মিঃ শাসমলের শেষ রাত্রি
মিঃ শাসমল আরাম কেদারাটায় গা এলিয়ে দিয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।
মোক্ষম জায়গা বেছেছেন তিনি—উত্তর বিহারের এই ফরেস্ট বাংলো। এর চেয়ে নিরিবিলি নিরাপদ নিরুপদ্রব জায়গা আর হয় না। ঘরটিও দিব্যি। সাহেবি আমলের মজবুত, সুদৃশ্য টেবিল চেয়ার সাজানো, প্রশস্ত খাটে বালিশ বিছানা তকতকে পরিষ্কার, ঘরের সঙ্গে লাগায়ো বাথরুমটিও বেশ বড়। পশ্চিমের জানালাটা দিয়ে ফুরফুরে বাতাস আসছে, আর সেই সঙ্গে আসছে ঝিঝির একটানা শব্দ। বিজলি না থাকলেও কোনও ক্ষতি নেই; কলকাতার লোড শেডিং-এ কেরোসিনের আলোয় পড়ার অভ্যাস হয়ে গেছে। বাংলোর আলোতে সাদা কাচের শেড থাকার ফলে তাঁর কলকাতার আলোর চেয়ে বেশি বলেই মনে হচ্ছে। সঙ্গে বই আছে—গোয়েন্দা উপন্যাস; মিঃ শাসমলের প্রিয় পাঠ্য।
এক চৌকিদার ছাড়া বাংলোয় অন্য কোনও বাসিন্দা নেই। অথাৎ আর কারুর মুখ দেখতে হবে না, কারুর সঙ্গে কথা বলতে হবে না। চমৎকার। কলকাতার ট্যুরিস্ট আপিসে গিয়ে দশদিন আগে থেকে বলে এসেছিলেন এই বাংলোর কথা; দিন চারেক আগে মিঃ শাসমল তাদের কাছ থেকে চিঠিতে জানেন যে ঘর বুক করা হয়ে গেছে। অন্তত তিনটে দিন এখানে থেকে তারপর অন্য কোথাও যাবার কথা ভাবা যাবে। সঙ্গে টাকা আছে যথেষ্ট; মাসখানেক চালিয়ে নেওয়া যাবে অক্লেশে। নিজের গাড়ি আছে সঙ্গে; স্বভাবতই তিনি নিজেই চালিয়ে এসেছেন এই সাড়ে পাঁচশো কিলোমিটার পথ।
চৌকিদার তার কথামতো সাড়ে নটায় ডিনার দিয়ে দিল। হাতের রুটি অড়হরের ডাল, একটা তরকারি আর মুরগির কারি। ডাইনিং রুমেও সাহেবি আমলের চিহ্ন রয়েছে। টেবিল, চেয়ার, চীনেমাটির পাত্র, বাহারের সাইনবোর্ড—সবই সেই কালের।
‘এখানে মশা আছে কি?’ খেতে খেতে প্রশ্ন করলেন মিঃ শাসমল। কলকাতায় যে অঞ্চলে তাঁর ফ্ল্যাট, সেখানে মশা নেই। আজ বছর দশেক হল মশারির অভ্যেসটা চলে গেছে। ওটা ব্যবহার না করতে পারলে আরো নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।
চৌকিদার জানাল যে শীতকালে মশা হয়, তবে এসময়টা অর্থাৎ এপ্রিলে, মশারির দরকার না হওয়ারই কথা। অবিশ্যি স্টকে আছে মশারি, সাহেবের দরকার হলে খাটিয়ে দেবে। চৌকিদার আরো বলল যে রাত্রে দরজা বন্ধ করে শোয়াই ভাল। চারিদিকে জঙ্গল; আর কিছু না হোক, শেয়াল-টেয়াল ঢুকে পড়তে পারে ঘরে! মিঃ শাসমল অবিশ্যি নিজেই ঠিক করেছিলেন যে দরজা বন্ধ রাখবেন।
খাওয়ার পর ডাইনিং রুম থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এসে হাতের টর্চটা জ্বালিয়ে জঙ্গলের দিকে ফেললেন মিঃ শাসমল। শাল গাছের গুঁড়ির উপর পড়ল আলো। তারপর আলোটা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখলেন কোনও জানোয়ার-জাতীয় কিছু দেখা যায় কি না। চোখে পড়ল না কিছুই। নিস্তব্ধ বন, ঝিঁঝি ডেকে চলেছে অবিরাম।
‘বাংলোয় ভূত-টুত আছে নাকি হে!’ হালকা ভাবে প্রশ্ন করলেন মিঃ শাসমল। চৌকিদার খাবার সরঞ্জাম তুলে নিয়ে তার ঘরের দিকে যাচ্ছিল, সে খালি একটু হেসে জানিয়ে দিল যে সে এখানে পঁয়ত্রিশ বছর আছে, বহু লোক এই বাংলোয় থেকে গেছে, কেউ কোনওদিন ভূত দেখেনি। কথাটা শুনে মিঃ শাসমল আরো খানিকটা হালকা বোধ করলেন।
ডাইনিং রুমের পর একটা ঘর ছেড়েই তাঁর নিজের ঘর। তাই আর খেতে যাবার সময় দরজাটা বন্ধ করেননি; ঘরে ঢুকে বুঝলেন বন্ধ রাখলেই ভাল ছিল। এই ফাঁকে কখন জানি একটা কুকুর ঢুকে পড়েছে। নেড়ি কুকুর। সাদার উপর বাদামি ছোপ, রুগ্ণ, হাড় বার করা চেহারা।
‘অ্যাই—ভাগ্, ভাগ্—নিকালো হিঁয়াসে!’
কুকুর ঘরের এক কোণে বসে আছে; ধমকে কোনও কাজ হল না। যেন এই ঘরেই রাত কাটাবে এমন একটা ভাব নিয়ে বসে রইল।
‘অ্যাই কুত্তা—ভাগ্, ভাগ্!’
এবারে কুকুরটা মিঃ শাসমলের দিকে দাঁত খিচিয়ে দিল।
মিঃ শাসমল দু’পা পিছিয়ে এলেন। ছেলেবেলায় যখন বেকবাগানে থাকতেন তখন একজন প্রতিবেশীর ছেলেকে পাগলা কুকুরে কামড়ায়; ফলে ছেলেটির হয় জলাতঙ্ক। মিঃ শাসমলের স্মৃতিতে সেটা একটা বিভীষিকার আকার ধারণ করে আছে। দাঁত খিঁচোনো কুকুরের দিকে এগোনোর হিম্মৎ তাঁর নেই।
আড় দৃষ্টি কুকুরের দিকে রেখে মিঃ শাসমল ঘর থেকে বারান্দায় বেরোলেন।
‘চৌকিদার।’
‘বাবু!’
‘একবার এদিকে এসো তো।’
চৌকিদার গামছা দিয়ে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এল।
‘আমার ঘরে একটা কুকুর ঢুকেছে; ওটাকে তাড়াও তো।’
‘কুত্তা?’—চৌকিদার যেন ভারী অবাক হয়েছে বলে মনে হল।
‘কেন, কুকুর নেই নাকি এ তল্লাটে? তুমি আকাশ থেকে পড়লে যে। ঘরে এসো, দেখিয়ে দিচ্ছি।’
চৌকিদার মিঃ শাসমলের দিকে একটা সন্ধিগ্ধ দৃষ্টি দিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকল।
‘কাঁহা হ্যায় কুত্তা, বাবু?’
মিঃ শাসমলও ঢুকলেন তার পিছন পিছন। সত্যিই তো, এই দু’মিনিটের মধ্যেই কুকুর ভেগেছে। তাও নিশ্চিন্ত হবার জন্য চৌকিদার খাটের তলা এবং পাশের বাথরুমটা দেখে নিল।
‘নেহি বাবু, কুত্তা নেহি হ্যায়।’
‘ছিল, চলে গেছে।’
মিঃ শাসমলের নিজেকে একটু বোকা বোকা লাগছিল। চৌকিদারকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে তিনি আবার আরাম কেদারাটায় বসলেন। প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটটা ক্যারমের খুঁটি মারার মতো করে জানালা দিয়ে ফেলে দিয়ে দু’হাত মাথার উপর তুলে আড় ভাঙতে গিয়ে দেখেন—কুকুর যায়নি, অথবা এরই মধ্যে কুকুর আবার ফিরে এসেছে, এবং সেই ভাবেই ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে আছে।
জ্বালাতনের একশেষ। রাত্তিরে তাঁর নতুন চটিটার দফারফা করবে। ফেলে রাখা চটির ওপর কুকুরের লোভের কথা মিঃ শাসমল জানেন। মেঝে থেকে বাটার চটিটা তুলে নিয়ে টেবিলের উপর রেখে দিলেন তিনি।
ঘরের একজন বাসিন্দা বাড়ল। এখন থাকুক, ঘুমোনোর আগে আরেকটা চেষ্টা দেবেন ব্যাটাকে বিদেয় করার।
মিঃ শাসমল হাত বাড়িয়ে টেবিলে রাখা এয়ারলাইনস ব্যাগটা থেকে গোয়েন্দা উপন্যাসটা বার করলেন। ভাঁজ করা পাতায় আঙুল ঢুকিয়ে যেই খুলতে যাবেন, অমনি তাঁর চোখ গেল কুকুরের কোণের বিপরীত কোণে। সেখানে কখন যে আরেকটি প্রাণী এসে আস্তানা গেড়েছে সেটা শাসমল আদৌ টের পান নি।
একটা বেড়াল। বাঘের মতো ডোরাকাটা বেড়াল। ঘোলাটে চোখ তাঁরই দিকে রেখে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে।
এরকম বেড়াল কোথায় দেখেছেন মিঃ শাসমল?
হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তাঁর বাড়ির পাশেই মুখুজ্যেদের সাতটা বেড়ালের একটা ছিল ঠিক ওইরকম দেখতে। একদিন রাত্রে—
ঘটনাটা মনে পড়ে গেল মিঃ শাসমলের।
মাস ছয়েক আগে একদিন রাত্রে বেড়ালের কান্নায় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল মিঃ শাসমলের। তখন মেজাজটা ভাল যাচ্ছিল না তাঁর। তাঁর অংশীদার অধীরের সঙ্গে তার আগের দিনই প্রচণ্ড বচসা হয়েছে—প্রায় হাতাহাতি। অধীর শাসিয়েছে পুলিশের কাছে তাঁর কারচুপি ফাঁস করে দেবে। সেই অবস্থায় ঘুম এমনিতেই ভাল হচ্ছিল না, তার উপর এই বেড়ালের কাঁদুনি। আরো আধ ঘন্টা এই কান্না শুনে আর থাকতে না পেরে একটা ভারী কাচের পেপারওয়েট তুলে নিয়ে কান্নার উৎস লক্ষ্য করে মিঃ শাসমল সজোরে নিক্ষেপ করেন। তৎক্ষণাৎ কান্না থেমে যায়। পরদিন সকালে মুখুজ্যেদের বাড়িতে হুলস্থূল কাণ্ড। তাদের সাধের হুলোকে মাঝরাত্তিরে কে যেন নৃশংসভাবে খুন করেছে। মিঃ শাসমলের খুব মজা লেগেছিল কথাটা শুনে। বেড়াল খুন! সেরকম দেখতে গেলে তো মানুষ হামেশাই খুন করছে। মনে পড়ল একবার—বহুদিন আগের ঘটনা, মিঃ শাসমল তখন কলেজে পড়েন, হস্টেলে থাকেন—ঘরের দেয়ালে পিঁপড়ের লম্বা লাইন দেখে, একটা খবরের কাগজের টুকরোয় দেশলাই ধরিয়ে সেই লাইনের এ-মাথা থেকে ও-মাথা জ্বলন্ত কাগজটা একবার বুলিয়ে দিতেই সব ক’টা পিঁপড়ে এক সঙ্গে মরে কুঁকড়ে দেয়াল থেকে ঝরে পড়েছিল মেঝেতে। পিঁপড়ে খুন!…
মিঃ শাসমল রিস্টওয়াচের দিকে চেয়ে দেখলেন দশটা বেজে দশ। মাস খানেক থেকে মাথায় একটা দপদপানি অনুভব করছিলেন তিনি; সেটা এখন আর নেই। আর মাথা গরম ভাবটা, যেটার জন্য তাঁকে দিনে তিনবার স্নান করতে হত, সেটাও আর বোধ করছেন না তিনি।
মিঃ শাসমল বইটা খুলে মুখের সামনে ধরলেন। দু’ লাইন পড়ে আবার চোখ চলে গেল বেড়ালটার দিকে। সেটা এরকম ভাবে চেয়ে রয়েছে কেন তাঁর দিকে?
নাঃ, একা থাকার বাসনা তাঁকে ত্যাগ করতে হল। অবিশ্যি মানুষ তো তিনি একাই; সেটাই ভরসা। রাত্রে এই দুই প্রাণী যদি উৎপাত না করে তা হলে ঘুম না হবার কোনও কারণ নেই। ঘুমটা খুবই দরকার। গত কয়েকটা দিন স্বাভাবিক কারণেই তাঁর ভাল ঘুম হয়নি। ঘুমের বড়ি খাওয়ার আধুনিক বাতিকটা তাঁর নেই।
মিঃ শাসমল টেবিল থেকে ল্যাম্পটা তুলে বিছানার পাশে ছোট টেবিলটায় রাখলেন। তারপর গায়ের জামা খুলে আলনায় টাঙিয়ে, ফ্লাস্ক থেকে এক গেলাস জল ঢেলে খেয়ে হাতে বই নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
পায়ের দিকে কুকুর। সেটা বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে, দৃষ্টি মিঃ শাসমলের দিকে।
কুকুর খুন?
মিঃ শাসমলের বুকের ভিতরে ধড়াস করে উঠল।
হ্যাঁ, তা এক রকম খুন বইকী। ঘটনাটা মনে পড়ে গেছে। বোধহয় তিয়াত্তর সাল। গাড়িটা তখন সবে কিনেছেন মিঃ শাসমল। চালক হিসাবে তিনি কিঞ্চিৎ ‘র্যাশ’। কলকাতার ভিড়ে স্পিড় তোলা সম্ভব নয়, তাই বোধহয় শহর থেকে বেরোলেই মিঃ শাসমলের স্পিডোমিটারের কাঁটা তরতরিয়ে উঠে যায় উপর দিকে। ৭০ মাইল স্পিড় না ওঠা পর্যন্ত তাঁর মন অতৃপ্ত থেকে যায়। সেই অবস্থায় একবার ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে কোলাঘাট যাবার পথে একটা নেড়ি কুকুর তাঁর গাড়ির তলায় পড়ে। সাদার উপর বাদামি ছোপ। মিঃ শাসমল তা সত্ত্বেও গাড়ির স্পিড কমাননি। যে কুকুর খেতে পায় না, যার পাঁজরার হাড় গোনা যায়, তার বেঁচে থেকে লাভ কী—এমন একটা ধারণা মনে এনে অপরাধবোধ লাঘব করতে চেষ্টা করেছিলেন এটাও মনে আছে।
কিন্তু এই স্মৃতিই তাঁর মনের নিরুদ্বেগ ভাবটাকে একেবারে তছনছ করে দিল।
জীবনে যত প্রাণী হত্যা করেছেন তিনি তার সবগুলোই কি আজ এই ঘরে এসে হাজির হবে নাকি? সেই যে সেই প্রথম পাওয়া এয়ার গান দিয়ে মারা কুচকুচে কালো নাম-না-জানা পাখি আর সেবার সেই ঝাড়গ্রামে মামাবাড়িতে থান ইট দিয়ে—
হ্যাঁ, সেটাও এসেছে।
জানালার দিকে চোখ যেতেই মিঃ শাসমল সাপটাকে দেখতে পেলেন। হাত চারেক লম্বা একটি গোখরো। তার মসৃণ দেহটা জানালা দিয়ে ঢুকে দেয়ালের সংলগ্ন টেবিলটার উপর উঠেছে। এপ্রিল মাসে সাপ বেরোয় না; কিন্তু সাপ বেরিয়েছে।
সাপের তিন ভাগের দুই ভাগ রয়ে গেল টেবিলের উপর। বাকি এক ভাগ টেবিল ছেড়ে উঁচিয়ে উঠল ফণা তোলার ভঙ্গিতে। ল্যাম্পের আলোয় জ্বলজ্বল করছে তার নির্মম, নিষ্পলক দুটি চোখ।
ঝাড়গ্রামে তাঁর মামাবাড়িতে ঠিক এমনই একটা গোখরোর মাথা থেঁতলে দিয়েছিলেন মিঃ শাসমল থান ইঁট মেরে। সেটা ছিল নাকি বাস্তুসাপ, কারুর কোনও অনিষ্ট করেনি কোনওদিন।
মিঃ শাসমল অনুভব করলেন তাঁর গলা একদম শুকিয়ে গেছে। চেঁচিয়ে যে চৌকিদারকে ডাকবেন তার কোনও উপায় নেই।
বাইরে ঝিঝির ডাক থেমে গিয়ে চারিদিকে এক অপার্থিব নিস্তব্ধতা। হাতঘড়ির কোনও শব্দ নেই, না হলে সেটা শোনা যেত। একবার মিঃ শাসমলের মনে হল তিনি হয়তো স্বপ্ন দেখেছেন। সম্প্রতি দু-একবার এরকম হয়েছে। নিজের ঘরে নিজের খাটে শুয়ে হঠাৎ মনে হয়েছে তিনি যেন অন্য কোথাও রয়েছেন, ঘরে অচেনা লোকজন চলাফেরা করছে, অস্ফুট স্বরে কথা বলছে। কিন্তু সেটা কয়েক মুহূর্তের জন্য। ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগের মুহর্তে বোধহয় এরকম হয়। এও একরকম স্বপ্ন, যদিও পুরোপুরি স্বপ্ন নয়।
আজ অবিশ্যি স্বপ্ন দেখেছেন না তিনি। নিজের গায়ে চিমটি কেটে বুঝেছেন তিনি জেগেই আছেন। যা ঘটেছে তা সত্যিই তাঁর চোখের সামনে ঘটেছে, এবং তাঁকে দেখানোর জন্যই ঘটছে।
আরো ঘণ্টা খানেক এই ভাবে শুয়ে রইলেন মিঃ শাসমল। ইতিমধ্যে মশা ঢুকেছে ঘরে। কামড় তিনি অনুভব করেননি এখনও, কিন্তু তারা যে আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে সেটা চোখে দেখে এবং কানে শুনে বুঝছেন। কত মশা মেরেছেন তিনি জীবনে তার কি হিসেব আছে?
শেষ পর্যন্ত প্রাণীদের দিক থেকে উৎপাতের কোনও ইঙ্গিত না পেয়ে মিঃ শাসমল খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করলেন! এবার ঘুমোনোর চেষ্টা দিলে কেমন হয়?
ল্যাম্পটা কমানোর জন্য হাত বাড়াতেই বাইরে থেকে একটা শব্দ এল। বাংলোর গেট থেকে বারান্দার সিঁড়ি পর্যন্ত পথটা নুড়ি দিয়ে ঢাকা। সেই পথ দিয়ে কেউ হেঁটে আসছে।
চতুষ্পদ নয়, দ্বিপদ।
এবারে মিঃ শাসমল বুঝলেন তাঁর সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে আসছে, আর তাঁর হৃৎস্পন্দনের শব্দ তিনি নিজের কানে শুনতে পাচ্ছেন।
বেড়াল কুকুরের দৃষ্টি এখনও তাঁর দিকে। মশা গান গেয়ে চলেছে তাঁর কানের পাশে। গোখরোর ফণা এখনও তোলা; কোনও অদৃশ্য সাপুড়ের অশ্রুত বাঁশির তালে তালে যেন সেই ফণা দুলছে।
পায়ের শব্দ এবার বারান্দায়। এগিয়ে আসছে।
ফুরুৎ করে একটা কুচকুচে কালো পাখি জানালা দিয়ে ঢুকে টেবিলে বসল। এই সেই পাখি—তাঁর এয়ার গানের গুলি খেয়ে যেটা পাঁচিল থেকে টুপ্ করে পড়েছিল পাশের বাড়ির বাগানে।
পায়ের শব্দ তাঁর ঘরের দরজার বাইরে থামল।
মিঃ শাসমল জানেন কে এসেছে। অধীর। অধীর চক্রবর্তী। তাঁর পার্টনার। এককালে বন্ধু ছিল, কিন্তু সম্প্রতি পরস্পরে প্রায় কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মিঃ শাসমলের ব্যবসায়িক কারচুপি অধীরের পছন্দ হয়নি। তাঁকে শাসিয়েছিল পুলিশে ধরিয়ে দেবে বলে। মিঃ শাসমল উলটে বলেছিলেন—ব্যবসার ক্ষেত্রে সিধে রাস্তাটা হল মূর্খের রাস্তা। অধীর সেটা মানেনি। এটা আগে জানা থাকলে কখনই তাকে অংশীদার করতেন না মিঃ শাসমল। তিনি বুঝেছিলেন অধীর তাঁর পরম শত্রু। শত্রুর শেষ রাখতে নেই। শেষ রাখেননি মিঃ শাসমল। গতকাল রাত্রে অধীরেরই বৈঠকখানায় দুজনে মুখোমুখি বসেছিলেন। মিঃ শাসমলের পকেটে রিভলভার। খুনের অভিপ্রায় নিয়েই এসেছেন তিনি। মাত্র চার হাত দূরে বসে অধীর। অধীরের গলা যখন ভর্ৎসনার সপ্তমে চড়েছে, তখন রিভলভার বার করে গুলি চালান মিঃ শাসমল। তাঁর হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখে এককালের বন্ধু অধীর চক্রবর্তীর মুখের অবস্থা কী হয়েছিল সেটা ভাবতে হাসি এল মিঃ শাসমলের। খুনটা করার দশ মিনিটের মধ্যেই তিনি গাড়িতে বেরিয়ে পড়েন। রাতটা বর্ধমান স্টেশনের ওয়েটিং রুমে কাটিয়ে আজ সকালে এই দশ দিন আগে রিজার্ভ করা বাংলোর উদ্দেশে রওনা দেন।
দরজায় আঘাত পড়ল। একবার, দু’বার, তিনবার।
মিঃ শাসমল চেয়ে আছেন দরজার দিকে। তাঁর সর্বাঙ্গে কাঁপুনি ধরেছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে।
‘দরজা খোল, জয়ন্ত। আমি অধীর। দরজা খোল।’
যাকে তিনি গতকাল রাত্রে খুন করে এসেছেন, এই সেই অধীর। একটা কারণে তাঁর মনে সন্দেহ ছিল খুনটা ঠিক হয়েছে কি না, কিন্তু এখন আর সন্দেহ নেই। ওই কুকুর, ওই বেড়াল, ওই সাপ, ওই পাখি—আর এখন দরজার বাইরে অধীর। সবাই যখন এসেছে মৃত্যুর পরে, তখন অধীরও আসবে এটাই সঙ্গত।
আবার দরজায় ঘন ঘন করাঘাত।
মিঃ শাসমলের দৃষ্টি ঝাপসা, কিন্তু তিনি দেখতে পাচ্ছেন কুকুরটা তাঁর দিকে এগোচ্ছে, বেড়ালের চোখ তাঁর নিজের চোখের এক হাতের মধ্যে, সাপটা টেবিলের পায়া বেয়ে মেঝেতে নামছে তাঁরই দিকে এগোবে বলে, পাখিটা এসে তাঁর খাটের উপর বসল, তাঁর বুকে গেঞ্জির ওপর অজস্র পিঁপড়ে এসে হাজির হয়েছে…
শেষ পর্যন্ত দুই কনস্টেবলের ঠেলায় দরজা ভাঙল।।
অধীরবাবুই পুলিশ নিয়ে এসেছেন কলকাতা থেকে। মিঃ শাসমলের কাগজপত্র থেকে টুরিস্ট ডিপার্টমেন্টের একটা চিঠি বেরোয়; এই বাংলো রিজার্ভ করার খবর ছিল তাতে।
ঘরে ঢুকে মিঃ শাসমলকে মৃত অবস্থায় দেখে ইনস্পেক্টর সামন্ত অধীরবাবুকে জিগ্যেস করলেন তাঁর পার্টনারের হার্টের ব্যারাম ছিল কি না। অধীরবাবু বললেন, ‘হার্টের কথা জানি না, তবে ইদানীং ওর মাথাটা গোলমাল করছিল। যে ভাবে টাকা এদিক-ওদিক করেছে, আমাকে যে ভাবে ঠকিয়েছে, সেটা সুস্থ-মস্তিষ্ক লোকের পক্ষে সম্ভব নয়। অবিশ্যি ওর হাতে রিভলভার দেখে সে ধারণা আরো বদ্ধমূল হয়। সত্যি বলতে কী, ও যখন ওটা বার করল পকেট থেকে, তখন আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি। ও গুলি মেরে পালানোর পর দশ মিনিট লেগেছিল আমার সংবিৎ ফিরে পেতে। তখনই ঠিক করি এই উন্মাদকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে। আমি যে খুন হই নি, সেটা নেহাতই দৈবক্রমে।’
মিঃ সামন্ত ভ্রূকুঞ্চিত করে বললেন, ‘কিন্তু এত কাছ থেকে আপনাকে মিস্ করলেন কী করে?’
অধীরবাবু মৃদু হেসে বললেন, ‘কপালে মৃত্যু না থাকলে আর মানুষ কী করে মরে বলুন! গুলি তো আমার গায়ে লাগেনি। লেগেছিল আমার সোফার গায়ে। অন্ধকারে লক্ষ্যভেদ করার ক্ষমতা আর ক’জনের থাকে? রিভলভার বার করার সঙ্গে সঙ্গে যে আমার পাড়ায় লোড শেডিং হয়ে যায়!’