মিরজাফরের ছাতা
দুটো করে পরোটা, আর মাংসের প্রেপারেশান কি আছে?
আজ্ঞে, সব রকম, চিকেন, মাটন।
চিকেন? চিকেন আবার মাংস হল কবে! ওর চেয়ে হেলুনি মেরে কাগজের মণ্ড খেলেই হয়।
তাহলে মাটনই খান, কোর্মা কিংবা চাঁপ।
চাঁপ, সেই গায়ে জড়ানো একটা থেবড়া মতো, এইটটি টোয়েন্টি!
স্যার?
মানে আশিভাগ হাড় আর কুড়িভাগ মাংস?
কী যে বলেন স্যার! আমাদের এটা হল ফার্স্ট ক্লাস রেস্তোরাঁ।
এই হাইওয়েতে সবই ফার্স্টক্লাস! কি যেন নাম?
শিরোনাম স্যার।
সে আবার কি? রেস্তোরাঁর নাম শিরোনাম।
আজ্ঞে মালিক সাংবাদিকতা করতেন, বড় লেখক। চাকরি চলে গেল, ঠিক গেল না, কাগজটা বন্ধ হয়ে গেল। তখন আমরা সবাই মিলে এটা করেছি।
বাঃ, ভেরি গুড! আপনি কি ছিলেন। সাংবাদিক?
প্রূফ রিডার। খুব কাজে লেগেছে ট্রেনিংটা।
কি রকম! মেনুর প্রূফ রিডিং?
নো স্যার। চালের কাঁকরবাছা। আমাদের কাস্টোমারের দাঁতে যাতে একটাও কাঁকর না পড়ে!
মালিকের নাম কি?
সুদর্শন সরকার। সেবার ওই মাধ্যমিকের প্রশ্নপত্র ফাঁসের স্টোরিটা করে তিন মাস হাসপাতালে ছিলেন।
কেন? হাসপাতালে কেন?
বেধড়ক পেটানি। ওপর পাটি, নীচের পাটি খুলে পড়ে গেল, দু-সাইডের তিনটে তিনটে ছ’টা রিব প্যাঁকাটির মতো পট পট।
একবার দেখা করা যাবে?
না স্যার, তিন দিন ধরে কবিতা লিখছেন।
কবিতা লিখছেন কেন?
গল্প, উপন্যাসের মার্কেট গেঁজে গেছে। কবিতার বাজার ভালো। পুরস্কার, বিদেশ ভ্রমণ। তাছাড়া, কবিদের ইউনিয়ান আছে।
তা লিখছেন লিখুন, দেখা করবেন না কেন?
স্যার, ভাব নষ্ট হয়ে যাবে। কবিতা হল জ্বরের মতো।
ঠিক আছে, পরোটা আর কোর্মা আর স্যালাড।
ভদ্রলোক অর্ডার নিয়ে চলে গেলেন। বড়মামা বললেন, বেশি দিন বাঁচতে যদি চাস তো অলওয়েজ কম খাবি। অ্যাজ কম অ্যাজ পসিবল। পৃথিবীর তিনের চার ভাগ জল, একের চার ভাগ স্থল।
আমরা তিনের চার, একের চার বুঝব কী করে?
খুব সোজা। প্রথমেই তিন গেলাস জল খেয়ে নে, তারপর খেতে থাক, যতটা পারিস।
তুমিও তাই করবে?
না, না, এতদিন খেতে খেতে আমার মাপ জানা। নতুন করে মাপার দরকার হবে না। তুই ক’ বছরই বা পৃথিবীতে এসেছিস পিলু!
বড়মামা, আমার নাম বিলু।
পিলু আর বিলুতে কি তফাৎ! পিলু, বিলু, খিলু। এই যে পিলু বললুম, তোর বুঝতে কোনও অসুবিধে হল?
দুজনে আছি বলে হল না। দশজনের মধ্যে থাকলে হত। তাহলে আর নাম রাখা কেন?
ঠিক আছে, আজ থেকে তোর দুটো নাম হল, পিলু আর বিলু। বিলু বলে ডাকলে বিলু, পিলু বলে ডাকলেও বিলু।
আমাদের অর্ডার অনুযায়ী খাবার এসে গেল। খিদেও পেয়েছে খুব। বাঘের মতো খাদ্যকে আক্রমন করলুম। বেশ ভালো। বড়মামা খাচ্ছেন আর বলছেন, রিয়েলি গুড। ফ্যান্টাস্টিক প্রেপারেশন। আর এক প্লেট মাংস বলি, আর একটা পরোটা। দুটো পারব না। হেবি হয়ে যাবে।
আমার জন্যে বলবে না? আমার তোর চার ভাগের আধভাগও হল না। সকালে কম পরিশ্রম করালে। একটা গাড়ির আগা-পাশতলা ধোয়া, মোছা, পালিশ করা। গাড়িটার যা অবস্থা হয়েছিল!
তোর বয়েস তো পরিশ্রমের বয়েস। যত খাটবি ততই ভালো থাকবি। হার্ড লেবার। তোর বয়েসে আমি নদী থেকে পাহাড়ের মাথায় বালতি করে জল তুলতুম।
কেন তুলতে?
ব্যায়াম। আমার গুরু তখন ওঙ্কারেশ্বরে থাকতেন।
তোমার তো অনেক গুরু, কোন গুরু?
আমার ধর্মগুরু আর ব্যায়ামের গুরু একজনই, টু-ইন-ওয়ান। আগে শরীর তারপর ধর্ম, তারপর অলরাইট।
অলরাইট মানে?
তারপর যা খুশি তাই করো। তুমি তৈরি। একেবারে ফোর্ট উইলিয়াম। গোলাগুলি তোমার আর কিচ্ছু করতে পারবে না। নাচো-গাও। জপ, ধ্যান-ফ্যান কিস্যু প্রয়োজন নেই। পাখির মতো। ডানা বেরলো, ডানায় জোর এলো, নীল আকাশে উড়ে গেল ফট ফট করে।
বড়মামা টেবলে টক টক শব্দ করে ওয়েটার ভদ্রলোককে ডাকলেন।
আচ্ছা, আপনাদের আর কি প্রেপারেশান আছে? বেশ ভালো!
আপনি আমাদের কবাবটা টেস্ট করতে পারেন। আমাদের কবাবের জন্যে একেবারে আলাদা আর্টিস্ট। একেবারে কবাবি ঘরানা। এর গ্রেট, গ্রেট, গ্রেট গ্যান্ডফাদার মুর্শিদাবাদের প্যালেসে আলিবর্দি খাঁর আর্টিস্ট ছিলেন। তারপর নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হাঁড়ি কবাব খাইয়ে মুগ্ধ করে, পায়রার ডিমের মতো একটা হিরে উপঢৌকন পেয়েছিলেন।
হোয়াট ইজ উপঢৌকন?
উপঢৌকন মানে উপহার।
তা উপহার বললেই তো হয়।
আজ্ঞে না, হিরের সঙ্গে উপঢৌকনটাই যায়। দামি জিনিস তো!
সেই হিরেটা এখন কোথায়?
ওই যে বদমাইশ ক্লাইবটা! ক্লাইব কেড়ে নিলে। সেই হিরে এখন ইংল্যান্ডেশ্বরীর মুকুটে।
এই কবাবের কি স্পেশ্যালিটি?
কবাবের স্পেশ্যালিটি তেমন কিছু নেই, স্পেশ্যালিটি ছাগলের। ছাগল সব সেই নবাবি আমলের বংশপরম্পরা। সাধারণ ছাগল ব্যা ব্যা করে, এই ছাগল ওয়া, ওয়া করে। গজল শুনতে শুনতে শ্রোতারা যেমন ওয়া ওয়া করে। আমাদের কবাব-এ-গুলিস্তাঁ খেলে কিছুক্ষণ বাংলা ভুলে, কেয়া বাত, কেয়া বাত করবেন।
বড়মামা বললেন, আমাদের পূর্বপুরুষ মুর্শিদাবাদের নবাবি আমলের ছিলেন, আম নিয়ে রিসার্চ করে ওই বিখ্যাত কোহিতুর আম তৈরি করেছিলেন। সাধারণ ল্যাংড়া আমের সঙ্গে কর্পূর গাছের জোড় কলম। সে-আম গাছে উঠে, ডালে শুয়ে শুয়ে খেতে হয়। সিরাজ হাতির পিঠে তাকিয়া মাথায় দিয়ে শুয়ে থাকতেন। আর মাহুতরা হাতিটাকে চালাতে চালাতে ঠিক আমটার তলায় নিয়ে গিয়ে সিরাজের মুখটা ফিট করে দিয়েই হুইসল বাজাত। সিরাজ সঙ্গে সঙ্গে মুক্তোর মতো দাঁত দিয়ে আমটাকে ঘ্যাঁক করে কামড়ে দিত। দুটো ঐতিহাসিক জিনিস এখনো আমাদের ফ্যামিলিতে আছে। সিরাজের বুকের ওপর যে গামছাটা পাতা হত, সেই গামছা। আর একটা সাংঘাতিক জিনিস, ক্লাইবের ছাতা।
ওয়েটার ভদ্রলোকের নাম সুমন সরকার, আগে প্রূফ দেখতেন এখন চালের কাঁকর বাছেন। তিনি হাঁ হয়ে গেছেন।
বড়মামা বললেন, ছাতার এমন ধর্ম, সে রাজাই হোক আর প্রজাই হোক, হারাবেই হারাবে। সিরাজ রাজ্য হারালেন, ক্লাইব হারালেন ছাতা। অবশ্য নিজের ছাতা নয়, বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরের ছাতা। ক্লাইব এসেছিলেন, আমার গ্রেট, গ্রেট, গ্রেট…
বড়মামা আমাকে বললেন, হিসেব করত কটা গ্রেট পেরুলে সেইসময়ে ব্যাক করা যাবে। এক গ্রেট ধর পঞ্চাশ বছরের গাঁট। দু গ্রেটে এক সেঞ্চুরি। ক্রিকেটের হিসেবে দুটো উইকেট—শচীন, সৌরভ।
তুমি চারটে নয় পাঁচটা বসাও। সব ফাদারই যে পঞ্চাশ রান করেছিলেন এমন নাও হতে পারে। ইন্ডিয়ান টিমকে বিশ্বাস নেই।
রাইট। তাহলে ওই, গ্রেট গ্র্যান্ড বললেই হবে। একদিন দুপুরবেলা মিরজাফরের ছাতা মাথায় দিয়ে লর্ড ক্লাইব আমার বৃদ্ধ প্রপিতামহের কাছে এলেন। তিনি ছিলেন সংস্কৃতের বিরাট পণ্ডিত। প্রণাম করে বললেন, হামি আপনার কাছে বাংলা শিখিবে। ক্লাইবের শ্রদ্ধা ভক্তি দেখে ঠাকুরদার ঠাকুরদা একেবারে মুগ্ধ। আধঘণ্টায় বাংলা শিখে গেল সাহেব। পণ্ডিতমশাই করলেন কী, হামিটাকে আমি করে দিলেন, আর শিখিবের থেকে জাস্ট একারটাকে খুলে নিলেন, হয়ে গেল শিখিব। সাহেব চলে গেলেন। দাওয়ায় বাতায় ঝুলে রইল মিরজাফরের ছাতা। তার বাঁটে চীনে মিস্ত্রীর হিরে, পান্না বসান কাজ। ফ্যান্টাস্টিক! না দেখলে, বলে বোঝান যাবে না।
চীনে মিস্ত্রী কোথা থেকে এল স্যার?
চীন থেকে। পর্যটক ফা হিয়েনের সঙ্গে এক শিল্পী এসেছিলেন। তাঁর নাম উংসুং। তিনি ভারত ছেড়ে আর গেলেন না, গঙ্গার ধারে একটা কুঠিয়ায় থেকে গেলেন। থাকতে থাকতে বাঙালি। খুব স্বাভাবিক। বিলেতে থাকলে সাহেব হয়, বাংলায় থাকলে বাঙালি। নাম হয়ে গেল উমেশ সামন্ত। তাঁরই বংশধর গদাই সামন্ত এখন বহরমপুরে—পেতলের বাসনের বিরাট কারবারি!
গদাই কে চেনেন?
কে না চেনে, নাকটা থ্যাবড়া মতো, চোখ দুটো গুলি গুলি। তিনবার ন্যাশানাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। বাকিংহাম প্যালেসের যত অ্যাশট্রে সব তার তৈরি। লেডি ডায়নার ড্রয়িংরুমের এরিকা পামের যত টব সব তার তৈরি। কোটি কোটি টাকার মালিক। দেখলে বোঝার উপায় নেই। একটা গামছা পরে ঘুরে বেড়ায়। আর সব সময় ধান্দা হল, কি করে পরোপকার করা যায়। তারই উপকারে কারো বাড়ি হচ্ছে, কারো গাড়ি!
সেই ছাতাটা এখন কোথায়?
যেখানে ভারতের সব দামি জিনিস, সেইখানে, ব্রিটিশ মিউজিয়ামে।
খাওয়া শেষ। বিল এসে গেল। বড়মামা হাত ধুয়ে রুমালে হাত মুছতে মুছতে আধ হাত জিভ বের করলেন।
জিগ্যেস করলুম, কি হল?
সর্বনাশ!
সর্বনাশ মানে?
কেলেঙ্কারি! মানি ব্যাগ সার্কিট হাউসে ফেলে এসেছি।
সে কি গো, সাড়ে চারশো টাকা বিল!
তার চেয়েও বড় কথা, ব্যাগে সাড়ে চার হাজার টাকা আর আমার আদ্যামায়ের ছবি।
উপায়!
বড়মামা অম্লান বদনে বললেন, তোকে বাঁধা রেখে সার্কিট হাউসে ফিরে যাব।
সে তো পনের কিলোমিটার! ব্যাগটা রেখেছিলে কোথায়?
বালিশের তলায়।
সে আর নেই।
বালিশের তলায় তোশক, তার তলায় চেটাই, সেই চেটাইয়ের তলায়। ইন কেস যদি না পাই তো কলকাতায়। দু’দিন, দু’দিন বাঁধা থাকবি। খাবি-দাবি। এসে ছাড়িয়ে নেব। হোস্টেজ! বেশ মজা লাগবে দেখবি! একটা এক্সপিরিয়েনস!
ওয়েটার এসে দাঁড়িয়ে আছেন। বড়মামা বলতে যাবেন, এমন সময় চোখে পড়ল যে-চেয়ারে বসেছিলেন, তার পাশে কালো মতো পেট মোটা সেই ব্যাগ মেঝেতে পড়ে আছে।
গাড়ি ছুটছে হাইওয়ে ধরে। চিলকি গড় এখনো অনেক দূর। আমি থাকতে না পেরে বলেই ফেললুম, বড়মামা, মনে হচ্ছে, আমি মিরজাফরের ছাতার তলাতেই আছি, তুমি আমাকে বাঁধা রেখে চলে যাচ্ছিলে!
বড়মামা বললেন, গাধা। তোর মূল্য কত বাড়িয়ে দিচ্ছিলুম। লোকে দামি জিনিস বাঁধা রাখে।