মিও আমোরে

মিও আমোরে

মন্দিরা মাইক্রোওভেনের দরজা খুলে পেস্ট্রি বের করে কাচের টেবিলের উপরে রাখতেই দোকানের কাচের দরজাটা খুলে গেল৷ একটা বছর আঠাশের ছেলে ঢুকে এল দোকানের ভিতরে৷ মন্দিরা সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে একটা কাগজের বাটিতে সাজিয়ে নিল পেস্ট্রিটা৷ তারপর সামনের বাচ্চাটার দিকে এগিয়ে দিল৷ বাচ্চাটা একবার মায়ের দিকে চেয়ে নিয়ে হাসি মুখে কামড় বসাল তাতে৷

এখন দুপুর৷ ঘড়ির কাঁটা দুটো পেরোতে চলেছে সবে৷ এ সময়ে দোকানে লোকজন তেমন আসে না৷ কেকের দোকানে ভিড় সাধারণত সকাল কিংবা সন্ধের দিকেই বেশি হয়৷ বেশিরভাগ সময়টাই হাঁ করে বসে কেটে যায়৷ মন্দিরা গল্পের বই আনে৷ কাস্টমার একেবারেই কমে এলে একটা প্রোফেসর শঙ্কু কিংবা ব্যোমকেশ সমগ্র খুলে ধরে মুখের সামনে৷ এই গল্পগুলো ছোটো থেকে পড়ে পড়ে মুখস্থ হয়ে গেছে ওর৷ তবু এখনও পড়তে ভালো লাগে৷

আজও কঙ্গো অভিযানের পাতায় মুখ ডুবিয়েছিল সে৷ এমন সময় একটা বছর দশেকের বাচ্চা স্কুলফেরত মাকে একরকম টেনে হিঁচড়েই নিয়ে এসে ঢোকাল দোকানে৷ মন্দিরার মনে হল ছেলেটা স্কুলের কোনও ইউনিট টেস্টে ভালো নম্বর হাঁকিয়েছে৷ কথামতো মায়ের তাকে পেস্ট্রি খাওয়ানোর কথা৷ সেই দেনাপাওনা বুঝে নিতেই মিও আমোরের দিকে টেনে এনেছে মাকে৷

মা-ছেলে দোকান থেকে বেরিয়ে যেতে যুবকটি এগিয়ে এল৷ এই মুহূর্তে দোকানের কাউন্টারে মন্দিরা ছাড়াও অন্য একটি কাউন্টারে সুরঞ্জনা বসে আছে৷ তবে সে চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা এঁটে ক্যাশবাক্সে কী যেন ঘাঁটাঘাঁটি করছে৷ তার কাছে গিয়ে লাভ হবে না বুঝতে পারল ছেলেটা৷ চারপাশে একবার সতর্ক দৃষ্টি হেনে মন্দিরার দিকে এগিয়ে এল৷ ব্যাপার কী? ছেলেটার চোখে মুখে এমন মার্জার সুলভ দৃষ্টি কেন?

‘দিদি, একটু কথা ছিল…’

একটু থমকায় মন্দিরা৷ দোকানে এসে সাধারণত সবাই কাচের আস্তরণ দিয়ে ঘেরা র‌্যাকের দিকে তাকিয়ে পছন্দের খাবার কিংবা কেক বেছে নেয়৷ এ ছেলেটা অন্য কিছু চায় তাহলে?

‘হ্যাঁ বলুন…’ মন্দিরা মুখ তুলে বলে৷

‘আমি একটা কেক কিনতে চাই…’

‘বেশ তো, বলুন কোনটা পছন্দ…’

ছেলেটার ইতস্তত ভাব বেড়ে যায়, শুকনো ঠোঁট চেটে নিয়ে সে বলে, ‘মানে… ঠিক নিজের জন্য কিনতে চাই না…’

ছেলেটার বোকামিতে হেসে ফেলে মন্দিরা, নরম গলায় বলে, ‘বার্থডে কেক কেউ নিজের জন্যে কেনে না৷ আপনি বরঞ্চ বেছে নিন, আমি…’

‘আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন না…’ আড়চোখে একবার পাশের চেয়ারে সুরঞ্জনার দিকে তাকিয়ে নেয় ছেলেটা, ‘আমি কেকটা কিনব, কিন্তু নিয়ে যাব না৷ নিয়ে যাবে অন্যজন…’

‘তাতেও অসুবিধা নেই, আপনার নাম বললেই…’

‘না-না আমার নাম বললে সর্বনাশ হয়ে যাবে…’ ঘাড় চুলকায় ছেলেটা, ‘আসলে ব্যাপারটা একটু ঘোরালো… আপনি একটু বাইরে আসবেন?’

আতান্তরে পড়ে মন্দিরা৷ শঙ্কুর কঙ্গো অভিযানটা ওকে টানছে৷ তাছাড়া আজ তাড়াতাড়ি বাড়িও ফিরতে হবে ওকে৷ ছেলেটা কেক কিনে চলে গেলে ওর হাতের কাজ কমে৷ সুরঞ্জনা এখনও টাকা গোনায় মশগুল৷

ও বাইরে বেরিয়ে আসে৷ মাথার চুল ঠিক করতে করতে বলে, ‘হ্যাঁ বলো ভাই, কী হয়েছে?’

ছেলেটা বুঝি এতক্ষণ মনের ভিতরে গুছিয়ে নিচ্ছিল কথাগুলো, চাপা স্বরেই বলল, ‘কেকটা যে নিতে আসবে সে জানবে না যে কেকের টাকাটা আমি দিয়েছি৷ আপনি শুধু তার কাছ থেকে টাকাটা নেবেন না৷ কিছু একটা ভুজুং ভাজুং দিয়ে ঘুরিয়ে দেবেন৷’

‘কিন্তু কেন?’

‘ওরা যদি জানে কেকের টাকাটা আমি দিয়েছি তাহলে নিতে চাইবে না৷’ এতক্ষণে খানিকটা পরিষ্কার হয় ব্যাপারটা৷ এক পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ভুরু তুলে ভারীক্কি গলায় মন্দিরা জিজ্ঞেস করে, ‘জন্মদিনটা কার?’

‘ঈশানীর৷ আমার… আমার…’

‘গার্লফ্রেন্ড?’

‘ছিল, ওর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে সামনের মাসে৷’ ছেলেটা প্রায় কেঁদে ফেলার উপক্রম করে৷

‘সেকি! তাহলে তোমার গার্লফ্রেন্ড হয় কী করে?’

‘আরে মহা মুশকিল তো…’ ছেলেটা প্রশ্নবাণে বিরক্ত হয়, ‘আমার সঙ্গে ব্রেকআপ হয়েছে নাকি? ওর নাটুকে বাবাটাই জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে৷ আমার গার্লফ্রেন্ড থেকে সিধে অন্য কারও বউ হয়ে যাচ্ছে, মাঝে কোনও স্টেজ নেই…’

‘তো মেয়েটি রাজি হল কেন?’

‘আর রাজি হল কেন…’ ছেলেটা বিড়বিড় করে কী যেন খিস্তি করে, ‘বাংলার যাত্রাপালার জন্য যদি কোনও অস্কার থাকত না, শালা তাতে আচ্ছা করে খাটি সরষের তেল মাখিয়ে ওই বুড়োর…’ কথাটা শেষ করতে গিয়েও সে থেমে যায়৷ সামলে নিয়ে বলে, ‘মেয়ে নিজের মতে বিয়ে করতে চলেছে শুনেই বুকের বাঁদিক খামচে লুড়কে গেল শুয়োর বাচ্চাটা… খাবি খেল, মেডিক্লেমের টাকায় হসপিটাল দৌড়াল, দু-দিন পেছন উলটে পড়ে থেকে মেয়ে সালটে নিয়ে ধুতি গুটিয়ে বাড়ি চলে এল৷ নেহাৎ গুরুজন বলে কিছু করিনি, নাহলে শালা ওর বাপের বিয়ে দেখিয়ে দিতাম…’

‘আপাতত ওর মেয়ের বিয়েটা দেখতে হবে তোমায়…’ মন্দিরা একটা বাঁকা হাসি হেসে বলে৷

ছেলেটা আচমকাই খামচে ধরে মন্দিরার হাতটা, ‘দশ বছরের রিলেশন দিদি, সেই বগলে চুল না গজানোর টাইম থেকে ও আমার গার্লফ্রেন্ড৷ ওপেনার বলতে শেওয়াগ, দাদা বলতে গাঙ্গুলি, হারামি বলতে গ্রেগ চ্যাপেল আর প্রেমিকা বলতে আমি ঈশানীকেই বুঝি, প্লিজ কিছু করুন…’

‘মহা মুশকিল! আমি কী করতে পারি?’ মন্দিরা পিছিয়ে আসে৷

ছেলেটা কবজির উলটো দিক দিয়ে নাক মোছে, ‘আজ ওর জন্মদিন৷ ওর বাপ-ভাই বা কেউ একটা আসবে বার্থডে কেক কিনতে৷ এ অঞ্চলে একটাই মিও আমোরে আছে৷ এখানেই আসবে৷ কেকের উপরে নাম লিখতে বললেই বুঝতে পারবেন কোনটা ওর কেক৷ আপনি শুধু একটু কায়দা করে টাকাটা নেবেন না… ব্যস এই আমার শেষ ইচ্ছা…’

ছেলেটা এমন করে কথাটা বলল যেন কাল সকালেই শববাহী গাড়ি বুক করা আছে৷

‘এতে আমার কী লাভ?’ মন্দিরা ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করে৷

ছেলেটা হঠাৎ উপরের দিকে আঙুল দেখায়, মন্দিরা থমকে যায়৷ স্বর্গলাভের লোভ দেখাচ্ছে নাকি? তারপর চেয়ে দেখে তার আঙুলটা তাগ করা আছে দোকানের উপরের সাইনবোর্ডটার দিকে৷ গড়গড় করে বলতে থাকে ছেলেটা, ‘মিও আমোরে মানে জানেন? ফলাও করে ভালোবাসার নামে দোকানের নাম রেখেছেন আর একজন ব্যর্থ প্রেমিককে সাহায্য করতে লাভ খুঁজছেন৷’ ভর্ৎসনা করে ছেলেটা৷

‘নাম কী তোমার?’ মন্দিরা এবার অন্য পায়ে ভর দিয়ে জিজ্ঞেস করে৷

‘পার্থ…’

‘তা দেখো ব্যর্থবাবু…’

‘আঃ, ব্যর্থ না, পার্থ…’

‘একই হল৷ তা দেখো ভাই আমি নাহয় লাভ দেখলাম না, কিন্তু টাকাটা আমি না নিতে চাইলে উনি তো সন্দেহ করতে পারেন, তখন কী হবে? তাছাড়া উনি কোন কেকটা পছন্দ করবেন সেটাও জানি না৷ বাকি টাকাটা আমি তোমাকে ফেরত দেব কী করে?’

ছেলেটা টুক করে পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে গুঁজে দেয় মন্দিরার হাতে, তাতে ফলাও করে লেখা আছে, ‘পার্থ বোস…’ তার নীচে লেখা আছে একটা মোবাইল নম্বর৷

‘কোন অসুবিধা হলেই কল করবেন আমাকে৷ যা টাকা বাকি থাকবে আমি কাল এসে নিয়ে যাব… প্লিজ দিদি…’

ব্যর্থ বোসের করুণ মুখের দিকে চেয়ে মন্দিরার মনটা একটু নরম হল৷ কপালের ঘাম মুছে বলল, ‘সে সব তো বুঝতে পারছি, কিন্তু আজ আবার মালিককে বলে একটু তাড়াতাড়ি ছুটির ব্যবস্থা করলাম, বোনের জন্মদিন আছে আজ৷ তোমার চক্করে যদি যেতে দেরি হয়ে যায়…’

‘কিচ্ছু দেরি হবে না৷ ওরা বিকেলের মধ্যেই এসে নিয়ে যাবে কেক…’

‘এই মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করতে পারবে না কখন কেক নিতে আসবে?’

ছেলেটার মুখের হাসিটা একেবারেই মিলিয়ে যায় এবার, ‘ওর সঙ্গে তো কথাই বলতে দিচ্ছে না দিদি, সাক্ষাৎ পাষণ্ড… ফোনটা অবধি কেড়ে নিয়েছে…’

হুট করে নিজের প্রেমের কথা মনে পড়ে যায় মন্দিরার৷ বছর সাতেক আগের কথা সেসব৷ তখনও প্রেম করার মতো বয়স ছিল ওর৷ অভাবের সংসারে মানুষ৷ মন্দিরার যখন উনিশ বছর বয়স তখন ওর বাবা মারা যায়৷ বাবার মারা যাবার কিছুদিনের মধ্যে বোনটারও থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ে৷ মন্দিরার একার ঘাড়েই বোন আর সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে৷ মা মাঝে সেলাই ফোড়াইয়ের কাজের চেষ্টা করেছিলেন কয়েক বছর৷ ধীরে ধীরে তাঁরও শরীর ভেঙে পড়ে৷

মন্দিরা কলেজের পড়াশোনা কোনও রকমে শেষ করেছিল৷ ছবি আঁকার হাত ছিল তার৷ সেসব নিয়েই পড়াশোনা করার ইচ্ছা ছিল৷ কিন্তু রোজগারের চিন্তায় সেসব আর হয়ে ওঠেনি৷ ওরও প্রেম ছিল একটা৷ বছর দুয়েক চলেছিল৷ শেষে মন্দিরাই একসময় বুঝতে পারল সে প্রেম পরিণত হবে না৷ মন্দিরার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয় এখনই৷ মা-বোন ওর মুখ চেয়েই বসে আছে৷ প্রেমটা ফিকে হতে হতে মিলিয়ে যায়৷ এখন এই ছেলেটার মুখের দিকে চেয়ে নিজের সাতবছর আগের সময়টার কথা মনে পড়ে যায়৷

অন্যদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে দশটা বেজে যায় তার৷ আজ তা হলে চলবে না৷ বোনটা পথ চেয়ে বসে থাকবে, মা পথ চেয়ে বসে থাকবে৷ বাড়ি ফিরেই ময়দা মাখতে বসবে৷ বোনটা লুচি খেতে ভালোবাসে৷ তবে মন্দিরা ঝটপট কাজ করতে পারে৷ সাড়ে চারটের মধ্যে বেরোলেই হবে৷

‘আচ্ছা বেশ, হয়ে যাবে কাজ… তুমি এসো এখন…’

মন্দিরার কথা শুনে পার্থ বোসের চোখে মুখে খুশির ঝিলিক খেলে যায়৷ সড়াৎ করে পকেট থেকে বের করে দুটো পাঁচশো টাকার নোট এগিয়ে দেয় সে৷ সেটা হাতে নিতে গিয়েও থমকে যায় মন্দিরা, ‘এই, আমাদের কেকের এত দাম না… অবশ্য বড়ো কেক লাগলে…’

পার্থ বোস হাত তুলে বলে, ‘রাবণের গুষ্টি দিদি, আর সব ক-টা মাক্কিচুস৷ ফোকটে খেতে পেলে ওরা মোষের গুও খাবে…’

‘তা এমন বাড়ির জামাই হওয়ার শখ তো তোমার কম ছিল না…’ টাকাটা আর কাগজটা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে পার্থ বোসের মুখের উপরে আর একবার চোখ বুলিয়ে নেয় সে৷

‘আমি তাহলে আসি এখন?’

‘এসো…’

ছেলেটা চলে যেতে সে দোকানের ভিতরে ঢুকে আসে৷ সুরঞ্জনা এতক্ষণ টাকা গুনে রেখে সমস্ত ব্যাপারটা কাচের ভিতর থেকে লক্ষ করছিল৷ সে ভুরু তুলে বলল, ‘ছেলেটা গল্প জুড়েছিল নাকি তোর সঙ্গে?’

‘গল্প বলে গল্প! সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার…’

‘কেমন ব্যাপার?’

মন্দিরা উত্তর না দিয়ে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যায়৷ সুরঞ্জনা ব্যাপার খানিকটা আঁচ করে৷ মুখ নামিয়ে নিয়ে বলে, ‘দেখিস বাবা, এসব ব্যাপারে গোলমাল হলে কাস্টমার ফাঁসবে না, তুই বাঁশ খেয়ে যাবি৷ এই বাজারে একবার চাকরি গেলে… এমনিতেই আজ হাফবেলা করেছিস বলে মালিক খচে আছে৷’

কথাটা মন্দিরা আগেও জানত৷ তাই আর উত্তর না দিয়ে নিজের কাউন্টারে এসে বসে পড়ে৷ সুরঞ্জনা মেয়েটা খারাপ নয়৷ তবে একটু বেশিই ভীতু প্রকৃতির৷ কথায় কথায় চাকরি চলে যাওয়ার ভয় দেখায়৷ মন্দিরার মনে হয় বসের সঙ্গে কোনও গোপন ষড় আছে ওর৷ মন্দিরা কাজে ফাঁকি-টাকি দিলে বা হিসেবে গোলমাল করলে সেই বসকে জানিয়ে দেয়৷

কঙ্গো অভিযানে আবার মন দেওয়ার চেষ্টা করে সে৷ কিন্তু মন বসে না৷ থেকে থেকে বোনের মুখটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে৷ রক্তশূন্য ফ্যাকাসে মুখ৷ চোখ দুটোও যেন মিইয়ে এসেছে৷ একমাত্র দিদির দিকে তাকালে সে চোখে হাসি ফুটে ওঠে৷ বাড়ি ফিরেই ওর বিছানায় গিয়ে বসে মন্দিরা৷ তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে৷ কতদিন হয়ে গেল ওর হাসির আওয়াজটা শুনতে পায়নি৷ কতদিন হল একসঙ্গে দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে পারেনি, মাঠে নেট টাঙিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলতে পারেনি৷

এই মিও আমোরের দোকানে কেকের গন্ধ, রংচঙে মোমবাতি আর এসির ঠান্ডা হাওয়াটাও ওকে শান্ত করতে পারে না৷ ফ্রেশ ক্রিম, রোজ আর রুম ফ্রেশনারের গন্ধ ফেলে ও বুক ভরে নিতে চায় একটা অসুস্থ মানুষের জমাট রক্ত আর ওষুধের গন্ধ৷

বোনের মতো আর কাউকে ভালোবাসে না মন্দিরা৷ ওর জন্যেই তো এতকিছু…. ঘড়ির কাঁটা দুপুর ফেলে রেখে এগোতে থাকে বিকেলের দিকে৷ সুরঞ্জনা কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে ওর বরের সঙ্গে গুজগুজ করে গল্প করে চলেছে৷ সামনের রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝেই রিক্সা পার হয়ে যাচ্ছে৷ তার সোজা হয়ে থাকে ছাউনির মাথায় সূর্যের আলো এক ঝিলিক পড়েই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে৷ একটু একটু করে বিকেল নামতে দেখলে কেমন খারাপ হয়ে যায় মনটা৷ কীসের জন্য যেন মন কেমন করে… বাড়ি ফেরার জন্যেই বুঝি৷

এর মাঝেও কেনাবেচা হয়েছে কিছু৷ তবে বার্থডে কেক নিতে আসেনি কেউ৷ ওটা আসে মূলত বিকেলের দিকে৷

চারটে বাজতেই উসখুস শুরু করে মন্দিরা৷ আর বড়জোর আধঘণ্টা দোকানে থাকতে পারবে সে৷ তারপর থাকলে ভীষণ দেরি হয়ে যাবে৷ তার মধ্যেও যদি ঈশানীর বাড়ির লোক না আসে? মন্দিরা অবশ্য চলে যেতেই পারে৷ কিন্তু পার্থ বোসের মুখটা মনে পড়লেই মায়া লাগে তার৷ আহা, ছেলেটা হয়তো এই শেষবার ওর বান্ধবীর জন্মদিনের কেক কিনতে পারবে৷ এরপর বিয়ে হয়ে গেলে আর দেখতেই পাবে না ওকে…

‘তুই এত ছটফট করছিস কেন বল তো?’ ওকে অনেকক্ষণ থেকেই লক্ষ করছে সুরঞ্জনা৷ এবার সে মুখ তুলে সন্দেহের গলায় বলে৷

‘একজনের আসার কথা আছে৷’

‘কে?’

‘ঈশানীর বাবার৷ ওই যে ছেলেটা বলে গেল…’

সুরঞ্জনা উত্তরটা ভালো করে বুঝতে পারে না৷ তাও আর কোন প্রশ্ন করে না সে৷ ইয়ারফোনের স্পিকারে আবার কী যেন গুজগুজ করতে থাকে৷ সত্যি বরের সঙ্গে কথা বলছে না মালিককে ফোন করেছে?

ঠিক চারটে বাইশ নাগাদ কাচের দরজাটা খুলে যায়৷ দু-জন ঢুকে আসে দোকানের ভিতরে৷ মন্দিরার মন বলে দু-জনের মধ্যে বছর বাইশের মেয়েটি ঈশানী৷ কারণ মেয়েটির চোখে মুখে একটা বিষণ্ণ ভাব, চোখের কোনায় না ঘুমিয়ে কালি পড়েছে৷ মুখটা নীচু করে আছে সে৷ বোঝা যাচ্ছে আজ দোকানে আসার ইচ্ছা তার একেবারেই ছিল না৷

সঙ্গের লোকটি সম্ভবত তার বাবা৷ ভদ্রলোক রাশভারী৷ একবার দেখলেই মনটা কেমন দুরুদুরু করে ওঠে৷ বিরাট মাংসাশী ফুলের মতো মুখ, নাকের ভিতর থেকে লম্বা লম্বা লোম বেরিয়ে আছে, কুমিরের মতো চেহারা, দেখে মনে হয় কসাইয়ের দোকানে ঢুকতে গিয়ে ভুল করে কেকের দোকানে ঢুকে পড়েছেন৷ ব্যর্থ বোসের এলেম আছে বলতে হবে৷ বিয়ে না হোক দশ-দশটা বছর এমন শ্বশুরের নাকের ডগায় প্রেম করে যাওয়াও চাট্টিখানি কথা নয়৷ কেবল শেষে এসে তরী ডুবেছে৷ মন্দিরার নিজেরই গলা শুকিয়ে আসে৷ লোকটা যদি কোনও রকমে জেনে যায়…

‘দেখ, দেখে নে কী কী নিবি৷ কোনটা পছন্দ…’ বাজখাঁই গলায় মেয়েকে কেক সিলেক্ট করতে বললেন ভদ্রলোক৷ মন্দিরার মনে হল একদিন এভাবেই খানদশেক ছেলের ছবি মেয়ের মুখের সামনে ধরে পাত্র নির্বাচন করতে বলেছিলেন হয়তো৷ সে যদি বলে কোনও কেকই তার পছন্দ নয়, সে যে কেকটা পছন্দ করেছে সেটা অন্য কোনও দোকানের সেকেন্ড র‌্যাকে রাখা আছে তাহলে না আবার বুক ধরে বসে পড়েন৷

ঈশানী মিনমিন করে, ‘শুধু কেক না, মা বলেছে মোমবাতি, ফোম, স্পার্ক আর…. আর…’

পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করে মেয়েটা৷ যা যা দরকার লিখে এনেছে সে৷ ‘যা নিবি বলে দে ওনাকে…’ কথাটা বলে একটা হাত তুলে মাথার উপরে রেখে দোকানটা খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন তিনি৷

মেয়েটা এই সুযোগে কাঁপাকাঁপা হাতে চিরকুটটা এগিয়ে দেয় মন্দিরার দিকে৷ ঘড়ির কাঁটা সাড়ে চারটে ছুঁয়েছে৷ কেক ছাড়াও আরও ফিরিস্তি আছে মেয়েটার৷ মন্দিরা প্রমাদ গোনে৷ দেরি হল বলে…

কাগজটা খুলে কিন্তু থ হয়ে যায় সে৷ কাগজে আদৌ জিনিসপত্রের নাম কিছুই লেখা নেই, তার বদলে কাগজের মধ্যে জড়ানো আছে দুটো পাঁচশো টাকার নোট৷ কাগজে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, ‘প্লিজ আমার বাবার কাছ থেকে টাকা নেবেন না৷ এই টাকাটা আমার প্রেমিকের৷ ওর সঙ্গে আমার বিয়ে হচ্ছে না৷ আমি চাই শেষবারের মতো আমার বার্থডে কেকটা ওই কিনে দিক…’

থতমত মুখ তুলে ঈশানীর দিকে তাকায় মন্দিরা৷ মেয়েটা ইশারায় কাগজের উলটোদিকটা দেখতে বলে ওকে৷ মন্দিরা দেখে কাগজের উলটো পিঠে লেখা আছে, ‘যদি তা না হয় আমি এই কেকে বিষ মিশিয়ে খেয়েই আত্মহত্যা করব…’ খ্যাঁক খ্যাঁক করে কাশির দমক আসে মন্দিরার৷ বিচ্ছিরিভাবে কেশে ফেলে সে৷ মেয়েটার মুখটা কঠিন হয়ে ছিল৷ সে জলের জগ এগিয়ে দেয় ওর দিকে৷

‘কীরে, এখনও পছন্দ করলি না কিছু? চাইছিসটা কী তুই?’ কুমিরের মতো বাবা গর্জে ওঠেন আবার৷

কাশিটা কোনওরকমে সামলে নেয় মন্দিরা, তারপর ফোনটা পকেট থেকে বের করে একটা নম্বর ডায়াল করতে করতে বলে, ‘ইয়ে আমি একটু আসছি, তুমি কেক পছন্দ করে নাও, কেমন?’ দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসেই ফোনটা কানে লাগিয়ে ফেটে পড়ে মন্দিরা,

‘হারামজাদা, অপদার্থ কোথাকার, তোমার জন্য আমি ফেঁসে গেলাম…’

‘আমি কী করলাম!’ ব্যর্থ বোস কাঁচুমাচু গলায় বলে, ‘ওর বাপ এসেছে দোকানে?’

‘বাপ কী কাকা আমি বুঝব কী করে?’

‘পাক্কা শুয়োরের বাচ্চার মতো দেখতে? তাহলে বাপ…’

‘চুপ করে থাকবে একদম৷ বাপের সঙ্গে মেয়েও এসেছে কেক সিলেক্ট করতে…’ ব্যর্থ বোসের গলা আবেগে কেঁপে যায়, ‘আপনার ফোনে ক্যামেরা আছে? যদি ওর একটা ছবি…’

‘তুমি এদিকে যা কেচিয়ে রেখেছ তাতে ও ছবিই হয়ে যাবে, আর আমি শালা জেলে যাব…’

‘সে কী! কেন?’

মন্দিরা নিঃশ্বাস চেপে বলে, ‘তুমি যা বলছিলে ও তাই বলছে৷ তোমার কী টাকা নাকি ওর কাছে রাখা আছে, সেটা নিতে বলছে…’

কী যেন ভাবে পার্থ, ‘আমার টাকা… ওর কাছে…’ হঠাৎ কী মনে পড়তে বলে, ‘আরে ওটা আমার টাকা নয়…’

‘তাহলে ও বলছে কেন তোমার টাকা…’ মন্দিরার মাথায় হঠাৎ অন্য একটা ভাবনার উদয় হয়, ‘বয়ফ্রেন্ড বলেছিল অবশ্য, তোমার নাম বলেনি, হতে পারে তুমি ছাড়া অন্য কোন…’

‘শাট আপ, মন বলে কিছু নেই আপনার? ও টাকাটা আসলে ওর বাপেরই, আমি মেরে দিয়েছিলাম…’ পার্থ বোসের গলায় অপরাধবোধ ঝিলিক মারে৷

‘মানে?’

‘উফফফ, মানে বলতে গেলে অনেক গল্প বলতে হয়৷ একসময় ওকে ফিজিক্স পড়াতাম আমি৷ তো স্পেশাল ক্লাসের নাম করে নলবনে গিয়ে চুমু খেতাম আর ওর বাপের থেকে স্পেশাল ক্লাসের জন্যে এক্সট্রা পেমেন্ট নিতাম৷ পরে বিবেকে লেগেছিল বলে টাকাটা ওকে দিয়ে দিয়েছিলাম জমা রাখার নাম করে…’

‘কী বেহায়া ছেলে মাইরি, লোকটার মেয়েটাকে চুমুও খাবে আবার পয়সাও নেবে, এসব জানতে পারলে তোমার শ্বশুর সত্যি হার্ট ফেল করত ভাই…’ কথাটা বলে মন্দিরা কপাল চাপড়ায়, ‘শালা নিজের বিয়ের মাচা বাঁধতে পারলে না বলে আমার পেছনে দিয়ে গেলে বাঁশগুলো… এবার আমি কী করব?’

‘বলুন দুটোই আমার টাকা, এটা কারেন্ট টাকা, ওটা ওর কাছেই রেখে দিক…’

‘বলব কী করে?

বাপ দাঁড়িয়ে আছে সামনে… এখন ওর টাকাটা যদি না নিই ও বাড়ি গিয়ে কেকে বিষ মেশাবে, যদি নিই তাহলে তোমার আর প্রেমিকাকে কেক খাওয়ানো হবে না… আর যদি ওর বাবার টাকা নিই…’

পার্থ বোস থতমত খায়৷ তারপর কান্নায় ভেঙে পড়ে, ‘দিদি আপনি ছাড়া আর কেউ নেই আমার৷’

‘ভাগ্যিস নেই, নইলে তার লাইফটাও হেল করে দিতে…’

ফোনটা কাটে না মন্দিরা৷ আবার গটগট করে দরজা দিয়ে ঢুকে আসে ভিতরে৷ ঘড়ির কাঁটা এই ঝামেলার মধ্যে পাঁচটার দিকে গড়িয়েছে৷

‘এই যে দিদি এই কেকটা…’ আঙুল দিয়ে কাচের ভিতর একটা কেক দেখায় ঈশানী৷

‘ওটাতেই বিষ মেশাবে?’ বিড়বিড় করে বলে মন্দিরা৷

‘অ্যাঁ! কী বললেন?’ কুমির মুখ ফেরান৷

‘না-না, কিছু না… আসলে…’ খাবি খায় মন্দিরা, ‘ইয়ে নামটা কী লিখব?’

‘ঈশানী…’

কাচের ভিতর থেকে কেকটা বের করে আনে সুরঞ্জনা৷ মন্দিরা যে ছটফট করছে সে বুঝতে পেরেছে৷ এর মধ্যে নাম লিখতে গেলে হাত কেঁপে যাবে৷ সেকেন্ডের কাঁটার খচখচ আওয়াজ হয়ে চলেছে৷ মন্দিরার কানের পাশ দিয়ে গরম হাওয়া বইতে থাকে৷ পকেট থেকে মানি ব্যাগ বের করে টাকা বের করেন কুমির, ‘কত হয়েছে আপনাদের?’

‘ন-শো টাকা…’

দুটো পাঁচশোর নোট এগিয়ে দেন তিনি মন্দিরার দিকে৷ মন্দিরা বুঝতে পারে দুটো কঠিন চোখের দৃষ্টি ছুঁয়ে আছে নোটদুটোতে৷ এদিকে ও নোটে হাত দেবে ওদিকে কেকের উপরে বিষের টপিংস পড়বে৷

‘ওই দেখুন দেওয়ালে কী…’ আচমকাই পেছনের দেওয়ালে আঙুল তুলে কী যেন দেখায় মন্দিরা৷ কুমির রিফ্লেক্স অ্যাকশনে সেদিকে তাকায়৷ সঙ্গে সঙ্গে হাতের দুটো নোট ঈশানীর দিকে বাড়িয়ে দেয় মন্দিরা৷ দ্রুত নোটদুটো নিয়ে ওর হাতে একটা একশো টাকার নোট গুঁজে দেয় ঈশানী৷ মুহূর্তে সেই একশো টাকার নোটটা কুমিরের দিকে বাড়িয়ে ধরে মন্দিরা, ‘আপনার চেঞ্জ…’

‘অ্যাঁ?’ ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারেন না কুমির, ‘কিন্তু সেতো আপনার হাতে৷ দেওয়ালে তো ঝুল ছাড়া কিছুই নেই…’

সুরঞ্জনার দিকে ফিরে চোখ পাকায় মন্দিরা, ‘কতবার মাসিকে বলেছি দেওয়ালে ঝুলগুলো পরিষ্কার করতে, রোজ ফাঁকি মারবে, রোজ… ননসেন্স…’

সুরঞ্জনা ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারে না৷ কিন্তু পরিস্থিতির চাপে সে কিছু বলেও না৷ একবার ঠোঁট চেটে মুখ নামিয়ে নেয়৷ কেক আর জিনিসপত্র গুছিয়ে নেয় মন্দিরা৷ প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ওরা বেরিয়েই যাচ্ছিল ঠিক এই সময় হঠাৎ কী যেন মনে পড়ে মন্দিরার৷ সে এগিয়ে এসে বলে,

‘ইয়ে স্যার… একটা কথা…’

কুমির ঘুরে তাকায় ওর দিকে, ‘কী হল?’

‘আমাদের একটা স্পেশাল অফার চলছে আজ, আপনি যে কেকটা নিয়েছেন তার সঙ্গে অন্য একটা কেক ফ্রি আছে৷’

ফোনটা টেবিলের উপরে রেখে এগিয়ে যায় মন্দিরা৷ সুরঞ্জনা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে ওর দিকে৷ চোখদুটো ছানাবড়া হয়ে গেছে ওর৷

‘ফ্রী! সে কী কেন?’

‘আজ আমাদের ইনোগোরেশন ডে তো…’

‘ইনোগোরেশন ডে!’ কুমিরের ভুরু কুঁচকে গেছে৷ ব্যাপারটা যেন কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না তার৷ সুরঞ্জনার দিকে ফিরে তাকান তিনি, ‘তাই নাকি?’

‘তাই নাকি!’ সুরঞ্জনাও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে৷

‘বেশ তাহলে ওটাও…’ হঠাৎ কী যেন চোখে পড়ে যায় ভদ্রলোকের৷ দু-জনের কথাবার্তার ফাঁকে ঈশানীর দিকে নজর দেয়নি কেউ৷ সেই সুযোগে সে এগিয়ে গেছে মন্দিরার ফোনটার দিকে৷ লকস্ক্রিনটা খুলে ফেলেছে সে, নিঃশব্দে কী একটা মেসেজ টাইপ করে চলেছে…৷

‘একী! তুই ফোন কোথেকে পেলি৷’ ভয়ংকর বাজ পড়ার শব্দ হল যেন৷ ঘরের কেকগুলো আর একটু হলেই চটকে যেত, ‘কাকে? কাকে মেসেজ করছিস তুই… ছিঃ ছিঃ ছিঃ…’

দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন কুমির৷ একহাতে তার চুলের মুটি খামচে ধরে সপাটে একটা চড় মারলেন গালে৷ শক্ত হাতের চড় খেয়ে ককিয়ে উঠল মেয়েটা৷ মন্দিরা কোনওরকমে আটকানোর চেষ্টা করল, ‘এ কী!

এখানে কী করছেন এসব! ছাড়ুন ওকে…’

মেয়ের কাঁধ ধরে টানতে লাগলেন তিনি, ‘চল তুই আজ বাড়ি, তোর একদিন কি আমার একদিন আজ… সব প্রেম ঘুচিয়ে দেব…’

টানতে টানতে মেয়েকে দোকানের বাইরে নিয়ে গেলেন ভদ্রলোক৷ মন্দিরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু তার আগেই রাস্তার উপরে গিয়ে পড়েছেন তাঁরা৷

একরকম ঘষটাতে ঘষটাতেই ঈশানীকে টেনে নিয়ে চলেছেন তিনি৷ মন্দিরা বুঝল বাধা দিয়ে লাভ নেই৷ ভদ্রলোকের মাথায় খুন চেপেছে…

‘বাপ রে বাপ!’ পেছন থেকে সুরঞ্জনার গলা শুনতে পেল মন্দিরা, ‘কী যে হল শালা কে জানে… আর তুই…’

ওর সামনে উঠে এসে প্রশ্ন করে চলেছে সুরঞ্জনা৷ কিন্তু মন্দিরার কানে সেসব কিছুই এখন ঢুকছে না৷ ঘড়ির কাঁটা সাড়ে পাঁচটার কাছে এখন৷ আজ আর লুচি বানানোর সময় পাবে না৷ বোনটা…

কিন্তু এবার কী হবে? যদি বিষ খেয়ে নেয় মেয়েটা? কী যে পাগলামি করতে গেল, মন্দিরা প্রায় গুটিয়েই এনেছিল ব্যাপারটা…

অস্থির হয়ে দোকানের সামনেই পায়চারি করতে থাকে সে৷ মাথাটা ভোঁ ভোঁ করতে থাকে৷ পার্থ বোসের কথায় বাজে ফাঁসা ফেসে গেল৷

পাঁচ মিনিট সেভাবেই পায়চারি করে মন্দিরা৷ ওর বুক ঢিপঢিপ করতে থাকে৷ মেয়েটার মুখ চোখ দেখে মনে হয় বিষ খেয়ে নেওয়া ওর পক্ষে মোটেই আশ্চর্য কিছু না৷ তাছাড়া মানুষ ঠিক কতটা ডেসপ্যারেট হলে অচেনা লোকের ফোন থেকে বাবার সামনে বয়ফ্রেন্ডকে মেসেজ করতে যায়৷ যেভাবেই হোক মেয়েটার বাড়ি অবধি কেকদুটো দিয়ে আসা দরকার৷ তাতে সে খানিকটা নরম হলেও হতে পারে… কিন্তু ঠিকানাটা?

ঘড়ির দিকে আবার দেখে নেয় মন্দিরা৷ আজ ট্যাক্সি ধরলেও সময়মতো বাড়ি পৌঁছাতে পারবে না৷ বোনটার জন্য সত্যি মন কেমন করতে শুরু করেছে ওর৷ ‘তুই একটু ম্যানেজ করে নে, তোকে সব বলব আমি, এখন সময় নেই…’ ফোনটা হাতে নিতে নিতে দ্রুত সুরঞ্জনার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে মন্দিরা৷ ওপাশ থেকে রিং-এর আওয়াজ হতেই কানে চেপে ধরে ফোনটা—

‘হ্যালো৷’

ওপাশ থেকে পার্থ বোসের গলা শোনা যায়৷ কী হয়েছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না৷

‘ঈশানীর ঠিকানা বলো, জলদি৷’

‘ঠি… ঠিকানা… মানে…’

‘হারি, তাড়াতাড়ি বলো, সময় নেই আমার হাতে৷’

‘কিন্তু কেকটা…’

‘কেকটা দেওয়ার এবং তোমার প্রেমিকার প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টাই হচ্ছে৷ আগে লোকেশনটা পাঠাও আমাকে৷’

পার্থ বোস আর বাক্যব্যয় করে না৷ মন্দিরার ওয়াটস্যাপে একটা লোকেশন আসে৷ জায়গাটা এখান থেকে খুব একটা দূরে নয়৷ কিন্তু বাড়ির লোক যদি জিজ্ঞেস করে ঠিকানা পেল কোথা থেকে? নাহয় কিছু একটা বানিয়ে বলে দেবে৷ মেয়েটা তো বাঁচুক আগে৷ সে দু-হাতে দুটো কেকের প্যাকেট তুলে নেয়৷ তারপর এক ছুটে বেরিয়ে আসে বাইরে৷

চারদিকে তাকিয়ে একটা রিক্সা চোখে পড়ে তার৷ ডাকতেই সেটা কাছে চলে আসে৷ মন্দিরা হাত বাড়িয়ে ফোনের লোকেশনটা দেখিয়ে দেয় রিকশাওয়ালাকে৷ তারপর কোনওরকমে দু-হাত সামলে উঠে পড়ে রিক্সায়৷

ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে টিকটিক করে৷ হয়তো বাড়ি নিয়ে গিয়ে মারধর করে একটা ঘরে বন্দি করে দিয়েছে ঈশানীকে৷ বিষ কি ওর কাছেই আছে? মিনিটদশেক পর একটা গলির মোড়ে মন্দিরাকে নামিয়ে দেয় রিক্সাটা৷ তারপর আবার হর্ন বাজাতে বাজাতে চলে যায় পেছন দিকে৷ মন্দিরার সমস্ত মুখে ঘাম জমেছে৷ মুছতেও পারছে না সেটা৷ দুটো হাতই বাঁধা পড়েছে৷ চারদিকে তাকিয়ে অসহায় লাগে মন্দিরার৷ খুব একটা বেশি বাড়িঘর নেই গলির ভিতরে৷ তবে একটা বিয়েবাড়ি আছে৷ সেটা সাজানো হচ্ছে৷ তার পাশেই একটা চারতলা আবাসন৷ একটা দুধসাদা বিড়াল ঘুমিয়ে রয়েছে তার গেটের সামনে৷ মন্দিরার মুখের দিকে চেয়ে জমিদারি কায়দায় একবার ম্যাও ডেকে আবার গোল হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল৷

লোকেশনটা ঠিক রাস্তার মোড়েই শেষ হচ্ছে৷ কিন্তু এরপর কী করবে? তখন উত্তেজনায় আর তাড়াহুড়োয় হুঁশ ছিল না মন্দিরার৷ কেকদুটো একটা পাঁচিলের উপরে রেখেই সে মুখ মুছে ফোনটা হাতে নেয়৷ ডায়াল করে পার্থ বোসের নম্বরটা৷ কিন্তু এবার তার উত্তেজনা আরও বেড়ে ওঠে… পার্থ বোসের নম্বর সুইচড অফ৷ মন্দিরার মনে হয় কেকদুটো এখানেই ফেলে পালিয়ে গেলে ভালো হত৷ কে মরল কে বাঁচল দেখে ওর কী লাভ? ওর বাড়ি যাওয়ার তাড়া আছে৷

 ‘আপনি কি আমাকে খুঁজছেন?’

পিঠে টোকা দিয়ে কে যেন ডাকল ওকে৷ চেনা গলার আওয়াজ৷ ঘুরে তাকাল সে৷ চমকে গেল৷ ব্যর্থ বোস দাঁড়িয়ে আছে ওর পেছনেই৷ মুখে মিচকে মিচকে হাসি৷

‘তুমি এখানে৷’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে মন্দিরা৷

পার্থ বোস৷

‘আমার বিয়ে আর আমি থাকব না! তা কী করে হয়?’

হাত উলটে ব্যঙ্গ করে ‘তোমার বিয়ে? কার সঙ্গে?’

‘কেন? আমার দশ বছরের প্রেমিকার সঙ্গে৷ হেঃ, পাত্র না হয়ে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র এই শর্মা নয়৷ অমন কত বাঘা বাঘা শ্বশুর নাকের তল দিয়ে গেল এল…’

কী যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারে না মন্দিরা,

‘তোমার ঈশানীর সঙ্গে বিয়ে তো তুমি এতক্ষণ নাটক করলে কেন?’

খিকখিক করে হেসে ওঠে ছেলেটা৷ তারপর একটা কেক হাতে তুলে নেয়, ‘আসুন, আসুন আমার সঙ্গে৷ মেলা দেরি হয়েছে৷ ওদিকে লোকজন বসে আছে আপনার জন্য…’

মন্দিরা কিছু প্রশ্ন করে না৷ তার মুখে কোনও কথা ফোটে না৷ ব্যর্থ বোসের বিয়ে? ঈশানীর সঙ্গে? যে ঈশানী বাপের কাছে এমন মারধর খেল এতক্ষণ তার বিয়ে? কী আশ্চর্য!

বিয়েবাড়িটার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসে সে৷ এবং উঠেই দ্বিতীয়বার চমকে যায়৷ সিঁড়ির ঠিক মুখেই দাঁড়িয়ে আছে সেই কুমিরের মতো দেখতে লোকটা৷ তার গাল ভরা হাসি৷ একটা হাত রাখা আছে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার কাঁধে, ঈশানী৷ তারও মুখে হাসি৷

অবাক হয়ে পার্থ বোসের মুখের দিকে তাকায় মন্দিরা৷ সে একটা অদ্ভুত হাসি হেসে বলে, ‘প্রতি বছর বোনের জন্মদিনটা একাই সেলিব্রেট করেন৷ আজ এতগুলো লোকের সঙ্গে করলেন না হয়… এই আর কী… আর কিছু নয়৷’

ঈশানী এগিয়ে এসে ওর হাতটা ধরে, ‘চলো চলো, কেক কাটা হবে, দেরি করে লাভ কী আর…’

অন্তত জনাপঞ্চাশেক লোক দাঁড়িয়ে আছে হল ঘরে৷ তার সবাই হাসিমুখে তাকিয়ে আছে মন্দিরার মুখের দিকে৷ যেন সবাই চেনে ওকে৷ সবাই জানে ওর কথা৷ কিন্তু এদের কাউকে চেনে না ও৷ কি হচ্ছে এসব? কী করতে চাইছে এরা? হলঘরের একটা প্রান্তে চোখে পড়তেই ও চমকে যায়৷ সেখানে একটা টেবিলের উপরে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা আছে একটা বাচ্চা মেয়ের ছবি৷ তার সামনে বেশ ক-টা রঙিন মোমবাতি৷ হাসছে ছবির মেয়েটা৷ এই মেয়েটাকে চেনে মন্দিরা৷ ভীষণ ভালো করে চেনে৷ সশরীরে এখানে থাকতে পারেনি মেয়েটা, থাকা সম্ভব নয়৷ আজ থেকে তিনবছর আগে মারা গেছে ও৷ তিনবছর ধরে নিজের ঘরে ছবির সামনে মোমবাতি জ্বালিয়ে কেক কেটে বোনের জন্মদিন পালন করে আসছে মন্দিরা৷

‘বিয়ে তো সবাই করে…’ ঈশানী ফিসফিসে গলায় বলে, ‘আমরা ভাবলাম আলাদা কিছু করি৷ তুমি বোনের জন্মদিনটা একা পালন করতে, আজ আমরাও না হয় থাকলাম তোমার সঙ্গে… ক্ষতি কী বলো?’

‘কিন্তু আমার বোনের কথা তোমরা জানলে কেমন করে?’

ওর হাত থেকে কেকের প্যাকেটটা নিয়ে সেটা খুলে টেবিলের উপরে রাখে ঈশানী৷ সঙ্গে সঙ্গে আবার চমকে যায় মন্দিরা৷ কেকের উপরে ঈশানীর নাম লেখা নেই৷ লেখা আছে অন্য একটা নাম, নূপুর৷

বিড়বিড় করে মন্দিরা, ‘কিন্তু এ কী করে সম্ভব! নামটা বদলে গেল কী করে? আমি তো ওই কেকটাই হাতে করে নিয়ে এলাম, ওতে তো ঈশানীর নাম…’

‘হাতে করে বয়ে এনেছিস, হাতে করে লিখেছিলিস কি?’

চেনা গলা ভেসে আসে পেছন থেকে৷ ফিরে তাকায় মন্দিরা৷ সুরঞ্জনা৷ সেও কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছে ওর পেছনে৷

‘ওদেরকে আমিই দিয়েছিলাম আইডিয়াটা৷ প্রতি বছর তুই একা একা কেক নিয়ে বাড়ি চলে যাস৷ আমার মন খারাপ করে ভীষণ… তাই এবার ভাবলাম…’

মন্দিরা কী বলবে বুঝে পায় না৷ কুমিরের মতো লোকটা একটা হাত রাখে ওর পিঠে৷ প্লাস্টিকের ছুরিটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে পার্থ আর ঈশানী ওর হাত চেপে ধরে৷

‘তোমাদের যে কী বলব…’ কথাটা বলতে গিয়েও গলা বুজে যায় ওর৷ ছবিতে বোনের হাসিমুখটা ঝাপসা হয়ে যায়৷ ওই মুখটার দিকে তাকালে এখনও দুঃখ হয় না মন্দিরার৷ এখনও বাড়ি ফিরলে রোজ দেখতে পায় বোনকে, রোজ ঘুমাতে যাওয়ার আগে হাত রাখে ওর কপালে, রক্তশূন্য হাত দিয়ে সমস্ত শক্তিতে শক্ত করে দিদিকে জড়িয়ে ধরতে চায় মেয়েটা৷ মন্দিরা আজও বিশ্বাস করে না ও নেই৷

পার্থ বোস ঠেলা দেয় ওকে, ‘দোকানের নামটা মনে আছে তো? আমার ভালোবাসা৷ আর ভালোবাসা জিনিসটা মোটেই চেপে রাখার জিনিস না৷ ছড়িয়ে দিতে হয়, কী বলো?’

হাততালির শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে ঘরটা৷ হাসির শব্দ ভেসে আসে কোথা থেকে৷ কেকের প্যাকেটটা এখনও পড়ে আছে টেবিলের উপরে৷ তাতে বেগুনির উপর সাদা দিয়ে দুটো শব্দ জ্বলজ্বল করছে এখনও…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *