনা জানেন, রাগের বশেও কখনো কাচের বা চীনেমাটির বাসনে হাত দেয় না।’
স্বামী ফিরে আসছেন দেখে সুজানকে বিদায় দিলেন গৃহিণী।
মেয়েরা এসে উচ্ছ´সিত বর্ণনা দিল সূর্যাস্তের, ‘কাল তোমায় নিয়ে যাবই মা। না-যাও যদি, ঠকবে। সূর্যাস্তের এমন বাহার আগে কেউ দেখেনি কোথাও!’
স্ট্রিটফিল্ড নিজেও এক মত মেয়েদের সঙ্গে মনোরম সূর্যাস্ত বটে এখানকার! কিন্তু সে আর কয়দিন? বর্ষা-বাদল-বরফ তো লেগেই আছে। সূর্যকে আকাশে একদম দেখা যায় না, এমন দিনই বেশি। এ হপ্তাটা সে সব উপসর্গ নেই বলেই—
মাদাম ওদিকে মেয়েদের চালান করে দিয়েছেন পড়ার ঘরে।
এইবার স্বামীকে নিরিবিলিতে অনেক কিছু কথা বললেন তিনি। তার ফলে ডিনারের পরেই স্ট্রিটফিল্ড একা চলে গেলেন গির্জায়। অত রাত্রে একটিমাত্র রক্ষী ছাড়া সেখানে আর উপস্থিত নেই কেউ। উপাসনার বেদিতে একটিমাত্র আলোক জ্বলছে মিটমিট করে। সেইখানে বসে অজানা-অচেনা রুথের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করলেন পাদরি, ভগবানের কাছে।
ঠিক সেইসময়ে স্ট্রিটফিল্ডের গৃহে দাসীরা তো বটেই, মাদামও ভীতচকিত। এত বেশি রাগ রুথের আর কখনই দেখা যায়নি। আজ সে কাচের বাসন ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, যা নাকি অতীতে সে একদিনও করেনি।
স্ট্রিটফিল্ড ফিরে এসে যখন শুনলেন একথা, করুণ হাসি হেসে তিনি বললেন, ‘মেয়ের অভিমান হয়েছে। এত দিন কেন কেউ ওর জন্য প্রার্থনা করেনি, তারই জন্য অভিমান। সেই অভিমানেরই মাশুল দিতে হল ওই কয়েকখানা কাচের বাসন-কে।’
রাত্রে ঘুমিয়ে আছেন স্ট্রিটফিল্ড দম্পতি, হঠাৎ দু-জনেরই ঘুম ভেঙে গেল। দরজার হাতল কেউ বাইরে থেকে ঘোরাচ্ছে। আস্তে আস্তে একটা পাল্লা খুলে গেল, আর তারই ফাঁকে দেখা গেল একখানি কচি মুখ।
রুথ ঢুকল ঘরে। তার সোনালি চুল আর তার লাল ফ্রক যেন আগুনের আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে চারিদিকে। সেই আলোতেই স্ট্রিটফিল্ড দেখলেন রুথের চোখে জল ঝরছে। সে যেন স্পষ্ট বলছে, ‘আমায় মাফ করুন বাবা, আপনি আমার ভালো করতে গিয়েছিলেন, আমি উলটে রাগ করেছি আপনার উপরে—’
স্ট্রিটফিল্ড উঠে দাঁড়ালেন। একটা চাদর জড়িয়ে নিলেন গায়ে, তারপর এগিয়ে গেলেন রুথের দিকে, ‘মা, আমি তোমায় মুক্ত করব, ভগবানের যদি দয়া হয়—’
মিসেস উঠে পড়েছেন, একটা চাদর তিনিও জড়িয়ে নিয়েছেন ততক্ষণে। রুথ ওদিকে দরজা দিয়ে বেরিয়ে চলে যায়।
না, সে পালাচ্ছে না, ভীতচকিত ভঙ্গি তার নয়। বরং সে যেন ইশারায় এঁদের বলছে, তার অনুসরণ করবার জন্য। ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা, সিঁড়ি দিয়ে নেমে রান্নাবাড়ির উঠোন। আগে আগে রুথ চলেছে, পিছনে এঁরা দু-জন। দাস-দাসীরা তখন ঘুমে অচৈতন্য, এ ব্যাপার কেউ কিছুই জানল না।
রান্নাবাড়ির এক কোণে কয়লার ঘর। রুথ গিয়ে ঢুকল তারই ভিতরে। তারপর তার সোনালি চুল বা লাল ফ্রকের আভা আর দেখতে পেলেন না স্ট্রিটফিল্ডেরা।
পরদিন জনমজুর এনে স্ট্রিটফিল্ড সেই কয়লার ঘরের দেয়াল ভেঙে ফেললেন, খুঁড়ে ফেললেন মেজে। মেজের নীচে প্রায় তিন ফুট গভীরে পাওয়া গেল একটি ছোটো কঙ্কাল। তার মাথার খুলিতে এখনও দুই-এক গোছা চুল লেগে রয়েছে। সে চুলের রং যে সোনালি ছিল একদা, তা অনুমান করা শক্ত নয়।
পুলিশ এসে সেই কঙ্কাল যথাশাস্ত্র সমাধি দেবার অনুমতি দিয়ে গেল। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে তারা জানাল, কতকাল আগে এই বালিকা খুন হয়েছিল, কার দ্বারায়, এখন আর তা নির্ণয় করবার কোনো উপায় নেই। তবে জিনিসটা যে খুন ছাড়া কিছু নয়, তা অন্য পাঁচজনের মতো পুলিশকেও স্বীকার করতে হল। খুন না-হলে ঘরের মেজে খুঁড়ে তাকে পুঁতে ফেলতে হবে কেন?
গির্জা সংলগ্ন পবিত্র সমাধিভূমিতে স্থানলাভ করল রুথের অস্থিগুলি অপমৃত্যুর কতকাল পরে তা কে বলবে? তবে এটা ঠিক যে, এর পরে আর রুথের প্রেতকে কোথাও দেখা যায়নি কোনোদিন।
পুরো এক বৎসরকাল পাদরি স্ট্রিটফিল্ড রোজ রাত্রে গির্জার উপাসনা-বেদীর পাশে বসে প্রার্থনা করে গিয়েছেন, অভাগিনি রুথের আত্মার শান্তিকামনায়।