মিষ্টান্নমিতরে জনাঃ
দ্বারকানাথ বিদ্যারত্ন তাঁর কবিতাকুসুমাঞ্জলি বইয়ের প্রথম খণ্ডে লিখেছেন বিয়েতে কে কী চায়? তাতে বলা হচ্ছে, কন্যা চায় বরের রূপ, মাতা চান জামাইয়ের ধন, পিতা চান পাত্রের জ্ঞান, বান্ধবরা দেখেন পাত্রের কুল আর জনগণ মিষ্টি পেয়েই খুশি, মিষ্টান্নমিতরে জনাঃ।
বাংলায় বৈষ্ণবরাই প্রথম মিষ্টান্ন আহারে বৈচিত্র্য আনেন। তাঁদের প্রায় সব খাবারই ছিল খুবই সাদামাটা ও স্বাদহীন। এইসব স্বাদহীন খাবারকে আকর্ষণীয় করে তুলতে তালিকায় যোগ হয় নানা ধরনের মিষ্টি। ক্ষীর পুলি নারিকেল পুলি পিঠা ইষ্ট-সঘৃত পায়স মৃৎকুণ্ডিকা ভরিষা, তিন পাত্রে ঘনাবর্ত দুগ্ধ, দুগ্ধ চিড়া, দুগ্ধ লকলকি, দধি-সন্দেশ খেতেন শ্রীচৈতন্য। এ ছাড়াও লাড্ডু, চিনিফেনী, মিছরি, মনোহরা, মতিচুর, খাসামৃত, পুরী পুলি, রুটি, শামুলী নামে নানা মিষ্টি চলত। বৈষ্ণবদের পছন্দের মিষ্টিগুলি বেশিরভাগ দুধ ও দই মিশিয়েই তৈরি করা হত। সঙ্গে যোগ করা হত বিভিন্ন গন্ধদ্রব্যও। কথিত আছে, চৈতন্যদেব নাকি দইয়ের সঙ্গে সন্দেশ পেলে খুবই খুশি হতেন। শিষ্যরা নৈবেদ্য হিসাবে এই সন্দেশ উপহার দিলে তিনি যারপরনাই খুশি হতেন।
পায়সেরই কত বাহার— চালের পায়েস, ছানার পায়েস, চুষির পায়েস, চিঁড়ের পায়েস, সুজির পায়েস, কাউন চালের পায়েস, লুচির পায়েস, শীতে হত নাড়ু আর পিঠে। পিঠেরও কত নাম— কাঁঠালি, গেণ্ডুয়া, গুয়া পান, অমৃত মণ্ডল, চন্দ্রপুলি, চন্দ্রকান্তি, মনোহরা, মুগসামালি, আসকে পিঠে— কত কী! ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রাচীন মিষ্টি মতিচুরের লাড্ডু। বয়স প্রায় দুই হাজার বছরেরও বেশি। মধ্যযুগের সূচনা থেকেই বাংলার মানুষ মিষ্টির বৈচিত্র্য খুঁজতে বেশি ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। ক্রমে নানা মিষ্টি ঢুকে পড়ে বাঙালির খাদ্যতালিকায়। এবঙ্গ-ওবঙ্গের মিষ্টি নিয়ে লড়াইও বেশ মজাদার। কৃষ্ণনগরের সরভাজা, বর্ধমানের মিহিদানা-সীতাভোগ, শক্তিগড়ের ল্যাংচা শুধু জগৎবিখ্যাতই নয়, জগৎজয়ীও। কম যায় না ক্ষীরপাইয়ের বাবরসা, বীরভূমের মোরব্বা, মালদহের রসকদম, জলপাইগুড়ির চাঁছি-দই, জয়নগরের মোয়াও। মিষ্টির স্বাদ ও বৈচিত্র্যে পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ)-ও পিছিয়ে নেই। টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, কুমিল্লার রসমালাই, বিক্রমপুর ও রসগোল্লা, বগুড়া ও গৌরনদীর দই, যশোরের খেজুর গুড়ের সন্দেশ, শাহজাদপুরের রাঘবসাই, পানতোয়া, মুক্তাগাছার মন্ডা, খুলনা ও মুন্সীগঞ্জের অমৃতি, কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি, নওগাঁর প্যাঁড়া সন্দেশ, ময়মনসিংহের অমৃতি, যশোরের জামতলার মিষ্টি, যশোরের নলেনগুড়ের প্যাঁড়া সন্দেশ, যশোরের খেজুররসের ভিজা পিঠা, মাদারিপুরের রসগোল্লা, রাজশাহির তিলের খাজা, সিরাজদীখানের পাতক্ষীরা, রাজবাড়ীর শংকরের ক্ষীরের চমচম, নওগাঁর রসমালাই, পাবনার প্যারাডাইসের প্যাঁড়া সন্দেশ, পাবনার শ্যামলের দই, সিরাজগঞ্জের পানতোয়া, কুষ্টিয়ায় মহিষের দুধের দই, মেহেরপুরের সাবিত্রী, কুষ্টিয়ার তিলে খাজা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানামুখী, মানিকপুর-চকরিয়ার মহিষের দই, ইকবালের সন্দেশ, বোম্বাইয়াওয়ালার ক্ষীর, মহাস্থানের কটকটি, গাইবান্ধার রসমঞ্জুরি, কুষ্টিয়ার স্পেশাল চমচম, ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউর পূর্ণিমার জিলাপি, গুলশানের সমরখন্দের রেশমি জিলাপি, দেওয়ানগঞ্জ-জামালপুরের রসগোল্লা, মহেশখালীর মোষের দই, রাজশাহির রসকদম, চাঁপাই-নবাবগঞ্জের চমচম, প্যাঁড়া সন্দেশ, কিশোরগঞ্জের তালরসের পিঠা খাদ্যরসিকদের জিভে জল ঝরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সুপরিচিত নাম। সঙ্গে রয়েছে বগৌড়ার দই। একবার স্বাদ নিলে অমৃতের স্বাদ বোঝা যায়। প্রচণ্ড গরমে এক ভাঁড় বগৌড়ার দই নতুন করে জীবন ফিরিয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশের আর-একটি নামকরা মিষ্টি— প্রাণহরা (দই ও মোয়া মেশানো হালকা সন্দেশ)। এর জনপ্রিয়তাও আকাশচুম্বী। পোড়াবাড়ির চমচমের বয়স নয় নয় করে ১৫০ বছর ছাড়িয়েছে। এই বিশেষ মিষ্টিটির আধুনিক সংস্করণ করেন উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলার রাজা রাম গৌড়। পরে এর আরও উন্নত রূপ বের করেন তাঁর নাতি মতিলাল গৌড়।
আধুনিক সন্দেশ-রসগোল্লার বয়স মাত্র দুই-আড়াইশো বছর। বাঙালিরা ছানা তৈরি করতে শিখেছে পর্তুগিজদের থেকে। তাদের কাছ থেকে বাঙালি ময়রারা ছানা ও পনির তৈরির কৌশল শেখে। উপমহাদেশে ছানা তৈরির শিক্ষাবিস্তার অনেক পরের ঘটনা। প্রথম দিকে ছানা ও ছানার মিষ্টি একরকম পরিত্যাজ্যই ছিল ধর্মীয় কারণে। বৈদিক যুগে দুধ ও দুধ থেকে তৈরি ঘি, দধি, মাখন ইত্যাদি ছিল দেবখাদ্য। বিশেষ করে ননি ও মাখন অত্যন্ত প্রিয় ছিল শ্রীকৃষ্ণের। এজন্য দুধ থেকে রূপান্তরিত ওইসব খাদ্য শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হত। কিন্তু ছানা তৈরি হয় দুধ বিকৃত করে, এজন্য মনুর বিধান মতে, ছানা ছিল অখাদ্য। মহারাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্নের এক রত্ন অমরসিংহ ‘অমরকোষ’ নামে একটি অভিধান রচনা করেছিলেন। সেখানে (ব্রহ্মবর্গ: ২/৫৬) বলা হয়েছে, উষ্ণ দুধে দধি যোগ করলে তাকে ‘আমিক্ষা’ বলে। তখন আরও দুটি নাম ছিল। গরম দুধে দই দিলে দুধটা কেটে যে সাদা অংশ তৈরি হয়, তার নাম ‘দধিকুর্চিকা।’ নষ্ট দুধ অপবিত্র, নষ্ট হওয়া জিনিস খেতে নেই বা ভগবানকেও দিতে নেই। দুধকে ছিন্ন করা হয় বলে ছিন্ন থেকে ছেনা বা ছানা হয়েছে। ছানা নামকরণ নিয়ে আর-একটি দেশীয় মত রয়েছে, গরম দুধে দধি সংযোগে যখন জল এবং সাদা সারাংশ আলাদা হয়ে যায়, তখন সাদা সুতির কাপড়ের হালকা টুকরোতে ‘ছেনে’ জল থেকে সাদা পিণ্ডাকার বস্তুটিকে জলহীন করে বলে এর নাম হয় ‘ছেনা’ বা ‘ছানা।’ এ সম্পর্কে সুকুমার সেন তাঁর ‘কলিকাতার কাহিনী’ বইয়ে লিখেছেন, “ক্ষীর-মাখন-ঘি-দই— এগুলো কাঁচা দুধের স্বাভাবিক পরিণাম, কৃত্রিম অথবা স্বাভাবিক। কিন্তু কোনোটিই দুধের বিকৃতি নয়। ‘ছানা’ কিন্তু ফোটানো দুধের কৃত্রিম বিকৃতি। বাঙালি অন্য দ্রব্য সংযোগ করে দুধ ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে, যাতে সারবস্তু ও জলীয় অংশ পৃথক হয়ে যায়। এভাবে দুধ ছিন্নভিন্ন করা হয় বলেই এর নাম হয়েছিল বাংলায় ‘ছেনা’, এখন বলা হয় ‘ছানা’। সংস্কৃত ভাষায় ছানার কোনোরকম উল্লেখ নেই। অন্য ভাষাতেও ছিল না। আগে অজ্ঞাত ছিল বলেই শাস্ত্রসম্মত দেবপূজায় ছানা দেওয়ার বিধান নেই।”
বাংলার মিষ্টিকে দুভাগে ভাগ করেছেন সুকুমার সেন। প্রথম ভাগে আছে একক উপাদানে তৈরি মিষ্টি। এ ধরনের মিষ্টিতে গুড় বা চিনির সাথে আর কিছু মিশ্রিত থাকে না। যেমন : গুড় বা চিনির নাড়ু ও চাকতি, পাটালি, বাতাসা, খাজা, ছাঁচ ইত্যাদি। দ্বিতীয় ধরনের মিষ্টিকে আরও দুরকমে ভাগ করা চলে। গুড় বা চিনির সাথে দুগ্ধজাত কোনও উপকরণ ছাড়া অন্য দ্রব্য সহযোগে তৈরিকৃত মিষ্টান্ন। যেমন— নারকেল, তিল এসবের নাড়ু, চিঁড়া, মুড়ি, খই-এর মোয়া ইত্যাদি। দুগ্ধজাত দ্রব্যযোগে তৈরি নানান ধরনের মিষ্টি রসিক ও মিষ্টিপ্রিয় বাঙালির সুপরিচিত। চিনির সাথে ছানার সংযোগে তৈরি হয় সন্দেশ ও মন্ডা। আবার এই ছানা রসে মাখিয়ে তৈরি হয় রসগোল্লা, দুধে ডোবালে রসমালাই। বেসনের ছোটো ছোটো দানা ঘিয়ে ভেজে তৈরি হয় বুন্দিয়া, যা দেখতে ছোটো বিন্দুর মতো। কড়া পাকে প্রস্তুতকৃত বুন্দিয়াই মতিচুর, লাড্ডুর কাঁচামাল৷
এই অধ্যায়ে আমাদের অতি চেনা কিছু দেশি আর বিদেশি মিষ্টির গল্প বলব।
সন্দেশকথা
সন্দেশ ছানা আবিষ্কারের আগেও ছিল। আগের দিনে সন্দেশ তৈরি করা হত বেসন, নারকেল ও মুগের ডালের সঙ্গে চিনির সংযোগে। এ ছাড়া শুধু চিনি দিয়ে তৈরি একধরনের চাকতিকেও অনেকসময় সন্দেশ বলা হত। নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ বইয়ে বাঙালির মিষ্টিজাতীয় যে খাদ্যের বিবরণ দিয়েছেন, তাতে সংগত কারণেই ছানার কোনও মিষ্টির উল্লেখ নেই। দুধ থেকে তৈরি মিষ্টির মধ্যে আছে দই, পায়েস ও ক্ষীরের কথা। সন্দেশের উল্লেখ আছে, তবে সেই সন্দেশ ছানার নয়। তিনি বলেছেন, ‘কোজাগর পূর্ণিমা রাত্রে আত্মীয়-বান্ধবদের চিপিটক বা চিঁড়া এবং নারিকেলের প্রস্তুত নানা প্রকারের সন্দেশ পরিতৃপ্ত করিতে হইত এবং সমস্ত রাত বিনিদ্র কাটিত পাশা খেলায়।’ চিনির সঙ্গে ছানার রসায়নে আধুনিক সন্দেশ ও রসগোল্লার উদ্ভাবন অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে।
এই আধুনিক সন্দেশ রসগোল্লার আবিষ্কর্তা হুগলির হালুইকররা। পরে তারা কলকাতায় এসে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একে জগদ্বিখ্যাত করে তোলেন। প্রথম দিকে ছানার সন্দেশকে বলা হত ‘ফিকে সন্দেশ’। কারণ, এ সন্দেশে আগের দিনের সন্দেশের চেয়ে মিষ্টি কম। শাস্ত্রসম্মত নয় বলে ছানার সন্দেশ অনেকে খেতে চাইত না। কলকাতার ময়রাদের সৃষ্টিতে মুগ্ধ শংকর তাঁর ‘বাঙালির খাওয়াদাওয়া’ বইয়ে কড়াপাক, নরমপাক, কাঁচাগোল্লা, চন্দন সন্দেশ সহ হাজার রকম সন্দেশের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘এঁরা আমেরিকান বিজ্ঞানীদের মতো পাইকিরি হারে মিষ্টি শাস্ত্রে নোবেল জয়ী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।’ তিনি জানিয়েছেন, সন্দেশ এত বৈচিত্র্যময় যে শীতকালের সন্দেশ আর গ্রীষ্মের সন্দেশে তো পার্থক্য আছেই, এমনকি সেপ্টেম্বর আর অক্টোবরের সন্দেশও নাকি একরকম নয়। সন্দেশের ইতিহাস নিয়ে প্রামাণ্য প্রবন্ধ লিখেছেন হরিপদ ভৌমিক মশাই। তাঁর থেকেই হাত পেতে জানতে পারলাম, প্রাচীন বাংলায় সংবাদ অর্থে ‘সন্দেশ’ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। চৈতন্যচরিতামৃতে (অন্ত্যলীলা) সংবাদ অর্থে ‘সন্দেশ’–এর ব্যবহার এভাবে এসেছে।
‘শ্রীকান্ত আসিয়া গৌড়ে সন্দেশ কহিল।
শুনি ভক্তগণ মনে আনন্দ হইল।।’
একই সময়ে একই গ্রন্থে (আদিলীলা) মিষ্টান্ন অর্থে সন্দেশ–এর ব্যবহার দেখা যায় :
‘আপনি চন্দন পরি পরেন ফুলমালা।
নৈবেদ্য কাড়িয়া খান সন্দেশ চালু কলা।।’
১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে কবি মুকু্ন্দ মিশ্র ‘বাশুলীমঙ্গল’ কাব্য রচনা করেছিলেন। ‘কনকার কন্যাজন্মে উৎসব’–এ চিনির সন্দেশের উল্লেখ রয়েছে :
‘খিরপুলি দেই রামা করিয়া বিশেষ।
দধি মধু নারিকেল চিনির সন্দেশ।।’
এই সময়ে ক্ষীরের সন্দেশও প্রচলিত ছিল :
‘পাট ভোট নেত লয় ময়মল্ল গন্ডা।
ক্ষীরের সন্দেশ পুলি মধু কাকরন্ডা।।’
প্রাচীন বাংলায় চালের গুঁড়ো, বেসন প্রভৃতি দিয়ে মিষ্টি তৈরি করত। ব্রাহ্মণবাড়ির শুদ্ধ অন্ন ছাড়া অব্রাহ্মণের হাতে তৈরি চালের গুঁড়ো মেশানো মিষ্টিকে অন্নযুক্ত মিষ্টি বলে গণ্য করা হত। তাই উচ্চবর্ণের মানুষ সেই মিষ্টি নিজেরাও খেতেন না, ভগবানের পুজোতেও দিতেন না। হরিপদবাবু সন্দেশ বা খবরের সঙ্গে মিষ্টান্ন নামের সাযুজ্যর এক সুন্দর কারণ নির্দেশ করেছেন। “মধ্যযুগে বঙ্গদেশে বিবাহ অনুষ্ঠান পাকা করা হত পান–সুপারি দিয়ে। সমাজে যিনি প্রথম পান–সুপারি পেতেন তিনি নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করতেন। বিজয় গুপ্তের পদ্মাপুরাণের সময়েও এমন প্রথা ছিল— ‘পান সুপারি বিনে তোমার ছাড়া নাই।’ কবিকঙ্কণের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে দেশের অন্যান্য শুভ সংবাদ দিতে চিঠি পাঠানো হত— ‘লিখন করিয়া পাঁতি আনাইল বন্ধু জ্ঞাতি/ দেশে দেশে পাঠাল বার্তন।’ পরবর্তীকালে পান–সুপারির জায়গায় সন্দেশ নিজগুণে জায়গা পেয়ে গেল। স্বামীজির ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন— ‘আমরা ছেলেবেলায় দেখেছি... দেশী তুলোট কাগজে শুভ কার্যের চিঠি লাল কালি দিয়ে লেখা হইত এবং কাগজখানি চারদিকে লাল সুতা বেঁধে কিছু মিষ্টির সহিত নাপিতের হাতে যাইত।’ এত মানুষ থাকতে শুভকাজের চিঠি নাপিতের হাত দিয়ে পাঠানো হত কেন? প্রাচীন বাংলায় লৌকিক–সাংবাদিকের সম্মান পেত নাপিতরা। দশ গ্রাম ঘুরে এরা কাজ করত, চুল কাটতে কাটতে নাপিতের মুখ থেকে শুনে নিত নানান কথা। এক গ্রামের সংবাদ এদের মুখ দিয়েই পৌঁছে যেত অন্য গ্রামে। বিয়ের শুভ সন্দেশ (সংবাদ) চিঠির সঙ্গে শুকনো মিষ্টি ‘সন্দেশ’ তাদের হাত দিয়েই পাঠিয়ে দেওয়া হত। এই সংবাদ সূত্রেই শুকনো ছানার মিষ্টিটি নাম পায় ‘সন্দেশ’।”
এই মিষ্টি সন্দেশটি যেত থালায় করে। দেখা যেত রাস্তাতেই থালার সন্দেশ কিছুটা কমে যেত, তাই থালার জায়গায় এল হাঁড়ি। এ প্রসঙ্গে মহেন্দ্রনাথ দত্ত জানিয়েছেন— “পাছে নাপিত হাঁড়ি থেকে মিষ্টি খেয়ে ফেলে এই জন্য হাঁড়ির মুখে সরাটা উল্টে দিয়ে ময়দা গুলিয়া চারিদিকে লাগাইয়া দেওয়া হইত। তাহাকে ওলপ [কুলুপ] দেওয়া বলে। ‘এই জন্যে মেয়েরা পরস্পর ঠাট্টা করিত। ‘ওলো, তুই যে মুখে ওলপ [কুলুপ] দিয়েছিস, তোর মুখে রা নাই।’” সন্দেশে বিখ্যাত ছিলেন ভোলা ময়রা (১৭৭৫-১৮৫১), ভীম নাগ আর গিরিশ চন্দ্র দে। রসগোল্লায় নবীন ময়রা। মনোহরা, প্রাণহরা, দেলখোস দরবেশ, মধুক্ষরা, আবার খাবো, অবাক নামের মিষ্টিরা শেষ পাতে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে কতবার। গোট পাড়ার ঝুরো সন্দেশ, খাগড়ার মণ্ডা, বর্ধমানের সীতাভোগ, মুড়োগাছার ছানার জিলিপি আজ মিথে পরিণত।
যমদত্তর ডায়ারী খ্যাত যতীন্দ্রমোহন দত্ত সন্দেশ নিয়ে একখানা গোটা সন্দর্ভ রচনা করেছেন। তাতে তিনি লিখছেন, ‘যে যে প্রকারের সন্দেশ খাইয়াছি তাহার নাম দিতেছি, আপনারা যদি খাইয়া থাকেন তো বুঝিতে পারিবেন কি জিনিষ বাঙালি হারাইল। ১) পানিহাটীর গুঁপো, ২) সোদপুরের রামচাকি, ৩) রানাঘাট শান্তিপুরের কাঁচাগোল্লা, ৪) পোড়াদহর সরের নাড়ু, ৫) জনাইয়ের মনোহরা, ৬) এঁড়েদার ভুতো ময়রার আমসন্দেশ, ৭) চন্দননগরের তালশাঁস, ৮) শিমুলিয়ার জলভরা তালশাঁস, ৯) মদন দত্তের কপাট ভাঙা কড়াপাক, ১০) সিমলার কড়াপাক, ১১) জোড়াসাঁকোর বাতাবি সন্দেশ, ১২) আবার খাবো, ১৩) অবাক, ১৪) গোলাপ ফুল, ১৫) কাঁচা আমের গন্ধযুক্ত আম সন্দেশ, ১৬) মনোরঞ্জন, ১৭) কস্তুরি, ১৮) ডিম সন্দেশ, ১৯) কাঁটা ডিম, ২০) বিস্কুট সন্দেশ, ২১) চপ সন্দেশ, ২২) আতা, ২৩) বরফি, ২৪) চকোলেট সন্দেশ, ২৫) ক্ষীরের সন্দেশ, ২৬) আইস-ক্রিম সন্দেশ।’
সূর্য মোদকের জলভরা সন্দেশের গল্প সবাই জানেন। তবু একবার বলেই দি। তখন ১৮১৮ সাল। বাংলায় তখন ইংরেজ শাসন চালু হলেও আনাচেকানাচে দু-চারটে জমিদারি তখনও টিকে আছে বহাল তবিয়তে। আয় যেমনই হোক, আদবকায়দায়, ঠাটেবাটে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা পুরোপুরি বর্তমান। এমনই এক জমিদার ছিলেন ভদ্রেশ্বরের তেলিনীপাড়ার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার। বাড়ির মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পরে মেয়ে এসেছে বাপের বাড়ি জামাই নিয়ে জামাইষষ্ঠী উপলক্ষ্যে। তখন আবার জামাইঠকানো বা বউঠকানো বহু প্রথা চালু ছিল। এখন সেগুলো বোকা বোকা মনে হলেও তখন এইসব প্রথা রমরম করে চলত। সে যাই হোক, জামাইকে ঠকাতে হবে। কী করা যায়? ঠকানোও হল আবার জামাই বাবাজীবন রাগও করতে পারলেন না, এমন কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।
অনেক ভেবে তেলিনীপাড়ার জমিদারবাড়িতে তলব হল এলাকার নামকরা ময়রা সূর্যকুমার মোদকের। তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হল এমন একটা মিষ্টি বানাতে হবে যা দিয়ে জামাই ঠকানো যাবে অথচ তাঁর মানসম্মান যেন কোনওভাবেই ক্ষুণ্ণ না হয়। বহু ভাবনাচিন্তা করার পর মোদক মহাশয় একটা বিশাল আকারের মিষ্টি বানালেন, যার ভেতরে জল ভরা থাকে, অথচ বাইরে থেকে দেখে বোঝার কোনও উপায়ই নেই। সেই মিষ্টি দেওয়া হল জামাইয়ের পাতে। মিষ্টিতে মাতোয়ারা জামাই সেই মিষ্টি হাতে নিয়ে দিলেন বিশাল এক কামড়। আর যেই না কামড়ানো, মিষ্টির ভেতরের লুকোনো জল বেরিয়ে এসে ভিজিয়ে দিল জামাইয়ের সাধের গরদের পাঞ্জাবি। জামাই অপ্রস্তুত। হো হো করে হেসে উঠলেন শালা-শালিদের দল। ঘোমটার আড়ালে হাসিতে ভরে উঠল শাশুড়িদের মুখ আর জমিদারবাবু গোঁফে দিলেন তা। জন্ম হল জলভরার।
ধর্মচর্চার পীঠস্থান হওয়ার জন্য গুপ্তিপাড়াকে ‘গুপ্ত বৃন্দাবন’ বলা হত। ক্রমে ‘গুপ্ত বৃন্দাবন পল্লী’, তার থেকে ‘গুপ্ত পল্লী’ এবং পরিশেষে গুপ্তিপাড়া নাম হয়। কথিত আছে যে গুপ্তিপাড়াতেই সন্দেশের জন্ম। এখানেই প্রথম তৈরি হয় সন্দেশের মিশ্রণ, যা মাখা সন্দেশ নামে পরিচিত। পরে সেই মাখা সন্দেশকেই আকার দিয়ে তৈরি হয় গুপো সন্দেশ। এই সন্দেশ জনপ্রিয় হলে তা ‘গুপ্তিপাড়ার সন্দেশ’ বা সংক্ষেপে ‘গুপো সন্দেশ’ বলে পরিচিতি লাভ করে। অপর মতে অবশ্য সন্দেশটি খাওয়ার সময় গোঁফে লেগে যায় বলে তার নাম হয়েছে গুঁফো সন্দেশ।
সন্দেশ নিয়ে গোটা একটা বই হয়ে যায়। অত বাড়াবাড়ি না করে দুটো কথা বলে আলোচনা থামাই। দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন বাজারে সন্দেশের আকাল পড়েছিল। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুনের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকা থেকে অংশবিশেষ তুলে দিচ্ছি : ‘দক্ষিণেশ্বরের নবরত্ন মন্দির প্রতিষ্ঠাজানবাজার নিবাসিনী পুণ্যশীলা শ্রীমতী রানী রাসমণি জ্যৈষ্ঠ পৌর্ণমাসি তিথিযোগে দক্ষিণেশ্বরের বিচিত্র নবরত্ন ও মন্দিরাদিতে দেবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন, ঐ দিবস তথায় প্রায় লক্ষ লোকের সমাগম হইয়াছিল,... আহারাদির কথা কি বলিব, কলিকাতার বাজার দূরে থাকুক, পানিহাটি, বৈদ্যবাটি, ত্রিবেণী ইত্যাদি স্থানের বাজারেও সন্দেশাদি মিষ্টান্নের বাজার আগুন হইয়া উঠে, এমত জনরব যে ৫০০ মোন সন্দেশ হয়... বাঙ্গালি লোক অনেক গিয়াছিল, তাহারা মিষ্টান্ন প্রভৃতি উপাদেয় দ্রব্যাদি আহারে পরিতৃপ্ত হইয়া... বিদায় হইয়াছে।’ ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে দু্র্গাপূজার খরচের একটি ফর্দ পাওয়া যায়, ওই ফর্দ অনুসারে ওই দুর্গাপুজোয় মোট খরচ হয়েছিল ৮০ টাকা ১৪ আনা ২ পাই পয়সা। এর মধ্যে প্রতিমার দাম ৫ টাকা, এক মন ঘি কেনা হয়েছিল ৫ টাকা, ৪ মন ময়দা ২ টাকা ৬ আনা। ক্ষীর কেনা হয় ৫ টাকার, সন্দেশ ৭ টাকার। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় নীলমণি মিত্র স্ট্রিটে রাজকৃষ্ণ মিত্রের বাড়িতে যে দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানে এক মন খাসা সন্দেশ কেনা হয়েছিল ১৫ টাকা দিয়ে। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে এক মন সন্দেশ ১৬ থেকে ২০ টাকার মধ্যে বিক্রি হত বলে রসরাজ অমৃতলাল বসু তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন। সাধে কি আর যম দত্ত বলেছিলেন, ‘সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মিষ্টান্ন হইতেছে সন্দেশ। শ্রাদ্ধ বাড়িতে কেহ পিণ্ডদানের আগে কিছু খাইতেন না ইহাই ছিল নিয়ম... কিন্তু নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ডাব ও সন্দেশ খাইতেন। ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বিদায়ের সঙ্গে আটটা করিয়া কাঁচাগোল্লা, না [দিতে] পারিলে ছানা ও চিনি দেওয়া হইত, মেয়ের বাড়ির খবর আনিতে লোক যাইবে— এক থালা সন্দেশ খোঞ্চেপোষ ঢাকা দিয়া লোক যাইত। তত্ত্বর কথা বাদই দিলাম। বিবাহে সন্দেশ না হইলে প্রায় বিবাহ হইত না। আমার নাতি হইয়াছে, পাড়ায় পাঁচ বাড়িতে সন্দেশ বিলি করা হইল। নাতির অন্নপ্রাশনের ত কথাই নাই। তোমার নাতির ভাতে সন্দেশ খাইব— এটি একটি আদরের আবদার। ছেলে পাশ করিয়াছে সন্দেশ খাওয়াও...।’
রসগোল্লা
রসগোল্লা! বাঙালি এমন নস্টালজিক এই গোলাকার মিষ্টিটি নিয়ে, যার তুলনা আর কোথাও পাবেন না। মুশকিল হল, কোথায় প্রথম এই বস্তুটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল তা নিয়ে যথেষ্টই বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন রসগোল্লার প্রথম আবির্ভাব কলকাতায় নয়, ওড়িশাতে। মধ্যযুগে কোনও এক সময় পুরীতেই নাকি রসগোল্লার প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। কটকের কাছে সালেপুরের রসগোল্লার যশ এখনও ঈর্ষণীয়। ভুবনেশ্বরের পহলার রসগোল্লাও নামকরা। তবে সেরা রসগোল্লার কারিগরেরা বেশিরভাগই যে এই শহর কলকাতারই, সে বিষয়ে ঐকমত্য দেখা দেয়নি। সালেপুরে বিকলানন্দ কর নামে এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম রসগোল্লা তৈরির কৌশল বের করেন। স্থানীয় দেবদেবীদের নৈবেদ্য প্রস্তুত করতেই এই খাদ্যবস্তুটির আবির্ভাব ঘটে। বাংলার তৎকালীন অবস্থাপন্ন লোকেরা বাড়িতে ওড়িয়া রাঁধুনি রাখতেন। তাঁরাই প্রথম বাড়ির মালিক-মালকিনদের তুষ্ট করতে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করা শুরু করেন।
১৮৬৮ সাল নাগাদ বাগবাজারের নবীনচন্দ্র দাস রসগোল্লাকে বিশেষ স্বাদযুক্ত করে বাজারজাত করলেন। যদিও নবীন দাস প্রথমে রসগোল্লা নয়, বানিয়েছিলেন সন্দেশ। তারপর এই শুকনো মিষ্টির জায়গায় আনলেন রসালো মনভরানো রসগোল্লা। তবে ঘটনা হল প্রথমে বাঙালি নবীন দাসের রসগোল্লাকে ভালোমতো নেয়নি। বেশি সময় ধরে ফোটানো হত বলে দেবতারা নাকি তা পছন্দ করবেন না এমনটাই মনে করতেন তাঁরা। কথিত আছে, একদিন ভগবানদাস বগলা নামে জনৈক ব্যবসায়ী গ্রীষ্মের দুপুরে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাগবাজারের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে প্রচণ্ড গরমে খুবই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে ব্যবসায়ীর পুত্র। এমন সময় তিনি নবীন দাসের দোকান দেখতে পেলেন। দেখেই ছেলেকে নিয়ে দোকানের সামনে এসে থামলেন। বগলার ছেলেটি তখন এতই তৃষ্ণার্ত যে চলার শক্তিটুকুও তার ছিল না। বাধ্য হয়ে বগলা দোকানদারের কাছে এক গ্লাস জল চাইলেন। দোকানির দয়া হল। তিনি ছেলেটিকে জলের সঙ্গে একখানা রসগোল্লাও খেতে দিলেন। মিষ্টির স্বাদ পেয়ে ভগবানদাস বগলার ছেলে দারুণ তৃপ্ত হল, তার চোখে মুখে ফুটে উঠল আনন্দের ঝিলিক। ছেলের খুশি দেখে বাবাও খেয়ে ফেললেন একখানা রসগোল্লা। তারপর আরও একটা। রসগোল্লার অপূর্ব স্বাদে মুগ্ধ হয়ে পিতা-পুত্র মিলে পেটভরে খেলেন মিষ্টি। বগলা বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য বিপুল পরিমাণ মিষ্টির অর্ডারও দিয়ে দিলেন সঙ্গে সঙ্গে। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি নবীন দাসকে। দেখতে দেখতে কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে গেল তাঁর রসগোল্লার খ্যাতি। ‘বাগবাজারের নবীন দাস’-ও হয়ে উঠলেন ‘রসগোল্লার কলম্বাস।’ প্রথমে মাটির ভাঁড়ে রসগোল্লা দেওয়ার রীতি ছিল। ফলে রসগোল্লা বাইরে পাঠানো ছিল সমস্যার। ছিল নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ও। এই সমস্যার সমাধানও মিলল নবীন দাসের ছেলে কে সি দাসের হাত ধরে। তিনি রসগোল্লাকে কৌটোজাত করে শুধু অন্য রাজ্যগুলিতেই নয়, বিদেশেও পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হলেন।
হরিপদ ভৌমিক অবশ্য বাংলার রসগোল্লা নিয়ে সোচ্চার। তিনি বলছেন, “ওড়িশা থেকে যে দাবি করা হয়েছে তাতে রসগোল্লার জন্ম পুরীতে৷ কোন সময়ে এই রসগোল্লার আবিষ্কার তা নিয়ে ওখানকার গবেষকগণ এক-একজন এক-এক রকম সময় নির্ধারণ করেছেন৷ কেউ কেউ বলেছেন রসগোল্লার জন্ম সময় সঠিক ভাবে জানা যায় না৷ কেউ বলেছেন ৩০০ বছর, কেউ ৬০০ বছর, কেউ ৭০০ বছর, আবার একজন দাবি করেছেন ১১ শতক অর্থাৎ ৯০০ বছর৷ আসলে কেউই জানেন না কোন সময়ে রসগোল্লার জন্ম৷ এই না জানার কারণ আসলে পুরীতে ছানার রসগোল্লার জন্মই হয়নি৷ পুরীর দাবি অনুযায়ী রসগোল্লাটির নাম ‘ছানার ক্ষীরমোহন রসগোল্লা’৷ এই রসগোল্লাটি যে অপবিত্র ছানায় তৈরি হয়নি, পরের ‘ক্ষীর’ শব্দটি থেকে পরিষ্কার৷ ছানাকে কখনোই ক্ষীর বলা হয়নি বা এখনও হয় না৷ প্রথম রসগোল্লা লক্ষ্মীদেবীকে খাওয়ানো হয়েছিল৷ যদি তাই হয়ে থাকে, তা হলে প্রথম যে দেবতাকে নিবেদন করা হয়, তাঁর নামানুযায়ী নামকরণ করা হয়ে থাকে, কিন্তু এই মিষ্টির ক্ষেত্রে তা হয়নি। নাম ‘ক্ষীরমোহন’, এই মোহন শব্দে মদনমোহনরূপী শ্রীকৃষ্ণ মনে হয়৷ শ্রীকৃষ্ণের নামের মিষ্টি প্রথম লক্ষ্মীদেবীকে নিবেদিত হল কোন তথ্যের ভিত্তিতে তা বোঝা গেল না৷ আর মিষ্টিটি যে ছানার রসগোল্লা তার তথ্য কোথায়৷ উনিশ শতকের আগে ছানার রসগোল্লার নাম কোথাও পাওয়া যায় না৷ তবে ক্ষীর দিয়ে গোল্লা করে রসে নিষিক্ত করে ‘ক্ষীরগোলা’ নামে ক্ষীরের একটি মিষ্টান্ন তৈরি হত ১৮৩১ সালে ছানা ‘পাকরাজেশ্বর’ গ্রন্থে দেখা যায়৷ এই ক্ষীরগোলককে যদি গোল্লা শব্দ যোগ করে ক্ষীরগোল্লা বা ক্ষীরের রসগোল্লা বলে কেউ দাবি করেন তা হলে তো তা ছানার রসগোল্লা হবে না, হবে ক্ষীরের রসগোল্লা৷”
জিলিপি
বাঙালির রথযাত্রায় যে মিষ্টি একেবারে হিট, সে হল জিলিপি। রসগোল্লা যদি বাঙালির ঘরের খাওয়া হয়, তবে মেলার মিষ্টিতে জিলিপিকে হারানো মুশকিল। সোনালি আড়াই প্যাঁচ, মুচমুচে স্বাদ, প্রতি কামড়ে ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসা চিনির শিরা… দু আঙুলে ধরে টপ করে মুখে ঢোকানোর আনন্দই আলাদা। শিঙাড়ার সঙ্গে একেবারে মানিকজোড় এই জিলিপি… তবে দাঁড়ান মশাই, রসগোল্লার মতো এই মিষ্টিকে আমাদের বলে দাবি করলে মুশকিল আছে। জিলিপির সর্বাধিক পুরোনো লিখিত বর্ণনা পাওয়া যায় মুহম্মদ বিন হাসান আল-বোগদাদীর লিখিত ১৩শ শতাব্দীর রান্নার বইতে, যদিও মিশরের ইহুদিরা এর আগেই খাবারটি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিল। ইরানে এই মিষ্টান্ন জেলেবিয়া নামে পরিচিত, যা সাধারণত রমজান মাসে গরিব-মিশকিনদের মাঝে বিতরণ করা হয়। মধ্যযুগে পারসি ভাষাভাষী তুর্কিরা খাবারটিকে ভারতবর্ষে নিয়ে আসে। বাংলাদেশে রমজান মাসে ইফতারিতে এটি একটি জনপ্রিয় খাবার। শুধু মধ্য এশিয়া না, প্রায় গোটা এশিয়াই জিলিপির রস চেটে চেটে খেয়ে চলেছে বহুদিন ধরে। ইরানে এর নাম জালাবিয়া, মালদ্বীপে জিলিপি, তিউনিসিয়া, লিবিয়া এবং আলজেরিয়াতে জিলিবিয়া এবং নেপালে একে বলা হয় জেলি। ভারতে ঠিক কবে জিলিপি এসেছে বলা মুশকিল। তবে তা প্রথম এসেছিল পশ্চিম দিক থেকে। তাই ভারতেরও পশ্চিম, মানে রাজস্থানে জিলিপি নম্বর ওয়ান ডেসার্ট। জানা যায়, মুঘল যুগে বাদশাদের খাদ্যতালিকায় জিলিপির প্রবেশ ঘটে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় থেকে। এই মিষ্টি জাহাঙ্গীরের এত প্রিয় ছিল যে, তিনি এই মিষ্টির সঙ্গে নিজের নাম জুড়ে দিতে দ্বিধা করেননি। তিনি নাম রেখেছিলেন ‘জাহাঙ্গিরা।’
১৫শ শতকের ভারতে জিলিপিকে ‘কুণ্ডলিকা’ বলা হত। ওই আড়াই প্যাঁচের জন্যই বোধহয়। ইলাহাবাদ বা ত্রিবেণীতে বসে পেট ভরে জিলিপি খেলে নাকি পুনর্জন্ম হয় না। বেচারা বুদ্ধদেব এই খবর জানতেন না। জানলে শিয়োর তাঁর তিনটে পিটকের বদলে এই শর্টকাটটা নিতে বলতেন। ১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সংস্কৃত ভাষায় রচিত গ্রন্থ “গুন্যগুনবধিনী”-তে জিলাপি প্রস্তুত করার জন্য যে উপাদানের তালিকা পাওয়া যায়, তার সাথে আধুনিক জিলাপি রন্ধন প্রক্রিয়ার যথেষ্ট মিল রয়েছে। পয়ার ছন্দে লেখা এই বইতে জিলিপির ফুল রেসিপি দেওয়া আছে। কিছুদিন আগে অবশ্য ১৪৫০ সালে জৈন সাধু জিনসুরের লেখা “প্রিয়ঙ্কর রূপরেখা”-তে জিলিপির উল্লেখ পাওয়া গেছে। সপ্তদশ শতকে রানি দীপাবাই-এর সভাকবি রঘুনাথের দক্ষিণ ভারতের খাবার নিয়ে প্রামাণ্য কুকবুক “ভোজনকুতূহল”-এও জিলিপি সগৌরবে উপস্থিত।
এবার আসি আসল প্রশ্নে। রথের মেলার সঙ্গে জিলিপির কী সম্পর্ক। ঘটনা হল জগন্নাথদেবকে তো ছানার মিষ্টি দেওয়া যায় না, আমরা জানি। যারা জানি না, তাঁদের বলি দুধ কেটে বা ছিন্ন করে ছানা তৈরি হয়, ফলে দুধের গুণ নষ্ট হয়, এমন কিছু একটা কনসেপ্ট কাজ করত। পুরীতে তাই জগন্নাথ গজা খান, আর ছানা খেলেও সেটা পুড়িয়ে ছানাপোড়া বানিয়ে খান। বাংলায় তাই জগন্নাথের মেলায় রসগোল্লা প্রথমেই বাদ। যা রইল, তা তপ্ত কটাহে ভাজা ভাজা হওয়া পবিত্র জিলিপি। বাংলার ময়রারা আবার এক কাঠি উপরে। তাঁরা ময়দার বদলে ডাল ব্যবহার করে বানিয়েছেন জিলিপির ভায়রা ভাই অমৃতি। অমৃতি বা অমৃত্তি বা আমিত্তি কিছুটা জিলিপির মতো দেখতে খাবার, তবে এর রং সাধারণত লাল বা কমলা হয় এবং এটা খেতেও জিলিপির থেকে আলাদা হয়। এটি তৈরি হয় অড়হর ডাল ভিজিয়ে বেটে সেটি ভেজে। কোথাও কোথাও একে আমিত্তি পিঠা হিসাবেও আখ্যায়িত করা হয়। দ্বারিকের জিলিপির গল্প দিয়ে শেষ করি। সিউড়ির ১০৫ বছর ধরে দাতা সাহেবের পাথরচাপড়ি মেলায় আসছে তাঁতিপাড়ার দে পরিবার। তাঁরা জিলিপি তৈরিতে বিখ্যাত। যে দাতাবাবার নামে এই মেলা হয়, দে পরিবারের পূর্বপুরুষ অমৃতলালের জিলাপি খেয়ে দাতাবাবার খুব ভালো লেগেছিল। সেই তাঁর আমন্ত্রণে মেলায় যাওয়া। প্রথম জিলিপি দাতাবাবাকে তুলে দিয়ে তারপরে মেলায় বেচাকেনা করতেন। বর্তমানে সেই রীতি চলছে। আগে দাতাবাবার মাজারে জিলিপি উৎসর্গ করা হয়, তারপরে দোকান শুরু। এলাকার ইতিহাস বলছে সেসময়ে কড়িধ্যা থেকে একটি মনোহারি ও নটকনা সামগ্রীর দোকান আসত। সময়ের কালে সেসব বিলীন হয়ে গিয়েছে। শুধু জিলাপির টানে এখনও আসে দ্বারিকনাথের দোকান। মেলায় আসার জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি চলে। তাঁতিপাড়ায় এখনও ঢেঁকি আছে। একমাস আগে থেকে তাতেই বিউলির ডাল, আতপ চালের গুঁড়ো তৈরি করতে হয়। কারণ বন্ধুত্বের সঙ্গে জিলাপির মানকেও মলিন হতে দেয়নি চতুর্থ প্রজন্মের দে পরিবার।
জিলিপি বোধহয় একমাত্র মিষ্টি, যা দিয়ে মানুষের চরিত্র বর্ণনা করা হয়। “জানিস তো ওঁর মনে জিলিপির প্যাঁচ”, মানে মানুষটি সুবিধার নন মোটেই। জিলাপির প্যাঁচ বললেই কেমন যেন কূটচালের ব্যাপারটি ভেসে আসে। মোটামুটি আড়াই প্যাঁচের হলেও বাস্তবে পাঁচ পেঁচে, কখনও ছয় পেঁচে জিলাপি তৈরি করা কিন্তু সহজ কথা নয়। আর ২০ পেঁচের শাহি জিলাপির কথা শুনে তো অনেকের জিবে জল চলে আসে। পুরোনো ঢাকার কারিগরদের হাতের প্যাঁচে জিলিপি তৈরি দেখার ব্যাপার। শুধু দেখারই নয়, শাহি জিলিপি পুরোনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যেও পড়ে। শাহি জিলিপি সচরাচর দেখতে পাওয়া জিলিপির চেয়ে আকারে অনেক বড়ো। বিশাল আকৃতির এ জিলিপি দেখতেও আকর্ষণীয়। ঢাকার বাজারে তিন ধরনের জিলিপি আছে। বোম্বে জিলিপি, শাহি জিলিপি ও রেশমি জিলাপি। সবচেয়ে ছোটো জিলিপি হয় আড়াই প্যাঁচের। আর বড়ো জিলিপি ২০ পেঁচের, একে বলা হয় শাহি জিলাপি। এই জিলিপির প্রতিটির ওজন এক কেজি থেকে চার কেজি পর্যন্ত হয়। একটা একজন খেতে পারে না। পারলেও রাতে অন্য কিছু আর খেতে হয় না।
লেডিকেনি আর পান্তুয়া
চার্লস ক্যানিং ও তাঁর তরুণী স্ত্রী শার্লট ১৮৫৬ সালে পা রাখলেন ভারতের মাটিতে। ভারতে জনপ্রিয় গভর্নর জেনারেল হয়ে উঠতে তাঁর বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু তার ঠিক পরের বছরেই শুরু হল সিপাহি বিদ্রোহ। তার আগেই অবশ্য শার্লটের অনুপ্রেরণায় চার্লস ক্যানিং শুরু করেছেন ভারতীয় অধিবাসীদের ওপর গবেষণামূলক কাজ। সিপাহি বিদ্রোহের সময় তাঁর প্রশংসনীয় ভূমিকা পরের বছরেই তাঁকে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম ভাইসরয় হিসাবে অধিষ্ঠিত করে।
ততদিনে চার্লস ক্যানিংয়ের মতোই শার্লটও পরিচিত হয়ে গেছেন লেডি ক্যানিং নামে। এখনকার সেলিব্রিটিদের মতোই তখনও লর্ড অ্যান্ড লেডি ক্যানিংয়ের বিবাহিত জীবন নিয়েও আলোচনা কম হত না। বিশেষ করে লেডি ক্যানিং হয়ে উঠলেন জনপ্রিয় এক চরিত্র। হাজার হোক, ভাইসরয়ের স্ত্রী বলে কথা। তারপর তিনি ছিলেন ভারতীয় সংস্কৃতির ওপর সহানুভূতিশীল। অসাধারণ রূপবতী এবং দক্ষ চিত্রশিল্পী। ফুল ও গাছের প্রতি ছিল ভালোবাসা। ব্যারাকপুরের বাড়িতে তাঁর নিজের হাতে লালিত বাগান ছিল দেখবার মতো। লর্ড ক্যানিং যদিও ভারতীয়দের কাছে কিছুটা নিন্দিত হয়েছিলেন, কিন্তু লেডি ক্যানিং হয়ে উঠেছিলেন খুব জনপ্রিয় এক চরিত্র।
ক্যানিংয়ের শাসনদক্ষতা ইংল্যান্ডেও সাড়া ফেলে দিল। ভালোই কাটছিল সব, কিন্তু সুখের দিন বেশি দিন টিকল না। ১৮৬১ সালে দার্জিলিং যেতে গিয়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে লেডি ক্যানিং মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সে মারা গেলেন। ব্যারাকপুরে তাঁকে সমাহিত করা হল। পরে সেই সমাধি সরিয়ে আনা হয় কলকাতার সেন্ট জন’স চার্চে। তারপর লর্ড ক্যানিংও ফিরে গেলেন স্বভূমিতে। লেডি ক্যানিংয়ের মৃত্যুর পর কলকাতায় বেশ কিছুদিন চর্চা হল তাঁর নামের। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে কলকাতার বিখ্যাত ময়রা ভীম চন্দ্র নাগ বানিয়ে ফেললেন এক নতুন মিষ্টি, নাম দিলেন ‘লেডি ক্যানিং’। ‘বাঙ্গালা’ যেমন ইংরেজদের মুখে মুখে বেঙ্গলি হয়ে গিয়েছিল, ঠিক তেমনিই নতুন মিষ্টি ‘লেডি ক্যানিং’ চলতি কথায় হয়ে উঠল ‘লেডিকেনি’। এইভাবে ভারতের প্রথম ভাইসরয়-পত্নীর নাম থেকে গেল বাংলার মিষ্টির মধ্যে। প্রায় সব সরকারি অনুষ্ঠানে একবাক্যে জায়গা পেতে লাগল লেডিকেনি। এমনকি সেকালের ভোজবাড়িতেও একসাথে উচ্চারিত ও পরিবেশিত হল ‘রসগোল্লা-লেডিকেনি’। কেউ কেউ বলেন লেডি ক্যানিংয়ের ভারতে আগমনের উদ্দেশে ভীম নাগ এই মিষ্টি বানিয়েছিলেন। কেউ বলেন লেডি ক্যানিংয়ের জন্মদিন উপলক্ষ্যে লর্ড চার্লস ক্যানিং-ই অর্ডার দিয়ে ভাজা রসের মিষ্টি বানিয়েছিলেন। তবে লেডি ক্যানিংয়ের নাম যে এই মিষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেকথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন।
লেডিকেনির মতো আর-একটা মিষ্টি বাংলায় অনেক আগে থেকেই জনপ্রিয় ছিল। পান্তুয়া। শুদ্ধ বাংলায় ‘পানিতোয়া’। প্রথমে এই পান্তুয়া ঘরে বানানো হত এবং উপকরণ ছিল রাঙালু। কিন্তু পান্তুয়ার সঙ্গে লেডিকেনির তফাত ছিল। দুটোই ছানা আর খোয়াক্ষীর মিশিয়ে তৈরি হয়। কিন্তু লেডিকেনিতে ছানার ভাগ থাকে বেশি, আর পান্তুয়াতে খোয়াক্ষীর বেশি।
কলকাতার বাইরে রানাঘাটের লেডিকেনি বিখ্যাত। কিন্তু এখন সেই আসল লেডিকেনি অনেক মিষ্টির দোকানেই আর পাওয়া যায় না। তার জায়গা নিয়েছে গোলাপজাম। আর আসা মাত্রই নিরীহ গোবেচারা গোলগাল লেডিকেনিকে একেবারে দেশছাড়া করে ছেড়েছে। তাই এখন রেস্টুরেন্টে, বাফেট মেনুতে কিংবা অভিজাত গেট-টুগেদারে গুলাবজামুনের রমরমা। আসল লেডিকেনি শুকনো মিষ্টি নয়, বরং রসগোল্লার মতোই রসে ডোবানো। তবে গুলাবজামুনের মতো ঘন হলদেটে রস নয়, বরং রসগোল্লার মতো পাতলা আর কম মিষ্টির রসে ডোবানো। লেডিকেনির ভেতরে একটা গহ্বর থাকে, যাতে থাকে কিছুটা রস আর একটা এলাচ। এই এলাচ হল লেডিকেনির আসল পরিচয়। তবে এখন উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার হাতে গোনা কয়েকটা দোকান ছাড়া আর কোথাওই আদি-অকৃত্রিম লেডিকেনি পাওয়া যায় না।
ক্রেপ সুজেত
ক্রেপ শুনলেই ব্যান্ডেজ মনে হয়। আসলে ফরাসি শব্দ ক্রেপ এসেছে ল্যাটিন ক্রিস্পাস থেকে, মানে কোঁচকানো, বা কুঁকড়ে যাওয়া। মধ্যযুগে ফ্রান্সের উত্তর পশ্চিমের ব্রিটানিতে বাজরার ময়দায় মিষ্টি আর সাইডার মাখিয়ে তৈরি হত এই সুখাদ্য। পিনাকী ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, “ফরাসি দেশের ক্রেপ প্রীতি এতটাই প্রবাদপ্রতিম যে ২ ফেব্রুয়ারির ছুটি ‘লা শান্দেলিয়ঁ’-র অপর নাম হল ‘জ্যর দ্য ক্রেপ’। সে দিন ওই দেশে সারা দিন ধরে প্রচুর পরিমাণে ক্রেপ খাওয়া হয়। ওই দেশের মানুষের এক সংস্কার হল ডান হাতের মুঠোয় একটা কয়েন রেখে বাঁ হাতে ক্রেপ রান্না করতে করতে ক্রেপটাকে শূন্যে ‘টস’ করা। যদি সেই ‘টস’ করা ক্রেপ আবার চাটুর ওপর এসে পড়ে, মনে করা হয় বাকি বছরটা পরিবারের কোনও অভাব থাকবে না।” সব ক্রেপের মধ্যে সেরা হল ক্রেপ সুজেত। কিন্তু এই ক্রেপের আবিষ্কার একেবারেই দুর্ঘটনা। ১৮৯৫ সালে প্রিন্স অফ ওয়েলস হাজির হয়েছেন মন্টি কার্লোর কাফে দে প্যারিসে। সঙ্গে তাঁর রক্ষিতা আর পারিষদবর্গ। সেদিন সেই ক্যাফেতে চৌদ্দ বছরের অঁরি সার্পেন্টেয়ার নামে এক ওয়েটারকে দায়িত্ব দেওয়া হল শেষপাতের মিষ্টিমুখের। এমন সময় হল এক কাণ্ড! কী কাণ্ড? ১৯৪০ সালে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনী ‘লাইফ আ লা অঁরি’-তেই দেখে নেওয়া যাক—
“আমি প্যানকেকের চাটুটার পাশেই ছিলাম, এমন সময় মুহূর্তের অন্যমনস্কতায় গোটা চাটুতে আগুন ধরে গেল। ভাবলাম গেল গোটা রান্নাটা! এদিকে রাজপুত্র আর তাঁর বন্ধুরা অস্থির হয়ে পড়েছেন। কী করি? আবার নতুন করে বানাব? একটু চেখে দেখলাম। দারুণ লাগল। মিষ্টির এমনতর স্বাদ আগে কোনোদিন পাইনি। বুঝলাম এই আচমকা জ্বলে গিয়েই মিশ্রণের উপাদানগুলো সবচেয়ে ভালোভাবে একত্র হয়ে এই স্বাদের জন্ম দিয়েছে। যা থাকে কপালে ভেবে রাজপুত্রের কাছে নিয়ে গেলাম। তিনি একটা কাঁটা দিয়ে কেকটা আর সিরাপটাকে ম্যানেজ করতে একখানা চামচ নিলেন। যখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন এই অদ্ভুত স্বাদের মিষ্টির নাম কী, বললাম ক্রেপ অউ প্রিন্স। রাজকুমার ছদ্মরাগ দেখিয়ে বললেন, সামনে এক মহিলা আছেন দেখতে পাচ্ছ না? মহিলাও উঠে দাঁড়িয়ে বাও করলেন। রাজকুমার তারপর আমায় খুব নরম ভাবে বললেন, ‘তুমি কি এই ক্রেপের নাম ক্রেপ অউ প্রিন্স থেকে বদলে ক্রেপ সুজেত রাখবে?’” পরদিন রাজকুমার তাঁকে একটা রত্নখচিত আংটি, পানামা হ্যাট আর লাঠি উপহার দিয়ে গেলেন। জন্ম নিল ক্রেপ সুজেত।
আইসক্রিম
কীভাবে জানি না, গত পাঁচ-সাত বছরে ভোজবাড়ির ডেজার্ট হিসেবে আইসক্রিম অপরিহার্য হয়ে গেছে। বাঙালি মিষ্টিতে আইসক্রিম সন্দেশ ঢুকে একে বাঙালি বানিয়ে দিয়েছে একেবারে। ঠিক কবে, কীভাবে এর শুরু হল জানা নেই। তবে ওই যে, গল্প প্রচলিত আছে। শোনা যায়, ৬২ খ্রিস্টাব্দে। রোমের রাজা নিরো রাজ্যের বাবুর্চির কাছে নতুন মুখরোচক কিছু খেতে চাইলেন। বাবুর্চি তখন রাজার এক কর্মচারীকে পাঠালেন অ্যাপেনাইন পাহাড় থেকে কিছু বরফ নিয়ে আসতে। বরফের সাথে বাদাম আর মধু মিশিয়ে রাজাকে পরিবেশন করলেন। রাজা কিছুটা ভয়ে ভয়ে মুখে দিলেন এক চামচ। মুখে দিতেই কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলেন। সাথিরা সকলেই ভয়ে ভয়ে রাজার পানে চেয়ে রইলেন। রাজা চোখ খুলেই এক পরম তৃপ্তির মুখ করে বললেন, ‘ওহে, কোথা পেলে এমন মজাদার জিনিস?’ ব্যস! সেই প্রথম আইসক্রিম বানানো হল। তবে অনেকে বলেন আইসক্রিমের ধারণা আরও প্রাচীন। খিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতাব্দীতে গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের বাজারে বরফকুচির সাথে মধু আর ফল মিশ্রিত একধরনের খাবার পাওয়া যেত। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক হিপোক্রেটিস আইসক্রিম খাওয়াকে বেশ উৎসাহিত করেছিলেন আর কারণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন, ‘আইসক্রিম জীবনে প্রাণের সঞ্চার করে আর বেঁচে থাকার উদ্দামতা জোগায়।’ আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ফুলের মধুতে বরফ দিয়ে খেতে ভালোবাসতেন। এদিকে বাইবেলের রেফারেন্সে রয়েছে, রাজা সোলেমান ফসল কাটার মৌসুমে বরফ পানীয় খেতে ভালোবাসতেন। ধারণা করা হয় আইসক্রিম রেসিপির সূত্র এগুলোই।
রোম থেকে এই ঠান্ডা রঙিন মিষ্টি বরফের জাদু সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। বরফকুচির সাথে ফলের রস, মধু বা সিরাপ দিয়ে তৈরি হতে লাগল ভিন্ন স্বাদের ‘অমৃত।’ যখন এই এলাহি জিনিস বাগদাদের খলিফাদের কাছে এসে পৌঁছোল তখন এই জাদুর রং বেড়ে গেল আরও কয়েকগুণ। বরফের সাথে তারা বাদামকুচি, পেস্তা, বিভিন্ন ধরনের ফলের ব্যবহার শুরু করল। খলিফরাই প্রথম আইসক্রিমে চিনি মেশানো শুরু করে। এখানকার আরব বণিকদের মাধ্যমেই আইসক্রিমের বাণিজ্যিকীকরণ শুরু হয়। চিনেও ব্যাপক প্রসার পায় এই আইসক্রিম। তারা এর মধ্যে ব্যাপকভাবে ফলের রস ব্যবহার শুরু করল। চিনের তাং শাসন আমলে (খ্রিস্টাব্দ ৬১৮-৯০৭) বরফের একরকম ডিশ রাজকন্যারা মজা করে খেতেন। তাং রাজার নাকি ৯৪ জন বরফ-বাহক কাজ করতেন। সেই ডিশ গরম দুধ, ময়দা এবং কর্পূর দিয়ে তৈরি হত। এরপর ওই মিক্সচার একটা ধাতব টিউবে ভরে মাটির নিচে রেখে দেওয়া হত। অনেক পরে ভারতে কুলফি এভাবে তৈরি হত।
তবে অনেক আবার বলেন, আরবের মুসলমানরাই সর্বপ্রথম আইসক্রিমের প্রধান উপাদান হিসেবে দুধকে ব্যবহার করেন। তাঁরা আইসক্রিমকে মিষ্টি করতে ফলের চেয়ে বেশি চিনি ব্যবহার করেন। ১০ম শতাব্দীর দিকে আরবের প্রধান শহরগুলোতে, যেমন বাগদাদ, দামেস্ক এবং কায়রোয় আইসক্রিম ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁরা বাণিজ্যিক আইসক্রিমগুলো তৈরি করতেন বরফ, ক্রিম, বাদাম, দুধ, গোলাপজল, শুকনো ফল ইত্যাদি দ্বারা। Maguelonne Toussaint তাঁর ‘A History of Food’ গ্রন্থে লিখেছেন, সম্ভবত চিনাদের শরবত ও আইসক্রিম তৈরির একটি যন্ত্র তৈরির কৃতিত্ব রয়েছে। তাঁরা ভরাট কন্টেনারে সিরাপের সাথে বরফ ও যব ক্ষারের মিশ্রণ ঢালত। যাতে নুনের মতোই জলের স্ফুটনাঙ্ক শূন্যের কোটায় নেমে যায়। ১২৬০ সালের দিকে ভারতের দিল্লিতে নাকি আইসক্রিমের প্রচলন শুরু হয়। তখন ভারতের মুঘল শাসকরা আইসক্রিম খেতেন এবং এটিকে পছন্দ করতেন। তাঁরা হিন্দুকুশ পর্বত থেকে ঘোড়ায় করে বরফ আনয়ন করতেন। সেই বরফ দিয়ে তাঁদের ও অতিথিদের জন্য বিশেষ শরবত তৈরি করা হত। ভারতীয় উপমহাদেশে দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে তা দিয়ে নানা মুখরোচক খাবার তৈরি করা হত এবং বর্তমানেও হয়। মোঘল আমলে পেস্তা বাদাম ও জাফরান মিশিয়ে কুলফির দারুণ চল ছিল। তখন কুলফি ধাতব কোনে ভরে প্যাকেটজাত করেও বিক্রি হত। কুলফি বানানোর প্রক্রিয়া ‘আইন-ই-আকবরী’তেও পাওয়া যায়। রাজকীয় রসুই ঘরের জনপ্রিয় খাবার হওয়ায় একে বইয়ে স্থান দেন। প্রচলিত অর্থে যাকে কুলফি বলা হয় তাকে দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে সুগন্ধীযুক্ত করা হয়। যে পাত্রে জ্বাল দেওয়া হয় তার নিচে যেন লেগে না যায়, সেজন্যে দুধ ক্রমাগত নাড়া হয়। যখন দুধ ঘন হয়ে পরিমাণে অনেক কমে আসে, তখন এতে এলাচ, জাফরান এবং পেস্তা বাদাম মিশিয়ে ঠান্ডা করতে দেওয়া হয়। সেই সময় মাটি-কাদার তৈরি পাত্রে রেখে এগুলো ঠান্ডা করা হত।
এদিকে মার্কো পোলো (যাঁর নাম এই বইতে বহুবার করা হয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে) দেশভ্রমণ করতে করতে এসে পৌঁছোলেন চিন দেশে। সেখানে মনভোলানো এই অমৃত খেয়ে মার্কো পোলোর চোখ ছানাবড়া। শিখে নিলেন রেসিপি। এরপর যখন আবার ইতালিতে ফিরে আসেন সাথে নিয়ে আসেন দিগ্বিজয়ী এই রেসিপি। নেপলসের স্পেনীয় ভাইসরয় আন্তোনিও লাতিনি (১৬৪২-১৬৯২) শরবতের একটি রেসিপি লিখে রেখেছিলেন। তিনি দুধ দিয়ে যে শরবত বানিয়েছিলেন, ইতিহাসে একেই প্রথম অফিশিয়াল আইসক্রিম বলে ধরে নেওয়া যায়। ইতালিয়ানরাই প্রথম আইসক্রিম তৈরিতে দুধের ব্যবহার করার কথা ভাবেন। ১৫৩৩ সালে ইতালির রাজকন্যা ক্যাথরিন ফ্রান্সের রাজা অঁরিকে বিয়ে করে যাচ্ছিলেন শ্বশুরবাড়ি। বায়না ধরলেন সাথে নিতে হবে তাঁর প্রিয় রাঁধুনি রগেরিকে, যার আয়ত্তে ছিল হরেক রকম আইসক্রিমের সিক্রেট রেসিপি। অবস্থা বেগতিক দেখে রাজা সম্মতি দিলেন রাঁধুনিকে সাথে করে নিয়ে যেতে। আর সেই থেকেই ফ্রান্সে আইসক্রিমের অনুপ্রবেশ। এই সেই ক্যাথরিন অফ মেদিচি, যিনি ফরাসি সসেরও জননী। ইংল্যান্ডেও আইসক্রিম নিয়ে মাতামাতি কম নয়। ১৭ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লসের টেবিলে রোজই দেখা যেত ক্রিম আইস নামক একটি খাবার। এই খাবার খেয়ে রাজা এতটাই আত্মহারা হয়েছিলেন যে তার প্রস্তুতকারক ডি মার্কোকে সারাজীবন হেসেখেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, বিনিময়ে রেসিপির ব্যাপারে কাউকে না জানাতে আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু মার্কো সেই কথা রাখেনি। পরবর্তীতে তাঁর এই রেসিপি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ভিক্টোরিয়ান যুগে আমেরিকা এবং নরওয়ে থেকে ইংল্যান্ডে আইসক্রিম আমদানি করা হতো। আমদানির ফলে এর দাম ছিল অনেক চড়া। তবে ১৬৬০ সালের আগে আইসক্রিম সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য ছিল না। এরপর প্যারিসের প্রথম ক্যাফে ‘ক্যাফে প্রকোপ’ দুধ, ক্রিম, মাখন ও ডিমের সংমিশ্রণে একটি রেসিপি উপস্থাপন করে। ১৮ শতকে এসে আমেরিকার হাত ধরে আইসক্রিমের ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। দুধ, ক্রিম, ভ্যানিলা, স্ট্রবেরি, র্যাস্পবেরি, চকোলেট, ম্যাংগো, এমন নতুন নতুন ফ্লেভার মিশিয়ে আধুনিক আইসক্রিম তৈরি করা শুরু হয়। আমেরিকায় আইসক্রিমের প্রথম সংস্করণ আসে ১৭৪৪ সালে। নিউইয়র্কে আইসক্রিমের প্রথম বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় ১৭৭৭ সালের ১২ মে। তখন কনফেকশনার ফিলিপ লানজি ঘোষণা দেন, এটি প্রায় সবদিন শহরে পাওয়া যাবে। নিউইয়র্কের চ্যাথাম স্ট্রিটের এক ব্যবসায়ী হিসাব করেছিলেন, প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন ১৭৯০ সালের গ্রীষ্মে আইসক্রিমের পেছনে প্রায় দুশো ডলার খরচ করেছেন। আঠারোশো শতক পর্যন্ত আইসক্রিম ছিল অভিজাত শ্রেণির প্রিয় ডেজার্ট। ওই শতকের আশেপাশে উৎপাদিত আইসক্রিম শিগগির একটি শিল্প হয়ে ওঠে। প্রযুক্তির উন্নয়নের পর অন্যান্য আমেরিকান ইন্ডাস্ট্রির মতো আইসক্রিম ইন্ডাস্ট্রিতেও উৎপাদন উর্ধ্বগতিতে চলতে থাকে।
আইসক্রিমের রেসিপি বই আকারে প্রথম বের হয় ১৭৬৮ সালে। নাম ‘The Art of Making Frozen Desserts’। ২৪০ পৃষ্ঠার বইটিতে শুধু আইসক্রিমের রেসিপিই ছিল না, এখানে প্রতিটা আইসক্রিমের ধর্মীয় ও দার্শনিক ব্যাখ্যাও ছিল। ১৭৭৪ সালে নিউইয়র্কের সংবাদপত্রে জনাব ফিলিপো লেঞ্জি জানাচ্ছেন যে তিনি সবেমাত্র লন্ডন থেকে পৌঁছেছেন এবং বিক্রি করবেন জ্যাম, জেলি, পেস্ট্রি আর আইসক্রিম। এটাই সম্ভবত ইতিহাসের প্রথম আইসক্রিমের বিজ্ঞাপন।
১৮৪৩ সালে ন্যান্সি এম. জনসন (১৭৯৫-১৮৯০) আবিষ্কার করেন হ্যান্ড-আইসক্রিম তৈরির যন্ত্র। ওই যন্ত্রের সাহায্যে ঘরে বসে সহজেই আইসক্রিম তৈরি করা যেত। ন্যান্সি ১৮৪৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর যন্ত্রটি পেটেন্ট করেন। ১৮৫০ সালে কার্লো গাতি (১৮১৭-১৮৭৮) পেনি আইস বিক্রি শুরু করেন। গাতি আইসক্রিমের গাড়িকে জনপ্রিয় করে তোলেন। মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে যায় আইসক্রিম। প্রথম বিপুল পরিমাণে আইসক্রিম তৈরি করেন ১৮৫১ সালে মেরিল্যান্ডের জ্যাকব ফুসেল নিজের কারখানায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে আইসক্রিমের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে চলে যায়। ১৯৪৫ সালে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের নাবিকদের জন্য প্রথম ভাসমান আইসক্রিম পার্লার তৈরি হয়। যুদ্ধ শেষে দুগ্ধজাত পণ্যের রেশন প্রত্যাহার করা হয় ও আমেরিকানরা আইসক্রিম দিয়ে বিজয় উদযাপন করে। আইসক্রিম এত জনপ্রিয় হয়ে পড়ল যে ১৯৮৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোলান্ড রেগন পুরো জুলাই মাসকেই ‘ন্যাশনাল আইসক্রিম মান্থ’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। পাশ্চাত্যের আইসক্রিম কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় মূলত ফ্লেভারের সংখ্যা নিয়ে। হাওয়ার্ড জনসন যদি তৈরি করে ২৮ রকম, তা হলে বাস্কিন রবিন্স তৈরি করবে ৩১ রকম। আর তাই খেয়াল করে দেখলে বাস্কিন রবিন্সের লোগোতে আজও BR-এর মধ্যে নীল রঙে লেখা ৩১ সংখ্যাটা চোখে পড়ে।
আইসক্রিমের নাম এলে সাথে যে নামটি মনের অজান্তেই চলে আসে সেটি হল ‘কোন।’ কোনের আবিষ্কারের পেছনেও আছে মজার ইতিহাস। ১৯০৪ সালে সেন্ট লুই-এর ওয়ার্ল্ড ফেয়ারে এক আইসক্রিমওয়ালা প্লেটে আইসক্রিম সার্ভ করে পেরে উঠছিলেন না। তখন তিনি ওয়াফল (এখন যাকে আমরা ওয়েফার বলি) বিক্রেতার কাছ থেকে ওয়াফলের কোনে আইসক্রিম ভর্তি করে আইসক্রিম বিলি করতে লাগলেন। আর এই যুগলবন্দি ক্রেতাদের মুখে এক অনবদ্য মুখরোচক খাবারের জন্ম দিল। আর সেই থেকেই রমরমিয়ে চলছে এই ‘কোন আইসক্রিম।’
আর দুই রকমের আইসক্রিম দিয়ে অধ্যায় শেষ করব। প্রথম গল্প ফিলাডেলফিয়ার সোডার দোকানি রবার্ট গ্রিনের। ১৮৭৪ সালের এক প্রখর গরমের দিনে তাঁর সোডার দোকানে বরফ শেষ হয়ে যায়। এদিকে গরম সোডা খাবে কে? উপায় না দেখে চটজলদি ভদ্রলোক সোডার সঙ্গে আইসক্রিম মিশিয়ে আইসক্রিম সোডা বেচা শুরু করলেন। দেখতে দেখতে এই আইসক্রিম সোডা আমেরিকার জাতীয় ডেসার্টে পরিণত হল। গ্রিন এই আবিষ্কার নিয়ে এতটাই গর্বিত ছিলেন যে তাঁর কথামতো তাঁর সমাধিতে ‘Originator of the Ice Cream Soda’ খোদাই করা আছে।
এদিকে ১৮৮১ সালে উইসকনসিনের এড বার্নার খেয়াল করলেন আইসক্রিম সোডায় যে তরল চকোলেট দেওয়া হয় তা আইসক্রিমের উপরে দিলেও দারুণ খেতে লাগে। তিনি ফ্লোরা ডোরা বা চকলেট পিনি নামে এই আইসক্রিম বিক্রি করতে লাগলেন। এই রেসিপি জেনে ম্যানিটকের গির্জার ধারে জর্জ জিফি তাঁর দোকানে চকোলেট দেওয়া আইসক্রিম বিক্রি শুরু করেন। কিন্তু তাঁর ভিড় হত মূলত রবিবার, যেদিন সবাই গির্জায় আসতেন। জিফি তাই রবিবার ছাড়া এই স্পেশাল আইসক্রিম বানাতেন না। একদিন হয়েছে কী, এক ছোট্ট মেয়ে এসে তাঁর থেকে চকোলেট দেওয়া আইসক্রিম চাইছে। তিনি অনেক বোঝালেন, ‘বাছা আজ তো রবিবার না, এই আইসক্রিম রবিবার ছাড়া পাওয়া যায় না।’ সে মেয়েও নাছোড়। বারবার বলতে লাগল, ‘আজকে আমার এই আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে, তাই আজকে নিশ্চয়ই রবিবার।’ বাধ্য হয়ে জিফি তাঁকে চকোলেট মাখানো ভ্যানিলা আইসক্রিম বানিয়ে দিলেন। কিন্তু মেয়েটার বলা ‘This must be Sunday’ কথাটা তাঁর মাথায় ঘুরতে লাগল। পরের রবিবার থেকেই তিনি এই আইসক্রিমের নাম দিলেন Sunday, যা ধীরে ধীরে লোকমুখে Sundae হয়ে গেল।