মিত্তির বাড়ি
মুখবন্ধ
মিত্তিরদের খুব নাম। প্রাচীন, বনেদী পরিবার। পিতামহ তাঁর ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতার জন্য ইংরেজ আমলে রায়বাহাদুর খেতাব পেয়েছিলেন। পিতামহী ছিলেন বিদুষী, সুন্দরী। জীব, জন্তু, পশু-পক্ষী প্রেমী। নিজের একটি আত্মজীবনী লিখেছিলেন, ‘বঙ্গললনার সংসার পরিক্রমা’। বইটির একটি মাত্র কপি মিত্তির বাড়িতে সযত্নে রক্ষিত আছে। মরক্কো লেদার বাইন্ডিং। সোনার জলে নাম লেখা, প্রমীলা মিত্র। বইটি একটি কাচের আধারে থাকে। সেবাযত্ন পায়। সেকালের সংবাদপত্রে প্রমীলা মিত্রের নাম পাওয়া যায়। স্বামী বিবেকানন্দ ও নিবেদিতার আদর্শে তিনি স্ত্রীশিক্ষার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। একটি বিদ্যালয় ও একটি আতুরালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রসূতি পালন, ধাত্রীবিদ্যা ইত্যাদি পুস্তিকা রচনা করে সাধারণের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করেন।
পিতা প্রদ্যুম্ন মিত্র ছিলেন বিজ্ঞানী। তাঁর কাজের ক্ষেত্র ছিল বাষ্পের শক্তি, বয়লার টেকনোলজিস্ট। বহুকাল বিলেতে ছিলেন। স্বভাবে পাক্কা সাহেব। দৈব-দৈত্যে বিশ্বাসী না হলেও পিতৃপুরুষ ও মাতৃভক্ত ছিলেন। মিত্তির বাড়ির তিনতলার মন্দিরে তাঁরাই বসে আছেন পাশাপাশি ছবি হয়ে। নিত্যপুজা ও ভোগরাগাদির ব্যবস্থা আছে। যিনি যে আহার পছন্দ করতেন ভোগে তাই নিবেদন করা হতো। পিতামহের প্রিয় পুঁইশাক, পিতামহীর পোস্ত, পিতার স্যুপ, মাতার বড়ির ঝাল।
সম্পদ ও সম্পত্তি পুরুষানুক্রমে বেড়েছে, যা সাধারণত হয় না। অন্নচিন্তা চমৎকারা হয়ে দেখা দেয়নি। বর্তমান বংশধরেরা সকলেই প্রতিষ্ঠিত। বড় ভাই নামকরা ডাক্তার। মেজোভাই দর্শনের সুখ্যাত অধ্যাপক। ভোজনরসিক। সামান্য খামখেয়ালী। বড়ভাই পিতামহীর পশুপ্রেমের উত্তরাধিকারী। সেজভাই টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার। ন’ভাই আর্টিস্ট ও ডিজাইনার, ফ্যাশান মডেলার। বোন, কুসি শিক্ষিতা। রসায়নের গ্র্যাজুয়েট। সম্প্রতি বিউটিশিয়ান। সৌন্দর্য ও গাছগাছড়া তার বিষয়। নানারকম সৌন্দর্য প্রলেপের নানা পরীক্ষা নিয়ে সে ব্যস্ত।
মিত্তিররা পাঁচজনকে নিয়ে বেশ আছে। বাড়ি অবারিত দ্বার। মানুষ দুঃখ নিয়ে আসে, আনন্দ নিয়ে ফিরে যায়। এই শতাব্দীর শেষপাদেও যে গত শতাব্দীর আদর্শ নিয়ে মহাসুখে বাঁচা যায় এই মিত্তির পরিবারই তার প্রমাণ। প্রতিদিনই সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত একটা না একটা ব্যাপারে বাড়ি সরগরম। ভেতরের লোক আর বাইরের লোকে মিলে তৈরি হচ্ছে, মজা আর মজা। নানা চরিত্রের আগমন-নিগমনে বাড়িটি জীবন্ত এক থিয়েটার। অবিরত নাটক চলেছে।
সবাই একডাকে বলে দেবে মিত্তির বাড়ি কোথায়। এই হিংসার যুগেও মিত্তিরদের কোনও শত্রু নেই। সকলেই ভালোবাসে। পাড়ার অভিভাবক বলে ভাবে। বলে, মিত্তির বাড়ি তো বাড়ি নয়, বিশাল একটা ছাতা। এই ছাতার তলায় আশ্রয় নেয়া যায়, আড্ডা মারা যায়, বনভোজন করা যায়। বাড়ির সবাই টগবগে জীবন্ত। কেউ হতাশায় ভোগে না। সকলের মনে আশার সঞ্চার করে, যেন বলতে চায়, তোমরাও আছ আমরাও আছি তোমাদের পাশে,
হেসে নাও দু’দিনের বই তো নয়।
এক
মিত্তির বাড়ির ন’বউয়ের আজ জন্মদিন। একটা গ্রুপ ফটো তোলা হচ্ছে। মহা গুলতানি। বড় আর মেজো ভাইয়ের মহা সমস্যা। কি উপহার দেওয়া যায় যা ন’বউয়ের নেই। শেষে ঠিক হলো একটা নতুন বাথরুম দেওয়া হবে, মডার্ন স্টাইলের। আপাতত সিদ্ধান্তটাই উপহার। রাতের উৎসব জমে গেল বাচ্চাদের নাটিকা পরিবেশনে। সেই জমাট মুহূর্তে এসে হাজির হলেন পূর্বপরিচিত নিরাশ্রয় এক বৃদ্ধ। ব্যস্ত ফটোগ্রাফারের কেরামতিতে কেউ তিষ্ঠতে পারছে না। আপাতত ছবি, তারপর ধীরে ধীরে একে একে।
ফটোগ্রাফার : একটু সরে, বড়দা একটু ডানদিকে। উঁহু, বাঁদিকে যাচ্ছেন কেন?
বড়দা : কার ডানদিক? আমার, নাম তোমার? শোনো নির্দেশ যখন দেবে পরিষ্কার নির্দেশ। তোমার মাথায় এক বলছ আর এক। তোমার বলা উচিত ছিল, আপনার ডানদিক।
মেজদা : শুরু হয়ে গেল। ওরে! মুখের কাছে একটা মাইক্রোফোন ধরে দে। আরও আধঘণ্টা উচিত, অনুচিতের লেকচার হোক।
বোন কুসি : আধঘণ্টা হয়ে গেল, ঝড়ের এঁটো পাতার মতো, একবার ডান থেকে বাঁ, বাঁ থেকে ডান।
বড়দা : আমার মনে হচ্ছে পাশাপাশি স্ট্রেট লাইনে দাঁড়ালে ভালো হতো।
মেজদা : তোমার মুণ্ডু হতো। এত বড় একটা গ্রুপ। অর্ধচন্দ্রাকারে, ঘোড়ার ক্ষুরের নালের আকারে, কাস্তের আকারে…
বড়দা : তোর মতো একটা ইডিয়েটের আকারে…
মেজদা : তোমার মতো একটা পণ্ডিত মূর্খের নির্দেশে…
[Flash)
কুসি : যাঃ, মেরে দিলে!
ফটোগ্রাফার (কুন্তল) : ঠিক এই জিনিসটাই চাইছিলুম। মিত্তির বাড়ির সব ব্যাপারটাই চনমনে। মাল্টিভিটামিন কমপ্লেক্স।
[group photo বড় থেকে ন’ সব ভাই।
সেজ বউ, ন বউ তাদের একটি ছেলে একটি মেয়ে। বোন কুসি।]
[গ্রুপ ভেঙে ছড়িয়ে গেল।]
মেজো : বড়দা তুমি এখনো মিচকি হাসি হাসছ কেন?
বড় : অফ করতে ভুলে গেছি। ছবি তোলার সময় অন করেছিলুম। দেখবি, আলো আর হাসি, যে অন করে খুব হিসেবী না হলে অফ করতে ভুলে যায়। কুন্তল, হঠাৎ তুমি ছবি তুললে কেন?
কুন্তল : লাস্ট ফিলম। একসপোজ করে দিলুম। এইবার রিলটা খুলে ওয়াশ করব।
মেজো : একেই বলে, উড়ো খই গোবিন্দায় নমঃ।
বড় : এই কথাটা অপমানসূচক।
মেজো : কুন্তল আমার ছাত্র ছিল। ওকে একসময় আমি বাঁদর, উল্লুক, গাধা থ্রি ইন ওয়ান বলেছি। আমার সে অধিকার আছে।
বড় : কুন্তল আমার পেশেন্ট। আত্মিক আঘাত থেকে তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার। নার্ভাস টেনশানে ভুগছে। ঘুমের ওষুধ ছাড়া ঘুম আসে না।
মেজো : কেন আসে না?
কুন্তল : ভয়ে।
মেজো : ভয়ের ওষুধ ঘুমের বড়ি নয়, একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত—
আমি ভয় করব না ভয় করব না
দু’বেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না।
বড় : রবীন্দ্রসঙ্গীতের অডেশানে তোর পাশ সার্টিফিকেট আছে?
মেজো : নো।
বড় : তাহলে আর কেরামতি নাই বা করলে। ওটা বড় পবিত্র মন্দির।
কুন্তল : স্যার! ও ভয় আর এ ভয়ে অনেক তফাৎ। অন্যের ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে আমি ঘুমোতে পারি না।
মেজো : সে আবার কী!
কুন্তল : আজ্ঞে, আগে আমি ঘুমোতুম। আমার স্ত্রী সারারাত জেগে থাকত। চোখ গর্তে ঢুকে গেল। রোগা হয়ে গেল। হজমের গোলমাল। সবাই বললে, ফিমেল ডিজিজ। অনেক চিকিৎসা করালুম। শেষে জানা গেল, ওটা মেল ডিজিজ।
মেজো : ফিমেলে মেল ডিজিজ কী ব্যাপার! ফি মেলে বলেই না ফিমেল ডিজিজ।
কুন্তল : স্যার! লজ্জার কথা বলব কী!
মেজো : আরে, লজ্জার কী আছে, ডিজিজ বলছ কেন? ফিমেলে ফিমেল আসতে পারে মেলও আসতে পারে। মানুষের হাতে কিছু নেই। আর ছেলেপুলেদের ডিজিজ বলাটা ঠিক নয় কুন্তল। সব মানুষেই মহামানবের সম্ভাবনা।
ওই মহামানব আসে
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
কুন্তল : স্যার মহামানব নয় মহা নাক। শোয়া মাত্রই আমার নাকের পাঞ্চজন্য শঙ্খ বেজে ওঠে। হরেক জানোয়ারের মিলিত ডাক। শোবার ঘরে আফ্রিকার অরণ্য। প্রতিবেশীদের কমপ্লেন। আপনার বউমা ভয়ে জানলা খোলে না।
মেজো : গাধা কোথাকার। ঘুমের ওষুধ বউকে খাওয়া, নিজে সুখে নিদ্রা যা।
কুন্তল : সেইটাই তো করছি। প্রেসক্রিপশান আমার নামে, ওষুধ খাচ্ছে মিসেস।
বড়দা : বাঃ, এই না হলে রুগি। এদের জন্যেই ডাক্তাররা পেটাই খায়।
মেজো : এক কাজ করো না দাদা, নাকটা খুলে ক্লিন করে আবার সেট করে দাও।
বড় : নাক নাকের জন্যে ডাকে না, প্রবলেমটা গলায়।
মেজো : তাহলে গলাটা কেটে দাও।
বড় : তারপর জেলে যাও, তারপর ফাঁসিতে লটকাও। আধহাত জিভ বের করে লাট খাও। আহারে! আমার ভ্রাতা লক্ষ্মণ রে!
মেজো : এরা সব দাঁড়িয়ে কেন?
বড় : আমাদের শ্রুতিনাটক শোনার জন্যে!
মেজো : কর্তব্যে কর্মে অবহেলা। আমাদের তো এখন টি-টাইম (হাঁক) গান্ধারী!
গান্ধারী। ইয়েস মেজদা।
মেজো : কি করছিস!
গান্ধারী : চাটুতে ঝাঁটা দিয়ে তেল মাখাচ্ছি।
মেজো : এই ধরনের বদমাইশি তোকে কে করতে বলেছে।
গান্ধারী : ন’ বউদি।
মেজো : বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দাও।
কুসি : কারণ?
মেজো : চাটুতে আর ঝ্যাঁটাতে কেউ এক করে?
কুসি : করে। ধোসা তৈরির সময়।
বড় : কেয়া বাত! মশালা ধোসা। আমি উদ্বোধন করব।
মেজো : আমরা দু’জনে করব। দুয়ে মিলে করি কাজ/ভুগে মরি নাহি লাজ।
কুসি : আজ রেখার জন্মদিন। খেয়াল আছে?
মেজো : বড়দা, তোমার আছে?
বড় : তোর আছে?
[ কুসি চলে গেল, বড় আর মেজো মুখোমুখি। ]
মেজো : আমাদের মাথার অবস্থা দেখেছ? সব ভুলে যাই।
বড় : আমি মনে রাখতে রাখতেও লাস্ট মোমেন্ট ভুলে গেলুম।
মেজো : একটা কিছু দিতে হয়!
বড় : অবশ্যই।
মেজো : এক সঙ্গে, না আলাদা আলাদা।
বড় : আলাদা আলাদা। এ তোমার বন্ধুবান্ধবের জন্মদিন নয়, যে চাঁদা তুলে একটা গামলা কিনে দিয়ে আসবে।
মেজো : কি দেওয়া যায়? শাড়ি?
বড় : হাজার খানেক আছে।
মেজো : ভালো বই?
বড় : কেউ পড়ে না। আজকাল চিঠির নীচে অলিখিত থাকে—বই না দিলে বাধিত হব। [বড় পায়চারি করতে করতে] এমন একটা কিছু, এমন একটা কিছু।
মেজো। [উঠে দাঁড়িয়ে] এমন একটা কিছু, এমন একটা কিছু।
দুজনে : [সমস্বরে] যা কাজে লাগে।
দুজনে : [সমস্বরে] গান্ধারী!
গান্ধারী : যাতা হুঁ ম্যায়।
মেজো : তোর ন বউদির কি নেই! চিৎকার করবি না, ফিসফিশ করে বল।
গান্ধারী। [ফিসফিস] ছেলে নেই! ছেলের খুব শখ।
বড় : ছেলে? এত রাতে ছেলে কোথায় পাব?
মেজো : আরে, কী যে বল? এ ছেলে সে ছেলে নয়। ভেতরের ছেলে।
বড় : [বুঝতে পেরে] ও হোঃ সেই ছেলে। সন্তান! সন্তান। এইটুকু থেকে তোর মতো এত বড় একটা দামড়া। সে তো মানুষের হাতে নেই।
গান্ধারী : আছে। আছে। মাদুলি। সেই মাদুলি দেশ থেকে আসার সময় তিনটে এনেছি। সেই গুণীন শ্মশানে থাকে। ভূত চতুর্দশীর রাতে তিন পহরে শেয়ালের ডাক শুনে কাজ আরম্ভ করে।
মেজো : কী কাজ?
গান্ধারী : সে আমরা কি জানি। এক একটা মাদুলির খরচ পড়ে যায় পাঁচশো। এর পর বাইরের সাজ। তামার মাদুলি, রুপোর মাদুলি, সোনার মাদুলি। যে যাতে ভরবে। মেয়ের মাদুলির খরচ কম, মাত্র একশো টাকা। প্রত্যেকটা মাদুলির সঙ্গে আধ হাত লাল সুতো ফিরি।
মেজো : কী বড়দা, দেবে নাকী! তুমি একটা, আমি একটা।
বড় : তাহলে তো যমজ হয়ে যাবে! সে কী সামলাতে পারবে? বরং আমি ভেতরটা দি, তুই বাইরেটা দে। একটা সোনার মাদুলি আর কত নেবে! হাজার বারোশো!
মেজো : না, আমি ভেতরে তুমি বাইরে।
বড় : না, তুই বাইরে আমি ভেতরে।
মেজো : আমি ভেতর, তুমি বাইরে।
বড় : বাইরে।
মেজো : ভেতরে।
বাইরে। ভেতরে। ভেতরে। বাইরে।
গান্ধারী : উরেব্বাসরে। এ কী করতে লেগেছে। যাই, কুসি দিদিমণিকে ডেকে আনি।
মেজো : আমি ভেতরে থাকায় অবিচল।
বড় : আমি বাইরে যাব না, যাব না, যাব না।
কুসি : তোমরা দুটোতেই বাইরে যাও। বেরোও। গেট আউট। দুটো দামড়া হুলো। মুখোমুখি হলো তো ফ্যাঁসফোঁস। যাও, যাও। রাত দশটার আগে দুজনের মুখ যেন না দেখি।
বড় : কুসি, তুই এসেছিস! এ বাইরে সে বাইরে নয় রে। এ হলো মাদুলির বাইরে।
কুসি : কিসের মাদুলি?
বড় : সোনার মাদুলি।
মেজো : আমি ভেতরে পাঁচশো। ও বাইরে বারোশো।
বড় : না, আমি ভেতরে পাঁচশো, ও বাইরে বারোশো।
মেজো : কান্ট বি।
বড় : উইল বি।
কুসি : কিসের মাদুলি? কই দেখি মাদুলিটা।
মেজো : সে তো স্যাকরার দোকানে। আমাকে কিনতে বলছে।
কুসি : কিনতে বলছে কেন?
মেজো : ওর মধ্যে মন্ত্রপূতঃ গান্ধারী ঢুকবে।
কুসি : সে আবার কে?
বড় : ব্যাপারটা আমি ক্লিয়ার করছি। ও উত্তেজিত। মাদুলির মধ্যে থাকবে গান্ধারীর শ্মশান।
কুসি : গান্ধারীর শ্মশান! শ্মশান থাকবে মাদুলিতে! গান্ধারীটা কে?
মেজো : আমাদের গান্ধারী। মহাভারতের গান্ধারী নয়।
কুসি : [গলা চড়িয়ে] গান্ধারী।
গান্ধারী : হাঁ দিদি।
কুসি : কি ব্যাপার!
গান্ধারী : যত দূর বুঝেছি, এরা ন’ বউদিকে মাদুলি পরাবে।
কুসি : কেন? এত লোককে টুপি পরিয়ে শান্তি হচ্ছে না! মাদুলি পরাবে কেন?
[গান্ধারী কানে কানে]
কুসি : [ভাইদের দিকে তাকিয়ে] আরে ছিঃ ছিঃ। তোমাদের লজ্জা শরম সব গেছে। সময়ে বিয়ে না করলে মানুষের এই অবস্থাই হয়। ছোঁকছোঁকে স্বভাব হ। অসভ্য, ইতর।
দু’ভাই। [এক সঙ্গে] লে হালুয়া। আমরা কি জানি! গান্ধারীই তো বললে।
গান্ধারী : বাঃ, আমি বললুম, না আপনারাই আমাকে বললেন, বল তো গান্ধারী ন’বউয়ের কি নেই? আমি বললুম, ছেলে নেই। যা নেই, তা নেই, সত্যিই তো নেই। আমি কি মিথ্যে বলব! সে মেয়ে আমি নই। আমার গুরু পঞ্চানন।
ন’বউ : [চায়ের ট্রে হাতে] দিদি পুরটা হয়ে গেছে।
কুসি : কাপ ধরে দিয়ে তুই এখুনি এখান থেকে কেটে পড়! এ দুটো অ্যান্টি-সোশ্যাল হয়ে গেছে।
[ন’বউ ভয়ে ভয়ে চলে গেল]
বড় : দেখলি তো মেজো, কি যুগ পড়েছে। ভালো করতে চাইলে মন্দ হয়। কলির শেষ। এই ব্যাটা গান্ধারীই বললে, আমার কাছে শ্মশানের বীজ আছে, সোনার মাদুলিতে ভরে ডান হাত বেঁধে দেন। বীজের দাম পাঁচশো, মাদুলি বারোশো। বছর না ঘুরতেই দোল দোল দুলনি/রাঙা মাথায় চিরুনি।
গান্ধারী : ও বাবা, কি মিথ্যে কথা বলে গা!
বড় : মেজো! তুই সাক্ষী!
মেজো : গোছগাছ করে এতটা বলেনি।
বড় : এখন দলত্যাগ করিসনি পাঁঠা। ফ্রন্টের ঐক্য বজায় রাখ।
মেজো : যুক্তফ্রন্ট জিন্দাবাদ।
কুসি : [গান্ধারীকে] যা, তুই সাম্বারটা বসা। এ দুটো পাগল। তোমাদের আমি বিয়ে দোবো। তবে যদি ঢিট হও।
বড় : আমার একজন প্রেমিকা ছিল রে কুসি।
মেজো : জানি। মণি পাগলি। তোমাকে দেখলেই গান ধরতো, ও দয়াল বিচার কর। আমায় গুণ করেছে, আমার খুন করেছে।
বড় : না রে না, আমার প্রেমিকার নাম কবিতা। দুজনেই প্রতিজ্ঞা করেছিলুম, বিয়ে করে প্রেমের মতো একটা সুন্দর জিনিসকে নষ্ট করবো না। প্রেমকে মুরগী করে, জবাই করে, পালক ছাড়িয়ে চিলি চিকেন বানাবো না। বিরহী যক্ষ, বিবাগী কোকিল আমাদের আদর্শ। আমাদের আদর্শ রবি কবি। আমাদের প্রাণের মানুষ প্রাণে থাকে।
মেজো : আমার আদর্শ তুলসীদাস। বেহা বেহা সবকোই কহে, মেরা মনমে এহি ভায়/চড় খাটোলি ধো ধো লগড়া জেহেল পর লে যয়ে। ওই দেখ বর যাচ্ছে চৌদোলায় চড়ে। বাদ্য-বাজনা। ভোঁপ্পোড়ো পোঁ। যাচ্ছে কোথায়, না জেলখানায়।
বড় : তোর মধ্যে কোনও প্রেম নেই।
মেজো : আমার ফ্রেমে প্রেম নেই। আছে কর্ম। কর্মযোগী আমি। স্বামীজি আমার আদর্শ। জীবে প্রেম করে যেই জন…
বড় : কারেকসান, জীব নয় জিভ, জিভে প্রেম…
মেজো : ফ্রন্টের ঐক্য বজায় রাখ। বলো বলো বলো সবে, আমাদের যৌথ প্রচেষ্টায় ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।
বড় : কুসি তুই বিয়ে করলি না কেন?
কুসি : তোমাদের ছেড়ে থাকা যায় না বলে। এই দুটো কচি পাঁঠাকে কোথায় রেখে যাব। কার কাছে রেখে যাব, গা মাখা ঝোল করে খেয়ে ফেলবে।
বড় : এই দেখ মেজো, একই রকমের ত্যাগ! মনে আছে অনেক কাল আগে, বাবা যখন হঠাৎ মারা গেলেন, শ্মশানে চিতার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ভাই দুটো নাবালক, বোনটার বিয়ে দিতে হবে, আমরা বিয়ে করবো না। কি জানি বাবা, কেমন বউ আসবে, কৈকেয়ী আর মন্থরা আমাদের সুখের সংসার ফ্র্যাকচার করে দেবে।
মেজো : কুসির শাসনে আমরা কেমন সুখে আছি বলো?
বড় : মাঝে মাঝে মনে হয় স্বর্গে আছি। উঃ পাগল করা গন্ধ আসছে রান্নাঘর থেকে। একটু টেস্ট করা না। টক, ঝাল, নুন।
মেজ : কুসি। ন’বউকে জন্মদিনে কি দেওয়া যায় বল তো। মাদুলি তো ক্যানসেল।
কুসি : একটা বাথরুম দাও।
বড় : এই রাতে বাথরুম কোথা থেকে কিনব! বাথরুম কি জিনিস!
কুসি : আরে বাথরুম জানো না! যেখানে মানুষ চান করে।
বড় : সে তো আমাদের আছে।
কুসি : ওর নিউ স্টাইলের একটা বাথরুমের খুব শখ। সিরামিক টাইলস, টেলিফোন শাওয়ার, বাথটব, টাওয়ার ট্যাপ!
মেজো : ওই ইংরিজি সিনেমার মতো।
বড় : বাথটব? আমি শুয়ে থাকবো সাবানের ফেনায়। সেলুলার ফোনে কথা বলব ভগবানের সঙ্গে।
[এক যুবকের হন্তদন্ত প্রবেশ]
যুবক : ডাক্তারবাবু, আবার হেঁচকি উঠছে। ননস্টপ। হিক, হিক। কোনও কাজ হলো না ওষুধে।
বড় : কার হেঁচকি? কিসের হেঁচকি?
যুবক : আমার স্ত্রীর।
বড় : কি খাইয়েছিলে?
যুবক : এক খিলি জর্দা পান।
বড় : জর্দার অভ্যাস ছিল?
যুবক : না। জীবনের এই ফার্স্ট জর্দা।
বড় : দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়। ঠিক হয়ে যাবে।
যুবক : মরে যাবে না তো! জাস্ট পনেরো দিন বিয়ে হয়েছে।
বড় : মানুষ হেঁচকি তুলেই মরে। সেই হেঁচকি তোলার বয়েস এখনো হয়নি। এটা ছেঁচকি।
যুবক : বিশ্বাস করুন ডাক্তারবাবু, আমি জোর করে জর্দা খাওয়াইনি। নিজের ইচ্ছেয় চেয়ে চেয়ে খেয়েছে। এ যা দিনকাল যদি মরে যায় সঙ্গে সঙ্গে আমার গণধোলাই, আমার মায়ের, আমার বোনের হাজতবাস। সতীর চিতায় পতির সহমরণ।
বড় : সেরকম কোনও সম্ভাবনা আছে?
যুবক : নেই কেমন করে বলি। হলেই হলো। একালে সবই সম্ভব। আমার আর একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম ছিল।
বড় : দয়া করে তাকে বিয়ে করলেই হতো।
যুবক : একটু সমস্যা ছিল। সেই মেয়েটা আর একটা ছেলেকে ভালোবাসত, সেই ছেলেটা আবার আর একটা মেয়েকে ভালোবাসত, সেই মেয়েটা আবার আর একটা…
বড় : হয়েছে হয়েছে, সবশেষে একটা ফাঁকা মাঠ, মাঠে একটা গরু। ইলু, ইলু, ইলু, ইলু।
যুবক : আপনার কাছে এসেছিলুম, প্রয়োজন হলে বলবেন তো!
বড় : কাকে বলব?
যুবক : পুলিশকে, আদালতকে। ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দেবেন, হেভি ডোজে জর্দা খেয়ে মৃত্যু।
বড় : [মেজকে] কী সব আবোলতাবোল বকছে বলতো।
মেজো : দাঁড়াও কুসিকে কল করি। [গলা চড়িয়ে] কুসি কুসি।
কুসি : আজ বাড়িতে একটা উৎসব। বারে বারে ডাকলে হয়।
বড় : কি করব বল। এ কোথা থেকে এসে কি সব বকছে?
কুসি : কোথা থেকে আসবে কেন, নিমন্ত্রণ করা হয়েছে তাই এসেছে। পল্লবকে চিনতে পারলে না! যাত্রার পালা লিখে বিখ্যাত।
বড়, মেজ : [সমস্বরে] আমাদের দেশের গৌরব পল্লব গাঙ্গুলি! মাই গড।
বড় : যাত্রা আমার ভালোই লাগে। ছেলেবেলায় খুব দেখেছি। এখন আর সময় পাই না।
মেজো : যাত্রার চেয়ে যাত্রার নাম আমার ভীষণ ভালো লাগে, সতীর কোলে পতির মাথা।
পল্লব : ওটা আমার হিট পালা।
মেজো : জুতোর তলায় কাঁটা পেরেক।
পল্লব : এটা আমার নয়। আমার আর একটা হিট পালা হলো পানাপুকুরে কচিসুন্দরী। আমি এখন যে পালাটা লিখছি, সেটার নাম জর্দাপান কেন খেলে কুলবধূ। ক্রাইম পালা। সেখানে এইরকম একটা প্লট আছে। একের পর এক বধূর করুণ মৃত্যু। শেষে সাহসী এক বধূ আসামীকে ধরবে। তাকে ল্যাম্প পোস্টে ঝোলাবে। তারপর সে ইলেকশানে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী হবে। আইন করবে, ক্যারেকটার সার্টিফিকেট না দেখালে কোনও মেয়ে কোনও ছেলেকে বিয়ে করবে না। আমার পরের পালা ঘরে ঘরে সিঁদুরের আগুন।
[এক বৃদ্ধের প্রবেশ]
বৃদ্ধ : চিনতে পারছ মিত্তির?
বড় : আমাকে বলছেন?
বৃদ্ধ : তোমাদের দুজনকেই।
মেজো : চেনা চেনা মনে হচ্ছে।
বৃদ্ধ : কালীপুজোর রাতে আমার খড়ের গোলা তোমাদের বাজির আগুনে পুড়ে গিয়েছিল।
বড় : হ্যাঁ হ্যাঁ, সে তো অনেক বছর আগে? আমরা তখন ছাত্র।
বৃদ্ধ : সেই আগুন আজও আমার বুকে ধিকি ধিকি জ্বলছে।
বড় : এখনো জ্বলছে! নেভাতে পারছেন না!
বৃদ্ধ : তোমাদের জন্যে আমি ধনে প্রাণে মারা গেছি। ত্রিভুবনে আমার আর কেউ নেই। একজনের আশ্রয়ে ছিলুম, সে এইমাত্র আমাকে তাড়িয়ে দিলে।
মেজো : তাড়ালে কেন?
বৃদ্ধ : আগুনে আমার খুব ভয়। সেই থেকে। লোকটা সংসারে আগুন ধরাচ্ছে। প্রতিবাদ করেছিলুম, বললে, নিকাল যাও। বেরিয়ে এলুম। এইবার কোথায় যাই! জানো মিত্তির, মানুষের কোনও যাবার জায়গা নেই। যার ঘর আছে তার আছে। যার নেই? হ্যাঁগো, তোমরা কী আমাকে তাড়িয়ে দেবে! তা দেবে নাই বা কেন! এই বাজারে কে কাকে দেখে!
[কথা শেষ হতে না হতেই সবাই ঘরে ঢুকল। ভায়ের বউরা, কাজের লোকেরা,
বাচ্চা দুটো। কুসির হাতে ‘বার্থ ডে কেক’]
বৃদ্ধ : আজ কিছু আছে বুঝি! তাহলে আমি যাই। রাতটা শ্মশানেই কাটাই।
[বৃদ্ধ উঠছেন]
বড় : দাঁড়ান। যাচ্ছেন কোথায়? আমরা কি যেতে বলেছি। কুসি, চিনতে পারছিস এঁকে। না পারারই কথা, তুই তখন অনেক ছোট। ইনি আমাদের সরকার মশাই। এক সময় খুব ভালো টপ্পা গাইতেন।
কুসি : হাত জোড়া, নমস্কার করতে পারছি না।
বড় : আজ থেকে আমাদের বাড়িতে থাকলে কোনও আপত্তি আছে তোমাদের?
বাচ্চা দুটো : [আনন্দে] আমাদের দাদু, আমাদের দাদু।
[জিন্স-শার্ট পরা এক যুবক। আধুনিক বাউল। ন’ভাইয়ের বন্ধু। গান গাইতে গাইতে ঢুকছে]
চেতন বাউল : আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে/তাই হেরি তায় সকল খানে। ঠিক সময়ে এসে পড়েছি।
গান্ধারী : আজ কিন্তু সব নিরামিষ।
চেতন : আমি কেবল খেতে আসি? আমি গান শোনাতে আসি।
গান্ধারী : তুমি বাপু বড্ড খাও।
চেতন : খিদে পায় তাই খাই। দোষটা তো কুসিদির। অত ভালো রাঁধে কেন?
[ইতিমধ্যে কেক সাজানো হয়েছে। আলো জ্বলছে। বাতি জ্বলেছে।]
কুসি : সবাই রেডি!
মেজো : [গালে হাত বুলিয়ে] যাঃ আজ দাড়ি কামানো হয়নি।
বড় : আজ রেখার জন্মদিন, তোর নয়। আজ রবিবার, মানুষ যেমন কাজে বেরোয় না, দাড়িও সেই কম বেরোয় না।
মেজো : ঠিক বলেছ। গালটা সত্যিই তেমন খড় খড় করছে না!
কুসি : আমাদের দীপু আর পূজা ছোট্ট একটা নাটক পরিবেশন করবে। তোমরা সবাই বোসো। মেজদা কেক কাটার জন্যে ছুরিটা এনেছি। হাত কাটার জন্যে নয়।
মেজো : সরি।
কুসি : স্টার্ট।
পুজা : হ্যাঁরে হ্যাঁরে তুই নাকি কাল সাদাকে বলছিলি লাল?
আর সেদিন নাকি রাত্রি জুড়ে নাক ডেকেছিস বিশ্রী সুরে?
আর তোদের পোষা বেড়ালগুলো শুনছি নাকি বেজায় হুলো?
আর এই যে শুনি তোদের বাড়ি কেউ নাকি রাখে না দাড়ি?
দীপু : ক্যান রে ব্যাটা ইসটুপিড? ঠেঙিয়ে তোরে করব ঢিট।
পুজা : চোপরাও তুম স্পিকটি নট, মারব রাগে পটাপট—
ফের যদি ট্যারাবি চোখ কিংবা আবার করবি রোখ
কিম্বা যদি অন করে মিথ্যেমিথ্যে চ্যাঁচাস জোরে
আই ডোন্ট কেয়ার কানাকড়ি জানিস আমি স্যান্ডো করি?
ফের লাফাচ্ছিস? অলরাইট কামেন ফাইট! কামেন ফাইট!
দীপু : ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখনি টেরটা পাবে আজ এখনি
আজকে যদি থাকতো মামা পিটিয়ে তোমার করতো ঝামা।
আরে! আরে! মারবি নাকি? দাঁড়া একটা পুলিশ ডাকি!
হাঁ হাঁ হাঁ হাঁ! রাগ করো না করতে চাও কি তাই বল না?
পূজা : হ্যাঁ হ্যাঁ তাতো সত্যি বটেই আমি তো চাটনি মোটেই।
মিথ্যে কেন লড়তে যাবি? ভেরি ভেরি সরি, মসলা খাবি?
দীপু : শেক হ্যান্ড আর দাদা বল সব শোধ বোধ ঘরে চল।
ডোন্ট পরোয়া অলরাইট হাউ ডুয়ুডু
—গুড নাইট—
বড় : বাঃ বাঃ, আর ধৈর্য্য রাখা যাচ্ছে না। এইবারে কেকে মারো ছুরি।
সমস্বরে : হ্যাপি বার্থডে টু ইউ।
দুই
সকালবেলা। বড়ভাই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গলার টাই বাঁধছে। কিছুতেই মাপে মিলছে না। কখনও সরু দিকটা লম্বা হয়ে ঝুলে যাচ্ছে, কখনও চওড়া দিকটা।
বড় : ধ্যাৎ তেরিকা, এত বয়স হলো এখনও টাই বাঁধাটাই শিখতে পারলুম না। আমার বাবাকে দেখ, ওই তো ছবি। কতভাবে কত কায়দায় টাই বাঁধতে পারতেন। দিস সিম্পিল মেকানিজম ফ্রাস্কেটস অল মাই এফার্টস।
[আয়নার সামনে থেকে বাবার ছবির সামনে গিয়ে] ‘ও ফাদার টিচ মি, হাউ টু নট এ টাই। ধ্যাৎ তেরিকা।’
[একটান, এইবার টাই ফাঁস হয়ে মেন আটকাল আর খুলতে পারছে না তখন চিৎকার!] —কুসি-কুসি।
কুসি : সাতসকালে কী হলো আবার!
বড় : সেই ওল্ড প্রবলেম, লাগ লাগ লাগ… লাগিয়ে বসে আছি।
কুসি : শোন দাদা, টাই তোমার জিনিস নয়। স্কার্ফ, মাফলার, নিদেন একটা গামছা। এই নিয়ে থাকার চেষ্টা কর না? তোমাকে কতবার দেখিয়েছি টাই-এর নট হবে আলগা ফাঁস। একটা পাশ ধরে টানবে খুস করে খুলে যাবে।
বড় : আরে সাতটা থেকে তো সেই চেষ্টা করছি এখন ঘড়িটা দেখ। ওদিকে আবার সেমিনার আরম্ভ হয়ে গেল। প্লিজ দে ভাই, শেষবারের মতো বেঁধে।
কুসি : [নিমেষে টাইটা বেঁধে, ঠিকঠাক করে, দাদার বুকে একটা চাপড় মেরে] নাউ ইউ আর রেডি। ইউ ক্যান গো।
বড় : [কুসির মাথাটাকে আচমকা বুকের কাছে টেনে নিয়ে] মেরি পেয়ারি বাচ্ছে।
কুসি : [ভয়ে চিৎকার করে উঠল] লেগে যাবে, লেগে যাবে। মাথায় জবা আর কেশুত পাতা একসঙ্গে মেখেছি। যা জামাটার সর্বনাশ হয়ে গেল বোধহয়।
বড় : [বুকের দিকে তাকিয়ে] বাঁচ গিয়া, বাঁচ গিয়া।
কুসি : আর একটু হলেই যেত। শেষ রাতে লাগিয়েছি তো শুকিয়ে গেছে।
বড় : তোর নাম বদলে রাখবো ঘৃতকুমারী। আচ্ছা গুডবাই।
[দরজার মুখে ন’ভাই, মুখটা অসম্ভব গম্ভীর]
বড় : কিরে বদহজম!
ন : [নাটকীয় ভঙ্গিতে] ফাইনালি ডিসাইড করলুম আমার দাম্পত্য জীবন চুরমার হয়ে গেল। আমি আজই চলে যাব যেদিকে দু’চোখ যায়। তোমরা তোমাদের আদরের বউমাকে নিয়ে থাকো। তোমাদের আদরে সে আর মানুষ নই। শি হ্যাজ বিকাম এ মাঙ্কি।
বড় : বাংলা করলে কী দাঁড়ায়। আমাদের আদরে তোমার বউ বাঁদর হয়েছে।
কুসি : এ স্লাইট কারেকশন সিনিয়র মিত্তির। বিপদকালে লিঙ্গ ভুল করো না। বাঁদর নয় বাঁদরী।
বড় : এই রে মহা সমস্যায় ফেললি, মাঙ্কির স্ত্রীলিঙ্গ কী হবে রে? কারেকশনটা তো ওরই ইংরেজিতে করতে হবে। বিয়ের পর ব্যাটা লিঙ্গ তো ভুলেইছে—গ্রামারও ভুলে গেছে। আজ বাবা থাকলে এই মুর্খটার খাওয়া বন্ধ করে দিতেন। ছাত্রজীবনে সারাটা দুপুর আমাদের মুখস্থ করতে হতো ডাচ-ডাচেস, গুজ-গিজ, হর্স-মেয়ার। এই নেসফিল্ড বের করে আগে তোর ইংরেজি ঠিক কর। মাঙ্কির স্ত্রীলিঙ্গ খুঁজে বের কর। তারপর গৃহে থাকবি কী গৃহত্যাগ করবি দেখা যাবে।
[ভাইয়ের গালে টোকা মারতে মারতে] মাঙ্কির ইংরেজি জান না মানিক, বউয়ের সঙ্গে কাজিয়া করতে গেছ! যদি গৃহত্যাগ করতে হয় তো ব্যাকরণ শিখে গৃহত্যাগ করবি। মূর্খের কোনও সম্মান নেই। কুসি সংস্কৃতটা মনে করিয়ে দে।
কুসি : বিদ্বান সর্বত্রঃ পূজ্যতে।
বড় : এইজন্য তোকে আমার ভালো লাগে। তুই গ্রেট। চুলে লতাপাতা চটকালেও তুই ডাচেস। তুই মিত্তির বাড়ির গাঁদাল পাতা জড়ানো সম্রাজ্ঞী। [আচমকা ন’ভাইকে এক ধমক] এক গ্লাস ফ্রুটসল্ট খেয়ে পড়তে বোস। আমি দুপুরে এসে জেন্ডার ধরব।
মেজো : [মন্থর গতিতে প্রবেশ, ঘুম ঘুম ভাব] এত চিৎকার কীসের? কী কারণে এই চলচ্চিত্তচঞ্চরী? ভোরবেলা কাঁচা ঘুম ভেঙে গেল। একালে কে আবার গৃহত্যাগ করছে। সে তো সেকালে একবারই হয়ে গেছে। সুন্দরী বিষ্ণুপ্রিয়াকে ত্যাগ করে মহাপ্রভু সমুদ্রে ঝাঁপ মেরেছিলেন। [ন’ভাই-এর ভুঁড়িতে কুচুরমুচুর করে] শোন গোপাল, আধ্যাত্মিক কারণে গৃহত্যাগ করলে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। পাঁচশো বছর ধরে যুগ অপেক্ষা করে আছে আর একজন শ্রীচৈতন্যর জন্য। তুমি যদি সেই আত্মচৈতন্য হতে পার, আমরা তাহলে ঢাক বাজাব। আর যদি স্ত্রীর খোঁচা খেয়ে মগ্নচৈতন্য হও, তাহলে ভেঁপু বাজাব, ব্যাটা গাধা। কুসি শ্লোকটা সাপ্লাই কর।
কুসি : অজা যুদ্ধে, ঋষি শ্রাদ্ধে, প্রাতে মেঘডম্বরে, দাম্পত্য কলহেচৈব বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া।
মেজো : কুসি তোকে আমি ব্যাকরণতীর্থ, স্মৃতিচঞ্চু, তর্কালঙ্কার উপাধি তিনটেই একসঙ্গে ম্যানজ করে দেব। তোমার তুলনা তুমিই ভাগিনী। [মেজ ন’ভাই-এর ভুঁড়িটা আর একবার খামচে] শুনলে নাড়ুগোপাল, প্রাতঃকালে মেঘ ডাকলে কিছুই হয় না। দেখি তোর পেট, ড্যাব ড্যাব করছে মনে হচ্ছে। এ তো বায়ুপুরাণ। কুসি এর আজ জলপথ্য। এত ভোরে উঠলে কেন আর্টিস্ট। যাও আর এক রাউন্ড নাক ডাকিয়ে এস।
বড় : যাঃ সর্বনাশ হয়ে গেল, আধঘণ্টা লেটে চলেছি। ফাইনালি গুডবাই। [দরজা দিয়ে বেরোতে বেরোতে] শান্তি, শান্তি, শান্তি।
মেজো : যাঃ বাড়িটা খালি করে চলে গেল রে। বড়টা না থাকলে বাড়িটা কেমন খালি হয়ে যায় দেখেছিস কুসি। ওটা কোন জাতের প্রাণী বলতো, হাতি না ভাল্লুক।
কুসি : হাতি বোল না দাদা, সম্মান জানাতে হলে শুদ্ধ সংস্কৃতে বলতে হয়, দেখ হাতি হলো গালাগাল। কিন্তু বিশুদ্ধ ঐরাবত? একটা আলাদা ব্যাপার। বড়দা আমাদের সুঠাম ঐরাবত।
মেজো : [উজ্জ্বল মুখে] আর আমি?
কুসি : তুম মনে হয় জাতিতে ভাল্লুক।
মেজো : [ফিউজ হয়ে গিয়ে] আমার মধ্যে ভাল্লুকের কী দেখলি?
কুসি : বেশ একটা নরম নরম, কম্বল কম্বল, ভোম্বল ভোম্বল ব্যাপার।
মেজো : বেশ ভালো লাগল। ভাল্লুকের সংস্কৃত?
কুসি : আগে মাঙ্কির স্ত্রীলিঙ্গ বল। তারপর আমি ভাল্লুকের সংস্কৃত বলব।
মেজো : পরীক্ষা করছিস। শোন লিঙ্গ শব্দটা খুব মজার। তার নিজের কোনও লিঙ্গ নেই। আগে একটি পুং বসালে পুংলিঙ্গ, আগে একটি স্ত্রী বসালেই স্ত্রীলিঙ্গ। সেইরকম মাঙ্কিরও কোনও লিঙ্গ নেই। বাঁদরামি ছেলেও করতে পারে, মেয়েও করতে পারে। মাঙ্কির আগে একটি ‘হি’ বসাও, হয়ে গেল বাঁদর, একটা ‘শি’ বসাও হয়ে গেল বাঁদরি। তাহলে বাঁদরির ইংরেজি হলো শি মাঙ্কি। এইবার ভাল্লুকের সংস্কৃত বলতো।
কুসি : হারাতে পারবে না, ভাল্লুকের সংস্কৃত হলো ঋক্ষ।
ন’ভাই : পালতোলা জাহাজের মতো এধার থেকে ওধারে গিয়ে তোমরা ব্যাপারটাকে হালকা করে ঘুরিয়ে দিতে চাইছ। এটাই প্রমাণ করে এ বাড়িতে আমার কোনও পজিশন নেই। রেখাই তোমাদের মনে রেখাপাত করেছে। তোমাদের পরিমল হলো মল।
মেজো : সত্যি কথাটাই বললি রে। তুই হলি মল, সুন্দর একজোড়া পায়ে সেই মল ঝুমুর ঝুমুর বাজে। কিছু মনে করিসনি তুই একটু স্ত্রৈণ আছিস। অবশ্য শিল্পী মাত্রেই মেয়েদের একটু অন্য চোখে দেখে।
ন : [ঘুরে দাঁড়িয়ে] মেজদা অ্যাডিং ইনসাল্ট টু ইনজুরি। তুমি আমার মতো এক পুরুষসিংহকে স্ত্রৈণ বললে, তোমার মনে এই ছিল!
মেজো : শোন ভ্রাতা। কাল ছিল চাঁদের আলোর রাত। তোমার ঘরের খোলা জানালা দিয়ে চাঁদের আলো তোমাদের ঘরে লুটিয়েছিল, সেই আলোয় জানলার দিকে মুখ করে তোমরা পাশাপাশি বসেছিলে। তোমার হাতে ছিল বিলেত থেকে আনা সেই ঝকঝকে পাইপটা। সেটাতে তুমি একটা বাংলা প্রেমের গান বাজাবার চেষ্টা করছিলেন। অবশ্যই ব্যর্থ চেষ্টা। বেশির ভাগ পর্দাই লিক করছিল। তার ফলে মনে হচ্ছিল, মাঝরাতে একটা মা-হারা ছানা বাসার খড়কুটোয় চিঁ চিঁ করে ডাক ছাড়ছে। বল ভ্রাতা, ইহা সত্য না মিথ্যা। তোমার ফুঁ আছে, সেই ফুঁয়ে বাতি নিভতে পারে, কিন্তু প্রেম জাগে না। রাতের সেই প্রেম কোন কায়দায় চটকালে মানিক।
ন : তুমি এত সব জানলে কী করে। ইউ আর এ পিপিং টম।
মেজো : ইউ আর এ টম ক্যাট। হুলো বেড়াল।
কুসি : তুমি এমন প্রেমের দৃশ্য দেখলে কেন? কোন আক্কেলে, ওদের প্রেমের জানলায় নাক গলাতে গিয়েছিলে? বুড়ো আইবুড়ো তুমি। তোমার ক্যারেকটারই একমাত্র কম্বল। সেইটাকে সম্বল করে তোমার জীবনপথে এগিয়ে যেতে হবে।
মেজো : [অমায়িক হেসে] জানি, এই সন্দেহই করবি। আমি উঁকি মেরেছিলাম টেকনিক্যাল কারণে।
কুসি : অর্থাৎ?
মেজো : এই বিশেষ ধরণের বাঁশিতে কিঞ্চিৎ দক্ষতা আছে আমার। আমি যখন অক্সফোর্ডে ছিলাম, তখন ব্ল্যামফোর্ড সাহেব আমাকে কিছু তালিম দিয়েছিলেন। বারে বারে ওর ফুঁ যখন ফসকে যাচ্ছিল তখন আমি অস্বস্তিতে ছটফট করছিলাম। মনে হচ্ছিল বাঁশিটা কেড়ে নিয়ে আমি বাজাই, মোৎজার্ট-এর একটা কনচের্টো। জান বোধহয় ওই প্রখ্যাত শিল্পীকে বাঁশিটি উপহার দিয়েছিল—এই প্রখ্যাত পণ্ডিত [ন’কে ইঙ্গিত করে]
[রেখার প্রবেশ, হাতে এককাপ চা ন’কে লক্ষ্য করে ঝাঁঝালো গলায়]
রেখা : মিত্তির বাড়ির অনেক রেস্ত দেখেছ তাই না? বড়দা আর মেজদার অনেক টাকা। আর আমার দিদির রান্নাঘরটাও ভূত ভোজনের জায়গা। এই নিয়ে তিনবার চা হলো আর চা ফেলা হলো। তোমার এত রাগ কীসের। যে সকালে পরপর পঞ্চাশটা হাঁচে, হজমের ওষুধ না খেলে ঝোলভাতও হজম হয় না, যে এখনও অন্ধকারে ভূত দেখে, বিছানায় একা শুতে পারে না, তার কীসের এত মাস্তানি!
মেজো : কুল ডাউন, কুল ডাউন। লাস্টা ওয়ার্ডটা রকে। কুসি, মাস্তানির সংস্কৃত কী হবে?
কুসি : ওখানে পুরুষত্ব বসিয়ে দাও। ওইটাই ফিট করবে।
মেজো : রেখা, তুমি মাইরি খুব ডিপ্লোম্যাটিক আছ।
কুসি : মাইরিটা তুলে ফেল। ওটা বন্ধুকে বলা যায়। তুমি ওর ভাসুর।
মেজো : এ তুই একটা, সেকালের মতো কথা বললি। সেই রাবণের যুগে ভাসুররা সব অসুর ছিল। শ্বশুররা ছিল খশুর। শাশুড়িরা ছিল বউকাটকি। একালে উই আর অল ফ্রেন্ডস। একটা সংস্কৃত সাপ্লাই কর।
কুসি : মিত্র।
মেজো : দারুণ, মিত্তির পরিবারে আমরা সবাই মিত্র।
রেখা : মেজদা আমায় ডিপ্লোম্যাট বললে কেন?
মেজো : তুই কি সুন্দর বললি, বড়দা আর মেজদার পয়সা, এককথায় তুই প্রমাণ করে দিলি। তুই আমাদের দলে। একেই বলে সলিডারিটি, একেই বলে স্ট্রেংথ। [ন’ভাইকে উদ্দেশ্য করে] মহাপ্রভু; বার বার তিনবার, এই তৃতীয় প্রচেষ্টার চাটি ওষ্ঠলগ্ন করে উদরে চালান কর। ঘড়ি দেখেছ তোমার সময় হয়েছে খাজনা জমা দেবার। যদি আটকে যায় তাহলে ত্রিফলা চূর্ণ। অতিশয় সুস্বাদু।
রেখা : [স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে] এইবার যদি চা না খাও সকলের সামনে তাহলে আমি তোমার টাকে এই চা ঢালব।
ন : [বিস্ফারিত চোখে] শুনলে, ল্যাঙ্গোয়েজটা শুনলে?
মেজো : গাধা, এটা যে কতবড় প্রেমের ভাষা, আমি বিয়ে না করেও বুঝতে পারছি, আর তুই ব্যাটা এক মেয়ের বাপ হয়ে বুঝতে পারছিস না! এর মধ্যে লুকিয়ে আছে নারীর অধিকার বোধ। বলতে চাইছে আমার পাঁঠা আমি লেজাতেও কাটতে পারি, মুড়োতেও কাটতে পারি। [মুখভঙ্গি করে] আই লাভ ইউ। এটা হলো কেতাবী প্রেম। অ্যাই মিনসে—এটা হলো বাস্তব প্রেম।
কুসি : মিনসে শব্দটা?
মেজো : ওটা আমি পাল্টাতে পারছি না ভাই, ব্যাকরণ দেখ মনুষ্য থেকে মানুষ, মানুষ থেকে মিনসে, সমগ্র মানবজাতি হলো মনুষ্য, পাড়ার পকেটে তারা মানুষ। আর স্ত্রীর অঞ্চলের বন্ধনে তারা একটি গ্রাম্য শব্দ মিনসে। হেঃ হেঃ।
ন : তুমি আমাকে পাঁঠা বললে!
মেজো : রেগে গেলে মানুষের বুদ্ধিভ্রংশ হয়। আমি আমার পাঁঠা বলেচি? বলেচি স্ত্রীর পাঁঠা। পাঁঠা জিনিসটা উপেক্ষার নয়। একটা ভালো ওজনদার পাঁঠার দাম তোমার চেয়ে অনেক বেশি। তোর ওজন কত?
ন : বাহান্ন কেজি।
মেজো : একটা বাহান্ন কেজি পাঁঠার দাম হিসেব কর? বাহান্ন ইনটু একশো, লিভার যেটাকে আমরা মেটে বলি তার দাম আরও বেশি। এইবার ছাল, টোট্যাল মার। কুসি কত হলো?
কুসি : অঙ্কে আমি কাঁচা, ক্যালকুলেটর লাগবে।
রেখা : স্বামীকে ছাগল বলতে নেই, কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি এটা একটা মাথামোটা রামছাগল।
মেজো : ছিঃ বৌমা, স্বামী হলো গুরু। শোন পরে একটু গোবর খেয়ে নিও।
রেখা : ও ফুলকপি খেলেই গোবর খাওয়া হবে। এমনি গোবর নয় গোবর সার। ফুল হয়ে ফুটে আছে। নাও চাটা ধর, ওয়ান, টু, থ্রি।
[ন চায়ের কাপটা নিয়ে নিল]
মেজো : লেড়কা লোক তালি বাজাও।
[দরজার বাইরে থেকে সত্যি সত্যি তালির আওয়াজ পাওয়া গেল]
মেজো : ওরে বাঁদর দুটো বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কেন, ভিতরে আয়, ভিতরে আয়।
[দুষ্টু দুষ্টু মুখে দুটো বাচ্চা খুশির হাওয়া নিয়ে ভিতরে ঢুকে এল এবং ঢুকেই নাচতে লাগল হারে রে রে রে তোরা দে রে আমার ছেড়ে।]
[বাইরে ফট করে একটা শব্দ হলো। ঘরে ঢুকছেন সেই আশ্রিত বৃদ্ধ বুড়োটি।
হাতে ট্রে, তার ওপর চায়ের কাপ।]
মেজো। এ কী আপনি! বাইরে কিসের শব্দ হলো।
বৃদ্ধ : জন্মদিনের বড় বেলুন ফেটে গেল।
মেজো : তার মানে বিয়ে হলো। জন্ম হয়েছিল যার, সে আবার বড় হলো তার বিয়ে হলো, বিয়ের পর প্রেমের বেলুন ফাটল।
[আদালতে দাঁড়ানো উকিল সাহেবের মতো মেজো বলে উঠল] মি লর্ড দ্যাটস হোয়াই আই অ্যাম ও ব্যাচেলার, আই অ্যাম এ প্রিন্স।
কুসি : জজসাহেব বলছেন, শুনতে পাচ্ছ। ব্যাচেলার লিভস লাইক এ প্রিন্স, ডাইস লাইক এ ডগ।
মেজো : পয়সা ফেললে সব সার্ভিসই পাওয়া যায়।
কুসি : স্ত্রীর স্নেহ পাওয়া যায় না, স্ত্রীর সেবা পাওয়া যায় না।
মেজো : সে তুই সেকালের স্ত্রীর কথা বলছিস। একালের মিসেসরা অন্যরকম।
রেখা : প্রতিবাদ করছি। স্ত্রীদের সেকাল, একাল নেই। এই ছোকরা যদি চা না খেত, তাহলে আমি জলগ্রহণ করতাম না। দেখিয়ে দিতুম তোমার রোখ বেশি না আমার রোখ বেশি।
বৃদ্ধ : চাটা গ্রহণ কর। বেড টি, এখনও নিশ্চয়ই দাঁত মাজা হয়নি?
মেজো : আপনি চা নিয়ে এলেন কেন? আরও অনেকে আছে।
বৃদ্ধ : আমাকে গ্রহণ করবে না! আদর করে বসিয়ে রাখলে আমি এই পরিবারের একজন হই কী করে?
মেজো : দ্যাটস রাইট, দ্যাটস রাইট। কাল কেমন ঘুমোলেন?
বৃদ্ধ। নরম বিছানা, নেটের মশারি, আতরের গন্ধ। প্রথমটায় একটু অস্বস্তি হচ্ছিল ঠিকই। পরে মনে হলো ভাগ্য কোথায় কখন নিয়ে যায়। পড়ে ছিলুম আস্তাকুঁড়ে, উঠে এলুম রাজপ্রাসাদে। আচ্ছা তোমরা কি দিয়ে তৈরি বলো তো।
মেজো : হাড়, মাংস, মেদ, মজ্জা, লিভার, পিলে, ফুসফুস, হৃদয়। সব সাধারণ সাধারণ জিনিস দিয়ে তৈরি।
বৃদ্ধ : হৃদয়টা?
মেজো : হৃদয়টা একটা টুলু পাম্প। রক্ত তুলছে, রক্ত নামাচ্ছে। ওই গানটা মনে আছে?
বৃদ্ধ : কোনটা?
মেজো : কাগজে লিখো না নাম।
বৃদ্ধ : ও প্রত্যেক পুজোয় শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে। কাগজে লিখো না নাম, কাগজ ছিঁড়ে যাবে। পাথরে লিখো না নাম, পাথর ক্ষয়ে যাবে, হৃদয়ে লেখো নাম, সে নাম রয়ে যাবে।
মেজো : লাস্ট লাইনে একালের কারেকশন, হৃদয়ে লিখো না নাম হৃদয় বাইপাস হয়ে যাবে।
বৃদ্ধ : তোমাদের হৃদয়টা সোনার। এটা তোষামোদি নয়, এটা বৃদ্ধের অনুভূতি।
মেজো : [চায়ে চুমুক দিয়ে] উত্তম। যথেষ্ট ফ্লেভার, কিন্তু শীতল।
বৃদ্ধ : তোমাদের কথার চোটে ঠান্ডা হয়ে গেল। উষ্ণ এক কাপ আনব কী?
মেজো : আপাতত থাক। আধ ঘণ্টার মধ্যে আমরা আবার মিট করব। [মেজো চলে গেল, ঘরে বৃদ্ধ, ন ও রেখা]
রেখা : [বৃদ্ধকে] জ্যাঠামশাই, আপনি অনুগ্রহ করে একটা কাজ করবেন। গান্ধারীকে একবার বলবেন তারে কাপড়গুলো মেলে দিতে।
[বলতে না বলতেই গান্ধারী রণচণ্ডী মূর্তিতে দরজার সামনে]
গান্ধারী : [বৃদ্ধকে ঝাঁঝালো গলায়] সাত তাড়াতাড়ি তোমাকে চা কে আনতে বলেছে? বেশি আদিখ্যেতা। ভাবছ এইসব করলেই খাতির বেশি পাবে। বুড়োটা মহা চালাক।
রেখা : এসব কী বলছিস গান্ধারী। তোর মুখের কোনও রাখঢাক নেই। প্রবীণ এক শ্রদ্ধেয় মানুষ। জানিস একসময় ইনি এত বড়লোক ছিলেন যে এই মিত্তির বাড়ির সবকটাকে কিনে নিতে পারতেন। তুই খুব বেড়েছিস গান্ধারী।
বৃদ্ধ : [হাসতে হাসতে] মা ওর কোনও দোষ নেই। ও জগৎ-এর নিয়মেই চলছে। যার টাকা নেই, তার ইজ্জতও নেই। এখানে আমার এত সুখ, তার মধ্যে একটু দুঃখ না থাকলে ব্যাপারটা যে সিনেমার গল্প হয়ে যাবে। গান্ধারীর একটু ঝাঁঝ বেশি, বয়স কম তো, মেয়েটা কিন্তু ভালো। কাল রাত্রে আমার মাথার কাছে জলের গ্লাস চাপা দিয়ে রেখে গিয়েছিল। আর বলেছিল রাতে দরকার হলে আমাকে ডেকো। একা একা বেশি বাহাদুরি করতে যেও না। বুড়োরা পড়ে গেলেই কাঠামো খুলে যায়। এ আমাদের ব্যাপার মা। তোমরা কিছু মনে করো না।
গান্ধারী : [বৃদ্ধকে] মুখে একগাদা পাটের মতো দাড়ি, যাও না গিয়ে কামাও না। লোককে আর নাইবা জানালে তোমার এত দুঃখ।
[গান্ধারীর নাকটা নেড়ে দিয়ে বৃদ্ধ চলে গেলেন।]
গান্ধারী : [যেতে যেতে] লোকটাকে ঠিক আমার বাপের মতো দেখতে।
রেখা : [ন’কে] মাথামোটা, কাল রাতে তুমি যা বলেছিলে, যেটা না করায় রেগে গেল, সেটা করলে কী হতো? জানই তো মেজদা রাতে ঘুমোয় না। সারারাত আপন মনে পায়চারি করতে করতে গুনগুন করে গান গায়। আর বাইনোকিউলার দিয়ে আকাশের তারা দেখে।
ন : আজ বুঝলুম, মেয়েরা ছেলেদের থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান।
রেখা : ফট করে রেগে যাবার আগে চিন্তা করবে। রেখা কী বলছে কেন বলছে। তার পিছনে নিশ্চয় কোনও কারণ আছে।
ন : কেন বলেছিলাম জানো? পোশাকের ওই নতুন ডিজাইনটা বাজারে ছাড়ার আগে চাঁদের আলোর ব্যাকলাইটে তোমাকে পরিয়ে একটু দেখব। এটা একটা প্রফেশনাল ব্যাপার।
রেখা : শোবার ঘরে প্রফেশনটা নাইবা ঢোকালে। ওর জন্য তো তোমার দামী দামী মডেলরা আছে।
[বাইরে থেকে এক মহিলার কণ্ঠস্বর]
মহিলা : পরিমলদা আছেন, পরিমলদা।
পরিমল : কে?
মহিলা : আমি সুদেষ্ণা।
পরিমল : এসো।
[সুদেষ্ণা ঘরে প্রবেশ করল। পাড়ার মেয়ে, কলেজে পড়ে]
পরিমল : কী সমস্যা তোমার সুদেষ্ণা?
সুদেষ্ণা : জাস্ট আপনার একটা সাজেশন, আকাশি নীল রঙের শাড়ির সঙ্গে কী ব্লাউজ পরা উচিত?
রেখা : তুই এইটা জানার জন্য, এতটা হেঁটে এলি! তোর বউদি তো বলে দিতে পারত।
সুদেষ্ণা : বৌদি বললে সাদা, পরে দেখলুম মানাচ্ছে না। তাই ভাবলুম ফ্যাশনের জগতের এতবড় একজন মানুষ পরিমলদাকে জিজ্ঞাসা করে আসি।
পরিমল : শোন, তোমাকে শিখিয়ে দিই। রঙের জগতে দুটো কথা আছে ম্যাচিং আর কনট্রাস্ট। আকাশি নীলের সঙ্গে নীল যেতে পারে। এটা হলো ম্যাচিং, কিন্তু একঘেয়ে। এটাকে আমরা কনট্রাস্ট দিয়ে ভাঙতে পারি। নীলের কনট্রাস্ট হলো গোলাপি। রঙটা যখন আকাশি নীল তখন গোলাপিটাও হবে ফিকে গোলাপি অর্থাৎ পিঙ্ক। তোমার বৌদি যে বলেছিলেন সাদা। সাদা হলো ডেড কালার। অগতির গতি। সবেতেই যেতে পারে। বুঝতে পারলে। তোমাকে একটা কালার হুইল প্রেজেন্ট করব। তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। জানবে মূল রঙ হলো তিনটে— লাল-নীল-হলদে। বাকি সব মিলেমিশে। [ন বেরিয়ে গেল।]
[ঘরে সুদেষ্ণা ও রেখা]
সুদেষ্ণা : [রেখার পাশে বসে] কানের দুলের পাথর দুটো কী গো? হীরে?
রেখা : [লাজুক লাজুক মুখে] হ্যাঁরে হীরে।
সুদেষ্ণা : মিত্তির বাড়ির বউ, হীরে তো হবেই।
[ঘরে কুসি আর সেজবউ পরমা ঢুকল]
কুসি : কতদিন পরে তুই এলি, সুদেষ্ণা?
সুদেষ্ণা : [অভিমানের গলায়] তোমরা তো একবারও খবরও নাও না, মেয়েটা বেঁচে আছে না মরে গেছে। জান আমাদের বাড়িতে কি হয়েছিল? চোর এসেছিল।
পরমা : চোর এসেছিল তো কি হয়েছে? কিছু নিতে পেরেছিল?
সুদেষ্ণা : কিছুই নিতে পারেনি। বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল।
কুসি : চোরের সঙ্গে হার্ট অ্যাটাকের কী আছে?
সুদেষ্ণা : বাবার সঙ্গে চোরের পনেরো মিনিট শুভদৃষ্টি।
রেখা : সে আবার কী? সে তো ছাঁদনাতলায় হয়।
সুদেষ্ণা : আরে না গো। চোর বারান্দার কাচের জানলার ওপাশে, বাবা জানলার এপাশে ঘরে। মাঝখানে পাতলা কাঠের ব্যবধান। কাচে নাক ঠেকিয়ে বাবা বাইরে তাকিয়ে আছে আর ওপাশে নাক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চোর। প্রথমটায় বাবা ভেবেছিল নিজের মুখের প্রতিবিম্ব। তারপর হঠাৎ যেই মনে হলো প্রতিবিম্বের ঠোঁটে গোঁফ আর নাকটা চ্যাপটা। বাবার গোঁফ নেই, নাকটা টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো টিকলো। বাবা অমনি চো-চো শব্দ করে থ্যাস করে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। চোর লজ্জায় পালিয়ে গেল। আর আমাদের হইচই। লোকজন এসে পড়ল। বাবা তখনও অজ্ঞান। শ্বাস পড়ছে কী পড়ছে না। এসে গেল অ্যাম্বুলেন্স। সেই রাতেই ইনটেনসিভ কেয়ারে।
কুসি : [উদ্বেগের গলায়] এখন কেমন আছেন?
সুদেষ্ণা : আজকে অফিস বেরোবেন। ডাক্তার আমাকে বলেছেন তুমি বাবাকে অফিসে পৌঁছে দিয়ে আসবে, আবার তুমিই বাড়ি ফিরিয়ে আনবে।
কুসি : আর ক’দিন ছুটে নিলে পারতেন?
সুদেষ্ণা : ছুটি আর পাওনা নেই। বিশাল একটা প্রমোশন ঝুলে আছে। কামাই করলেই ডিমোশন। ওই উঁচু চেয়ারটায় বসার জন্য তিনজন হাঁচোড়পাঁচোড় করছে। কে ওঠে, কে ছিটকে যায়।
কুসি : হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল একথা কেউ যেন জানতে না পারে।
সুদেষ্ণা : আরে আমরা তো চেপে রাখার চেষ্টা করছি। আমাদের কাজের মেয়েটা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এতদিনে বোধহয় ডালহৌসি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
পরমা : ওরা হলো রয়টার।
কুসি : আমি দেখেছি, যে যত বড়ই বীর হোক, চোর দেখলে চোর চোর করে চিৎকার করতে পারে না। চেষ্টা যে করে না তো নয়, কিন্তু যা বেরোয় তা হলো চো-চো।
পরমা : এই রেখা, তোকে একটা কথা বলতে এলাম। তোর কচি কলাপাতা রঙের শাড়িটা আজ দিবি?
রেখা : এতে বলার কি আছে! আলমারি খুলে নিয়ে নেবে। তোমাকে আগেই বলেছি। তোমার-আমার বলে কিছু নেই।
পরমা : জানি, তবে ও শাড়িটা তুই একদিনও পরিসনি তো।
রেখা : তোমার শরীরেই উদ্বোধন হোক সেজদি। তবে ওকে জিজ্ঞাসা করে নিও ম্যাচিং ব্লাউজ কি হবে।
[পরমা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। গান্ধারীর প্রবেশ]
গান্ধারী : [উত্তেজিত হয়ে] বড়দি, হয়ে গেল, আজ নিরামিষ। বড়দার সেই সাধের হুলো মুজাহিদ ওই অতবড় মাছটাকে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে নিয়ে গেছে পাঁচিলের ওপর। সেখানে বসে একটু একটু করে খাচ্ছে আর কাকের ঠোকরে কোঁক কোঁক করছে। আর গোটাকুড়ি কাক ছেঁকে ধরেছে।
কুসি : সেকী রে? মাছ গেছে যাক, বেড়ালটাকে বাঁচা। ওকে ঘরে বসে খেতে বল।
গান্ধারী : আমার কথা শুনবে, কোনও ব্যাটাছেলে কোনও মেয়েছেলের কথা শুনেছে কোনওদিন? কাছে যেতেই দিচ্ছে না। ফ্যাস ফ্যাস করছে।
কুসি : চল দেখি।
[কুসি, রেখা, সুদেষ্ণা সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল]
গান্ধারী : [পিছনে যেতে যেতে] এইবার র্যাশনের দোকান থেকে একটা বস্তা আনব। তারপর গোদাটাকে ধরব। তারপর তেপান্তরে ছেড়ে দিয়ে আসব। কাল রাতে একবাটি ক্ষীর খেয়েছে। আমাকে দেখে পালালো না, উলটে জিভ দিয়ে গোঁফ চাটতে লাগল। এদের আদরে বেড়ালও বাঁদর হয়।
[বাইরের দরজা দিয়ে, ভয়ে ভয়ে একজন উঁকি মারছে। মধ্যবয়সী একজন মানুষ। আর ঠিক সেই সময় ঘরে ঢুকছেন বৃদ্ধ জ্যাঠামশাই। দুজনে মুখোমুখি।]
বৃদ্ধ : কী মতলব?
মধ্যবয়সী : বাড়িতে কেউ নেই?
বৃদ্ধ : সবাই আছে। খালি ডাক্তারবাবু নেই।
মধ্যবয়সী : ডাক্তারবাবুকেই আমার দরকার। কম্পাউন্ডারবাবু হলেও চলবে। ভীষণ সমস্যায় পড়েছি।
বৃদ্ধ : এখনও তো ডিসপেনসারি খোলেনি। এগারোটার সময় খুলবে।
মধ্য : তাহলে কী হবে? ন’টা যে বেজে গেল।
বৃদ্ধ : আর তো মাত্র দু’ঘণ্টা।
মধ্য : [পকেট থেকে একটা ওষুধের শিশি বের করে] ডাক্তারবাবু বলেছিলেন ঠিক ন’টার সময় দু’চামচ খেতে।
বৃদ্ধ : তাহলে খেয়ে ফেলুন। চামচে কী দেব?
মধ্য : খাব কী করে? ছিপির প্যাঁচ ঘুরে গেছে।
তিন
বড়ভাই ঘরে ঢুকছেন, একজনকে আহ্বান করছেন, আসুন আসুন।
দুটো হাত দু’পাশে ছড়িয়ে সসম্ভ্রমে ভিতরে চলুন, ভিতরে চলুন।
বড় : আমাদের কী ভাগ্য! কতদিন পরে আপনি এলেন।
[সৌম্য সুন্দর চেহারার এক ভদ্রলোক। পরনে ধুতি, সিল্কের পাঞ্জাবি, সোনার বোতাম। সব আঙুলে সোনার আংটি। পাঞ্জাবির বুকপকেটে দুটো সোনার কলম। পকেট ঘড়ির সোনার চেন বুকের কাছে দুলছে।]
[ভদ্রলোক রাজকীয় ভঙ্গিতে সোফায় বসা মাত্রই বড়র চিৎকার]
বড় : ওরে কে কোথায় আছিস?
[ডাক শুনেই প্রথমে এল গান্ধারী। হাতে এক গ্লাস জল, গেলাসটা বড়র দিকে বাড়িয়ে দিয়ে]
গান্ধারী : ফিল্টারের জল। গরম-ঠান্ডা মেশানো।
বড় : তোর কাছে আমি জল চেয়েছি?
গান্ধারী : বড়দা আপনি যে বলেন মেঘ না চাইতেই জল।
বড় : মেঘ না চাইতেই জল আজ ওই সোফায় বসে আছেন। ডাক সবাইকে।
[এক একজন ঢুকছে আর বিস্ময়ের উক্তি : ওমা আপনি!]
কুসি : এত দিন কোথায় ছিলেন?
রাজজ্যোতিষী : আর বল কেন, রাজা মহারাজারাই আমাকে শেষ করে দিল। গেছি পশুপতিনাথে, নেপালের রাজার কানে খবরটা ঠিক চলে গেছে। একেবারে হাওদা চড়ানো হাতি এসে হাজির, যেতেই হবে। নেপালে একটু ক্রাইসিস যাচ্ছে তো।
কুসি : হাতি কেন? রাজার তো মার্সিডিজ, রোলস রয়েস সবই আছে।
রাজজ্যোতিষী : এই দেখ ভুলে গেছ। আমি ধাতব গাড়িতে চড়তে পারি না, কাঠ ছাড়া সমস্ত কিছু অসহ্য। লোহা হলো কন্ডাকটার, আমার ভিতরের এনার্জি, আমার পাওয়ার লোহা টেনে নিতে পারে। সেই কারণে ননকন্ডাকটার হাতি, ঘোড়া, কাঠের রথ—এছাড়া আমার চলে না। বেসরকারি বাস চলতে পারে, কাঠের সিট। আগে ট্রেন চলতে পারত, কিন্তু এখন তো সব লোহার।
কুসি : মহা মুশকিল। এখন কীভাবে এলেন?
রাজ্যো : এই দেখ, আবার তোমার মেমারি ফেল করেছে। কলকাতায় চলাফেরা করার জন্য আমি পৈত্রিক ফিটন গাড়িটাই ব্যবহার করি। অস্ট্রেলিয়ার প্রাইম মিনিস্টার আমাকে একটা ঘোড়া প্রেজেন্ট করেছেন। আগে খুব তাগড়া ছিল। এখন বলে না দিলে কেউ বিশ্বাসই করবে না ওটা অস্ট্রেলিয়ান ঘোড়া। এদেশের জলবায়ুতে পটকে গেছে।
বড় : আমি একটু চেঞ্জ করে আসি।
রাজ্যো : হ্যাঁ, হ্যাঁ, ধড়াচুড়ো খুলে এস। ণ্ডবউদের দিকে তাকিয়েণ্ণ বাঃ তোমরা দুটিতে বেশ ফুটফুটে হয়েছ। ভালো সময় যাচ্ছে।
[বাচ্চা দুটো একপাশে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে বড় বড় চোখে তাকিয়েছিল]
রাজ্যো : [তাদের দিকে তাকিয়ে] এদেশে বেশি দিন নয়। ছেলেটা যাবে আমেরিকায়, মেয়েটা যাবে জার্মানিতে। আমি দেখতে পাচ্ছি। ওটার তুঙ্গী রবি, আর মেয়েটার তুঙ্গী চন্দ্র।
দুই মা : [রেখা ও পরমা] [একসঙ্গে] ওরা বড় হবে তো?
জ্যোতিষী : প্রশ্নটা ঠিক হলো না। কালের নিয়মে সবাই বড় হবে। মহাকাল ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। বড় হবে কী না জিজ্ঞাসা কোর না। জিজ্ঞাসা কর মানুষ হবে কী না? মানুষের বড় অভাব।
বড় : [ঘরে ঢুকতে ঢুকতে] আজ্ঞে হ্যাঁ, মানুষের বড় অভাব।
জ্যো : দুটো পা থাকলেই মানুষ হওয়া যায় না। বকেরও তো দুটো ঠ্যাং।
কুসি : মহাভারতের বককে যে ধর্ম বলা হয়েছে?
জ্যোতিষী : এই নাও, আর একবার গুলোলে। ধার্মিকের ধর্ম, আর বকের ধর্ম অনেক তফাৎ। বকধার্মিক হওয়াটা মোটেই ঠিক নয়। বকধার্মিকের বকাণ্ড প্রত্যাশা।
বড় : [তাড়াতাড়ি অনুনয়ের কণ্ঠে] ওটা আর ব্যাখ্যা করবেন না, ওটা আর ব্যাখ্যা করবেন না। মেয়েরা রয়েছে, বাচ্চারা রয়েছে।
জ্যো : তুমি আমাকে এতটা বেআক্কেলে ভাবলে কী করে অমল? সাধন-ভজনের সময় আমার পরিবেশ জ্ঞান থাকে না ঠিকই। কিন্তু এখন তো আমি সাধন-ভজন করছি না। এখন আমি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলেই আছি। রাত বারোটার সময় আমি দেহের দরজা খুলে অন্যলোকে চলে যাই। কাল মাঝরাতে দেখলুম ভারতের অবস্থা খুব খারাপ। খুব খারাপ। মানুষ আর পশুতে আর প্রভেদ থাকবে না। ভাই ভাইকে মারবে, বাপ ছেলেকে মারবে, ছেলে বাপকে মারবে। স্ত্রীরা সব ব্যাভিচারিণী হয়ে যাবে। ঘরে ঘরে কলসি থেকে মদ গড়িয়ে খাবে। বাচ্চারা ফুটপাথে পড়ে থাকবে, কুকুরে এসে শুঁকবে, কিন্তু খাবে না।
কুসি : [ভয়ে ভয়ে] আমাদের কী হবে?
জ্যো : ধর্ম ধরে থাক, বেঁচে যাবি। এই সবকটাকে ক্ষীরিকার মূল পরিয়ে দে। আর রোজ দুটো করে মরিচ চিবিয়ে খাবি। আচ্ছা এখন যে আমার একটু ইচ্ছে করছে…
বড় : [সসম্ভ্রমে] আজ্ঞে কী ইচ্ছে করছে?
জ্যো : একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার একটু চায়ের লিকার, এক চামচে মধু। মধুটা গোলানো হবে না। সিরসির করে মধুটা মিশে যাবে। আর এই লিকারটা করবে ন’ বউ। ওর একটা মনের বাসনা প্রবল হয়েছে না! হবে, হবে, মাদুলি ধারণ না করেই হবে।
কুসি : [রেখাকে] নতুন স্টেনলেস স্টীলের নতুন গেলাসে তুই লিকারটা নিয়ে আয়।
জ্যো : এই দ্যাখ মেয়েটার আমার কিছু মনে থাকছে না। কী বলেছি ধাতু আমি স্পর্শ করতে পারি না। কাঠের গ্লাস, পাথরের গ্লাস যখন নেই তখন নতুন কাচের গ্লাস।
কুসি : পাথরের গেলাস আছে তো।
জ্যোতিষী : নিশ্চয়ই কালো পাথর অথবা ছিটছিটে পাঁশুটে পাথর, হবে না, মার্বেল পাথর চাই।
[ন’ বউ উঠে বেরিয়ে গেল]
জ্যো : ইচ্ছে তো হতেই পারে। মেয়ের পর একটা ছেলে। দেখি আজ মাঝরাতে ট্রপোস্ফিয়ার থেকে একটা বীজ যোগাড় করে শক্তিচালান করে দেব।
বড় : আহারাদি কী করবেন?
জ্যো : সব ভুলে গেছ। আমার আহার তোমরা জান। খাঁটি গাওয়া ঘিয়ে ভাজা চারখানা ফুলকো লুচি, একটু সিজিন্যাল তরকারি। কাশী হলে বলতুম একবাটি মালাই। এখানে অভাবে একবাটি ক্ষীর। সঙ্গে একটু সন্দেশ থাকলেও হয়, না থাকলেও হয়। আমার চাহিদা খুব অল্প।
বড় : তাহলে সেইরকম বলে দিই?
জ্যো : না, ওই কাজের লোককে দিয়ে করালে হবে না। ওই ভোগ প্রস্তুত করতে হবে কুসিকে। গলায় একটা রুদ্রাক্ষের মালা পরে। সে মালাটি অবশ্য আমিই দেব। জান তো, সাধারণ মানুষ ভাবে আমিই আহার করছি। অজ্ঞ, তারা অজ্ঞ। আহার কর, মনে কর আহুতি দি শ্যামা মাকে। মেজোভাইকে দেখছি না কেন? তিনি তো আবার ঘোর নাস্তিক।
বড় : এই সময়টা ও একটু বেড়াতে যায়। এখন কলেজের ছুটি চলেছে তো। তিন-চার মাইল না হাঁটলে উইক ফিল করে।
জ্যো : নাস্তিকই হোক আর আস্তিকই হোক, তিনি তাঁর কাজ ঠিক করে যান। ওই যে সুগার হতে পারে, সে যোগ আছে কোষ্ঠীতে। কবে দেখেছি আজও আমার মনে আছে। তাই তিনি টেনে নিয়ে গেছেন বেড়াতে। তাঁর খেলার কথা যখন ভাবি তখন স্তম্ভিত হয়ে যাই। ঠিকই বলেছেন। সাধকরা ঠিকই বলেছেন। আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী। যেমন চালাচ্ছ তেমনই চলছি। জীবনের টুনি লাইট পাওয়ার হাউসের সেই শক্তিতে জ্বলে আছে। যেই কানেকশন কেটে দেবেন, সঙ্গে সঙ্গে ফিউজ। [হঠাৎ খুব তীব্র গলায়] ওরে মূঢ়, মা কুরু ধনজন যৌবন গর্বং, হরোতি নিমেষাং কাল সর্বং।
গান্ধারী : [ধড়ফড় করে ঘরে ঢুকে] কী হলো, কী হলো?
জ্যো : [সেইদিকে তাকিয়ে] সেই গান্ধারী না, বেশ ডাগর-ডুগুর হয়েছে, রূপ খুলেছে, আদরে আছে। পূর্বজন্মের সামান্য একটু ভুলে রাজরানী না হয়ে চাকরানি। সৎ কর্ম করে যা, সৎ কর্ম। জেনে রাখিস কর্মই ধর্ম। ফলের আকাঙ্ক্ষা করিসনি। একটি মাত্র ফলই ফল, সেটি হলো মোক্ষফল। আচ্ছা, একটু জল খেলে কেমন হয়?
বড় : এই যে বললেন চা খাব।
জ্যো : চায়ের আগে তো একটু জল খেতে পারি। তিনি চাইছেন। এত কথা বললেন তো। গলাটা শুকিয়ে গেছে।
কুসি : তাহলে জল নিয়ে আসি?
জ্যো : কীসে করে আনবে?
কুসি : আপনার তো ধাতু চলবে না।
জ্যো : এই। এখন শ্রুতি স্মৃতিতে বসেছে।
[কমলের প্রবেশ। বাড়ির সেজ ছেলে। ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল। পরনে অফিসের ধড়াচূড়া।]
জ্যো : কমল না? তুঙ্গী বৃহস্পতি। তোমাকে কোথায় নিয়ে যাবে তুমি নিজেই জান না। টাকা বিছিয়ে তার ওপর শুয়ে থাকবে। আর যশ খ্যাতি। দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে। কী রকম হবে জান? আজ ভারতে তো কাল আমেরিকায়, কাল আমেরিকায় তো পরশু থাইল্যান্ডে। তবে বাবা, শত্রু হতে সাবধান। [উত্তেজিত হয়ে] শত্রু কোথায়? শত্রু বাইরে, না গো, শত্রু আর মিত্র দুটোই তোমার ভিতরে বসে আছে। আত্মাই আত্মার শত্রু। আত্মাই আত্মার মিত্র। একথা আমার নয়। আমি মূর্খ। একথা ভগবানের গীতায় বলেছেন। [আবার গলা চড়িয়ে] প্রলোভনে পা দেবে না, দেবে না, দেবে না। নারী হতে সাবধান।
কমল : [ভয়ে ভয়ে] আমার জীবনে আমার স্ত্রীই একমাত্র নারী।
জ্যো : মূর্খ, স্ত্রী নারী হলেও নারী নয়। সে হলো তোমার শক্তি। জীবনের কতটুকু দেখেছ ছোকরা যে তর্ক করছ! তোমার জীবনে নারী প্রলোভন আসবে, ধরে থাক।
কমল : [ভয়ে ভয়ে] কাকে?
জ্যো : শক্তিরূপিণী তোমার ওই স্ত্রীকে।
[ছিপির প্যাঁচ ঘুরে যাওয়া সকালের সেই লোকটি কখন ঢুকে পড়েছে। ফাঁক পেয়েই বলে উঠল]
লোক : ডাক্তারবাবু, প্যাঁচ ঘুরে গেছে।
বড় : [অন্যমনস্ক] যাকগে ঘুরে, আবার সোজা হয়ে যাবে।
লোক : এ প্যাঁচ সে প্যাঁচ নয়, শিশির প্যাঁচ।
বড় : [তাকিয়ে] কী বলতে চাইছ?
লোক : আপনি যে ওষুধটা দিয়েছিলেন সেই ওষুধের সিল করা ছিপির প্যাঁচ ঘুরে গেছে। খুলছে না, শুধু ঘুরেই যাচ্ছে। নটার ওষুধ খাওয়া হয়নি।
বড় : বাড়িতে দরজা আছে?
লোক : হ্যাঁ আছে। পুবদিকে একটা, পশ্চিমদিকে একটা, দক্ষিণ দিকে একটা। উত্তরে তো কোনও দরজা নেই।
বড় : [অবাক হয়ে] তোমাকে উত্তরের দরজার কথা বলেছি। বলেছি দরজার কথা। যে কোনও একটা দরজা ও পাল্লার মাঝখানে ছিপিটাকে চেপে ধরে ঘোরাও।
লোক : ঘুরিয়ে ছিলাম।
বড় : তা কী হলো?
লোক : [হতভম্ব হয়ে বলল] ভেঙে গেল, সব ওষুধ মাটিতে।
বড় : বাঁচা গেছে।
লোক : অনেক টাকা দাম, আর যে কেনার পয়সা নেই, একটা ফ্রি স্যাম্পেল।
বড় : ঠিক আছে, পরে এস।
লোক : [তবুও না গিয়ে] আমার আর একটা প্রশ্ন আছে ডাক্তারবাবু। নাভিশ্বাস কাকে বলে?
বড় : যে শ্বাস নাভি থেকে ওঠে।
জ্যো : এই প্রশ্নের ওই উত্তর হলো? শোন বাবা, নাভিশ্বাস দু’রকমের আছে। সাধকের নাভি থেকে যে শ্বাস ওঠে তাকে বলে প্রাণায়াম, আর সাধারণ মানুষের যে শ্বাস নাভি থেকে ওঠে তাকে বলে মৃত্যু। কার উঠেছে?
লোক : আমার মায়ের।
জ্যো : পুবদিকে মাথা, পশ্চিমদিকে পা। মাথার দিকের দেওয়ালে মা কালীর ক্যালেন্ডার। ডানপাশে জানালার বাইরে এটা নারকেল গাছ। বাড়িতে ঢোকার মুখে একটা নর্দমা। মাথার বালিশের ওয়াড়টা ময়লা। বিছানায় যে তোশক পাতা তার জায়গায় জায়গায় তুলো ঢেলা পাকিয়ে আছে। যে খাটে শুয়ে আছেন তার তলায় পিচবোর্ডের বাক্সে একগাদা পুজোর বাসন। ঘরের আলোর শেডে ঝুল। ঘরে ঢোকার মুখের পাপোস ছেঁড়া ছেঁড়া। বাথরুমের একটা কল ঠিকমতো বন্ধ হয় না। ফোঁটা ফোঁটা জল পড়েই যাচ্ছে। কী মিলছে?
লোকটি : [ভয়ে ভয়ে] হ্যাঁ, সবই মিলছে।
জ্যো : দ্বাদশীর শেষ রাতে তোমার মা পুষ্পক রথে চড়ে সপ্তম স্বর্গে প্রস্থান করবেন। বাবা দুঃখ কর না। শঙ্কর বলছেন, যাবৎ জনমং তাবৎ মরণং। জীবের ধর্মই হলো আজ আছে কাল নেই।
লোক : আপনি কিছু করতে পারেন না? মায়ের মৃত্যুটা আমার কাছে বড় কথা নয়। সব মাই মরবেন, আমার মাও মরবেন। কথাটা হলো মা মারা গেলেই দাদা আর বৌদি আমার পিছনে লাথি মারবে।
জ্যো : শোন, শোন, ভাগ্য বদলানো যায় না। কারুর বাবার ক্ষমতা নেই। জগৎবিখ্যাত প্রাণবল্লভ তোমার কী করবেন, যদি রাধাবল্লভ তোমায় রক্ষা না করেন? ভাগ্যের সঙ্গে লড়াই করবার জন্য প্রস্তুত হও।
লোক : কীভাবে মহারাজ?
জ্যে : উঁহুঃ আমি রাজা নই, মহারাজও নই। আমি কৃষ্ণদাস। তোমাকে একটা উপদেশ দিই। রোজ সকালে ডন-বৈঠক মার। পঞ্চাশটা ডন, একশোটা বৈঠক। তারপর…
লোক : [উদগ্রীব হয়ে] তারপর?
জ্যো : দাদা ঘুষি মারার আগেই দাদাকে ঝেড়ে দাও এক ঘুষি। শোন বাবা, পৃথিবীর নিয়ম আর ভগবানের নিয়ম দুটো আলাদা। দুটো আলাদা শাস্ত্র। ভুল কোর না। ভাগ্যটাই সব নয়। পুরুষকার বলে একটা কথা আছে। মারের বদলা মার, প্রেমের বদলা প্রেম। যাও, যাও, বাড়ি যাও, আমাদের এখন একটু অন্য আলোচনা হবে।
লোকটি : আমি একটু বসে শুনতে পারি?
বড় : শুনতে পারবে কিন্তু কোনও প্রশ্ন করতে পারবে না।
লোক : আমার একটাই প্রশ্ন, পাথর চাপা বরাত কী খোলা যায়?
জ্যো : এই তো, নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিয়ে দিয়েছ। পাথরটা সরাতে হবে। কেউ সরিয়ে দেবে না। তুমি নিজে সরাবে। পাথর মানে কী? ভারী একটা জিনিস। সরাতে শক্তি চাই। তাহলে একটু আগে বলেছি ডন-বৈঠক মার। আর ভিজে ছোলা খাও।
লোক : কোনও ধারণ-টারণ?
জ্যো : [একটু রাগ রাগ গলায়] হীরে পরতে পারবে? হীরে! ষাট হাজার টাকা দাম।
লোক : আজ্ঞে না।
জ্যো : তাহলে হয়ে গেল।
লোক : আপনি সকলকেই সব বিধান দিচ্ছেন, আর আমি গরিব বলে তাড়িয়ে দিচ্ছেন।
জ্যো : শোন, তোমার ওই ক্যাটক্যাটে কথা না ছাড়লে তোমার ভাগ্য ফিরবে না। আসলে তুমি একটা নির্বোধ।
বড় : তুমি যাবে?
লোক : না গেলে কী করবেন?
বড় : ওরে কুসি, এ যে ক্রমশ বাঁকছে।
জ্যো : আমি এক মিনিটে সোজা করে দিতে পারি।
বৃদ্ধ : আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি। লোকটিকে নিয়ে বাইরে চলে গেলেন।
বড় : কতরকমের উৎপাত আছে?
জ্যো : উৎপাত তো থাকবেই। শোন, উনুনে দুধ বসালেই ওতলাবে। জান তো ক্রোধ হচ্ছে ষড়রিপুর দ্বিতীয় রিপু। সারা পৃথিবীতে এই ক্রোধের খেলা। [হঠাৎ উঁচু গলায়] শক্তি, শক্তি। জাগো মা।
[ন’বউ চা নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল]
ন’বউ রেখা : এই যে চা, তলায় এক চামচে মধু, এই দেখুন রস ছাড়ছে।
জ্যো : [কাচের গেলাসটাকে আলোর দিকে তুলে] মনটাকে করতে হবে এইরকম স্বচ্ছ। এইরকম উষ্ণ। তবেই না সেই অমৃতস্বরূপিণী মধুক্ষরণ করবেন।
বড় : আমার কয়েকটা প্রশ্ন ছিল।
জ্যো : বল।
বড় : আমি এমন একটা শক্তি চাই, যাতে সমস্ত মানুষের ভিতরটা দেখা যায়। যেমন এন্ড্রোস্কোপি ছাড়াই আমি মানুষের স্টমাকটা দেখতে পাব। সিস্টোস্কোপি ছাড়াই ব্লাডারের মধ্যে ঢুকে যাব। অ্যাঞ্জিওগ্রাফি ছাড়াই হৃদয়ে প্রবেশ করব। স্ক্যানিং ছাড়াই ঢুকে যাব মানুষের খুলির তলায়।
জ্যো : এই চাহিদাটা তো জাগতিক চাহিদা। আধ্যাত্মিক কিছু চাও।
বড় : [ভালোমানুষের মতো] মানুষের দেহটা আধ্যাত্মিক নয়?
জ্যো : দূর পাগল! পঞ্চভূতের এই দেহ পঞ্চভূতেই মিশে যাবে। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ [বোমা ফাটার মতো] ব্যোম।
[ভিতরে বাসন পড়ে যাবার ভীষণ শব্দ]
কুসি : যাঃ, সব ভেঙে শেষ করে দিল।
গান্ধারী : মনে হয় সেই হুলোটা। জান বড়দা, তোমার মুজাহিদ আজ গোটা এক মাছ মুখে নিয়ে পাঁচিলে উঠে সাবড়েছে। তুমি যদি শিক্ষা দিতে না পার আমিই দেব।
জ্যো : আঃ, সাংসারিক কথাবার্তা কেন রে পাগলি? কার মাছ কে খায়! সবই ভাগ্য।
গান্ধারী : আজ্ঞে মুখ্যু মানুষ, এই যে একটু আগে বললেন ভাগ্য বলে কিছু নেই!
জ্যো : সেটা ওই নির্বোধকে বলেছি। জানিস, সমস্ত মানুষই ভাগ্যের চাকায় বাঁধা। রবি, চন্দ্র, বৃহস্পতি, শুক্র, মঙ্গল, বুধ, শনি, কেতু, রাহু। সবসময় জানবে আমরা গ্রহের দাস। তাহলে উপায়? [আঙুল তুলে সেজভাইকে দেখিয়ে] বল টেক্সটাইল মাস্টার উপায়। [জনে জনে সকলের দিকে আঙুল তুলে বারকতক উপায় উপায় করলেন। তারপর ঠক করে কাচের গেলাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে হা হা করে হাসতে লাগলেন।]
জ্যো : উপায় আছে রে, উপায় আছে। সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ। অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ। [আবার সকলের দিকে একে একে তাকিয়ে] মানে? [অল্প হেসে] কেউ জান না। কেউ জান না। একজন ডাক্তার, একজন ইঞ্জিনিয়ার, একজন আর্টিস্ট, একজন দার্শনিক। সেই দার্শনিকটি কোথায়?
[মেজোভাই ঠিক সেই মুহূর্তে প্রবেশ করলেন]
মেজো : এই যে আমি। অনেকদিন পরে এলেন।
জ্যো : অধ্যাপক, গীতার শেষ শ্লোকটা বল তো।
মেজো : আজ্ঞে, সেই সর্বধর্মাণ পরিত্যজ্য।
জ্যো : হ্যাঁ, ওর মানে কী?
মেজো : শ্রীভগবান বলছেন, তুমি সকল প্রকার ধর্ম ও অধর্ম পরিত্যাগ করে একমাত্র আমাকেই আশ্রয় কর।
জ্যো : ব্যস, ব্যস, ব্যস ওই জায়গাটাতেই ধর। আমাকেই আশ্রয় কর। এই আমিটা কে?
মেজো : এই আমিটা শ্রীভগবান।
জ্যো : হুঁ, হুঁ, হলো না। এটা সেই চিরাচরিত ব্যাখ্যা। এই আমি হলো তুমি নিজে। নিজেকে ধর। চেপে ধর। নিজেকে ধরলেই দেখতে পাবে পাপও নেই, পুণ্যও নেই। কর্মও নেই, অকর্মও নেই। প্রেমও নেই, ঘৃণাও নেই। আছে শুধু ইন্দ্রিয়। ছটি ফোকর দিয়ে জগৎ আর জীবনকে দেখছ বাবাজীবন। ছটা জানলায় ছ’রকমের কাচ। একটা লাল, সেটা কাম, একটা ক্রোধ, সেটা হলো কমলালেবুর রঙ, একটা লোভ, সেটা হলো পিত্তি রঙ, একটা মোহ, সেটা হলো ধোঁয়াটে রঙ। আর একটা মদ, সেটা হলো মদের রঙ। আর একটা মাৎসর্য। সেটা হচ্ছে কুচকুচে কালো। যে জানলায় চোখ রাখবে ঠিক সেই রঙের পৃথিবী দেখবে। তাহলে উপায়? এ দেহটাকে তো নাশ করা যায় না। যায়? যায় না। বড় প্রেমের জিনিস, বড় প্রিয় জিনিস। তাহলে উপায়?
মেজো : নিরুপায়।
জ্যো : ধুৎস। পণ্ডিত মানুষ হয়ে এই কথা, উপায় থাকবে না? সবকিছুর উপায় আছে। তাহলে শোন শ্রীভগবান কী বলছেন—ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ। মনসস্তু পরা বুদ্ধির্যোবুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ। মানেটা কী?
মেজ : সত্যি কথা বলব। গীতা আমি তেমন পড়িনি। সংস্কৃত আমার জিভে জড়িয়ে যায়।
জ্যো : শোন, ইন্দ্রিয় হলো শ্রেষ্ঠ। কোনও সন্দেহ নেই ইন্দ্রিয় শ্রেষ্ঠ। তুমিও জান, আমিও জানি, রামও জানে, শ্যামও জানে। সব মানুষই জানে। কারা জানে না? বল, জানে না পশুরা। তা ইন্দ্রিয় শ্রেষ্ঠ হলো তো কী হয়েছে। ইন্দ্রিয়ের ওপরে তো বসে আছে মন। আরে বেটা মনই তো ইন্দ্রিয়গুলোকে চালাচ্ছে। তুমি গাড়ি চালাচ্ছ, তোমার ফ্যাক্টরিতে তুমি মানুষ চালাচ্ছ, যন্ত্র চালাচ্ছ। সেই রকম ইন্দ্রিয়কে চালাচ্ছে মন। চালাক। চালাতে দাও। মনের মাথার ওপর তো বুদ্ধি বসে আছে। মনের চেয়ে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ। এইবার বুদ্ধি তুমি যাবে কোথায়? বুদ্ধির মাথার ওপরে বসে আছে আত্মা। শুধু আত্মা নয় বল পরমাত্মা। যেমন তোমাদের মাথার ওপর বসে আছেন তোমাদের বড়দা। সেই পরমাত্মার সঙ্গে বন্ধুত্ব কর। তাকে সন্তুষ্ট কর। [হঠাৎ সুর ঘুরিয়ে] একটু যেন ক্ষিদে ক্ষিদে পাচ্ছে।
কুসি : কী খাবেন বলুন?
জ্যো : এই দেখ বোকা মেয়ে। ক্ষিদে পেলেই খেতে হবে? এটা কী মামার বাড়ি? দেহগত আত্মা অর্থাৎ জীবাত্মা যেই হুকুম করবে এইটা আমার চাই, সঙ্গে সঙ্গে সেটা দিয়ে দিতে হবে। পাগল, পাগল কোথাকার। দোব না। [চিৎকার করে] কিছুতেই দেবো না। তুমি যা চাইবে ঠিক তার উলটোটা পাবে। তোমাকে উপোস করিয়ে মারব। বুঝলে কিছু। এটা টেকনোলজির যুগ। এটাই টেকনিক। নিজের কাছে সরে আসা। এক থাপ্পড়ে, এক থাপ্পড়ে [আরও জোরে] সব ঠান্ডা।
গান্ধারী : আপনি মাঝে মাঝে ওরকম আচমকা চেঁচিয়ে ওঠেন কেন?
জ্যো : এই মেয়েটা ধরেছে। চমকে দেব বলেই আচমকা চেঁচাই, তা না হলে ভিতরে ভিতরে যে সব ঘুমিয়ে পড়বে। ওঠ, জাগো। কাকে বললুম? নিজে কিন্তু উঠছি না। বসে আছি, বসে থাকব। তাহলে কাকে বললুম? ভেতরে যে আছে তাকে।
পরমা : আমার একটা প্রশ্ন ছিল।
জ্যো : প্রশ্ন করতে হবে কেন মা? আমি তো সব জানি। এই ঘরে যারা বসে তাদের সকলের মনের কথা আমি জানি। তুমি বলতে চাইছ তোমার কর্তার শরীরটা ঠিক যাচ্ছে না। রাতে ভালো ঘুম হয় না। ভোরের দিকে একটু ঘুমোয়। তাও পাতলা ঘুম, স্বপ্নে ভরা। কেন হবে না? এ যে যুগের ধর্ম। আকাঙ্ক্ষা। আমি একটা গান গাইব।
কুসি : গান না, গান না, হারমোনিয়াম আনব?
জ্যো : কোনও দরকার নেই। সব বাদ্যযন্ত্র আমার গলায়, গানটা মন দিয়ে শোন, উত্তর পেয়ে যাবে। অকারণ মন আশা/কোর না কোর না/যতই করিবি আশা/মিটিবে না সে পিপাসা/অপার সে আশা নদী/তাও কি মন জান না/ভিখারি বাসনা করি/হইতে চায় লক্ষপতি/লক্ষপতি হলেও সে হইতে চায় কোটিপতি/ইন্দ্রত্ব লভিলেও সে শিবত্ব করে কামনা। [গান শেষ, দমকা কাশি]।
সবাই সমস্বরে : কী হলো কী হলো?
জ্যো : [কাশির ফাঁকে কোনওরকমে বললেন] ম-ম-মশা ঢুকে গেছে।
বড় : [দুঃখের গলায়] তোরা কিছু স্প্রে করিসনি? তোদের নিয়ে আমি আর পারব না। শীগগির একটু জল নিয়ে আয়।
জ্যো : [কোনওরকমে] গিলব না, গিলব না, ম্যা, ম্যা।
বড় : [সঙ্গে সঙ্গে] ম্যালেরিয়া হবে না, ম্যালেরিয়া হবে না। এখানে একটা মশাও ম্যালেরিয়ার নেই। সব মেল মসকুইটো। আপনি ক্যাপসুলের মতো ঢোঁক করে গিলে ফেলুন।
জ্যো : [মুখব্যাদান করে বারতিনেক হাঃ হাঃ হাঃ করলেন।]
মেজো : এটা মনে হয় জীবাত্মার কাজ। পরামাত্মার গলায় মশা ঢুকতে পারে না।
জ্যো : এই ধরেছ ঠিক। ওই যে তিনবার হাঁ করলাম, ওইটাই পরমাত্মা। এই যে একটু আগে বলছিঢ় না নাভিশ্বাস। সেই নাভির শ্বাস দিয়ে মশাটাকে অনন্তে উড়িয়ে দিলুম।
[কোথায় ঢ্যাং করে একটা শব্দ হলো]
জ্যো : শব্দটা শুনলে? কোথায় হলো?
বড় : আজ্ঞে কাছাকাছি কোথায়।
জ্যো : আরে না, শব্দটা আমি করলুম। একেই বলে অনন্তের সমাপ্তি ঘণ্টা। [কুসির দিকে তাকিয়ে] ও মেয়ে, জীবাত্মা যে এবার ফুলকো লুচি খেতে চাইছে। গাওয়া ঘিয়ের সুগন্ধ। জীবাত্মাই ওটা পরমাত্মার দিকে ঠেলে দেবে।
গান্ধারী : [বোকার মতো] আপনার ঘোড়াটা কী খাবে?
জ্যো : [মুচকি হেসে] ফচকে মেয়ে।
চার
দাবার ছক, এপাশে ঝুঁকে আছে বড়, ওপাশে ঝুঁকে আছে মেজো।
মেজো : বড়দা, কিছু একটা কেরামতি করেছ মনে হচ্ছে? তোমার এই বোড়েটা তো এখানে ছিল না। এটা কোথা থেকে এল?
বড় : কোথা থেকে আসবে? ওটা ওখানেই ছিল।
মেজো : না, না, হতেই পারে না। আমি অনেকক্ষণ ধরে তাক করে আছি। ওই রুট দিয়ে ঢুকে তোমার রানীকে কব্জা করব। এটা তোমার জোচ্চুরি। তুমি কোন ফাঁকে ওটাকে তুলে এনে বসিয়েছ।
বড় : মিথ্যে কথা বলবি না মেজ। জীবন আর খেলা—দুটোতেই সত্যকে ধরে থাকবি।
মেজো : শোন বড়দা, এই দাবার ব্যাপারে তোমার একটা ব্যাড রেপুটেশন আছে। তোমার সঙ্গে যে খেলতে বসে সেই হারে। তুমি যদি দাবায় এত বড় চ্যাম্পিয়ান হবে তাহলে কারপভকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছ না কেন? তোমার যত কেরামতি বাড়িতে। আর সে কেরামতিটা হলো জোচ্চুরি। কুসি আমায় আগেই সাবধান করেছিল—’মেজদা চোখ বুজিয়ে থেক না, চোখ খোলা রেখ।’ আমি ওই উপদেশটাকেই একটু অ্যাডজাস্ট করে নিয়েছিলাম। চোখ বুজিয়ে মিট মিট করে দেখছিলাম তুমি কী কর। তুমি এদিক ওদিক তাকিয়ে টুক করে ওঠা ঠেলে দিলে।
বড় : তুমি স্বপ্ন দেখেছিলে মানিক। ওই ঘুঁটিটা প্রথম থেকেই ওখানে আছে।
মেজো : না, ওটা ছিল না।
বড় : দাদাকে জোচ্চর বলতে তোর লজ্জা করছে না? তোর অন্তরে লাগছে না?
মেজো : জোচ্চরকে, জোচ্চর বলব, অন্তরে লাগবে কেন?
বড় : তার মানে আমি একটা চিট!
মেজো : আমি ইংরেজি বলিনি। জোচ্চোর আর চিট দুটো আলাদা ব্যাপার। আকাশ-পাতাল তফাৎ। চিট অনেক বড় ব্যাপার। সে তোমার দ্বারা হওয়া সম্ভব হবে না। তুমি ছিঁচকে চোর হতে পারবে, ডাকাত কোনও দিনই নয়।
বড় : ছিঁচকে চোর কথাটা ভালো হলো? ছিঁচকে চোর, সিঁধের চোর, ঘৃণ্য জীব। বরং ডাকাত অনেক রেসপেকটেবল।
মেজো : ঘুঁটিটা ওখান থেকে সরাও।
বড় : কেন সরাব?
মেজো : ওটা ওখানে ছিল না।
বড় : ওটা ওখানেই ছিল।
মেজো : না, ছিল না।
বড় : হ্যাঁ, ছিল।
মেজো : না, ছিল না।
বড় : কুসি, কুসি,
[খুন্তি হাতে কুসির প্রবেশ]
কুসি : তোমাদের জ্বালায় বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে। তোমরা বিয়ে কর বাপু, বেঁচে যাই।
বড় : সে পরে দেখা যাবে। আগে তুই বল আমাকে তুই চোর বলেছিস। ছিঁচকে চোর। আমি নাকি ফ্রিজ খুলে চুরি করে মিষ্টি খাই। ছেলেবেলায় আমার জন্য মা আচারের বয়াম সিন্দুকে চাবি দিয়ে রাখত? শেষ জীবনে আমি ডাকাতি করব? আমি ব্যাগ দেখলেই খুলে টাকা সরাই, সেজ বউয়ের কানের দুল বিক্রি করে আমি বাদাম ভাজ খেয়েছি।
মেজো : দাঁড়াও, দাঁড়াও, তুমি এসব কী বলছ?
বড় : আরে দাঁড়া, দাঁড়া। কুসির নাম করে তুই যা বলেছিস, তারপর এইগুলোই আসে। একটা রোগের পিছনে পিছনে দশটা রোগ জোটে।
কুসি : কী হয়েছে বলবে তো?
মেজো : আরে সেই ওল্ড কেস। খেলতে খেলতে অন্যমনস্ক হয়েছি অমনি ঘুঁটি সরিয়েছ।
কুসি : বড়দা, এই রোগটা তোমার আছে। তুমি যখনই আমার সঙ্গে লুডো খেলতে বসেছ তখনই আমি গোহারান হেরেছি। তুমি পাঁচ ফেলে ছয়ের চাল দাও। আঙুলের কায়দায় ছক্কা ফেলো। এ তোমার অনেক দিনের ব্যামো। তোমার ভেতর স্পোর্টসম্যান স্পিরিট নেই। তুমি হারতে ভয় পাও, খালি হারাতে চাও।
বড় : তার মানে আমি ক্যারেকটারলেস। আমি একটা বদ লোক। তাহলে কাল থেকে তোরা আমাকে দাদা বলিস না।
মেজো : তুমি আচ্ছা ক্রুকেড লোক তো।
বড় : ক্রুকেড মানে?
মেজো : বাঁকা লোক।
বড় : আর তুমি ভারি সোজা লোক।
[কুসি খেপে গিয়ে দাবার ছকটক সব উলটে দিল]
কুসি : তোমরা যদি আর কোনও দিন দাবা খেলতে বসেছ তাহলে এই খুন্তি গরম করে ছ্যাঁকা দেব।
বড় : তা তুমি দিতে পার। বড় ভাইকে যখন চোর বলতে পার, তখন ছ্যাঁকাও দিতে পার।
কুসি : তোমার এখন এক কাপ চা খাওয়া দরকার।
বড় : থাক, থাক, অত খাতিরে প্রয়োজন নেই। পয়সা ফেলব, মোড়ের দোকান থেকে খাব।
কুসি : তোমার অনেক পয়সা আছে। সে আমরা জানি। তবে আমার হাতের চায়ের মতো চা কোথাও পাবে না।
বড় : কোন হাত? যে হাত খুন্তি ছ্যাঁকা দেয়। আমি জানি যেদিন আমার মা মারা গেছেন সেদিন থেকে আমার আদরও চলে গেছে। আর এই মেজো জ্ঞানের অহংকারে একবারে ফেটে পড়ছে। অধ্যপক, অধ্যাপক!
মেজো : বড়দা তুমি তিলকে তাল করছ।
বড় : আজ্ঞে না। আমি তালকে তিল করছি। তোমরা যা বলেছ, অন্য কেউ হলে গৃহত্যাগ করত।
মেজো : শোন বড়দা, এই গৃহত্যাগের কথা যখন বললে তখন আমার স্ট্যাটিসটিক্সের কথা শোন। আমি জনে জনে জিজ্ঞাসা করে দেখেছি গৃহত্যাগ করে কে কতদূর যেতে পেরেছে। ওই গেট পর্যন্ত, কিংবা গেটের বাইরে রাস্তা পর্যন্ত। একজনই একটু বেশিদূর পর্যন্ত গিয়েছিল, ওই মোড়ের মাথার ল্যাম্পপোস্ট পর্যন্ত। রাত এগারোটার সময় পান-বিড়ির দোকান বন্ধ করতে করতে দোকানদার বলল, আমি তো চললাম, আপনি কী করবেন? সে তখন কাঁদো কাঁদো হয়ে বললে, ভাই বাড়িতে একটু বলে পাঠাও না আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি, একবার ডাকলেই যেতে পারি। অতএব গৃহত্যাগ করার আগে ভেবে নাও কোথায় যাবে, কার কাছে।
বড় : আমার যাবার অনেক জায়গা আছে।
কুসি : ঠিক আছে জায়গাগুলো বল।
বড় : যেমন ধর, যেমন ধর, যেমন ধর [হতাশ হয়ে] যাবার কোথাও জায়গা নেই রে। এক কাপ চাই খাওয়া।
মেজো : পথে এসো। শোন বড়দা, আমরা যে গোয়ালে আছি সেই গোয়ালেই মিলেমিশে থাকতে হবে। তুমি হলে বড় ষাঁড়, আমি হলুম মেজো ষাঁড়, ভাইগুলো সব ষণ্ড, আর…
কুসি : আর এগিও না মেজদা।
[দরজার কাছে গলা] আসতে পারি?
কুসি : আরে প্রমোদ জ্যাঠা!
প্রমোদবাবু : [ঢুকতে ঢুকতে] অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা নিয়ে আমি তোমাদের কাছে এলাম। দেখ এ পাড়ায় আমার নাম মিঃ অ্যাংজাইটি। কিন্তু তোমরাই বল, দুশ্চিন্তা না করে থাকা যায়! এটা কী একটা দিনকাল! কোনও ভদ্রলাক এভাবে বাঁচতে পারে! [সুর করে] বসতে পারি?
বড় : হ্যাঁ, হ্যাঁ, বসুন, বসুন। আপনার জন্ডিস হয়েছিল, কেমন আছেন?
প্রমোদ : অ্যাই, ভালো কথা জিজ্ঞাসা করেছ। জন্ডিসে কী হয় তুমি জান?
কুসি : আপনি চা খাবেন?
প্রমোদ : অবশ্যই।
বড় : তার মানে লিভার ভালো যাচ্ছে।
প্রমোদ : ডাক্তার হয়ে এ কথাটা কী করে বললে? চায়ের সঙ্গে লিভারের কী সম্পর্ক? [কুসি এই ফাঁকে বেরিয়ে গেছে] চায়ের সঙ্গে লিভারের কি সম্পর্ক? গলায় চা ঢালবে সড়াক করে স্টমাকে পৌঁছে যাবে। সেখানে থেকে জলীয় পদার্থ তার পথ বেয়ে বেরিয়ে যাবে টয়লেটে। আর চায়ের কষটা লেগে যাবে পাকস্থলির ভিতরের দেওয়ালে। তাহলে কী হলো? চায়ের সঙ্গে আলসারের সম্পর্ক। লিভারের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। তবে হ্যাঁ, জন্ডিসের সঙ্গে লিভারের সম্পর্ক আছে।
বড় : জল ফুটিয়ে খাচ্ছেন?
প্রমোদ : জল ফুটিয়ে! আমার জন্য এত তদারকি কে করবে? তোমাদের জীবনের দাম আছে। আমার জীবনের কী দাম?
মেজো : আপনি এক সময় কত ভালো বেহালা বাজাতেন?
প্রমোদ : একালে বেহালা বাজালে লোকে মারতে আসবে। বেহালা নাকি শুধু কাঁদতে জানে। কথাটা খুব মিথ্যে নয়। যাত্রা, থিয়েটার, সিনেমায় শুধু কান্নার সিন হলেই বেহালা বেজে ওঠে।
মেজো : বেহালায় আপনি ক্লাসিক্যাল সুর-টুর বাজাতে পারেন। সময়টা ভালো কাটবে। বিদেশি কনসার্টে একসঙ্গে পঞ্চাশটা বেহালা বাজে।
প্রমোদ : বিদেশের সঙ্গে কেন তুলনা করছ? তোমরা শুনেছ?
বড় : কী হলো আবার?
প্রমোদ : কিডন্যাপিং। এপাড়ায় ঢুকে পড়েছে। সকাল থেকে সুজনের মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বৌমাদের ডাক।
[ডাকাডাকি। পরমা ও রেখা দুজনেই ঘরে ঢুকল]
দুজনে একসঙ্গে : জ্যাঠামশাই।
প্রমোদ : তোমাদের সাবধান করতে এলুম। বাচ্চা দুটোকে সাবধানে রেখ, চোখে চোখে। সুজনের বাচ্চা মেয়েটাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে। এইবার চিঠি আসবে দশ লাখ টাকা ছাড়।
রেখা : থানায় ডায়েরি করেছে?
প্রমোদ : আর ডায়েরি! পুলিশ কী করবে? সে কী আর এদেশে আছে?
পরমা : কত পুলিশ, একটা থানায় গিজগিজ করছে পুলিশ, পুলিশ নেই?
প্রমোদ : আমি পুলিশের কথা বলিনি। আমি মেয়েটার কথা বলছি। সে এতক্ষণে পাঞ্জাব কী হরিয়ানায় পাচার হয়ে গেছে। দুবাইতেও চলে যেতে পারে।
রেখা : এইটুকু সময়ের মধ্যে দুবাই চলে যাবে?
প্রমোদ : মডার্ন টেকনোলজির যুগে মানুষের স্পিড কী বেড়েছে। হু হু শব্দে সব ছুটছে। ও হ্যাঁ, স্পিডের কথায় মনে পড়ল। ডাক্তার তুমি কী রোজ ওই স্পিডে গাড়ি চালাও?
বড় : কোন স্পিডে?
প্রমোদ : ওই যে আজ হুস করে চলে গেলে আমার পাশ দিয়ে। তুমি জান কীরকম দুর্ঘটনা হচ্ছে। কালকে আমার চোখের সামনে একটা গাড়ি একটা অটোকে মারল। অটোটা ছিটকে রাস্তার ধারে গিয়ে চায়ের দোকানে বসে তিনজন খবরের কাগজ পড়ছিল তাদের ঘাড়ে। ব্যস ছটা খতম।
বড় : ছজন কোথা থেকে এল?
প্রমোদ : আরে তিনজন তো অটোর ভিতরে ছিল।
মেজো : ছজনেই মারা গেল?
প্রমোদ : সঙ্গে সঙ্গে কী গেল! যখন মেরেছে তখন ছটাই যাবে। জীবনের কোনও দাম নেই, কোনও দাম নেই। চারপাশে ফুটকড়াই-এর মতো লোক। পিলপিল করছে গাড়ি। যাবে কোথায়? এইভাবেই পপুলেশন কন্ট্রোল হচ্ছে।
[গান্ধারী চা নিয়ে ঢুকল]
গান্ধারী : এই নিন, গরম গরম দার্জিলিং চা।
প্রমোদ : এই শোন, তুমি আজ সেফটিপিন দিয়ে দাঁত খুঁটছিলে?
গান্ধারী : কখন?
প্রমোদ : যদি না খুঁটে থাক ভালো। আর যদি ওই অভ্যাস থাকে তাহলে ছাড়। আজ আমাদের পাশের বাড়ির কার্তিকের মা হাসপাতালে গেল। দাঁতের গোড়ায় সেফটিপিন দিয়ে খোঁচা মেরেছিল। সেপটিক।
গান্ধারী : তাই বলুন, আমি তো ভয় পেয়ে গেছি।
প্রমোদ : [মেজোকে] শোন শোন, চা সব সময় ঠান্ডা করে খাবে। অত গরম চা খেলে পেটের লাইনিং নষ্ট হয়ে যায়।
বড় : তা আপনার শরীর এখন কেমন আছে?
প্রমোদ : আর শরীর! ক্যানসার কেমন হচ্ছে দেখেছ ডাক্তার? ঘরে ঘরে ক্যানসার। জান, আমার খুব অম্বল হয়। আজকাল শুনছি ডাক্তাররা অম্বলের কারণ খুঁজে পায় না। খালি অ্যান্টাসিড খাওয়ায়। একবারও ভাবে না ওটা ক্যানসার হতে পারে। এই যে আমার থেকে থেকে কাশি হয়, এই কাশিটা কী সেই কাশি?
মেজো : কোন কাশি? বারাণসী?
প্রমোদ : খুব অফেনডেড হলুম। আমি একজন বয়স্ক লোক। তোমাদের কাছে আসি পাঁচটা কথা বলতে। তুমি ঠাট্টা করছ?
বড় : না, না, আমিও তো বুঝতে পারলাম না, কাশি তো কাশিই হবে।
প্রমোদ : শোন, আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, সব কাশি কাশি নয়। কিছু কাশি হলো লাঙ ক্যানসার। তোমরা কী বলতে পার, তোমাদের কারুর ক্যানসার হয়নি বা হবে না?
বড় : তা কী করে বলব? হতেই পারে।
প্রমোদ : তাহলে ক্যানসার নিয়ে ঠাট্টা করছ কেন?
বড় : কই ঠাট্টা করিনি তো।
প্রমোদ : ঠাট্টা না করলেই ভালো, ও হ্যাঁ, ভুলে যাবার আগে জিজ্ঞাসা করে নি, আমার চোখের দৃষ্টি ক্রমশই কমছে। একটা ব্রেন স্ক্যান করানো কি দরকার?
বড় : স্ক্যান, স্ক্যান করাতে যাবেন কেন?
প্রমোদ : আরে শোন, আমার জ্যাঠতুতো ভাইয়ের বউয়ের এইরকম পাওয়ার ঘন ঘন চেঞ্জ হচ্ছে। শেষে ধরা পড়ল ব্লেন টিউমার। টিউমারটি তখন বিশাল হয়ে গেছে। এখন ডাক্তাররা বলছেন কিস্যু করার নেই।
বড় : আপনার দৃষ্টিশক্তি কমছে বয়সের জন্য। একে বলে চালসে।
প্রমোদ : কী কথাই বললে, আমাদের ফ্যামিলিতে কারুর কখনওই চালসে হয়নি। আমার বাবা আশি বছর বয়সে খালি চোখে পাখি ছুঁচে সুতো পরাতেন।
বড় : তাহলে স্ক্যান করান। খরচটা কত জানেন তো?
প্রমোদ : সে করাতেই হবে। আমার বাবা একটা কথা বলতেন, এ স্টিচ ইন টাইম সেভস নাইন। বাঃ চাটা বেশ ভালো হয়েছে তো। কত টাকার?
বড় : কে জানে, কুসি আনায়।
প্রমোদ : [একটু বাঁকা হেসে] তোমরা সংসারের কিছুই দেখ না, ওই মেয়েটার ঘাড়ে ফেলে রেখেছ। আছে অনেক তাই বুঝতে পারছ না। যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি। পরের লাইন?
মেজো : ও কুসি জানে।
প্রমোদ : সবই তোমাদের কুসি। মেয়েটার বিয়ে দিচ্ছ না কেন?
মেজো : ও বিয়ে করবে না।
প্রমোদ : আমার মাসিমাও বিয়ে করেননি। শেষকালটায় মাথার গোলমাল হয়ে গেল। প্রকৃতির বিরুদ্ধে গেলেই সপাটে ঝাপটা মারবে। মারবেই মারবে। [সুর করে] এই যে এত ইউটেরাসে ক্যানসার হচ্ছে, কেন হচ্ছে? একটা রিপোর্টে পড়েছিলুম…
বড় : অসুখের কথা থাক না জ্যাঠামশাই। ওতে মন দুর্বল হয়ে যায়।
প্রমোদ : বাজে কথা, পুরনো কথা, জেনে রাখ প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর। আচ্ছা, তোমরা কী জুতো পর?
বড় : জুতোয় চলে গেলেন?
প্রমোদ : কেন গেলুম জানো। মুখ খোলা জুতো হলে ভয় নেই। শু হলেই বিপদ।
মেজো : বিপদ কেন? কড়া পড়বে পায়ে?
প্রমোদ : কড়াতে মানুষ মরে না। কাঁকড়াবিছের কামড়ে মানুষ মরে যেতেও পারে।
বড় : জুতোর সঙ্গে কাঁকড়া বিছের কী সম্পর্ক?
প্রমোদ : আছে, আছে। কিছুই জান না, জন্মে বসে আছ। ওই মুখবন্ধ জুতোর মধ্যে কাঁকড়াবিছে ঘাপটি মেরে থাকে। সেদিন সন্তোষকে অ্যায়সা মেরেছে। তিনদিন যমে-মানুষে টানাটানি। বাচ্চাদের কেডস, তোমাদের শু সবসময় ঠুকে পড়বে।
মেজো : কাঁকড়াবিছে কোথা থেকে আসবে?
প্রমোদ : যখন আসবে তখন বুঝবে কোথা থেকে আসে।
বড় : কিছু আশার কথা বলুন না।
প্রমোদ : আশার কথা থাকলে কী বলতাম না! এটা হচ্ছে নিরাশার যুগ। এই যে তোমাদের বাড়ির ইলেকট্রিক্যাল ওয়্যারিং কত বছর আগে চেক করিয়েছ?
বড় : তা পাঁচ বছর হবে।
প্রমোদ : অদ্ভুত! তোমরা এক একটি ভূত। নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছ। প্রত্যেক ছয় মাস অন্তর চেক করানো উচিত। আমাদের ওয়েদার তো ভালো নয়। ধর তোমরা সবাই ঘুমোচ্ছ, মাঝরাতে শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন ধরে গেল। ভোরবেলা সব ছাই।
মেজো : তা কেন হবে?
প্রমোদ : শিক্ষিত লোকের মুখে কী অশিক্ষিত কথা! সামান্য শর্ট সার্কিটে কতবড় থিয়েটারটা পুড়ে গেল। বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
বড় : কোন থিয়েটার?
প্রমোদ : আরে স্টার। স্টার-এর কথা বলছি।
বড় : জ্যাঠামশাই, রাত হলো দিনকাল ভালো নয়, এইবার আপনি বাড়ি যান।
প্রমোদ : বাড়ি! এত তাড়াতাড়ি আমি বাড়ি ফিরি না। যাক তোমাদের এখানে এককাপ চা খেলুম। এইবার একবার পঞ্চাননের কাছে যাই। খবর পেলুম ওদের বাড়িতে আজ মালপো হয়েছে।
মেজো : আপনি এখানে খেয়ে যান না?
প্রমোদ : পাগল হয়েছ? আমি কী ভখিরি যে চেয়ে চেয়ে খাব। তোমরা যদি আগে বলতে, তাহলে ভেবে দেখা যেত। আচ্ছা আসি বাবা। তোমরা ভালো থেক, সাবধানে থেক, আর ছোটদের নাগালের মধ্যে দেশলাই রেখ না। ও যে কী মারাত্মক জিনিস! বাথরুমে গিজার আছে নাকি?
বড় : [অপরাধীর গলায়] আজ্ঞে আছে।
প্রমোদ : হয়ে গেল। ও একদিন মারবেই। একমাত্র উপায় বাথরুমে একটা কাঠের পিঁড়ি রেখ। ওই কাঠের পিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে যা করার কোরো।
[প্রমোদবাবু বেরিয়ে গেলেন। বড় মেজোকে জিজ্ঞাসা করলেন]
বড় : কী বুঝলি?
মেজো : সব কথাই শোনার মতো। মানুষকে মারার মেশিন ফিট হয়েই আছে। বেঁচে থাকাটাই আশ্চর্যের।
[গান্ধারী ঝাঁ ঝাঁ করে ঢুকল]
গান্ধারী : তোমার মুজাহিদ, আদরের মুজাহিদ।
বড় : কী করেছে?
গান্ধারী : তোমার পাখির খাঁচার মাথার ওপর উঠে বসে আছে।
বড় : সেকী রে! নামা নামা।
গান্ধারী : সে আমি নামিয়ে দিয়েছি। এই নিয়ে তিনবার হলো। পাখিগুলো ভয়ে চিৎকার করছে। একই বাড়িতে বেড়াল, কুকুর, পাখি, খরগোশ এমন দেখিনি বাপু। প্রত্যেকটাই প্রত্যেকের শত্রু।
বড় : কেন জঙ্গলে? একই জঙ্গলে বাঘ, ভাল্লুক, সিংহ, হরিণ থাকে না?
গান্ধারী : মরেও তেমনি।
বড় : তা মরুক।
গান্ধারী : বেশ তাহলে মরুক। কিন্তু মরার পর মেজাজ খারাপ করো না। সেদিন একটা পাখি মরেছিল, আমরাও মরতে বাকি ছিলাম।
বড় : সব ব্যাপারটাই নির্ভর করে ট্রেনিং-এর ওপর। তোর বড় মুখ হয়েছে গান্ধারী।
গান্ধারী : সত্যি কথা বললেই মুখ হয়ে গেল।
[গান্ধারী বেরিয়ে গেল]
মেজো : আর একদান বসবে নাকি?
বড় : জোচ্চর বলবি না?
মেজো : জোচ্চুরি না করলে, বলবো না।
বড় : তাহলে লাগা।
[দাবার ছক পড়ল এমন সময় টেলিফোন। বড় উঠে গিয়ে ফোনে]
বড় : হ্যালো।
বড় : ডঃ মিত্র বলছি।
বড় : হ্যাঁ, কী হয়েছে?
বড় : বার্নকেস!
বড় : কে?
বড় : আপনার স্ত্রী?
বড় : ভেরি স্যাড।
বড় : ভেরি স্যাড।
বড় : এ তো ভাই আমি কিছু করতে পারবো না। সোজা হাসপাতালে নিয়ে যান। এ তো পুলিশ কেস হবে।
বড় : মানবিকতা।
বড় : না মশাই, ও কথায় আর ভুলছি না। এখন দিনকাল বড় খারাপ। সোজা হাসপাতালে কিংবা নার্সিংহোমে নিয়ে যান।
[বড় ফোন নামালেন]
মেজো : কী হলো?
বড় : আগুন।
মেজো : কোথায়?
বড় : ওই যে প্রোমটার হয়েছে। বিষ্ণুবাবু। ওর বৌ। বলছে রান্না করতে গিয়ে…কেউ কি তা বিশ্বাস করবে? একালে মেয়েদের কিছু হলে রক্ষে নেই। হাজতবাস। তার আগে গণধোলাই, বাড়ি ভাঙচুর। আমরা বিয়ে না করে বেশ আছি বল। শুধু তোর সঙ্গে আমার যদি একটু মনের মিল হতো?
মেজো : এটা সিরিয়াসলি বললে?
বড় : ধ্যুর। আমাদের ভালোবাসা, অবিচ্ছিন্ন বন্ধন। একটা কথা তোকে বলি, তখন আমি ঘুঁটিটা সরিয়েছিলুম রে।
মেজো : এই স্বীকারোক্তিতে তোমার পাপ কেটে গেল। না বলিয়া পরের দ্রব্য গ্রহণকে বলে চুরি। বলিয়া গ্রহণ করাকে বলে ছিনতাই।
বড় : ছিনতাই বললি কেন?
মেজো : [একগাল হেসে] দুষ্টুমি।
বড় : [একটু চিন্তিত ভাবে] একবার যাই কী বল?
মেজো : কোথায়?
বড় : বিষ্ণুবাবুদের বাড়িতে। ওর বউটা আমাকে খুব ভালোবাসত রে, দাদা দাদা করত, ভারি সুন্দর মেয়ে।
মেজো : আমিও যাই চল। তোমাকে একা ছাড়তে ভয় করছে। ওদের বাড়ির সামনে এতক্ষণ শ’দুই জমে গেছে।
বড় : থানার ওসিকে একবার ফোন করব?
মেজো : এতক্ষণে ওরাই ফোন করেছে?
বড় : দাঁড়া, জুতোটা গলাই।
মেজো : আমার তো চটি।
[বড় জুতো পরে উঠে দাঁড়িয়েছে, দাঁড়িয়েই চিৎকার]
বড় : ওরে ডান পাটির ভেতর কী এটা খড়খড় করছে। কাঁকড়াবিছে। বাঁচাও বাঁচাও। এ প্রমোদবাবু ছেড়ে দিয়ে গেছেন।
[বড় ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন]
মেজো : আর তুমি জুতোটা খুলে ফেল না।
বড় : [দাঁতে দাঁত চেপে] দেখছিস না কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, নড়লেই কামড়ে দেবে।
মেজো : কুসি, কুসি।
[মেজর চিৎকারে সবাই ঘরে। বাচ্চা দুটোও এসেছে]
কুসি : এবারে কী?
মেজো : দাদার জুতোয় কাঁকড়াবিছে।
কুসি : তুমি সোফায় বোস, দেখি কেমন কাঁকড়াবিছে।
[সবাই হাঁ করে যেন সিনেমা দেখছে। কুসি টান মেরে জুতো দু’পাটি খুলে ফেলল।
জুতো ঠুকতেই ডান পাটি থেকে বেরিয়ে এল মেয়েদের মাথার চুলের একটা কাঁটা]
কুসি : [ওটাকে তুলে ধরে] এটা কোন বউয়ের মাথা থেকে খসেছে? সেজোকি তোর, না নকার!
উপসংহার
বড় মজার এই মিত্তির বাড়ি।
চন্দন রঙের তিনতলা এই বাড়িটির নাম হওয়া উচিত ছিল ‘আনন্দ নিকেতন’। তিন পুরুষের বসবাস। সমৃদ্ধি এতটুকু কমেনি, বরং বেড়েই চলেছে। সূর্যোদয়ে সদর দরজা খুলে যায়। তারপর অবারিত দ্বার। তোমরা এস, তোমাদের সুখ, দুঃখ, সমস্যা নিয়ে। শ্রোতা পাবে, সহানুভূতি পাবে, সমাধান পাবে।
রাত আড়াইটের আগে আলো নেবে না। কারো খেয়াল চাপলে রাত বারোটার সময় নতুন ফর্মুলায় রান্না চাপতে পারে। এইবাড়িতে যত রাত বাড়ে ততই যেন উৎসব বাড়ে। ছোটোখাটো কোনও পারিবারিক সমস্যা নেই বললেই চলে।
সব কটা মানুষের মুখের দিকে তাকালেই পড়ে ফেলা যায় মনের কথা। অদ্ভুত, অলৌকিক এক আনন্দের রাজ্যে সবাই আছে। কোনও মনে কোনও সঙ্কীর্ণতা নেই। ভাঙা সংসারের ঘা-খাওয়া অনেকেই এই বাড়িতে সাময়িক আশ্রয় খুঁজে পায়। পরে প্রশ্ন নিয়ে ফিরে যায়, সব সংসারই কেন এমন সুখের সংসার হয় না!
আজ বাড়ির সামনে আকাশি রঙের একটা ট্যুরিস্ট বাস দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে একটা ব্যানার লাগানো। গেরুয়া রঙের জমির ওপর বড় বড় করে লেখা মিত্তির স্পেশ্যাল। মালপত্তর সব উঠছে। গান্ধারী অতি সাবধানে একটা প্যাকিং বাক্স তুলছে। বড়ভাই জিগ্যেস করলেন, ‘কি রে ওটা?’
গান্ধারী উদ্ভাসিত মুখে বললে, ‘সাত রকম।’
‘কি সাত রকম?’
‘আচার গো আচার।’
বড়ভাই উচ্ছ্বসিত, ‘ইও আর গ্রেট, গান্ধারী সেই মহাভারতের আমল থেকে তুই গ্রেট। সাবধানে, একেবারে সামনে রাখ। ঝাঁকুনিতে সর্বনাশ না হয়ে যায়।’
‘হবে নি গো। সব প্যালেটিকে প্যাক করা!’
মেজোভাই ড্রেসট্রেস করে বড়র পাশে দাঁড়িয়েছেন এসে। বড় জিগ্যেস করলেন, ‘হ্যাঁরে, গ্রেটের বড় কি, আরও আরও গ্রেট!’
‘গ্রেটেস্ট।’
‘আ, আওয়ার গান্ধারী ইজ গ্রেটেস্ট।’
‘ভুল হলো।’
‘কেন, ভুল হলো কেন? গ্রেট, গ্রেটার, গ্রেটেস্ট।’
‘একা তো আর গ্রেটেস্ট হওয়া যায় না, অনেকের মধ্যে গ্রেটেস্ট। গ্রামারে পড়নি, সুপার রিলেটিভ ডিগ্রি! অনেকের মধ্যে যে গ্রেট, সেই গ্রেটেস্ট।’
‘ঠিক আছে। পৃথিবীতে যত গান্ধারী আছে, তাদের মধ্যে এই গান্ধারীটা গ্রেটেস্ট।’
পাড়া-প্রতিবেশীরা সব পথে নেমে এসেছেন। হন্তদন্ত হয়ে প্রমোদবাবু ঘটনাস্থলে প্রবেশ করলেন, এই বলতে বলতে, ‘কি ভাবে ছুটতে ছুটতে এলুম উলটো পাঞ্জাবি পরে! ভেতরের পকেটটা বাইরে। তখন থেকে ভাবছি, পকেট কি করে ছোট হয়ে যায়! এ তো সিগারেট নয়!’
তারপর দম নিয়ে বড়কে জিগ্যেস করলেন, ‘যাচ্ছ কোথায়, হোল ফ্যামিলি?’
‘আমরা সব কটা মিত্তির সদলে পুরী চলেছি। জগন্নাথদেবকে দর্শন করব। সমুদ্রের ঢেউ ভাঙব। কোনারকে পিকনিক করব, সাক্ষীগোপাল দেখব, ভুবনেশ্বরে উদয়গিরি, খণ্ডগিরি।’
প্রমোদবাবু চোখ বড় বড় করে শুনলেন, তারপর অভাবনীয় এক হুঙ্কার, ‘না, যাবে না, সব কটা মিত্তির একসঙ্গে যাবে না।’
‘কেন?’
‘এই গাড়ির সঙ্গে আর একটা গাড়ির যদি হেড-অন কলিসান হয়! ওভারটেক করতে গিয়ে স্কিড করে যদি টার্ন টার্টল হয়, সব মিত্তির একসঙ্গে খতম!’
বড় বললেন, ‘এ সব হবে কেন?’
প্রমোদবাবু বললেন, ‘হবে না কেন?’
‘হবে না এই কারণে যে আমরা আপনাকেও ধরে নিয়ে যাব।’
‘আমার পাঞ্জাবি যে উলটে আছে!’
‘এক্ষুনি সোজা করে দোবো।’
‘আমার মাল-পত্তর ব্যাগ-ব্যাগেজ!’
‘দরকার নেই। আমাদের সব আছে।’
‘বাড়িতে খবর!’
‘বাস থামিয়ে, ভ্যাঁক ভ্যাঁক হর্ন।’
‘তাহলে?’
‘উঠে পড়ুন। একেবারে সামনের সিটে জানলার ধার।’
প্রমোদবাবু ধরা গলায়, ‘তোমরা আমার কে গো?’
‘আমরা আপনার একগাদা মিত্তির।’
বাস ছেড়ে দিল। মিত্তির স্পেশ্যাল। সকলে সমস্বরে বলে উঠল, ‘তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন। পাড়া একদম খালি হয়ে গেল। দুর্গা, দুর্গা!’