মিছিল

মিছিল

কে বলবে এখন বিকেল চারটে? আটতলার বড় বড় কাচের জানলায় রোদ পড়ে ঠিকরে যাচ্ছে। বহু বছর পর কলকাতায় খুব গরম পড়ল। মাসখানেক আগে একটা দুটো কালবৈশাখী হয়ে মেঘ সেই যে উধাও হয়েছে, আর দেখা নেই। শূন্য, শুষ্ক আকাশ দাউ দাউ করে জ্বলছে। অফিসের ভেতর এসি মেশিনের ঠান্ডা, তবু বাইরে চোখ পড়লে শরীর জ্বালা করে।

শ্রীময়ী কম্পিউটার বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। অনন্যা চোখ তুলে বলল, ‘কী হল, উঠে পড়লি!’

শ্রীময়ী বলল, ‘চলে যাব।’

অনন্যা ঠোঁটের ফাঁকে হেসে বলল, ‘মার্কেটিং?’

শ্রীময়ী একটু লজ্জা পেল। বলল, ‘মায়ের সঙ্গে বেরোব। গড়িয়াহাটের কাছে কী ছাই বুটিক আছে, সেখানে যেতে হবে। মাকে কে যেন খবর দিয়েছে। এখন হাবিজাবি খবর দেওয়ার লোকও জুটেছে। খালি খরচ করিয়ে দেওয়ার মতলব। ওখানে নাকি কাঁথা স্টিচ…। দূর, মা ভীষণ জ্বালাচ্ছে। যেখানে যা শুনছে, বলছে, চল একবার ঘুরে আসি। যাব না বললে ঠোঁট ফোলাচ্ছে। বলছে, ক’দিন পরেই তো শ্বশুরবাড়ি চলে যাবি, তখন কি আর বলব?’

অনন্যা চেয়ারে হেলান দিয়ে বড় করে হেসে বলল, ‘ঠিকই তো। একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা, মাসিমা শখ মেটাবেন না? তোর মেয়ের যখন বিয়ে হবে তুইও করবি। গাদা গাদা কেনাকাটা করবি।’

শ্রীময়ী টেবিলের কাগজপত্র গোছাতে গোছাতে বলল, ‘কচু করব।’

অনন্যা বলল, ‘ঠিক করবি। খাট, আলমারি, ফ্রিজ কিচ্ছু বাদ দিবি না।’

শ্রীময়ী হেসে ফেলল। বলল, ‘অনন্যাদি, এরা কিন্তু কিছু নিচ্ছে না। বাবা একটা টিভি দিতে চাইছিল। তাও রাজি হয়নি।’

অনন্যা অস্ফুটে বলল, ‘ভেরি গুড।’

শ্রীময়ী গর্বের হেসে, ঠোঁট উলটে বলল, ‘ভেরি গুড কিনা জানি না, তবে এখন পর্যন্ত তো মনে হচ্ছে ভদ্রলোক।’

অনন্যা ধমক দিল, ‘যা:, এমন ভাবে বলছিস কেন? ভদ্রলোকরা সবসময়েই ভদ্রলোক। তোর শ্বশুরবাড়ির মতো।’

শ্রীময়ী এই ধমকে খুশিই হল। হেসে বলল, ‘শ্বশুরবাড়ি বলছ কেন অনন্যাদি? উড বি শ্বশুরবাড়ি বলো।’

অনন্যা হেসে বলল, ‘নেকা। ডেট বাদে সবই তো ঠিক হয়ে গেছে।’

‘কালপরশুর মধ্যে সেটাও হয়ে যাবে মনে হয়। ওর ঠাকুমার একটু পাঁজি-পঞ্জিকার ব্যাপার আছে। বাড়ির পুরুতঠাকুর বাইরে গেছেন, ফিরে এসে তারিখ ফাইনাল করে দেবেন।’

অনন্যা হেসে বলল, ‘তোকে হিংসে হচ্ছে। বিয়ে থা করে বাচ্চার মা হয়ে বসে আছি, নইলে আর একবার ট্রাই নিতাম।’

শ্রীময়ী হেসে ডান হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘বয়ে গেছে তোমার, অনুভবদার মতো হাজবেন্ড হয়? অফিসে পঁচিশবার ফোন আসছে, বছরে দুবার বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে।’

অনন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘হাজবেন্ডটি ভালো, কিন্তু শ্বশুর-শাশুড়ি দুজনই গড়বড়ে বাপু। এতগুলো বছর হয়ে গেল এখনও কাঠি করার স্বভাব গেল না, একটা চান্স পেলেই হল। যাক, তোমার আর এসব শুনে কাজ নেই, তোমার এখন ধেই-ধেই করে নাচবার সময়।’

অনন্যা কথাটা খুব ভুল বলেনি। ধেই-ধেই করে নাচতে ইচ্ছে না করলেও শ্রীময়ীর মনটা খুব ভালো। একইসঙ্গে এমন ভালো ছেলে এবং চমৎকার পরিবার পাওয়া যাবে সে ভাবতে পারেনি। বেশিরভাগ সময়ে ছেলে ভালো হলেও বাড়ির লোক গোলমাল করে। অনন্যাদির মতো ঘটনা ঘরে ঘরে। শ্রীময়ী এবং তার বাবা-মা নিশ্চিন্ত এখানে সেরকম ঘটবে না। অল্প পরিচয়তেই পরিবারটি তাদের দারুণ লেগেছে। পাত্র হিসেবে তপোধীর অতি চমৎকার। ভালো রেজাল্ট করা ইঞ্জিনিয়র। কম বয়সেই চাকরিতে বড় জায়গায় গেছে। ঠান্ডা স্বভাবের লাজুক এই ছেলে কথাও কম বলে। অতিরিক্ত ভদ্র। কেরিয়ারে অনেক দূর পর্যন্ত যেতে চায় সে। শ্রীময়ীর খুব পছন্দ। ফোকাস না থাকলে ভালো ছেলেমেয়েরাও একটা জায়গা পর্যন্ত গিয়ে আটকে যায়। মাঝ নদীর চরে নৌকো আটকে যাওয়ার মতো। শুধু নিজের কেরিয়ার নয়, শ্রীময়ীর কাজকর্মেও উৎসাহ দিয়েছে তপোধীর। মন দিয়ে বিভিন্ন প্রজেক্টের কথা শুনেছে। এটাও মস্ত গুণ। তবে শ্রীময়ীর সবথেকে ভালো লেগেছে, কোনও ব্যক্তিগত প্রশ্ন না করায়। শ্রীময়ী বুঝেছে, এই ছেলে আর পাঁচজনের মতো নয়।

শুধু ছেলে নয়, ছেলের বাবা-মাও ভালো। মেয়েকে একদিন দেখতে এসেই পছন্দ করে ফেলেছেন। অথচ শ্রীময়ীর চেহারায় চটকদারি কিছু নেই। গায়ের রং মাঝারি। শুধু একধরনের শান্ত, স্নিগ্ধ, বুদ্ধিদীপ্ত ভাব রয়েছে। রান্নাবান্না, সেলাই-ফোঁড়াই নয়, ছেলের মা শুধু লেখাপড়ার কথাই জিগ্যেস করলেন। শ্রীময়ী ইতিহাসে এমএ শুনে চোখ বড় করে বললেন, ‘তাই নাকি! কী ভালো হল। জানো আমারও ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনার ভীষণ ইচ্ছে ছিল। বাবা-মা জোর করে সায়েন্সে ঢুকিয়ে দিল। বলল, ডাক্তার হতে হবে। শেষ পর্যন্ত ডাক্তার না হয়ে স্কুলের হেডমিসট্রেস হয়েছি। চান্স পেলেই ক্লাসে গিয়ে মেয়েদের ইতিহাস পড়াই। নিজে খানিকটা পড়ে নিই আর কী!’ কথাটা বলে মহিলা খুব হাসতে লাগলেন। মহিলার হাসিটাও উজ্জ্বল। ছেলের বাবাও শিক্ষক। পরিতোষ চট্টোপাধ্যায়। কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। এক বছর হল রিটায়ার করেছেন। হাসিখুশি ধরনের মানুষ। কথা বলার মধ্যে একটা হইহই ভাব। পুরোনো ঘরানার উদার মনের মানুষ। কলেজের ক্লাসে লেকচার দেওয়ার ঢঙে বললেন, ‘যে সমাজে মেয়েরা উপার্জন করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না সেই সমাজের কোনও উন্নতি নেই। সংসারের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ চলতে পারে, কাজের সঙ্গে নয়। মা শ্রীময়ী তুমিও কখনও কম্প্রোমাইজ করবে না।’

শ্রীময়ী মুগ্ধ হল। কিছুদিন আগেই তার একটা সম্বন্ধ এসেছিল। সম্বন্ধ খারাপ নয়। পারিবারিক বড় ব্যবসা আছে। কথাবার্তা শুরুর আগেই তারা শর্ত পাঠাল, মেয়েকে চাকরি ছাড়তে হবে। শ্রীময়ী বেঁকে বসেছিল।

শ্রীময়ী বসের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। সুদর্শন তালুকদার কাজের ব্যাপারে কড়া ধাঁচের হলেও মানুষটা অন্যরকম। পুরোপুরি কর্পোরেট প্রফেশনালদের মতো নয়। বয়স বেশি হওয়ার কারণে একধরনের গার্জেনসুলভ আচরণ করেন। ভুল হলে বকাবকি যেমন করেন, আবদারও শোনেন। কখনও রসিকতা করে সম্পর্ক সহজ করে নেন। কে জানে, এটাই হয়তো আধুনিক ম্যানেজমেন্টের কায়দা। কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে রাখলে কোয়ালিটি কাজ আদায় করা যায়। শ্রীময়ীকে দেখে সুদর্শন তালুকদার ভুরু কোঁচকালেন, ‘আবার কী হল? সমস্যা?’

শ্রীময়ী বলল, ‘না স্যার, সমস্যা কিছু নয়, প্রজেক্টটা কালই শেষ হয়ে যাবে। স্যার, আজ আমি একটু বেরিয়ে যাচ্ছি।’

সুদর্শন তালুকদার হাতের পেনটা টেবিলের ওপর রেখে চেয়ারে হেলান দিলেন। বললেন, ‘কী ব্যাপার বলো তো শ্রীময়ী, মাঝে মাঝেই তুমি ডিউটি আওয়ার্সে বেরিয়ে যাচ্ছ কেন? লাস্ট উইকে কবে একটা যেন খোঁজ করে তোমাকে পাইনি। তার আগের উইকে একদিন দেরি করে এলে।’

শ্রীময়ী জানত এই বকুনিটুকু আসবে। সে বলল, ‘স্যার, আমি কাল কাজ শেষ করে দেব। যত দেরি হোক অফিসে থাকব। আসলে গড়িয়াহাটে মা অপেক্ষা করছেন।’

সুদর্শন তালুকদার হালকা হেসে বললেন, ‘কী ব্যাপার শ্রীময়ী? মাঝে মাঝেই মা গড়িয়াহাটে অপেক্ষা করছেন নাকি! আই থিঙ্ক ইট ইজ ট্রু।’

শ্রীময়ী হেসে ফেলল। বলল, ‘ইয়েস স্যার, ইটস ট্রু। একটু কেনাকাটার ব্যাপার আছে।’

সুদর্শন তালুকদার মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন, ‘ফলস হলেও আপত্তি নেই, তবে ঘন ঘন অ্যালাও করব না।’

শ্রীময়ী হেসে ফেলল। বলল, ‘থ্যাঙ্কিউ স্যার। আজই লাস্ট।’

অফিসের দরজা টপকে ফুটপাথে পা দিতেই গরম হাওয়া। যেন আঁচড়ে দিল। চোখমুখ চিড়বিড়িয়ে ওঠে। শ্রীময়ী তৈরিই ছিল। ঠান্ডা অফিস থেকে বেরোলে বেশি কষ্ট। আজ শাড়ি পরে অফিসে এসেছে। নীলরঙের সুপারনেট। শাড়ি খুব বেশি পরে না শ্রীময়ী। অফিসে তো একেবারেই নয়। মায়ের সঙ্গে বেরোবে বলে পরেছে। মা-ই জোর করল। বলল, ‘আজ শাড়ি পরিস।’

শ্রীময়ী অবাক হয়ে বলেছিল, ‘এই গরমে অফিসে শাড়ি! কেন মা?’

সুতপাদেবী ঢোঁক গিলে বললেন, ‘শুধু তো আর অফিস যাচ্ছিস না, আমার সঙ্গেও তো বেরোবি।’

‘তাতে কী হয়েছে! তোমার সঙ্গে কি জিনস পরে বেরোই না?’

সুতপাদেবী বললেন, ‘তা নয়, ওবাড়ির কারও সঙ্গে যদি হুট করে দেখা হয়ে যায়…ওরা তো সাউথেই থাকে। তাই না?’

শ্রীময়ী খিলখিল আওয়াজে হেসে বলল, ‘কী যে বলো মা! তোমার মাথা পুরো গেছে। বিয়ে করব বলে এখন থেকে রাস্তাঘাটে বউ সেজে ঘুরে বেড়াতে হবে?’

সুতপাদেবী রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘যা ভালো বুঝিস কর। বিয়ে ঠিক হলে মাঝেমধ্যে শাড়িটাড়ি পরা অভ্যেস করতে হয়।’

শ্রীময়ী হাসতে হাসতে বলল, ‘ঠিক আছে, শুধু শাড়ি পরব না, ঘোমটাও দেব। গড়িয়াহাটের মোড়ে ভাবী শাশুড়ির সঙ্গে দেখা হলে গড় হয়ে প্রণাম করব। বলব, আশীর্বাদ করুন মা, আমার বিয়ের মার্কেটিং যেন ভালো হয়।’

হাসিঠাট্টা করলেও শেষ পর্যন্ত শাড়িই পরেছে শ্রীময়ী। হবু শ্বশুরবাড়ির জন্য নয়, মায়ের জন্য। নইলে ঘ্যানর ঘ্যানর করবে। শাড়িতে একটা সুবিধে হল, আঁচল তুলে নাকে-মুখে চাপা দেওয়া যায়। গরমের হলকা দুম করে শরীরে ঢুকতে পারবে না। তবে শাড়ি নিয়ে মাথা ঘামাতে গিয়ে একটা কাণ্ড হয়েছে। রোজকার অফিসের ব্যাগটা বদলে শাড়ির সঙ্গে রং মিলিয়ে লম্বা একটা শান্তিনিকেতনি কায়দার চটের ব্যাগ নিয়েছে। গায়ে নীল কাপড়ের ফুল পাতার নকশা করা। ছাতাটা এই ব্যাগে ঢোকানো হয়নি। মায়ের ওপর বিরক্ত হল শ্রীময়ী। এসব শাড়ি-টাড়ির আদিখ্যেতা বেশিদিন চলবে না।

পরিকল্পনা ছিল, মোড় পর্যন্ত গিয়ে ট্যাক্সি ধরে গড়িয়াহাট। মোড়ের কাছাকাছি এসে থমকে যেতে হল শ্রীময়ীকে। বাস, গাড়ি সব জড়িয়ে মড়িয়ে আছে। বিকট হর্ন বাজছে, তুমুল হট্টগোল। ফুটপাথেও ভিড়। গায়ে গায়ে ঠেলাঠেলি। বিশ্রি অবস্থা। কী হয়েছে? ট্রাফিক জ্যাম? অ্যাক্সিডেন্ট? দ্রুত পায়ে বড় রাস্তার মুখে এল শ্রীময়ী। এসে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। মিছিল বেরিয়েছে! গোটা রাস্তা আটকে চলেছে বিরাট মিছিল। সঙ্গে ফ্ল্যাগ, ফেস্টুন। কাতারে কাতারে মানুষ। পায়ে পা ঠোকাঠুকি করে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে উত্তেজিত ভঙ্গিতে হাত মুঠো করে আকাশের দিকে ছুঁড়ছে। শ্লোগান দিচ্ছে। সেই শ্লোগানের কথা বোঝা যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে চাপা গর্জন।

সত্যি সত্যি মাথায় হাত দিয়ে ফুটপাথের ওপর বসে পড়তে ইচ্ছে করল শ্রীময়ীর। কী হবে এখন? মিছিলের মাথা লেজ কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না। কখন শেষ হবে? অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে না ঘণ্টাখানেকের আগে এই পথে গাড়িটাড়ি কিছু চলবে। একটা ট্যাক্সি ধরে উলটো দিক দিয়ে পালাতে হবে। শ্রীময়ী এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে ট্যাক্সি খুঁজতে চাইল। কোথায় ট্যাক্সি? আর পেলেই বা কী লাভ? সবদিকের পথই আটকে গেছে এতক্ষণে। সামনে, পিছনে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। মোবাইলে সময় দেখল শ্রীময়ী। নম্বর টিপল মায়ের। ‘আটকে পড়েছি’ এটা অন্তত জানানো দরকার। ফোন বেজে যাচ্ছে, বেজেই যাচ্ছে। নো রিপ্লাই। মা নিশ্চয় আজও ফোন ফেলে রেখে বেরিয়েছে। এই ভুল তার হামেশাই হয়। মাথায় রক্ত উঠে গেল শ্রীময়ীর। থাকুক দাঁড়িয়ে। যার মোবাইল নিয়ে বেরোনোর কাণ্ডজ্ঞানটুকু থাকে না, তাকে রাস্তায় হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। মানুষের কনুইয়ের ধাক্কায় রাস্তার পাশে খানিকটা ছিটকে ছিটকে পড়তে হচ্ছে। কী করবে? অফিসে ফিরে যাবে? দরদর করে ঘাম হচ্ছে। আঁচল দিয়ে গলা, মুখ, কপালের ঘাম মুছল শ্রীময়ী। শাড়ির আঁচল বলে বাঁচোয়া। রুমাল হলে নিংড়োতে হত। মাকে খবরটা দিতে পারলে ঝামেলা মিটে যেত…বেচারি দাঁড়িয়ে থাকবে…। একটু এগিয়ে গেলে কেমন হয়? খানিকটা হেঁটে গিয়ে দেখতে হবে কোনও গলিটলির মধ্যে যদি ট্যাক্সি পাওয়া যায়। তারপর ঘুরিয়ে নিয়ে…গলির মধ্যে ভিড় কম থাকে।

ফুটপাথ থেকে নেমে পড়ল শ্রীময়ী। মিছিলের পাশে পাশে হাঁটতে শুরু করল গুটিগুটি এবং একটা সময় নিজের অজান্তেই ঢুকে পড়ল ভেতরে। খানিকটা এগোতে শ্রীময়ী বুঝতে পারল, শহর লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। হাঁটা ছাড়া কোনও উপায় নেই। বাঁ-হাতের গলির ভেতর ওটা কী? ট্যাক্সি না? মুখ লুকিয়ে থাকা ট্যাক্সিকে হাত তুলে ডাকতে লাগল শ্রীময়ী। লাভ হল না। ট্যাক্সি ড্রাইভার নিশ্চিত গভীর ঘুম দিয়েছে। কে জানে হয়তো নাকও ডাকছে। মোবাইল বের করে ফের মায়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করল শ্রীময়ী। আগের মতোই বেজে গেল ফোন। শ্রীময়ী সিদ্ধান্ত নিল, আর এগিয়ে লাভ নেই, সে বাড়ি ফিরে যাবে। এই হতচ্ছাড়া মিছিল টপকে উলটো দিক থেকে যাবে। কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে খানিকটা গলায় ঢালল। ভাগ্যিস ছাতার মতো জল আনতে ভুলে যায়নি। পাশে হাঁটা রোগ ভোগা চেহারার একটা ছেলে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘দিদি, জলটা দিন।’ শ্রীময়ীর মজা লাগল। কথাটা বলার মধ্যে একধরনের নিশ্চিন্ত ভাব আছে। ছেলেটা যেন জানে, বোতলটা সে পাবেই!

শ্রীময়ী হেসে বোতলটা এগিয়ে দেয়।

চঞ্চল মৈত্র ড্রইংরুমে, টিভির সামনে বসে আছেন। চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। তিনি সেই ছাপ সরানোর চেষ্টা করছেন। খানিকটা পারছেন, বেশিটাই পারছেন না। একটু আগে পরিতোষ চট্টোপাধ্যায় টেলিফোন করেছিলেন। মেয়ের হবু শ্বশুর। তারপর থেকেই চিন্তার শুরু। বিষয়টা হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মতো। তবু ভদ্রলোক অদ্ভুত আচরণ করলেন! একটা ভুল জিনিস নিয়ে এত সিরিয়াস হওয়ার কী আছে! ‘ভালো মানুষ’ সম্পর্কে ধারণাটা কোথায় যেন একটু চিড় খেয়েছে। খুব সামান্য, কিন্তু খেয়েছে। এই জন্যই চিন্তা হচ্ছে।

শ্রীময়ীর ফিরতে আটটা বেজে গেল। বাসের জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল ঝাড়া এক ঘণ্টা। তারপরেও বাসে উঠতে পারেনি। এত ভিড়! মিছিল, মিটিঙের পর শহর নরক হয়ে যায়। বাড়ি ঢুকেই মায়ের ওপর এক চোট মেজাজ দেখাল। সুতপাদেবী বললেন, ‘আমার কী দোষ! ট্রাফিক জ্যাম। ট্যাক্সিতে ঠায় বসে থেকে একসময় নেমে পড়লাম। খানিকটা পথ হেঁটে, খানিকটা রিকশায় বাড়ি ফিরেছি।’

শ্রীময়ী রাগি গলায় বলল, ‘সেই জন্য বলিনি, মোবাইলটা নিয়ে বেরোওনি কেন?’

সুতপাদেবী বললেন, ‘চার্জ ছিল না। আমি তো তোমাদের মতো সারাক্ষণ কানে মোবাইল নিয়ে বকবক করি না। জিনিসটার কথা মনেই থাকে না।’

শ্রীময়ী রাগে গজগজ করতে করতে বলল, ‘আমাকে আর কোনওদিন ডাকবে না…উফ! কী হ্যারাসড যে আজ হয়েছি…তার ওপর আগে বেরিয়েছি বলে বসের কথা শুনতে হল…।’

সুতপাদেবী বললেন, ‘আমার ওপর মেজাজ দেখাচ্ছিস কেন? আমি কি মিছিল করেছি?’

শ্রীময়ী বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘না, আমি করেছি।’

সুতপাদেবী দু-কাপ চা নিয়ে ড্রইংরুমে এলেন। চঞ্চলবাবু ভুরু কুঁচকে বসে আছেন। চোখ টিভির দিকে। হাতে রিমোট। একটার পর একটা চ্যানেল বদলাচ্ছেন। সুতপাদেবী সোফার একপাশে বসে অভিমানাহত গলায় নিজের মনে একটানা বলে যেতে লাগলেন —’আরে বাবা, আমি কি আমার বিয়ের বাজার করতে বেরিয়েছিলাম? আমি তো তোর জন্যই বেরোচ্ছি। আমাকে কথা শোনানোর কী আছে? মিছিলে আটকে গেলে আমি কী করব? উড়ে উড়ে যাব?’

চঞ্চলবাবু অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন, ‘ডেটটা এবার ফাইনাল করা উচিত।’

সুতপাদেবী স্বামীর দিকে ফিরে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘কীভাবে ফাইনাল হবে? মেয়ের বাবা যদি সর্বক্ষণ টিভির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বসে থাকে, বিয়ের তারিখ ফাইনাল হয়?’

চঞ্চলবাবু থমকালেন। টিভিতে খবর দেখাচ্ছে। মন্ত্রীর ভাষণ। এরপর কি দেখাবে? নাকি দেখানো হয়ে গেছে? সুতপাদেবী বললেন, ‘চুপ করে গেলে কেন? মন্ত্রীর লেকচার শুনছ!’

চঞ্চলবাবু অন্যমনস্ক গলায় নিজের মনেই বললেন, ‘মিছিল দেখাবে না?’

সুতপাদেবী হাতের চায়ের কাপ নামিয়ে অবাক গলায় বললেন, ‘মিছিল দেখাবে! কীসের মিছিল? কী বলছ হাবিজাবি?’

চঞ্চলবাবু তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে জোর করে হাসলেন, ‘বা:, শহরে অত বড় একটা মিছিল হল, তুমি আর তোমার মেয়ে পথে আটকে গেলে, তোমাদের এত ঝগড়া হল, আর খবরে দেখাবে না?’

সুতপাদেবী চোখ সরু করে বললেন, ‘ঠাট্টা করছ?’

চঞ্চলবাবু প্রসঙ্গ পালটে বললেন, ‘আসলে কী জানো সুতপা, ওনারা এত ভদ্রলোক যে তাড়া লাগানোটা ঠিক হবে না।’

সুতপাদেবী মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘তাড়া তো নয়, জিগ্যেস করতে বলছি। পুরোহিত মশাই বাইরে থেকে ফিরলেন কিনা জানতে চাইবে। আমাদেরও তো সব গোছাতে হবে। কার্ড ছাপা, নেমন্তন্ন, কেটারার।’

চঞ্চলবাবু শুকনো হেসে বললেন, ‘একই হল। তপোধীরের বাবা-মা অতি সজ্জন মানুষ। আয়োজন অগোছালো হলেও কিছু মনে করবেন না। ধরো বরযাত্রীকে ঠান্ডা কফি দিলে, ওরা দেখবে সোনামুখ করে খেয়ে নেবে।’

সুতপাদেবী খুশি হলেন। মেয়ের হবু শ্বশুরবাড়ির প্রশংসা শুনলে খুশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এখনও তার যেন কেমন বিশ্বাস হচ্ছে না। এটাই নিয়ম। অতিরিক্ত ভালো কোনও ঘটনা ঘটলে বিশ্বাস করতে মন চায় না। তার মেয়েটা খুব খুঁতখুঁতে। চট করে কাউকে পছন্দ হয় না। হয়তো সেই কারণেই প্রেম-ট্রেম হয়নি। স্বভাবে শান্ত হলেও মেয়ের আত্মসম্মান বোধ টনটনে। সেই মেয়ে যে তপোধীরকে খুব পছন্দ করেছে সেটাই বিরাট স্বস্তির বিষয়। সুতপাদেবী বললেন, ‘ভদ্রলোক কি ফোন-টোন কিছু করেছিলেন?’

চঞ্চলবাবু চমকে উঠে বললেন, ‘ফোন! কই না তো?’

কথাটা মিথ্যে। একটু আগেই পরিতোষ চট্টোপাধ্যায়ের ফোন এসেছিল। তার গলা ছিল থমথমে, বিরক্ত।

‘শরীর খারাপ না কি পরিতোষবাবু?’

ওপাশ থেকে ঠান্ডা গলার উত্তর এল, ‘শরীর ঠিকই আছে, একটা কথা জানবার জন্য ফোন করলাম মিস্টার মৈত্র।’

চঞ্চলবাবু আগ্রহ নিয়ে বললেন, ‘বলুন।’

‘কিছু মনে করবেন না, আপনার মেয়ে কি পলিটিক্স করে? রাজনীতি?’

চঞ্চলবাবু চমকে উঠলেন, ‘পলিটিক্স! মানে? না, না, আমার মেয়ে ওসবের মধ্যে নেই। সে রাজনীতি করবে কেন!’

পরিতোষবাবু চিন্তিত গলায় বললেন, ‘আমিও অবাক হচ্ছি। লেখাপড়া করেছে, ভালো চাকরি করে, সে হঠাৎ রাজনীতির মতো নোংরা ব্যাপারে জড়াবে কী কারণে!’

চঞ্চলবাবু ভয় পেলেন। বিয়ের সময় নানা রকম ভাংচি হয়। সেরকম কিছু হল নাকি! তিনি ভীত গলায় বললেন, ‘কী হয়েছে বলুন তো? কেউ কিছু বলেছে?’

ওপাশে মানুষটা একটু চুপ থেকে বললেন, ‘না, কেউ বলেনি। আমি দেখলাম। ইনফ্যাক্ট আমি ঠিক নই, আমার মিসেস আগে দেখেছেন, তারপর আমাকেও দেখালেন। উই শকড।’

‘দেখেছেন! কী দেখেছেন?’

পরিতোষ চট্টোপাধ্যায় কঠিন গলায় বললেন, ‘শ্রীময়ীকে দেখেছি। সে মিছিলে হাঁটছিল। পলিটিক্যাল পার্টির র‌্যালি। ফ্ল্যাগ, ফেস্টুন ছিল। টিভির নিউজে বেশ অনেকটা সময় ধরে দেখিয়েছে। বাংলা নিউজে। আপনার মেয়েকে দেখাল, একবার নয়, অন্তত তিনবার তো বটেই। প্রথমবার আমার মিসেস দেখে বিশ্বাস করেনি। ভাবে ভুল দেখছে। আমাকে ডাকে, আমিও দেখি। বেশ খানিকক্ষণ ধরেই দেখি। কতগুলো হুলিগানসদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করতে করতে শ্রীময়ী হাঁটছে।’

চঞ্চলবাবুর হাত থেকে রিসিভার পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। তিনি বিস্মিত গলায় বললেন, ‘আপনি কী বলছেন পরিতোষবাবু! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘আমরাও বুঝতে পারছি না মিস্টার রায়। সেই জন্যই সরাসরি আপনাকে ফোন করলাম। ইট সুড বি ক্লিয়ারড। পরিষ্কার হয়ে যাওয়াটা দরকার। শিক্ষিত, ভদ্র ঘরের একজন মেয়ে রাস্তায় মিছিলে হাঁটবে কেন? এখন তো আর দেশ স্বাধীনের আন্দোলন হয় না। আখের গোছানোর রাজনীতি। ইন ফ্যাক্ট মিস্টার মৈত্র, উই হেট পলিটিক্স। ঘৃণা করি। পলিটিক্স করে দেশটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। তপোধীর এসব সহ্যই করতে পারে না।’

পরিতোষ চট্টোপাধ্যায়ের কথাগুলো হুমকির মতো শোনাচ্ছিল। নিজেকে সামলে হাসবার চেষ্টা করলেন চঞ্চলবাবু। বললেন, ‘আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমার মেয়ে কখনও রাজনীতির মধ্যে থাকেনি। কলেজেও নয়। আর এখন তো বড় হয়ে গেছে, প্রশ্নই ওঠে না। আপনারা নিশ্চয় শ্রীময়ীর মতো কাউকে দেখেছেন, মিছিল-টিছিলে কত মানুষ থাকে…আমার মেয়েকে তো আর তেমন আলাদা কিছু দেখতে নয়…কমন চেহারা।’

পরিতোষবাবু একটু থমকে নীচু গলায় বললেন, ‘আমরা দুজনেই ভুল দেখলাম? নীল রঙের শাড়ি, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ?’

চঞ্চলবাবু এবার যেন খড়কুটো পেলেন। হেসে বললেন, ‘অবশ্যই ভুল দেখেছেন। শ্রীময়ী আজ সারাদিন অফিস করেছে। আমি যতদূর জানি অফিসে সে কখনও শাড়ি পরে যায় না। এই নিয়ে ওর মায়ের সঙ্গে ঝগড়াও হয়। বোঝেনই তো আজকালকার মেয়ে…।’

চঞ্চলবাবু আওয়াজ করে হাসলেন। পরিতোষ চট্টোপাধ্যায় এবার যেন থমকালেন। হালকা হাসলেনও। বললেন, ‘তাই নাকি! ও হো সরি! তাহলে বোধহয় আমরাই ভুল করেছি। আচ্ছা, আপনারাও একটু টিভির নিউজ দেখবেন তো…একেবারে একরকম দেখতে… যেন যমজ!’

এসব শুনলে স্ত্রী টেনশন করবে। তাই ফোনের কথাটাই বলেননি চঞ্চলবাবু। তার বদলে অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘শ্রীময়ী কি অফিসে শাড়ি পরে যায় সুতপা?’

সুতপাদেবী অবাক হয়ে বললেন, ‘হঠাৎ এই প্রশ্ন!’

চঞ্চলবাবু একটু থতমত খেয়ে বললেন, ‘বিয়ের পর কী হবে তাই ভাবছি।’

সুতপাদেবী হেসে বললেন, ‘ওসব নিয়ে একদম ভেব না। শ্রীময়ীর শাশুড়ি খুব লিবারল মহিলা। আজকালকার মেয়েরা শাড়ি পরে পথে বেরোতে পারে নাকি? উনি নিজেও তো কাজে যান। তবে তোমার মেয়েকে শাড়ি পরলে খুব সুন্দর দেখায়। আজই জোর করে পরিয়েছিলাম। নীল রঙের শাড়িতে চমৎকার লাগছিল!’

চঞ্চলবাবুর বুকটা ধক করে উঠল। পরিতোষ চট্টোপাধ্যায় নীল রঙের শাড়ির কথাই বলছিলেন না?

রাতে অনন্যা ফোন করল। শ্রীময়ী নিজের ঘরে শুয়েছিল। তার পা ব্যথা করছে। মোবাইলটা কানে নিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে অনন্যাদি? এত রাতে!’

‘কিছু হয়নি। তুই কী করছিস? হবু বরের তপস্যা?’

শ্রীময়ী হেসে বলল, ‘তোমার মুন্ডু। কী হয়েছে বলো? অফিসে প্রবলেম?’

‘না, একটা মজার কথা বলতে ফোন করেছি। অনুভব খানিক আগে তোকে টিভিতে দেখেছে। নিউজে।’

শ্রীময়ী ধড়মড় করে উঠে বসল। হেসে বলল, ‘আমাকে! নিউজে! কী করছি? প্রাইম মিনিস্টারের সঙ্গে মিটিং করছি?’

অনন্যা বলল, ‘প্রায় সেরকমই। মিছিল করছিস।’

উত্তেজনায় খাট থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল শ্রীময়ী। বলল, ‘কী বলছ পাগলের মতো! আমি মিছিলে! অনুভবদার মাথাটা একেবারে গেছে গো।’

‘অনুভব বলল, তোর নাকি মুখের ক্লোজআপ দেখিয়েছে। ফিল্ম স্টারের কায়দায়। আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে হাঁটছিস।’

মাথায় বিদ্যুতের চমক দিল শ্রীময়ীর। নিশ্চয় বিকেলে মিছিলের আশপাশে কোথাও ফটোগ্রাফাররা ক্যামেরা বাগিয়ে ঘাপটি মেরে ছিল। মিছিলের লোক ভেবে ভুল করে তার ফটো তুলে ফেলেছে! খুব মজা পেল শ্রীময়ী। কাদের মিছিল হল, আর কার ফটো উঠল! সে চিৎকার করে বলল, ‘অনুভবদা ঠিক দেখেছে, আজ আমি অফিস কামাই করে মিছিল করেছি। মানছি না মানব না, আমাদের দাবি মানতে হবে। হি-হি।’ বলতে বলতে হাত শূন্যে ছুঁড়তে লাগল শ্লোগান দেওয়ার কায়দায়।

ডিনার টেবিলে হাসতে হাসতে বাবা-মাকে গল্পটা বলল শ্রীময়ী। চঞ্চলবাবু খাওয়া থামিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘ঘটনাটায় একটু সমস্যা হয়েছে।’

শ্রীময়ী হাসি থামিয়ে অবাক হয়ে বলল, ‘সমস্যা!’

‘কী মজার কাণ্ড দেখুন তো।’ হাসতে হাসতে বললেন চঞ্চল মৈত্র।

‘কোনটা মজার?’

চঞ্চলবাবু একটু থমকে বললেন, ‘না, মানে এই যে আজ খবরের কাগজে শ্রীময়ীর ফটো বেরিয়েছে…দেখেছেন নাকি?’

প্রশ্নটা করে চুপ করে গেলেন চঞ্চল মৈত্র। ওপাশ থেকে শান্তভাবে উত্তর এল, ‘হ্যাঁ, দেখেছি। দেখব না কেন? আগে বাড়িতে দুটো কাগজ নিতাম, রিটায়ার করার পর চারটে নিই। প্রায় সব কাগজেই তো আপনার মেয়ের ছবি রয়েছে।’

চঞ্চলবাবু গলায় উৎসাহ এনে, জোর করে হেসে বললেন, ‘আমি তো মেয়েকে বললাম, কিছু না করে কেমন ফেমাস হয়ে গেলি দ্যাখ। একেই বলে কপাল। হা…হা।’

ওপাশের গলা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘ফেমাস! রাস্তাঘাট আটকে কতগুলো গুন্ডা, বদমাইশ, বেকার হুলিগানিজম করছে, তাদের সঙ্গে ছবি ওঠাকে আপনি ফেমাস হওয়া বলছেন মিস্টার মৈত্র? স্ট্রেঞ্জ! খবরের কাগজে চোর-ডাকাতের ছবিও বেরোয়।’

সকালে খবরের কাগজ খুলেই চমকে উঠেছেন চঞ্চলবাবু। প্রথম পাতাতেই বড় করে শ্রীময়ীর ফটো। ফটোগ্রাফার কায়দা করে তুলেছে। মেয়েটার মুখ ঘামে চকচক করছে। রোদে পুড়ে গাল দুটো লাল। এলোমেলো ভাবে কিছু চুল এসে পড়েছে কপালের ওপর। বিধ্বস্ত, অথচ উজ্জ্বল মুখে একধরনের তেজি ভাব। নীল শাড়ির আঁচলটা এক হাতে শক্ত করে ধরা। ডান হাতটা তোলা রয়েছে আকাশের দিকে। ফটোর নীচে ক্যাপশন। সেটাও কায়দা করে লেখা—’মিছিলে এক প্রতিবাদী’। মেয়ের ফটো দেখে খানিকক্ষণ হতবাক হয়ে বসে ছিলেন চঞ্চলবাবু। তারপর দ্রুত হাতে ইংরেজি কাগজটাও টেনে নেন। সেখানেও রয়েছে। ভেতরের পাতায়। ফটো বড় না হলেও, দিব্যি চেনা যাচ্ছে। কাঁধে লম্বা ব্যাগ। মনে হচ্ছে কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। ফটোতে শ্রীময়ী মিছিলের এক রোগা-ভোগা ছেলের দিকে জলের বোতল এগিয়ে দিচ্ছে। দুজনের মুখেই হাসি। যেন অনেক দিনের চেনা। এখানে আবার ফটোর ওপরে বড় করে লেখা—’কোফাইটার’। সহযোদ্ধা।

কাগজদুটো হাতে নিয়ে পাথরের মতো বসে রইলেন চঞ্চল মৈত্র। কী করবেন? মেয়েকে ঘুম থেকে ডেকে তুলবেন? লাভ নেই। সে কী করবে? সে তো আর তার হবু শ্বশুরমশাইকে ফোন করে বলতে পারবে না—’এ সবই আকস্মিক। প্লিজ, আপনারা বিশ্বাস করবেন না। ফটোগ্রাফাররা ভুল করে আমার ফটো তুলেছে, কাগজওয়ালারা ছেপেওছে ভুল করে। আমি মিছিলে হাঁটিনি। বিশ্বাস করুন, আমি আমার বিয়ের জন্য শাড়ি কিনতে যাচ্ছিলাম। বিশ্বাস করুন.. প্লিজ।’

মেয়ের সঙ্গে নয়, স্ত্রীর সঙ্গে কথা বললেন চঞ্চল মৈত্র। খবরের কাগজগুলো দেখালেন। মেয়ের ফটো দেখে সুতপাদেবীর মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। তিনি স্বামীর হাত ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ‘কী হবে!’

চঞ্চলবাবু অভয় দেওয়ার জন্য বললেন, ‘তুমি নার্ভাস হচ্ছো কেন?’

‘ওরা যদি ভুল ভাবে?’

চঞ্চলবাবু সংশয়ভরা গলাতে বললেন, ‘তা কেন হবে? শিক্ষিত ফ্যামিলি চট করে ভুল বুঝবে কেন? কাল হঠাৎ দেখেছে বলেই ঘাবড়ে গিয়েছিল…বিষয়টা তো একই। টিভি নিউজের জন্য যেমন ফটো তুলেছে, খবরের কাগজওলারাও একই কম্ম করেছে। তুমি সেটাই বলবে। দেখবে খুব হাসাহাসি করবে।’

সুতপাদেবী সিঁটিয়ে গিয়ে বললেন, ‘আমি পারব না, তুমি বলো। এখনই ফোন করো। ওরা দেখার আগেই।’

সেই কারণেই সাতসকালে পরিতোষ চট্টোপাধ্যায়কে ফোন করা।

ভদ্রলোকের কথাবার্তার ধরন কঠিন থেকে ক্রমশ কঠিন হচ্ছে। চঞ্চলবাবু তাও চেষ্টা চালালেন। পাশেই চেয়ার টেনে বসে আছেন সুতপাদেবী। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ওপাশের কথা বোঝার চেষ্টা করছেন। পুরোটা না হলেও অনেকটাই বোঝাও যাচ্ছে। যত বোঝা যাচ্ছে, ভেঙে পড়ছেন।

‘মিস্টার চট্টোপাধ্যায় আপনি ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না।’

‘কী বুঝতে পারছি না? আপনার মেয়ে হাত তুলে মিছিলে শ্লোগান দিচ্ছে এটা বুঝতে পারছি না।’

চঞ্চলবাবু হতাশ ভঙ্গিতে বললেন, ‘শ্লোগান নয় মিস্টার চট্টোপাধ্যায়, শ্রীময়ী সম্ভবত ট্যাক্সি ডাকছিল। পাগলের মতো তখন একটা ট্যাক্সি খুঁজছিল সে।’

‘মিস্টার মৈত্র, সাতসকালে এসব ছেলেমানুষি ধরনের কথা না বললেই কী হয় না? ট্যাক্সি কি আমরা কোনওদিন ডাকিনি? তার জন্য কি আমাদের কখনও মিছিলের সঙ্গে হাঁটতে হয়েছে? এসব কথা কেন বলছেন? আপনি একজন জেন্টলম্যান। কাল বললেন, মেয়ে শাড়ি পরে না, আজ কাগজের ফটো কী বলছে?’

চঞ্চলবাবু স্ত্রীর দিকে তাকালেন। স্বামীর হাবভাবই বলে দিচ্ছে পরিস্থিতি খারাপ। তিনি আঁচল তুলে চোখ মুছলেন।

‘আসলে ওটা আমার একটু ভুল হয়ে গিয়েছিল। শ্রীময়ী কাল তার মায়ের কথা মতো শাড়ি পরেই বেরোয়।’

ফোনের ওপাশে পরিতোষ চট্টোপাধ্যায় একটু আওয়াজ করে হাসলেন। গা বেঁধানো হাসি। এই মানুষটা যে এমন বিশ্রী হাসতে পারে চঞ্চলবাবুর ধারণার মধ্যে ছিল না। কান মাথা ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল।

‘দেখুন মিস্টার মৈত্র, আপনি নানা রকম এক্সকিউজ তৈরি করছেন। করতে গিয়ে মিথ্যে জালে জড়িয়ে পড়ছেন। কাল আপনার কথা শুনে আমি খানিকটা বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম। রাতের নিউজ রাউন্ড আপে আমরা ফ্যামিলির সকলে মিলে বসে দেখেছি। তপোধীরও ছিল। আমরা সকলেই আপনার কন্যাকে চিনতে পেরেছি…।’ কথার মাঝখানে চঞ্চলবাবু কিছু বলতে গেলে পরিতোষ চট্টোপাধ্যায় ঠান্ডা গলায় বলেন, ‘লেট মি ফিনিশ। দেখুন, এমন নয় যে এই বয়েসের ছেলেমেয়েরা রাজনীতি করে না। অবশ্যই করে। বেশিই করে। আজকাল তো সরাসরি রাজনীতি না করলেও মিছিল-টিছিলে যাওয়া একটা ফ্যাশন হয়েছে। আপনার মেয়ে ছোট নয়, লেখাপড়া করা মেয়ে, সে ভালো বুঝেছে তাই মিছিল করেছে। হয়তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাষণও দেয়। এটা নিয়ে আপনার এই সংকোচ বা গোপনীয়তার কোনও অর্থ হয় না। তবে ভালোই হয়েছে, আপনি নিজে ফোন করেছেন, নইলে আমাকেই ফোন করতে হত। সরি মিস্টার মৈত্র, আমার বলতে খারাপ লাগছে…। ইন ফ্যাক্ট তপোধীরই বলেছে, একজন মিটিং-মিছিলে চিৎকার করা স্ত্রীর জন্য সে এখনই মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়…সো, প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।’

ফোন নামিয়ে ফ্যাকাশে মুখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন চঞ্চল মৈত্র। চাপা গলায় বললেন, ‘ওরা বিশ্বাস করল না, ওরা…।’

সুতপাদেবী ডুকরে কেঁদে উঠলেন, ‘এত বড় একটা ভুল… কিছুতেই হতে পারে না…আমি নিজে যাব। আমি নিজে গিয়ে কথা বলব…ওদের বলব, আপনারা খোঁজ নিন…মেয়ের পিছনে গোয়েন্দা লাগান, পাস্ট রেকর্ড দেখুন।’

‘ছি: মা, এসব কী বলছ!’

শ্রীময়ী যে বেশ খানিকক্ষণ হল ড্রইংরুমের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে চঞ্চলবাবু বা সুতপাদেবী জানতে পারেননি। সুতপাদেবী উঠে গিয়ে মেয়ের হাত ধরলেন। কাতর গলায় বললেন, ‘তুই একবার নিজে তপোধীরের সঙ্গে কথা বল। তুই ওর কাছে যা। গিয়ে বল একটা বড় ভুল হয়ে যাচ্ছে। ও নিশ্চয় বুঝতে পারবে।’

শ্রীময়ী সহজ ভাবে বলল, ‘ভুল তো আমরা করিনি, ওরা করেছে। আমরা কেন যাব? তাছাড়া এতক্ষণ বাবার টেলিফোনের কথা শুনতে শুনতে আর একটা কথা ভাবছিলাম।’

চঞ্চলবাবু বললেন, ‘কী?’

শ্রীময়ী শুকনো হেসে বলল, ‘যদি সত্যি আমি কাল ওই মিছিলে হাঁটতাম, তাহলেই বা কী? হোয়াটস রং?’

সুদর্শন তালুকদার রিসেপশনেই খবর দিয়ে রেখেছিলেন, শ্রীময়ী মৈত্র এলেই যেন তার সঙ্গে দেখা করে। কিন্তু তিনি নিজেই ফাস্ট হাফে অফিসে ঢুকতে পারেননি। কোথায় যেন মিটিঙে আটকে গিয়েছিলেন। পাঁচটার পর যখন এলেন তখন শ্রীময়ীর প্রজেক্টের কাজ শেষ।

ফুরফুরে মেজাজে সে কাজ করেছে। মেজাজ ভালো হয়ে যাওয়ার কারণ, অফিসে আসার পথে ট্যাক্সিতে বসে সে মোবাইলে তপোধীরকে ধরেছিল। নম্বরটা ক’দিন আগে তার মামাতো ভাই কোথা থেকে যেন জোগাড় করে মেসেজ করে পাঠিয়েছিল। বলেছিল, ‘এটা আমার পক্ষ থেকে তোকে প্রি ম্যারেজ গিফট।’ এই ভাইটি শ্রীময়ীর থেকে দু-বছরের ছোট। মজার ছেলে। নানা রকম পাকামো করে আত্মীয়মহলে জনপ্রিয়। কোনও কেরামতি করে তপোধীরের নম্বরটাও জোগাড় করেছে। সেই নম্বরে আজই প্রথম ফোন করল শ্রীময়ী। তপোধীর সঙ্গে সঙ্গেই ফোন ধরে। নাম শুনে হকচকিয়ে যায়। সে ফোনটা আশা করেনি। শ্রীময়ী সময় নষ্ট না করে দ্রুত বিষয়ে চলে আসে। সে দ্রুতই নিষ্পত্তি চাইছিল।

‘আপনারা ভুল বুঝেছেন। একবারে আকস্মিকভাবে গতকাল আমি একটা মিছিলের মধ্যে ঢুকে পড়ি। বাধ্য হই বলতে পারেন। কোইন্সিডেন্টালি তখন আমার ফটো তোলা হয়। আমি জানতেও পারিনি। আপনারা টিভি, নিউজপেপারে সেই ফটো দেখেছেন এবং ভেবেছেন মিছিলটায় আমি পার্টিসিপেট করেছি। হ্যালো, আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?’

তপোধীর বলে, ‘পাচ্ছি, আপনি বলুন।’

শ্রীময়ী ট্যাক্সির কাচ তুলে বাইরে আওয়াজ ঠেকাতে ঠেকাতে স্বর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে, ‘আপনারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এই ধরনের মেয়ের সঙ্গে…এই সিদ্ধান্তে কি আপনারও সায় আছে?’

তপোধীর একটু ভেবে বলল, ‘হ্যাঁ, আছে।’

শ্রীময়ী মৃদু হেসে বলল, ‘ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।’

কান থেকে ফোন নামিয়ে নম্বরটা ডিলিট করে ফেলল শ্রীময়ী। তারপর জানলার কাচ নামাতে নামাতে গুনগুন করে গান ধরল।

অনন্যা আজ আসেনি। শ্রীময়ীর বিয়ের ব্যাপারটা অফিসে শুধু সে-ই জানে। শ্রীময়ী মনে মনে ঠিকই করে রেখেছিল, তাকে সব বলে দেবে। বলবে, ভালোই হল। গোড়াতেই ধরা পড়ে গেল। যারা একবার এই ধরনের ভুল বোঝে, তারা যতই চমৎকার মানুষ হোক বারবার ভুল বুঝবে। খারাপ মানুষের সঙ্গে হয়তো থাকা যায়, কিন্তু ভুল বোঝা মানুষের সঙ্গে থাকা যায় না। অনন্যা না আসায় আজ বলা হল না। অফিসে কয়েকজন খবরের কাগজের ফটো নিয়ে মজা করে গেছে। দেবাংশু বলেছে, ‘খাওয়াবি কিন্তু। তুই এখন সেলিব্রিটি। গুরু তুমি কি সত্যি হাত তুলে শ্লোগান ঝাড়ো নাকি?’

শ্রীময়ী ভেবেছিল, বস প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলবে। বলল, মিছিল নিয়ে। ক্লান্ত, বিরক্ত শ্রীময়ীর প্রতিবাদও করতে ইচ্ছে করল না। সে মাথা নামিয়ে অপরাধীর মতো চুপ করে রইল।

‘পলিটিক্স তুমি করতেই পারো শ্রীময়ী। মিটিং বা র‌্যালিতেও জয়েন করতে পারো। ইটস ইওর ফান্ডামেন্টাল রাইট। কিন্তু প্রবলেম, ইজ দ্যাট আমাদের মতো অর্গানাইজেশন এটা অ্যালাও করে না। আমরা কাজে বিশ্বাস করি, পলিটিক্সে নয়। আমরা এমন ছেলেমেয়ে বেছে নিই, যাদের জীবন সম্পর্কে ধারণাটাই ডিফারেন্ট। আমাদের কাছে জীবনটা ডেস্কে, রাস্তায় নয়। আজকের ফটো দেখে আমি খুবই দু:খ পেয়েছি শ্রীময়ী। কাল তুমি আমাকে মিথ্যে বলে বেরিয়ে গেলে। দিস ইজ আনফেয়ার। ফটোতে দেখলাম, তুমি ওই র‌্যালিতে একজনকে জলের বোতল এগিয়ে দিচ্ছ। তোমার মুখে হাসি। ভেরি গুড। কিন্তু তোমাকে বেছে নিতে হবে। এটা আমার অ্যাডভাইজ এবং ওয়ার্নিং দুটোই।’

অফিস থেকে বেরিয়ে শ্রীময়ীর খেয়াল হল আকাশ মেঘে মেঘে ভরে গেছে। আহা! বৃষ্টি আসছে। ব্যাগের ভেতর মোবাইল বেজে উঠল। না ধরলে কেমন হয়? মোবাইলটা বের করে চোখের সামনে তুলে ধরল শ্রীময়ী। বাবা।

‘কী হয়েছে?’

‘একটা খারাপ খবর।’ চঞ্চল মৈত্রর গলা একটু কাঁপছে।

শ্রীময়ী থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কী খবর?’

‘থানা থেকে ফোন করেছিল। তোকে খুঁজছে।’

শ্রীময়ী অবাক গলায় বলল, ‘আমাকে খুঁজছে। কেন?’

চঞ্চল মৈত্র গলার উদ্বেগ কমাতে চেষ্টা করলেন। পারলেন না। বললেন, ‘আমি তো সেটাই জানতে চাইলাম। অফিসার ভদ্রলোক ভালো। সবটা বলছেন কাল নাকি কলকাতার কোনও একটা মিছিল শেষ হলে কিছু ছেলেমেয়ে গিয়ে পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করেছে। ইট ছোড়ে। তারপর পালিয়ে যায়। তাদের খোঁজ চলছে। খবরের কাগজ, টিভি থেকে পুলিশ মিছিলের ফটো জোগাড় করেছে। অনেকের সঙ্গে তোর ফটোও পেয়েছে। নাম-ঠিকানা-ফোন নম্বর সব বের করে ফেলেছে পুলিশ। তাই ফোন করেছিল। তোর সঙ্গে কথা বলতে চায়। মনে হয়, যারা ভাঙচুর করেছে তাদের চিনিস কিনা জানতে চাইবে। তুই এলে তোকে নিয়ে থানায় যাব।’

শ্রীময়ী শান্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি চিন্তা কোরো না বাবা। আমি থানা হয়ে ফিরব।’

শিরশিরে ঠান্ডা বাতাস বইছে। বৃষ্টি আসছে। শ্রীময়ীর দারুণ লাগছে। কাল এই সময় গরমে খুব কষ্ট হচ্ছিল, আজ চারপাশ ঠান্ডা। শ্রীময়ী দ্রুত পায়ে বড় রাস্তার মুখে পৌঁছোল। পৌঁছে থমকে গেল। আবার মিছিল! তবে কালকের মতো বড়, রাস্তা জোড়া নয়। এই মিছিল ক্ষীণকায়। জীর্ণ, মরা নদীর স্রোতের মতো ফুটপাথের গা ঘেঁষে চলেছে তির-তির করে। ভঙ্গিতে অবসন্ন, খানিকটা ভীতও যেন। সবাই শ্লোগানও দিচ্ছে নীচু গলায়। হঠাৎই শ্রীময়ীর মনে হল, মেঘ নেমে আসছে ঠিক মিছিলের ওপর। একটু পরেই সেখানেই বৃষ্টি নামবে। ছোটবেলার গল্পে শোনা নিশির ডাকের মতো কে যেন ডাক দিল! ফুটপাথ থেকে নেমে এলও শ্রীময়ী। মিছিলের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করল, আজও সে শাড়ি পরে এসেছে।

বৃষ্টি নামল মিছিল ভাসিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *