মিমসিগুলো বনলে বোরোগোবে – দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

মিমসিগুলো বনলে বোরোগোবে – দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

“আপনি দারুণ বোঝাতে পারেন স্যার,” অ্যালিস বলে উঠল, “আমায় একটু জ্যাবরওয়াকি কবিতাটার মানে বুঝিয়ে দিন না!”

“আর আমার কাছে যে কোনও কবিতার মানে বোঝানো তো নস্যি। বল শুনি। বল—বল—” হাম্পটি ডাম্পটি জবাব দিল।

শুনে অ্যালিসের বেশ আশা গজাল প্রাণে। সে শুরু করে দিল,

“সেই যে ব্রিলিগ স্লাইদি টাটুমটোবে

গিমলে ঘুরান সূর্যকাঁটার ঘাসে

মিমসিগুলো বনলে বোরোগবে

এবং মোমে রাথিন বাহিরদ্রাসে”

“হুম। এইখানটা থাম্‌ দেখি। এতে অনেক কঠিন কঠিন শব্দ আছে রে বাপ!” হাম্পটি ডাম্পটি অ্যালিসকে থামিয়ে দিল হঠাৎ, “ব্রিলিগ হল বিকেল চারটে, ডিম সেদ্ধ করবার টাইম।”

“আহা দারুণ। আর স্লাইদি?”

“স্লাইদি মানে বেশ কঠিন। একসঙ্গে দুটো জিনিস। পিছল হতে হবে আবার শক্ত, গোলগালও হতে হবে।”

“বুঝলাম। আচ্ছা দাদা, টোবে মানে কী?”

“ওরে বাবা? তারা দেখতে গিরগিটির মতোও হতে পারে, ছুঁচোর মতোও হতে পারে, মোট কথা সূর্যকাঁটার আড়ালে তাদের বাসা।”

“আর গিমলে ঘুরান?”

“গিমলে হল গর্ত। আর ঘুরান মানে নেচে নেচে পাক। হা হা। কেমন সোজা!”

“হুম! তার মানে ঘুরে ঘুরে নাচলেই—সূর্যকাঁটার ঘাস—তার মানে সূর্যঘড়ির ডায়াল ঘিরে যে মাঠটুকু, তা-ই না?”

“একদম ঠিক! ও মাঠ ওর আগে যায়, পরে যায়—”

“আর ওকে ছাড়িয়ে অনেক, অ–নেক দূর যায়—আচ্ছা, মোমে মানে কী? মোমবাতি নাকি?”

“দূর বোকা। মোমে মানে পথহারা। তা-ও জানিস না? আর যদি বলিস বাহিরদ্রাসে মানে কী, আমি বলব আকুল করা ডাক। ব্যাস। এবার থাম্‌। এত কঠিন কঠিন শব্দ তোকে কে শেখাল রে?”

“একটা বইতে পড়েছি তো,” অ্যালিস জবাব দিল।

থ্রু দ্য লুকিং গ্লাস—চার্লস ডজসন (ওরফে লুই ক্যারল)

Image

উন্টাহর্স্টেন বা তার পারিপার্শ্বিকের বিবরণ দেবার চেষ্টা করে কোনও লাভ নেই কারণ, প্রথমত, ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের পর বেশ কয়েক লাখ বছর কেটে গেছে, আর দ্বিতীয়ত, এক অর্থে উন্টাহর্স্টেন পৃথিবীতে নেইও। ল্যাবের সঙ্গে তুলনীয় একটা জায়গায় সে, দাঁড়াবার সঙ্গে তুলনীয় একটা ভঙ্গিতে অবস্থান করছিল। উদ্দেশ্য, তার টাইম মেশিনটিকে পরীক্ষা করে দেখা।

চালু করবার খানিক বাদে উন্টাহর্স্টেন হঠাৎ খেয়াল করল, বাক্সটা একেবারে খালি। পুরানো কালখণ্ডে একে চালু রাখতে গেলে সে সময়কার দস্তুরমতন এতে একটা তিনমাত্রিক বস্তু কিছু রাখতে হবে। ওতে করে সময়ভ্রমণে এনট্রপি আর মহাজাগতিক রশ্মির ধাক্কার প্রভাবে বস্তুটাতে খানিক বদল হবে। সেইটা মেপে গণকরা বলতে পারবে সেটা এক বা হাজার বা লক্ষ খ্রিষ্টাব্দ, কোন সময়ে গিয়ে পৌঁছেছিল। নইলে সেটা বোঝা যাবে না। অবশ্য ওসব বোঝাবুঝির বিশেষ কোনও মানে নেই। কিন্তু এসব ব্যাপারে উন্টাহর্স্টেনের কিছু ছেলেমানুষি আছে।

হাতে সময় নেই বিশেষ। যন্ত্রটা বেশ গনগনে হয়ে উঠে কাঁপুনি দিচ্ছে। পাশের গ্লসাচ‌-এ একটা মাল রাখবার পাত্র আছে। উন্টাহর্স্টেন ব্যস্তসমস্ত হয়ে সেখানে উড়ে গিয়ে পাত্রটা হাঁটকে কয়েকটা অদ্ভুত চেহারার খেলনা বের করে আনল। হুম। স্নোয়েনের বাতিল করা সব খেলনা। কায়দাকানুন শিখে নেবার পর পৃথিবী থেকে এ মাত্রায় সরে আসবার সময় ছেলেটা এগুলো সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। এখন অবশ্য এগুলো আর তার কাজে লাগবে না। স্নোয়েনের কন্ডিশনিং শেষ। ওসব ছেলেমানুষি জিনিসে তার কোনও টান থাকা উচিত নয়।

উন্টাহর্স্টেনের বউ বেচারার অবশ্য এগুলোর ওপরে খানিক দুর্বলতা আছে। কিন্তু এ পরীক্ষাটা তার চেয়ে বেশি জরুরি। উন্টাহর্স্টেন জিনিসগুলো নিয়ে গ্লসাচ ছেড়ে বেরিয়ে এসে সেগুলোকে টাইম মেশিনটার বাক্সে ঢেলে দিয়ে তার ঢাকনা টেনে দিতে দিতেই যন্ত্রের ঘণ্টাটা বেজে উঠেছে। আর তারপর তার চোখ ঝলসে দিয়ে সেটা উধাও হয়ে গেল দেশ-কালের গর্তে।

তারপর উন্টাহর্স্টেন অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। যন্ত্র আর ফিরল না। তখন সে যন্ত্রের ফেরবার আশা ছেড়ে দিয়ে আরেকটা টাইম মেশিন বানাল। আগের বার কয়েকটা বাতিল খেলনা নেবার পর যেহেতু বউ তাকে কিছু বলেনি তাই এবার সে স্নোয়েনের ছোটবেলার বাকি খেলনাগুলো বাক্সে ঢেলে দিয়ে সেটাকে রওনা করিয়ে দিল।

হিসেবমতো এই দু নম্বরটার উনিশ শতকের শেষের দিকের পৃথিবীতে গিয়ে হাজির হবার কথা। তবে যদি তা হয়েও থাকে তাহলে সে যন্ত্র সেখানেই রয়ে গেল। ফিরল না। অতএব তিতিবিরক্ত হয়ে উন্টাহর্স্টেন ফের একবার টাইম মেশিন বানাবার ফন্দি ত্যাগ করল। কিন্তু ততদিনে ক্ষতি যা হবার তা হয়েই গেছে।

দুটো টাইম মেশিন—তার প্রথমটা—

গ্লেন্ডেল–এর গ্রামার স্কুলের ছাত্র স্কট প্যারাডাইন হুকি খেলতে গিয়ে সেটাকে খুঁজে পায়। সে দিন তার ভূগোল পরীক্ষা। তবে ১৯৪২-এর সেই বসন্তের দুপুরটা বেশ গরম ছিল। তার মধ্যে আবার ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস বইছে। এমন দিনে ভূগোল পরীক্ষার বদলে মাঠে শুয়ে আকাশের মেঘ দেখা অনেক বেশি জরুরি কাজ। অতএব স্কট স্কুল পালিয়ে মাঠে এসে শুয়ে ঘুম দিচ্ছিল।

দুপুর নাগাদ স্কটের খিদে পেল। তখন সে মাঠ ছেড়ে দোকানে গিয়ে চিজ, চকোলেট, কুকি আর একটা সোডা পপ–এর বোতল নিয়ে খালের ধারে গিয়ে খেতে বসল। খাওয়া শেষ করে সে খালের জলে ব্যাঙাচি ধরে পরীক্ষানিরীক্ষা করছে, এমন সময় কিছু একটা জিনিস ধুপ করে এসে পড়েই খালপাড়ের কাদাতে গেঁথে গেল। দেখে স্কট ব্যাঙাচি ছেড়ে সেদিকে দৌড় দিল।

তারপর তো ঘণ্টাভর চলল পেঁচালো চেহারার বাক্সটাকে খোলবার আপ্রাণ চেষ্টা। সেটার গায়ের সব যন্ত্রপাতি পুড়ে, গলে, কুঁকড়ে একাকার হয়ে আছে। তবে ইতিহাসে কখনও কোনও ছোকরা একটা বন্ধ বাক্সকে সহজে ছেড়ে দেয়নি। বস্তুটা যদি একটা খেলনাগাড়ি হত, তাহলে স্কট খানিক বাদেই সেটাকে ভেঙেচুরে দেখে নিয়ে ক্ষান্তি দিত। কিন্তু এ বাক্স তেমনটা ছিল না। তাকে খোলে কার সাধ্য!

অতএব স্কট নতুন কায়দা নিল। স্কুলের থলে থেকে বের হল একটা পেনসিল কাটবার ছুরি। জিব বের করে ভুরু কুঁচকে তা-ই দিয়ে সেটাকে সে খোঁচাচ্ছে, এমন সময় হঠাৎ ছুরিটা গেল ভেঙে। আঙুলেও একটা ইলেকট্রিক শকের মতো লাগল তার সঙ্গে সঙ্গেই। অতএব এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে নিয়ে স্কট বিড়বিড় করে গোটাকয় নতুন শেখা গালাগাল আওড়ে চমকটা কাটিয়ে নিল।

অবশ্য বাক্সটা না খুলতে পেরে স্কটের আপশোস হবার কথা নয়। জিনিসটাকে দেখলে স্বয়ং আইনস্টাইন সাহেবও ঘাবড়ে যেতেন নিঃসন্দেহে। সেটা খোলা যাচ্ছিল না, তার কারণ টাইম মেশিনটা তখনও স্কটের স্থান-কালে পুরোপুরি এসে ঢোকেনি। চতুর্থ মাত্রার সঙ্গে তখনও তার একটুখানি এলাকা সেঁটে ছিল।

খানিক বাদে স্কট একটা বড়সড়ো পাথরের টুকরো খুঁজে বের করে আনল। তারপর তা-ই দিয়ে দমাদ্দম ঘা দিতে শুরু করে দিল পেঁচালো বাক্সটার গায়ে। পাথরের গুঁতো গিয়ে পড়বি তো পড় ঠিক যে জায়গাটায় বাক্স চার মাত্রাকে ছুঁয়ে আছে সেই বিন্দুটাতে। তাতে বাক্সটা চার মাত্রা ছেড়ে স্কটের স্থান-কালে সবটা ঢুকে এল আর স্কটও ডালা ধরে টান দিয়ে সেটাকে খুলে ফেলল।

বাক্স থেকে প্রথমেই বের হল একটা উলের টুপি। স্কট সেটাকে একপাশে ছুড়ে ফেলে দিল। বাড়িতে অনেক আছে। তারপর বের হল একটা কালো কাচের ঘনক। বস্তুটা দু হাতের তেলোয় এঁটে যায়, অথচ বাইরে থেকে নজরে আসে, তার ভেতরে অনেক যন্ত্রপাতি আর জিনিসপত্র ঠাসা। স্কট বুঝে গেল জিনিসটা একটা পেপারওয়েট। ওর ভেতরে রাখা ছোট ছোট জিনিসগুলো কাচে ঘা খেয়ে এত বড় বড় দেখাচ্ছে।

তবে জিনিসগুলো ভারী অদ্ভুত। যেমন ধরুন একগাদা খুদে খুদে মানুষ। মানুষগুলো আবার নড়াচড়াও করে। অদ্ভুত পোশাক–আশাক পরে তাদের একদল সেখানে একটা খুদে বাড়ি বানাচ্ছে। মনোযোগ দিয়ে সেদিকে দেখতে দেখতেই স্কট ভাবল, এবার বাড়িটায় আগুন লাগুক, আর ওরা আগুন নেবাক দেখি!

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আধা গড়ে ওঠা বাড়িটা জুড়ে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। অমনি একটা হাত ঘোরানো ফায়ার এঞ্জিন এসে আগুনটা নেবাতে লেগেছে।

ব্যাপারটা কী ঘটছে, সেটা বুঝে নিতে স্কটের এরপর বেশি সময় লাগেনি। কাচের ভেতরের খুদে মানুষরা তার ইচ্ছেগুলো পড়ে নিয়ে ঠিক সেইমতো কাজ করে দেখাচ্ছে। এবারে স্কটের একটু ভয় হল। জিনিসটাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে হ্যাঁচোড়–প্যাঁচোড় করে খালের ধার বেয়ে ওপরের দিকে রওনা হল সে। মাঝরাস্তা অবধি পৌঁছেই অবশ্য ভয়ের চমকটা কেটে গেল তার। অতএব স্কট ফের নেমে এল জলে আধডোবা হয়ে পড়ে থাকা কাচের বাক্সটার কাছে। জিনিসটা যে কোনও ধরনের একটা খেলনা, সেটা বুঝতে স্কটের অবশ্য কোনও সমস্যাই হয়নি। খেলনা চিনতে ছোটরা কখনও ভুল করে না। তবে সঙ্গে সঙ্গে জিনিসটাকে সে তুলে নেয়নি। তার বদলে পেঁচালো বাক্সটার কাছে এসে সে তার ভেতরের অন্য জিনিসগুলোকে পরখ করতে বসল।

দারুণ দারুণ কিছু গ্যাজেট পেয়েছিল স্কট সে বাক্সে। সেই নিয়ে বিকেলটা যে কোন ফাঁকে ফুড়ুৎ করে পালিয়ে গেল তা সে টেরও পেল না। অবশেষে সন্ধের মুখেমুখে বাক্সটাকে টানতে টানতে সে ফেরার পথ ধরল। বাড়ি ফিরে নিজের ঘরের আলমারিটার ভেতর বস্তুটাকে লুকিয়ে রেখে তবে স্বস্তি। ততক্ষণে কাচের ঘনকটা তার ফুলে থাকা পকেটে গিয়ে ঢুকেছে। সেখানে আগে থেকেই ঢুকে রয়েছে খানিকটা দড়ি, খানিক তার, দুটো পেনি, খানিকটা টিনের পাত, একটা নোংরা মিলিটারি স্ট্যাম্প আর একদলা ফেল্ডস্পার। আলমারির দরজা বন্ধ করতে যাবে, ঠিক তক্ষুনি স্কটের দু-বছুরে বোন এমা টলতে টলতে ঘরে এসে ঢুকে বলে, “এই দাদা!”

“কী রে পেতনি?” স্কট তার দিকে ঘুরে বলল।

এমার অবশ্য অমন খোঁচানো বোঝবার বয়স হয়নি। টলমলিয়ে হেঁটে এসে কার্পেটের ওপরে বসে পড়ে পা দুটো সামনে বাড়িয়ে ধরে বড় বড় চোখ করে সে বলে, “জুতো বেধে দে স্কটি—”

“পেতনি!” বলে হি-হি করে একটু হেসে নিল স্কট। কিন্তু তারপর নিচু হয়ে বোনের জুতো দুটো ভালো করে আটকে দিয়ে বলল, “খেতে দিয়েছে?”

“হুঁউ—”

“দাঁড়া, আসছি তাহলে—” বলে স্কট বাথরুমে ঢুকে হাত ধুয়ে নিল ভালো করে। ব্যাঙাচি ঘেঁটে বেজায় ময়লা হয়েছিল হাত দুটো।

ডেনিস পারাদিন আর তার বউ জেন ড্রয়িং রুমে বসে ডিনারের আগে একটু ককটেল চাখছিল। ডেনিস মাঝবয়সি, চুলে পাক ধরেছে, মুখটা ছেলেমানুষদের মতো। ইউনিভার্সিটিতে দর্শনের মাস্টার। জেন ছোটখাটো, মাজা রং, বেজায় সুন্দরী।

“জুতোটা ভালো কিনেছি না?”

জেনের পায়ের দিকে একনজর তাকিয়েই ফের মুখ ঘুরিয়ে নিল ডেনিস, “হাঃ! জুতো!! পরে দেখছি। দিনটা আজ যা গেল!”

“পরীক্ষা ছিল?”

“হুঁ। তরুণ তুর্কিগণ সব জ্ঞানী পুরুষ হইবেক। আপদগুলো মরুক! ছটফটিয়ে মরুক সব। ইনশাল্লাহ্‌।”      

“তোমার গ্লাস থেকে জলপাইটা তুলে দেবে?” জেন জবাব দিল।

“সে তো দেবই। কত বছর আমি মার্টিনিতে ডোবা জলপাই খাইনি গো। তোমার গ্লাসে যদি আধ ডজন দি, তুমি তারপরেও আমার গ্লাস থেকে সাত নম্বরটা তুলে নিয়ে খাবে।”

“খাবই তো! তোমার গ্লাসেরটাই খাব। সিমবলিজম! বুঝলে। আমি তোমার অর্ধাঙ্গিনী না? হি-হি—”

“উফ, বাড়িটাও ফিলজফির ক্লাস বানিয়ে ফেলছে এ। মনে হচ্ছে আমার কোনও ছাত্রীকে নিয়ে বসে আছি।”

“কার সঙ্গে গো? বেটি ডসন নামে ওই খলবলি ছুঁড়ি? এখনও তোমার দিকে ইশারাটিশারা করছে নাকি?”

“হ্যাঁ। মেন্টাল কেস। ভাগ্যিস আমার মেয়ে না। নইলে দিতাম ধরে দু ঘা—” বলতে বলতে পারাদিন মাথা নাড়ল, “সিনেমা দেখে দেখে মাথাটা গেছে। তার ওপর নিজের জেন্ডার নিয়ে বেজায় উৎসাহ। আমার মনে হয় মেয়েটা এখনও ভাবে যে আমায় নিজের হাঁটু দুটো দেখিয়ে দেখিয়েই পাস-মার্ক তুলে নেবে। ছ্যাঃ। কাঠি কাঠি দুটো ঠ্যাং!”

জেন বেশ গর্ব গর্ব মুখে নিজের স্কার্টটা একটু টেনেটুনে নিল। পারাদিন ততক্ষণে আরও দুটো মার্টিনি ঢেলে নিয়েছে। জেনের দিকে একটা গ্লাস বাড়িয়ে দিতে দিতেই সে বলে, “সত্যি বলতে কী জানো, এই মর্কটের দলকে দর্শনশাস্ত্র পড়িয়ে কোনও লাভ নেই। ভুল সময়ে জন্মেছে সবগুলো। স্বভাব, অভ্যেস, সবকিছু একেবারে ছকে বাঁধা। মুখে স্বীকার করবে না, ওদিকে বেজায় রক্ষণশীল সব ক-টা। সত্যি কথাটা কী জান জেন, দর্শন বুঝতে গেলে হয় সত্যিকারের প্রাপ্তবয়স্ক মানসিকতা লাগে, অথবা এই এমা বা স্কটির মতো সরল শিশুর মতো মন হতে হয়।”

“তা-ই বলে স্কটিকে আবার তোমার ক্লাসে নিয়ে ঢুকিয়ো না। আমার ছেলে, অতএব ওসব ভারী ব্যাপারস্যাপারে ওর দৌড় কতটা হবে তা আমার ভালোই জানা আছে।”

“তা বটে। কিন্তু তাহলেও বেটি ডসনের চেয়ে খারাপ করবে না—এই বলে দিচ্ছি।”

“পাঁচ বছরে বৃদ্ধ হয়ে প্রাণ দিল সে আহা—*” গুনগুন করে কবিতা আওড়াতে আওড়াতে জেন বলল, “তোমার জলপাইটা দাও এবারে ডিয়ার—”

“এই যে—ধর। ওহো, খেয়াল করিনি, জুতোটা তোমায় ভালোই মানিয়েছে কিন্তু।”

“যাক। তা-ও যে চোখে পড়েছে! এই যে রোজালি এসেছে। খেতে দিয়েছ?”

“সব তৈরি ম্যাডাম,” বলতে বলতে রোজালি সামনে এসে দাঁড়াল, “এমা আর স্কটিকে ডেকে আনি?”

“উঁহু। আমি ডাকছি,” বলতে বলতেই ওপর দিকে মুখ তুলে হাঁক দিল, “খাবি আয় তোরা।”

সিঁড়িতে ছোট ছোট পায়ের শব্দ উঠল। পরক্ষণেই স্কটির দেখা মিলল। স্নানটান করে ধোপদুরস্ত হয়েছে। মাথার ঠিক মাঝখানে চুলের একটা খাবলা খাড়া হয়ে আছে। তার পেছন পেছন এমা পা টিপে টিপে ভয়ে ভয়ে নামছিল। সিঁড়ির মাঝবরাবর এসে বড়দের কায়দায় নামার চেষ্টা ছেড়ে সে উলটো হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে নামা শুরু করল। পারাদিন বেশ মনোযোগ দিয়ে সেটা দেখছিল, কিন্তু স্কটি এসে তার গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে এমার নেমে আসাটা আর সবটা দেখা হল না তার।

খানিক সামলেসুমলে নিয়ে পারাদিন স্কটের দিকে চোখ কটমটিয়ে চাইল একবার, “কোমরের একটা হাড় বোধহয় সরেই গেল রে তোর ধাক্কায়! নে। এখন হাতটা ধরে খাওয়ার টেবিলে নিয়ে চল্‌ দেখি!”

স্কটের অবশ্য সেসব শুনতে বয়েই গেছে। পারাদিনকে ছেড়ে, জেনের নতুন জুতো মাড়িয়ে এক লাফে খাওয়ার ঘরে গিয়ে ঢুকে চেয়ার টেনে বসে পড়েছে সে ততক্ষণে। তার পেছন পেছন পারাদিন আস্তে আস্তে আসছিল। তার ডান হাতের একটা আঙুল পাকড়ে এমাও দিব্যি টুকটুক করে আসছে।

“বাঁদর দুটো যে কী করতে থাকে সবসময়!”

“ভালো কিছু যে করে না, সে তো বলাই বাহুল্য,” জেন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, “এই যে ছোকরা, তোর কানটা দেখি!”

“পরিষ্কার। মিকি চেটে দিল তো।”

“তবে তো কথাই নেই। কুকুরটার জিব তোর কানের চেয়ে অনেক পরিষ্কার,” বলতে বলতেই স্কটির কান দুটো টেনে ধরে তার ফুটোর মধ্যে আঙুল দিয়ে দেখে নিল জেন, “খানিকটা আছে, তবে শুনতে যখন পাচ্ছিস, তখন ময়লা থাকলেও দোষ নেই, বল্‌?”

“অ্যাত্তোতা?” এমা জেনের আঙুলটা দেখবার চেষ্টা করছিল।

“না না। একটুখানি ময়লা আছে,” বলতে বলতে এমাকে কোলে নিয়ে জেন তাকে একটা চেয়ারে তুলে বসিয়ে দিল। এমা সবে কয়েকদিন হল বড়দের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাবার অনুমতি পেয়েছে। ফলে চেয়ারে বসতে তার ভারী গর্ব। তাকে জানানো হয়েছে, ছোট বাচ্চারা খাবার ছড়ায়। অতএব সে এমন সাংঘাতিক সাবধানে চামচ মুখে তুলছিল যে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে পারাদিনের বেশ একটু সাসপেন্স সাসপেন্স ঠেকছিল।

“এমার জন্য একটা কনভেয়ার বেল্ট থাকলে বেশ হত,” পারাদিন জেনের জন্য একটা চেয়ার টেনে দিতে দিতে হাসছিল, “হাত দিয়ে ধরতে হবে না। খানিক বাদে বাদে একদলা করে পালং শাক আমাদের এমার মুখের কাছে এসে পৌঁছে যাবে।”

খানিক বাদে খেতে খেতেই হঠাৎ পারাদিন স্কটের দিকে ঘুরে বলল, “কী রে? পেট ব্যথা করছে? নাকি দুপুরে বেজায় ঠেসে খেয়েছিস? কোনটা?”

স্কট খাবারের থালাটার দিকে মনোযোগ দিয়ে খানিক দেখল, “যতটুকু আমার দরকার, আমি খেয়ে নিয়েছি বাবা।”

“সে কী রে? এমনিতে তো পেট ফাটবার অবস্থা না হলে মুখ চালানো থামে না তোর একেকদিন! তা আজ হঠাৎ করে—”

“সত্যি বলছি বাবা, আমার যতটুকু দরকার, আমি—”

“হুম। আর যতটুকু ইচ্ছে, সেটার কী হবে?”

“যতটুকু দরকার, ততটুকুই ইচ্ছে। আমি তোমাদের মতো করে খাই না।”

“সে কী রে? তাহলে? কীভাবে খাস? ইশকুলে নতুন কিছু কায়দাটায়দা শিখিয়েছে বুঝি?”

“উঁহু। কেউ শেখায়নি। আমি নিজে নিজেই আবিষ্কার করেছি। আমি যতটুকু খাই, তার একেবারে সবটাকে অনেকটা থুতু দিয়ে হজম করে—”

“উঁহু। আবার বল্‌। বাজে শব্দ—”

“মানে অনেকটা বেশি লালা দিয়ে—”

“লালা দিয়ে—মানে পেপসিন—জেন, লালাতে পেপসিনই থাকে তো?”

“উপস্থিত আমার লালায় বিষ আছে,” জেন আলুসেদ্ধ মুখে পুরতে পুরতে বলল, “রোজালি দায় সেরেছে। আলুসেদ্ধর মধ্যে বড় বড় আধকাঁচা টুকরো।” তবে জেন কান না দিলেও স্কটির কথায় পারাদিনের বেশ আগ্রহ হচ্ছিল, “তার মানে তুই যেটুকু খাচ্ছিস, তার একটুও নষ্ট না করে সবটাকেই হজম করে ফেলছিস এখন থেকে, তা-ই তো? আর তাই কম খাচ্ছিস। নাকি?”

স্কট গম্ভীর মুখে খানিক ভাবল। তারপর মাথা নেড়ে বলে, “সেরকমই। তবে শুধু থু—মানে লালা নয় বাবা। ঠিক কতটুকু মুখে নেব, কী কী মিশিয়ে দলা বানাব, সেগুলোরও হিসেব আছে।”

“হুম্‌ম্‌।” পারাদিন মাথা নাড়ল। বাচ্চাদের মাথায় মধ্যে মধ্যে এমন উদ্ভট সব আইডিয়া খেলে যায়! তবে এ ছোকরার আইডিয়াটা খারাপ নয়। “একটা সময় আসবে, যখন ওই গাদা গাদা খেয়ে নষ্ট করবার বদলে এইভাবেই অতটুকু দরকার—আহা হা! জেন, আমাদের ছেলের মধ্যে জিনিয়াসের লক্ষণ দেখা দিচ্ছে।”

“অ্যাঁ?”

“এই বয়সেই এমন একটা আইডিয়া বানিয়ে ফেলেছে! এই, তুই এটা নিজে নিজে ভেবেছিস? নাকি—”

“হ্যাঁ তো!”

“আইডিয়াটা কোথায় পেলি?”

স্কট একটু অস্বস্তিভরে নড়েচড়ে বসল, “সেসব জানি না। ওই হঠাৎ করে আর কী—”

“কোনও টিভি প্রো—”

“থুউউউউতু—” হঠাৎ এমার চিলচিৎকারে পারাদিনের কথাবার্তা থেমে গেল। শব্দটা তার ভারী পছন্দ হয়েছে। তা ছাড়া দাদাকে নিয়ে বাবার এমন ব্যস্ত থাকাটাও তার মেজাজ খারাপ করে দিচ্ছিল। চিৎকারটা দিয়ে এবারে সে প্রাণপণে কাজটাও করে দেখাবার চেষ্টায় ছিল। তবে বুকে আঁটা বিবটা ভেজানো ছাড়া তাতে আর কোনও লাভ হচ্ছিল না, বলাই বাহুল্য। জেন তাড়াতাড়ি উঠে এসে এমার মুখ মোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পারাদিনও স্কটের দিকে সন্দেহের দৃষ্টি দিতে দিতেই খাওয়া শেষ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

এর পরের ঘটনাটা ঘটল ডিনারের পর বসবার ঘরে।

“হোমওয়ার্ক নেই কোনও?”

“ইয়ে মানে—” অস্বস্তিটা এড়াবার জন্য স্কট মাথা নিচু করে পকেট থেকে একটা খেলনা বের করে সেটার ভাঁজ খুলতে শুরু করে দিল। জিনিসটা ওই বাক্সের থেকে নেয়া। পুরোটা খুলে ফেলতে সেটার চেহারা দাঁড়িয়েছে, একটা চার মাত্রার ঘনকের ত্রিমাত্রিক মডেল বানালে যেমন দেখাবে, সেই টেসেরাক্তের মতন। তার বাহুগুলোতে আবার একগাদা পুঁতি আঁটা।

পারাদিন প্রথমে দেখতে পায়নি। তবে এমার নজর এড়ায়নি জিনিসটা। বলে, “আমায় দে—”

স্কট ধমকে উঠল, “হাত দিবি না বলছি পেতনি। তাহলে না—” বলতে বলতেই সে দ্রুত হাতে পুঁতিগুলো এদিক–সেদিক নাড়াচাড়া করতে শুরু করেছে।

এমার অবশ্য স্কটের ধমকে থোড়াই কেয়ার। এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সে টেসেরাক্তটার দিকে। কিন্তু‍ তারপর, আঙুল দিয়ে জিনিসটাকে ছুঁয়েই হঠাৎ একটা চিলচিৎকার ছেড়ে মাটিতে পড়ে ছটফট করতে শুরু করল সে।

“স্কটি!” এবার পারাদিন একটা ধমক দিয়ে উঠল, “ওইটুকু বোনকে কেউ মারে?”

“আমি মারিনি!”

“আমায় কামড়ে দিল। ওইটা আমায় কামড়ে দিল। হুঁউউ—”

এমার আঙুল অনুসরণ করে জিনিসটাকে দেখে পারাদিন একটু ভ্রু কুঁচকাল, “ওটা কী রে? অ্যাবাকাস? নিয়ে আয় দেখি আমার কাছে?”

একটু তানা–নানা করে স্কটি বস্তুটাকে বাবার কাছে নিয়ে গেল এবার। জিনিসটা আয়তনে এক স্কোয়্যার ফুট মতন হবে। সরু সরু তার এখানে-ওখানে জুড়ে তৈরি। তারগুলোর মধ্যে আবার রঙিন পুঁতি আটকানো। পুঁতিগুলোকে তার বেয়ে আগুপিছু করানো যায়, এমনকী জোড়ের জায়গাগুলো বেয়ে এক তার থেকে অন্য তারেও নিয়ে চলে যাওয়া যায়।

কিন্তু—ফুটো করে গাঁথা হলে পুঁতির তো জোড় পেরিয়ে অন্য তারে যাবার কথা নয়! তাহলে? পারাদিন একটা পুঁতি ধরে খুঁটিয়ে দেখল। না, ফুটো নয়। ওর গা ঘিরে সরু খাঁজের ভেতর দিয়ে তারগুলো গেছে। তাহলে তো টান পড়লে খুলে আসা উচিত! একটা পুঁতি ধরে টেনে দেখল পারাদিন। খুলে আসা উচিত, কিন্তু এল না। তার মানে কোনও চৌম্বকশক্তি পুঁতিকে তারের সঙ্গে বেধে রেখেছে। লোহা? উঁহু। প্লাস্টিকের তৈরিই মনে হচ্ছে তো পুঁতিগুলোকে!

তবে পুঁতির চেয়েও যে জিনিসটা পারাদিনকে বেশি অবাক করছিল, সেটা হল জিনিসটার চেহারা। পারাদিন অঙ্কের পণ্ডিত নয়। কিন্তু তবু, বস্তুটার বাহুদের মধ্যকার ইউক্লিডের সূত্রদের নস্যাৎ করে দেওয়া বিচিত্র কোণগুলো দেখতে দেখতে খানিক অবাকই হয়ে যাচ্ছিল সে। সব মিলিয়ে একটা ধাঁধা—হ্যাঁ, তা-ই হবে। বস্তুটা একটা খেলনা। ছোটদের পাজ্‌ল্‌।

“পেলি কোথায় এটা, হ্যাঁ রে?”

“হ্যারিমামা গত রোববারে যখন এল, তখন নিয়ে এসেছিল।” স্কট এলোপাথাড়ি যা মুখে এল, বলে দিল। বাবাদের সবসময় সত্যি কথা বলা যায় না। বললে কেড়ে নিতে পারে। হ্যারিমামা যে দু-তিন দিন আগে শহরের বাইরে গেছে, সেটা তার জানা। কয়েক সপ্তাহ বাদে ফিরবে। সে অনেক লম্বা সময়। তদ্দিনে বাবা ভুলে যাবে। অতএব চিন্তা নেই।

পুঁতিগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে পারাদিন একটু হতভম্বই হয়ে পড়ছিল। একটু অদ্ভুত আচরণ করছে সেগুলো। ধর একটা লাল পুঁতি, সেটাকে একটা তার বেয়ে টেনে নিলে যে কোণটায় তার পৌঁছাবার কথা বলে চোখে দেখা যাচ্ছে, তার বদলে সে গিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে অন্য একটা কোণে। বেশ মাথা-গোলানো ধাঁধা তো!

খানিক বাদে খেলনাটা স্কটের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে পারাদিন অন্য দিকে মন দিল। স্কট বস্তুটা নিয়ে ঘরের এক কোণে গিয়ে ফের নাড়াচাড়া করতে শুরু করে দিল। পুঁতিগুলোর বেশ বুদ্ধি আছে। সেগুলোর যে কোনওটাকেই যেখান দিয়ে যেদিকে নিয়ে যাবার কথা; তার উলটো করলেই আঙুলে একটা ছোট্ট শক দেয়। আর সঠিক রাস্তায় নিয়ে গেলে দিব্যি সরসরিয়ে চলে যায়। খানিক বাদে হঠাৎ সে বেশ খুশি-খুশি গলায় হাঁক দিয়ে উঠল, “বাবা, হয়ে গেছে। অদৃশ্য হয়ে গেছে।”

পারাদিন জিনিসটাকে হাতে নিয়ে দেখল একবার, “কই, কী অদৃশ্য হল রে? একই আছে তো?’

“উঁহু। নীল পুঁতিটা। আর নেই। ঠিকঠাক নাড়িয়ে ওটাকে অদৃশ্য করে দিলাম।”

ছেলেমানুষি কথা! পারাদিন তাতে পাত্তা না দিয়ে ফের নিজের কাজে ফিরে গেল। স্কট ফের খেলনায় মজে গেল। পুঁতিগুলোকে ঠিক কীভাবে, কোন দিকে নাড়াতে–চাড়াতে হবে, সেটা সে বুঝে গেছে। অতএব, সেইটা তাকে শিখিয়ে দেবার পর আর কোনও শক-টক দেবার বালাই নেই খেলনার। তার উদ্ভট কোণগুলোও আর ততটা উদ্ভট লাগছে না স্কটের। বেশ সোজাই তো ব্যাপারটা! আর মজার।

তার মানে ওই কালো কাচের ঘনকটার মতন এটারও একটু একটু বুদ্ধি আছে! ঘনকের কথা মনে হতেই স্কট পকেট থেকে সেটা বের করে এনে পুঁতির খেলনাটা এমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তা-ই নিয়ে মজে গেল।

বস্তুটা হাতে পেয়ে এমার আনন্দ দেখে কে! প্রথম প্রথম পুঁতিগুলো তাকেও একটু-আধটু শক দিচ্ছিল বটে, তবে এবারে আর সে নিয়ে তার কান্নাকাটি নেই। চটপট ব্যাপারটা ধরে নিয়ে সে স্কটের মতোই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার আরেকটা পুঁতিকে অদৃশ্য করে ফেলল।

তবে, তার সঙ্গে সঙ্গেই স্কটের অদৃশ্য করা নীল পুঁতিটা যে ফিরে এসেছে, সেটা অবশ্য এমা বুঝতে পারেনি। আর স্কটও সেটা খেয়াল করেনি, কারণ সে তখন একটা জিনিসপত্তর বোঝাই সোফার এক কোণে ঢুকে লুকিয়ে বসে তার ঘনক নিয়ে মজে আছে।

ঘনকটার ভেতরে ছোট ছোট মানুষজন। একদম আসলের মতো দেখতে। তারা একটা বাড়ি বানিয়েছে সেখানে। বাড়িটায় আগুন ধরে গেছে। বেশ লম্বা লম্বা আগুনের শিখা উঠছে। লোকগুলো তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কারও আদেশের অপেক্ষা করছে।

“এইবারে আগুন নেবাবে এরা,” স্কট বলে উঠল। কিন্তু কোনও সাড়া নেই। কী হল আবার?

“সেই হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আগুন নেবানোর গাড়িটা কোথায় গেল? সেটাকে আন?” ভাবতে না ভাবতেই দেখা গেল আগুন নেবানোর গাড়ি এসে হাজির। হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জল ছুড়ে মারছে আগুনে।

“হুম। তার মানে ঠিক কী করতে হবে, সেইটে বলে দিতে হবে তোদের, তা-ই না? ঠিকঠাক না বললে কাজ হবে না—এই তো?”

ভারী মজার খেলা। ঠিক যেন একটা নাটক চলছে কাচের ভেতরে। স্কট যা হুকুম দিচ্ছে মনে মনে, সেটা ঠিকঠাক হলে খুদে লোকগুলো সেটা তামিল করছে। আর ভুল হলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকছে, যতক্ষণ না সে ঠিক হুকুমটা ভেবে বের করে।

ঘনকটাও আসলে ছিল একটা শেখাবার খেলনা। স্কটকে সেটা খুব তাড়াতাড়ি, ভারী মজা করে করে শিখিয়ে দিচ্ছিল অনেক কিছু। কিন্তু সে শুধু মনকে সঠিক পথে চালাবার শিক্ষা। আসল জ্ঞান তাকে তখনও সে কিছু দেয়নি। এখনও সে তৈরি নয়। পরে—আরও পরে—

খানিক বাদে অ্যাবাকাস নিয়ে খেলা শেষ করে এমা স্কটের ঘরে গেল তার খোঁজে। স্কট সেখানে নেই। এদিক-সেদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ এমার চোখ পড়ল স্কটের আলমারিটার খোলা দরজার দিকে। সেখানে একটা বাক্স রাখা। তাতে সাত রাজার ধন। প্রথমেই পাওয়া গেল একটা পুতুল। স্কট সেটা দেখেও নাক সিঁটকে সরিয়ে রেখেছিল।

পুতুলটা নিয়ে খিলখিল করে হাসতে হাসতে এমা এক ছুটে নিচের ঘরে এসে মেঝের ওপর থেবড়ে বসে সেটাকে ভেঙেচুরে দেখবার কাজ শুরু করে দিল।

“এমা, ওটা কী রে?”

“এইতা? এইতা হল ভালুকদাদা।”

পুতুলটা মোটেই এমার ভালুকদাদা নয়। ভালুকদাদা অন্ধ, তার কান দুটো ছেঁড়া, সে তুলতুলে নরম। তবে এমার কাছে সমস্ত পুতুলের একটাই নাম—ভালুকদাদা।

জেন পারাদিন একটু ইতস্তত করছিল, “কার থেকে পেলি রে এটা? কোনও বন্ধুর থেকে নিয়ে আসিসনি তো?”

“না না। ওটা আমার।”

কথা চলতে চলতেই স্কট ঘনকটা পকেটে পুরে তার লুকানো জায়গাটা থেকে বের হয়ে এসেছে, “ওটাও হ্যারিমামা এনে দিয়েছে মা।”

“এমা, এটা হ্যারিমামা তোকে দিয়েছে?”

স্কট তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে এল, “না না। হ্যারিমামা ওটা আমায় দিয়ে এমাকে দিতে বলেছিল তো! গত রোববার।”

“এহে, ভেঙে ফেলছিস কেন এত সুন্দর খেলনাটা?”

এমা তাড়াতাড়ি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আলাদা করে ফেলা খেলনাটা তার মায়ের দিকে তুলে ধরল, “ভাঙিনি মা। এইতা তো এমনি এমনি তুকরো হয়ে যায়!”

“তাই বুঝি? এ—কী? —অ্যাঃ,” হঠাৎ জেন একটু শিউরে উঠল জিনিসটা হাতে নিয়ে।

পারাদিন সঙ্গে সঙ্গে সেদিকে ফিরে তাকাল, “কী হল জেন?”

জেন বস্তুটাকে পারাদিনের দিকে একবার তুলে ধরে দেখিয়ে চোখের ইশারা করে খাবার ঘরে ঢুকে গেল। তার পেছন পেছন সে ঘরে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল পারাদিন। জেন ততক্ষণে টুকরো টুকরো করে ফেলা পুতুলটাকে খাবার টেবিলের ওপর রেখেছে।

“জিনিসটা বেশ বিশ্রী, তা-ই না ডেনি?”

“হুম্–ম্!”

প্রথম নজরে জিনিসটা বেশ বিশ্রীই ঠেকে। ডাক্তারি কলেজের অ্যানাটমির ডামি হলে নয় ঠিক ছিল। কিন্তু ছোটদের খেলনায় এসব—

পুতুলটার প্রত্যেকটা অঙ্গ আলাদাভাবে খুলে আসে। চামড়া, বিভিন্ন পেশি, শরীরের ভেতরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছোট ছোট, কিন্তু একেবারে নিখুঁতভাবে তৈরি। “বিশ্রী ঠিক নয় জেন, আসলে তোমার কাছে বাজে ঠেকলেও ছোটদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে—”

“যকৃৎটা দেখ! ওটা–ওটা যকৃৎই তো? নাকি—”

“হ্যাঁ হ্যাঁ যকৃৎ। সন্দেহ নেই। কিন্তু—ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো?”

“ইন্টারেস্টিং বলতে?”

পারাদিন একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল, “জিনিসগুলো ঠিকঠাক বানায়নি, বুঝলে? শুধু যকৃৎটাই অদ্ভুত দেখতে তা নয়। এই যে এই দেখ, খাদ্যনালিটা অনেক ছোট। বৃহদন্ত্র নেই। অ্যাপেন্ডিক্স নেই।”

“এমার এটা নিয়ে খেলা কি উচিত হবে? এইসব নাড়িভুঁড়ি, হৃৎপিণ্ডটিণ্ড শরীর খুলে খুলে দেখা—”

“এটা দেখে তো আমারই খেলতে ইচ্ছে হচ্ছে গো,” পারাদিন মাথা নাড়ছিল, “এসব খেলনা হ্যারি যে কোত্থেকে খুঁজে পেতে জোগাড় করে আনে, কে জানে! না। আমার মনে হয় এটা এমাকে দিলে কোনও সমস্যা হবে না। দেখ জেন, আমরা বড়রা শরীরের ভেতরের যন্ত্রপাতি সামনাসামনি দেখলে অস্বস্তি পাই, কারণ ওইটে আমাদের কন্ডিশনিং। কিন্তু একটা শিশুর কাছে সেটা কোনও সমস্যা নয়। তা ছাড়া, ছোটরা নিজেদের শরীরের ভেতরটা আলু বা মাটির ঢেলার মতোই কিছু একটা ভাবে। এটা হাতে পেলে মানুষের শরীরের ভেতরটা কেমন দেখায়, সেটা এমা খানিক বুঝতে পারবে।”

“আচ্ছা—এই সুতো-সুতোমতন এই জ্বলজ্বলে জিনিসগুলো কী গো? নার্ভ?”

“উঁহু। এই যে। এগুলো নার্ভ। আর এই এগুলো হল শিরা, ধমনি। অ্যাওর্টাটা কেমন যেন অদ্ভুত গড়নের, তা-ই না?” পারাদিন আপন মনেই বলে যাচ্ছিল, “কিন্তু এই জালের মতো জিনিসটা—নার্ভতন্ত্র নয়, রক্তজালক নয়—অথচ ফুসফুস থেকে বেরিয়ে সারা গায়ে ছড়িয়ে আছে! দাঁড়াও—মিলিয়ে দেখি তো!”

খেলনাটা নিয়ে তারা দুজন মজে গিয়েছিল এরপর। পারাদিন বইয়ের তাক থেকে খুঁজেপেতে একটা অ্যানাটমিক্যাল চার্ট বের করে এনেছে। তা-ই নিয়ে তারা খেলনার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে চেনবার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। সেগুলো অনেকটাই চার্টে দেওয়া ছবিগুলোর তুলনায় অন্যরকম। ফলে চিনে চিনে মেলানোও বেশ কঠিন। তবে খেলাটা নিঃসন্দেহে বেশ মজার—

ইতিমধ্যে পাশের ঘরে এমা তখন অ্যাবাকাস থেকে একের পর এক পুঁতিকে অদৃশ্য করে চলেছে। খেলনাটা তাকে আর বিশেষ অবাক করছে না এখন। নিয়মগুলো বেশ সোজা তো। চেহারাটার মানেও বোঝা যাচ্ছে দিব্যি। কোন পথে কীভাবে গেলে কোথায় পৌঁছাবে পুঁতিগুলো, সেটা বুঝতে আর বিশেষ সমস্যা হচ্ছিল না তার।

ওদিকে স্কট তখন তার কাচের ঘনকের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে খানিক আগে আগুনে পুড়ে যাওয়া বাড়িটার চাইতে অনেক জটিল একটা বাড়ি তৈরি করাবার চেষ্টা করে চলেছিল তার পুতুলদের দিয়ে। জটিল থেকে জটিলতর ভাবনাগুলোকে টেলিপ্যাথির পথে ঠিক জায়গায় ঠিকভাবে পৌঁছে দেবার শিক্ষা তার তখন দ্রুত এগিয়ে চলেছিল, তার নিজেরই অজ্ঞাতে—

একটাই ভুল করেছিল পারাদিন। গোটা ব্যাপারটাকেই সে মানুষের গড়া খেলনারহস্য হিসেবে ধরে নিয়েছিল। খেলনাগুলোকে সে সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি থেকে বিদেয় করেনি তাই। ওদের গুরুত্ব সে বোঝেনি। যখন বুঝেছিল, ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। হ্যারি শহরের বাইরে থাকায় তার কাছ থেকেও স্কটের কথাগুলো যাচাই করতে পারেনি সে।

এর দু-একদিনের মধ্যে তার ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। সারাটা দিন গাধার মতো খেটে বাড়ি ফিরে মড়ার মতন ঘুম। জেনেরও মধ্যে শরীরটা খারাপ রইল ক-দিন। সব মিলিয়ে স্কট আর এমার হাতে তখন পূর্ণ স্বাধীনতা।

“বাবা, ‘সূর্যকাঁটা’ কাকে বলে?”

“সূর্য কাঁটা? মানে সেই আজটেকদের গল্প?”

“হতে পারে, কিন্তু—” স্কট একটু ইতস্তত করল, “সূর্যকাঁটা কি তাহলে ভুল শব্দ?”

“কোনও গাছের কাঁটাটাঁটা হবে। দাঁড়া, ডিকশনারি দেখে—”

“উঁহু—তা নয়, তা নয়—” বলতে বলতে স্কট ভুরু দুটো কুঁচকে ঘরের দিকে চলে গেল। এমা আর সে সাধারণত তাদের নিজেদের ঘরের ভেতর লুকিয়েই খেলাধুলো চালায়। বাবা-মা-র সামনে কে খেলবে? ধুস। বিশেষ করে খেলনাগুলো নিয়ে এখন তারা যে কঠিন খেলাগুলো খেলে, সেগুলো তো বড়দের একেবারেই দেখানো যাবে না। বুঝবেই না কিছু।

স্কট এখন খুব তাড়াতাড়ি শিখছে সবকিছু। শুরুতে কালো ঘনকটা যে সাদাসিধে খেলা দিয়েছিল তাকে, এখন আর সেসব খেলা তার ভেতরে নেই। তার জায়গা নিয়েছে অনেক জটিল হিসেব, অনেক মাথা গুলিয়ে দেওয়া ধাঁধালো কাজ। গোটা ব্যাপারটাই যেন একটা মহা উত্তেজক গেম তার কাছে। সেভাবেই শিক্ষা প্রোগ্রামটা তৈরি অবশ্য। কোনও শিশু যদি টের পায়, একটা যন্ত্র আসলে তাকে কিছু জটিল বিদ্যা শিখিয়ে-পড়িয়ে নিচ্ছে তাহলে সে আর তার ধারেকাছে আসবে না।

অবশ্য জেন আর পারাদিন তাদের সেইসব শিক্ষাদীক্ষার বিন্দুমাত্র আন্দাজ -ও পেল না। পাবেই বা কেমন করে? ছোটরা জাত অভিনেতা। বড়দের দুনিয়া -টার সঙ্গে এখন তাদের তেমন করে আলাপ নেই। বড়দের মাথা–গোলানো কাজকর্ম তাদের সোজাসাপটা যুক্তির নাগালের বাইরে। একজন বড় হয়তো হুকুম দিল, কাদা নিয়ে খেল, তখন আরেকজন এসে বলবে, খেল, তবে কাদা মাখতে পাবে না, আর তিন নম্বর জন এসে সটান বলে দেবে, কাদা ঘাঁটা বেজায় খারাপ কাজ। করলেই শাস্তি। অথচ এরাই তাদের খাওয়া–পরার মালিক। এদের খুশি করে না রাখতে পারলে হাজারো সমস্যা আসবে। ছোটরা তাই বড়দের সামনে তাদের নিজেদের আসল ভাবনাচিন্তাগুলো লুকিয়ে রেখে ভারী আদুরে, ভোলাভালা ভাব করে থাকে। আর আড়ালে ঠিক নিজেদের কাজটা করে যায়। সেসব কথা জানতে পেলে বড়রা সেসব কাজের থই পাবে না।

তার কারণ ছোটরা আলাদা। তাদের ভাষা আলাদা। তাদের হাতে কাগজ- পেনসিল দিলে তারা তাদের ভাষায় যে হাতি আঁকবে, সেটা বড়দের ভাষায় গড়া হাতির মতো নয় একেবারেই। ইংরেজি-জানা একজন মানুষের চোখে চিনে ভাষায় লেখা হাতি শব্দটা যতটা দুর্বোধ্য, ততটাই দুর্বোধ্য হয় বড়দের কাছে একটি শিশুর আঁকা হাতি। অথচ শিশুটির কাছে সে দাগগুলো তো হাতিই বোঝায়! যেমন চিনে ভাষা জানা কোনও মানুষের কাছে সে ভাষায় লেখা শব্দটা অর্থবহ হয়ে ওঠে।

সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকে সে। তার নতুন চোখ সামাজিক কন্ডিশনিং–এর হাত থেকে মুক্ত থাকে। নতুন কোনও জিনিস সে তাই অনেক তাড়াতাড়ি শিখে নেয়। সহজেই দেখতে পেয়ে যায় যে কোনও ব্যাপারের পেছনকার আসল সত্যিটাকে। তাই সে রাজাকে উলঙ্গ বলে দিতে পারে মুখের ওপরে। তারপর যত বয়স বাড়ে, তত তার চোখ ঘোলাটে হয়ে আসে নানান মুখোশের চাপে।

সম্ভবত সেই কারণেই খেলনাগুলো থেকে দু-বছুরে এমা যতটা বেশি শিখতে পারছিল সাত-বছুরে স্কট ততটা নয়। তবে হ্যাঁ, স্কট টেলিপ্যাথির পথে নিজের চিন্তাভাবনাগুলো প্রকাশ করতে শিখে গেলেও এমা তখনও সেটা পারে না। সে তার মনের ভাব জানায় শুধুই গলার শব্দ কিংবা কাগজের বুকে তার আঁকিবুকির নিজস্ব ভাষায়।

সে দিন সন্ধেবেলা পারাদিন পরীক্ষার খাতা দেখছিল। স্কট আর এমা মেঝেতে বসে খেলছে। মাঝে মাঝেই খাতা ফেলে পারাদিন তাদের কথাবার্তা শুনছিল। স্কট বোনকে কী সব প্রশ্ন করছে। কথাগুলো মাঝে মাঝে ইংরেজি, আবার মাঝে মাঝেই সেগুলো একেবারে মাথামুণ্ডুহীন কিছু শব্দে বদলে যাচ্ছিল।

এমা জবাব দিতে চেষ্টা করছে, কিন্তু ঠিক করে কিছু বলতে পার না। শেষমেশ স্কট উঠে গিয়ে ঘর থেকে একটা কাগজ–পেনসিল এনে ধরে দিল বোনের সামনে। এমাও অমনি তার গায়ে কী একটা লিখে দিল অনেক কষ্টে পেনসিলটা ধরে। কাগজটা একনজর দেখে ভুরু কুঁচকে স্কট বলে, “হয়নি এমা।”

এমা একটু ঘাবড়ে যাওয়া মুখ করে ফের কাগজটা নিয়ে তার গায়ে আরও কিছু লিখল যেন। এবারে কাগজটা নিয়ে স্কট খানিকক্ষণ দেখল। তারপর উঠে ঘর ছেড়ে চলে গেল।

পারাদিন তাড়াতাড়ি উঠে এসে কাগজটায় চোখ বুলিয়ে দেখল একবার। নাঃ, ইংরেজিটেজি কিছু নয়! গোটা কাগজটা জুড়ে শুধু এমার এলোমেলো দু-বছুরে আঁকিবুকি। দেখে মজা পেয়ে ঘাড় নাড়ল সে একবার। তার কাছে জিনিসটার কোনও অর্থ নেই। রেলগাড়িও হতে পারে, কিংবা কোনও পাগল আরশোলার ইইজি-র গ্রাফ। কিন্তু শিশু মনস্তত্ত্ব তাকে যেটুকু পড়তে হয়েছে, তাতে সে জানে, এমার কাছে দাগগুলোর নির্দিষ্ট মানে আছে একটা। হয়তো তার কাছে ওর অর্থ হল তার ভালুকদাদা।

খানিক বাদে স্কট ফিরে এসে এমার দিকে তাকিয়ে ঘাড় ঝাঁকাল একবার। দেখে পারাদিন এক গাল হেসে বলে, “কোনও গোপন কথা নাকি?”

“উঁহু। এমা আমায় জিনিস দেখে আসতে লিখল তো! সেইটা—”

এইবার একটু অবাক ঠেকছিল পারাদিনের। স্কট এত স্বাভাবিকভাবে কথাটা বলল যে—

—এমার আঁকিবুকিগুলো কি সত্যি সত্যি স্কটের কাছে তার মনের ভাবটাকে খুলে ধরতে পেরেছে? সে ক্ষেত্রে নকশাগুলো এলোমেলো কিছু হবে না। কিন্তু—!!! পারাদিনের পণ্ডিতির কৌতূহলটা জেগে উঠছিল একটু একটু করে।

শিশুদের ভাষা নিয়ে গবেষণা তো কম হয়নি পণ্ডিতসমাজে!

কী মনে হতে কাগজটা পকেটে করে পরদিন ইউনিভার্সিটির ভাষাতত্ত্ব বিভাগে গিয়ে এলকিনসকে দেখাল পারাদিন। এলকিনসের সাংকেতিক ভাষাবিজ্ঞানে গভীর জ্ঞান। কাগজটা খানিক পরীক্ষানিরীক্ষা করে এলকিনস হা-হা করে হেসে বলে, “মানেটা বুঝতে পেরেছি। ওতে লেখা আছে, বাবাকে কেমন বুদ্ধু বানালাম!” পারাদিন আর কিছু জবাব দিল না। ছেলেমেয়েগুলো কী যে দুষ্টু হয়ে উঠছে দিনকে দিন!

ঘটনাটা পারাদিনের অনেক পরে মনে পড়েছিল। মনে পড়েছিল হলওয়ের সঙ্গে দেখা হবার পর। তবে ততদিনে ব্যাপারটা আরও অনেক দূর এগিয়ে গেছে।

এর কিছুদিন পর থেকে স্কট আর এমা খেলনাগুলো নিয়ে বাবা-মা-র সামনে খেলা একেবারে বন্ধ করে দিল। জিনিসগুলো তারা লুকিয়ে রাখে। বাপ–মা এলাকায় না থাকলে সেগুলো বের করে নিজের মনেই খেলে।

তবে ব্যাপারটা জেনের নজর এড়ায়নি। মনের ভেতর একটা অস্বস্তি কাজ করছিল তার। একদিন হঠাৎ পারাদিনকে ডেকে সে বলল, “হ্যারির দেওয়া পুতুলটার কথা মনে আছে?”

“হুঁ। আবার কী হল?”

“কিছু না। আজ মার্কেটিং-এ গিয়ে কয়েকটা দোকানে খোঁজ নিলাম, কেউ কিছু বলতে পারল না।”

“নিউ ইয়র্ক থেকে কিনে এনেছিল হয়তো।”

জেন দেখা গেল তাতে খুশি নয়। বলে, “সব বড় ব্র্যান্ডের খেলনার লিস্ট দেখাতে বললাম। ওই অ্যাবাকাসটার মতো কোনও কিছুই পেলাম না তাতে।”

“হুম।”

পারাদিন খুব একটা আগ্রহ দেখাল না বিষয়টা নিয়ে। সন্ধেবেলা সে দিন তাদের সিনেমার টিকিট কাটা ছিল। শো-এর সময় হয়ে গিয়েছে তখন।

ক-দিন বাদে অবশ্য ব্যাপারটা ফের ঘুরে এল। এবার পাশের বাড়ি থেকে একটা টেলিফোন পেল জেন।

“স্কটিটা তো এরকম ছিল না ডেনি। মিসেস বার্নস বলছিলেন, ও নাকি ওঁর ফ্রান্সিসকে বেজায় ভয় দেখিয়েছে কাল।”

“মানে?”

“স্কটি নাকি ফ্রান্সিসকে কী একটা দেখিয়েছে আর তাতে সে ভয়টয় পেয়ে অস্থির। তুমি বরং ব্যাপারটা একবার—”

“দাঁড়াও, দেখছি। স্কটি?”

“দুম!” বলে হাসতে হাসতে স্কট উদয় হল পাশের ঘর থেকে, “সব ক-টা মহাকাশ-দস্যু খতম। আমায় ডাকছ নাকি বাবা?”

“হুঁ, ডাকছি। মহাকাশ-দস্যুগুলোকে কবর দেবার কাজটা রেখে আগে একটা কথার জবাব দে দেখি। ফ্রান্সিস বার্নসের সঙ্গে কী হয়েছে রে তোর?”

স্কটি বেজায় ভালোমানুষের মতো মুখ করে বলল, “কই? না কিচ্ছু তো!”

“‘না কিচ্ছু’ নয় স্কটি, কথাটা হল কিচ্ছু না।” জেন বাধা দিয়ে বলল।

“হ্যাঁ। কিচ্ছু না। আমি তো শুধু ওকে আমার টেলিভিশন সেটটা দেখালাম। আর ও অমনি ভয় পেয়ে গেল।”

“টেলিভিশন সেট? তোর?”

স্কট তার কালো কাচের ঘনকটা বের করে পারাদিনের সামনে ধরল, “এই যে। টেলিভিশান সেট।”

পারাদিন জিনিসটা হাতে নিয়ে দেখল। ভেতরে কতকগুলো জটিল জ্যামিতিক নকশা ভাসছে তার।

“এটা পেলি কোত্থেকে তুই?

“হ্যারিমামা—”

পারাদিন টেলিফোনের দিকে হাত বাড়াল। স্কট ঘাবড়ে গিয়ে বলে, “হ্যারিমামা—ফিরে এসেছে?”

“হ্যাঁ।”

“আমি স্নান করতে যাই।” বলতে বলতে স্কট দরজার দিকে পা চালিয়ে দিল। পারাদিন জেনের সঙ্গে চোখাচোখি করল একবার।

দুই

হ্যারিকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, খেলনাগুলোর বিষয়ে সে কিছুই জানে না। পারাদিন এবার গম্ভীরভাবে স্কটকে তার সব খেলনা বের করে আনতে বলল। শেষমেশ টেবিলের ওপর ঘনক, পুতুল, হেলমেটের মতো টুপি আর আরও কিছু অদ্ভুতুড়ে জিনিসপত্র লাইন করে সাজানো হবার পর স্কটকে জেরা করা শুরু হল। খানিক এটা–ওটা বলে অবশেষে জেরার মুখে স্কটের সব গোপন কথা ফাঁস হয়ে গেল।

“যে বাক্সটায় এগুলো পেয়েছিস, সেটা এখানে নিয়ে আয়। তারপর সটান ঘুমাতে যা।” পারাদিন গম্ভীর গলায় আদেশ দিল।

“আমায় তুমি পানিশমেন্ট দেবে নাকি বাবা?”

“মিথ্যে কথা বলবার জন্য শাস্তি তো পেতেই হবে। দু-সপ্তাহ টিভি দেখা আর সোডা খাওয়া বন্ধ তোমার।”

“আর খেলনাগুলো? ওগুলো আর ফেরত দেবে না?”

“এখনও ঠিক নেই। ভেবে দেখতে হবে।”

স্কট চলে যাবার পর পারাদিন বাক্সটাকে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখল। জায়গায় জায়গায় ওর গায়ের যন্ত্রপাতিগুলো গলে গেছে একেবারে।

“জিনিসটা কী ডেনি?”

“জানি না। খালের মধ্যে এক বাক্স খেলনা কে ফেলে যেতে পারে বল দেখি?”

“কোনও গাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে থাকলে—”

“ওখানটা দিয়ে গাড়ির রাস্তা যায় না জেন।”

জেনের চোখে একটু ভয়-ভয় ভাব ঘিরে আসছিল, “চিন্তার কিছু নেই তো?”

“উঁহু, শুধু ভাবছি, খেলনাগুলো এল কোথা থেকে?”

“আমিও তো তা-ই ভাবছি। কোনও কোম্পানিই তো ওসব বানায় না। আমি খবর নিলাম সে দিন—”

“খোঁজ আমিও কিছু নিয়েছি, বুঝলে?” পারাদিন নিজের মনেই বলল। তারপর পুতুলটাকে খোঁচা দিতে দিতে বলে, “বোধহয় কারও অর্ডারি মাল।”

“কোনও সাইকোলজিস্টের জিনিস? ওরা এইরকম অ্যাবাকাসটাস নিয়ে মানুষকে পরীক্ষা করে না?”

পারাদিন হাতের আঙুল মটকাল একবার, “সাইকোলজিস্ট! দাঁড়াও দাঁড়াও, একটা বুদ্ধি এসেছে। হলওয়ে নামে এক চাইল্ড সাইকোলজিস্ট আগামী সপ্তাহে লেকচার দিতে আসছে ইউনিভার্সিটিতে। নামকরা লোক। সে যদি কিছু বলতে পারে!”

“হলওয়ে? আমি তো—”

“রেক্স হলওয়ে। কাছাকাছিই থাকে। ও–ই হয়তো অর্ডার দিয়ে—”

“দেখ খোঁজ করে।” বলতে বলতে অ্যাবাকাসটায় একবার হাত ঠেকিয়েই মুখটা বিকৃত করে হাতটা সরিয়ে নিল জেন।

তিন

সপ্তাহখানেক বাদে পারাদিন রেক্স হলওয়েকে বাড়িতে ডিনারে নিয়ে এল। মানুষটা বেশ গোলগাল, টাক মাথা, জোড়া ভুরু। ভদ্রলোক স্কট বা এমার সঙ্গে কথাবার্তা বললেন না বিশেষ, কিন্তু তাদের একটা নড়াচড়াও তাঁর তীক্ষ্ণ নজরকে এড়িয়ে যাচ্ছিল না।

ডিনারের পর বাচ্চারা শুতে গেলে খেলনাগুলো খুঁটিয়ে দেখে বেশ অবাকই হলেন হলওয়ে। তারপর পারাদিন আর জেনের কথা শুনতে শুনতেই সেগুলোকে নেড়েচেড়ে দেখলেন অনেকক্ষণ।

“এখানে এসে আজ খুব ভালো হল, বুঝলেন? ব্যাপারটা বেশ চিন্তার।”

“মানে?” পারাদিন আর জেন একসঙ্গে বলে উঠল।

“এখানে একটা পাগলামোর আভাস আছে।” কথাগুলো বলেই পারাদিন আর জেনকে চমকে উঠতে দেখে একটু হাসলেন তিনি, “ঘাবড়াবার কিছু নেই। প্রাপ্তবয়স্ক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সব শিশুই খানিক পাগল। হিউজেসের ‘হাই উইন্ড ইন জামাইকা’ বইটার কথা জানা আছে?”

“আমার কাছে আছে,” বলতে বলতে পারাদিন উঠে গিয়ে তাক থেকে বইটা এনে টেবিলে রাখল।

তার পাতা ওলটাতে ওলটাতে এক জায়গায় এসে থেমে গিয়ে হলওয়ে বললেন, “এই যে, এইখানটা। পড়ে শোনাই—”

“শিশুরা সঠিক অর্থে মানুষ নয়। তারা মনুষ্যেতর। বেড়াল, কুকুর, মাছ বা সাপের মতোই, একটা প্রবৃত্তিগত সংস্কৃতি সঙ্গে নিয়ে তারা জন্মায়। তবে তার ক্ষেত্রে সে সংস্কৃতি অনেক বেশি উচ্চকিত, অনেক বেশি জটিল। সেটা স্বাভাবিক। কারণ উন্নততম মেরুদণ্ডী প্রজাতির সন্তান তারা। এককথায় শিশুদের মন যে পথে এবং যে নীতি মেনে কাজ করে, তাকে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের চিন্তাধারা ও নীতির ভাষায় অনুবাদ করা সম্ভব নয়।”

জেন অতশত গভীর তত্ত্ব বোঝার ধার ধারে না। খানিক ঢোক গিলে সে বলে, “আমার এমা তাহলে—”

“ম্যাডাম, একটা কথা বলুন দেখি। আপনার মেয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে কোনও ভাবনাচিন্তা কি আপনি করতে পারবেন? এই যে শুনুন—‘একটা শিশুর দৃষ্টিকোণ থেকে তার মতো করে ভাবার চেষ্টা করা আর একটা মৌমাছির মতো করে ভাবার চেষ্টা করা একই কথা।’”

পারাদিন ককটেল বানাচ্ছিল। সেটা করতে করতেই গলা তুলে বলে, “একটু তাত্ত্বিক হয়ে যাচ্ছে নাকি ব্যাপারটা? আপনার তত্ত্ব হল, শিশুদের একটা আলাদা, দুর্বোধ্য সংস্কৃতি থাকে। সে সংস্কৃতিতে উঁচুদরের বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগও করে তারা, তা-ই তো?”

“উঁচুনিচু জানি না। ওগুলো মাপজোক করবার কোনও রাস্তা আমাদের হাতে নেই। তা ছাড়া ‘দুর্বোধ্য’ আপেক্ষিক শব্দ। আমি বরং বলব, হ্যাঁ—অন্যরকম—সেটা বলা যেতেই পারে।”

“বাজে কথা। শিশুদের চেতনা আমাদের চাইতে আলাদা কিছু নয়।”

“আলাদা কে বলল? আমি শুধু বলতে চাইছি, তারা তাদের মনকে একেবারে অন্যভাবে ব্যবহার করে।”

“ব্যাপারটা আমি একটু একটু ধরতে পারছি। আমার মিক্সিটা দিয়ে আমি আলুসেদ্ধ, ময়দা—এসব মাখি। তবে চাইলে ওতে কমলার রসও বের করা যায়।” জেন বলে উঠল হঠাৎ।

“অনেকটা তা-ই। মস্তিষ্ক একটা জটিল যন্ত্র। ওর কতটা কী ক্ষমতা তা এখনও আমরা ভালো করে জানি না। তবে এইটুকু জানা গেছে, মানুষের শিশু যখন বড় হয়, তখন তার মন ক্রমাগত কন্ডিশন্‌ড হতে থাকে। বড় হয়ে ওঠবার পথে কয়েকটা চেনা স্বতঃসিদ্ধ শিশুর স্মৃতিতে গেঁথে দেওয়া হয়। তারপর তার ওপর ভিত্তি করে তার সমস্ত চিন্তাভাবনা গড়ে ওঠে। যেমন ধরুন এইটা—” বলতে বলতে হলওয়ে অ্যাবাকাসটা টেনে আনলেন সামনে। “এটা নেড়েচেড়ে দেখেছেন?”

“একটু-আধটু,” পারাদিন জবাব দিল।

“তার বেশি নয়, তা-ই তো? কেন?”

“কোনও মানে নেই বলে। যে কোনও পাজ্‌লের পেছনে একটা যুক্তি থাকে। কিছু নিয়ম থাকে। কিন্তু এর উদ্ভট, অর্থহীন কোণগুলোর কোনও নিয়ম নেই।”

“দেখুন প্রফেসর, আপনার–আমার মন ইউক্লিডকে ধ্রুব জেনে বড় হয়েছে। কাজেই ইউক্লিড না-মানা এ জিনিসটা আমাদের কাছে অর্থহীন ঠেকবেই। কিন্তু একটা শিশু? সে তো ইউক্লিডকে পড়েনি। তাকে ধ্রুব সত্য বলে তার মনকে কন্ডিশনও করেনি সমাজ এখনও। কাজেই আমাদের চেনা ছকের বাইরের একটা সম্পূর্ণ আলাদা, নন–ইউক্লিডীয় জ্যামিতি তার কাছে অযৌক্তিক না–ও লাগতে পারে, তা-ই না?”

“নন–ইউক্লিডীয় জ্যামিতি? আপনি কি বলতে চাইছেন, খেলনাটার কোন চতুর্মাত্রিক অংশ আছে?”

“আহা, তা বলছি না। নেই যে, সেটা তো দেখাই যাচ্ছে। আমি শুধু বলতে চাইছিলাম, আমাদের ইউক্লিড-প্রভাবিত মন যেখানে কিছু এলোমেলো তারের বোঝা দেখছে, সেখানে একটা শিশু তাতে হয়তো কোনও পরিষ্কার নিয়মানুবর্তী নকশা দেখতেও পারে। শুরুতে নয়। শুরুতে সেটা তার কাছেও একটা ধাঁধাই থাকবে। কিন্তু সে ধাঁধার সমাধান করতে গিয়ে বড়দের মতো ইউক্লিডীয় কন্ডিশনিং-এর বাধাটা তার সামনে দেওয়াল হয়ে দাঁড়াবে না।”

“আপনি কি বলতে চাইছেন, একটা শিশু আইনস্টাইনের চেয়ে ভালো ক্যালকুলাস বুঝে ফেলতে পারে?” পারাদিন ঝাঁজিয়ে উঠেই চুপ করে গেল ফের। হলওয়ে মোটেই তা বলতে চাননি। আসলে ভেতরে জমে উঠতে থাকা একটা অস্বস্তি তাকে রাগিয়ে তুলছিল সেই মুহূর্তে। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, “স্যরি, আপনি যা বলতে চাইছেন, সেটা আমি একটু একটু বুঝতে পারছি।”

“আরেকটু ভেঙে বলি তাহলে, ধরুন দুনিয়ায় দু-ধরনের জ্যামিতি আছে। তার একটা হল চিরপরিচিত ইউক্লিডীয় জ্যামিতি। তার কিছু মৌলিক স্বতঃসিদ্ধ আছে। অন্য জ্যামিতিটার নাম ধরা যাক ‘ক’ জ্যামিতি। ইউক্লিডের সঙ্গে তার কোনও মিল নেই। তার মৌলিক স্বতঃসিদ্ধগুলো, তার উপপাদ্যরা সবই আলাদা। তার অঙ্কে দুই আর দুই মিলে চারের বদলে অন্য কিছু হয়। আমরা যেহেতু ইউক্লিডে কন্ডিশন্‌ড, তাই আমরা তাকে বুঝতে পারব না। কিন্তু একটা শিশুর মন যেহেতু সে কন্ডিশনিং-এর খাঁচায় বন্দি নয়, দুটোর কোনওটাকেই সে জানে না, তাই তার সামনে যেটা প্রথম আসবে, সেটাকেই সে সত্য বলে বুঝবে। তাকে ইউক্লিডের জ্যামিতি শেখাতে শুরু করুন—”

“আহা, বেচারা শিশু—” জেন টিপ্পনী কাটল।

হলওয়ে কড়া চোখে তার দিকে দেখে নিয়ে বললেন,“জ্যামিতি বলতে শুরুতে শুধু কিছু প্রতীক। আমাদের ভাষায় বর্ণমালা, সংখ্যা। ইউক্লিডীয় জ্ঞানের ভিত্তি। অঙ্ক, জ্যামিতি সব আসবে তাতে ভর করে। অন্য দিকে ‘ক’ জ্যামিতির জ্ঞানের ভিত্তি দিয়ে তার শিক্ষা শুরু করুন—”

“তার বর্ণমালা? তার কী হবে?”

অ্যাবাকাসটাকে হাতে নিয়ে তার পুঁতির সজ্জাগুলোর দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন হলওয়ে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “আমরা তাকে বর্ণমালা বলে বুঝব কী করে পারাদিন? আমাদের চেতনা তো ইউক্লিডীয় কন্ডিশনিং-এর হাতে বন্দি!!!”

“তাহলে কে এর হাতে বন্দি নয়? কে বানাল এগুলো?” জেন উত্তেজিত গলায় বলে উঠল হঠাৎ, “জিনিসগুলো যখন ধরা–ছোঁয়া যাচ্ছে তখন ধরা–ছোঁয়া যায় এমন কোন মানুষ নিশ্চয় এদের বানিয়েছে। তারা-”

হলওয়ে মাথা নাড়লেন, “অসম্ভব নয়।”

“কোথায়?”

“জানি না।”

“অতিমানব?”

“জানি না। দেখ পারাদিন, ফের সেই আপেক্ষিকতার সমস্যা। আমাদের মাপে হয়তো তারা কিছু কিছু দিক থেকে অতিমানব। আবার কিছু কিছু দিক থেকে হয়তো একেবারে জড়বুদ্ধি। বিষয়টা বড়-ছোটর নয়, ওরা অন্য রাস্তায় ভাবে। ওরা যা পারে, আমরা তা পারি না হয়তো, কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমরা পারি এমন অনেক কিছু ওরা পারবে না।”

পারাদিন পেঁচালো বাক্সটার গায়ের গলে যাওয়া যন্ত্রপাতিগুলোর গায়ে আস্তে আস্তে টোকা দিচ্ছিল। এবার বলে, “এ বাক্সটার উদ্দেশ্য কী হতে পারে?”

“কিছু একটা হবে নিশ্চয়।”

“জিনিস বয়ে আনা?”

“হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এটা যেখান থেকে এসেছে, সেখানে—”

“দুনিয়াটা অন্যরকম?”

“ঠিক তা-ই। অন্য ধর্মের স্থান বা সময় বা দুটোই—আমি জানি না। আমি

মনস্তত্ত্ববিদ। দুর্ভাগ্যবশত আমিও ইউক্লিডীয় নীতি কন্ডিশন্‌ড।”

“উদ্ভট জায়গা হবে নিশ্চয়,” জেনি উঠে দাঁড়াল হঠাৎ, “ডেনি, খেলনাগুলো বাড়ি থেকে দূর কর।”

“আমারও তা-ই ইচ্ছে।”

হলওয়ে কাচের ঘনকটা হাতে তুলে নিলেন, “বাচ্চাদের এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন?”

“হ্যাঁ। স্কট বলল, ওটার মধ্যে আগে লোকজন দেখা যেত। এখন ওতে কী দেখা যায়, সে নিয়ে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।”

“লোকগুলো কী করত, কিছু বলেছে?”

“নাকি একটা বাড়ি বানাত ওরা। তাতে আগুন ধরত, সেটা নেবাতে হত। আর কিছু বলতে পারেনি। তারপর আস্তে আস্তে লোকগুলো চলে গিয়ে কিছু জটিল নকশা—”

“হুম। তার মানে জিনিসটা আস্তে আস্তে এগোয়। সহজ থেকে কঠিন—কতদিন ধরে বাচ্চারা খেলছে এগুলো নিয়ে?’

“মাস তিনেক হবে।”

“যথেষ্ট সময়। আদর্শ একটা খেলনা। প্রথমে ছবি-টবি দেখিয়ে বাচ্চার আগ্রহ জাগাবে, সহজ পথে তাকে মূলনীতিগুলো শেখাবে, তারপর আস্তে আস্তে জটিলতর—”

“‘ক’–জ্যমিতি!” জেনের গলাটা কাঁপছিল একটু একটু।

“বাজে কথা!! এমা আর স্কট একদম স্বাভাবিক দুটো বাচ্চা,” ধমকে উঠল যেন পারাদিন।

“এই মুহূর্তে ওদের মন কোন পথে চলেছে, সে বিষয়ে কিছু—” কথাটা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন হলওয়ে। এভাবে বললে এরা ঘাবড়ে যেতে পারে।

একটু ভেবে নিয়ে শান্তভাবে পুতুলটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে তিনি হঠাৎ বললেন, “যেখান থেকে এগুলো এসেছে, সে জায়গাটার বিষয়ে কিছু আন্দাজ করা গেলে ভালো হত। তবে মুশকিল হল, সাধারণ মানুষের যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে তো আর সেটা করা যাবে না। সেখানকার জ্যামিতির শিক্ষায় গড়ে ওঠা মন ছাড়া তো আর সে জায়গাকে অন্য কেউ বুঝতেও পারবে না। আচ্ছা, এইটা ঠিক কী বলতে পারবেন?”

হলওয়ের হাতে একটা টকটকে লাল গোলক উঠে এসেছে। দু ইঞ্চি মতন ব্যাস। গায়ের ওপর একটা নব উঁচু হয়ে আছে তার।

“জানি না।”

“স্কট বা এমা বলতে পারবে?”

“সপ্তাহ তিনেক আগে এমা যখন এটা নিয়ে খেলতে শুরু করল, তার আগে আমি নিজেও এটাকে দেখিনি।” পারাদিন ঠোঁট কামড়াল, “তারপর স্কট ওটা নিয়ে পড়ল।”

“কী করছিল ওরা এটা নিয়ে?”

“সামনে উঁচু করে ধরে এলোমেলো আগুপিছু করে কেবল।”

“এলোমেলো? নাকি নন-ইউক্লিডিয়ান? শুরুতেই ওরা এটা বের করেনি। তার কারণ হতে পারে, তখন এটা দিয়ে কী করতে হবে, ওরা জানত না—যতক্ষণ না ওর ব্যবহারের শিক্ষাটা হচ্ছে ওদের।”

“কী ভয়ংকর!” জেন শিউরে উঠল একবার।

“ওদের কাছে নয়। আরেকটা কথা। এমার বয়স স্কটের চেয়েও কম। আমাদের এই দুনিয়ার কন্ডিশনিং ওর ওপরে আরও কম দিন কাজ করেছে। ফলে নতুন কন্ডিশনিং স্কটের চাইতে ওরই বেশি তাড়াতাড়ি গ্রহণ করা উচিত। খেয়াল করে দেখুন, ও–ই আগে এ জিনিসটা বের করেছে—”

হাতের গ্লাসটা হঠাৎ ঠক করে নামিয়ে রাখল জেন, “একবার বলছেন, আমাদের যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে বেশি কিছু আন্দাজ করা যাবে না, আবার অন্য দিকে সামান্য কিছু সূত্র থেকে সে কাজটাই করে ফেলবার চেষ্টা করছেন আপনি ডঃ হলওয়ে। সেটা—”

“আমি একজন শিশুমনস্তত্ত্ববিদ, জেন। আমি ঠিক সাধারণ মানুষ নই। এ খেলনাগুলোর গুরুত্ব আমার কাছে কতটা তা আপনি ভাবতে পারবেন না।”

“আপনি তো ভুলও হতে পারেন?”

“প্রার্থনা করি, তা-ই যেন হয়। ছেলেমেয়ে দুটোকে একটু পরীক্ষা করতে পারি কি?”

“জেন একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “কীভাবে?”

হলওয়ে কী করতে চাইছেন, সেটা ব্যাখ্যা করবার পর একটু শান্ত হল সে। তারপর সামান্য ইতস্তত করে বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু খেয়াল রাখবেন—” 
ডক্টর হলওয়ে একটু হাসলেন,“আমি ফ্র্যাংকেনস্টাইন নই ম্যাডাম। আমি একজন ডাক্তার। ছেলেমেয়ে দুটোর কোনও মানসিক ক্ষতি হয়ে থাকলে আমি সেটা সারিয়ে দিতে চাই।”

পারাদিন তার আঙুলের ফাঁক থেকে পাক খেয়ে উঠে যাওয়া ধোঁয়ার সুতোটার দিকে চোখ আটকে রেখেই বলল, “ঠিক কী ক্ষতির কথা ভাবছেন, তার একটা আন্দাজ দিতে পারবেন?”

“চেষ্টা করব—এইটুকুই এখন বলতে পারি। যদি সত্যিই মন দুটোকে অন্য পথে ঘুরিয়ে দেয়া হয়ে থাকে তাহলে তাদের, আমাদের চেনা পথে ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করতে হবে। আমি বলছি না চেনা পথটাই সেরা পথ। কিন্তু, আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে সেইটাই একমাত্র রাস্তা। স্কট আর এমাকে তো এই বিশ্বেই বসবাস করতে হবে, তা-ই না?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ। তবে আমার তো মনে হয়, তেমন কিছু চিন্তার কারণ নেই। দুজনের আচরণই তো বেশ স্বাভাবিকই ঠেকে।”

“বাইরে থেকে—হ্যাঁ। অস্বাভাবিক আচরণ করবার কোনও কারণ তো নেই। কিন্তু চিন্তা? মনোজগতে যে ওরা একেবারে অন্যপথে দুনিয়াকে দেখে না, সেটা আপনি নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন কি?”

“আমি ওদের ডাকছি।”

“ডাকুন। তবে আমার বিষয়ে ভয়–টয় দেখাবেন না। সাবধান হয়ে গেলে কাজ হবে না।”

এমা আর স্কটকে ডেকে আনবার পর হলওয়ে সঙ্গে সঙ্গেই তাদের কোনও প্রশ্ন করলেন না। আস্তে আস্তে স্কটকে কথাবার্তার মধ্যে টেনে আনলেন তিনি। মাঝে মাঝে খেলনাগুলোর বিষয়ে একটা–দুটো জরুরি শব্দ মিশিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে কথাবার্তার ধারাটা ঘুরিয়ে দিয়ে চললেন তাঁর অনুসন্ধানের বিষয়ের দিকে।

খানিক বাদে কথা চলতে চলতেই হলওয়ে অ্যাবাকাসটা তুলে নিয়ে বললেন, “এটা কী করে খেলে, আমায় একটু দেখাবে নাকি?”

“হ্যাঁ স্যার,” স্কট জিনিসটা হাতে তুলে নিল। আর তারপর জট-পাকানো তারগুলোর মধ্যে দিয়ে একটা পুঁতিকে এমন বিদ্যুৎগতিতে এদিক–সেদিক ঘূর্ণিপথে চলিয়ে নিয়ে গেল যে, শেষ অবধি সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল, নাকি হাতের কৌশলে সেটাকে সে গায়েব করে দিল—বোঝাই গেল না। তারপর—ফের একবার—

এবার জিনিসটা হাতে নিয়ে হলওয়ে একবার চেষ্টা করলেন, “এইভাবে?”

“উঁহু—পুঁতিটা ওইখানে যাবে—”

“এ–এইখানে? কেন? এটা তো—”

“তাহলে খেলাটা হবে। নইলে কিচ্ছুই হবে না, ব্যাস।”

কিন্তু হলওয়ে ইউক্লিডীয় কন্ডিশনিং-এর শিকার। কেন যে পুঁতিটাকে একটা তার থেকে অন্য একটা বিচিত্রভাবে বাঁকা তারের মধ্যে চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে, তার কোনও যুক্তি তাঁর মাথায় আসছিল না। আপাতদৃষ্টিতে সেটা একটা যুক্তিহীন এলোমেলো পদক্ষেপ। হলওয়ে এ–ও লক্ষ করেছিলেন, আগের বার স্কট যখন খেলাটা খেলছিল, তখন পুঁতিটাকে সে সে পথে চালায়নি। অন্য একটা রাস্তায় নিয়ে গিয়েছিল।

“আরেকবার করে দেখাও না?”

স্কট করে দেখাল। পরপর দুবার। হলওয়ে চশমার ফাঁকে চোখ পিটপিট করছিলেন। প্রত্যেকবার আলাদা পথ—আর প্রত্যেকবার তাঁর কাছে একেবারে যুক্তিহীন, এলোমেলো একটা পথে পুঁতিটাকে নিয়ে চলেছে ছেলেটা।

শেষমেশ কিছুই বোঝা গেল না। বিদায় নেবার সময় হলওয়ে দেখা গেল স্পষ্টতই খানিকটা বিপর্যস্ত।

“আমি কি আরও একবার আসতে পারি?”

“যখন খুশি,” জেন জবাব দিল, “আপনার কি এখনও মনে হচ্ছে—”

হলওয়ে মাথা ঝাঁকালেন, “ওদের মন যে স্বাভাবিক পথে কাজ করছে না, সেটুকু পরিষ্কার। ছেলেমেয়ে দুটো বুদ্ধিমান। তবে আমার দেখে-শুনে মনে হচ্ছে, ওরা যে যুক্তি বেয়ে ওদের সিদ্ধান্তগুলোয় পৌঁছাচ্ছে তা আমাদের বোধবুদ্ধির বাইরে। আর প্রত্যেকবারই আলাদা যুক্তির পথ বেয়ে ওরা একই ফলে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে। আমরা যেটাকে চোখে দেখা জ্যামিতির পথে ভাবছি, ওরা যেন সেটাকে কোনও ধরনের বীজগণিতের বিশ্লেষণের রাস্তায় ভাবছে। বুঝতে পারছি না— ”

“খেলনাগুলো নিয়ে কী করা উচিত?”

“ওদের নাগালের বাইরে রাখা উচিত। আমি ওগুলো ধার নিতে চাইব, যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে।”

সে রাতে পারাদিনের ঘুম হল না। হলওয়ের কথাগুলো তার মাথায় ঘুরছিল। বড়রা যেখানে জ্যামিতি দিয়ে ভাবছে, বাচ্চাগুলো সেখানে বীজগণিতের জাতের কোনও নীতি ব্যবহার করছে। ঠিক আছে। কিন্তু—জ্যামিতি যে উত্তরগুলো দিতে পারে না, বীজগণিত তা পারে! অনেক রাশি আছে, যা বীজগণিতে সুলভ হলেও জ্যামিতির নাগালের বাইরে!! তাহলে কি ওদের যুক্তিধারা এমন কিছু সিদ্ধান্তে ওদের পৌঁছে দিচ্ছে, যা বয়স্কদের ধরাছোঁয়ার বাইরে! তাহলে—

“ধুস!”

আওয়াজটা পেয়ে তার পাশে জেন নড়েচড়ে উঠল হঠাৎ, “তোমারও ঘুম আসেনি, না?”

“উঁহু। ছেলেমেয়ে দুটোকে দেখে আসি চল।”

বলতে বলতে বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে পারাদিন বাচ্চাদের ঘরে উঁকি দিল একবার। দুটোতেই ঘুমাচ্ছে। এমা তার ভালুকদাদাকে জড়িয়ে শুয়ে।

জেন তার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ বলে, “আহা রে। ফুলের মতো দুটো শিশু। হলওয়ে ওদের পাগল বলল! ডেনি, আমার মনে হয় আমরা বড়রাই আসলে পাগল।”

হঠাৎ ঘুমের মধ্যে নড়েচড়ে উঠল স্কট। জড়ানো গলায় কিছু একটা প্রশ্ন করল। উলটো-পালটা কিছু অর্থহীন শব্দ। জবাবে ঘুমের মধ্যেই এমা তীক্ষ্ণ গলায় একটা মিউ মিউ শব্দ করে উঠল।

দুজনেই ঘুমিয়ে কাদা। শুধু পারাদিনের যেন মনে হল, ঘুমের মধ্যে স্কট কিছু একটা জিজ্ঞাসা করেছে এমাকে। আর সে তার জবাবও দিয়েছে অবোধ্য ওই ভাষায়। তার ভেতরে কেমন একটা কাঁপুনি গড়ে উঠছিল। এতটাই বদলে গেছে ওরা যে, এমনকী ঘুমেরও সংজ্ঞা পালটে গেছে ওদের?

একরকম জোর করেই চিন্তাটাকে সরিয়ে দিল সে। “ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার জেন। চল শোবে।”

জেন কিছু বলল না। পরে ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে খানিক কাঁদল শুধু।

স্কট ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু তার মন খুব আস্তে আস্তে কাজ করছিল। এইভাবে—

“ওরা আমাদের খেলনাগুলো নিয়ে যাবে। মোটকা লোকটা গালুমভের বিপজ্জনক হতে পারে—কিন্তু শিথলে দিকের রাস্তাটা ও দেখতে পাবে না—মোমতারাগুলোর কাছে সে পথ নেই—ভুরপিকাটাকুলি, ঝকমকে। এমা। ও এখন খোপ্রানিক স্তরে উঠে গেছে, কিন্তু আমি এখনও বুঝতে পারছি না, দাবারার লিজেরি দিস্তটা কেমন করে—”

স্কটের চিন্তার একটু-আধটু তখনও বোধগম্য রয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এমার কন্ডিশনিং ততদিনে আরও বেশ এগিয়ে গেছে। সে–ও ঘুমের মধ্যেই ধীর চেতনায় ভাবছিল—শিশুর মতো নয়, বয়স্কের মতো নয়, কোনও মানুষের মতোই নয়। অথবা হয়তো এমন কোনও মানুষের মতো, যারা হোমো সেপিয়েন্স পরিবারের সদস্যই ছিল না কখনও! মাঝে মাঝে স্কটও তার চিন্তাভাবনাগুলোকে ঠিকঠাক অনুভব করতে পারে না আজকাল।

হলওয়ে মাঝখান থেকে এভাবে এসে না পড়লে হয়তো ওদের জীবনটা ফের স্বাভাবিক খাতেই বইত এরপর থেকে। খেলনাগুলো পারাদিনরা সরিয়ে নিয়ে হলওয়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এমা ফের ফিরে গিয়েছিল তার পুতুলখেলার দুনিয়ায়। স্কট তার বেসবল খেলা আর কেমিস্ট্রির ‘নিজে কর’ কিট নিয়ে দিব্যি মজে ছিল। আর পাঁচটা বাচ্চার মতোই ফের দিন কাটানো শুরু করেছিল তারা।

কিন্তু হলওয়ে ব্যাপারটাকে ভুলতে দিলেন না। খেলনাগুলোকে তিনি নানাভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করাচ্ছিলেন। অসংখ্য হিসেবনিকেশে তাঁর খাতা ভরে উঠছিল। গণিতজ্ঞ, এঞ্জিনিয়ার, মনস্তত্ত্ববিদদের সঙ্গে ঘন ঘন আলোচনা চলছিল। কিন্তু মাথা-গোলানো খেলনাগুলোর রহস্য কিছুতেই ধরা দিচ্ছিল না তাঁর কাছে। বাক্সটা থেকে অবশ্য কিছুই বোঝবার রাস্তা ছিল না। তার বেশির ভাগ যন্ত্রই একেবারে গলে-মিশে গিয়েছে। কিন্তু খেলনাগুলো—-

আসলে জিনিসগুলোর চরিত্রের নিয়মভাঙা এলোমেলো ব্যাপারটাই যাবতীয় অনুসন্ধানকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছিল। হলওয়ের দৃঢ় ধারণা, ওগুলো একেবারে এলোমেলো নয়। ওর মধ্যে একটা কোনও গভীরতর নিয়ম আছে। সে নিয়মের ধর্মগুলো জানা যাচ্ছে না এই যা। জানবার জন্য যে পরীক্ষাগুলো করা দরকার, সেগুলো করবার সাহসও হলওয়ের ছিল না। যেমন, কোনও বয়স্ক মানুষই ওই অ্যাবাকাসটাকে দিয়ে ঠিকঠাক কাজ করাতে পারত না। অথচ অন্য কোনও শিশুকে দিয়ে যদি পরীক্ষা করিয়ে দেখা যেত, সে সেটা পারছে তাহলে, দুর্বোধ্য হলেও একটা নিয়ম, একটা প্যাটার্ন বোঝা যেত। কিন্তু আর কোনও শিশুকে দিয়ে সেটা পরীক্ষা করবার সাহসও হলওয়ের ছিল না। কালো কাচের ঘনকটাও একই রকম রহস্যময়। ওর ভেতরকার নানা রঙের নকশাগুলো অনেকটা ক্যালিডোস্কোপের মতো। সেটা নয় বোঝা গেল। অথচ হাজার নাড়াচাড়া করে, উলটে-পালটে দিয়েও তাদের বদলানো যেত না। কিন্তু মাঝে মাঝে, প্রকৃতির পরিচিত নিয়ম ভেঙে, কোনও কারণ ছাড়া নিজে নিজেই বদলে যেত সেগুলো। বেনিয়ম। অথবা অজানা কোনও নিয়ম। ‘ক’ প্যাটার্ন!

ওদিকে পারাদিন আর জেন ততদিনে তাদের সব আশঙ্কা কাটিয়ে উঠেছে। খেলনাগুলো বাড়িতে নেই। বাচ্চারা ফের সাঁতার, হাইকিং, সিনেমা, গেম, বাজার-চলতি খেলনা নিয়ে মেতে রয়েছে। এটা ঠিক যে, মাঝে মাঝেই হিসেব কষে খেলতে হয় এমন কোনও স্বাভাবিক খেলনা এনে দিলে তারা সেগুলো ভালো করে খেলতে পারত না। যেমন, রুবিক কিউব জাতের একটা ত্রিমাত্রিক জিগ্‌স-গ্লোব। স্কট আর এমা জিনিসটার জ্যামিতিকে ধরতেই পারল না। অবশ্য সেটা অস্বাভাবিক নয়। পারাদিন নিজেও ও নিয়ে খেলতে গিয়ে নাজেহাল কম হয়নি। আর এরা তো শিশু।

মাঝে মাঝে অবশ্য তাদের দু-একটা কথায় কিছু অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ত। একদিন স্কটকে নিয়ে পাহাড়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা টিলার মাথায় উঠে বিশ্রাম নিতে বসেছিল পারাদিন। পায়ের তলায় অপূর্ব সুন্দর উপত্যকাটা একটা ঢাল হয়ে নেমে গেছে। সেদিকে দেখিয়ে পারাদিন বলল, “কী সুন্দর,

তা-ই না?”

স্কট মন দিয়ে সেদিকে দেখল খানিক। তারপর গম্ভীর গলায় বলে, “সব ভুলভাল, উলটো-পালটা।”

“মানে?”

“জানি না।”

“উলটো-পালটাটা কী দেখলি, সেটা তো বলবি?”

“না মানে—” বলতে বলতেই স্কট কেমন যেন বোকার মতো চুপ করে গেল খানিকক্ষণ। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “জানি না তো!”

প্রথম প্রথম খেলনাগুলোর ফেরত চেয়ে ভারী বিরক্ত করেছিল দুজনেই। কিন্তু সে বেশি দিনের জন্য নয়। এমা তো একেবারেই ভুলে গেল ক-দিনের মধ্যে। স্কট অবশ্য হাত-পা ছোড়া বন্ধ করলেও ও নিয়ে খানিক মনমরা হয়ে থাকত। মাঝে মধ্যেই বোনের সঙ্গে অবোধ্য ভাষায় কথাবার্তা চালাত। তার হাতে কাগজ ধরিয়ে দিয়ে, তাতে এমা যে আঁকিবুকি কাটত, সেগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখত। যেন, তার নাগালের বাইরের কোনও একটা সমস্যা নিয়ে বোনের কাছে পরামর্শ নিচ্ছে সে।

তবে, এমার বোধশক্তি বেশি হলেও, স্কটের বুদ্ধিটা বেশি পরিণত ছিল। যন্ত্রপাতিতে হাতও বেশি চলে তার। মেকানো–সেট দিয়ে একদিন একটা উদ্ভট চেহারার কিছু বানাল সে। কিন্তু তারপরেই বিরক্ত হয়ে ভেঙে ফেলে দিল সেটাকে। আর তার বিরক্ত হবার কারণটাই পারাদিনের মন ভালো করে দেবার কারণ ছিল। ভেঙে ফেলবার আগে জিনিসটাকে দেখেছিল সে। একটা বাঁকাচোরা জাহাজ। এদিক-ওদিক অসমান। কিন্তু স্বাভাবিক জাহাজ বলে চেনা যায় সেটাকে। এ বয়সের স্বাভাবিক ছেলেমেয়েরা যেরকমটা বানায় আর কী!

জাহাজটার চেহারাটা বড্ড বেশি এখানকার জাহাজদের মতো। স্কট সেটা বানিয়ে মোটেই খুশি হয়নি। ব্যাপারটা নিয়ে সে এমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু প্রশ্ন করেছিল। তারপর জবাবে এমার লেখা হিজিবিজি আঁকিবুকিগুলোকে দেখেওছিল মন দিয়ে।

“হ্যাঁ রে, এমা যে কী হিজিবিজি আঁকে কাগজে, সেগুলো তুই পড়তে পারিস বুঝি?” একদিন সকালে জেন হঠাৎ তেমন একটা কাগজের টুকরো হাতে নিয়ে স্কটকে জিজ্ঞাসা করল।

“উঁহু। ঠিক পড়া নয় মা, ও কী বলতে চাইছে, সেইটা বুঝতে পারি খানিক খানিক। সবসময় পারি না অবশ্য।”

“তার মানে—ওগুলো লেখা? না ছবি? না-”

“না না মা। ওগুলোকে দেখে যা মনে হয় আসলে তা নয়—”

“সিমবলিজ্‌ম্‌!!!” খাবার টেবিল থেকে হঠাৎ ফোড়ন কাটল পারাদিন। জেন খানিক চমকে উঠে সেদিকে তাকাতে চোখ টিপে মুচকি হাসল সে।

পরে, ছেলেমেয়েরা দূরে গেলে পারাদিন জেনকে বুঝিয়ে বলল ব্যাপারটা, “হলওয়ের বুজরুকি কথাবার্তায় অত পাত্তা দিয়ো না তো! বাচ্চারা অজানা ভাষায় কথাবার্তা বলে! ধুস! ব্যাপারটা জলের মতো সোজা। ধর এমা একটা এলোমেলো আঁকিবুকি কেটে বলল, এইটা গোলাপ। স্কট সেটা মনে রাখল। পরের বার তার আঁকিবুঁকিতে সেরকম কিছু একটা দেখা গেলেই স্কট ধরে নেবে ওইটে—”

“হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি,” জেন ঘাড় নাড়ল। তবে তার চোখ থেকে অবশ্য সন্দেহ যায়নি, “স্কট আজকাল খেলা কমিয়ে খুব বই নিয়ে মেতেছে। খেয়াল করেছ?”

“করেছি। ছেলেমানুষি বই। তেমন কিছু স্কান্ট, স্পিনোজা নয়। সে দিন তো দেখলাম অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড নিয়ে—”

“পড়ে না। কেবল পাটা ওলটায়।”

“ওর বয়সে আমিও তা-ই করতাম,” এই বলে পারাদিন ইউনিভার্সিটি চলে গেল।

সে দিন দুপুরে রোজকার মতো হলওয়ের সঙ্গে খাবার খেতে খেতে এমার আঁকিবুকির কথাটা পারাদিন তুলল তাঁর সঙ্গে।

“সিমবলিজ্‌ম্‌। কথাটা ঠিক বলিনি আমি?”

হলওয়ে মাথা নাড়লেন, “ঠিকই বলেছ। আরে, আমাদের যে ভাষা, সেইটাও তো প্রতীকী। অন্তত তার প্রয়োগটা। এই যে দেখ—”

বলতে বলতেই কাগজের রুমালের গায়ে একটা লম্বাটে গোল্লা এঁকে ফেললেন তিনি। “এটা কী হতে পারে?”

“অনেক কিছু। গ্লাসের কানা, ডিমভাজা, ফ্রেঞ্চ ব্রেড, সিগার।”

“বেশ।” বলে হলওয়ে বস্তুটার একদিকের মাথায় একটা ত্রিভুজ এঁকে দিয়ে বললেন, “আর এবার?”

“মাছ।” সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল পারাদিন।

“মাছ নয়। মাছের জন্য আমরা যে প্রতীকটা ব্যবহার করি, সেইটে। পাখনা, মুখ, আঁশ কিচ্ছু নেই। তবুও তুমি এটাকে মাছ বলে চিনতে পারলে। কারণ স্মৃতিতে মাছের যে ছবিটা আমাদের আছে, তার সঙ্গে এইটেকে এক করে দেখবার জন্য আমাদের কন্ডিশন করা হয়েছে। বলতে পার, একটা রেবাস। উপযুক্ত কন্ডিশনিং থাকলে, কাগজের গায়ে যেটুকু দেখছি, একটা প্রতীক, তার চেয়ে বেশি অর্থ বয়ে আনে আমাদের মনের কাছে। এবারে এস, উলটো দিক থেকে দেখা যাক। একটা পাখির প্রতীক আঁক দেখি।”

পারাদিন একটা ওলটানো ডবলিউ-এর মতো দাগ এঁকে দিল।

“সরলতম জ্যামিতিক সারটুকু। ছোটবেলার কন্ডিশনিং। একটা শিশু যখন নতুন কিছু দেখে, তখন অভিজ্ঞতা কম থাকায় অন্য কিছু জানা জিনিসের সঙ্গে তাকে তুলনা করবার ক্ষমতা তার থাকে না। তখন সে সরলতম জ্যামিতিক যে চেহারাটা ওর মধ্যে দেখছে, সেইটে এঁকে দিয়ে সেটাকে ওর প্রতীক হিসেবে শিখে নেয়।

“ইউক্লিডীয় দুনিয়ার জ্যামিতিতে তোমারও সেই অটোকন্ডিশনিং হয়েছে ছোটবেলায়। তাই তোমার কাছে এইটেই পাখির প্রতীক। তাই পাখির বদলে সমুদ্র বললে তুমি কয়েকটা তেকোনা মাথার সার এঁকে দিতে। এমার হিজিবিজিগুলোও সেই একই ধরনের প্রতীকীকরণ। সেগুলো তোমার-আমার চেনা নকশা নয়, কারণ তার চিন্তার পদ্ধতি আলাদা। দৃশ্য বস্তুদের জ্যামিতিক চেহারাটা সে অন্যভাবে দেখে, অন্যভাবে আঁকে। আমরা যারা অন্যভাবে, অন্য জ্যামিতিতে কন্ডিশন্‌ড, তাদের কাছে সেগুলো তাই হিজিবিজি।”

“আপনার কি এখনও মনে হয় যে—”

“হ্যাঁ। ওর মন অন্যভাবে, অস্বাভাবিক পথে কন্ডিশন্‌ড হয়ে গেছে। দৃশ্যমান দুনিয়ায় ও ওর চোখে যে জ্যামিতিক নকশাগুলো দেখতে পায়, সেগুলো ওর কাছে সরল, অর্থবহ, কিন্তু আমাদের কাছে জটিল, হিজিবিজি।”

পারাদিন মনে মনে ঠিক করে নিল, এ লোকটার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ এইবারে একটু কমিয়ে ফেলতে হবে। মহা সন্দেহবাতিক লোক। ক্রমেই একটা সামান্য জিনিসকে নিয়ে ঘোঁট পাকিয়ে তুলছে। তুচ্ছাতিতুচ্ছ কোনও বিষয় পেলেও সেটাকে ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে নিজের তত্ত্বের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে খাড়া করবার চেষ্টা করে চলেছে সবসময়।

মুখ বাঁকিয়ে সে বলল, “তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, এমা স্কটের সঙ্গে কোনও অচেনা ভাষায় কথাবার্তা চালাচ্ছে তা-ই তো?”

“কথাবার্তা নয়, প্রতীকের ভাষা। এমন সব প্রতীক, যেগুলোর জন্য কোনও শব্দ তার জানা নেই। আমাদের এ দুনিয়ার পরিচিত জ্যামিতির সঙ্গে যে শব্দগুলো জড়িত, সেগুলো ওদের ব্যাখ্যা দিতে পারে না। আমি নিশ্চিত, ওই আঁকিবুকিগুলোর অনেকটা অর্থই স্কট ধরতে পারে। নইলে বারবার দুজনে মিলে এ কাজটা করে চলবে কেন?”

প্রশ্নটার কোনও উত্তর দিল না পারাদিন। তখন তার কয়েকদিন আগের সেই হাইকিং-এর স্মৃতিটা মনে পড়ে গেছে। প্রাকৃতিক দৃশ্যটা—তার উঁচু পাহাড়চুড়ো আর খাড়াই অতিভুজের মতো নেমে যাওয়া ঢাল স্কটের চোখে ভুল ঠেকেছিল!

কথাটা হলওয়েকে বলে ফেলেই পারাদিন বুঝল, ভুল হয়ে গেছে। ভদ্রলোক ফের একবার উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, “স্কটের গোটা চিন্তাপদ্ধতিটা তার মাথায় যে দুনিয়ার সংজ্ঞা গড়ে তুলছে, তার চেহারা এই দুনিয়ার থেকে আলাদা। সম্ভবত নিজের অগোচরে সে, যেখান থেকে এ খেলনাগুলো এসেছে, সেই দুনিয়াটাকে দেখতে চাইছে।”

পারাদিন শোনা বন্ধ করে দিল। বাচ্চারা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এখন গন্ডগোল রয়ে গেছে শুধু এই হলওয়ের মাথায়।

সে দিন রাতে মাছদের নিয়ে একটা অদ্ভুত মন্তব্য করল। বিষয়টার গুরুত্ব পরে বোঝা গিয়েছিল। ন্যাচারাল হিস্ট্রি পড়াতে গিয়ে পারাদিনই ইল মাছের কথাটা তুলেছিল অবশ্য।

“কিন্তু ওরা ডিম পাড়ে কোথায়?”

“ব্যাপারটা রহস্যময়। সমুদ্রে ঠিক কোথায় ওরা ডিম পাড়ে, সেটা কেউ জানে না। সারাগাসো সমুদ্রে হতে পারে। অথবা সমুদ্রের অনেক গভীরে কোথাও—যেখানে জলের চাপ ডিম ফুটিয়ে ওদের বাচ্চাদের বের করে আনে—”

স্কট ভুরু কুঁচকে খানিক ভেবে নিয়ে বলল, “ভারী মজার ব্যাপার।”

“স্যামনরা আবার ডিম পাড়তে সমুদ্র ছেড়ে নদীতে এসে ঢোকে—” পারাদিন তখন ইল ছেড়ে স্যামন মাছের জীবনী বলে চলেছে তাকে।

“দারুণ ব্যাপার, তা-ই না বাবা? নদীতে জন্মায়, সাঁতরাতে শেখে, তারপর সমুদ্রে চলে যায়। তারপর ফের ডিম পাড়বার জন্য নদীতে ফিরে আসে—”

“ঠিক।”

“কিন্তু— ওরা ফিরে আসে না!” হঠাৎ গলা নামিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠল স্কট, “ওরা শুধু ডিমগুলোকে পাঠিয়ে দেয়—”

“ধুস! তা-ই হয় নাকি? ডিম কি হাঁটতে পারে, না সাঁতরাতে পারে?”

স্কট তবুও মাথা নাড়ল, “কিন্তু গাছেরা তো তাদের বীজকে দূর দূর দেশে পাঠিয়ে দেয় বাবা?”

“কিন্তু তার মধ্যে ক-টা আর ভালো মাটি পায় বল্‌? ওরা তো আর হিসেব করে বীজ পাঠায় না?”

“কারণ ওদের বুদ্ধি নেই। আচ্ছা বাবা, মানুষরা এখানে থাকে কেন?”

“কোথায়? এই গ্লেনডেল–এ?”

“উঁহু। এখানে। এই গোটা দুনিয়াটায়। এইটাই কি সবটা?”

“অন্য গ্রহের কথা বলছিস?”

স্কট ফের একটু ভাবল। তারপর বলল, “না বাবা। এইটা আসলে অনেক বড় একটা জায়গার একটা টুকরো। এইখানটা হল, স্যামনরা যে নদীতে যায় ডিম পাড়তে, সেই নদীর মতোন। মানুষ কেন তাহলে বড় হলে সমুদ্রে চলে যায় না?”

পারাদিন হঠাৎ টের পেল, নদী—সমুদ্র—স্যামন—এগুলো প্রতীক—ওদের দিয়ে স্কট অন্য কিছু বোঝাতে চাইছে। একটা মৃদু কাঁপুনি হঠাৎ বয়ে গেল তার মেরুদণ্ড দিয়ে।

সমুদ্র!!! স্যামন!!! তার প্রজাতির সদ্য ডিম-ফোটা শিশুরা তাদের পিতৃ–পিতামহের বৃহত্তর দুনিয়ায় বাঁচবার উপযুক্ত থাকে না। তার জন্য তাদের বিবর্তিত হতে হয়। তারপর বেড়ে ওঠবার পর একদিন তারা তাদের আসল দুনিয়ায় ভেসে যায়। তারপর ফের একদিন তারা ফিরে আসে নদীতে—সুদূর উজানে জলতলের বালিতে বুনে দিয়ে যায় তাদের নিষিক্ত ডিম—তারপর ফের—

—নিচুজাতের জীব। প্রবৃত্তির তার শিশুদের শিখিয়ে দেয় পিতৃ–পিতামহের দুনিয়ায় ফিরে যাবার জন্য দরকারি কৌশল। কিন্তু উন্নততর প্রজাতির হলে? তার আসল জগৎ অনেক বেশি জটিল। একা প্রবৃত্তির সাধ্য নেই, তার শিশুকে সেই জটিলতর জগতের জন্য তৈরি করে দেয়। সাহায্য লাগবে তার। প্রশিক্ষণ, কন্ডিশনিং। বিনা যন্ত্রণায়, নীরবে, সবার নজরের আড়ালে!

শিশুরা খেলনা ভালোবাসে। খেলনারাই যদি সেই শিক্ষক হয়—

চার

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এক ব্রিটিশ ভদ্রলোক নদীর ধারে এক টুকরো ঘাসজমিতে বসে ছিলেন। এক সদ্য কিশোরী তাঁর পাশে ঘাসে শুয়ে আকাশের দিকে দেখছিল। এতক্ষণ ধরে একটা অদ্ভুত খেলনা নিয়ে খেলছিল সে। এইবার সেটা ফেলে দিয়ে মাথামুণ্ডুহীন শব্দ দিয়ে বাঁধা একটা গান ধরল সে গুনগুন করে।

“কী গান গাইছিস রে?”

“এক্ষুনি একটা গান বানালাম চার্লসকাকা, সেইটা গাইছি।”

“আবার গা দেখি,” বলতে বলতে চার্লস ডজসন একটা ছোট খাতা আর পেনসিল বের করে আনলেন।

মেয়েটা ফের গানটা গেয়ে শোনাল।

“এটার কোনও মানে আছে নাকি রে?”

“হুঁ–উ–উ। আমি তোমায় যে ওয়ান্ডারল্যান্ডের গল্পগুলো শোনাই, সেই যে মাটির নিচে গিয়ে দারুণ সব অ্যাডভেঞ্চার! সেইরকম।”

“সেসব খুব দারুণ গল্প কিন্তু।”

“তুমি বুঝি ওই নিয়ে একটা বই লিখবে?”

“লিখব, তবে ওর অনেক কিছু পালটে দিতে হবে, বুঝলি? নইলে কেউ ওর মাথামুণ্ডু কিচ্ছু বুঝবে না যে!”

“উঁহু। একদম কিচ্ছুটি বদলাবে না চার্লসকাকা। বদলালেই ওদের আর কোনও মাথামুণ্ডু থাকবে না।”

“আচ্ছা, আচ্ছা, সে নয় হবে। এবার গানটার মানে বল্‌?”

“বেরবার রাস্তা। ঠিক জানি না এখনও। আমার ম্যাজিক খেলনা আমায় বলেছে।”

“কোত্থেকে পেলি বল্‌ তো এমন আশ্চর্য খেলনাগুলো?”

“মা কিনে দিয়েছে। মা তো মরে গেছে। বাবা কিচ্ছু খেয়ালই করে না!”

মিথ্যে কথা বলল সে। টেমসের ধারে খেলতে খেলতে একদিন একটা পড়ে থাকা বাক্সের মধ্যে সে খেলনাগুলো পেয়েছিল। দারুণ সব খেলনা!

চার্লসকাকা তার গানটার মানেই বোঝেনি! ওর মধ্যেই রাস্তাটার খবর দেওয়া আছে। যা যা করতে বলা আছে ওতে, এইবার সে সেগুলো করে ফেলবে চটপট। তারপর—

কিন্তু সে তখন অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। রাস্তাটা সে খুঁজে পেল না।

পাঁচ

পারাদিন হলওয়ের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখেনি। জেন চায় না। তার বাচ্চারা ভালো আছে। লোকটা খেপা। জেন নিশ্চিন্তে আছে। পারাদিন ততটা নিশ্চিন্তে থাকতে পারে না তবু। স্কট তার মেকানো–সেট, ভাঙাচোরা জিনিসপত্রের টুকরো, পোড়া মোমবাতি, পাথরের টুকরো—এইসব দিয়ে সাজানো উদ্ভট চেহারার প্যাটার্নগুলো মাঝে মাঝেই এমাকে ডেকে এনে দেখায়। এমা দু-দিকে মাথা নাড়ে। কখনও কখনও হ্যাঁ–ও বলে। আর যখন হ্যাঁ বলে, তখন তারপর ঘণ্টাভর কাগজের গায়ে আঁকিবুকির পালা চলে। সেগুলো দেখে দেখে স্কট তার বানানো জিনিসপত্রের এটা-ওটা নাড়ায় সরায়, ভাঙে, গড়ে—প্রত্যেকদিন কাজের মেয়ে সেইসব ঝেঁটিয়ে বাইরে ফেলে আসে, প্রত্যেকদিন স্কট আবার বানায়।

পারাদিন একদিন ওই নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করতে স্কট তাকে বোঝাবার চেষ্টাও করেছিল খুব। সেটা ছিল রোববার। দুপুরে খাবার পরে পারাদিন গিয়ে ছেলেমেয়েদের ঘরে বসেছিল তাদের নিয়ে। স্কট তখন তার উদ্ভট প্যাটার্ন বানাবার কাজে ব্যস্ত।

“এই ঢিলের টুকরোটা এইখানটায় বসালি কেন?”

“বাবা, ওটা শক্ত আর গোল দেখছ না? ওটা তো ওখানেই হবে।”

“কিন্তু ওপরের ওই টুকরোটা? ওটাও তো শক্ত, গোল। তাহলে ওটা এখানে দিলি না কেন?”

“ধুস! ওর গায়ে তো মোম মাখিয়ে পিছল করে রাখা। অত দূর যখন যাবে, তখন বুঝতে পাবে ওটা শুধু শক্ত, গোল একটা জিনিস না বাবা—”

“হুম। তা এই নিচের শক্ত গোলের পরেই এই মোমবাতির টুকরোটা কেন?”

স্কট দেখা গেল খানিক বিরক্ত হয়েছে। মাথা নেড়ে বলে, “ঢিলের পরে মোমবাতি, সে তোমায় কে বলল? ওটা তো আসলে রয়েছে একদম শেষে। এই যে—ঢিলটার পরে এসেছে তো—এইটা—”

বলতে বলতে বেশ খানিকটা দূরে লাগানো একটা লোহার আংটার দিকে দেখিয়ে দিয়েছে সে। পুরানো ঘড়ির ফ্রেম সেটা একটা।

পারাদিনের মনে হচ্ছিল, জিনিসটা যেন জঙ্গলের মধ্যে একটা স্কাউট ট্রেল। একেকটা জিনিসের অবস্থান তার ঠিক পথটার নিশানা। অথচ এখানেও সেই আপাত যুক্তিহীন এলোমেলো সজ্জা। একটা সংকেতের পরের সংকেত যে কোনটা, তা বোঝবার জন্য মানুষের বোধগম্য কোনও যুক্তিই কাজ করে না সেখানে।

ঘর ছেড়ে পারাদিন যখন বের হয়ে যাচ্ছে, ততক্ষণে এক টুকরো কাগজ নিয়ে স্কট গিয়ে এমার সামনে থেবড়ে বসেছে। “নে, এবার বল্‌—”

সেটা রোববারের দুপুর। গরম পড়েছে। বসে বইপত্র পড়া ছাড়া আর কোনও কাজ নেই হাতে। জেন হ্যারির সঙ্গে লাঞ্চ খেতে গেছে। একতলায় বসবার ঘরে নেমে এসে পারাদিন একটা কমিক্‌সের বই নিয়ে একটা সোফায় বসে তাইতে ডুবে গেল।

ঘণ্টাখানেক বাদে ওপর থেকে দুপদাপ পায়ের শব্দ পেয়ে তন্দ্রাটা ছুটে গেল তার। স্কটের উত্তেজিত গলা ভেসে আসছিল সেখান থেকে—“হয়ে গেছে—পেয়েছি—পেয়েছি—এই পেতনি—আয়—আয়—”

পারাদিন ভুরু কুঁচকে উঠে দাঁড়িয়ে সিঁড়ির দিকে এগতে যাবে, তখন টেলিফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। জেনের ফোন! রিসিভারটা হাত দিয়ে ধরতে যাবে পারাদিন, ঠিক তখন ওপর থেকে এমার উত্তেজিত গলার একটা হালকা চিৎকার ভেসে এল। পারাদিন মুখ বাঁকাল, “কী যে শুরু করেছে ছেলেমেয়ে দুটো! উফ্‌ফ্‌—”

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফের স্কটের চিলচিৎকার ভেসে এল, “আরে সাবধানে—এদিকে—এদিকে—এখানটায় পা রাখ্‌—”

হঠাৎ কী মনে হতে, জবাব না দিয়েই রিসিভার থেকে হাত ছেড়ে দিল পারাদিন। তারপর দু-তিনটে করে সিঁড়ি ডিঙিয়ে স্কটের ঘরের খোলা দরজাটার সামনে পৌঁছে গেল।

ছেলেমেয়ে দুটো তখন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট টুকরোয়—যেমন করে বাতাসের মুখে ঘন ধোঁয়ার একটা তাল ভেঙেচুরে যেতে থাকে, যেমন করে আঁকাবাঁকা আয়নার সামনে নড়াচড়া করলে শরীরের একেকটা অংশ হঠাৎ করে হারিয়ে যায়—হাতে হাতে ধরে দুই ভাইবোন তেমনি করে—চলে যাচ্ছিল, কোন দিকে? পারাদিন কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, ঠিক কোন অভিমুখে এগিয়ে যেতে যেতে হারিয়ে যাচ্ছে তারা।

দরজার চৌকাঠের এদিকে যতক্ষণে পা পড়ল তার, ততক্ষণে তারা একেবারে মিলিয়ে গেছে।

“এমা—আ আ আ—স্কটি—ই—ই—ই—”

কার্পেটের ওপর একগাদা মার্কার, মোম-মাখানো ঢিল, লোহার আংটার মতো দেখতে পুরানো ঘড়ির একটা ফ্রেম—সবকিছু এলোমেলোভাবে সাজানো। একেবারে এলোমেলো একটা নকশা। অর্থহীন। একটা দলা পাকানো কাগজের টুকরো উড়ে এল পারাদিনের দিকে। কাগজটাকে মুঠো করে ধরল সে।

“লুকিয়ে থাকিস না। বেরিয়ে আয় তোরা—এমা—স্কটি—”

নিচে বসবার ঘরে টেলিফোনটা বেজে বেজে অবশেষে থেমে গেছে। পারাদিন হাতের মুঠোয় ধরে থাকা কাগজটার দিকে তাকাল একবার। জিনিসটা একটা বই থেকে ছিঁড়ে নেওয়া পাতা। তার এদিক–ওদিক এমার এলোমেলো আঁকিবুকির মার্জিন নোট। একটা অনুচ্ছেদ এতবার দাগ দিয়ে দিয়ে পড়া হয়েছে যে সেটা প্রায় পড়া যায় না আর। কিন্তু, পারাদিন সে কবিতাটা খুব ভালোভাবে জানে। স্মৃতি থেকে ‘থ্রু দ্য লুকিং গ্লাস’-এর বিখ্যাত কবিতার সেই লাইনগুলো ভেসে উঠছিল তার—

 সেই যে ব্রিলিগ স্লাইদি টাটুমটোবে

গিমলে ঘুরান সূর্যকাঁটার ঘাসে

মিমসিগুলো বনলে বোরোগবে

এবং মোমে রাথিন বাহিরদ্রাসে

সূর্যকাঁটার পাশে! সে দিন সে বোঝেনি। আজ মনে পড়েছে তার। সূর্যকাঁটা—সানডায়াল—সময়—চতুর্থ মাত্রা—হ্যাঁ, এর সঙ্গে সময়ের কোনও একটা সম্বন্ধ আছে। অনেকদিন আগে স্কট তাকে শব্দটার মানে জিজ্ঞাসা করেছিল। সিমবলিজ্‌ম্‌!!!

আশ্চর্য, রহস্যময় সেই বইটায় হাম্পটি ডাম্পটি এ লাইনগুলোর ব্যাখ্যা দিয়েছিল! প্রত্যেকটা শব্দের! নিজেকে একটা নির্বোধের মতো ঠেকছিল পারাদিনের! চোখের সামনে সূত্রগুলো ছিল!

“ব্রিলিগ মানে বিকেল চারটে—স্লাইদি মানে পিছল কিন্তু শক্ত—গিম্বল—সুড়ঙ্গ—সূর্যকাঁটার পাশে—সময়ের বুকে সুড়ঙ্গ—টোবে—তারা সময়ের নিচে বাড়ি বানায়—মোমে—পথহারা—বাহিরদ্রাস—আহ্বান—”

স্থান, কাল, সমস্ত শর্ত—তারা অন্য কিছু অজানা শব্দের সংকেতের আবরণে ঢাকা—দুই ভাইবোন সে সংকেতগুলোর রহস্য বুঝেছিল! মেঝের ওপর এলোমেলো সাজানো কিছু জিনিস—এলোমেলো? শক্ত নুড়ির দল—তাদের পিচ্ছিল আবরণে জড়িয়ে—কোনও অজ্ঞেয় গাণিতিক সূত্রের শর্ত মানা নকশায় সাজালে—নির্দিষ্ট কালমুহূর্তে সময়ের বুকে সুড়ঙ্গকে দেখতে পাবে শিক্ষিত চোখ—

পাগলামো?

কিন্তু স্কট আর এমার কাছে তা পাগলামো ছিল না। ভিন্নমাত্রিক কন্ডিশনিং-এ অভ্যস্ত করে তোলা তাদের বোধি ওর মধ্যেকার যুক্তিকে ধরতে পেরেছিল। পাতাটার গায়ে এমার আঁকিবুকিগুলো ক্যারলের ননসেন্স ছড়ার শব্দগুলোকে তার ও স্কটের বোধগম্য সংকেতে অনুবাদ করে দিয়েছিল। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট সজ্জা গড়ে তুলে তারা স্থান-কালের সমীকরণের সমাধান করেছিল। আর তারপর—এবং মোমে রাথিন বাহিরদ্রাসে—

পাগলের মতো মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা ঘড়ির ফ্রেম, মোম-মাখানো নুড়ি, মো -মের টুকরোগুলোর অর্থহীন সজ্জাটার দিকে তাকাচ্ছিল পারাদিন। এর অর্থ সে বুঝবে না। বুঝতে পারে না। সে ইউক্লিডের দুনিয়ার বাসিন্দা। তার মন তখন একটা অকল্পনীয় ভয়ের মুঠোয় আটকে পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু সে শুধু কয়েকটা মুহূর্তের জন্য। হঠাৎ হাতে ধরা কাগজটা মুঠোয় পিষতে পিষতে বিকৃত গলায় সে চিৎকার করে উঠল, “স্কটি—এমা—”

সে জানত, কেউ সাড়া দেবে না। খোলা জানালা দিয়ে শেষ সূর্যের আলো তেরচা হয়ে এসে পড়ছিল ঘরের মধ্যে। এমার ভালুকদাদার পেটের সোনালি কাপড়টা ঝকমক করছে সে আলোয়। নিচে—টেলিফোনটা ফের বাজছে—

*দ্য প্রিকশাস বেবি—শ্যোয়েংক গিলবার্টের বিখ্যাত কবিতার পঙ্‌ক্তি

মূল রচনা : লুই প্যাজেট (হেনরি কুটনার এবং ক্যাথরিন মুর)

লেখক পরিচিতি – দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটিতে। ভারতীয় রেভেন্যু সার্ভিসের প্রাক্তন সদস্য। ছোটদের জন্য প্রথম পূর্ণাঙ্গ ওয়েব ম্যাগাজিন ‘জয়ঢাক’ এবং বাংলা সাহিত্যের লাইব্রেরি পোর্টাল ‘পদক্ষেপ’-এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। ছোট-বড় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও সংবাদপত্রে ছোট ও বড়দের জন্য দীর্ঘকাল লেখালিখি করেছেন। ভ্রমণসাহিত্যে ‘কলম সম্মান’ পেয়েছেন। নর্মদা গুহাচিত্রের ওপরে তিনটি গবেষণাপত্র আছে। ছোট ও বড়দের জন্য এখন অবধি ১৩টি গ্রন্থ প্রকাশিত। 

লেখক পরিচিতি – লুই প্যাজেট (হেনরি কুটনার এবং ক্যাথরিন মুর)

লুইস প্যাজেট ছিল হেনরি কুটনার এবং ক্যাথরিন মুরের মিলিত ছদ্মনাম। ১৯৪০ সালে বিবাহের পরে এই আমেরিকান দম্পতি একসঙ্গে ছদ্মনামে বহু গল্প ও উপন্যাস লিখে গেছেন। ১৯৫৮ সালে কুটনারের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই দম্পতির লেখা গল্প ও উপন্যাসের কয়েকটি হল – দ্য প্রাউড রোবট, টাইম লকার, এক্স মাখিনা, দ্য টোংকি ইত্যাদি। ‘মিমজিজ ওয়্যার দ্য বোরোগোভস’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ সালের আস্টাউন্ডিং সায়েন্স ফিকশন ম্যাগাজিনে। এই নভেলাটিকে আমেরিকার সেরা কল্পবিজ্ঞানগুলির মধ্যে ধরা হয় এবং সায়েন্স ফিকশন হল অফ ফেম প্রথম খন্ডে এটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *