বাংলাদেশের কোনো কোনো পত্রিকায় দেখলাম আমার ‘স্তনের টিউমার’ নিয়ে বেশ উত্তেজিত। টিউমারকে রীতিমত ‘ক্যানসার’ বানিয়ে বাজারে ছেড়েছে। লোকরা লুফে নিয়েছে স্তন ক্যানসার সংবাদ। যদিও টিউমারটা ক্যানসার নয়, একে ক্যানসার বানানো হয়েছে। আমাকে নিয়ে সেই আশির দশকের শুরু থেকেই অবশ্য নানারকম কেচ্ছা বানানো হচ্ছে। কেচ্ছাগুলো বিশ্বাস করায় অজ্ঞ অশিক্ষিত লোকেরা অসম্ভব পারদর্শী। আমি দেশে নেই আজ কুড়ি বছর, কিন্তু কেচ্ছার কমতি নেই। ভাবছিলাম, যদি স্তনে না হয়ে শরীরের অন্য কোথাও ক্যানসার হওয়ার খবর প্রচার হতো, ধরা যাক পায়ের আঙুলে! স্তন বলেই কি আগ্রহটা বেশি? অনলাইন পত্রিকার মন্তব্য বিভাগে শত শত নিন্দুকের খুশি উপচে পড়েছে। ক্যানসারের খবর শুনে আনন্দ করেছে ধর্মান্ধের দল। কেউ একজন বললো, আমার স্তনের ওপর ঝড়-ঝাপটা বেশি গেছে বলেই ক্যানসার হয়েছে। কেউ কেউ বলছে, ইসলামের সমালোচনা করেছি বলেই আল্লাহ আমাকে শাস্তি দিয়েছেন, ক্যানসার দিয়েছেন, আমি যেন ভুগে মরি। কেউ আবার ভীষণ উত্তেজিত, ক্যানসারে মরছি, আর দুদিন পরই জাহান্নামের আগুনে পুড়বো। কী সুখই না এরা পেয়েছে আমার ক্যানসারের খবরে। এরা ইসলাম বিশ্বাসী, ধার্মিক। এরা অন্য লোক জাহান্নামের আগুনে পুড়লে ক্যানসারে ভুগলে আনন্দে চিৎকার করে। ধর্ম কি দিন দিন এদের ভয়ানক অমানবিক করছে? আমার ঘোর শত্রুরও যদি অকালমৃত্যু হয়, যদি ক্যানসারে ভোগে, আমার চোখের জল তো তার জন্য ঝরবে। নাস্তিক্যবাদ আর মানববাদ আমাকে সহিষ্ণু করেছে, সহমর্মী করেছে, মানুষের প্রতি আমাকে সহানুভূতিশীল করেছে, আমাকে মানবিক করেছে, কিন্তু ধর্মবিশ্বাস কেন মানুষকে তা করে না? কেন মানুষ নিষ্ঠুর হয়, কেন হিংসা আর প্রতিহিংসা তাদের ক্রমাগত ক্ষুদ্র করে তোলে! আমার মাও ধার্মিক ছিলেন। একই সঙ্গে মা ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে দয়ালু, সবচেয়ে মমতাময়ী, সবচেয়ে সৎ মানুষ। আদর্শ মানুষ হওয়ার পেছনে ধর্মের কতটা অবদান আছে জানি না। তবে ধার্মিকদের মন্তব্যগুলো পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, যদি আমার জরায়ুতে ক্যানসার হতো, তাহলে ওরা বলতো, জরায়ুর স্বাধীনতা চেয়েছিলাম, তাই আল্লাহ জরায়ুতে ক্যানসার দিয়েছেন। যদি হাতে হতো? তাহলে হয়তো বলতো, হাত দিয়ে লিখেছি বলেই আল্লাহ হাতে ক্যানসার দিয়েছেন। যদি পায়ের আঙুলে হতো? তাহলেও পার পেতাম না, বলতো আল্লাহর পথে না হেঁটে অন্য পথে হেঁটেছি বলে পায়ে ক্যানসার হয়েছে। যদি মাথায় হতো, তাহলে বলতো মাথা খাটিয়ে ইসলামের সমালোচনা করেছি, সে কারণে আল্লাহ বুঝে শুনে ওখানেই ক্যানসারটা দিয়েছেন। এখন দেখা যাচ্ছে, আমার শরীরটা আল্লাহ আছেন, তা প্রমাণ করার জন্য ভীষণ জরুরি বটে।
জিএস হাসান লিখেছে, ‘ওটা তো ওরিজিনাল শয়তান, ওর মাংস শরীর থেকে খসে পড়বে, আল্লাহ ওর এমন ভাবে মরণ দাও নাস্তিকরা যাতে ওকে দেখে শিক্ষা নেয়’। সাইফুল ইসলাম লিখেছে, ‘ভালোই হলো দুনিয়া থেকে একটা নাস্তিক কমবে মনে হয়’।
চৌধুরী লিখেছে, ‘তোর জন্য জাহান্নামের আগুন অপেক্ষা করছে। আল্লাহ তোরে কঠিন শাস্তি যেন দিন, সেই দোয়া করছি আমি। নাস্তিক হারামি তুই দুনিয়াতে আরও শাস্তি পেয়ে মর। আমিন’।
নাইম লিখেছে, নাস্তিকদের পরিণতি এই রকমি হয়। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান, আল্লাহ চাইলে ভালো করে দিতে পারে। কারণ আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনও মাবুদ নাই, আগুন, পানি, বাতাস, জীব-জন্তু যত কিছু আছে সব কিছুই আল্লাহর গোলাম। তার হুকুম ছাড়া কোনও কিছু হয় নাই, এবং ভবিষ্যতে হবেও না। সবার ধারণা আমি কোনও পাপ করেছি, তাই আমার টিউমার হয়েছে। টিউমারকেই সম্ভবত তারা ক্যানসার বলে মনে করে। কিন্তু টিউমার মানেই যে ক্যানসার নয়, তা বোঝাবে কে তাদের! আর পাপ না করলেও যে ক্যানসার হয় তাই বা কে বোঝাবে। ইশতিয়াক খান লিখেছে, এখন অবশ্য বুঝতেছেন যে মরার পর যে আরেকটা জীবন আছে, এই জীবনে এত কষ্ট করে যাচ্ছেন তার হিসাব না দিলে কেমনে, এখনো সময় আছে আল্লাহর কাছে মনে প্রাণে ক্ষমা চান, আল্লাহই একমাত্র ক্ষমা করার মালিক, তিনি অসীম দয়ালু ও ক্ষমাশীল।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘যারা ইসলামের বিপক্ষে কটূক্তি করে তাদের পরিণতি এমনই হয়। তারই একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই *** তাসলিমা নাসরিন। এখনো সুযোগ আছে খালিছভাবে তাওবাহ করে ইসলামের সঠিক পথে ফিরে আসার’। নাদিম সাইমান লিখেছে, ‘স্তনে টিউমার ধরা পড়েছে, যা প্রায় এক ইঞ্চি পর্যন্ত বিস্তৃত। উনার স্তন ক্যানসার হওয়া স্বাভাবিক। স্তনের ওপর দিয়ে তো কম ঝড়-ঝাপটা যায়নি।’ মোহাম্মদ সালিম উদ্দিন লিখেছে, ‘তসলিমা ভালো হয়ে যা, না হলে জাহান্নামে যাবি’।
মূর্খতার কোনও শেষ নেই। ধর্মের মানুষেরা বিজ্ঞান থেকে কত লক্ষ মাইল দূরে সরে আছে যে তা হিসাব করতেই ভয় হয়। কুসংস্কার তাদের আশ্রয়। রূপকথা তাদের বাস্তব। মিথ্যে তাদের সত্যি। ঘৃণা তাদের সহায়। অজ্ঞ অশিক্ষিত লোকদের খাবার জোটাতে জোটাতে মিডিয়া নিজেরাও অজ্ঞ অশিক্ষিত হয়ে উঠছে। স্তনের টিউমার দেখাতে আমি আমেরিকা যাইনি। আমেরিকায় গেছি ‘উইমেন ইন সেকুলারিজম’ কনফারেন্সে বক্তৃতা করতে। ভার্জিনিয়ায় হলো অনুষ্ঠান। বক্তা সবই নারী। গত তিন বছর ধরে হচ্ছে এই কনফারেন্স। এই প্রথম আমি ছিলাম। এবার আরও যারা বক্তৃতা করেছেন, তাদের মধ্যে আমেরিকার লেখিকা রেবেকা গোল্ডস্টাইন, সুজান জাকোবি, বারবারা এরেনরিস, কাথা পলি্লট, সোরাইয়া চেমালি, অফেলিয়া বেনসন ছিলেন। আলোচনার বিষয়গুলো চমৎকার, আমি মাল্টিকালচারিলিজম নিয়ে একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি। আমার নিজস্ব বক্তৃতার বিষয় ছিল, ‘কেন সেকুলারিজম নারীর অধিকারের জন্য জরুরি।’ জরুরি, কারণ ধর্মের আইন আর নারীর অধিকার, এই দুই এর সহাবস্থান সম্ভব নয়। সেকুলারিজমের মানে হলো রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করা। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। রাষ্ট্রে, আইনে, শিক্ষায়, বাণিজ্যে ধর্ম ঢুকে গেলে যা হয়, তাহলো, নারীর অধিকারের বারোটা বাজা, আর পুরুষতন্ত্র শক্তপোক্ত হওয়া। বাংলাদেশের রাষ্ট্রে, আইনে, শিক্ষায়, বাণিজ্যে ধর্ম ঢুকেছে। সমাজে এসবের প্রভাব প্রচণ্ড। রীতিনীতি পাল্টে যায়। নারীকে দেখার চোখ গড়ে ওঠে। নতুন চোখ। নারীরা অনেকে ক্ষমতার শীর্ষে বসে আছেন বলে অনেকের হয়তো চোখে পড়ছে না সাধারণ নারীর অবস্থা। অথবা পড়ছে কিন্তু গা সওয়া হয়ে গেছে নারী বিদ্বেষ। টুইটারে আমি আমাদের সেকুলারিজমের ওপর হতে থাকা অনুষ্ঠানটির খবর প্রতিদিনই দিয়েছি। মিডিয়া যদি টুইটার থেকে আমার ব্রেস্ট টিউমারের খবর নিতে পারে, তবে টুইটার থেকে আমার কনফারেন্সের খবরও নিতে পারে। কিন্তু মিডিয়া তা নেয়নি। মিডিয়া আমার স্তন এবং ক্যানসার নিয়ে উৎসাহী, আমার বক্তৃতা বা সেকুলারিজম বিষয়টি নিয়ে নয়। মিডিয়ার অজ্ঞ অশিক্ষিত পাঠক সেকুলারিজমের মর্ম বুঝবে না বলে কি মিডিয়া এ নিয়ে উৎসাহী নয়? নাকি নিজেরাও ওই একই দলের লোক বলেই উৎসাহী নয়? মানুষের চেতনার বিকাশ হয়, এমন সব লেখা না লিখে, যে অন্ধকারে মানুষ পড়ে রয়েছে, সেই অন্ধকারকেই মহিমান্বিত করায় মিডিয়ার জুড়ি নেই।
মাঝে মাঝে ভাবি, একটা সমাজ কতটুকু শিক্ষিত বা উন্নত, তা হিসেব করতে হলে অনলাইন পত্রিকার মন্তব্য কলামে নারীবাদ বা নারীবাদীদের ওপর মন্তব্যগুলো পড়লেই চলে। আর তা যদি করা হয়, আমি নিশ্চিত বাংলাদেশ প্রমাণিত হবে পৃথিবীর সবচেয়ে অসভ্য দেশ হিসেবে। গোটা ইন্টারনেট অসাধারণ বিপ্লব বটে, এর মাধ্যমে যেমন বিজ্ঞান প্রচার হচ্ছে, জ্ঞানের আলো ছড়ানো হচ্ছে। একই সঙ্গে কিন্তু অবিজ্ঞানও প্রচার করছে লোকেরা। অসত্য, অন্যায় বৈষম্যও প্রচার হচ্ছে, মূর্খতা, মৌলবাদ, আতঙ্কবাদ প্রচার হচ্ছে। এখন পাঠককে শুধু বুঝে শুনে ভালোটা বেছে নিতে হবে। বোঝার ক্ষমতা যেন কারও নষ্ট হয়ে না যায়। শিশুবয়সে মাথাটা ধর্মান্ধতা থেকে বাঁচাতে পারলে আর কোনও সমস্যা নেই, মাথাটা বাঁচবে। বোঝার, ভাবার, চিন্তা করার, সিদ্ধান্ত নেওয়ার বোধবুদ্ধিগুলো অক্ষত রয়ে যাবে।