মিলন-ময়দানের সন্ধানে
আদিম অসহায় ও অকুশল মানুষের শিকারে ও শস্য উৎপাদনে যৌথ প্রয়াসের প্রয়োজন ছিল। জ্ঞাতিত্বের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল এই যৌথ জীবন। ঐক্য ও সম্প্রীতি রক্ষার জন্যে রক্ত সম্পর্কে আরোপিত হয় অশেষ নৈতিক, আত্মিক ও সামাজিক গুরুত্ব। তাই জ্ঞাতিত্ববোধই মানুষের প্রথম পবিত্র দায়িত্ব বলে স্বীকৃতি লাভ করে আদিম সমাজে। জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যের অবচেতন গরজে গড়ে উঠা এই বোধ ক্রমে আজন্ম লালিত সংস্কারে ও বিশ্বাসে পরিণতি পায়। এভাবে গভীর প্রত্যয়ে শুরু হয় গোত্রীয় জীবন।
মানব সমাজের শৈশবে-বাল্যে এ গোত্ৰ-চেতনা ও গোত্রীয় জীবন অশেষ কল্যাণ এনেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। কেননা সেদিন যৌথ প্রয়াস ছাড়া মানুষের আত্মরক্ষা ও আত্মপোষণ সম্ভব হত না। তারপর অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও বুদ্ধির ক্রমবিকাশে মানুষ ধর্ম তথা অভিন্ন আচার ও মতাদর্শের ভিত্তিতে রচনা করেছে বৃহত্তর সমাজ। গোত্রীয় চেতনাকে অতিক্রম করে জীবনের সংকীর্ণ পরিসরকে তারা সম্ভাবনার বিস্তৃত প্রান্তরে উন্নীত করল বটে, কিন্তু চেতনার গতি ও প্রকৃতি রইল। অপরিবর্তিত। ফলে স্বাধর্ম ও নবপ্রত্যয়ের প্রাচীর দিয়ে মানুষে মানুষে ব্যবধান বাড়িয়ে দিল। আগে। যেমন স্বগোত্রীয় না হলেই শত্রু মনে করা হত, এক্ষেত্রেও স্বমতের না হলেই পর মনে করা স্বাভাবিক হয়ে রইল।
আদিতে মানুষের যৌথ প্রয়াস প্রয়োজনীয় ছিল প্রকৃতি ও পরিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্যে। বিভিন্ন আঞ্চলিক গোত্রে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এখন যৌথ জীবনের প্রয়োজন হল প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্রের কবল থেকে খাদ্য ও খাক তথা জমি ও জীবন, জল ও জন্তু, প্রাণ ও মাল রক্ষার গরজে।
এই আত্মধ্বংসী গোত্রীয় বিবাদ নিরসনের জন্যেই মতবাদ ও আদর্শভিত্তিক জীবন-ভাবনায় প্রবর্তনা পায় মানুষ। তার থেকেই আসে ধর্ম নামের জীবন-নীতি। এতে পরিবর্তন মাত্র এটুকু হল। যে ক্ষুদ্র গোত্রীয় দ্বন্দ্ব এখন গোত্র সমষ্টির সমবায়ে গঠিত বৃহৎ সাম্প্রদায়িক হানাহানির রূপ নিল। অতএব চারিদ্র্যে ও আদর্শে কোনো রূপান্তর কিংবা উন্নয়ন ঘটেনি।
অভিজ্ঞতা, প্রকৌশল, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বুদ্ধি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে নব উদ্ভূত মানবিক সমস্যার সমাধানের জন্যে যে আনুপাতিক চিন্তা-ভাবনা, পরিহার-সামর্থ্য, গ্রহণশীলতা ও সৃজনপ্রবণতা থাকা আবশ্যিক ছিল; অদূরদর্শী মানুষে তা কখনো সুলভ ছিল না। জ্ঞানী-মনীষীরা স্বকালের সমস্যার আপাত সমাধান পেয়েই চিরকালের মানুষের জন্যে প্রশস্ত জীবন-পথ রচনার গৌরব-গর্ব ও সাফল্য-সুখ অর্জন করতে চেয়েছেন। তারা নিজেদের মতাদর্শকে চরম ও পরম বলে জেনেছেন এবং জনগণকেও সে-ধারণা দিয়ে বিভ্রান্ত ও বিমূঢ় করে রেখেছেন। এভাবে তাঁদের। অজ্ঞাতেই তারা মানুষের মন করেছেন আনুগত্যের দীক্ষায় নিষ্ক্রিয় এবং মননক্ষেত্র করেছেন অসীম ভরসা দানে বন্ধ্যা।– বৈষয়িক ও জাগতিক আর সব ব্যাপারে মানুষ জানে অতীতের চেয়ে বর্তমান অনেক উন্নত। হোমারের চাইতে শেক্সপীয়ার, ভিঞ্চির চাইতে পিকাসো, সেন্ট অগাস্টাইনের চাইতে টয়নবী, জুলিয়াস সিজারের চাইতে জর্জ ওয়াশিংটন, ইডিপাস থেকে ফাউস্ট যে অনেক অগ্রসর তা কেউ অস্বীকার করে না। কিন্তু আদ্যিকালের শাস্ত্রের চাইতে উন্নত নিয়ম-নীতি কোথাও কখনো আর কিছু যে হতে পারে, তারা বরং প্রাণ দেবে, তবু তা স্বীকার করবে না। এখানে তারা প্রত্যয়-সর্বস্ব, অন্ধ ও গোঁড়া। বৈষয়িক ব্যাপারে তারা শ্রেয়সকে সহজেই গ্রহণ করে, নতুন স্বাচ্ছন্দ্যকে বরণ করবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠে; কিন্তু মতের ক্ষেত্রে, মননের জগতে, পুরোনোই তাদের প্রিয়, প্রাচীনত্বেই তারা পরিতৃপ্ত, বিশ্বাসেই তাদের ভরসা।
ফলে মানুষের বৈষয়িক ও প্রকৌশলিক অগ্রগতির সঙ্গে তাদের মন-মানসের আনুপাতিক সমতা রক্ষিত হয়নি। এ অসামঞ্জস্যজাত অসঙ্গতিই হচ্ছে আজকের দিনের মানবিক সমস্যার উৎস। তাদের জৈব জীবন এগিয়ে চলেছে, মনোজীবন রয়েছে অবিচল। জাগতিক জীবনে তারা বরণ করেছে চলমানতাকেই, মানস-জীবনে কামনা করছে স্থিতিশীলতাকে।
ইতিমধ্যে মানুষে মানুষে পৃথিবী ভরে উঠেছে। ভূ-তে বসতি-বিরল ভুবন নেই আর। বৈজ্ঞানিক আবিক্রিয়ায় ও প্রাত্যহিক প্রয়োজন বৃদ্ধির ফলে খণ্ড জগৎ অখণ্ড অঞ্চলে হয়েছে পরিণত। ঘেঁষাঘেঁষির জীবনে রেষারেষি হয়েছে প্রবল। প্রভাবের ও প্রতাপের টানাপড়েন অপরিসর জীবনকে প্রতিমুহূর্তে করছে প্রকম্পিত ও আন্দোলিত। অথচ গোত্রজ সংহতি ও ধর্মজ ঐক্য-ভিত্তিক সমাজ চেতনা আজো জগদ্দল হয়ে চেপে রয়েছে মানুষের বুকে। এ চেতনা নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের মন ও মেজাজ। আজকের দিনে যখন অব্যাহত গোত্রীয় স্বাতন্ত্র কিংবা একক ধর্মীয়-সমাজ অসম্ভব, তখন পরকে আপন করে নেয়ার মানস-প্রস্তুতি না থাকলে নির্ঘ নির্বিঘ্ন জীবন কিংবা সমাজ অথবা রাষ্ট্র থাকবে কল্পনাতীত। স্বগোত্রের, স্বধর্মের, স্বমতের ও স্বদেশের নয় বলেই মানুষকে যদি পর ভাবি, শত্রু মনে করি কিংবা অনাত্মীয় করে রাখি; তাহলে আজকের দুনিয়ার মিশ্র সমাজে, এজমালি জমিতে ও বারোয়ারী রাষ্ট্রে কেউ সুখে-শান্তিতে বাস করতে পারবে না। পারছে না যে তা কে অস্বীকার করবে? আফ্রিকার গোত্রীয় কোন্দল, য়ুরোপের জাতি-বৈর, আমেকিার বর্ণবিদ্বেষ, ভারতের সাম্প্রদায়িক চেতনা, পৃথিবীব্যাপী পরমত অসহিষ্ণুতা, ধর্মদ্বেষণা ও বিদেশী-বিদ্বেষ আজ মর্তমানবের যন্ত্রণার গোড়ার কথা। এই মৌল সমস্যার সমাধান না হলে স্বস্তি-শান্তির কোনো আপাত প্রলেপে মানব মনের এ দুষ্ট ক্ষতের নিরাময় নেই। এই দেশ-জাত-বর্ণ- ধর্ম চেতনা থেকে মুক্তি-সমাধানের প্রথম ও প্রধান শর্ত। কিন্তু এ মুক্তি সহজসাধ্য নয়। দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টায় অবশ্য সাফল্য সম্ভব। এজন্যে উদার রাষ্ট্রাদর্শ প্রয়োজন।
ধর্ম মানুষ ছাড়বে না। তবু ধর্মবোধের পরিবর্তন সাধন সম্ভব এবং এই লক্ষ্যেই চিন্তাবিদের ও রাষ্ট্রনায়কের প্রয়াস নিয়োজিত হওয়া আবশ্যিক। জনগণকে বলতে হবে–ধর্ম হবে আত্মিক, তা থাকবে ব্যক্তির বুকে এবং মন্দিরে-মসজিদে-চৈত্য-গীর্জায় ও সিনাগোগে। বাইরে বৈষয়িক, ব্যবসায়িক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক জীবনে তার উপযোগ কিংবা প্রয়োজন নেই। বলতে হবে-বর্ণ বা অবয়ব হচ্ছে আবহাওয়ার দান, প্রাকৃতিক প্রভাবের প্রসূন। তার জন্যে মানুষে মানুষে প্রভেদ থাকতে পারে না। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও হীনতা বিচারের ভিত্তি হবে শিক্ষা-জ্ঞান-প্রজ্ঞা-মনীষা ও চরিত্র। চণ্ডালও হবে দ্বিজশ্রেষ্ঠ যদি থাকে গুণ, জ্ঞান ও চরিত্র। দেশ ভেদে মানুষ শত্রু কিংবা মিত্র হতে পারে না। রুচি ও মনের মিলেই মানুষ হয় আত্মীয়। মানুষে মানুষে প্রীতিই একমাত্র মিলনসূত্র। মনে মনে গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গেলে বাইরের কোনো বাধাই টিকতে পারে না। স্বামী ও স্ত্রীর মতো আপন কে? দাম্পত্যে কী আমরা ঘরে ঘরে পরকে চিরকাল আপন করে নিচ্ছিনে? দেশ-ধর্ম-জাত বর্ণের বাধাকে অতিক্রম করে কত কত দাম্পত্য গড়ে উঠেছে। এর পরেও কী বলব, অভিন্ন গোত্র বর্ণ-দেশ-ধর্ম না হলে মানুষে মানুষে মিলন সম্ভব নয়? অভিন্ন স্বার্থে সহযোগিতা ও সহাবস্থান যে সম্ভব, তার বহু বহু প্রমাণ কী আমরা অহরহ চারদিকার পৃথিবীতে প্রত্যক্ষ করছিনে? গোত্র-প্রীতি আর ভূগোল-চেতনাও আসলে একটা সংস্কার। এ সংস্কার দুমুচ্য-দুরপনেয় হলেও, অনপনেয় নয়। আজকের দিনে আফ্রিকাবাসী ছাড়া পৃথিবীর আর কয়জন মানুষই বা স্বগোত্রের খবর জানে? আর কয়জন মানুষই বা স্বদেশের আদি বাসিন্দার বংশধর? যুগে যুগে কত মানুষের ধারা এসে মিশেছে এক এক দেশে। সে-সব মানুষের বংশধরেরা আজ অভিন্ন ধর্মে, ভাষায় ও বর্ণে গড়ে উঠেছে একক জাতিরূপে–হয়েছে অভিন্ন সত্তায় ও আত্মায় বিশ্বাসী। পূর্বপুরুষের মিশ্র ধারার খবরও জানা নেই–অনুভূতি তো দূরের কথা। কাজেই দীর্ঘ সহবাসের ফলে কালে মানুষ একক সমাজের অঙ্গীভূত হয়ে অভিন্ন সমাজসত্তায় স্বাতন্ত্র্য হারায়। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, যাযাবর জীবনেই ছিল মানুষ অভ্যস্ত। মানুষ স্থিতিকামী হয়েছে খোরপোষের দায়ে ঠেকেই। আজো কী আমাদের অন্তরের গভীরে, সে-যাযাবর তৃষ্ণা জেগে নেই?
আসলে দেশ বলে কোনো মাটির মমতা মানুষের নেই, যা আছে তা পরিচিত মনুষ্য পরিবেশের মোহ। অপরিচয়ের অস্বস্তি, আর পরিচিত পরিবেশের প্রশান্তিই রয়েছে দেশ-বিদেশ চেতনার মূলে। এটাকে ভুল করে আমরা মাটির মমতা বলি। স্বগ্রাম-স্বদেশ আসলে মাটি নয়– মানুষ, যে-মানুষ আজন্ম পরিচিত। এজন্যেই প্রবাসে বন্ধু ও পরিচিতের সংখ্যা বেড়ে গেলে মানুষ সেখানেই স্থায়ীভাব বাস করতে চায়। স্বদেশে শহরে বাসের আগ্রহ ও বিদেশকে ভালবাসার প্রেরণা জাগে প্রীতির প্রসারে ও প্রাবল্যে। অতএব, যে-সব সংস্কার বশে আমরা মানুষের প্রতি বিমুখ ও বিরূপ হয়ে থাকি-তার সব কয়টাই কৃত্রিম। পরিহার করা দুঃসাধ্য নয় মোটেই।
স্বার্থ-বুদ্ধির প্ররোচনাতেই আমরা তিলকে তাল করে তুলি, তুচ্ছকে করি উচ্চ, মোহকে ভাবি মমতা, স্বপ্নকে মানি সত্য বলে।
রাষ্ট্রিক জাতিচেতনা যে নিতান্ত কৃত্রিম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা রাষ্ট্র ভাঙা-গড়ার সঙ্গে তার জন্ম-মৃত্যু ঘটে। অতএব মানুষে মানুষে মিলনে বাধা কোথায়? আজকের দিনে সরকারি উৎসাহ ও সামাজিক উদারতা থাকলেই দেশে দেশে এ সমস্যার সমাধান কঠিন নয়।
যদি পোশাকে ও নামে দৈশিক ও ধার্মিক ছাপ না থাকে, তাতেও মিলন-ময়দান প্রশস্ত হবে। কুলবাচি পরিহার করলেও অনেকটা ঘুচবে অবাঞ্ছিত ব্যবধান। সবচেয়ে বেশি কার্যকর হবে নির্বিচার বৈবাহিক সম্পর্ক। দেশ-জাত ও বর্ণ-ধর্মের কৃত্রিম বাধা অস্বীকার করে স্ত্রী বা স্বামী গ্রহণের নির্বিঘ্ন রেওয়াজ চালু হলে অখণ্ড পৃথিবীতে একক জাতি ও অভিন্ন সমাজ গড়ে উঠবে। কেননা বিবাহের মাধ্যমেই গড়ে উঠে আত্মীয় সমাজ, আর আত্মীয়তা বোধেই মানুষের কোমলতম ও শ্রেষ্ঠতম বৃদ্ধির বিকাশ সম্ভব হয়। …
যে-সব রাষ্ট্রে গোত্রের, বিভিন্ন ধর্মের, একাধিক ভাষার, নানা বর্ণের ও অনেক সম্প্রদায়ের লোকের বাস; সেখানে একক জাতি গঠনে উক্ত সব নীতি-পদ্ধতি অবশ্যই ফলপ্রসূ হবে। এবং কালে ও ক্রমবিকাশে রাষ্ট্র সীমা অতিক্রম করে এই সমমর্মিতা ও সহযোগিতা বিশ্বে পরিব্যাপ্ত হবে। এইভাবেই গড়ে উঠবে পুরোনো নামে ও নতুন তাৎপর্যে মনুষ্যজাতি। তখন একক বিশ্বে মনুষ্যজাতির সামগ্রিক সমস্যার সমাধানের জন্যে সমবেত প্রয়াসে উদ্যোগী হবে প্রতিটি মানুষ। তখন বসতি-বহুল অঞ্চল থেকে মানুষ বসতি-বিরল এলাকায় গিয়ে বাস করতে পারবে, জাত-জন্ম ও বর্ণ-ধর্ম বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। কেননা খাদ্য বণ্টনে ও বসতি বিন্যাসে সমতা সাধনের মধ্যেই নিহিত রয়েছে ভাবী মানুষের সুখ-শান্তি ও আনন্দ-আরাম। মানুষের প্রাণ-ভ্রমরের নিরাপত্তা অর্জন কেবল এ ব্যবস্থাতেই সম্ভব।