মিনুর লাল ঘুড়ি আর লামিয়া

মিনুর লাল ঘুড়ি আর লামিয়া

সকালবেলা ছাদে উঠতেই মিনুর মনটা খুশিতে নেচে উঠল, এমনিতে ঘুম থেকে উঠে মায়ের কাছে একদফা বকুনি খেয়ে মন খারাপ হয়েছিল, তার উপর পোষা বেড়ালটা কাল রাত থেকে বেপাত্তা, বকুনি খাওয়ার পরে কিছুক্ষণ বইয়ে মুখ গুঁজে বসে ছিল মিনু, কিন্তু মনে ঘুরঘুর করছিল অন্য চিন্তা৷ কাল স্কুলে একটা আজব ব্যাপার দেখিয়ে তাকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে চিতু৷ রহস্যটা যে ঠিক কী তা মিনু এখনও ভেবে বের করতে পারেনি৷ আজ সকালে উঠে বাবাকে জিজ্ঞেস করবে ভেবেছিল কিন্তু তার আগেই মা এমন ধাতানি দিল যে সেটুকু আর সাহস হল না (পাঠক আপনারা হয়তো এখন জানতে চাইবেন সাত সকালে কেন মিনু মায়ের কাছে বকুনি খেল, কিন্তু মাফ করবেন, সেটা পেশাগত কারণেই আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়, কাল রাতে সে ঘুমের ঘোরে বিছানায় কী করে ফেলেছিল সেটা হাটের মাঝে ছড়িয়ে দিলে তার গল্পগুলো আমাকে বলাই বন্ধ করে দেবে সে)৷

যাই হোক, রহস্যটা হল চিতু কাল তার দাদার ফেলে দেওয়া একটা ক্যালকুলেটার কোনওমতে লুকিয়ে চুরিয়ে স্কুলে এনেছিল, এমনিতে সেটা দেখতে এমন কিছু আহামরি নয়, বরঞ্চ ভাঙাচোরাই বলা যায়, মিনু তাচ্ছিল্য করতে চিতু মিচকি হেসে বলেছিল, ‘হু, হু, বাবা, এসব অত ফেলনা নয়৷ এ ক্যালকুলেটারে ইংরেজি লেখা যায়, সেটা জানিস?’

মিনু প্রথমে ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে চায়নি, ক্যালকুলেটার কি মোবাইল ফোন নাকি যে তাতে লেখাও যাবে৷ হাতে নিয়ে দেখতে পেল তার কোথাও ইংরেজি হরফের বাটনগুলোও লেখা নেই, ধুর… চিতু ঢপ দিচ্ছে৷ সেটা ফেরত দিয়ে মিনু আবার নিজের বেঞ্চের দিকে ফেরার উপক্রম করেছিল, তার মধ্যেই চিতু ক্যালকুলেটারটাকে বাগিয়ে ধরে পটাপট কীসব টিপে মিনুর হাতে সেটা দিয়ে বলল, ‘এই দেখ, হু-হু…’ মিনু দেখল ছোট্ট স্ক্রিনটার ঠিক মাঝখানে বড়বড় হরফে ইংরেজিতে কী যেন লেখা আছে, ইউএনডি, পুরোটা সে পড়তে পারল না৷

চিতু ক্যালকুলেটারটা তার হাত থেকে নিতে নিতে বলল, ‘বিদেশি জিনিস, এতে গেমও খেলা যায়, সে আর একদিন দেখাব৷’ বলে সেই মিচকি হাসিটা আর একবার হেসে বসে পড়ল৷

তারপর থেকে মিনুর এই এক চিন্তা, এ-বি-সি-ডির বাটন নেই কিন্তু তাও লেখা যায়৷ ভারী আশ্চর্য জিনিস বটে, একবার ভেবেওছিল বাবাকে এনে দিতে বলবে, কিন্তু বিদেশি জিনিস যে, এখানে কি পাওয়া যাবে? এখন কিন্তু ছাদে উঠতেই সেই চিন্তাটা মাথা থেকে একেবারে মুছে গেল, তার কারণ অন্য কিছু নয়, ছাদের একপাশে যে ছোট মিটার ঘরটা আছে তার ঠিক মাথার কাছে আটকে আছে একটা লাল ঘুড়ি, দুপুরের ঝিরঝিরে হাওয়ায় সেটা তিরতির করে কাঁপছে, যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে৷ মিনু সেদিকে এগিয়ে গেল, হাত বাড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল ঘুড়িটা৷ কিন্তু হাতের আওতার বেশ খানিকটা উপরে আটকেছে সেটা, এমনকি লাফিয়েও ধরা গেল না৷ মিনু হতাশ হয়ে ছাদের পাঁচিলের একপাশে বসে পড়ল৷ কী সুন্দর রঙিন চাঁদিয়াল ঘুড়ি, কোথা থেকে কেটেছে কে জানে! এখন তো বিশ্বকর্মা পুজোও ঢের দেরি আছে, তাহলে এল কোথা থেকে?

এমনিতে কিন্তু মিনু ঘুড়ি ওড়াতে পারে না৷ একবার পাশের বাড়ির বিল্টুদাদারা তাকে লাটাই ধরতে দিয়েছিল, কিন্তু তখন সে এতই হালকা যে লাটাইটা প্রায় টেনে আকাশে নিয়ে যাচ্ছিল তাকে, তারপর থেকে মা বলেছে বড়ো না হলে আর লাটাই না ধরতে৷ মিনুর অবশ্য ঘুড়ি ওড়াতে তেমন ভালোও লাগে না, কিন্তু দেখতে মজা লাগে, এই মুহূর্তে মনে হল ঘুড়িটা না পেলেই নয়৷ পড়ার বইয়ের সামনে সাজিয়ে রাখলে বেশ লাগবে দেখতে৷ এইসব ভেবে সে আবার উঠে দাঁড়াল, আবার লাফ দিল, কিন্তু লাফ দিলেই যেন আরও খানিকটা সরে যাচ্ছে, কী আশ্চর্য! যদি হাতেই না আসবে তাহলে ছাদে এসে লাগল কেন? মিনুর এবার জেদ চেপে গেল৷ কী দুঃসাহস ঘুড়িটার! যেন বারবার তাকে বেঁটে বলে ভেংচি কাটছে, আহাহা! বাঁকা কাঠির হাসি দেখ না, গা জ্বলে যায়৷ মিনু উঠে দাঁড়াল৷

মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে বটে কিন্তু সেটা করতে গেলে যদি আশপাশের বাড়ি থেকে কেউ দেখে নেয় আর তারপর যদি মাকে বলে দেয় তাহলে তার পিঠের একখানা হাড়ও আর আস্ত থাকবে না৷ যাই হোক জেদ যখন চেপেছে তখন না করে উপায় নেই, তাছাড়া এখন চারপাশে কেউ নেইও৷ ছাদের পাঁচিলের উপর একটা পা রাখল মিনু, তারপর আর একটা পা, নিচে তাকাতেই গা-টা কেমন যেন শিরশির করে উঠল৷ ঘুড়িটা কিন্তু হাতের কাছে এসেছে৷ এবার যাবে কোথায়? হাত বাড়িয়ে ঘুড়ির একটা পাশ ধরল সে, আর সাথে সাথে পাঁচিলের উপর থেকে পা পিছলে গেল৷ ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিল মিনু, হয়তো এক্ষুনি নিচে পড়বে, খুব কি ব্যথা লাগবে? পা ভেঙে যাবে? অন্তত কয়েকটা হাড়… বেশ কিছুক্ষণ চোখ বুজে সে এইসব ভাবছিল, কিন্তু এখনও মাটিতে ধাক্কা লাগল না কেন? দোতলা থেকে পড়তে তো এতক্ষণ লাগার কথা নয়, মিনু দুরুদুরু বুকে চোখ খুলল৷ আর চোখ খুলতেই বিস্ময়ে মুখ হাঁ হয়ে গেল, সে নিচে পড়েনি৷ ঘুড়িটাই বাঁচিয়ে নিয়েছে তাকে, কিন্তু সেটা আর মিটার ঘরের ছাদে আটকে নেই, হাওয়ায় দুলতে দুলতে ভেসে পড়েছে ছাদের বাইরে৷ মিনু একবার ভাবল চেঁচিয়ে কাউকে ডাকবে, একি সর্বনেশে ঘুড়ি রে বাবা!

অন্তত পঁচিশ কেজির একটা মানুষকে নিয়ে দিব্যি উড়ে চলেছে, শুধু উড়ছে যে তাই নয়, আস্তে আস্তে উপরের দিকে চলেছে, হায় ভগবান, এবার কী হবে? হাত ছেড়ে দিলে নিচে পড়ে হাত-পা ভাঙবে, আবার ধরে থাকলেও কোথায় গিয়ে যে থামবে কে জানে, ভাবতে ভাবতেই সে বেশ খানিকটা উপরে উঠে গেল, যত উপরে উঠছে তত গতি বাড়ছে ঘুড়িটার, মিনুর কান্না পেয়ে গেল৷ তার ঠিক পায়ের নিচে তখন খেলার মাঠটা সরে যাচ্ছে, সব কিছু ছোট হয়ে আসছে৷ ছাদে মায়ের শুকোতে দেওয়া ভেজা শাড়িগুলো, বিল্টু দাদাদের অ্যান্টেনা৷ ঘুড়িটা এবার রকেটের মতো শোঁ শোঁ করে উপরে উঠছে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে৷ মিনু বুঝল নিচে তাকিয়ে আর কোনও লাভ নেই, ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে ঘুড়িটা কোথাও যেন নিয়ে যাচ্ছে তাকে৷

আকাশের বুকে সাদা ঝকঝকে মেঘেদের দল দুপুরের রোদ মেখে নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে৷ একটা দুটো পাখি ঘুড়ির ঠিক পাশ দিয়ে উড়ে যেতে যেতে মিনুকে দেখে অবাক বিস্ময়ে তার পায়ে দুটো ঠোক্কর মেরে গেল, সত্যিকারের মানুষ তো? নাকি ফানুস? এদিকে মিনু কিন্তু এতক্ষণে ঘুড়িটার উপর চড়ে বসেছে, তার একটু আগের ভয়টা কেটে গেছে৷ এখন বরঞ্চ বেশ মজাই লাগছে৷ যেভাবে ঘুড়িটা বোঁ-বোঁ করে মেঘগুলোর দিকে ধেয়ে যাচ্ছে তাতে সেগুলোকে পার না করে থামবে বলে তো মনে হয় না৷ কী আছে মেঘগুলোর ওপারে? এ ভাবনাটা আগেও তার মাথায় এসেছে, আজ মনে হচ্ছে সেই রহস্যের সমাধান হবে৷ মিনু ঝটপট ভেবে নিল বাড়ি ফিরেই এই সমস্ত ঘটনা লিখতে বসবে, অবশ্য কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না— তা সে ভালো করেই জানে৷ তবে যখন বড়ো হবে তখন মোটা মোটা ছবি ছাড়া বইতে এই সব ফলিয়ে লিখে দেবে৷ আর সেই বই পড়ে স্কুলের বাংলার স্যার গগনবাবু জিভ কেটে বলবেন, ‘আহা গো, মৃন্ময়ী বাংলায় এত ভালো ছিল, আর আমি কিনা নম্বরই দিতুম না খালি বানান ভুল করত বলে৷’

ব্যাপারটা ভেবেই মিনুর হাসি পেল৷ হাওয়ার টানে তার ঘাড় অবধি লম্বা চুলগুলো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ফ্রকের একটা দিক লেপটে আর একটা দিক পিছনে ফুলে ফেঁপে পতপত করে উড়ছে৷ নিচে তাকালে এখন আর কিছুই চোখে পড়ে না, সব যেন সাদা সাদা বাক্স৷ খুশিতে ডগমগ হয়ে মিনু খালি গলায় গান ধরল, ‘বিড়াল হল বাঘের মাসি, বাঘের মেসো হুলো…’ গানটা গাইতেই তার বিড়াল প্লুটোর কথা মনে পড়ে গেল৷ কাল রাত থেকে কোথায় যে ভ্যানিশ হয়ে গেল কে জানে৷ আজ সকালে খেতেও আসেনি৷ প্লুটো দিনকতক হল একটা নতুন খেলা পেয়েছে৷ শুধু খেলা নয়, তার সাথে খাওয়াও৷ পাশের বাড়ির ছাদগুলোতে গম ছড়িয়ে রাখা হয় বলে সেখানে দুপুরবেলা পায়রা এসে বসে, প্লুটো তক্কে তক্কে থাকে, সুযোগ বুঝলেই বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পায়রা ধরে নেয়৷ আজও হয়তো সেই লোভেই কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ প্লুটোকে আর দেখতে না পেলে খারাপ লাগবে মিনুর৷ যতই যাই হোক, প্লুটোর ‘ম্যাও’ ডাকটা ভারী সুন্দর৷ কাঁচুমাচু মুখ আর ওই করুণ ‘ম্যাও’ ডাকেই তার সব দোষ মাফ করে দেয় মিনু৷ এদিকে ঘুড়িটার তো থামার নাম নেই৷ শেষ পর্যন্ত যদি আকাশে মাথা ঠুকে যায়? আচ্ছা আকাশটা কি নরম না শক্ত? দেখে তো খুব শক্ত বলে মনে হয় না৷ আচ্ছা জল জমেই তো নাকি মেঘ হয়, তাহলে মেঘগুলোকে কি জলের মতো খাওয়া যায়? মিনুদের পাড়ায় একটা বুড়ো লোক হাওয়াই মিঠাই বেচতে আসে, কি যেন বলে কটন ক্যান্ডি না কী… সেরকমই হবে বোধহয় মেঘগুলো৷

এইসব ভাবতে ভাবতে মিনুর ঘুম পেল, ঘুড়ির উপরেই কোনওরকমে জায়গা করে শুয়ে পড়ল সে৷ দু-একটা লম্বা লম্বা হাই তুলল, পাশ ফিরে না শুলে ঘুম আসে না, পাশ ফিরতেই দেখতে পেলো তার চোখের ঠিক সোজাসুজি সূর্যটা হালকা লাল হয়ে ওপাশে ঢলে পড়েছে, মানে এখন বিকেল, তার সব বন্ধুরা এতক্ষণে মাঠে বউবসন্ত খেলছে৷ মা ছাদে জামাকাপড় তুলতে এসে দেখছে মিনু নেই, সারা বাড়িতে খোঁজ খোঁজ রব পড়েছে৷ এত সব কিছু ভাবতে ভাবতে মিনুর চোখ বন্ধ হয়ে এল, মেঘের বুক চিরে উড়তে থাকা আশ্চর্য ঘুড়িতে শুয়ে বিকেলের হালকা সোনালি আলো গায়ে মেখে ঘুমিয়ে পড়ল ছোট্ট মেয়েটা…

ঘুম যখন ভাঙল তখন চারিদিকে অন্ধকার নেমেছে৷ মিনু চোখ খুলে দেখল কোথাও একটা এসে দাঁড়িয়েছে ঘুড়িটা৷ শুয়ে শুয়ে মনে হল কোনও খালি জায়গা, আকাশে টিম টিমে তারা দেখা যাচ্ছে৷ সে উঠে বসে দু-হাত মাথার উপর তুলে আড়মোড়া ভাঙল৷ বেশ ঠান্ডা লাগছে৷ আকাশের একদিকে গোল মোটাসোটা চাঁদ উঠেছে৷ মিনু দুটো হাত মুঠো করে চোখ রগড়ে নিল, তারপর নিচে তাকিয়ে দেখল তার পায়ের ঠিক নিচেই মেঘের জমাট চাদর, তার উপরে এসে থেমেছে ঘুড়িটা৷ চাঁদের চকচকে আলো চারপাশের মেঘের উপর পড়ে মনে হচ্ছে যেন মুক্তোর সমুদ্রর উপর ভেসে রয়েছে একটা লাল ঘুড়ি৷ এখন ক-টা বাজে কে জানে, মিনুর এতক্ষণে কেমন যেন ভয় লাগল৷ ঘুড়িটা এত দূর নিয়ে তো এল, কিন্তু এবার যদি ফিরিয়ে না নিয়ে যায়? এখানে সে খাবেই বা কী? আর কথাই বা বলবে কার সাথে? ঘুড়ির উপর বসে পা দোলাতে দোলাতে ঠিক নিচের মেঘটায় পা লেগে গেল৷ বেশ শক্ত, বোধহয় এর উপর দিয়ে হাঁটা যায়৷ মিনু মেঘের উপর নেমে পড়ল৷ এত শক্ত মেঘ ফুঁড়ে ঘুড়ি কী করে এল কে জানে৷ যাইহোক অতশত না ভেবে মিনু হাঁটতে লাগল৷ মেঘগুলো কিছু দূর গিয়ে ছিঁড়ে গেছে, তারপর আবার শুরু হয়ছে অন্য মেঘ৷ সে একমনে চাঁদের দিকে পা চালাল৷ চারপাশে কোথাও কিচ্ছু নেই, এমনকি একটা আওয়াজও শোনা যাচ্ছে না৷ হঠাৎ মিনুর মনে হল তার জল তেষ্টা পেয়েছে৷ মেঘগুলোকে কি খাওয়া যায়? এত কাছে যখন আসা গেছে তখন একবার মুখে দিয়ে দেখাই যায়৷ সে নিচু হয়ে বসে শক্ত মেঘের উপর আঙুল দিয়ে চাপ দিল, আর ওমনি সেখানটা দেবে গিয়ে আঙুলটা ভিতরে ঢুকে গেল৷ হাতে করে খানিকটা মেঘ তুলে মিনু মুখে দিল৷ ওমা! এ তো জল নয়, আইসক্রিম! কিন্তু ভূগোল স্যার নীলকণ্ঠবাবু যে বলেছিল জল জমেই মেঘ হয়? মিনুর এমনিতে ভূগোল পড়তে একদম ভালো লাগে না৷ একবার ফিরতে পারলে সে সবাইকে বলে দেবে যে জল জমে নয়, আসলে আইসক্রিম জমেই মেঘ হয়৷ বেশ খানিকটা খেয়েও অবশ্য সে বুঝতে পারল না স্বাদটা ঠিক কীসের৷

পেট ভরে আইসক্রিম খেয়ে মিনু আবার চলতে লাগল, এ জায়গাটা খারাপ লাগছে না৷ কয়েক দিন থেকে গেলেও বেশ হয়, খালি প্লুটোটা যদি থাকত, খানিকটা গল্প করা যেত৷ প্লুটো অবশ্য ম্যাও ছাড়া কিছু বলতে জানে না, কিন্তু হলেই বা, সব ‘ম্যাও’ একরকম নয়৷ এতদিন তার সাথে মিশে মিনু বেশ বুঝতে পারে কোন ম্যাও দিয়ে প্লুটো কী বোঝাতে চায়৷ আর একটু এগোতেই কিন্তু সে থেমে গেল৷ সামনে আর এগোনোর পথ নেই, এই মেঘটা এখানেই শেষ৷ তারপর অন্য একটা মেঘ শুরু হয়ছে বটে কিন্তু দুটো মেঘের মাঝখানে একটা বড়োসড়ো ফাঁক৷ মিনুর পক্ষে অতটা লাফ দেওয়া সম্ভব নয়৷ সে ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করল, নিচে প্রায় কিছুই দেখা যায় না, বাড়ি-ঘর, গাছপালা সব একসাথে মিশে ড্রয়িং বইতে ওয়াটার কালারে আঁকা ছবিগুলোর মতো দেখাচ্ছে৷ এবার কী হবে? চারদিক থেকেই তো রাস্তা বন্ধ, আবার কি ঘুড়িটায় ফিরে যাবে? কিন্তু সেটা তো আর নড়বে বলে মনে হচ্ছে না৷ মিনুর এত দুঃখ হল যে আইসক্রিম খেতেও ইচ্ছা করল না, সে ছেঁড়া মেঘের একটা সুতোর উপর বসে পড়ল৷ আর সাথে সাথে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে গেল৷ ওপাশে দূরে থাকা মেঘটা ধীরে ধীরে এই মেঘটার কাছে চলে এল, কাছে আসতে আসতে দুটো মেঘ জুড়ে গেল৷ মিনুও এতক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে৷ তার মনটা আবার খুশিতে নেচে উঠল৷ এইভাবে মেঘের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই সে চাঁদে পৌঁছে যাবে, আচ্ছা চাঁদে কী আছে? নীলকণ্ঠবাবু অবশ্য বলেছিল চাঁদের গোটা গা জুড়ে শুধু বড়োসড়ো ফুটো, কিন্তু একটু আগে মেঘের গা থেকে আইসক্রিম খাওয়ার পর মিনুর ধারণা হয়েছে যে আসলে ভূগোলের মাস্টাররা কিছুই জানে না৷ শুধু যে জানে না তাই নয়, পরীক্ষার খাতায় নিজের মতো কিছু লিখতে গেলে রীতিমতো গোল্লা দিয়ে দেয়৷ মিনু গম্ভীর গলায় বলল, ‘দাঁড়াও, একবার ঘুড়িটা আমায় ফিরিয়ে নিয়ে যাক, গোল্লা দেওয়া কাকে বলে আমিও দেখিয়ে দেব৷’

এইরকম করে বেশ কিছুক্ষণ চলল, মিনু খানিকদূর চলে, আইসক্রিম খায়, জিরিয়ে নেয়, গান গায়, আবার চলতে থাকে, যত এগোয় তত মনে হয় চাঁদটা যেন বড়ো হচ্ছে, বেশ খানিকটা হেঁটে আসার পর কিন্তু মিনুর মনে হল সে আর চলতে পারবে না, পায়ে ব্যথা করছে, এদিকে ঘুমও পাচ্ছে না, শুয়ে থাকতেও ভালো লাগছে না, চলতেও ইচ্ছা করছে না, অগত্যা সে বসে পড়ল৷ মেঘের উপর কয়েকবার গড়িয়ে নিল৷ বাড়িতে এখন কী হচ্ছে কে জানে৷ বাবা বোধহয় পুলিশে খবর দিয়েছে৷ মা কি কান্নাকাটি করছে৷ মিনু মাকে কোনওদিন কাঁদতে দেখেনি৷ পিসতুতো ভাই গল্লুর একবার হাত পুড়ে গেছিল বলে পিসি একটা গোটা দিন হাপুস হয়ে কেঁদেছিল৷ অথচ মিনুর কোথাও কেটে গেলে মা কোনওদিন কাঁদেনি৷ হঠাৎ মিনু হিহি করে হেসে উঠল৷ আর সাথে সাথে তার মনে হল তার পিঠের তলার মেঘটা যেন কেঁপে উঠল৷ ব্যাপার কী? উঠে দাঁড়াতেই সে অবাক হয়ে গেল, মেঘটা আর স্থির নেই, লাল ঘুড়িটার মতোই সেটা হন্তদন্ত হয়ে চাঁদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্য সব মেঘগুলোকে পাশ কাটিয়ে, বাসের সামনের সিটে বসলেও অনেকটা এরকম দেখায় বটে৷ আর একটা ব্যাপার চোখে পড়তেই বিস্ময়ে মিনুর মুখটা হাঁ হয়ে গেল৷

চারপাশের মেঘগুলো এতক্ষণ সে ফাঁকা ভেবেছিল, এখন দেখা যাচ্ছে তার প্রত্যেকটার উপর বসে আছে তারই বয়সি ছেলেমেয়েরা৷ তাদেরকে নিয়ে চাঁদের দিকে ছুটে চলেছে মেঘগুলো৷ কিন্তু কেন? এতক্ষণে মিনুর সত্যিকারের ভয় লাগল, কী আছে চাঁদে যে এতগুলো ছেলেমেয়েকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ মিনু চিৎকার করে বাকিদের ডাকার চেষ্টা করল, কিন্তু কেউ শুনতে পেল না৷ কানের পাশ দিয়ে শনশন করে ঠান্ডা হাওয়া বইছে, তাতে কীরকম একটা আওয়াজ হচ্ছে যেন! হয়তো যতটা সম্ভব আর্তনাদ করে তারা কিছু বলতে চাইছে মিনুকে, কিন্তু কী? হাওয়ার ভাষা তো সে বোঝে না৷ আর বুঝেই বা কী লাভ, এখান থেকে পালানোর উপায় নেই৷

শেষ পর্যন্ত মেঘটা যখন চাঁদের উপর গিয়ে থামল তখন চারপাশে বেশ একটা হই হট্টগোল পড়ে গেছে৷ বাকি মেঘগুলো থেকেও নেমে এসেছে ছেলেমেয়ের দল, তাদের কেউ ভয়ে কাঁপছে, আবার কেউ দিব্যি আনন্দে লাফচ্ছে৷ মিনু নিচে নেমে দেখল চাঁদের মাটিটা বেশ নরম৷ ঠিক যেন স্পঞ্জের মতো, মনে হয় নিচে স্প্রিং লাগানো আছে, একটু লাফালেই অনেকটা উপরে ওঠা যায়৷ এতক্ষণে সে বুঝল যে নীলকণ্ঠবাবু লোকটা ভারী মুখ্যু৷ এখানে ফুটো তো নেইই বরঞ্চ প্রায় মানুষের সমান উঁচু বেশ কয়েকটা টিলা দেখা যাচ্ছে৷ মাটিটা একদম সমান, শ্বেতপাথরের মেঝের মতো৷ হাঁটতে ভারী আরাম লাগে৷ মিনু হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা দূরে চলে এল৷ হঠাৎ চোখে পড়ল তারই বয়সি একটা মেয়ে পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে চারিদিকে নজর রাখছে, ভাবখানা এমন যেন এক্ষুনি কেউ এসে ধরে নিয়ে যাবে৷ মিনু সাত পাঁচ না ভেবে তার পাশে গিয়ে বসে পড়ল৷ মেয়েটা আচমকা কারওর উপস্থিতি বুঝতে পেরে চমকে উঠে পালাতে যাচ্ছিল তারপর মিনুকে দেখে একটু আশ্বস্ত হল৷ সমস্ত ব্যাপারটা মিনুর কাছেও গুলিয়ে গেছিল, তাও সে কিছু জিজ্ঞেস করল না৷ মেয়েটা চারপাশ ভালো করে দেখে নিয়ে মনে মনে কী যেন হিসেব করতে লাগল, তারপর হঠাৎ করে মিনুর কাঁধে চেপে ধরল, মুখের একদম সামনে মুখ নিয়ে এসে বলল, ‘তোকেও নিয়ে এসেছে, ঘুড়ি ধরতে গেছিলি নিশ্চয়ই?’

মিনু মাথা নাড়ল৷ তারপর ঢোক গিলে বলল, ‘হ্যাঁ, লাল ঘুড়ি৷’

মেয়েটা কী যেন দুঃখে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, ‘ওই লোভেই আমারও এই হাল হয়েছে৷’

‘কী হাল?’ মিনু সভয়ে জিজ্ঞেস করল৷

মেয়েটা আবার কীসব ভাবতে লাগল, বোধহয় মিনুকে সব কিছু বলা উচিত হবে কি না সেটাই হিসেব করে দেখার চেষ্টা করছে৷ বেশ কিছুক্ষণ পর হতাশ মুখে বলল, ‘লামিয়ার নাম শুনেছিস?’

‘লামিয়া৷ সেটা কে?’

‘হুম… না শোনাই ভালো৷ আয় আমার সাথে৷’ মিনুর হাত ধরে সে টান দিল৷ দু-জনে উঠে পড়ল৷ মনে হচ্ছে মেয়েটা অনেকদিন আছে এখানে, হয়তো কিছু জানে, কিন্তু লামিয়া কে? তাকে এত ভয় পাওয়ারই বা কী আছে৷ যাই হোক মিনু বেশি না ভেবে এগিয়ে গেল৷ এইদিকের মাটি আর সমান নেই, কয়েকবার হোঁচট খেল৷ সামনেই একটা বড়ো পাথর, মেয়েটা সেদিকেই টেনে নিয়ে চলেছে তাকে, দূর থেকে কীসের যেন একটা আওয়াজ আসছে, ভালো করে শুনলে মনে হয় খুব মিনমিনে সুরে কে যেন বাঁশি বাজাচ্ছে৷ মেয়েটা তারই বয়সি হলে কী হবে, হাতে বেশ জোর৷ কেমন যেন রুক্ষ বালিমাখা হাত৷ খানিকটা এগোতে মিনুর চোখের সামনে থেকে পাথরটা সরে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল, পা আর এগোতে চাইল না৷ মেয়েটা ধরে না নিলে সে হয়তো পড়েই যেত৷ সামনে এবড়ো-খেবড়ো মাটির উপর পড়ে আছে কয়েকটা হাড়, গোটা নয়, ভাঙা-ভাঙা, যেন একটা বিশাল দৈত্য কামড়ে কামড়ে খেয়েছে তাদের৷ হাড়গুলো ফেলে দিয়েছে মাটির উপরে৷ ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যায় সেগুলো বাচ্চাদের হাড়৷ এক মুহূর্তে মিনুর মাথায় সমস্ত ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল৷ তাহলে এই কারণেই এতগুলো বাচ্চাকে ডেকে আনা হয়ছে এখানে৷ কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে এই মেয়েটা এখানে বেঁচে থাকল কী করে? মিনু পাথরের আড়ালে লুকিয়ে বসে পড়ল৷ এবার কী হবে? এখান থেকে তো আর পালানোর পথ নেই, একটু পরেই হয়তো আকাশ জুড়ে দেখা যাবে দৈত্যটাকে৷ মিনুর কান্না পেল৷ মেয়েটা তার কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বলল, ‘ভয় পেলি?’ মিনু উত্তর দিল না৷ তার চোখ ফেটে জল আসছে, প্লুটোকে আর দেখতে পাবে না হয়তো৷ একটু পরে তার হাড়গুলোও পড়ে থাকবে মাটির উপর৷ মেয়েটা তার পাশে বসে পড়ল, তারপর মাটির উপর হাত বুলোতে বুলোতে বলল, ‘লামিয়া কোনও দৈত্য নয়, অনেকটা মানুষের মতোই দেখতে৷ কিন্তু দৈত্যের থেকেও ভয়ানক৷’

এই কথাটা শুনে মিনু খানিকটা ভরসা পেল৷ মানুষের মতোই যখন তখন তাকে দেখে অন্তত ভয় লাগবে না, উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই দেখেছিস?’

‘হ্যাঁ, দু-বার, পাথরের আড়ালে লুকিয়ে৷ মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত মানুষের, তার নিচটা সাপের মতো৷ একটা সাপের খোলস জড়ানো থাকে কোমরে৷ একবার দেখলেই হাত-পা অবশ হয়ে আসে, আমি কোনওরকমে পালিয়ে বেঁচেছি৷ তারপর থেকে এই পাথরের আড়ালেই লুকিয়ে থাকি৷’ মিনু দেখল তারও খানিকটা আশা আছে, কিন্তু এভাবে লুকিয়েই বা কতদিন থাকা যায়, একসময় তো লামিয়া খুঁজে নেবেই তাকে৷ তখন? কথাটা মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করতেই তার মুখে কেমন একটা ঝিলিক খেলে গেল, মিনুর দিকে আর খানিকটা সরে এল সে, তারপর ফিসফিসে গলায় বলল, ‘জানিস, এই ক-দিনে আমি একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি৷’

‘কী?’

‘এখানে লামিয়া ছাড়াও আরও কিছু আছে৷’

‘কী আছে?’ মিনু আশার আলো দেখল৷

‘তা ঠিক জানি না, তবে লামিয়া ভয় পায় তাকে৷’

‘কী করে বুঝলি?’

মেয়েটা আঙুল দিয়ে একদিকে দেখিয়ে বলল, ‘ওই যে উঁচু পাহাড়টা দেখছিস, ওটাতে উঠে মাঝে মাঝে চারদিক নজর রাখে লামিয়া, তো আমি একদিন ওর নিচেই লুকিয়ে ছিলাম, অন্য কোথাও থাকলেই আমায় ধরে ফেলত, লামিয়া পাহাড়ের উপরে থাকলে পাহাড়ের নিচটাই বাঁচার জায়গা৷ আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছি৷ এমন সময় হঠাৎ কীসের একটা ডাক শোনা গেল, আমি মনে মনে ভাবলাম এখানে তো আর কেউ থাকে না, তবে এত জোরে ডাকল কে? হঠাৎ ঠিক সামনেই কিছু একটা দেখতে পেলাম, প্রথমে মনে হয়েছিল সেটা একটা বড়ো পাথর, পড়ে বুঝলাম কারওর পা সেটা, আমি তো অবাক, এত বড়ো পা তো কোনও জন্তুর হয় না৷ অথচ নখ আছে, পুরো জন্তুটাকে দেখতে পাইনি বটে… কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই দেখেলাম লামিয়া ভয়ঙ্কর চিৎকার করতে করতে পাহাড় থেকে নেমে গেল, বুঝলাম সেও কাউকে ভয় পায়৷’

এতগুলো কথা বলে মেয়েটা দম নিতে একটু থামল৷ মিনু ব্যাপারটা ভালো করে ভেবে দেখার চেষ্টা করল৷ সেই অজানা জন্তুটা যদি লামিয়াকে মেরে ফেলতে পারে তাহলে তার বাঁচার আশা আছে বটে, কিন্তু ততদিন পালিয়ে পালিয়ে বাঁচাও তো মুখের কথা নয়৷ তার আগেই যদি লামিয়া দেখতে পেয়ে যায় তাকে? সে যাহোক মিনুর ভয়টা এতক্ষণে কেটে গেছে৷ সে মেয়েটার কাঁধে একটা হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘নাম কী রে তোর?’

‘অন্তি৷ তোর?’

‘মৃন্ময়ী মিত্র৷’ অচেনা লোকের কাছে নিজের ডাকনামটা বলতে একদম ইচ্ছা করে না৷

‘ভালোই হল তোকে পেয়ে, শোন, একটা কাজ করতে পারবি?’

‘কী কাজ?’

‘যদি লামিয়াকে দেখে আমি অবশ হয়ে যাই তাহলে তুই আমাকে টেনে নিয়ে পালাবি, আমি যেতে না চাইলেও নিয়ে যাবি, বুঝেছিস?’ মিনু মাথা নেড়ে দিল৷ অবশ্য ততটা জোর তার গায়ে আছে কি না সেটাই সন্দেহের৷ যে কোনও একজনকেই যদি লামিয়া দেখে ফেলে তবে দু-জনকেই তার পেটে যেতে হবে, পিছনে পড়ে থাকা মানুষের হাড়গুলোর কথা ভেবে মিনুর গা-টা শিউরে উঠল৷

‘চ, এবার উঠি৷’ অন্তি উঠে পড়ল৷

‘কোথায়?’

‘ওই পাহাড়ের কাছে, লামিয়াও হয়তো ওদিকেই গেছে৷’

মিনুও উঠে পড়ল৷ তারপর কী যেন ভেবে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, আমার সাথে তো আরও অনেকে এল এখানে, তাদের কী হবে?’

‘আস্তে আস্তে সবাইকেই খাবে, এখানে তো পালানোর উপায় নেই৷ তুই ভালো লুকোচুরি খেলতে পারিস তো?’

‘হ্যাঁ৷’

‘তাহলে ভয় নেই৷’

‘কিন্তু শুধু বাচ্চাদেরই এখানে আনে কেন?’

‘আমিও ঠিক জানি না, তবে শুনেছি লামিয়া একসময় এতটা খারাপ ছিল না৷ খুব সুন্দর এক রানি ছিল তখন, ছেলেমেয়েও ছিল৷ তো একদিন হেরা বলে আর এক রানি তার সব ক-টা ছেলে-মেয়েকে খেয়ে নেয়, তারপর থেকে রাগে-দুঃখে লামিয়া মানুষের ছেলে-মেয়েকে খেতে শুরু করে৷’

‘কিন্তু হেরাই বা ওর ছেলে-মেয়েকে খেয়ে ফেলল কেন?’ মিনু অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল৷

‘তা আমি বলতে পারব না৷ তাড়াতাড়ি আয়, দেরি করলে আমাদের দেখতে পেয়ে যাবে৷’

দু-জনে দ্রুত পা চালাল৷ দূর থেকে আসা সেই বাঁশির আওয়াজটা ধীরে ধীরে বাড়ছে, এতক্ষণ শান্ত হয়ে হাওয়া দিচ্ছিল, সেটাও যেন ধীরে ধীরে গতি নিচ্ছে৷ দূরে পাহাড়ের চূড়াটা দেখা যাচ্ছে, তার উপর দিকটা মেঘে ঢাকা৷ আলো-আঁধারের অদ্ভুত রঙে সেজেছে চারিদিক৷ চারপাশের স্থির নিস্তব্ধ পাথরগুলো যেন কীসের প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছে, এতগুলো ছেলেমেয়ে এখানে এসে নামল কিন্তু এখন কাউকে দেখা যাচ্ছে না৷ সবাই গেল কোথায়? মিনু আর অন্তি আস্তে আস্তে পাহাড়ের কাছে পৌঁছল৷ মিনু শক্ত করে ধরে আছে অন্তির কব্জিটা, লামিয়া কাছে-পিঠেই কোথাও আছে, এখানে থাকলে সে দেখতে পাবে না বটে কিন্তু তার সটান নিচে দাঁড়িয়ে থাকার কথা ভাবলেই ভয়ে গলা বন্ধ হয়ে আসছে৷ একটা ফোকরের সামনে বসে দু-জনে অপেক্ষা করতে লাগল৷ মিনু ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁরে, এলে বুঝব কী করে?’

‘ঝুমুরের আওয়াজ, আর সাপের হিসহিস শুনতে পাবি৷’

‘যদি বুঝতে পারে আমরা এখানে আছি?’

অন্তি উত্তর দিল না, চারপাশটা নিস্তব্ধ, মিনু বেশ কয়েকবার কান পেতে শোনার চেষ্টা করল, ওই সর্বনাশা ঘুড়িটা যে তাকে এখানে নিয়ে আসবে তা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি৷ শেষ পর্যন্ত লামিয়ার পেটে যদি যেতেই হয় তাহলে ওই ঘুড়িটা অন্তত ছিঁড়ে দিয়ে এলে হত৷ মিনু এইসব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল, এমন সময় হাতের উপর চাপ পড়তেই সে চমকে উঠল৷ একটা হিসহিসে শব্দ শোনা যাচ্ছে, সাপের শিসের মতো৷ বাড়ছে কমছে৷ শব্দটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে৷ মিনু বুঝতে পারল না সে নিঃশ্বাস নেবে কি না৷ যতক্ষণ না লামিয়া দূরে চলে যাচ্ছে ততক্ষণ যদি শ্বাস আটকে রাখতে পারে তাহলে অসুবিধা নেই, কিন্তু তা যদি না হয় তাহলে জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়বে৷ তখন? অন্তি শক্ত করে ধরে আছে তার কনুইটা৷ মনে হল এই বুঝি সমস্ত পাহাড়টা ভেঙে পড়বে তাদের মাথায়৷ ফোকরের কাছে এসে হিসহিস শব্দটা থেমে গেল৷ সেটা আর উপরের দিকে উঠছে না৷ তবে কি কিছু বুঝতে পেরেছে? গর্তটার ঠিক বাইরে থেকে একটা খিলখলে হাসির শব্দ ভেসে এল, ফোকরের ভিতরের ফাঁকা দেওয়ালে ধাক্কা লেগে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল হাসিটা৷ মিনু অন্তির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল তার চোখ দুটো ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে আছে, মাথা নামিয়ে সে বলল,‘কোনওদিন তো এভাবে হাসে না৷’ মিনু আর কিছু বলতে পারল না, এই প্রথম তার বাড়ির সবার জন্য মন কেমন করতে লাগল৷ হিসহিস শব্দটা এখনও একই জায়গা থেকে আসছে৷ হাসিটা থেমে গেছে৷ কয়েক সেকেন্ড সব চুপচাপ তারপর ফোকরের ঠিক বাইরে যেন কিছু একটা সরতে লাগল, অনেকটা সাপের গায়ে যেরকম দাগ থাকে সেইরকম৷ তারপরেই দেখা গেল একটা মুখ, মানুষের মতোই তবে মানুষের নয়, টানা টানা ভয়ঙ্কর হলদে দুটো চোখে হিংসা জ্বলজ্জ্বল করছে৷ থুতনিতে একটা লাল পাথর বসানো, বাঁকানো ঠোঁটে ক্রুর হাসি, মাথায় সোনালি মুকুট৷ ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে জিভটা কয়েকবার বেরিয়ে এল, চেরা জিভ৷ অন্তি জড়িয়ে ধরেছে মিনুকে, আতঙ্কিত স্বরে কয়েকটা ভাঙা-ভাঙা শব্দ উচ্চারণ করছে সে, ‘তাকাস না ওদিকে, মরে গেলেও ওর দিকে তাকাস না৷’ মিনুর চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে এল, তবু সে মুখ ফেরাতে পারল না৷ একটু একটু করে মাথার মধ্যে সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে, এইবার হাত-পা অবশ হয়ে আসছে, আর একটু সময় বাকি৷ ঠিক এইসময় একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে গেল৷ ফোকরের সেই ভয়ঙ্কর মুখটা হঠাৎ তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে একটা বিকৃত শব্দ করে বাইরে ছিটকে পড়ল৷ এতক্ষণ ভয়ে মিনু খেয়ালও করেনি যে সেই হালকা বাঁশির শব্দটা এখন বেশ জোরে শোনা যাচ্ছে৷ ব্যাপার কী? সে হতবাক হয়ে গেছিল, ঠেলা দিয়ে অন্তিকে ডাকল, ‘ওই, ওঠ ওঠ, চলে গেছে রে৷’ অন্তি কোনও সাড়া দিল না, বোধহয় ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে৷ মিনু সাহস করে ফোকরের বাইরে পা বাড়াল, আর বাইরে এসে দাঁড়াতেই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখে তার বুকের ধুকপুকুনি কয়েক সেকেন্ডের জন্য বন্ধ হয়ে গেল৷ চাঁদের মাটির উপর শুয়ে ছটফট করছে লামিয়া৷ আর তার বুকের উপরেই তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর একটা মানুষ, না, ঠিক মানুষ নয়, তার সারা শরীর নীলচে রঙের ফিনফিনে কাপড়ে ঢাকা, তার উপর তারার মতো জ্বলজ্বল করছে কয়েকটা বিন্দু, যেন রাতের আকাশ থেকে কেটে খানিকটা কাপড় গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে সে৷ মুখটাও ঢাকা পড়েছে তাতে, এই কি তবে অন্তির দেখা সেই জন্তুটা? কিন্তু এর হাতে তো ঝলমল করছে আলোর তলোয়ার, আকস্মিকতায় মিনু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল সেই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ৷ মুহূর্তে সাপটা ছোবল মারছে তলোয়ারধারীকে, পর মুহূর্তেই সে লুটিয়ে পড়ছে মাটির উপরে৷ প্রচণ্ড চিৎকার আর আক্রমণের শব্দে মাটি কেঁপে উঠছে৷ মিনুর কাঁধে হাতের স্পর্শ লাগতে সে পিছন ফিরে তাকাল, অন্তি উঠে এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে৷ মিনু কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে, তার আগেই অন্তির মুখ দিয়ে একটা শব্দ বেরিয়ে এল, ‘সাইবিল৷’

‘সেটা কে?’ মিনু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল৷

‘যার হাতে তলোয়ার৷’

মিনু আর কিছু জিজ্ঞেস করল না, সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছে এই অনেক৷ এবার বাড়ি ফিরবে কীভাবে সেটাই চিন্তা৷ এতক্ষণে সাইবিলকে বেশ কাবু করে ফেলেছে লামিয়া, তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে আগুনের হলকা, সেই সাথে আকাশ ফাটানো চিৎকার৷ একটা হলকা এসে লাগল সাইবিলের হাতে, হাত থেকে দূরে ছিটকে পড়ল আলোর তলোয়ার৷ মিনু প্রমাদ গুনল, তবে কি হেরে যাবে সাইবিল? তাহলে তো আর লামিয়ার হাত থেকে নিস্তার নেই৷ সাপের শরীর নিয়ে লামিয়া ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে, ক্রমশ সে উঠে দাঁড়াল আহত সাইবিলের বুকের উপর, কয়েকবার ডান হাত দিয়ে ছিটকে পড়া তলোয়ারটা ধরার চেষ্টা করল সাইবিল, কিন্তু পারল না, কব্জির কাছ থেকে পুড়ে গেছে হাতটা৷ বুকের উপর দাঁড়িয়ে আকাশ কাঁপিয়ে হাসল লামিয়া৷ হিংস্র জিভটা বেরিয়ে এল কয়েকবার৷ দু-হাতের বিষাক্ত নখগুলো তুলে ধরল মাথার উপরে, এখুনি সেগুলো নেমে আসবে সাইবিলের বুকের উপর৷ পোড়া ডান হাত দিয়ে শেষবারের মতো তলোয়ার চেপে ধরার চেষ্টা করল অসহায় সাইবিল, আর ঠিক এই সময় এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে গেল৷ পাহাড়ের একদম উপর থেকে লামিয়ার ঘাড়ের উপর বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল একটা লোমশ জানোয়ার, কী বিরাট! মিনুদের গোটা বাড়িটাও এর থেকে ছোটো, জানোয়ারটার ধাক্কায় বেশ কিছুদূরে ছিটকে পড়েছিল লামিয়া৷ সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই উঠে দাঁড়াল সাইবিল, বাঁ হাতে তুলে নিল তলোয়ার৷ মুহূর্তের মধ্যে সেটা বসিয়ে দিল লামিয়ার বুকের ঠিক মাঝখানে৷ মিনু আর দাঁড়াল না৷ অন্তির হাত ধরে দৌড়াতে লাগল ভেসে থাকা মেঘগুলোর দিকে, আবার যদি জেগে ওঠে লামিয়া? আর এক মুহূর্তও এখানে দাঁড়ানো ঠিক হবে না, মেঘগুলো আর আগের মতো নেই, তাদের সমস্ত গা জুড়ে এখন কালো রং ধরেছে, কিন্তু তাও থামলে চলবে না, ওগুলো করেই ভেসে পড়তে হবে ঘুড়িটার কাছে৷ একটা মেঘের উপর উঠে বসল দু-জনে৷ কিন্তু মেঘটা এক বিন্দুও নড়ল না, দু-জনে দৌড়াতে লাগল৷ আর সাথে সাথে প্রচণ্ড গর্জন করে ভাঙতে লাগল কালো জমাট মেঘটা৷ ধীরে ধীরে সেটা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে, পুরোটা গলে যাওয়ার আগেই অন্য মেঘে উঠতে হবে, অন্তির পায়ের ঠিক পিছনেই খানিকটা মেঘ গরম হয়ে গলে পড়ল, সাথে বাজ পড়ার শব্দ৷ দু-জনে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল৷ কয়েকটা মেঘের ওপারেই দেখা যাচ্ছে লাল ঘুড়িটাকে৷ কিন্তু অতদূর দৌড়াতে পারল না ওরা৷ আকাশে এখন একটাও রুপোলি মেঘ নেই৷ একটা নরম, প্রায় জল হয়ে যাওয়া মেঘের উপর পা রাখতেই সেটা গলে পড়ল৷ শূন্য আকাশ বেয়ে নেমে আসতে লাগল দুটো শরীর৷ অন্তি মিনুকে চেপে ধরল, পায়ের নিচে আর কিচ্ছু নেই, না৷ আছে৷ অনেক নিচে আছে, চেনা পৃথিবী, ঘর-বাড়ি, মানুষ৷ বৃষ্টির জলের সাথে মিশে দু-জনে নামতে লাগল নিচে৷ আস্তে আস্তে চাঁদ আর মেঘের দেশ দূরে চলে যাচ্ছে, এগিয়ে আসছে পৃথিবীর মাটি৷ মিনুর ঘুম পেল…

* * *

কানে টান পড়তেই সম্বিৎ ফিরল মিনুর৷ সাথে সাথে মায়ের ঝাঁঝালো গলা কানে এল, ‘গেছো মেয়ে কোথাকার৷ ফের তুই ছাদের পাঁচিলে উঠেছিলি, দাঁড়া, বাবা’কে আসতে দে, তারপর তোর একদিন কি আমার একদিন৷’ দুপুরের রোদ ঝলমল করছে৷ মিনু থমথমে মুখে নিচে নেমে এল৷ তারপর গামছা কাঁধে নিয়ে স্নান করতে ঢুকে গেল৷ তবে কি এতক্ষণ সব কিছুই তার ভাবনা ছিল? ছাদের পাঁচিলে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখছিল? ধুর… মিনুর মনটা খারাপ হয় গেল, আগে জানলে মেঘের আইসক্রিমটা আরও খানিকটা খেয়ে নিলেই হত৷ স্নান করে মিনু খেতে বসল৷ চিংড়িমাছ সে একদম পছন্দ করে না৷ অথচ আজ মা সেটাই রান্না করেছে৷ কেন, লুচি করা যায় না? মা বাটি থেকে তরকারি তুলে থালায় দিচ্ছেন, একটা ব্যাপার চোখে পড়তেই মিনু অবাক হয়ে গেল, কী যেন ভেবে প্রশ্ন করল,

‘মা, তোমার হাত অতটা পুড়ল কী করে?’

‘তেজপাতা দিচ্ছিলাম, ছিটকে এসেছে, তুই খা এখন৷’

মিনু চুপচাপ খাওয়া শেষ করে নিচে চলে এল৷ একতলার ঘরে বসেই সে পড়াশোনা করে৷ আজ কিন্তু ঘরটা খুলতেই দেখতে পেল জানলায় বসে ঘুমোচ্ছে প্লুটো৷ মিনুকে দেখতে পেয়েই সে একলাফে ঘরের ভিতর ঢুকে এল৷ জবুথবু হয়ে বসে পড়ল কোলে৷ মিনু লক্ষ্য করল তার গলার নিচ থেকে একটা কাটা দাগ৷ যেন কিছু একটা আঁচড়ে দিয়েছে তাকে৷ অনেকক্ষণ থেকে একটা প্রশ্ন ঘুরছিল মনে, প্লুটোর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে সেটাই জিজ্ঞেস করল মিনু, ‘তুই কি পাহাড়ের মাথা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলি লামিয়ার ঘাড়ে?’ প্লুটো গর্ব ভরে মিনুর হাত চাটতে চাটতে বলল, ‘ম্যাও৷’

(আগেই বলেছি প্লুটোর ম্যাওয়ের অর্থ খালি মিনুই বুঝতে পারে, সেদিনও বুঝেছিল৷ তবে সেটা হ্যাঁ কি না তা আমাকে সে বলতে চায়নি৷ উলটে বাকি গল্পটার জন্য আমার কাছ থেকে একটা ইংরেজি লেখা ক্যালকুলেটার হাতিয়ে নিয়েছে, অতএব আমি নাচার৷ আপনারাই চেষ্টা করে দেখুন ওর পেট থেকে কিছু বের করতে পারেন কি না…)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *