মিমিরের মাথা আর ওডিনের চোখ

মিমিরের মাথা আর ওডিনের চোখ

দানবদের দুনিয়া, জতুনহাইমে রয়েছে মিমিরের কুয়ো। এটি মাটির অনেক গভীর থেকে জল আনে আর বিশ্ববৃক্ষ ইগড্রাসিলকে পুষ্টি জোগায়। জ্ঞানী মিমির, স্মৃতির রক্ষাকর্তা, অনেক কিছু জানে। তার কুয়ো হলো জ্ঞানভান্ডার, দুনিয়া যখন নবীন ছিল, মিমির প্রতিদিন কুয়ো থেকে গেলারহর্ন নামক শিং চুবিয়ে জল পান করত। অনেক অনেক দিন আগে, দুনিয়া যখন নবীন ছিল, ওডিন তার লম্বা কোর্তা আর টুপি পরে পর্যটকের ছদ্মবেশে দানবদের রাজ্যের মধ্য দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মিমিরের কুয়োয় এসেছিল, জ্ঞানের সন্ধানে।

“মিমির মামা, তোমার কুয়ো থেকে এক চুমুক জল পান করতে দাও”, বলেছিল ওডিন, “এইটুকুই শুধু তোমার কাছে চাই।”

মিমির মাথা নাড়ল। কুয়ো থেকে মিমির ছাড়া আর কেউ কখনো জল পান করেনি। সে কিছুই না বলে শুধু মাথা নেড়ে না করল। চুপ থাকা লোকেরা কদাচিৎই ভুল করে থাকে।

“আমি তোমার ভাগ্নে”, ওডিন বলল, “আমার মা, বেস্টলা, তোমার বোন ছিল।”

“এইটুকু যথেষ্ট নয়”, মিমির জবাব দিল।

“শুধু এক চুমুক জল, তোমার কুয়োর জলের এক চুমুকে আমি জ্ঞানীতে পরিণত হব। পরিবর্তে তুমি কী চাও বলো।”

“তোমার একটা চোখ”, জবাবে মিমির বলল, “তোমার একটা চোখ কুয়োর জলে ফেলো।”

মিমির ঠাট্টা করছে কি না, ওডিন জানতে চাইল না। মিমিরের কুয়োয় পৌঁছানোর জন্য দানবদের জগতের মধ্য দিয়ে যাত্রা খুবই দীর্ঘ আর বিপজ্জনক ছিল। এজন্য ওডিন জীবনের ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত ছিল। যে জ্ঞানের সন্ধানে সে বেরিয়েছে, তার জন্য আরো বেশি কিছু দিতেও সে প্রস্তুত ছিল।

ওডিনের চেহারায় দৃঢ় প্রত্যয় ফুটে উঠল।

‘ছুরি দাও’, ওডিন বলল।

প্রয়োজনীয় কাজ সেরে, ওডিন সাবধানতার সাথে তার একটি চোখ কুয়োর জলে রাখল। চোখটি জল ভেদ করে যেন তার দিকে তাকিয়ে ছিল। ওডিন মিমিরের কুয়ো থেকে গেলারহর্নে জল ভরে তার ঠোঁটের কাছে তুলল। বরফ শীতল জল! জলটুকু ওডিন এক চুমুকে পান করে ফেলল। তার মধ্যে যেন জ্ঞান প্লাবিত হলো। ওডিন তার এক চোখ দিয়েই অনেক দূরে আর পরিষ্কারভাবে দেখতে পেল, যেটা সে তার দুই চোখ দিয়েও কখনো দেখতে পায়নি।

এরপর থেকে ওডিনকে নানান নামে ডাকা হতো, ‘অন্ধ দেবতা’, ‘একচক্ষু দেবতা’, আর ‘জ্বলন্ত চক্ষু দেবতাত।

ওডিনের চোখ মিমিরের কুয়োয় আজো আছে, কুয়োর জলে সংরক্ষিত, কিছুই দেখছে না, আবার সবকিছুই দেখছে।

সময় বয়ে যায়। এসির আর ভানির দেবতাদের মধ্যে যুদ্ধ শেষে যখন যোদ্ধা আর দলনেতা বিনিময় হচ্ছিল, ওডিন মিমিরকে ভানিরদের নতুন রাজা এসির দেবতা হোনিরের উপদেষ্টা হিসেবে প্রেরণ করে।

হোনির ছিল লম্বা আর সুদর্শন। তাকে একজন রাজার মতোই দেখাত। যখন মিমির তার সাথে উপদেষ্টা হিসেবে থাকত, সে রাজার মতোই কথা বলত আর সিদ্ধান্ত নিত। কিন্তু যখন মিমির তার সাথে থাকত না, সে ভালোভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারত না। ভানিরেরা বিষয়টিতে বিরক্ত হয়ে উঠল। তারা তাদের প্রতিশোধ নিল। হোনিরের ওপর নয়, মিমিরের ওপর। তারা মিমিরের শিরোচ্ছেদ করল আর কাটা মুণ্ডুটি ওডিনের কাছে পাঠিয়ে দিল।

ওডিন ক্রুদ্ধ হলো না। সে মিমিরের কাটা মুণ্ডুকে পচনের হাত থেকে বাঁচাতে নানান জড়িবুটি দিয়ে মাখাল আর নানারকম জাদুমন্ত্র পাঠ করল। একসময় মিমির চোখ খুলল আর তার সাথে কথা বলতে শুরু করল। অন্য সময়ের মতোই মিমিরের কাটা মুন্ডুর মুখ থেকে আসা উপদেশ ছিল সঠিক আর যথার্থ।

ওডিন মিমিরের মাথাকে বিশ্ববৃক্ষের নিচে তার কুয়োর কাছে নিয়ে গেল। মাথাটিকে সে স্থাপন করল অতীত ও ভবিষ্যৎদ্রষ্টা জ্ঞানের জলে, নিজের চোখের পাশে।

ওডিন গেলারহর্নটি দেবতাদের প্রহরী হাইমডেলকে দিল। গেলাহৰ্নে যখন ফুঁক দেওয়া হবে, এটির শব্দ সকল দেবতাদের জাগিয়ে দেবে, তারা যেখানে বা যত গভীর ঘুমেই থাকুক না কেন

হাইমডেল গেলাহর্নে একবারই ফুঁক দেবে, রাগনারকের সময়, যখন সবকিছু ধ্বংস হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *