মিলনের পালা : নিকসন-মাও পদ্ধতি
নিকসন আর মাও সে তুঙ তাঁদের তাবৎ মত পার্থক্য সত্ত্বেও মিলিত হতে পারলেন, কিন্তু পশ্চিম বাংলার কংগ্রেসীরা অভিন্ন আদর্শ এবং কর্মসূচীর প্রতি সোচ্চার আনুগত্য সত্ত্বেও একটা কাজ চলা গোছের ঐক্য গড়ে তুলতে পারলেন না। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরাজীর শ্রীমুখ থেকে ভর্ৎসনাসূচক এই বাণী শ্রবণ করে পশ্চিমবঙ্গের বিবাদমান কংগ্রেসী নায়কদের মধ্যে আত্মগ্লানি এবং অনুশোচনার উদ্রেক হয়।
অতঃপর তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, না, আর বিবাদ নয়। এবার তাঁরা প্রেসিডেনট নিকসন এবং চেয়ারম্যান মাও-এর প্রদর্শিত পথে কাজ-চলা গোছের ঐক্য গড়ে তুলে প্রধানমন্ত্রী মনোবাঞ্ছা পূরণ করবেন।
পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসী নেতারা কাজ-চলা গোছের ঐক্য গড়ে তোলার জন্য যে কর্মসূচী গ্রহণ করবেন তা এই রকম :
একদিন শ্রীনিকসনশংকর রায় শ্রীকিসিংগারকান্তি ঘোষকে টেলিফোনে ডাকবেন।
‘হ্যালো কিসিংগারকান্তি!’
‘জয় গৌর।’
‘দেখ, তুমি এক্ষুনি আমার এখানে চলে এস।’
তারপর নিকসনশংকর এবং কিসিংগারকান্তির গুরুত্বপূর্ণ গোপন বৈঠক।
নিকসনশংকর : অভ্যন্তরীণ এই উত্তেজনা কমিয়ে ফেলাই ভাল। কি বলো?
কিসিংগারকান্তি : জয় গৌর! এর চাইতে মহৎ সংকল্প আর কী হতে পারে। সবই গৌরের ইচ্ছা।
নিকসনশংকর : হ্যাঁ, আমারও তাই ইচ্ছে। কী হবে আর ঝগড়া বিবাদ জীইয়ে রেখে। শান্তির উপরই নির্ভর করছে আমাদের সকলের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি। দেখলে তো দিদিমণির মেজাজ।
কিসিংগারকান্তি : সবই গৌরের ইচ্ছা!
নিকসনশংকর : আরে কী তখন থেকে গৌরের ইচ্ছা গৌরের ইচ্ছা করছ। বি সিরিয়াস।
কিসিংগারকান্তি : গৌরের ইচ্ছায় আপনার মনে যখন মিলনের আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছে, তখন দিদিমণির মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হতে দেরি হবে না।
নিকসনশংকর : তুমিও কি ওদের মত মনে করো নাকি যে আমিই এই গোলমাল পাকিয়ে তোলার মূলে? অ্যাঁ?
কিসিংগারকান্তি : রাধামাধব! তাই কখনো মনে করতে পারি! গৌর হে, প্রাণবল্লভ।
নিকসনশংকর : হ্যাঁ, তাই বলো। আমার বড্ড নরম মন, জানো? তাই সকলে তার অ্যাডভানটেজ নেয়। নইলে আমার হাতে যে-সব পুলিশ রিপোর্ট আছে তাতে ব্যাটাদের সব ধরে ধরে জেলে পুরে দিতে পারি।
কিসিংগারকান্তি : ওরে বাবা পুলিশ রিপোরট! গৌর হে, এ কী শোনালে!
নিকসনশংকর : আরে তুমি আমার ঘরের লোক। তোমার ভয় কী? যাক, তোমাকে যে জন্য ডেকেছি তা বলি। আমরা দলে একটা কাজ-চলা-গোছের ঐক্য গড়ে তুলতে চাই। তাই—
কিসিংগারকান্তি : কী, কী ঐক্য বললেন?
নিকসনশংকর : কাজ-চলা-গোছ ঐক্য।
কিসিংগারকান্তি : জয় গৌর!
নিকসনশংকর : দলের মধ্যে কাজ-চলা-গোছ ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে আমি অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা প্রশমিত করতে চাই। শান্তি মৈত্রী সহযোগিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখতে চাই। তাই আমি এ ব্যাপারে দেবী সে-তুঙের সঙ্গে মিলিত হতে চাই।
কিসিংগারকান্তি : সে কী! এ যে বিশ্ব আলোড়নকারী প্রস্তাব!
নিকসনশংকর : তা জানি। তাই তোমাকে এই ঐতিহাসিক মিলনের ব্যবস্থা করার ভার নিতে ডেকেছি। কিন্তু সাবধান! এখন এ জিনিস একেবারে গোপন থাকবে। পরে সব ব্যবস্থা পাকা হলে আমাদের সুবিধামতো একদিন ব্যাপারটা ফাঁস করে তাক লাগিয়ে দেব। ও কে?
কিসিংগারকান্তি : জয় গৌর।
অতঃপর একদিন কিসিংগারকান্তি জুলফিকার মৈত্রের বাড়িতে বেড়াতে যাবেন। তারপর সেখান থেকে ঘোষণা করবেন তাঁর অসুখ করেছে এবং তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন এবং বিকালে জুলফিকার মৈত্রের গাড়ি করে ময়দানে হাওয়া খেতে যাবেন। আসলে হাওয়া খাবার নাম করে কিসিংগারকান্তি জলফিকার মৈত্রের ব্যবস্থামতো সোজা চলে যাবেন রিচি রোড, দেবী সে-তুঙের বাড়ি। দেবী সে-তুঙের বাড়িতে গুরুত্বপূর্ণ গোপন বৈঠক সেরে কিসিংগারকান্তি জুলফিকার মৈত্রের বাড়িতে এসেই গাড়ি বদলিয়ে তৎক্ষণাৎ চলে আসবেন নিজের বাড়িতে। এবং এসেই হট লাইনে নিকসনশংকরের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
নিকসনশংকর : হ্যালো?
কিসিংগারকান্তি : জয় গৌর।
নিকসনশংকর : ভেরি গুড। এখনই চলে এস।
আবার দুজনে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক বসবে। এবং কিসিংগারকান্তি রিপোরট দেবেন যে, খবর খুব আশাপ্রদ। দেবী সে-তুঙও অরডিনারি ঐক্যের চাইতে কাজ-চলা-গোছ ঐক্যের ভিত্তিতেই আলোচনা চালাবার পক্ষপাতী।
নিকসনশংকর : বলো কী? আমি ভেবেছিলাম দেবী সে-তুঙ বোধ হয় পিওর ঐক্যই পছন্দ করবে। কাজ-চলা-গোছ ঐক্যের কথায় ও হয়তো রাজী হবে না।
কিসিংগারকান্তি : বরং উল্টো। ও তো নিজের থেকেই এই কাজ-চলা-গোছ ঐক্য প্রস্তাব দিল। আমি তো প্রথমে মুখ খুলিনি।
নিকসনশংকর : বড়ই আশ্চর্য! আমাদের দুজনের চিন্তাধারা একই খাতে বইছে!
কিসিংগারকান্তি : শুধু কি তাই। জুলফিকার মৈত্রের কাছে শুনলাম, দেবী সে-তুঙও আপনার কাছে কাজ-চলা-গোছ ঐক্যের প্রস্তাব পাড়তে দূত পাঠাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। আমি তার আগেই আমাদের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হওয়ায় ওর প্ল্যান ভেস্তে গিয়েছে।
নিকসনশংকর : বটে, বটে! তাহলে বলো, কাজ-চলা-গোছ ঐক্য গড়ে উঠলে লোকে আমাকেই ক্রেডিট দেবে?
কিসিংগারকান্তি : তা আর বলতে। গৌর হে, পার করো!
নিকসনশংকর : তাহলে আর দেরী নয়, আজই প্রেসে ঘোষণা করে দেওয়া যাক যে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা হ্রাস এবং দলের মধ্যে কাজ-চলা-গোছ ঐক্য স্থাপনের উদ্দেশ্যে নিকসনশংকর দেবী সে-তুঙের বাড়িতে কিছুদিনের মধ্যেই সফরে যাবেন। এই সফরের উদ্যোগ আয়োজনের কৃতিত্ব নিকসনশংকরের ব্যক্তিগত দূত কিসিংগারকান্তির প্রাপ্য। তাঁর চেষ্টার ফলেই নিকসনশংকর এবং দেবী সে-তুঙের এই ঐতিহাসিক মিলন সম্ভবপর হল। কী বল হে, প্রথম খবরটা এই ভাবেই যাক। তাহলে তোমার ভাবমূর্তিও খানিকটা উজ্জ্বল হবে।
কিসিংগারকান্তি : গৌরের যখন তাই ইচ্ছে তবে তাই হোক। আমি তো নিমিত্তমাত্র। জয় গৌর বল মন। গড়ব নব-বৃন্দাবন।
২৪ জুলাই ১৯৭৪