মিশরীয় জাহাজের রহস্য – অদ্রীশ বর্ধন

মিশরীয় জাহাজের রহস্য – অদ্রীশ বর্ধন

“চার হাজার ছ’শো বছর আগেকার জাহাজ? এখনও আছে?”

“আছে। আস্ত জাহাজটাকে পাওয়া গেছে পিরামিডের পাশের পাতালঘর থেকে।”

“সেই জাহাজের নকল তৈরি হচ্ছে প্লাস্টার অব প্যারিস দিয়ে?”

“হচ্ছে এই কলকাতাতেই। মানিকতলার একটা গলিতে।”

“তারপর?”

“চালান যাচ্ছে ইন্ডিয়ার বাইরে।”

“কিন্তু নকল জাহাজ নিয়ে আপনাদের মাথাব্যথা কেন?”

ঝুঁকে বসলেন রতন দত্ত। ফরসা। সুপুরুষ। মাথাজোড়া চকচকে টাক মুখের বুদ্ধির রোশনাইকে বাড়িয়ে দিয়েছে। চোখা নাক। সুন্দর চোখ। পাতলা ঠোঁট। গালে অল্প দাড়ি— জুলপিজোড়া লম্বা হয়ে গালের অর্ধেক ঢেকে রয়েছে। থুতনি কামানো। শক্ত চিবুক তাই চট করে চোখে পড়ে। ভদ্রলোকের সারা দেহে বুদ্ধি আর ব্যক্তিত্ব ঝলমল করছে।

উনি বললেন, “ইন্দ্রনাথবাবু, নকল জাহাজ আমাদের মাথাব্যথার কারণ নয়। ভাবিয়ে তুলেছে ক্লিয়ারিং এজেন্ট।”

নস্যি নিল ইন্দ্রনাথ। সাতসকালেই রতন দত্ত এসেছেন। তাই গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরেই তাঁর সমস্যা শুনতে হচ্ছে। বললে ডিবে বন্ধ করে, “খোলসা করুন।”

“কালেক্টর অব কাস্টমস পাঠিয়েছেন আমাকে। দিনা অ্যান্ড কম্পানির এক্সপোর্ট লাইসেন্স উনি সাসপেন্ড করেছেন।”

“কী অপরাধে?”

“দেড় কোটি টাকার নারকোটিক ড্রাগ্‌স রপ্তানিতে সাহায্য করেছিল বলে।”

“দেড় কোটি টাকার ড্রাগ্‌স!”

“সারা পৃথিবী লড়ছে ড্রাগ্‌স চোরাচালান বন্ধ করার জন্যে। দিনা অ্যান্ড কম্পানি এই কলকাতায় বসে সেই ক্রাইম করে চলেছে।”

“বেশ করেছেন লাইসেন্স সাসপেন্ড করে দিয়ে।”

“কিন্তু ওরা ট্রায়াল কোর্ট থেকে কালেক্টরের অর্ডার খারিজ করিয়েছে। আমরা গেছি হাইকোর্টে। ডিভিশন বেঞ্চে শুনানির দিন আগামী বেস্পতিবার।”

“আজ থেকে তিন দিন পরে? এর মধ্যে আমাকে কী করতে হবে?”

“দিনা অ্যান্ড কোম্পানির অপরাধ অকাট্যভাবে প্রমাণ করার মতো কিছু মালমশলা হাতে এনে দিন। আমরা যা পেয়েছি, তার ওপরেও আপনি দিন।”

“বুঝলাম। চেষ্টা করব। কিন্তু তার আগে বলুন, মিশরীয় জাহাজের গল্পটা আগে শোনালেন কেন?”

“দিনা অ্যান্ড কোম্পানিই যে নকল জাহাজ রপ্তানিতে সাহায্য করে চলেছে।”

“আ-চ্ছা!” উঠে পড়ল ইন্দ্রনাথ, “মানিকতলার কোথায় নকল জাহাজ তৈরি হচ্ছে বলুন তো?”

আধঘণ্টা পরে মানিকতলার মোড়ে ট্যাক্সি ছেড়ে দিল ইন্দ্রনাথ। এখন ওর পরনে মুগার পাঞ্জাবি আর চুনোট করা ধুতি। কোঁচা ঢুকনো পাশ পকেটে। গায়ে ল্যাভেন্ডারের খোশবাই।

এ-গলি সে-গলি ঘুরে একটা জরাজীর্ণ দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। রাস্তা এখানে সাতফুটের বেশি চওড়া নয়। গলিই বটে, তবে পিচবাঁধানো।

ইট বের করা দেওয়াল। ঘুণধরা কাঠের ফ্রেম। পাল্লা দু’খানা কোনওমতে লেগে রয়েছে। ঝুলছে বললেই চলে।

কড়া ধরে সজোরে নাড়া দিল ইন্দ্রনাথ। ঘড়ি দেখল। সকাল ন’টা। কড়া নাড়ল আবার।

সাড়া নেই। সাতফুট চওড়া রাস্তার এদিকের জানলায় উঁকি দিল একটা মুখ। ভাঙা দরজার উলটো দিকের জানলা। বছর আট-দশের একটি মেয়ে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে ইন্দ্রনাথের দিকে। অভাবী ঘরের মেয়ে। এ-পাড়ার সবাই গরিব। বাড়িগুলো পড়ো পড়ো।

মেয়েটি বললে, “কাকে ডাকছেন?”

ঘুরে দাঁড়াল ইন্দ্রনাথ, “ও তুমি! কী নাম তোমার?”

“দুষ্টু।”

“চমৎকার নাম। এ-বাড়িতে জাহাজ তৈরি হয়, তাই না?”

“জাহাজ?”

“সাদা রঙের জাহাজ। তুমি দ্যাখোনি?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, বিশুজ্যাঠা তৈরি করেন।”

“আমি এসেছি জাহাজ দেখতে।”

“কিন্তু বিশুজ্যাঠা তো এখন ঘুমোচ্ছেন।”

“এত বেলায়?”

“এখন ক’টা বাজে?”

“ন’টা।”

“তা হলে এই উঠলেন বলে। জোরে কড়া নাড়ুন।”

দুষ্টুর পেছনে এসে দাঁড়ালেন মাঝবয়সি এক ভদ্রলোক। খালি গা। পাঁজরা দেখা যাচ্ছে। পরনে লুঙ্গি। গাল ভরতি সাবানের ফেনা। এক হাতে খোলা ক্ষুর। ক্ষুর দিয়ে আজকাল বেশিরভাগ মানুষই দাড়ি কামায় না। চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ।

ভদ্রলোক বললেন, “বিশুদা সারারাত জাগেন। তাই বেলা করে ঘুমোন। ওই খুলেছে দরজা। বিশুদা, কুম্ভকর্ণের ঘুম বটে আপনার। কতক্ষণ ধরে কড়া নাড়ছেন ভদ্রলোক। যান, ভেতরে যান।”

ভাঙা দরজা পেরিয়েই একটা সরু গলি। তারপর একটা উঠোন। মাথার ওপর টিনের ছাউনি। রকমারি মূর্তি সাজানো চারপাশে। কোনওটা মাটির, কোনওটা পাথরের।

এইখানেই একটা বেঞ্চির ওপর বসল ইন্দ্রনাথ। বিশুবাবু বসলেন একই বেঞ্চিতে। ভদ্রলোক অসম্ভব রোগা। গায়ের রং কাজলের মতো কালো। একমুখ সাদা-কালো দাড়ি। চোখ দুটো বেশ লাল৷

খেঁকি গলায় বললেন, “কী দরকার?”

“জাহাজ দেখতে এসেছি।”

“জাহাজ?”

“চার হাজার ছ’শো বছরের পুরনো জাহাজ। এই পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো জাহাজ। মিশরের জাহাজ।”

“আপনাকে দেখাব কেন?”

“কিনতে চাই বলে।”

“কিনবেন? কত পিস?”

“একশো পিসের অর্ডার আছে এই মুহূর্তে। পরে আরও বাড়বে।”

“কোথায় পাঠাবেন?”

“ইন্ডিয়ার সব ক’টা টুরিস্ট সেন্টারে। কিউরিও সাপ্লাই আমার বিজনেস।”

“দেখে তো বিজনেসম্যান বলে মনে হচ্ছে না।”

“কী মনে হচ্ছে?”

“কবিতা-টবিতা লেখেন নাকি?”

“জীবনে না। কেন বলুন তো?”

“যা ড্রেস হাঁকিয়েছেন।”

“আর্টিস্টিক?”

“আজ্ঞে।”

“আর্টিস্টিক ড্রেস না হলে তো আর্টের জিনিস বেচা যায় না।”

“তা যা বলেছেন। ভগবান আমাকে মেরেছেন ও ব্যাপারে। আমাকে দেখলে কাক পর্যন্ত উড়ে যায়, মশাই।”

“খাঁটি আর্টিস্টদের ছাপ বাইরে থাকে না।”

“তবে কোথায় থাকে?”

“ভেতরে।”

লাল চোখ দুটো কুঁচকে চেয়ে রইলেন বিশুবাবু। ভদ্রলোক ভয়ানক কুৎসিত। গালের হাড় উঁচু। কণ্ঠার হাড় উঁচু। মুখখানা কঙ্কালের করোটি বললেই চলে।

“আপনি আমার ভেতর দেখতে পাচ্ছেন?”

“বিজনেসের চোখ দিয়ে দেখছি। খাঁটি আর্টিস্টরা সেলসম্যান হয় না। আপনিও নন। তাই পড়ে পড়ে মার খাচ্ছেন।”

“কে বললে আমি মার খাচ্ছি?”

“আপনার বাড়ি বলছে, আপনার চেহারা বলছে। সারারাত খেটেও আপনার রোজগার…”

“রোজগার করে কী করব? কে খাবে?”

“কেউ নেই আপনার?”

“না। বউ ছিল, মারা গেছে। আমি একা।”

“এই বাড়ি?”

“আমার।”

“তবে এত খাটছেন কেন?”

“সৃষ্টি ছড়িয়ে যাক, এই আমি চাই।”

“আপনার সেরা সৃষ্টি কি তা হলে মিশরীয় জাহাজ?”

“না। ওটা আমার খেয়াল। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনে ছবি দেখে বানিয়েছিলাম।”

“কিন্তু ভাল মার্কেট পেয়েছেন। আমি তো আপনার ঠিকানা পেলাম কায়রো থেকে।”

“কায়রো থেকে।” চমকে উঠলেন বিশুবাবু।

“নকল জাহাজ সেখানেও পৌঁছেছে। মিউজিয়ামের পাশেই বিক্রি হচ্ছে। আসল জাহাজের পাশে।”

“মানিকচাঁদের এলেম আছে বটে।”

“মানিকচাঁদ?”

“মানিকচাঁদ আগরওয়াল। ইমপোর্ট এক্সপোর্টের বিজনেস আছে। এক-একবারে পঞ্চাশ পিস ইজিপশিয়ান জাহাজ শুধু ও-ই নেয়।”

“ঠিকানাটা দেবেন তো। ব্যাবসার কথা বলব। জাহাজ তৈরি করেন কোথায়?”

“ভেতরের স্টুডিয়োতে। আসুন।”

উঠোন থেকে একটা সরু এঁদো গলি। তারপর আর- একটা উঠোন। এখানে চৌবাচ্চা। কল। শ্যাওলা-সবুজ মেঝে। সিঁড়ি উঠে গেছে কোমরসমান উঁচু দাওয়ায়। পরপর তিনটে ঘর। তিনটে ঘরেই মালপত্র ঠাসা। কারখানা ঘর। দাওয়াতেও ছড়ানো হাবিজাবি জিনিস।

মাঝখানের ঘরটায় শিকলি তোলা ছিল। খুললেন বিশুবাবু। পাল্লায় ঠেলা মারলেন।

বললেন, “দেখেছেন?”

অবাক হয়ে চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ। টানা লম্বা টেবিলের ওপর রয়েছে পাঁচখানা সাদা জাহাজ। একইরকম দেখতে। লম্বাটে গড়ন। দুটো সরু দিক একটু ওপরে তোলা এবং বাঁকানো। মাঝামাঝি জায়গায় কেবিনঘর। সামনের দিকে পাঁচজোড়া দাঁড়। পেছনে একজোড়া। কেবিনঘরের তলার দিকে ঝিকমিক করছে রংবেরঙের কাচ।

কানের কাছে মৃদুস্বরে বললেন বিশুবাবু, “আসল জাহাজটা লম্বায় ১৪২ ফুট, আমি বানিয়েছি তিন ফুটের মধ্যে। আসল জাহাজে আছে মোট ১২২৪টা অংশ। আমার জাহাজ দুটো ছাঁচ থেকে তৈরি।”

“রাজা খুফু-র জাহাজ,” যেন আপনমনে বললে ইন্দ্রনাথ।

“হ্যাঁ। এই সেই রাজা খুফুর জাহাজ। পবিত্র জাহাজ। এই জাহাজেই নাকি রাজার মমিদেহ আনা হয়েছিল নীল নদের ওপর দিয়ে। খরস্রোতের উপযোগী করেই এত সরু গড়ন রাখা হয়েছিল…”

“কাচগুলো?”

“আসল জাহাজে নেই। নকল জাহাজের দু’ পাশেই আছে। মানিকচাঁদের খেয়াল। ও এনে দেয়, আমি বসিয়ে দিই। এই তো বাক্সে রয়েছে বাড়তি কাচ।”

“ঠিকানাটা?”

“মানিকচাঁদের? তিন নম্বর রাসচন্দ্র বোস রোড, বড়বাজার।”

“আমি কিন্তু কাচ ছাড়াই চাইছি।”

“কাচ পছন্দ হচ্ছে না?”

“আপনার কি পছন্দ হচ্ছে?”

হাসলেন বিশুবাবু। কালো কুৎসিত মুখে ওঁর হাসিটা কিন্তু সুন্দর। শিল্পীর হাসি।

“না। মোটা রুচির ব্যাপার। কিন্তু খদ্দের যা চায়…”

“আমার কাছে কত নেবেন?”

“জাহাজ-পিছু দু’শো।”

“রাজি। অ্যাডভান্স দিয়ে যাব সন্ধ্যায়। বাড়ি থাকবেন তো?”

“কোথায় আর যাব?”

শ্যাওলা-সবুজ উঠোনে দাঁড়িয়ে হাঁক দিলেন বিশুবাবু, “কী হল?”

“রুমালটা …কোথায় যে পড়ল,” ঘরের ভেতর থেকে ভেসে এল ইন্দ্রনাথের গলা। পরক্ষণেই বেরিয়ে এল নিজেই। রুমাল পুরে রাখছে পকেটে, “নস্যি নেওয়ার অভ্যেস যাদের, রুমাল ছাড়া তাদের চলে না। আসি তা হলে।”

“আসুন।”

ইন্দ্রনাথ চৌকাঠ পেরিয়ে গলিতে নেমে মোড় ঘুরতেই দুষ্টুর বাবা সরে এলেন জানলার কাছ থেকে। সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন দোতলায়। ছাদের ঘর একটাই। চৌকির ওপর বসানো একটা সাদা টেলিফোন।

দরজা বন্ধ করে চৌকিতে বসলেন। রিসিভার তুললেন। ডায়াল করলেন।

“মানিকচাঁদবাবু?”

“বলছি।”

“বিশুকাকার বাড়িতে কাউকে পাঠিয়েছিলেন?”

“না। কেন?”

“একজন এসেছিল। এতক্ষণ ছিল। এক্ষুনি গেল।”

“কিছু নিয়ে গেছে?”

“না।”

“দেখতে কীরকম?”

“খুব সুন্দর। সিনেমার হিরোর মতো চেহারা। ধুতি আর পাঞ্জাবি, মানিয়েছে চমৎকার।”

“বিশু তাকে চেনে?”

“মনে হল না।”

“ঠিক আছে যাচ্ছি আমি।”

বিশুবাবু তখন এক মগ জল চৌবাচ্চা থেকে তুলে মুখ ধুচ্ছিলেন। মানিকচাঁদ এসে দাঁড়াল সামনে। রূপকথার রাজপুত্তুরদের মতো চেহারা। টকটকে গায়ের রং। গোলগাল মুখ। হাতের আঙুলে হিরে, পাঞ্জাবির বোতামেও হিরে। হিরে যেন তার চোখ দুটোতেও।

চোখের সেই জোড়া হিরেতে ঝিলিক তুলে বলল মানিকচাঁদ, “কে এসেছিল, বিশুবাবু?”

ভেজা মুখেই বলে ওঠেন বিশুবাবু, “আপনি জানলেন কী করে? এখনও তো আধঘণ্টা হয়নি…”

“কে এসেছিল?”

“নামটাই জিজ্ঞেস করা হয়নি।”

“কেন এসেছিল?”

“নকল জাহাজ কিনবে বলে।”

“আপনি বেচবেন?”

“বেচব না?”

“না,” শক্ত স্বর মানিকচাঁদের।

কাঁধের গামছা টেনে নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন বিশুবাবু, “আপনার হুকুমে?”

“হ্যাঁ।”

বিশুবাবুর লাল চোখ একটু গরম হল বটে। আরও একটু কুৎসিত হল হাড়সর্বস্ব মুখখানা। তারপরেই শিল্পীর হাসি হাসলেন। বললেন, “জিনিসটা আমার। যাকে খুশি বেচব।”

“তা হলে আমার সঙ্গে কারবার চলবে না।”

“নিয়ে যান আপনার জিনিস।”

মিনিট পাঁচেক লাগল প্যাক করতে। করোগেটেড বোর্ডের কার্টন বাক্স ‘ওমনি’ মারুতিতে করেই এনেছিল মানিকচাঁদ। প্রত্যেকটার মধ্যে ভরা ছিল খড়কুটো আর কাটা কাগজ। পাঁচটা জাহাজ ঢুকে গেল তাদের মধ্যে। ছোট্ট বাক্স-ভরতি বাড়তি কাচগুলো নিয়ে গটমট করে ভাঙাবাড়ি থেকে বেরিয়ে উঠে পড়ল গাড়িতে।

গলি পেরিয়ে এসে বড় রাস্তায় পড়তেই লাল মোটর সাইকেল এসে দাঁড়াল সামনে। নেমে এল ট্রাফিক সার্জেন্ট। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আপনার লাইসেন্স?”

ভুরু কুঁচকে গেল মানিকচাঁদের। “চোদ্দো বছর গাড়ি চালাচ্ছি, লাইসেন্স সঙ্গে রাখিনি কখনও।”

“তা হলে চলুন থানায়।”

“থানায়?”

সার্জেন্ট-ছোকরা বড় কড়া। কোনও আপত্তি টিকল না। সাদা ওমনিকে নিয়ে গেল মানিকতলা থানায়। মানিকচাঁদের মুখ তখন শুকনো৷ তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে বসানো হল একটা ঘরে। হাতে তার বাড়তি কাচভরতি ছোট্ট বাক্স। এ-ঘরে আর কেউ নেই।

দরজা খুলল আধঘণ্টা পর। ঘরে ঢুকলেন প্রথমে বিশুবাবু, তাঁর পেছনে ইন্দ্রনাথ রুদ্র, রতন দত্ত, আর-একজন ভদ্রলোক। এঁর চেহারা বেশ শৌখিন। চোখে সোনার চশমা। খুব দামি ওস্তাগর বানিয়ে দিয়েছেন ঝকমকে সুট।

সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল মানিকচাঁদ, “বিশুবাবু, এসব কী ব্যাপার?”

বিশুবাবু এখন একটা রঙিন খদ্দরের পাঞ্জাবি পরে এসেছেন। ফলে তাঁর কালো রং আরও খোলতাই হয়েছে। আমতা আমতা করে উনি বললেন, “কী যে ব্যাপার…”

“আমি বলছি কী ব্যাপার,” এগিয়ে এল ইন্দ্রনাথ, “বিশুবাবু আপনার ঘর থেকে বেরনোর সময়ে হাত সাফাই করেছিলাম। রুমাল খুঁজবার অছিলায় ছোট বাক্সের বাড়তি কাচগুলোর একটা পকেটে করে এনেছিলাম। কাচটা দেখেছেন ইনি। ইনি বিখ্যাত জহুরি রামেশ্বর প্রসাদ। কাচখানা উনি আটচল্লিশ লক্ষ টাকায় কিনতে চেয়েছেন।”

ঘরের মধ্যে যেন বাজ পড়ল। প্রতিটি মানুষ থ হয়ে দেখছে ইন্দ্রনাথকে।

রামেশ্বর প্রসাদ কেশে গলা সাফ করে নিয়ে বললেন, “আটচল্লিশ লাখে কিনে বেচব সাত কোটি টাকায়।”

এবার বুঝি অ্যাটম বোমা পড়ল ঘরে। একখানা কাচের দাম সাত কোটি টাকা!

ইন্দ্রনাথ বললে, “কারণ এটা কাচ নয়, ব্লু ডায়মন্ড। ওড়িশার কালাহান্ডি, ফুলবনি আর বোলাঙ্গির জেলা থেকে বেআইনিভাবে খনি থেকে তোলা হিরে। এরকম আরও দামি পাথর ওখান থেকে বেরিয়ে গেছে নানাদিকে। মোট দাম চারশো কোটি টাকা। বিশুবাবু এইগুলিকেই কাচ মনে করে নকল জাহাজের গায়ে ফিট করে দিতেন। কাচ মনে করেই সবাই ছেড়ে দিয়েছে। কোটি কোটি টাকার পাথর এভাবে খোলাখুলি পাচার হতে পারে, কেউ ভাবতেও পারেনি।”

ঢোক গিলে বিশুবাবু বললেন, “তা হলে বাক্সভরতি হিরে-মানিক ছিল?”

“এখনও আছে। মানিকচাঁদবাবু, অত আঁকড়ে ধরবেন না, এটা থানা। দিন, এই খুললাম ডালা। জহুরিমশায় কী বলেন?”

একটার পর একটা পাথর তুলে চুলচেরা চোখে দেখলেন রামেশ্বর প্রসাদ, “সবই দামি পাথর। কোটি কোটি টাকা দাম।”

রতন দত্ত আরক্ত মুখে বললেন, “এ যে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ। ড্রাগস-এর মামলায় ব্লু ডায়মন্ড।”

“ড্রাগসও আছে,” বলল ইন্দ্রনাথ।

“কোথায়?”

“মৃগাঙ্ক।”

দরজার বাইরে একটা তিন ফুট লম্বা নকল জাহাজ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। ইন্দ্রনাথের তলব শুনে ঢুকলাম ঘরে এবং ওর শেখানো কাজটা করে ফেললাম চক্ষের নিমেষে।

সুন্দর সাদা জাহাজটাকে মাথার ওপর দু’ হাতে তুলে আছড়ে ফেললাম মেঝেতে।

লাফিয়ে উঠেছিলেন বিশুবাবু। কিন্তু হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিল ইন্দ্রনাথ। মিশরীয় জাহাজের ধ্বংসস্তুপের মধ্যে থেকে গোটা দুই টুকরো হাতে নিয়ে উঠে দাড়াল, “আসুন রতনবাবু, দেখতেই পাচ্ছেন প্রত্যেকটা টুকরোর মধ্যে সুড়ঙ্গ রয়েছে।”

“রয়েছে।” গলা বসে গেছে রতন দত্তর।

“অর্থাৎ। তিন ফুট লম্বা জাহাজের এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত একটা সুড়ঙ্গ রয়েছে, যার ব্যাস দেড় ইঞ্চি।”

“হ্যাঁ”

“সুড়ঙ্গের মধ্যে সাদা গুঁড়ো ছিল, এখন মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে। এই টুকরো দুটোর গর্তে এখনও রয়েছে, একটু জিভে চেখে দেখবেন?”

আঁতকে উঠলেন রতন দত্ত, “পাগল!”

“পাগল নয়, পাগল নয়। বদমাশ!” আচমকা চিৎকারে চমকে ওঠে ঘরের সবাই। চোখ ঠেলে বেরিয়ে এসেছে বিশুবাবুর। ফুলে উঠেছে রগের শিরা। ভয়ানক ক্রোধে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে কুৎসিত মুখখানা, “ফোর টোয়েন্টি! সমস্ত ফোর টোয়েন্টি!”

“চেঁচাচ্ছেন কেন বিশুবাবু?” নিরীহ গলায় বলল ইন্দ্রনাথ। বিষম কৌতুকে নৃত্য করছে তার দুই চোখ।

“তবে কি গান গাইব? চারশো বিশের ম্যাজিক দেখাচ্ছেন?”

“চারশো বিশের ম্যাজিক! সেটা আবার কী?”

“দু’খানা ছাঁচ থেকে তৈরি জাহাজের ভেতর তো ফোঁপরা হবেই। তার মধ্যে সাদা গুঁড়ো এল কী করে?”

“আপনি ভরেননি?”

“আ-আমি ভরব ড্রাগ্‌স? জেনেশুনে?” রাগের চোটে কথা আটকে গেল বিশুবাবুর।

“সত্যিই তো, আপনি ভরতে যাবেন কেন! আপনি হলেন শিল্পী, খাঁটি শিল্পী। ও কাজটা করেছে আপনার মানিকচাঁদ।”

এই প্রথম তেড়ে উঠল মানিকচাঁদ, এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল কাঠের পুতুলের মতো, “দেখেছেন আপনি?”

নিমেষে পালটে গেল ইন্দ্রনাথের চোখ-মুখের চেহারা। উধাও হল হাসি আর কৌতুক। যেন মশাল লকলকিয়ে উঠল দুই চোখের তারায়।

কড়-কড়-কড়াত করে বুঝি বাজ ফেটে পড়ল গলার আওয়াজে, “পিশাচ! জানোয়ার! অমানুষ! এখনও লম্বা লম্বা কথা। টেনে জিভ ছিঁড়ে ফেলব আর একটি বাজে কথা বললে।”

এ যে মূর্তিমান প্রলয়! ইন্দ্রনাথের এই ভয়াল মূর্তি ঘরের আর কেউ তো কখনও দেখেনি। তাই চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে তার রুদ্র রূপের দিকে। মুখের ওপর সপাং করে চাবুক আছড়ে পড়লে মানুষ যেমন সিঁটিয়ে যায়, মানিকচাঁদের অবস্থা এখন সেইরকম।

কড়-কড়-কড়াত গলায় বললে ইন্দ্রনাথ, “বিস্ট! লক্ষ লক্ষ স্কুলের ছেলেমেয়েদের ড্রাগসের নেশায় ধ্বংস করছ তুমি, মানিকচাঁদ, তোমার ফাঁসি হওয়া উচিত। বিশুবাবু, মানিকচাঁদের যে ঠিকানা আমাকে দিয়েছেন, সে-নামে কোনও রাস্তা কলকাতায় নেই।”

“সে কী!” বিশুবাবু নিজেই মিইয়ে গেছেন ইন্দ্রনাথের রুদ্ররোষে।

“আপনি শিল্পী, এত খোঁজ নেওয়ার দরকারও হয়নি। কিন্তু আমি দেখেছি, স্ট্রিট ডিরেক্টরিতে ও রাস্তা নেই। আসল ঠিকানা আছে গাড়ির ব্লু-বুকে, যা থাকে গাড়ির মধ্যেই। তাই ট্রাফিক সার্জেন্টকে দিয়ে গাড়ি আনা হয়েছে থানায়। ব্লু-বুক-এর ঠিকানায় হানা দিয়ে কী পেয়েছি জানেন? কী হে মানিকচাঁদ? কী ছিল তোমার আন্ডারগ্রাউন্ড চেম্বারে?”

মানিকচাঁদ কি জ্যান্ত মড়া হয়ে গেল?

দুই চোখে অসীম ঘৃণা ছিটিয়ে বললে ইন্দ্রনাথ, “প্যাকেট প্যাকেট নারকোটিক ড্রাগ্‌স। এখান থেকে সাদা জাহাজ সেখানে পৌঁছলে ছুরি দিয়ে ঘষে খুলে আনা হয় একটা পাথর। সেই ফুটো দিয়ে ভেতরে ড্রাগস পুরে ফের পাথর বসিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কাজটা হচ্ছে কীভাবে, তা দেখে এসেছি। নিজের চোখে। মানিকচাঁদ, আর কিছু বলার আছে?”

কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের শুনানি বেরিয়ে গেল বেস্পতিবার। ছেচল্লিশশো বছরের পুরনো মিশরীয় জাহাজের নকল বানিয়ে, তার ভেতরে চোরা সুড়ঙ্গে পাচার হত নারকোটিক ড্রাগ্‌স, চোরাই পাথর লাগানো থাকত গায়ে, কাচ মনে করে কেউ খুলেও দেখেনি, খুললেই সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে ঝরে পড়ত কেজি কেজি ড্রাগ্‌স! দিনা অ্যান্ড কম্পানির লাইসেন্স সাসপেন্ড করেছেন বিচারপতিরা। ফেঁসে গেছে মানিকচাঁদ এবং আরও অনেকেই।

ইন্দ্রনাথের তুঙ্গে এখন বেম্পতি। যেখানে গোলমালের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, ডাক পড়ছে সেইখানেই।

২৮ জুন ১৯৮৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *