মিনু আর আমদুসিয়াসের সুর
অনেকদিন ধরেই বাজছে সুরটা৷ মিহি তানপুরার মতো৷ দিনে অন্তত চারবার সেটা শুনতে পায় মিনু, কিন্তু সুরটা যে কোথা থেকে আসছে সেটা ঠাহর করতে পারে না৷ কখনও মনে হয় ছাদে বসে কেউ বাজাচ্ছে, আবার কখনও মন বলে একতলার ভাড়াটেদের কেউ রেডিয়োতে শুনছে৷ একই সুর একইভাবে মিনিট খানেক বাজতে থাকে, তারপর আবার নিজে থেকেই মিলিয়ে যায়৷ বড়োরা কিন্তু কেউ শুনতে পায় না৷ বাবা, মা খেন্তিমাসি, কেউ না৷ মিনু ছাড়া বাড়ির একটি মাত্র প্রাণী শুনতে পায় সেটা, প্লুটো৷ সুরটা বাজলেই সে তঠস্থ হয়ে ওঠে, কান খাড়া করে এদিক-ওদিক তাকায়, নাহলে টেবিলের তলায় লুকিয়ে পড়ে৷ এমনিতে প্লুটো ভীতু নয়৷ বারান্দা থেকে মুখ বাড়িয়ে কুকুর দেখতে পেলে দিব্যি মুখ ভেংচাতে পারে৷ কিন্তু ওই আজব সুরটা শুনলে সেই মহাবলী প্লুটো সটান মিনুর পায়ের কাছে ঘুরঘুর করে৷ ভারী মুশকিল হল৷ ব্যাপারটা বড়োদের কয়েকবার বলার চেষ্টা করেছে মিনু, কিন্তু ফল হয়নি, উলটে বিপদ বেড়েছে, সমস্ত ঘটনা শুনে বাবা খুশি হয়ে বলেছেন,‘মেয়ের গানে শখ আছে দেখছি৷ তাহলে তো মাস্টার রাখতে হয়৷’
এই ব্যাপারটা মিনুর একদম পছন্দ নয়৷ পাশের বাড়ির শ্যামলীকে রোজ বিকেলে গান শেখাতে আসে৷ সে বেচারি খেলা ছেড়ে যেতে চায় না৷ ফলে খানিকটা টানাটানি চড় থাপ্পড় আর কান্নাকাটির পরে যখন সে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে তখন তার গলা থেকে সাত সুরের বদলে একটি মাত্র সুর বেরিয়ে আসে, ওঁয়া… সে দেখে ভারী মায়া লাগে মিনুর, শ্যামলী অনেকক্ষণ দম ধরে রেখে চু করতে পারে, এক কোট থেকে আর এক কোট বিড়ালের মতো লাফাতে পারে, তাকে কিনা বিকেল হলেই বউবসন্ত ছেড়ে চিল চিৎকারে বাড়ি মাথায় করতে হচ্ছে৷ অবশ্য তার থেকেও বেশি চেঁচায় তার দিদিমণি, মিনু একবার দোতলার জানলা দিয়ে দেখেছিল৷ এইসা হোঁতকা মোটা, চুলগুলো লাল, ঠোঁট দুটোয় এমন কষে লিপস্টিক মাখে যে দেখলে মনে হয় এই বুঝি কারও রক্ত খেয়ে এল, হাত দুটো বিছানার পায়ার মতো চওড়া, ওই হাতে একটা কিল খেলে পিঠটা মনে হয় সি-হর্সের মতো বেঁকে যাবে৷ কী ভয়ঙ্কর! বাবা যদি শেষ পর্যন্ত মিনুকে তার কাছেই গান শিখতে পাঠায়? এই সব ভেবেই মিনু চিন্তায় ছিল৷ তার উপর আবার এই সুরের উৎপাত৷ এখন যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে ওই হোঁতকা দিদিমণির কাছে না গিয়ে আর উপায় নেই৷
শ্যামলীকে ইদানীং আর খুব একটা বাড়ির বাইরে দেখা যায় না৷ কখনও জানলায় দেখতে পেলে এমন ভাবে হাসে যে মনে হয় ঠোঁট দুটোই ফাঁক হচ্ছে৷ হাসছে না৷
বিকেল শেষ হয়ে আসছিল, এমনিতে শীতকাল৷ স্কুল থেকে ফিরতেই পাঁচটা বেজে যায়৷ তারপর আর খেলার সময় থাকে না বললেই চলে৷ তাছাড়া মিনুর বন্ধুবান্ধবদেরও সবার ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশি-জ্বর৷ অগত্যা সে মাঠে একাই খানিকটা দৌড়াদৌড়ি করে৷ পুকুরের জলে গোল চাকতি ছুঁড়ে ব্যাংবাজি করে প্লুটোকে তাক লাগিয়ে দেয়৷ আবার সন্ধে হলে ঘরে ফিরে আসে৷ আজ কিন্তু বাড়ির সামনে এসে সে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ পাশেই শ্যামলীদের বাড়িটা কেমন যেন থমথম করছে৷ অন্যদিন দোতলার জানলা থেকে রেওয়াজের শব্দ ভেসে আসে৷ আজ আসছে না৷ মিনুর মনটা কেমন যেন করে উঠল৷ শ্যামলী দিনদিন কীরকম হয়ে যাচ্ছে৷ আগেকার মতো খেলতে আসে না৷ কারও সাথে বেশি কথা বলে না, দেখা হলেও মুখ ঘুরিয়ে নেয়৷ গায়ের চামড়াটা সাদা হয়ে যাচ্ছে৷ এই মুহূর্তে মিনুর তাকে দেখতে ইচ্ছা করল৷ অন্য সময় হলে ব্যাপারটা কঠিন হত না৷ কিন্তু এখন মনে হয় সে নতুন দিদিমণির কাছে গান শিখছে৷ ঘরে ঢুকতে দেবে না৷
মিনুর রোখ চেপে গেল৷ ইচ্ছা হয়েছে যখন তখন একবার দেখবেই৷ কী করা যায়? দোতলার জানলাটা বন্ধ৷ সেটার ঠিক পাশ দিয়ে লম্বা জলের পাইপ নেমে গেছে৷ পাইপটায় খানিকটা দূরে দূরে খাঁজ কাটা আছে৷ সেগুলো দেখেই মিনুর মাথায় একটা বুদ্ধি এল৷ বিকেলের আলো পড়ে এসেছে৷ রাস্তায় তেমন লোকও নেই৷ তা-ও পাইপ বেয়ে দোতলায় ওঠাটা সহজ নয়৷ বিশেষ করে পুরনো পাইপ জায়গায় জায়গায় শ্যাওলা হয়ে পিচ্ছিল হয়ে আছে, সেখানে একবার বেকায়দায় পা পড়লেই সটান নিচে৷ কিন্তু সেসব ভেবে মিনু ভয় পেল না৷ একটা ব্যাপার যখন ঠিক করে নিয়েছে তখন করেই ছাড়বে৷ ছোটো থেকে এই একটাই দোষ তার৷ মা মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘এত জেদ যদি পড়াশোনায় দেখাতিস তাহলে রোল নম্বর চিতুর আগে চলে আসত৷’
যাই হোক মিনু এগিয়ে এসে পাইপের নিচের দিকটা ভালো করে চেপে ধরল৷ প্লুটো এতক্ষণ পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল৷ এবার সে খানিকটা এগিয়ে এল৷ মিনু খাঁজে খাঁজে পা রেখে বেশ কিছুটা উঠল৷ এখান থেকে হাত বাড়ালেই জানলাটা ধরা যাবে৷ হঠাৎ মনে হল কীসের একটা মিহি আওয়াজ আসছে, ভালো করে শুনে সে বুঝতে পারল সেই সুরটা৷ এতদিন শুধু বাড়ির ভিতরেই শুনতে পেত, আজ প্রথম বাড়ির বাইরেও শোনা যাচ্ছে৷ মিনু নিচে তাকিয়ে দেখল প্লুটোর গায়ের সব ক’টা লোম খাড়া হয়ে উঠেছে৷ থাবা থেকে বেরিয়ে এসেছে নখগুলো৷ আস্তে আস্তে সে পিছিয়ে যাচ্ছে৷ হঠাৎ প্লুটো এত ভয় পাচ্ছে কেন৷ মিনু পাইপ চেপে ধরে আবার উঠতে লাগল৷ জানলাটা কাঠের, তবে একটা কোণের দিক বাইরে খসে পড়ায় সেখানে চোখ রাখলে ঘরের ভিতরটা দেখা যায়৷ সেই ফুটোতে চোখ রাখতে যাবে এমন সময় তার পিঠের উপর দিয়ে কী যেন একটা জিনিস লাফিয়ে পাইপের ওপারে চলে গেল— প্লুটো৷ সেও উঠে এসেছে পাইপ বেয়ে৷ তার হাবভাব কেমন যেন পালটে গেছে, এর আগে কোনওদিন তাকে এত ভয় পেতে দেখেনি মিনু৷ মনে হচ্ছে এক্ষুনি যেন কেউ হামলা করবে তার উপর৷ সেই ভয়েই সতর্ক থাকছে৷ পাইপ থেকে বারান্দায় ঝাঁপ দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল প্লুটো৷ ব্যাপারটা মিনুর ভালো লাগল না৷ কী দেখতে গেল প্লুটো? এরকম তো সে সচরাচর করে না৷
মিনু জানলার ফাঁকে চোখ রাখল৷ ঘরের ভিতরে হালকা অন্ধকার, ভালো করে দেখা যায় না৷ দু-জন মানুষ বসে আছে ঘরের ভিতরে৷ শ্যামলী আর তার গানের দিদিমণি৷ খুব ফিসফিস করে কী যেন বলছে দু-জনে৷ যেন গোপন কিছু৷ অন্য কেউ যেন শুনতে না পায়৷ মিনু ফাঁক থেকে চোখ সরিয়ে কান রাখল৷ না, কথা বলছে না, কীসের যেন মন্ত্র পড়ছে, সুরেলা, অথচ কেমন যেন ভয়ঙ্কর৷ যেন কেউ খুব নিচু স্বরে কীসের ষড়যন্ত্র করছে৷ হঠাৎ ঘর থেকে অন্য কিছুর শব্দ পাওয়া গেল, বাঁশি বাজছে৷ আগের মতোই হালকা স্বরে৷ ওই মন্ত্রর কথাগুলোর সাথে মিলে যাচ্ছে বাঁশির সুর৷ মিনুর মনে হল তার মাথাটা যেন দুলছে, আর একটু হলেই পড়ে যাবে পাইপ থেকে৷ এমন সময় কীসের যেন আচমকা শব্দে বাঁশিটা থেমে গেল৷ একটা হালকা চিৎকার ভেসে এল ঘর থেকে, মিনু তাড়াতাড়ি ফুটোতে চোখ রেখে দেখল শ্যামলী প্রায় অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে ঘরের মেঝেতে, তার ঠিক পাশেই পড়ে আছে তার গানের দিদিমণি, এবং তার একদম পাশেই একটা একহাত লম্বা বাঁশি৷ বিছানার উপর উঠে রাগে গজগজ করছে প্লুটো৷ সম্ভবত সে এসে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওদের উপর৷ কিন্তু কেন? সে লক্ষ্য করল গানের দিদিমণি প্লুটোর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলছে৷ তার চোখমুখ উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে, শুধু ফাঁক হয়ে থাকা ঠোঁটের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে শব্দগুলো৷ প্লুটো কিন্তু আগের মতোই গজরাচ্ছে৷ মিনুরও এতক্ষণে পা কাঁপছে৷ ভিতরে মারাত্মক একটা কিছু হচ্ছে নিশ্চয়ই৷ এইবার শ্যামলী উঠে দাঁড়িয়েছে, ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে প্লুটোর দিকে৷ কিন্তু একী! শ্যামলীর নখগুলো হঠাৎ করে এত বড় হয় গেল কী করে? নাকটাও যেন ছুঁচলো হয়ে এসেছে৷ মিনু আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না৷ সমস্ত ব্যাপারটা তার কাছে গুলিয়ে গেছে, শুধু এটুকু বুঝতে পারছে যে প্লুটোর বিপদ৷ যে কোনও ভাবে ওই ঘরে ঢুকতেই হবে৷ সে তড়বড়িয়ে পাইপ বেয়ে নিচে নেমে এল৷ শ্যামলীদের দরজার কলিং বেল বাজাল৷ মনের ভিতর উত্তেজনাটা ক্রমশ বাড়ছে৷ এরই মধ্যে খারাপ কিছু হয়নি তো? এক মিনিট পরে শ্যামলীর মা দরজা খুলে দিলেন, মিনু তাকে কিচ্ছু না বলে হুড়মুড় করে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এল৷ দোতলার সিঁড়িতে পা দিতেই একটা চেনা গলা শুনতে পেল, ‘এইসব বেড়াল টেরাল ঘরের মধ্যে কে এনেছে? কালই বিদেয় করে দেবে৷ নাহলে আমি আর আসব না৷ ছিঃ ছিঃ ছিঃ, কোথায় না কোথায় ঘুরে বেড়ায়, একবার আঁচড় খেলে ডিপথেরিয়া অবধারিত৷’
শ্যামলীর দিদিমণি৷ মিনু উঁকি দিয়ে দেখল তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন৷ তাঁর পিছন পিছন শ্যামলীও৷ সে আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেছে৷ শুধু গায়ের রংটা আরও ফ্যাকাসে, চোখ দুটো প্রাণহীন৷ মিনু সদর্পে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল, ঘরের ভিতর উকি দিয়ে বলল, ‘আমার বিড়াল কই?’
‘ওটা তোমার বিড়াল?’ মোটা দিদিমণি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করলেন মিনুকে৷
‘হ্যাঁ৷’ বলে সে ঘরের ভিতর ঢুকে চারপাশে তাকিয়ে দেখল বিছানার একটা পায়ার নিচে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে প্লুটো৷ মিনুকে দেখেই তার চোখের হিংস্র দৃষ্টিটা নিভে এল৷ সিঁড়ি থেকে পায়ের আওয়াজ শোনা গেল, অর্থাৎ ওরা দু-জনে নিচে নেমে গেল৷ মিনু নিচু হয়ে প্লুটোকে তুলতে যাবে এমন সময় কিসে যেন তার চোখ আটকে গেল৷ বিছানার নিচের অন্ধকারে একধারে পড়ে আছে সেটা৷ চৌকো, নির্জীব৷ কাছে এসে ভালো করে দেখে বুঝল একটা বই৷ খয়েরি মলাট, একটা সবুজ ফিতে দিয়ে বাঁধা৷ বেশি বড়ো নয়৷ এক হাতেই ধরা যাবে৷ সম্ভবত গানের আন্টি ফেলে গেছে৷ কী লেখা আছে বইটায়? এভাবে সবুজ ফিতে দিয়েই বা বাঁধা আছে কেন৷ মিনু বইটা হাতে তুলে নিল৷ হয়তো বইয়ের লেখাগুলো পড়লে কিছু জানা যাবে৷ প্লুটোকে কোলে নিয়ে সে নিচে নেমে এল৷ কেমন যেন থম মেরে আছে প্লুটো৷ এক মনে কী যেন ভাবছে৷ সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আবার শ্যামলীর মায়ের সাথে দেখা হয়ে গেল৷ বইটার উপর প্লুটোকে চেপে ধরে কোনওরকমে আড়াল করল মিনু৷
‘এক্ষুনি চলে যাচ্ছিস যে… বস না৷’
‘পরে আসব, এখন বসলে বাবা পিটবে৷’
শ্যামলীর মা এবার এগিয়ে এসে তার মাথায় একটা হাত রাখলেন, ‘শুনলাম তোর নাকি গান শেখার ইচ্ছা…’
মিনু আকাশ থেকে পড়ল, ‘কে বলেছে?’
‘ওমা, তোর বাবাই বলল কালকে, আজ গানের আন্টিও বললেন, বেশ মিষ্টি গলা তোর৷’
‘আমি গান শিখব না৷’ মিনু জোর গলায় কথাটা বলে ঝরের মতো দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল৷
বড়দিনটা এ পাড়ায় বেশ বড়ো করে হয়৷ একটা ছোটোখাটো চার্চ আছে৷
সেটাকে ইস্টার ট্রি দিয়ে নতুন করে সাজানো হয়৷ সকাল থেকে হালকা সুরে ক্যারল বাজতে থাকে৷ পাড়ারই দু-একজন বুড়ো সান্টা ক্লস সেজে বাচ্চাদের সাথে হাত মেলায়৷ মিনুর এই সমস্ত মন্দ লাগে না৷ শুধু একটাই আফসোস, কলকাতায় বরফ পড়ে না৷ বহুবার সে ইংরেজি সিনেমায় দেখেছে খ্রিস্টমাস এলেই সেখানকার রাস্তা বরফে সাদা হয়ে যায়, বাড়ির মাথাও ঢেকে যায় বরফে, অথচ এখানে তেমনটা হয় না৷
সকালবেলা সে ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল৷ চতুর্দিকটা কুয়াশায় ঢেকে আছে৷ দূরে গির্জার ঘণ্টাটা টুং টুং করে বাজছে৷ সামনের কোনও বাড়ি থেকে গানের শব্দ ভেসে আসছে৷ ‘জিঙ্গাল বেল, জিঙ্গাল বেল, জিঙ্গাল অল দ্যা ওয়ে৷’ মিনুও মনে মনে সুর করে গাইতে লাগল গানটা৷ বরফে ঢাকা পাহাড় মহানন্দে পাড়ি দিচ্ছে সান্টা ক্লজ, কুকুরে টানা গাড়িতে চড়ে৷ শীতকালটা খুব ব্যস্ত থাকে সে৷ এতগুলো বাচ্চাকে উপহার পৌঁছে দিতে হবে৷ মিনু অবশ্য আজ অবধি কিছু পায়নি৷ কাল রাতেও মাথার কাছে একটা লম্বা মোজা ঝুলিয়ে শুয়েছিল৷ সকালে উঠে দেখেছে সেটা ফাঁকা৷ তারপর থেকে মনটা খারাপ হয় গেছে৷ মন খারাপ হলেই সে ছাদে চলে আসে৷ প্লুটোটা অবশ্য আসেনি, সে ব্যাটা জুতোর বাক্সে শুয়ে শীতের আমেজ মেখে ঘুম দিচ্ছে৷ পাশের বাড়ির দিকে তাকিয়েই শ্যামলীর কথা মনে পড়ল৷ তার সাথে সেই ডায়েরিটার কথাও৷ ছাদেই সিমেন্টের বেঞ্চের তলায় লুকিয়ে রেখেছে সেটা৷ এই ক-দিন খুলে দেখতে সাহস হয়নি৷ বইটা যে হারিয়েছে সেটা নিশ্চয়ই এতদিনে বুঝে গেছে দিদিমণি৷ যদি খুঁজতে আসে? পড়া হয়ে গেলে কি সেটা আবার ফিরিয়ে দেওয়া উচিত? সেদিন জানলার ফুটো দিয়ে যা দেখেছিল সেটা এখনও বিশ্বাস হয় না মিনুর, হয়তো চোখে ভুল দেখেছিল৷ না হলে শ্যামলীর নখগুলো অত বড় হয় গেল কী করে? নাকটাই বা… মিনু ধীরে ধীরে সিমেন্টের বেঞ্চটার দিকে এগিয়ে গেল৷ শীতকাল বলে বৃষ্টিতে ভেজার ভয় নেই৷ অবশ্য কুয়াশা জমে খানিকটা ভিজে থাকতে পারে৷ সাবধানে বেঞ্চের তলায় হাত ঢুকিয়ে বইটা টেনে বের করল মিনু৷ ফিতেটা আগের মতোই বাঁধা আছে, তার মানে এখনও কেউ খুঁজে পায়নি সেটা৷ আর একবার সতর্ক দৃষ্টিতে চারিদিক দেখে নিল, কেউ দেখছে না তো? তারপর মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে দু-পায়ের ফাঁকে বইটা রেখে উপরের শক্ত কাঠের মতো পাতাটা খুলল৷ ভিতরের পাতাগুলো ভীষণ পুরনো আর হলদে৷ ধরলেই মনে হয় ভেঙে যাবে৷ সে খুব সাবধানে পাতা উলটাতে লাগল৷ একটা জায়গায় ছক কাটা আছে৷ মিনু গুনে দেখল মোট ঊনত্রিশটা ঘর কাটা আছে৷ তার সব কটাতেই নাম লেখা, শুধু শেষের ঘরটা ছাড়া৷ কাদের নাম এগুলো? পাতাটা উলটাতে যাচ্ছিল, এমন সময় একটা নাম চোখে পড়তেই সে আটকে গেল৷ শেষের ফাঁকা ঘরের ঠিক উপরের লেখা আছে, শ্যামলী গুহ৷ মিনু বই থেকে মুখ তুলে ভাবার চেষ্টা করল৷ এতগুলো নাম একসাথে লেখা হয়েছে কেন? এদের নিয়ে কী করতে চায় গানের আন্টি? সে আবার পাতা উলটাল৷ জায়গায় জায়গায় কীসব যেন লেখা আছে, তার খানিক ইংরেজিতে, সেগুলো ঠিক করে পড়তে পারল না৷ ইংরেজিটা সে এখনও সেভাবে সড়গড় হয়নি৷ কষ্ট করে যেটুকু পড়া গেল তার মধ্যে একটা শব্দ বেশ কয়েকবার আছে, ‘আমদুসিয়াস’৷ এরকম বিদঘুটে নাম মিনু আগে শোনেনি৷ বইটায় ইংরেজি ছাড়াও অন্য ভাষাতেও কিছু লেখা আছে৷ সেগুলো মিনু বুঝতে পারল না৷ অনেকগুলো পাতা জুড়ে বড় বড় ছবি দিয়ে সুর লেখা আছে৷ এগুলোকে বলে স্বরলিপি৷ কীসের সুর এটা? এটাই কি তাহলে মাঝেমাঝে শুনতে পায় সে? কিন্তু সেটা বাজায় কে? বইটা হাতে নিয়ে মিনু উঠে পড়ল৷ ছাদের এই জায়গাটা খুব একটা নিরাপদ নয়৷ নামটা কয়েকবার মনের মধ্যে আউরে নিল৷ ‘আমদুসিয়াস’৷ সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলে আগে পরে বাবার ঘর তারপর মিনুর পড়ার ঘর, সেখান থেকে সিঁড়ি আবার নিচে নেমে গেছে, একতলায় ভাড়াটেরা থাকে, আজ মিনু নিচে নেমে আসতেই দেখল মহেন্দ্রকাকা গায়ে একটা শাল দিয়ে কোথায় বেরোচ্ছে, কেমন যেন হন্তদন্ত ভাব৷ তাকে দেখেই মিনু থমকে দাঁড়াল, ফ্রকের পকেটে ঢুকিয়ে নিল হাতের বইটা৷ এত সকালে পাড়ার লোক ঘুম থেকেই ওঠেনি, এরই মধ্যে এত তাড়াহুড়ো করে বেরোচ্ছে কোথায়? মিনুকে দেখেই মহেন্দ্র থমকে দাঁড়াল,
‘শুনেছিস কী হয়েছে?’
‘কী হয়েছে?’
‘তোর বন্ধু শ্যামলী আছে না…’
‘হ্যাঁ, কী হয়েছে তার?’ অজান্তেই মিনুর বুক কেঁপে উঠল৷
‘তাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না৷’
‘পাওয়া যাচ্ছে না৷’ মিনু খুব একটা অবাক হল না, এমনটা যে হবে তা সে আগেই আশঙ্কা করেছিল৷ বরঞ্চ অন্য একটা প্রশ্ন ঘুরছে তার মাথায়৷ সে মহেন্দ্রর হাতটা ধরে সেটাই করে বসল, ‘আচ্ছা মহেন্দ্রকাকা, আমদুসিয়াস কে?’
একটা বছর দশেকের বাচ্চা মেয়ের মুখে প্রশ্নটা শুনে একটু হাসল মহেন্দ্র, তারপর একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘গ্রিক নাম মনে হচ্ছে, এখুনি মনে পড়ছে না, বই দেখতে হবে৷’
‘তো দেখ৷’ মিনু নির্বিকার মুখে বলল৷
‘এখনই?’
‘তবে নয় তো কী?’
মহেন্দ্রর তাড়া ছিল, সে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না, এই মেয়েটা বড্ড জেদি, যেটা বলেছে সেটা না করিয়ে ছাড়বে না৷
‘আচ্ছা চল দেখছি৷’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মহেন্দ্র ভিতরে ঢুকে এল৷ মিনু এল তার পিছন পিছন তারপর তার প্রিয় দুলন্ত ঘোড়াটার পিঠে বসে দোল খেতে লাগল৷ মিনিট দশেক বইয়ের পাহাড় ঘাঁটল মহেন্দ্র, ল্যাপটপ খুলে কী যেন টাইপ করে ঘনঘন মাথা নাড়াতে লাগল তারপর মুখ তুলে সটান মিনুর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, ‘হঠাৎ নামটা জানলি কোথেকে?’
‘আগে বল তুমি৷’
‘কী বলব?’
‘ওমা! এতক্ষণ কী দেখলে তবে?’
‘ও হ্যাঁ.. আমদুসিয়াস… বটে, যেমনটা ভেবেছিলাম, গ্রিক নাম, তবে মানুষ নয়, সাক্ষাৎ অপদেবতা৷’
‘অপদেবতা কী?’ মিনু বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল৷
‘মানে খানিকটা মানুষের মতোই আবার ঠিক মানুষও নয়, খারাপ কিছু, রাক্ষস বলতে পারিস৷’
‘আমদুসিয়াস রাক্ষস?’ মিনু কেমন যেন ঘাবড়ে গেছে৷
‘ঠিক রাক্ষস নয়, রাজা, কিং আমদুসিয়াস৷’
এবার মিনু অধৈর্য হয়ে উঠল, ‘ধুর কী যে বল ছাতা, বুঝি না৷ ঠিক করে বলবে?’ মহেন্দ্র বই বন্ধ করে তার দিকে বেশ খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, ‘সব বলব, আগে বল তুই এসব জানলি কী করে? এসব তোদের স্কুলের বইতে থাকার তো কথা নয়৷’
মিনু ভেবে দেখল মহেন্দ্রকাকাকে এসব সব কথা খুলে না বললে আমদুসিয়াস সম্পর্কে কিছুই জানা যাবে না৷ তার মনে বলছে সেটা না জানতে পারলে শ্যামলীকে ফিরে পাওয়ার আশাও নেই৷ অগত্যা সে ব্যাজার মুখে পকেট থেকে বইটা বের করে মহেন্দ্রর দিকে এগিয়ে দিল৷ প্রায় আধঘণ্টা ধরে তার প্রতিটা পাতা উলটে দেখল মহেন্দ্র, ধীরে ধীরে তার মুখ লাল হয়ে উঠল, অস্বাভাবিক রকম কাঁপতে লাগল হাত দুটো, এই শীতেও কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম পড়তে লাগল৷ কোনওরকমে মুখ তুলে মিনুকে একবার দেখেই বিছানা থেকে উঠে পড়ল সে৷ ঘরের দরজাটা বন্ধ করে আবার ফিরে এল বিছানার কাছে৷ তারপর ফিসফিসে গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘বইটা কে দিয়েছে তোকে?’
‘আমি পেয়েছি৷’
‘কোথা থেকে?’
‘বলব না, তুমি আমাকে এখনও বলনি আমদুসিয়াস কে৷’
মহেন্দ্র মাথা তুলে বলল, ‘সব বললে তুই বুঝবি না৷’
মিনু উঠে পড়ল, বইটা ছোঁ মেরে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা আমি চলি, তুমি কোথায় যাচ্ছিলে, যেতে পার৷’
‘আচ্ছা শোন, আয় বস এখানে৷’
মিনু আবার আগের মতো ঘোড়ার উপর বসে পড়ল৷ মহেন্দ্র খোলা জানলার দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বলে চলল, ‘গ্রিক পুরাণের কথা, বহু শতাব্দী আগে কোনও এক রাজার আমলে এক বিখ্যাত সুরকার ছিল আমদুসিয়াস, দেশ-বিদেশে তার সুর এত বিখ্যাত ছিল যে হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে লোকে তার বাজনা শুনতে আসত৷ মৃত মানুষও নাকি সেই বাজনা শুনে নড়ে উঠত, ফলে হল কী আস্তে আস্তে চারিদিকে খবর ছড়িয়ে গেল যে সে মরা মানুষকে জাগিয়ে তুলতে পারে, কিছু লোক তাকে দেবতা ভেবে পুজো করতে লাগল, কেউ কেউ আবার তাকে শয়তান বলে রাজার কাছে অভিযোগ করতে লাগল৷ এদিকে রাজা দেখল যে আমদুসিয়াস এত জনপ্রিয় হয়ে পড়েছে যে লোকে আর রাজাকে মান্য করছে না৷ আমদুসিয়াস মানুষ হোক বা শয়তান, সে যে অসীম শক্তির অধিকারী সেটা সবাই একবাক্যে স্বীকার করে৷ ফলে বিপদ বুঝে রাজা আমদুসিয়াসকে খতম করার হুকুম দিলেন৷ সে যুগে গ্রিক দেশে শয়তান অভিযোগে গলা কেটে নেওয়াটাই ছিল বিধি৷ তো রাজার খতমওয়ালা যখন আমদুসিয়াসের গলা কাটতে এল তখন সে সবে একটা একশিংওয়ালা প্রাণী ইউনিকর্নের হাড় থেকে কিছু একটা বাজনা বানাবে বলে সেটাকে কেটে দু-টুকরো করেছে৷ এমন সময় পিছন থেকে খতমওয়ালা তলোয়ার চালাল, আমদুসিয়াসের মাথাটা কেটে পড়ল সামনে৷ অথচ তার হাত দুটো তখনও সচল ছিল৷ সেই হাত দিয়ে সে নিজের মাথার বদলের ওই একশিঙের মাথাটাই তুলে বসিয়ে নিল নিজের মাথায়৷ তার হাড় দিয়ে বানাল এক আশ্চর্য বাজনা, দেখতে অনেকটা বাঁশির মতো৷ কিন্তু ভয়ঙ্কর শক্তি ধরে তাতে৷ সেই বাজনার সুর যে শোনে তাকেই নিজের দলে টেনে নিতে পারে আমদুসিয়াস৷ তারপর থেকে সে হয়ে উঠল শয়তান৷ হয়ে উঠল নরকের রাজা৷ প্রতিমুহূর্তে নরকে ভয়ঙ্কর আর পৈশাচিক সব বাজনা বাজে, তাতে নেতৃত্ব দেয় আমদুসিয়াস, শোনা যায় অনেক সময় ঝড় উঠলেও নাকি তার সেই মারণবাঁশির আওয়াজ শোনা যায়৷’
কথাগুলো শুনতে শুনতে মিনু হাঁ হয়ে গেছিল৷ বেশ কিছুক্ষণ সে কিছু বলল না৷ তারপর হঠাৎ একটা ব্যাপার মাথায় আসতেই বইটার উপর ঝুঁকে পড়ল৷ সেই ছককাটা পাতাটা বের করে মহেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখানে এই নামগুলো লেখা আছে কেন?’
‘ক-টা নাম আছে গুনে দেখ৷’
‘ঊনত্রিশটা, শেষটা খালি৷’
‘নরকে ঊনত্রিশটা দেশের দায়িত্ব ছিল আমদুসিয়াসের উপর, সেই ঊনত্রিশটা দেশের আবার আলাদা আলাদা রাজা ছিল, তাদের সবার নেতা ছিল আমদুসিয়াস, সে তাদের সুর শেখাত, আস্তে আস্তে তারাও ভয়ানক সব শয়তান হয়ে উঠত৷ এবার বলতো কোথা থেকে পেয়েছিস বইটা?’
মিনু এতক্ষণে বুঝেছে আর কিছু চেপে রাখা উচিত হবে না, সমস্ত ব্যাপারটা তার ধারণারও বাইরে৷ একটা চিন্তা শুধু থেকে থেকে হানা দিচ্ছে, শেষ ঘরটা ফাঁকা কেন? কার নাম বসবে ওখানে? সে নিজেও বেশ কয়েকবার শুনতে পেয়েছে সুরটা৷ সেদিন যা দেখেছে সেগুলো তাহলে চোখের ভুল নয়৷ সত্যিই শ্যামলী পালটে গেছে৷ আর তার গানের আন্টি? সেই কি তবে সাক্ষাৎ শয়তান আমদুসিয়াস৷ সুরটা শুনতে পাওয়ার কথা অবশ্য মহেন্দ্রকে বলল না সে৷ বইটাও আর ফেরত নিল না৷
মিনু ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে মহেন্দ্র তার হাত চেপে ধরল, ‘শোন, এসব সত্যি না, পুরাণের গল্প, তাও একা একা কোথাও যাস না৷ কয়েকটা দিন কাটুক, তারপর৷ বুঝলি?’
মিনু মাথা নেড়ে দিল৷ তার মন বলছে শ্যামলীকে আর পাওয়া যাবে না৷ ছকের শেষ ফাঁকা ঘরটা ভাবিয়ে তুলেছে তাকে৷ কী নাম লেখা হবে সেখানে? মৃন্ময়ী মিত্র? শয়তান আমদুসিয়াস কি শেষ পর্যন্ত তাকেও নরকে ধরে নিয়ে যাবে? তাই যদি হয় তাহলে শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে মিনু, কিন্তু কী দিয়ে করবে? তার গায়ে তো জোরও নেই, হাতে অস্ত্রও নেই৷ হঠাৎ খেয়াল হল পায়ের কাছে ভিজে কিছুর স্পর্শ লাগছে, মিনু উবু হয়ে বসে প্লুটোর গলায় হাত বুলিয়ে দিল, ‘তুই লড়াই করবি তো আমার সাথে?’ প্লুটো মহানন্দে আদর খেতে খেতে বিড়াল ভাষায় জানিয়ে দিল, ‘আসুক না ব্যাটাচ্ছেলে আমদুসিয়াস৷ বেড়ালের আঁচড় কাকে বলে আমিও দেখিয়ে দেব৷’
অন্যবার বড়দিনের সন্ধ্যায় পাড়াটাকে প্রায় চেনাই যায় না৷ এবার সব কেমন যেন মিইয়ে পড়েছে৷ পাড়ারই একটা মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ কারওর উৎসবে মন নেই৷ পাশের বাড়ি থেকে সারাদিন কান্নার আওয়াজ আসছে, সন্ধে হতে মিনুর আর ভালো লাগল না৷ ধীরে ধীরে সে বাইরে বেরিয়ে এল, গোটা রাস্তাটা রংবেরঙের আলোয় ভরে আছে৷ অথচ লোকজন বেশি চোখে পড়ছে না৷ পুকুর পেরিয়ে বড়ো রাস্তার ওপারে একদল লোক দলবেঁধে চার্চের দিকে চলেছে৷ ঝলমলে পোশাক পরেছে সবাই৷ মিনুর একবার চার্চ থেকে ঘুরে আসতে ইচ্ছা করল৷ সারি সারি বেঞ্চের উপর বসে প্রার্থনা করে সবাই, ফাদার ধবধবে আলখাল্লা পরে পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে বাইবেলের গল্প পড়ে শোনান৷ কখনও গান হয়৷ বাকি সময় চুপচাপ৷ এসব মিনুর বেশ ভালো লাগে৷ কখনও কখনও সে নিজেও একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ক্রস থেকে ঝুলন্ত যিশুর দিকে৷ আজও তার চার্চে যেতে ইচ্ছা হল৷ আগের বছর সব বাচ্চারা মিলে গেছিল, এবার শ্যামলী নেই, বাকিরাও আসেনি, এবার সে একা৷ মিনু ধীর পায়ে চার্চের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল৷ গায়ের নীলচে সোয়েটারটা দিয়ে ভালো করে কান মাথা ঢেকে নিল৷ চার্চের গা জুড়ে একটা বড়োসড়ো কবরস্থান আছে, একে ইংরোজিতে বলে গ্রেভইয়ার্ড, চার্চের লাগোয়া কবরস্থান৷ সেটা শেষ হতে খানিকটা ঝোপঝাড়, বাঁশগাছের জঙ্গল৷ অন্যদিন হলে সন্ধেবেলা এখানে আসার অনুমতি থাকে না, যদিও জঙ্গলটা ছোট, তাও সাপখোপ থাকতেই পারে৷ বাঁশগাছের জঙ্গলটা এখনও অন্ধকার হয়ে আছে, সেদিকে তাকিয়ে মিনুর কেমন যেন ভয় লাগল৷ হালকা হাওয়ায় বাঁশপাতাগুলো অল্পঅল্প দুলছে৷ সে ঢোক গিলল৷ প্লুটো এতক্ষণ একটু পিছনে হাঁটছিল, এবার সে পায়ের কাছে এগিয়ে এল৷ প্লুটো কাছে থাকলে মিনুর ভয় লাগে না৷ একটু দূরে ঢং ঢং করে চার্চের ঘণ্টা বাজছে৷ মিনু একবার পা চালিয়েও থেমে গেল৷ কীসের যেন একটা আওয়াজ আসছে৷ ভীষণ আস্তে কেউ যেন শিস দিচ্ছে৷ ব্যাপারটায় কান দিল না সে৷ পা টিপে টিপে এগিয়ে চলল চার্চের দিকে৷ মনের ভিতরে কেউ যেন বলতে লাগল জঙ্গলের দিকে তাকালেই এখন কাউকে দেখা যাবে, সামনের বাঁশগাছটার তলায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে৷ মিনুর হাত পা শিরশির করতে লাগল, ঘাড়ের কাছে কার যেন নিঃশ্বাস পড়ল? আর একটা পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে? কিন্তু আর কেউ তো নেই৷ প্লুটোর গায়ের লোম এরকম খাড়া হয়ে উঠছে কেন? সেই ফিনফিনে বাঁশির শব্দটা কি ধীরে ধীরে বাড়ছে?
‘মিনু, এখানে কী করছিস?’ পিছন থেকে আচমকা ডাকটা শুনে মিনু দাঁড়িয়ে গেল, চেনা গলা৷ শ্যামলী, তার অনেকদিনের বন্ধু৷ কিন্তু সে তো হারিয়ে গেছিল৷ এখানে এল কী করে? কথাটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও মিনু জিজ্ঞেস করল না, গির্জার দিকে একটা আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘ওখানে যাচ্ছি৷ কোথায় ছিলিস তুই?’
‘এই তো এখানেই, দ্যাখ এটা দ্যাখ৷’ মিনু দেখল শ্যামলী তার দিকে একটা ছোট বাঁশের টুকরো এগিয়ে দিয়েছে, ভালো করে দেখে বুঝল টুকরোটার গায়ে কতগুল ফুটো করা আছে, বাঁশ নয়৷ বাঁশি৷
‘কী হয় এতে?’
‘ওমা, বাঁশি দিয়ে আবার কী হবে? বাজাবি?’
‘না তুই বাজা, আমি চলি৷’ মিনু তার দিকে পিছন ফিরে পা বাড়াল৷ পিছন থেকে শ্যামলীর বাঁশির শব্দ আসছে, আশ্চর্য! সে এত সুন্দর বাঁশি বাজাতে শিখল কবে? একটুও ভুল নেই৷ দমে একটুও ঘাটতি নেই, দক্ষ বাঁশিওয়ালার মতো একটানা বাজিয়ে চলেছে৷ মিনু খানিকদূর গিয়ে আর যেতে পারল না, মাথাটা কেমন যেন ব্যথা করছে৷ পা দুটো চলতে চাইছে না৷ তার থেকেও আশ্চর্য ব্যাপার হল মিনুর কাঁধ থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসতে চাইছে প্লুটো, তার শরীরটা যেন আগের থেকে বেশ খানিকটা ফুলে উঠেছে৷
নখগুলো থাবার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে৷ একটা লাফ মেরে কোল থেকে নেমে সে পিছন দিকে এগিয়ে গেল, মিনু বুঝতে পারল তার বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই৷ কোনওরকমে সে মুখ পিছন দিকে ফেরাল, আর সাথে সাথে ভয়ে আর আতঙ্কে তার শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেল৷ তার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে একমনে বাঁশি বাজিয়ে চলেছে শ্যামলী, তার ঠিক পিছনেই কার যেন ছায়া পড়েছে, সে ছায়ার মাথাটা হরিণের মতো, শুধু দুটোর বদলে একটা শিং, হাতে একটা সরু লাঠিকে ক্রমাগত ধীরে ধীরে নেড়ে চলেছে ছায়াটা৷ ঠিক যেভাবে মিউজিশিয়ানরা অর্কেস্ট্রা কন্ডাক্ট করে৷
প্লুটো ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে তাদের দিকে, এখন আর তার হাবভাব আগের মতো হিংস্র নেই, সুরের মোহে যেন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে সে৷ আস্তে আস্তে তার শরীরটা বড়ো হচ্ছে৷ মিনু মাটির উপর বসে পড়ল৷ চেষ্টা করেও সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না৷ শ্যামলীর কাছে পৌঁছে প্লুটো কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে দাঁড়াল৷ এতক্ষণে একটা নেকড়ের মতো বড়ো হয়ে উঠেছে সে৷ বাঁশির সুর এখন আরও ভয়ঙ্কর আরও মোহময় হয়ে উঠেছে৷ ধীরে ধীরে প্লুটো ঘুরে দাঁড়াল৷ কী বীভৎস মুখের দৃষ্টি, নীল শয়তানিমাখা কুতকুতে চোখ৷ মিনুর দিকে তাকিয়ে কয়েকবার জিভ বের করল প্লুটো৷ মিনুর মনে হল সেও সুরের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে৷ ক্রমশ তার পা দুটো সচল হল৷ এক-পা এক-পা করে এগিয়ে গেল সেই বাঁশির দিকে৷ রাস্তায় ধারে কাছে কেউ নেই৷ দূরে পাড়ার সব আলোগুলো ঝাপসা হয়ে এসেছে৷ এইবার সেই ছায়ামূর্তির আঙুলগুলো একবারের জন্য থেমে গেল, তারপর হাতছানি দিয়ে ডাকতে লাগল মিনুকে৷ কাছে, আরও কাছে এগিয়ে চলেছে সে, আর বেশি দেরি নেই, মিনুর ছোট্ট দশ বছরের শরীরটা খুব তাড়াতাড়ি বড়ো হচ্ছে, কালই পরিষ্কার করে কাটা নখগুলো আরও ছুঁচলো হয়ে আসছে, এইবার ঝড় উঠবে…
শনশন করে ঝড়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে… শ্যামলীর একদম সামনে এসে পড়েছিল মিনু, এমন সময় মনে হল শ্যামলীর বাঁশি ছাপিয়ে অন্য একটা কিছু শোনা যাচ্ছে, হ্যাঁ, অন্য একটা বাঁশি৷ একটা চেনা সুর৷ মিনুর মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা, তা সত্ত্বেও সে ভালো করে শোনার চেষ্টা করল, সুরটা তাদের পিছন থেকে আসছে, অর্থাৎ মিনুর ঠিক পিছনে দাঁড়িয়েই কেউ বাজাচ্ছে সেটা, কিন্তু কে? এত চেনা সুর, অনেকক্ষণ শোনার পর মিনু বুঝল এই সুরটা সে আজই শুনেছে, ‘জিঙ্গাল বেল, জিঙ্গাল বেল, জিঙ্গাল অল দ্যা ওয়ে৷’
সামনে অন্ধকার ছায়ামূর্তি অস্থির হয়ে উঠেছে, শ্যামলীও বাঁশি থামিয়ে একটানা তাকিয়ে আসছে মিনুর কাঁধের পাশ দিয়ে৷ কে বাজাচ্ছে বাঁশিটা? তাদের পাড়ার কেউ? মিনুও পিছন ফিরে তাকাল, একটা ছোট ছয় চাকার গাড়ি, তার সামনে চারটে কুকুর বাঁধা, গাড়ির একদম উপরে দাঁড়িয়ে আছে একটা লোক, অন্ধকারেও বেশ বোঝা যায় তার লম্বা দাড়ি, বেঁটেখাটো গোলগাল চেহারা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে৷ সুর থামিয়ে সে একটানা তাকিয়ে আছে সামনে৷ কে এই লোকটা?
ঝড়ের শব্দ ধীরে ধীরে অস্থির হয়ে উঠছে, এতক্ষণে সেটা যেন আর্ত চিৎকারের মতো শোনাচ্ছে, একটু একটু করে কমে আসছে ঝড়টা, সেই সঙ্গে মিনুর মাথার তীব্র যন্ত্রণাটাও৷ মিনিট কয়েক মোহগ্রস্তের মতো সেই ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে মিনু পিছন ফিরে তাকাল, ঝড়ের শব্দ মিলিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সেই ছায়ামূর্তিও যেন মুছে গেছে, রাস্তার উপর পড়ে আছে শ্যামলী, তার একটু দূরেই সেই বাঁশিটা, প্লুটো আবার আগের মতো ছোট হয়ে গেছে, এতক্ষণ যেন অন্য জগতে ছিল সে, মিনুর দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ মিনু আবার সামনে ফিরে তাকাল, কুকুরে টানা গাড়ির উপর দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা একবার তার দিকে হাত নাড়াল, মিনু সেদিকে খানিকটা এগিয়ে গেল, জানতেই হবে এ লোকটা কে, এই সময় নির্জন রাস্তায় এই লোকটাই তাকে সাক্ষাৎ শয়তান আমদুসিয়াসের সুরের থেকে বাঁচিয়েছে৷ সেই সাথে শ্যামলীকেও৷ লোকটা কিন্তু এতক্ষণে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়েছে, সে মুখ দেখাতে চায় না৷
‘তুমি কে, দাঁড়াও, দাঁড়াও বলছি ওখানে৷’ কথাগুলো বলতে বলতে সে গাড়ির পিছনে দৌড় দিল, সেটা ধীরে ধীরে গতি নিচ্ছে, টুং টুং করে বেলের আওয়াজ আসছে৷ বরং ঘরর শব্দ করতে করতে সীমান্তের দিকে ছুটে গেল স্লেজটা৷ মিনুর ছোটো ছোটো পা তাদের সাথে পারবে কেন, একটু পরেই গাড়ি সুদ্ধ লোকটা মিলিয়ে গেল৷ মিনু ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল রাস্তার উপরে, দূরের দিকে তাকিয়ে তার মুখ থেকে অস্পষ্ট কয়েকটা শব্দ বেরিয়ে এল, ‘বললে না তুমি কে…’
হঠাৎ তার ঘাড়ের কাছে কীসের যেন ঠান্ডা ছোঁয়া লাগল৷ মিনু সেখানে হাত দিতেই হাতটা ভিজে গেল, বরফ, কিন্তু এখানে বরফ এল কোথা থেকে? উপরে তাকাতেই সে অবাক হয়ে গেল, তার মাথার ঠিক উপরে আকাশ থেকে নেমে আসছে অসংখ্য কুচি কুচি বরফের টুকরো, স্নো-ফল! কিন্তু কলকাতায় তো বরফ পড়ে না৷ মিনু অত কিছু ভাবল না, ঠান্ডা সাদা ধবধবে বরফ দু-হাতে মাখতে লাগল গায়ে৷ একটু পরেই তার চোখ পড়ল শ্যামলীর দিকে৷ এখনও আগের মতোই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে সে, একটু দূরেই সেই বাঁশিটা৷ এগিয়ে গিয়ে সেটা তুলে নিল মিনু, তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেল চার্চের দিকে৷ অবাক বিস্ময়ে দু-বার ‘ম্যাও’ করে প্লুটোও পিছু নিল তার৷
চার্চে ঢোকার ঠিক মুখেই বসে ছিল মিহির৷ গায়ে একটা ছেঁড়া ছেঁড়া সোয়েটার, রাজ্যের শুকনো কাঠ জড়ো করে আগুন জ্বালিয়েছে সে, দু-হাত কচলে আগুন পোহাচ্ছে৷ মিনু আর প্লুটো সেদিকে এগিয়ে গেল, তাকে দেখতে পেয়েই হাসল মিহির, ‘একা একা এতটা রাস্তা এলে দিদি! ভয় করে না?’
‘এবার আর কেউ নেই তো৷’ মিনু একদৃষ্টে চেয়ে আছে আগুনের দিকে৷
‘বড্ড ঠান্ডা পড়েছে, বস, বস, এই আগুনের ধারে বস৷’ কথাগুলো বলে মিহির আবার আগের মতো হাত কচলাতে লাগল৷
মিনু নিঃশব্দে হাতের বাঁশিটা ঢুকিয়ে দিল আগুনের ফাঁকে, লেলিহান শিখায় মুহূর্তে পুড়ে ছাই হয়ে গেল সেটা৷